[দ্বিতীয় পর্ব]
রামমোহন লিখেছেন সম্বাদ, তিনি তাঁর প্রতিপাদ্য উপস্থাপন করেছেন পুরোনো দার্শনিক সংলাপের কাঠামোতে; বিদ্যাসাগর লিখেছেন প্রস্তাব, তিনি সরাসরি লড়াইয়ে নেমেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে। রামমোহনের সময় বাঙলা গদ্যের, এবং রামমোহন নিজের বাঙলা গদ্যোর, যে-অবস্থা ছিলো, তাতে বিদ্যাসাগরের মতো সরাসরি তীব্র গবেষণাধর্মী প্ৰস্তাব লেখা সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে: তাই তিনি প্রবর্তক-নিবর্তকের বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রতিপাদন করেছেন যে শাস্ত্রে রয়েছে বিধবার বেঁচে থাকার বিধান।
শুধুই বেঁচে থাকা, এর বেশি নয়; বিধবা বেঁচে থেকে পালন করবে ব্ৰহ্মচর্য, আর কিছু নয়। রামমোহনের প্রবর্তক হচ্ছে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের উনিশশতকী দেশাচারগ্রস্ত রূপটি, যেটি দুর্বল হয়ে পড়েছিল সব দিকে, এবং রামমোহন তাকে করেছেন দুর্বল থেকে দুর্বলতর। রামমোহন প্রবর্তকের মুখে দিয়েছেন শাস্ত্রের পুরোনো সমস্ত কথা; নিবর্তকের মুখে দিয়েছেন শাস্ত্রের সাথে মানবতাবাদী যুক্তি, যার আক্রমণে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে প্রবর্তক। সম্বাদ-এর শুরুতেই রামমোহন (১৮১৮, ১৬৯) প্রবর্তকের সংলাপে পেশ করেছেন। পুরোনো সংস্কার :
স্বামী মরিলে পর যে স্ত্রী ঐ পতির জ্বলন্ত চিতাতে আরোহণ করে সে অরুন্ধতী যে বশিষ্ঠের পত্নী তাহার সমান হইয়া স্বর্গে যায়। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন করে সে মনুষ্যের দেহেতে যত লোম আছে যাহার সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি তত বৎসর স্বৰ্গে বাস করে। আর যেমন সৰ্পগ্রাহকেরা আপন বলের দ্বারা গৰ্ত্ত হইতে সর্পকে উদ্ধার করিয়া লয় তাহার ন্যায় বলের দ্বারা ঐ স্ত্রী স্বামীকে লইয়া তাহার সাহিত সুখ ভোগ করে। আর যে স্ত্রী ভৰ্ত্তার সহিত পরলোকে গমন কবে সে মাতৃকুল পিতৃকুল এবং স্বামিকুল এই তিনি কুলকে পবিত্র করে।
আর অন্য স্ত্রী হইতে শ্ৰেষ্ঠ এবং শ্ৰেষ্ঠ ইচ্ছাবতী আর স্বামীর প্রতি অত্যন্ত শ্ৰদ্ধাযুক্ত যে ঐ স্ত্রী সে পতির সহিত তাবৎ পৰ্যন্ত স্বর্গ ভোগ করে যাবৎ চতুৰ্দশ ইন্দ্ৰপাত না স্থায়; আর পতি যদি ব্ৰহ্মহত্যা করেন। কিম্বা কৃতঘ্ন হয়েন কিম্বা মিত্রহত্যা করেন তথাপি ঐ পতিকে সৰ্ব্বপাপ হইতে মুক্ত করে ইহা অঙ্গিরামুনি কহিয়াছেন। স্বামী মরিলে সাধী স্ত্রী সকলের অগ্নি প্ৰবেশ ব্যতিরেকে আর অন্য ধৰ্ম্ম নাই।
প্রবর্তক গ্ৰহণ করেছে। হারীত, অঙ্গিরার মত; রামমোহন গ্ৰহণ করেছেন। মনুর মত। রামমোহন বারবার যে-শাস্ত্ৰবাক্যটির হাতুড়ি পিটিয়েছেন, সেটি মনুর : ‘স্ত্রীলোক পতির কাল হইলে পর ব্ৰহ্মচয্যের দ্বারা মোক্ষ সাধন করিবেন।’ রামমোহন ও বিদ্যাসাগরের ভাগ্য ভালো যে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র পরস্পরবিরোধী বিধানের সমষ্টি; ওই পরস্পরবিরোধী বিশাল ভাণ্ডার থেকে বচন উদ্ধার ক’রে যে-কোনো কিছুকে শাস্ত্রসম্মত বলে প্রমাণ করা সম্ভব, অপ্রমাণও সম্ভব।
