(দ্বিতীয় ভাগ)
বালিকা শিশ্নকে ঈর্ষা করে না, ঈৰ্ষা করে শিশ্নের অধিকারীকে। একটি শিশ্ন থাকলে অশেষ অধিকার, না থাকলে অধিকার নেই। শিশুবয়সে সামনের দিকে লেজের মতো ঝুলে থাকা শিশুটিকে বরং হাস্যকর আর খাপছাড়া ব’লেই মনে হয়। ওটি দেখে যে ঘেন্না জন্মে, তা নয়; আবার ওটি দেখার সাথে সাথে যে ওটির মহত্ত্বের কাছে অবনত হয়ে পড়তে হয়, এমনও নয়। ফ্রয়েড মনে করেছেন, আর তার অনুসারীরা রটিয়েছেন, যে বালিকা বালকের শিশ্ন দেখার সাথেসাথেই লাভ করে দিব্যদৃষ্টি, তখনই বুঝে ফেলে যে তার নেই শিশ্ন, এবং সাথে সাথে আক্রান্ত হয় হীনমন্যতায়। তারা ভুল বুঝেছেন বালিকার মনস্তত্ত্ব। একটি প্রত্যঙ্গ দেখেই হীনমন্যতার আবেগ জাগে না, এর জন্যে থাকা দরকার নিজের অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ।
বালিকা দেখে দেখে বড়ো হয় যে অনেক কিছুই তার প্রাপ্য নয়, আর ছেলের প্রাপ্য সব কিছু তখন সে ঈর্ষা করে বালককে, পুরুষকে, তার শিশ্নটিকে নয়। বালিকা শিশ্নের ঈর্ষায় কাতর নয়, তবে একটি শিশ্নের অভাব তার জীবনে নিয়তির মতো কাজ করে। বোভোয়ারের মতে বালক তার শিশ্নে অনুভব করে নিজের ব্যক্তিত্ব, কিন্তু বালিকা তার কোনো প্ৰত্যঙ্গে ব্যক্তিত্ত্বের আশ্বাস পায় না। ছেলে খেলতে পারে তার শিশ্ন নিয়ে, মেয়ে নিজের যৌনপ্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলতে পারে না। খেলার জন্যে সে পায় পুতুল। পুতুল বস্তু, বালিকা ওই বস্তুর সাথে নিজেকে বোধ করে অভিন্ন। বালিকা পুতুল সাজায়, তাকে নিয়ে খেলে, তাকে আদর করে, যেমন আদর সে নিজে চায়। সে নিজেকে মনে করে পুতুল। বালক যখন ব্যক্তি হয়ে ওঠে, তখন বালিকা হয়ে ওঠে পুতুল।
সে চারপাশে দেখে নারীদের, বালিকা শেখে রূপের মূল্য, নিজে হয়ে উঠতে গায় রূপসী। সাজগোজ হয় তার প্রিয়, আয়নায় সে দেখে নিজেকে, অন্যরা যখন তাকে সুন্দর বলে সে সুখ পায়। সে হয়ে উঠতে চায় পরী বা রাজকন্যা। সে তখন থেকে আর নিজের জন্যে বাঁচে না, বাঁচে অন্যের জন্যে। যে-রূপের জন্যে তার ব্যাকুলতার শেষ নেই, সে-রূপও তার নিজের জন্যে নয়, যেমন তার জীব ও নিজের জন্যে নয়। বালিকা নারী হয়ে উঠতে থাকে, আর হারাতে থাকে স্বায়ত্তশাসন।
বালিকার জীবনে দেখা দেয় নার্সিসিজম বা আত্মপ্রেম, তবে তা কোনো রহস্যময় জৈবিক কারণে নয়। বালিকা দেখে তার কোনো কাজের জন্যে সে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার গুরুত্ব শুধু তার রূপের জন্যে। চারপাশের নারীদের দেখে সে, দেখতে পায় রূপই তাদের সম্পদ। সে তখন মন দেয় নিজের শরীরের দিকে, তাকে সাজিয়ে ক’রে তুলতে চায় রক্তমাংসের পুতুল। সে বুঝে ফেলে তার রূপ দিয়ে সে সম্ভোগ করবে না, বরং সে হবে সম্ভোগের বস্তু। নারী অক্রিয়, তবে তার অক্রিয়তাও কোনো জৈবিক কারণে নয়; তাকে রহস্যময়ী বলা হ’লেও তার কোনো আচরণই রহস্য নয়।