রামমোহনের আশ্রয় মনু, যে-মনু নারীকে বহু তিরষ্কার ক’রে একটিমাত্র কৃপা করেছিলেন : ব্ৰহ্মচর্য পালন ক’রে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছিলেন দ্র। ‘দেবী ও দানবী’, ‘পিতৃতন্ত্রের খড়গ’]। রামমোহন স্বীকার করেছেন শাস্ত্ৰে সহমরণের বিধান রয়েছে, কিন্তু তিনি নির্ভর করেছেন বিকল্পবিধানের ওপর। তিনি (১৮১৯, ১৯০) শাস্ত্ৰবাক্যকে ব্যাকরণবিদ-যুক্তিশাস্ত্রীর মতো ভেঙে ভেঙে বের করেছেন বিকল্প বিধানটি :
পতি ১ মরিলে ২-ব্ৰহ্মচৰ্য্য ৩ অথবা ৪ সহগমন ৫। অতএব ব্ৰহ্মচর্য্যের প্রথম গ্রহণ দ্বারা ব্ৰহ্মচৰ্য্য বিধবার শ্রেষ্ঠ ধৰ্ম্ম হয়।
বিধবার সহমরণও রামমোহন মেনে নিতে প্ৰস্তুত ছিলেন, যদি তা স্বেচ্ছাসহমরণ হয়। নিবর্তক (১৮১৮, ১৭৩) প্রশ্ন করেছে : ‘তোমাদের রচিত সংকল্পবাক্যেতে স্পষ্ট বুঝাইতেছে যে পতির জ্বলন্ত চিতাতে স্বেচ্ছাপূৰ্ব্বক আরোহণ করিয়া প্ৰাণ ত্যাগ করিবেক কিন্তু তাহার বিপরীত মতে তোমরা অগ্রে ঐ বিধবাকে পতিদেহের সহিত দৃঢ় বন্ধন কর পরে তাহার উপর এত কাষ্ঠ দেও যাহাতে ঐ বিধবা উঠিতে না পারে।’ তিনি স্বেচ্ছাসহমরণ মেনেছেন, কেননা তিনি জানতেন অধিকাংশ নারী স্বেচ্ছাসহমরণে যায় না। বা যাবে না; তাদের বাধ্য করা হয় সহমরণে।
প্রবর্তক সহমরণ চায় কলঙ্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্যে, তার কাছে নারী হচ্ছে সম্ভাব্য কলঙ্ক। প্রবর্তকের (১৮১৮, ১৭৪) মতে, ‘স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচার হইবার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সহমরণ করিলে এ আশঙ্কা থাকে না জ্ঞাতি কুটুম্ব সকলেই নিঃশঙ্ক হইয়া থাকেন এবং পতিও যদি জীবৎকালে জানিতে পারে তবে তাহারো মনে স্ত্রীঘটিত কলঙ্কের কোনো চিন্তা হয় না।’ সম্ভাব্য কলঙ্ক থেকে বাঁচার উপায় বিধবাকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলা; যেনো তারা কোনো মানুষকে পোড়ায় না, পোড়ায় কলঙ্ককে!
রামমোহন প্রথম সম্বাদ শেষ করেছেন। সহমরণ সম্পর্কে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের মনকে কিছুটা কোমল ক’রে; কিন্তু তার মন অতো সহজে গলার বস্তু নয়। তাই রামমোহনকে লিখতে হয় দ্বিতীয়, দীর্ঘতর, প্রস্তাব; এতে তাঁর একটিই প্রতিপাদ্য : ‘ভৰ্ত্তার মৃত্যু হইলে পর, স্ত্রী ব্ৰহ্মচৰ্য্য করবেন।’ রামমোহন বিধবাকে বঁচিয়ে রাখার জন্য মেনে নিয়েছেন নিষ্কাম ধর্ম, কামনাকে গণ্য করেছেন পাপ; এমনকি স্বৰ্গকামনাও তাঁর কাছে পাপ।
পিতৃতন্ত্র নিজের স্বাৰ্থ উদ্ধারের জন্যে নারীকে যে-কোনো স্তব করতে পারে, দেখাতে পারে যে-কোনো প্রলোভন। তিনি (১৮১৯, ১৯২) প্রশ্ন করেছেন, ‘স্বর্গের প্রলোভ দেখাইয়া এরূপ অবলা স্ত্রীবধেতে প্ৰবৰ্ত্ত হওয়াতে কি স্বাৰ্থ দেখিয়াছেন?’ আবার (১৮১৯, ১৯৪) প্রশ্ন করেছেন, তবে বিধবাকে স্বৰ্গ কামনাতে প্রলোভ কেন দেখান? মুক্তিসাধন নিষ্কাম কৰ্ম্মে কেন প্ৰবৰ্ত্ত না করান?’