আত্মপ্রেম আর অক্রিয়তার পাঠ সে নেয় সমাজের কাছ থেকেই, সে হয়ে ওঠে সমস্ত সামাজিক নিয়মের মেধাবী ছাত্রী। কেননা তাতে উত্তীর্ণ হ’লে সে পুরস্কার পাবে, ব্যর্থ হ’লে জুটবে শান্তি। বালিকা যখন ঘরে বন্দী হয়ে মেতে থাকে দিবাস্বপ্নে, লুপ্ত হয়ে যেতে থাকে অক্রিয়তায়, তখন বালক বেরিয়ে পড়ে বাইরের জগতে। সে গাছে ওঠে, নৌকো চালায়, রাস্তায় যায়, মারামারি করে; সে নিজের দেহকে মনে করে আধিপত্য হাতিয়ার। বালিকার শরীর যখন হয়ে ওঠে সুন্দর বোঝা, তখন বালকের শরীর হয়ে ওঠে তার বড়ো সম্পদ। সে তার শরীর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে পরিপার্শ্বকে।
সে সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে অনুভব করে তার অস্তিত্ব। বালিকার বেলা ঘটে বিপরীত, সক্রিয়তা নিষিদ্ধ তার জীবনে। বালিকা তার সত্তা আর জীবনের লক্ষ্যের মধ্যে বোধ করে বিরোধিতা। বালিকাকে শেখানো হয় তার কাজ অন্যদের মনোরঞ্জন করা; সে নিজের সুখ চাইবে না, সুখ চাইবে অন্যের; অন্যের সুখই তার সুখ। তাকে শেখানো হয় যে সে নিজেকে পরিণত করবে নিম্প্রাণ বস্তুতে, সে ছেড়ে দেবে নিজের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার।
সে হয়ে ওঠে জীবন্ত পুতুল, বাতিল হয়ে যায় তার স্বাধীনতা। সে কোনো কিছু নিজে বোঝার চেষ্টা করবে না, তার হয়ে বুঝবে অন্যরা; সে নিজে কিছু জানতে চাইবে না, তার হয়ে জানবে অন্যরা; সে নিজে কিছু করবে না, তার হয়ে করবে অন্যরা। বালিকা এভাবে হারিয়ে ফেলে তার মানসিক শক্তি, ক’মে যায় তার ভেতরের সম্পদ। সে হয়ে ওঠে শূন্য পাত্র। এভাবে নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার পর সে আর নিজেকে প্রধান ক’রে তোলার সাহস করে না। যদি তাকে উৎসাহিত করা হতো, তবে সেও পারতো বালকের মতো সাহসী, উদ্যমপরায়ণ, নিভীক, স্বাধীন হয়ে উঠতে। যখন কোনো মেয়েকে ছেলের মতো পালন করা হয়, তখন তার মধ্যে দেখা যায় সাহস, উদ্যম, স্বাধীনতা। বালিকারা যখন পুরুষের লালনে বড়ো হয়, তখন তারা কাটিয়ে ওঠে নারীত্বের ত্রুটিগুলো; কিন্তু সমাজ বালিকাকে বালকরুপে লালনের অনুমতি দেয় না।
কোনো মেয়ে চুল ছোটো করলেই সমাজ হাহাকার করে ওঠে। বাবার প্রভাবে বালিকা অনেকটা স্বাধীন হয়ে ওঠে, কিন্তু তার স্বাধীনতা হরণ করার মতো চারপাশে মা, খালা, ফুপুর অভাব নেই। কোনো বালিকাকে লালনের ভার নারীর হাতে দেয়ার অর্থ হচ্ছে তাকে বিকলাঙ্গ ক’রে তোলা। নারীরাই চিরকাল পালন করে আসছে বালিকাদের, এবং তৈরি করছে বিকলাঙ্গ মানুষ। বালিকার সবচেয়ে বড়ো শুভার্থী তার মা; তবে মা-ই হয়ে ওঠে বালিকার বড়ো শত্ৰু। মা হচ্ছে পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত প্ৰাণী, যে নিজের জীবন দিয়ে সেবা করে পুরুষতন্ত্রের। মা মেয়েকে নিজের থেকেও নারী ক’রে তুলতে চায়, আর ছেলের মধ্যে চায় চূড়ান্ত পৌরুষ। মা পিতৃতন্ত্রের আদর্শ নারী গড়ার পারিবারিক কুম্ভকার। সে মেয়েকে ভালোবেসে নিজের মতো করে তুলতে চেয়ে নিজের নিয়তি চাপিয়ে দেয় মেয়ের ওপর। মা নিয়তির মতো থাকে মেয়ের পাশে। মা ময়েকে ক’রে তুলতে চায় খাঁটি নারী, সতীসাধ্বী, কেননা সমাজ তার মেয়েকে এভাবে পেতেই পছন্দ করবে। মা তার জন্যে সংগ্রহ করে বান্ধবী, দেখে তার মেয়ের যাতে কোনো বন্ধু না জোটে: মা মেয়েকে শেখায় ধর্মকর্ম, শোনায় সতীসাধ্বীদের কাহিনী, শেখায় রান্নাবান্না, শেলাই।
মা জানে রূপ খুব দরকার, তাই বালিকাকে শেখায় যে তাকে হয়ে উঠতে হবে সুন্দরী, অন্যের কাছে আকর্ষণীয়, নাম, লজ্জাবতী; মা তার কন্যার জীবনকে সফল ক’রে তোলার আপ্ৰাণ চেষ্টা ক’রে নষ্ট করে কন্যার সত্তা। বালকবালিকার পোশাকেও আছে সক্রিয়তা ও অক্রিয়তার ব্যাপার। বালকের পোশাক সক্রিয়তার, বালিকার পোশাক সম্পূর্ণ অক্রিয়তার। বালক তার পোশাক তাড়াতাড়ি পরতে আর খুলতে পারে, যে-কোনো অবস্থায়ই তার পোশাক তার সক্রিয়তাকে বাধা দেয় না। কিন্তু বালিকা তার পোশাক নিয়ে সারাক্ষণ থাকে বিব্রত। বালিকাকে পরতে হয় শাড়ির মতো বিব্রতকর পোশাক, যা তাকে ঘিরে রাখে, তাকে গ্ৰাস ক’রে রাখে। ওই শাড়ি পরে দৌড়োনো যায় না, গাছে ওঠা যায় না, সাঁতার দেয়া যায় না। শাড়ি পরে শুধু শুয়ে থাকা যায়।
শাড়ির প্ৰতিবন্ধকতায় বালিকার পক্ষে সক্রিয় হওয়া অসম্ভব। তার পোশাকের অক্রিয়তার সাথে তাকে শেখানো হয় যে সোজা হয়ে হাঁটবে না, হাঁটবে মেরুদণ্ড বাঁকা ক’রে, সংকুচিত হয়ে। নিজেকে নিয়ে সব সময় থাকবে বিব্রত। এভাবে নষ্ট ক’রে দেয়া হয় তার স্বতস্ফুৰ্ততা। তাকে বানিয়ে তোলা হয় দাসী, পুতুল। আজকাল মধ্যবিত্তদের মধ্যে এটা কমছে, বালিকাকে দেয়া হচ্ছে সক্রিয়তার অনেক সুযোগ, তবে তা বালকের সুযোগের একাংশও নয়। লক্ষ্য হচ্ছে যেভাবেই হোক বালিকাকে নারী ক’রে তুলতে হবে।
বালিকার জগত ছোটো, মাকে দেখে দেখে তার মনে হয় মা পিতার থেকে শক্তিমান। তাই মা তার অনুকরণীয় আদর্শকাঠামো। সে মায়ের অনুকরণ করে, মায়ের মতো হয়ে উঠতে চায়, মা হয়ে উঠতে চায়। এক সময় পুতুল খেলার খুব চল ছিলো মেয়েদের মধ্যে, প্রতিটি মেয়েরই থাকতো একরাশ পুরোনো কাপড় দিয়ে তৈরি পুতুল। বালিকারা পুতুলকে মেয়েই মনে করতো নিজেদের, তাকে মেয়ের মতো সাজিয়ে বিয়েও দিতো। খুব মা মা ভাব দেখা যেতো ছোটো ছোটো বালিকাদের কথায়, কাজে, আচরণে; বাঙলা সাহিত্যে মায়ের আদলে গ’ড়ে ওঠা ছোটো ছোটো মায়েদের ছবি বেশ আবেগের সাথে আঁকা হয়েছে। এ-ছোটো মায়েরা সহজাত মা নয়, তারা আদর্শকাঠামো অনুকরণের দৃষ্টান্ত। কিন্তু আগে ছোটোদের আদর্শকাঠামো অনুকরণ দেখে মনে করা হত্যে বালিকাদের মধ্যে রয়েছে সহজাত মাতৃত্ব; একে মনে করা হতো কোনো রহস্যময় বিধানের ফল। বালিকাদের মাতৃত্ববোধ সমাজেরই শিক্ষার পরিণতি।
এ নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রচুর, গবেষকেরা দেখিয়েছেন বালকবালিকাবা অনুকরণ করে তাদের মাবাবাদের, তিন বছর বয়স থেকেই ছোটোদের আচরণ হয়ে পড়ে বিশেষ লিঙ্গ অনুকরণমূলক, ‘সেক্স-টাইপড’। চাষী পরিবারে বালিকা উঠোনে বসে মাটির হাঁড়িপাতিলে রান্না করে মাটির কাল্পনিক ভাতমাছ, তারপর ধোয় হাঁড়িপাতিল, গুছিয়ে রাখে থালাবাসন; বালকটি একটু দূরে হয়তো অভিনয় করে তার পিতার মতো কাল্পনিক চাষবাসের। শহরে মধ্য- বা উচ্চ-বিত্ত পরিবারে ছোটো বালিকা তার মায়ের মতো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লিপস্টিক ঘষে, উঁচু গোড়ালির জুতো পরে হাতে ব্যাগ নিয়ে খটখট ক’রে হাঁটে, নিউমার্কেটে যাওয়ার অভিনয় করে; সে হয়ে ওঠে তার মায়ের মতো পরগাছার পরগাছা। আর বালকটি হয়তো বাবার মতো টেবিলে বসে অনবরত ফোন করার অভিনয় ক’রে চলে; সে হয়ে ওঠে পরগাছা। বালিকাদের সহজাত মাতৃত্বের বোধ এক পুরোনো উপকথা; তাদের দেহ নয়, সমাজই তাদের শিখিয়ে দেয় যে তারা মা হবে।