স্বর্গের প্রলোভন দেখানো যে প্রতারণা রামমোহনের কাছে তা অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। স্বর্গের প্রলোভনে নারী যদি সহমরণে না যায়, তখন হিন্দু পিতৃতন্ত্র কী করে? তখন বিধবাকে ‘বন্ধনপূৰ্ব্বক দাহ’’’ করে, এটা ‘দেশাচারপ্রযুক্ত সৎকৰ্ম্ম। রামমোহন বলেছেন, এটা দসু্যুবৃত্তি। যেভাবেই হোক হিন্দু পিতৃতন্ত্রকে মুক্তি পেতে হবে বিধবার ভার থেকে, তাই তার শেষ যুক্তি হচ্ছে নারীনিন্দা রামমোহন (১৮১৮, ২০১)] :
স্ত্রীলোক স্বভাবত অল্পবুদ্ধি, অস্থিরান্তঃকরণ, বিশ্বাসের অপত্র, সানুবাগা, এবং ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্য হয়। স্বামীর পরলোক হইলে পর, শাস্ত্রানুসারে পুনরায় বিধবার বিবাহ হইতে পারে না, এককালে সমুদায় সাংসারিক সুখ হইতে নিরাশ হয়, অতএব এ প্রকার দূর্ভাগা যে বিধবা তাহার জীবন অপেক্ষা মরণ শ্ৰেষ্ঠ।
রামমোহন একটি একটি করে উত্তর দিয়েছেন এসবের। তার উত্তরের মধ্যে ধরা পড়েছে বলতন্ত্রের পীড়নের রাজনীতিক রামমোহন (১৮১৮, ২০২)। রূপটি :
‘প্রথমত বুদ্ধির বিষয়, স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইযাছেন যে অনায়াসেই তাহারদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যা শিক্ষা এবং জ্ঞান শিক্ষা দিলে পরে ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি কহা সম্ভব হয়; আপনারা বিদ্যা শিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন হয়। ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন?’
আধিপত্যকারী শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা অধীন শ্রেণীকে কোনো অধিকার, দায়িত্ব দেয় না; না দিয়ে দিয়ে তাদের ক’রে তোলে সম্পূর্ণ অযোগ্য, এবং শেষে ঘোষণা করে যে অধীনের সহজাতভাবেই অযোগ্য। তাদের দণ্ডিত করা হয় সে-অযোগ্যতায়, যে-যোগ্যতা তাদের অর্জন করতে দেয়া হয় নি। রামমোহন দেখিয়েছেন নারীর বুদ্ধিাচৰ্চা নিষিদ্ধ ক’রে দিয়ে তাদের নিন্দিত করা হয়েছে নির্বোধ অল্পবুদ্ধি ব’লে, তবে এটা তাদের সহজাত স্বভাব নয়; পুরুষতন্ত্রের পীড়নেরই ফল। নারী কি ‘অস্থিরান্তঃকরণ’ ‘বিশ্বাসের অপাত্রে?