তাই মায়ের পেশা তাদের শিখতে হয় শুরু থেকেই। বালিকা বুঝতে পারে শিশুপালনের ভার পড়ে মায়েরই ওপর। তাকে শিখিয়ে দেয়া হয় যে মা হওয়া এক দারুণ ব্যাপার, মা হওয়াই বালিকার জীবনের লক্ষ্য। নিজের মাকে বার বার বিয়োতে দেখে বালিকা বুঝে ফেলে একদিন সেও মা হবে, তার পেটেও জন্ম নেবে বাচ্চা, সেও বিয়োবে তার মায়ের মতো। বাচ্চা জন্ম দেয়ার প্রক্রিয়া যখন সে বুঝতে পারে, তখন ঘেন্নায় ভয়ে শিউরে ওঠে বালিকা; কিন্তু কিছু করার নেই তার।
বালিকা দেখে নিজেকে আর তার বয়সের বালকদের, সব কিছু দেখে তার মনে জাগে ঈর্ষা। ঈর্ষা খারাপ আবেগ নয়, ঈৰ্ষা নিজের অবস্থান সম্পর্কে অসন্তোষের অনিবাৰ্য আবেগগত পরিণতি। সে দেখতে পায় সে ভাগ্যনিয়ন্ত্রিত প্ৰাণী। নিজের ভাগ্যকে সে মেনে নিতে বাধ্য হয়, কিন্তু এ-ভাগ্য নিয়ে থাকে অসুখী। সে যতোই বাড়তে থাকে, বুঝতে থাকে সমাজ আর জীবনের রীতিনীতি, ততোই সে ঈর্ষা করতে থাকে ছেলেদের কিন্তু ওই ঈর্ষাকেও সে চেপে রাখতে বাধ্য হয়। বালিকা দেখে ছেলেরা স্বাধীন, তাদের জীবন অনেক সুবিধাজনক; তাতে বিধিনিষেধের বাড়াবাড়ি নেই, কিন্তু তার জীবন বিধিনিষেধ দিয়ে ঘেরা। বালিকার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি তার দেহ, কিন্তু সে-দেহ নিয়েও সে থাকে বিব্রত। তারপর বোধ করে বিপন্ন। বালিকার দেহ বেড়ে ওঠে আবদ্ধ ফলের মতো। তার শরীব কোনো কিছুর সংস্পর্শে আসতে পারে না, সেটি নিষিদ্ধ বস্তুর ঢাকা থাকে আবরণের পর আবরণে। তার দেহ সরাসরি সংস্পর্শে আসতে পারে না।
জলের, বাতাসের, রৌদ্রের। ঘাস অনেক দিন ঢাকা থাকলে যেমন বিবৰ্ণ হয়ে ওঠে, বালিকার দেহও হয়ে ওঠে তেমনই। সে পানিতে নামে একরাশ পোশাক নিয়ে, প্রচণ্ড গরমেও সে গা থেকে একটু কাপড় সরাতে পারে না; তার দেহ জানে না বৃষ্টির সরাসরি ছোয়ার স্বাদ, তার শরীর জানে না রোদের সরাসরি ছোয়া কেমন। বালক নগ্ন শরীরে সাতার কাটে, বাতাসে নগ্ন শরীর মেলে দেয়; খেলার সময় বালকের শরীর আসে অন্য শরীরের সংস্পর্শে। বালিকার শরীরকে বাড়াতে হয় অন্যাঘাত পুজোর ফুলারূপে। তার ভেতরে জন্ম নেয় গুমোট, যা পুরুষের কাছে মনে হয় আকর্ষণীয়। প্রচণ্ড গরমের সময় এক কিশোরী আমাকে বলেছিলো, ‘তোর মতো যদি খালি গায়ে বসে থাকতে পারতাম!’ ওটা ছিলো তার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ সাধা! বালিকা তার দেহকে নগ্ন মেলে ধরতে চায় প্রকৃতির সামনে, পেতে চায় প্রকৃতির সমস্ত আদর; কিন্তু তার জীবনে তা নিষিদ্ধ।
বালিকা বয়সেই তার শরীরে ওপর অনেক সমাজ শুরু করে নৃশংস আক্রমণ। এমন এক আক্রমণ হচ্ছে নারী-খৎনা। মেয়েদের খৎনার বিভীষিকাজাগানো প্ৰথা আজো প্রচলিত আরব দেশগুলোতে, বিশেষ ক’রে মিশর, সুদান, ইয়েমেন, ও নানা উপসাগরীয় রাজ্যে; এবং সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, তাঞ্জনিয়া, ঘানা, গিনি, ও নাইজেরিয়ায়। এসব দেশে কুমারীত্ব আর যোনিচ্ছদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যোনির এক টুকরো পাতলা পর্দার ওপর দাড়ানো সেখানে বংশের মানসম্মান। যাতে বংশের মানসম্মান বা বালিকার সতীত্ব ও সতীচ্ছদ অক্ষত থাকে, তার জন্যে খৎনা করানো হয় বালিকাদের। নারী সেখানে ফিৎনা, বিশৃঙ্খলা, যার কাজ বিপর্যয় ঘটানো; ওই বিপর্যয় থেকে সমাজকে বাঁচানোর জন্যে সেখানে কুরিয়ে ফেলে দেয়া হয় যোনির পাপপরায়ণ প্রত্যঙ্গগুলো।
ওই বর্বর পিতৃতন্ত্র জানে যদি কেটে ফেলা হয় বালিকার ভগাঙ্কুর, বৃহ্দোষ্ঠ, ক্ষুদ্রষ্ঠ, তাহলে থাকবে না তার কাম ক্ষুধা। রক্ষা পাবে সতীত্ব, আর সমাজ। বালিকাদের খৎনা করানো হয় সাত-আট বছর বয়সে, ঋতুস্রাব দেখা দেয়ার আগে [দ্ৰ নওঅল (১৯৮০, ৩৩-৪৩), মাইলস (১৯৮৮, ৮৮-৮৯)]। সেখানে রয়েছে মেয়েদের খৎনা করানোর জন্যে হাজামী। দুজন নারী মেয়েটিকে শক্ত ক’রে চেপে ধরে, যেমন ধরা হয় কোরবানির পশু; দু-উরু জোরে টেনে ধ’রে তারা ফাক করে বালিকার যোনিঅঞ্চল, আর হাজামী ছুরি দিয়ে কেটে ফেলে বালিকার ভগাঙ্কুর ও অন্যান্য প্রত্যঙ্গ। খৎনার সময় তারা আবৃত্তি করতে থাকে, ‘আল্লা মহান, মুহম্মদ তার নবী : আল্লা আমাদের দূরে রাখুক সমস্ত পাপ থেকে।’ যে-ডুরিটি দিয়ে খৎনা করা হয়, সেটি সব সময় ধারালোও হয় না। ছুরিটি হতে পারে ধারালো পাথর, ব্লেড, বা কাচের টুকরো। খৎনায় প্রথমে কেটে ফেলা হয় বালিকার সম্পূর্ণ ভগাঙ্কুর, তারপর কাটা হয় ক্ষুদ্রোষ্ট, তারপর বৃহ্দোষ্ঠের ভেতর ভাগের মাংস।
খৎনার পর শেলাই ক’রে দেয়া হয় যোনিরন্ত্র, একটু ফাক রাখা হয় ঋতুস্রাবের জন্যে, খোলা রাখা হয় মূত্ররন্ধ। খৎনার সময় বালিকার মা ও আত্মীয়ারা ক্ষতের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে পরীক্ষা করে খৎনা ঠিক মতো হয়েছে কিনা। খৎনার পর চল্লিশ দিনের জন্যে শক্ত করে বেঁধে দেয়া হয় বালিকার দু-উরু, যাতে যোনি ভালোভাবে জোড়া লাগে। হাজামীরা অশিক্ষিত নারী, তারা খৎনা করতে গিয়ে বিপন্ন ক’রে তোলে বালিকার জীবন। খৎনা সফল করার জন্যে তারা গভীরভাবে কাটে বালিকার ভগাঙ্কুর, যাতে দেহে কামের একটি কণাও অবশিষ্ট না থাকে।
খৎনার অব্যবহিত ফল প্রবল রক্তক্ষরণ, জীবাণুসংক্রমণ, মূত্ররন্ধ ফেড়ে যাওয়া, মূত্রথলে ও পায়ুদ্বার বিক্ষত হওয়া। যোনি অঞ্চল শেলাই ক’রে দেয়ার ফলে অনেক বালিকা পরে ঠিক মতো হাঁটতে পারে না। খৎনার পর যদি বালিকা বেঁচে থাকে, সে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে; সারাজীবনের জন্যে তার কাম ক্ষুধা মিটে যায়। সুদানে মেয়েদের খৎনা চলে মেয়েদের সারজীবন ধ’রে, মেয়েদের যোনি সেখানে নিরন্তর কাটাছেড়া ও শেলাইয়ের বস্তু। সুদানে বালিকার খৎনায় গভীর ক’রে কেটে ফেলা হয় ভগাঙ্কুর, বৃহদোষ্ঠ, ক্ষুদ্রোষ্ঠ, বলা যায় কামিয়ে ফেলা হয় ওই আপত্তিকর জিনিশগুলো; তারপর মেষের অন্ত্র দিয়ে শেলাই ক’রে দেয়া হয় যোনিরন্ধ, একটু ফাক রাখা হয় যাতে চুইয়ে বেরোতে পারে ঋতুস্রাব, আর প্রস্রাবের জন্যে খোলা রাখা হয় মূত্ররন্ধটি। বিয়ের সময় যোনির শেলাই একটু কেটে ফাঁক করা হয় রন্ধটি, যাতে শিশ্ন ঢুকতে পারে।