‘সানুরাগা’ অর্থাৎ পাবপুরুষাসক্ত? ‘ধৰ্ম্মজ্ঞানশূন্যা’ তিনি দেখিয়েছেন নারীর বিরুদ্ধে এগুলো মিথ্যে অভিযোগ; আর এসব দিকে নারী পুরুষের থেকে অনেক উ ৎকৃষ্ট। সে-উৎকৃষ্ট নারী পুরুষের দাসী (১৮১৮, ২০২-২০৩) : ‘স্বামীর গৃহে প্রায় সকলের পত্নী দাস্যবৃত্তি করে, অর্থাৎ অতি প্রাতে কি শীতকালে কি বর্ষাতে স্থান মার্জন, ভোজনাদি পাত্রে মার্জন, গৃহ লেপনাদি তাবৎ কৰ্ম্ম করিয়া থাকে; এবং সূপকারের কৰ্ম্ম বিনা বেতনে দিবসে ও রাতিতে করে…।’ নারী এমন দাসী, যাকে উঠতে হয় প্রভুর চিতায়! তিনি স্বেচ্ছাসহমরণও মেনে নিয়েছেন, চেয়েছেন ‘এই পৰ্যন্ত অধীন ও নানা দুঃখে দুঃখিনীদের যেনো বন্ধনপূৰ্ব্বক দাহ করা থেকে রক্ষা করা হয়।
রামমোহন তাঁর ‘সম্বাদ’ লিখেছেন নৈর্ব্যক্তিক রীতিতে; কিন্তু বিদ্যাসাগরের প্রস্তাবগুলোর ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে তার সকাতর আবেগ। তার প্রস্তাবগুলো অভিসন্দর্ভ হিশেবে অসামান্য, কিন্তু তিনি নারীর কথা বলতে গিয়ে কেঁপেছেন আবেগে। তিনি মুখোমুখি লড়াই করেছেন হিন্দু পিতৃতন্ত্রের সাথে, ওই পিতৃতন্ত্র তার সাথে যে-নিষ্ঠুরতা করেছে, তা তিনি ভোলেন নি। তিনি নারীকে শুধু নিশ্বাসের অধিকার নয়, দিতে চেয়েছেন জীবনের অধিকার, তাই তাঁর লড়াই ছিলো আরো রক্তাক্ত।
সহমরণ নৃশংস বলে তার নিবারণও সহজ, সহজেই মানুষ ও জনগণকে বোঝানো সম্ভব যে নারীকে পোড়ানো নৃশংসতা। কিন্তু যাদের সংবেদনশীলতা আদিম, তাদের বোঝানো অত্যন্ত কঠিন যে ব্ৰহ্মচর্য পালন করে বেঁচে থাকা চিতায় ছাই হওয়ার থেকেও মর্মান্তিক। নারীর আর্থ ও অন্যান্য স্বাধীনতা চাওয়ার মতো অবস্থা তখন ছিলো না, তিনি তা চান নি; চেয়েছেন জীবনযাপনের অধিকার। তিনি নারীর দেহকে মূল্য দিয়ে, নারীর দেহকে স্বীকার ক’রে হয়ে উঠেছেন একজন আমূল নারীবাদী; এবং উনিশশতকের সবচেয়ে আধুনিক মানুষ।
একটি আদিম পিতৃতন্ত্রের মুখোমুখি একজন আধুনিক মানুষ দাঁড়ালে তাকে যে-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়, তার সবখানিই ভোগ করেছেন বিদ্যাসাগর; তাঁর বুকে ক্ষোভও জেগেছে অশেষ। হিন্দু পিতৃতন্ত্র তাকে সহ্য করে নি; অমূল্যচরণ বসু জানিয়েছেন, ‘বিদ্যাসাগর পথে বাহির হইলে চারিদিক হইতে লোক আসিয়া তাঁহাকে ঘিরিয়া ফেলিত; কেহ পরিহাস করিত, কেহ গালি দিত। কেহ কেহ তাহাকে প্রহার করিবার এমনকি মারিয়া ফেলিবারও ভয় দেখাইত। বিদ্যাসাগর এ সকলে ভুক্ষেপও করিতেন না। একদিন শুনিলেন, মারিবার চেষ্টা হইতেছে।
কলিকাতার কোন বিশিষ্ট ধনাঢ্য ব্যক্তি বিদ্যাসাগরকে মারিবার জন্য লোক নিযুক্ত করিয়াছেন। দুৰ্বত্তেরা প্রভুর আজ্ঞা পালনের অবসর প্রতীক্ষা করিতেছে। বিদ্যাসাগর কিছুমাত্র ভীত বা বিচলিত হইলেন না। যেখানে বড় মানুষ মহোদয় মন্ত্রিবর্গ ও পরিষদগণে পরিবৃত হইয়া প্রহরীরক্ষিত অট্টালিকায় বিদ্যাসাগরের ভবিষ্যৎ-প্ৰহারের কাল্পনিক সুখ উপভোগ করিতেছিলেন, বিদ্যাসাগর একবারে সেইখানে গিয়া উপনীত হইলেন’ (বিনয় (১৯৭৩, ২৬৮)। এ হচ্ছে বিপন্ন পিতৃতন্ত্রের ইতির আচরণ। প্রিয় বালিকা প্রভাবতীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেছিলেন (প্ৰভাবতী সম্ভাষণ, ৪১৯) :