সন্তান প্রসবের সময় শেলাই আরো কাটা হয় যোনি প্রসারিত করার জন্যে। প্রসবের পর আবার শেলাই ক’রে দেয়া হয় রন্ধ। নারী তালাক পেলে বা বিধবা হ’লে শেলাই ক’রে বন্ধ ক’রে দেয়া হয় যোনি, এবং আবার বিয়ে হ’লে আবার কেটে ফাক করা হয় রন্ধ। এভাবে চলতে থাকে নারীর রন্ধ কাটাকাটি জোড়াতালি। খৎনার ফলে সঙ্গম ও প্রসব হয়ে ওঠে বিপজ্জনক, আর মনে যে-ক্ষতটি জন্ম নেয় তা নারীর জীবনকে ঢেকে ফেলে দুঃস্বপ্নে। খৎনা হওয়া নারীর জন্যে বিবাহ ভয়ংকর। সোমালিয়ার একটি বাসর রাত এমন : স্বামী প্ৰথমে নতুন বউকে পিটোয় চাবুক দিয়ে, তারপর ছুরি দিয়ে যোনির শেলাই কেটে ‘খোলে তাকে। খোলার পর তিন দিন ধরে চালাতে থাকে অবিরাম সঙ্গম! কেনো স্বামীকে এতো পরিশ্রম করতে হয়? তার কারণ [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৮৯)] :
‘তাকে এ-‘শ্ৰম’ করতে হয় একটি ‘প্ৰবেশ পথ’ তৈরি করার জন্যে, যাতে ক্ষতটি আবার জোড়া লেগে না যায়।…বাসর রাতের ভোরে স্বামী তার ছুরিটি কাধে ঝুলিয়ে সারা এলাকা ঘুরে আসে, সবাই প্রশংসার চোখে তাকায় তার দিকে। সে-সময় বউটি বিছানায় শুয়ে থাকে, নড়াচড়া করে না, লক্ষ্য রাখে যাতে তার ক্ষতটি খোলা থাকে।‘
নওঅল (১৯৮০, ৭-১১) বর্ণনা করেছেন তার নিজের খৎনার বিভীষিকা, যাতে শোনা যায় নৃশংস পিতৃতন্ত্রের আক্রমণে সমস্ত আরব বালিকার চিৎকার। ছ-বছরের নওঅল রাতে আধো ঘুমে আধো জাগরণে শুয়ে ছিলো নিজের বিছানায়। হঠাৎ সে অনুভব করে তার চাদরের নিচে ঢুকছে একটি শক্ত রোমশ হাত। হাতটি তাকে ধরে শক্ত ক’রে: আরেকটি হাত চেপে ধরে তার মুখ। সে চিৎকার ক’রে উঠতে চায়, কিন্তু পারে না। তারা তাকে গোশলখানায় নিয়ে যায়। সে দেখতে পায় নি। তারা কজন ছিলো, বা তারা পুরুষ না নারী। তারা লোহার মতো শক্ত ক’রে ধরে তার হাত, বাহু, দু-উরু। সে একটুও নড়তে চড়তে পারে না। সে শুনতে পায় ছুরি শানানোর শব্দ, তার মনে পড়ে যায় ঈদের দিনে মেষ জবাইয়ের দৃশ্য। তার রক্ত হিম হয়ে আসে, হৃৎপিণ্ড থেমে যায়। সে বোধ করে তারা তার পেটের নিচে দু-উরুর মাঝে কী যেনো খুঁজছে।
একটু পরে সে বুঝতে পারে তারা তার দু-উরু যতোটা সম্ভব ফাক ক’রে ধরেছে। তার মনে হয় এই একটি ধারালো ছুরি কেটে ফেলবে তার গলা, কিন্তু সে অনুভব করে যে ছুরিটি নেমে আসে তার দু-উরুর মাঝখানে, এবং সেখান থেকে কেটে ফেলে এক টুকরো মাংস ৷ তার মনে হয় তার শরীরে আগুন ধ’রে গেছে, সে চিৎকার ক’রে ওঠে, কিন্তু কোনো শব্দ হয় না। সে দেখতে পায় রক্তে ডুবে গেছে তার নিতম্ব। কারা তার ভগাঙ্গুর কেটেছে সে জানে না, তবে সে যখন তার মাকে দেখতে পায় পাশেই, তখন তার দুঃখের সীমা থাকে না। সে দেখে তার মা হেসে কথা বলছে। ওই লোকগুলোর সাথে, যারা কিছুক্ষণ আগে জবাই করেছে তাকে। তারা তাকে তার ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়, এবং চেপে ধরে তার ছোটো বোনকে।
বোনটি তার চেয়ে দু-বছরের ছোটো। সে না, না” ক’রে চিৎকার ক’রে ওঠে। সে দেখে ভয়ে তার বোনের মুখ নীল হয়ে গেছে, তার চোখে পড়ে বোনের চোখ, যাতে জমাট হয়ে আছে আতঙ্ক। তাদের দৃষ্টি বিনিময় হয়, যে-দৃষ্টিতে তারা বলতে চায় : ‘এখন আমরা জানি এটা কী। এখন আমরা জানি কোথায় আমাদের ট্র্যাজেডি। আমরা এক বিশেষ লিঙ্গের, স্ত্রীলিঙ্গের। পীড়ন ভোগ করাই আমাদের নিয়তি, আর আমাদের নিয়তি হচ্ছে যে ঠাণ্ডা নিমর্ম হাত ছিড়ে নেবে। আমাদের দেহেব একটি অংশ।‘ এ-নৃশংস অভিজ্ঞতার পর আর কোনো বালিকা কামের কথা ভাবতে পারে না; তার যোনিটি হয়ে ওঠে একটি স্পর্শকাতরতাহীন গর্ত, যাতে একদিন স্বামী খুঁজে পায় বহু স্বপিত বহু আকাঙ্খিত একটি পর্দা, কিন্তু সেটি কখনো কামসুখ বোধ করে না।
বালিকা যখন একটু বড়ো হয়, বড়ো হয় তার জগতটি; তখন সে চারপাশে দেখে পুরুষাধিপত্য। দেখে পৃথিবীটা পুরুষের। বালিকা এর বিরুদ্ধে যেতে পারে না, সে মেনে নেয় পুরুষাধিপত্য। বালকের শিশ্ন দেখতে পাওয়া নয়, পুরুষাধিপত্য দেখতে পাওয়াই তার জীবনের চরম সত্যেকে দেখতে পাওয়া। এটা তার নিজের সম্বন্ধে ধারণাই পাল্টে দেয়। সে এখন বুঝতে পাবে পিতাই বাড়ির প্রভু, সম্রাট, ঈশ্বর; মা তার মতোই তুচ্ছ। পরিবারে পিতাই সূর্য, তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় সব কিছু। সে দেখতে পায় পিতার ইচ্ছেই সব, মায়ের ইচ্ছে কিছু নয়। যখন সে আরো ছোটো ছিলো, সে মনে করেছিলো সে হবে মায়ের মতো শক্তিমান, এখন দেখতে পায় মায়ের শক্তি নেই।
সে চারপাশে দেখতে পায় পুরুষের মহিমা, শুনতে পায় পুরুষের বন্দনা। তার স্থান সেখানে নেই। সে সব কিছুতেই দেখে তার শোকাবহ নিয়তি। সে শুনতে পায় সব মহাপুরুষ পুরুষ, মহাপুরুষদের তালিকায কোনো নারী নেই; যারা রাজ্য জয় করেছে, মানুষকে ধর্মের পথে এনেছে, যারা সভ্যতা সৃষ্টি করেছে, তারা সবাই পুরুষ। কিছু কিছু নারীর কথাও শোনে বালিকা, তবে ওই নারীরা আকর্ষণীয় শুধু মর্মস্পশী মর্ষকামের জন্যে। ওই নারীরা শুধু ত্যাগ করেছে, দুঃখ ভোগ করেছে, পরিত্যক্ত হয়েছে, তারা স্মরণীয় হয়ে আছে পুরুষের পায়ে আত্মবিসর্জনের জন্যে। ধর্ম তাকে শোনায় ভয়ঙ্কর কথা, শোনায় পুরুষের পাজার থেকে জন্মেছে নারী। সে কি একথা বিশ্বাস করবে নাকি করবে না? তার মা তাকে বিশ্বাস করতে বলে, বাবা তাকে বিশ্বাস করতে বলে, সবাই বিশ্বাস করতে বলে; সে কী ক’রে করবে।
অবিশ্বাস? সে দেখে ধর্ম তারই জন্যে, তার ভাই ধর্মের কথা সব মেনে চলে না, সে-জন্যে তার ভাইকে চাপ দেয়া হয় না; কিন্তু দেখে তার ওপর খুব বেশি চেপে বসছে ধর্ম। সে শোনে পতির পায়ের তলে নারীর বেহেস্ত। সে শুনতে পায় নারীই সমস্ত নষ্টের মূলে, দিকে দিকে সে শুনতে পায় তার লিঙ্গের নিন্দা। সে নাটকে চলচ্চিত্রে পাঠ্যপুস্তকে উপন্যাসে দেখে পুরুষাধিপত্যের জয়। সে ধোঝে সে বালিকা, সে নারী হয়ে উঠবে; সে কিছু উপভোগ করবে না, কিন্তু ভোগ করবে যন্ত্রণ। সে বোঝে পুরুষভোগ্য পৃথিবী!