তুমি, স্বল্প কালে নরলোক হইতে অপসৃত হইয, আমার বোধে অতি সুবোধের কার্য কবিযািছ। অধিক কাল থাকিলে, আর কি অধিক সুখভোগ করিতে; হয় ত, অদৃষ্টদ্বৈগুণ্যবশতঃ অশেষবিধ যাতনাভোগের একশেষ ঘটিত। সংসার যেরূপ বিরুদ্ধ স্থান, তাহাতে, তুমি, দীর্ঘজীবিনী হইলে, কখনই সুখে ও স্বচ্ছন্দে, জীবনযাত্রাব সমাধান কবিতে পারিতে না।
বেঁচে থাকার চেয়ে ভারতে নারীর ম’রে যাওয়াও তার কাছে মনে হয়েছে ‘সুবোধের কাৰ্য’; বিধবাবিবাহের দ্বিতীয় প্রস্তাব-এ (১৮৫৫খ, ৮৩৯) বলেছেন, ভারতবর্ষে যেনো ‘হতভাগা অবলাজাতি জন্মগ্রহণ না করে’, আর্তনাদ করেছেন, ‘হা অবলা গণ! তোমরা কি পাপে, ভারতবর্ষে আসিয়া, জন্ম গ্রহণ কর।’ এ-ক্ষুব্ধ বিলাপ থেকেই বোঝা যায়। এ-মহৎ আমূল নারীবাদীকে কতোটা যন্ত্রণা দিয়েছিলো নির্বোধ হিন্দু পিতৃতন্ত্র।
নারীকে জীবন দেয়ার জন্যে বিদ্যাসাগর লিখেছেন ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামের একটি প্রবন্ধ, বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব-প্রথম পুস্তক (১৮৫৫), বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব- দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৫৫), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার-প্রথম পুস্তক (১৮৭১), বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার—দ্বিতীয় পুস্তক (১৮৭৩) নামের চারটি গুরুত্বপূর্ণ গ্ৰন্থ, এবং ব্রজবিলাস (১৮৮৪) নামের একটি বিদ্রুপাত্মক প্ৰতি আক্রমণাত্মক বই।
বিদ্যাসাগরের রচনাবলির এক বড়ো অংশ নারীকল্যাণমূলক রচনা, এবং ওগুলো মানবিকতা, পাণ্ডিত্য, ও যুক্তিতে অসাধারণ। শাস্ত্ৰে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু শাস্ত্ৰ দিয়েই তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিলো যে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত, বহুবিবাহ শাস্ত্রবিরোধী। আধুনিক কালের এক বড়ো ট্র্যাজেডি হচ্ছে একে চলতে হয় পুরোনো কালের বিধান দিয়ে, কেননা তা স্মৃতিশাস্ত্রপ্রতিপাদিত কল্পিত ফলমৃগতৃষ্ণায় মুগ্ধ’, এবং বিদ্যাসাগরকে তা ঘেটে দেখাতে হয়। বর্তমানকালসন্মত বিধান, যদিও তাতে তাঁর বিশ্বাস নেই, ও তিনি নিজেই লিখতে পারতেন ওই সব পুরোনো বস্তুর থেকে অনেক উৎকৃষ্ট শাস্ত্ৰ।
নারীকে জীবন দেয়ার জন্যে তিনি শুরু করেছেন শেকড় থেকে বাল্যবিবাহ থেকে; কেননা বাল্যবিবাহই বলবিধবা উৎপাদনের প্রধান ব্যবস্থা। তার মতে, অল্প বয়সে যে বৈধব্যদশা উপস্থিত হয়, বাল্যবিবাহই তাহার মুখ্য কারণ; সুতরাং বাল্যকালে বিবাহ দেওয়া অতিশয় নির্দয় ও নৃশংসের কর্ম’ (‘বাল্যবিবাহের দোষ’, ৬৮৫); ‘বিধবার জীবন কেবল দুঃখের ভার। এবং এই বিচিত্ৰ সংসার তাহার পক্ষে জনশূন্য অরণ্যাকার’ (ওই, ৬৮৪)। বিধবাকে তিনি জনশূন্য বনবাস থেকে মুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন মানবিক সংসারে।
বিদ্যাসাগর শাস্ত্ৰ মেনেছেন, কেননা লোকে শাস্ত্ৰ মানে, এবং তিনি শাস্ত্রে পেয়েছেন তাঁর প্রস্তাবের সমর্থন। যদি তিনি সমর্থন না পেতেন। শাস্ত্রে, তাহলে কী করতেন বিদ্যাসাগর? তিনি কি শাস্ত্ৰকেই শেষ কথা বলে মানতেন? না, তিনি বাতিল ক’রে দিতেন। শাস্ত্রকে; হয়তো দেখাতেন। ওই সব শাস্ত্রের কাল শেষ কয়ে গেছে, ওই সব শাস্ত্ৰ কলিকালের জন্যে নয়। শাস্ত্র কী?
বিদ্যাসাগর প্রথমে দেখান শাস্ত্র হচ্ছে ধর্মশাস্ত্র; আর মনু, অত্রি, বিষ্ণু, হারােত, যাজ্ঞবল্ক্য, উশনাঃ, আঙ্গিরা, যম, আপস্তম্ব, সংবর্ত, কাত্যায়ন, বৃহস্পতি, পরাশর, ব্যাস, শঙ্খ, লিখিত, দক্ষ, গোত, শাতাতপ, বশিষ্ঠ প্রমুখ ধর্মশাস্ত্ৰকৰ্তা। এর মাঝে উনিশটিকে বাতিল ক’রে বিদ্যাসাগর রেখেছেন একটিকে, কেননা সেটি তাকে সমর্থন করে; যদি সমর্থন না করতো তাহলে সেটিকেও বাতিল করতেন তিনি।
তিনি স্বীকার করেছেন। পরাশর সংহিতাকে। মনু বলেছেন, ‘কলিযুগের ধর্ম অন্য’, আর পরাশর সংহিতার প্রথম অধ্যায়ে আছে : ‘পরাশরনিরূপিত ধৰ্ম কলিযুগের ধর্ম।’ পরাশর বলেছেন ব’লেই বিদ্যাসাগর তাকে মেনেছেন, তা নয়; তিনি পরাশরকে স্বীকার করেছেন, কেননা তাতে রয়েছে বিধবার বিয়ের বিধান। তাই তিনি অন্য সব শাস্ত্ৰ বাতিল ক’রে বলেছেন, ‘কলিযুগের লোক পূর্ব পূর্ব যাগের ধর্ম অবলম্বন করিয়া চলিতে অক্ষম’ (১৮৫৫ক, ৬৯৭); স্থির করেছেন : ‘পরাশরসংহিতা কলিযুগের ধর্মশাস্ত্ৰ’ (১৮৫৫ক, ৬৯৯)। বাতিল অন্য সব শাস্ত্র। পরাশর বলেছেন বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০০) :
স্বামী অনুদ্দেশ হইলে, মরিলে, ক্লীব হইলে, সংসারধর্ম পরিত্যাগ করিলে, অথবা পতিত হইলে, স্ত্রীদিগেব পুনর্বাবে বিবাহ করা শাস্ত্ৰবিহিত। যে নারী, স্বামীর মৃত্যু হইলে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া থাকে, সে দেহান্তে স্বৰ্ণলাভ করে। মনুষ্যশরীরে যে সার্ধ ত্রিকোটি লোম আছে, যে নারী স্বামীর সহগমন করে, তৎসম কাল স্বৰ্গে বাস করে।
স্বৰ্গলাভের কোনো মোহ তার ছিলো না, নারী বিয়ে কবতে পারলে স্বর্গের কোনো দরকার বোধ করবে। ব’লেও তার মনে হয় নি। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ‘রাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে।’ পরাশরের বিধানের বিদ্যাসাগর (১৮৫৫ক, ৭০০) দিয়েছেন। এ-ভাষ্যে :
পরাশর কলিযুগের বিধবাদিগের পক্ষে তিন বিধি দিতেছেন, বিবাহ, ব্ৰহ্মচৰ্য, সহগমন। তন্মধ্যে, বাজকীয় আদেশক্রমে, সহগমনের প্রথা রহিত হইয়া গিয়াছে। বিধবাদিগের দুই মাত্র পথ আছে বিবাহ ও ব্ৰহ্মচৰ্য; ইচ্ছা হয় বিবাহ করিবেক, ইচ্ছা হয় ব্ৰহ্মচর্য করিবেক। কলিযুগে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন কবিয়া, দেহযাত্ৰা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। এই নিমিত্তই, লোকহিতৈষী ভগবান পরাশব সর্বপ্রথম বিবাহেরই বিধি দিয়াছেন।
পরাশর প্রথমেই দিয়েছেন বিয়ের বিধি। প্রশ্ন জাগে রামমোহন কেনো খুঁজে পান নি। পরাশরের এ-বিধিটি, তাকে কেনো সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো মনুর বিধি নিয়েই যে বিধবা ব্ৰহ্মচর্য পালন করবে বা সহমরণে যাবে? রামমোহন কি পেয়েও এড়িয়ে গিয়েছিলেন বিধিটিকে? তিনি কি, ১৮১৮-তে, মনে করেছিলেন যে প্ৰাণই যথেষ্ট নারীর জন্যে, ব্ৰহ্মচৰ্যই নারীর জীবন? রামমোহন কি মনে করেছিলেন বিধবার জন্যে প্ৰাণের বেশি কিছু চাইতে গেলে পণ্ড হবে সব কিছু, বা তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন যে বিধবার বিয়ে হওয়া ঠিক নয়?
কিন্তু আটত্রিশ বছরেই দেখা যায় প্রাণই যথেষ্ট নয়- ‘কলিযুগে, ব্ৰহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া, দেহযাত্ৰা নির্বাহ করা বিধবাদিগের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হইয়া উঠিয়াছে।’ যে-বিধবা ছিলো সামান্য নিশ্বাস, মাত্র আটত্রিশ বছরের মধ্যে বিদ্যাসাগর দাবি করেন যে তার রয়েছে একটি শরীর, তার রয়েছে কামনাবাসনা, আর ওই শরীরে রিপুরা অন্যান্য শরীরের মতোই সক্রিয়। বিধবাদের বৈধব্যযন্ত্রণা ছাড়াও ছিলো আৰ্থনিরাপত্তাহীনতার সমস্যা; তাদের অধিকাংশের জীবনই ছিলো অবহেলিত দাসীর জীবন।
বিদ্যাসাগর সে-সব প্রসঙ্গ তোলেন নি, মনে করেছেন বিয়ে হ’লে ওগুলো মিটবে। বিধবাকে বিয়ে দিয়ে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন সম্পূর্ণরূপে: তাই তাদের ও সন্তানদের কী মর্যাদা হবে, তাও দেখিয়েছেন শাস্ত্র ঘেটে। তার চোখে কুমারী ও বিধবার কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু হিন্দু পিতৃতন্ত্র কেনো মেনে নেবে এ-মানবিকতা? তার পাণ্ডারা কি কোলাহল করবে না?
মেতে উঠবে না। শাস্ত্রের শুদ্ধ-অশুদ্ধ ব্যাখ্যায়? তারা মেতে ওঠে; এবং তাকে লিখতে হয় দীর্ঘ দ্বিতীয় পুস্তক, যাতে প্রতিপাদ্য একই, কিন্তু শ্লোক আর যুক্তি অনেক বেশি। কিন্তু তিনি জানতেন শুধু শ্লোকে কাজ হবে না, আইন পাশ করাতে হবে। তা তিনি করিয়েছিলেন, বিধবাবিবাহের আইন পাশ হয় ১৬ জুলাই ১৮৫৬তে।
নারীকে সংসারে সুষ্ঠুভাবে প্রতিষ্ঠিত করার সুপরিকল্পনা নিয়ে বিদ্যাসাগর কাজ শুরু করেছিলেন: তাই বিধবাবিবাহ প্রচলনের পর তার কাজ হয় বহুবিবাহ রহিত করা। এ-লড়াইয়ে নামতে হয়েছে বিদ্যাসাগরকে, কেননা বহুবিবাহ নিষিদ্ধ না হ’লে তার নারী পুরুষতন্ত্রের পীড়ন থেকে বাঁচে না। বহুবিবাহ বিষয়ক তাঁর বই দুটি আকারে অনেক বড়ো, গবেষণা হিশেবে অসামান্য; এবং এ-দুটিতে তিনি হিন্দু কুলবিন্যাস ও পুরুষের কুৎসিত রূপ তুলে ধরেছেন বিস্তৃতভাবে।
তিনি বিয়ে দিয়েছেন বিধবাকে, কিন্তু ওই বিয়ে জিনিশটি কী? বিয়ে হচ্ছে নারীর জন্যে পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হওয়া; তিনি বলেছেন, ‘এ দেশে বহুবিবাহপ্রথা প্রচলিত থাকাতে, স্ত্রীজাতির যৎপরোনাস্তি ক্লেশ ও সমাজে বহুবিধ অনিষ্ট হইতেছে’ (১৮৭১, বিজ্ঞাপন। বহুবিবাহ নিষেধেও তিনি শাস্ত্ৰকেই নিয়েছেন প্রমাণ হিশেবে, কিন্তু তিনি শাস্ত্রের শেষে চেয়েছেন আইন। বহুবিবাহ বিষয়ক প্রথম পুস্তকে তিনি প্রমাণ করেছেন : স্ত্রী বিদ্যমান থাকিতে, নির্দিষ্ট নিমিত্ত ব্যতিরেকে, যাদৃচ্ছিাক্রমে পুনরায় সবর্ণবিবাহ করা শাস্ত্রকারদিগের অনুমোদিত নহে’ (১৮৭১,৮৪৭)।
তিনি দেখান যে ‘বল্লাল গুণ দেখিয়া কুলমর্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন; দেবীবর দোষ দেখিয়া কুলমর্যাদার ব্যবস্থা করিয়াছেন’ (১৮৭১, ৮৫৮)। দেবীবর ঘটক কুলীনদের দোষের তালিকা ক’রে যে-কুলবিন্যাস করেন, তাকে বলা হয় ‘মেলবন্ধন’, এবং এরই ফলে দেখা দেয়। বহুবিবাহ। আগে অনেক বেশি ঘরে নারীদের বিয়ে দেয়া যেতো, কিন্তু মেলবন্ধনের ফলে বিয়ে দেয়ার মতো ঘরের সংখ্যা ক’মে যায়।
কিন্তু নারীদের বিয়ে দিতেই হবে; তাই দেখা দেয় বহুবিবাহ! কুল কোনো ঐশ্বরিক ব্যাপার নয়; তিনি দেখিয়েছেন, ‘কুলীন মহাশয়েরা যে কুলের অহঙ্কারে মত্ত হইয়া আছেন, তাহা বিধাতার সৃষ্টি নহে’ (১৮৭১,৮৬২), নিতান্তই দেবীবর ঘটকের সৃষ্টি। বিদ্যাসাগর বলেছেন, ‘যদি ধর্ম থাকেন, রাজা বল্লাল সেন ও দেবীবর ঘটকবিশারদ নিঃসন্দেহে নরকগামী হইয়াছেন।’ (১৮৭১, ৮৬৮)।
বিদ্যাসাগর দিয়েছেন কুলীনদের অমানুষিক বর্বরতার পরিচয়; বলেছেন, ‘এ দেশের ভঙ্গকুলীনদের মত পাষণ্ড ও পাতকী ভূমণ্ডলে নাই’ (১৮৭১, ৮৬৯)। তাঁর এ-পুস্তক হিন্দু পিতৃতন্ত্রের পরোহিতদের উত্তেজিত করে, তারা শাস্ত্র নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন বিদ্যাসাগরের ওপর। তখন তিনি লেখেন। দ্বিতীয় প্রস্তক; একে একে তর্কবাচস্পতিপ্রকরণ, ন্যায়রত্নপ্রকরণ, স্মৃতিরত্নপ্রকরণ, সামশ্রমিপ্রকরণ, কবিরত্নপ্রকরণ প্রভৃতি পরিচ্ছেদে খণ্ডন করেন পিতৃতন্ত্ররত্নদের শ্লোক ও যুক্তি। কিন্তু তিনি বহুবিবাহ রহিত করতে পারেন নি।
রামমোহন হিন্দু বিধবার প্রাণদাতা, বিদ্যাসাগর জীবনদাতা; তবে প্ৰাণ দেয়ার চেয়ে জীবন দেয়া অনেক কঠিন। বিধবাকে এখন আর চিতায় উঠতে হয় না, যদিও ভারতে আবার সহমরণের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে; কিন্তু হিন্দু বিধবা আজো জীবনে স্বাভাবিক প্রতিষ্ঠা পায় নি। এখনো বিধবার বিয়ের কথায় হিন্দু পিতৃতন্ত্র বিচলিত হয়ে ওঠে; এমনকি বিধবারাও কেঁপে ওঠে নরকের ভয়ে। প্রথাবাদের ভারতীয় অঞ্চলে জীবনের থেকেও শক্তিশালী প্রথা।