সেও পুরুষের ভোগ্য। সবাই তাকে শেখায় তাকে প্রস্তুত হ’তে হবে পুরুষের উপভোগের জন্যে। তার শরীর তার উপভোগের জনে! নয়, তার কাজ ওই শরীরকে আবেদনময়, পুরুষের উপভোগের জন্যে নিটোল ক’য়ে তোলা। তার কাজ কোনো পুরুষের মন জয় করা। সে কি পুরুষের মন জয় করবে তার বুদ্ধি দিয়ে, মেধা দিয়ে? না, পুরুষের মন জয় করতে হবে তাকে শরীর দিয়ে, তাকে হ’তে হবে রূপসী। সে হবে যৌনসামগ্ৰী। তাকে হ’তে হবে মর্ষকামী। সে হবে বিবি রহিমা, সে হবে সতী সীতা। সমাজ বালিকাকে শিক্ষা দেয় আত্মপ্রেমের, মর্ষকামিতার। বালিকা দেখতে শুরু করে দিবাস্বপ্ন, ওই স্বপ্নে ঘোড়া ছোটোয় রাজপুত্ররা।
সে হয় আত্মপ্রেমবিভোর, ভরে ওঠে মেয়েলিপনায়; সে শেখে কটাক্ষ, শেখে শরীর বাকিয়ে দাঁড়াতে। অশু হয়ে ওঠে তার সম্পদ। বালকেরা মুগ্ধ হয় তার চোখের জলের গভীরতায়, তাই সে শেখে চোখ ছলছল করতে। বালিকাকে শেখানো হয় সে কিছু করতে পারবে না, করবে ছেলেরা; তাকে শেখানো হয় অক্রিয়তা অনেক বেশি সুখকর। তাই সে হয় অক্রিয়। অক্রিয় ভূমিকাকে সে প্রতিবাদ না ক’রে মেনে নেয়, কেননা সে মনে করে এই তার নিয়তি। বালকের জন্যে আছে। ভবিষ্যৎ, তার জন্যে নেই। বালক বড়ো হয়ে কর্মকর্তা হবে, বিমান চালাবে, সমুদ্রে যাবে, মাঠে যাবে, শহরে যাবে, পৃথিবী দেখবে, ধনী হবে; আর বালিকা হবে স্ত্রী, মা, পিতামহী, মাতামহী। সে তার মায়ের মতো সংসার দেখবে, সে সন্তান প্রসব আর পালন করবে তার মায়ের মতো। খুব বড়ো হয়ে ওঠে একটি কথা যে সে হবে মা।
বালিকা জেনে ফেলে সে হবে মা, তাই জন্মের রহস্য তার জন্যে হয়ে ওঠে এক বড়ো ব্যাপার। বালক যে-বয়সে জন্মের রহস্য সম্পর্কে ভাবেই না, সে-বয়সে বালিকার বড়ো ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে। জন্ম রহস্য আর কাম। বালকও ভাবে শরীরের কথা, তবে সে রহস্য উদঘাটনের জন্যে ভাবে না, ভাবে উপভোগের জন্যে। বালিকা উপভোগের জন্যে ভাবে না, ভাবে উদঘাটনের জন্যে, নিজের নিয়তিকে জানার জন্যে। বালক নারীদেহ সম্পর্কে খুবই উৎসাহী হয়, লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করে নারীদেহ নিয়মিত হস্তমৈথুনও করে, তবে সে এ-বয়সে স্বামী, পিতা হিশেবে কল্পনা করে না নিজেকে। কিন্তু বালিকা ভাবতে থাকে বিয়ের কথা, দেখতে থাকে নিজেকে স্ত্রী, মা-রূপে। বালিকা বুঝে ফেলে যে মায়ের পেটে সন্তান জন্ম নেয়, মা জন্ম দেয় সন্তান। সে বোঝে, গ্রামে হ’লে সে দেখতেও পায়, কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার সন্তান জন্ম দেয়া; কেঁপে ওঠে তার অস্তিত্ব। কীভাবে মায়ের পেটে ঢোকে৷ শিশু, এটা বালকবালিকা উভয়ের চিন্তায়ই স্থান পায়।
বালক জানে এ-দায়িত্ব তাকে বইতে হবে না, তাই সে মাথা ঘামায় না। এ নিয়ে; কিন্তু বালিকার চিন্তায় তা স্থির হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে একটু একটু আভাস পেতে থাকে কী ক’রে মায়ের পেটে আসে সন্তান। এক সময় সে মনে করতো বিয়ে হ’লেই সন্তান হয়; এখন সে বোঝে কিছু একটা করতে হয় বাবামাকে। কী করতে হয়? স্পষ্ট ক’রে কারো থেকে সংবাদ পায় না, তবু এক সময় সঙ্গমের সংবাদ সে পায়। প্রথমে বোঝে না, বোঝার পর বালিকা শিউরে ওঠে। বালকবালিকা যখন বুঝতে পারে সঙ্গম কী, তখন তারা প্রত্যেকে ঘেন্নায় চিৎকার ক’রে ওঠে : না, না, তাদের বাবামা অতো খারাপ নয়, তারা এ-কাজ করতে পারে না। কিন্তু বালিকা চিৎকার ক’রে সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না; তবে তার ভয় জাগে বিয়ে সম্পর্কে।
বালিকা হয়তো দেখে ফেলে (কানো পুরুষের শিশ্ন, ভয়ে সে আরো কুঁকড়ে যায়। তার জগতে নেমে আসে বিভীষিকা। বালিকা এক সময় অনুভব করে বদল ঘটছে তার ভেতরে, তার শরীর হয়ে উঠছে নারীর শরীর। বারো তেরো বছরের সময় শুরু হয় তার কৈশোরসংকট: দেখা দিতে থাকে তার স্তন, আর সে বিপন্ন বোধ করতে থাকে নিজেকে নিয়ে। তার শরীর তার কাছে হয়ে ওঠে। লজ্জার বস্তু, যা নিয়ে সে থাকে বিব্রত। এক সময় হঠাৎ ময়লা রক্তে ভেসে যায়। তার উরু, আর বিছানা; আর ভীত রক্তাক্ত অপরাধবোধগ্রস্ত বালিকা এগিয়ে চলে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে।