ফ্ৰয়েডীয় কুসংস্কার, ও মনোবিশ্লেষণাত্মক-সমাজবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা
(তৃতীয় ভাগ)
ক্লারা টম্পসন আরো প্রবলভাবে প্ৰত্যাখ্যান করেছিলেন ফ্রয়েডকে। তিনি দেখান যে নারীমনোবিজ্ঞান সম্পর্কে ফ্রয়েডের সিদ্ধান্তগুলো জন্মেছে নারীর নিকৃষ্টতা সম্পর্কে ফ্রয়েডের বদ্ধমূল ধারণা থেকে; তাই ফ্রয়েড শিশ্নাসূয়া, ঈৰ্ষা, মর্ষকাম, হীনমন্যতাবোধ প্রভৃতিকে মনে করেছেন জৈবিকা; তবে এসবের উৎপত্তি ঘটেছে সাংস্কৃতিক কারণে। মানুষ যে-অবস্থায় পড়ে সাধারণত তার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়, নারীও নিয়েছে। শিশ্ন পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুবিধা আর আধিপত্যের প্রতী, নারী ঈর্ষা করে পুরুষের ওই সুবিধা আর আধিপত্যকে। নারী শিশ্নকে ঈর্ষা করে না, আর ঈর্ষাও সর্বজনীন নয়।
ঈর্ষাবিদ্বেষ প্রতিযোগিতামূলক সংস্কৃতির চরিত্র; নারীকে বাদ দেয়া হয় ওই প্রতিযোগিতা থেকে, তাকে দেয়া হয় না বিকশিত হতে। তাই তার মনে ঈর্ষা জন্মানো স্বাভাবিক, তবে এর পেছনে কোনো জৈব কারণ নেই। বর্তমান ব্যবস্থায় একটি নিৰ্বোধি পুরুষ যে-সাফল্য লাভ করতে পারে, একটি বুদ্ধিমান নারী তা পারে না; তাই সে হতে পারে ঈর্ষাকাতর। সমাজই ঈর্ষার জনক। নারীর হীনমন্যতাবোধও সমাজে তার প্রকৃত অবস্থারই প্রতিফলন; তা শিশ্নাহীনতার ফল নয়, মনোব্যাধিও নয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিজের অবস্থা দেখে দেখে নারী ভোগে হীনমন্যতায়, এর পেছনে তার শরীর নেই; আছে সমাজ।
নারীর পরাসত্তা দুর্বল, এটা নারীর জৈবিক স্বভাব নয়; এটা সমস্ত অধীন জাতিরই কৃত্রিম স্বভাব। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্যে চায় শক্তিমানদের স্বীকৃতি। ভিক্টোরীয় তরুণী বা আজকের মধ্যপ্রাচ্যের বা বাঙলাদেশের তরুণী নির্ভরশীল তার পিতার ওপর, তার কোনো সুযোগ নেই স্বাধীন মন বিকাশের। যদি সে স্বাধীন হ’তে চায়, তবে তা হবে বিপজ্জনক। দুর্বলকে সব সময়ই আত্মরক্ষার জন্যে শক্তিমানের ভাবাদর্শ মেনে নিতে হয়। নারীও তা মেনে নিয়েছে, তাই মনে হয় নারীর পরাসত্তা দুর্বল; তবে এটা প্রাকৃতিক বা জৈবিক কারণে ঘটে নি, ঘটেছে সামাজিক কারণে।
ফ্রয়েডের মতে নারীদের আবেগমননগত বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায় পুরুষের অনেক আগে। তিনি (১৯৩৩, ১৭৩) বলেন, ‘তিরিশের কাছাকাছি কোনো পুরুষকে মনে হয় প্রাণবন্ত, এক অর্থে অপূর্ণ বিকশিত ব্যক্তি, যার কাছে প্রত্যাশা করি যে সে তার বিকাশের সব সম্ভাবনা পূরণ করবে… তবে ওই বয়সের নারীরা মাঝেমাঝেই তাদের মনস্তাত্ত্বিক অনমনীয়তা ও অপরিবর্তনীয়তা দিয়ে আমাদের বিচলিত করে।’ এ দেখেই তিনি ধ্রুব সূত্রে পৌঁছে গেছেন যে তিরিশ বছরের পর নারীদের আর কোনো সম্ভাবনা থাকে না! তিরিশ বছরেই নারী সমাপ্ত; এবং এর মূলে আছে তার শরীর। সম্পূর্ণ ভুল তার সূত্র, যদিও পর্যবেক্ষণ নির্ভুল। ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণের আভ্যন্তর ব্যাখ্যা দিয়েছেন টম্পসন; তিনি দেখিয়েছেন ওই কালে এ-ই ছিলো স্বাভাবিক।
তখনো পৃথিবীর অধিকাংশ জুড়ে এটাই স্বাভাবিক যে নারী সমাপ্ত তিরিশে। এক সময় বাঙলায় জনপ্রিয় ছিলো একটি শ্লোক যে বাঙালির মেয়ে কুড়িতেই বুড়ী, অৰ্থাৎ তার জীবন নিঃশেষিত বিশ বছরেই। টম্পসন বলেছেন, নারীর জীবনের সাফল্য যতোদিন নির্ভর করবে বিয়ে ও মাতৃত্বের ওপর, ততোদিন তিরিশেই তার জীবনের সাফল্য বা ব্যর্থতা অর্জিত হয়ে যাবে। যদি তার বিয়ে হয় ষোলো বা আঠারোতে, তাহলে তিরিশ বছরের মধ্যে উজাড় হয়ে যায় তার জরায়ু ও সৌন্দৰ্য, যা ছিলো তার জীবনের সম্ভাবনার ভিত্তি। যদি তার বিয়ে না হয়, তাহলে তার জীবন ব্যৰ্থ, বিয়ে হ’লেও ব্যর্থ কেননা বিয়ে ও সন্তান কোনো সাফল্যই নয়। এখনো পৃথিবী জুড়ে তিরিশ বছর বয়স্ক অধিকাংশ নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। টম্পসন ফ্রয়েডের পর্যবেক্ষণ মেনে নিয়ে দেখিয়েছেন তাঁর ব্যাখ্যার ত্রুটি; দেখিয়েছেন ফ্রয়েড নারীকে দেখেছেন পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে, ফ্রয়েডের নারী হচ্ছে পুরুষের না-সূচক রূপ। ফ্রয়েড দেখেছেন তাঁর নিজের সংস্কৃতির নারীদের, আর ওই নারীদের স্বভাবকে মনে করেছেন বিশ্বজনীন ও শাশ্বত। ফ্রয়েড স্বাভাবিক নারীদের ব্যাখ্যা করেন নি, করেছেন পিতৃতন্ত্রের পর্যুদস্ত নারীদের।
তিনি ফ্রয়েডের পুংগূঢ়ৈষ্যারও দিয়েছেন গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা; তিনি দেখিয়েছেন সংস্কৃতিই নারীকে ডাকে ওই দিকে। নারী যখন প্রথাগত আশ্রিত ভূমিকা ছেড়ে স্বাধীন জীবনের খোজে বেবিয়ে পড়ে, তখন সে সাফল্যের জন্যে অনুসরণ করে সফলদেরই : নারী দেখে সফল হচ্ছে পুরুষ, তাই নারী অনুকরণ করে পুরুষের আচরণ। পুরুষের জগতে পুরুষের অনুকরণ করে সাফল্য অর্জন করে নারী, যা তার পুরুষাধীন অবস্থায় অসম্ভব। তাই পুংগূঢ়ৈষ্যা কোনো রোগ নয়। ফ্রয়েভ নারীর যে-সব বৈশিষ্ট্যকে মনে করেছেন একান্তভাবে নারীসুলভ ও জৈবিক, সেগুলোকে টম্পসন দেখিয়েছেন সামাজিক অবস্থার ফল ব’লে। তা শাশ্বত নয়, তার সাথে দেহের সম্পর্ক নেই, তা নারীর মৌল স্বভাব নয়। নারীর মৌল স্বভাব কী? টম্পসন বলেছেন, নারীর মৌল স্বভাব আজো অজানা’ [দ্র উইলিয়মস (১৯৭৭, ৭৬)।
অ্যাডলার ছিলেন ফ্রয়োডীয় বৃত্তে, কিন্তু বেরিয়ে এসেছিলেন যখন বুঝতে পারেন যে বদ্ধমূল ফ্রয়েডীয় ধারণা দিয়ে বিজ্ঞানচর্চা অসম্ভব। নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন ফ্রয়েডীয় ধারণা থেকে, এবং অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। অ্যাডলার [দ্র উইলিয়মস্ (১৯৭৭, ৮০)] বলেছেন :
‘আমাদের সমস্ত সংস্থা, আমাদের প্রথাগত প্রবণতা, আমাদের বিধান, আমাদের নৈতিকতা, আমাদেব প্রথা সাক্ষী দেয় যে পুরুষাধিপত্যের গৌরব প্রতিষ্ঠার জন্যে ওই সব প্রণয়ন ও রক্ষণ করেছে সুবিধাভোগী পুরুষেরা।‘
শিশুকাল থেকেই শিশুরা পিতৃতন্ত্রের বিধানের শিকার হয়ে ওঠে। ছেলেশিশুকে ক’রে তোলা হয় আধিপত্যবাদী, মেয়েশিশুর মধ্যে জাগিয়ে তোলা হয় অধীন ও অপদার্থের বোধ। অ্যাডলারের মতে, বালিকা চারপাশে নারীর বিরুদ্ধে কুসংস্কার দেখে দেখে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে নিজের আর নারীজাতির ওপর; এটা কোনো খোজা গূঢ়ৈষ্যাব ফল নয়, সমাজব্যবস্থাই তাকে ক’রে তোলে আত্মঅবিশ্বাসী। নারীকে বের ক’রে দেয়া হয় শক্তির এলাকা থেকে, পুরুষের সমাজব্যবস্থা তার সাথে এমন দুর্ব্যবহার করে যে তার মনে দেখা দেয় সংকট। সমগ্র সভ্যতা নারীর ওপর যে-চাপ সৃষ্টি করে, তা নারীকে বাধ্য করে পুরুষেব কাছে আত্মসমর্পণ। তবে পক্ষে সুস্থ থাকা কঠিন। তিনি দেখিয়েছেন সমাজ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজকেই মনে করে পুরুষের কাজ, গুরুত্বহীন কাজকে মনে করে নারীর কাজ; পুরুষ গুরুত্বপূর্ণ শক্তিমান, সুযোগ্য; নারী বাধ্য, দাসভাবাপন্ন, অধীনস্থ। তিনি দেখিয়েছেন পুরুষ নারীর প্রতি যে-সৌজন্য দেখিয়ে থাকে, তাতে মনে হয় যে নারীদের খুব মূল্য দেয়া হচ্ছে; তবে তাও করা হয় পুরুষের সুবিধারই জন্যে। নারী ভূমিকা নিয়ে রয়েছে যে-বিশ্বজনীন অসন্তোষ, অ্যাডলারের মতে তা নিতে পারে তিন রকম রূপ।
নারী হয়ে উঠতে পারে পুরুষের মতো সক্রিয়, বিদ্রোহ ক’রে সে ক্ষতিপূরণ করতে পারে নিজের অবস্থার। এ-ই হচ্ছে পুরুষালি প্রতিবাদ, যার অপব্যাখ্যা করেছেন ফ্রয়েড; তবে পুরুষালি প্রতিবাদের আশ্রয় নিতে পারে নারীপুরুষ উভয়ই, যখন তারা দেখে যে তাদের মানসম্মান বিপন্ন। তার মতে নারীর জন্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে বিশেষ সীমা, ওই সীমা থেকে নারী একটু ক’রে গেলেই তার নিন্দা করা হয় পুরুষালি বলে। তিনি বলেন, এটা কোনো রহস্যময় ক্ষরণের ফলে ঘটে না, ঘটে বিশেষ স্থানে ও কালে, কেননা এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই। নারী আরেক ধরনের প্রতিবাদ জানায় নিজেকে সম্পূর্ণ নারী ক’রে, পুরুষের পুরোপুরি অধীন হয়ে, নিজের ব্যর্থতায় নিজেকে অসুস্থ ক’রে।
আছে আরেক ধরনের নারী, যারা ভাবতে পারে যে পুরুষই সব, তারা নিজেরা কোনো কাজের নয়, সম্পূর্ণ অযোগ্য তারা; তাদের অধীনতা ন্যায়সঙ্গত। তাদের এ-মনোভাবও একধরনের প্রতিবাদ, পরোক্ষ প্রতিবাদ : পুরুষের ওপর সমস্ত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে, নিজেরা সামান্যও দায়িত্বভার না নিয়ে তারা জানায় প্রতিবাদ। তাদের ভাব এমন : যেহেতু তোমরা পুরুষ, তাই তোমাদেরই সব কিছু করতে হবে, আমরা কিছু করতে পারবো না। ফ্রয়েডের পুংগূঢ়ৈষ্যা তিনি মানেন নি, মানেন নি শিশ্নাসূয়া। তিনি মনে করেন ফ্রয়েড যে-সবকে মনে করেন জৈবিক ও বিশ্বজনীন, তা আসলে সামাজিক; তাই দরকার সমাজবদল।
ফ্ৰয়েড মনোবিজ্ঞানের নামে নারী সম্পর্কে প্ৰকাশ করেছিলেন একরাশ পুরুষতান্ত্রিক কুসংস্কার; পুরুষাধিপত্যকে তিনি ক’রে তুলেছিলেন জৈবিক, যদিও তা সাংস্কৃতিক। তাঁর প্রভাবেরও সীমা ছিলো না; তিনিই যেহেতু ছিলেন মনোবিজ্ঞানের শেষ কথা, তাই দেখা দিয়েছিলেন তাঁর অসংখ্য অনুসারী, ও জনপ্রিয় ভাষ্যকার, যারা প্রচার ক’রে চলছিলেন যে নারী বিকলাঙ্গ, আর পুরুষাধিপিত্য মেনে নেয়াই নারীজীবনের সার্থকতা। চল্লিশের দশকে দেখা দেন একদল মনোবিজ্ঞানী, যাদের বলা হয় উত্তর-ফ্রয়েডীয়, যাদের মধ্যে ছিলেন অনেক নারীও; কিন্তু তারা ফ্রয়েডের সমস্ত কুসংস্কারকে চূড়ান্ত বিজ্ঞান মনে ক’রে বিচিত্ৰভাবে প্রমাণ করেন যে নারী বিজ্ঞানসম্মতভাবেই বিকলাঙ্গ পুরুষ।
ইয়ুং ফ্ৰয়েডকে বলেছিলেন, ফ্রয়েডের মৃত্যুর পরে তাঁর অনুসারীরা তাঁর ভুলগুলোকেও ‘পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন’ হিশেবে গণ্য করবে, তা প্রমাণিত হয় সত্য ব’লে। উত্তর-ফ্রয়েডীয়রা ফ্রয়েডের সমস্ত ভুলকে ধ্রুব জ্ঞান ক’রে সেগুলোকে চাপিয়ে দিতে থাকেন নারীর ওপর; জনপ্রিয় ভাষ্যকারেরা সেগুলোকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে নারীদের সন্ত্রস্ত ক’রে তোলেন। ফ্রয়েডের নারীতিত্ত্বের দুজন আদি সম্প্রসারণকারী নারী : মারি বোনাপার্তা ও হেলেন ডয়েটশ; কিন্তু তারা কোনো প্রশ্ন তোলেন নি ফ্রয়েডের নারীমনোবিজ্ঞান সম্পর্কে, বরং তারা ফ্রয়েডকে ছাড়িয়ে গিয়ে প্রবলভাবে প্ৰকাশ করেন নারী সম্পর্কে ছদ্মবৈজ্ঞানিক কুসংস্কার। যেমন ফ্রয়েডীয় নারীর অক্রিয়তা ও মর্ষকামতত্ত্বকে বোনাপার্ত [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ২০8)] চরমরূপ দেন এভাবে :
‘পশু বা উদ্ভিদ, প্ৰাণীজগতের সবটা জুড়েই অক্রিয়তা হচ্ছে নারীকোষেব বৈশিষ্ট্য, ডিম্বের লক্ষ্যই হচ্ছে পুরুষকোষের জন্যে অপেক্ষা করা, অপেক্ষায় থাকা যে সক্রিয় সচল শুক্রাণু আসবে ও তাকে বিদ্ধ কববে। এমন বিদ্ধকরণেব অর্থ হচ্ছে তার কোষলংঘন, তবে কোনো জীবিত প্রাণীর কোষলংঘন বোঝাতে পারে ধ্বংস : মৃত্যু অথবা জীবন। তাই নারীকোষের উর্ববতা সূচিত হয় এক ধরনের ক্ষত দিয়ে; স্বভাবে, নারীকোষ আদিরূপেই ‘মর্ষকামী’।‘
তাঁর চোখে শুক্রাণু আক্রমণাত্মক, তাই পুরুষও আক্রমণাত্মক; একেই মনে করেন তিনি স্বাভাবিক। নারী তার খর্ব ভগাঙ্কুরের মতোই, তার পক্ষে আক্রমণাত্মক হওয়া অসম্ভব। বোনাপার্তের মতে, নারীর লিবিডো যেমন দুর্বল তেমনি দুর্বল তার আক্রমণাত্মকতা; তাই নারীকে থাকতে হবে পুরুষপর্যুদস্ত। তিনি প্রচার করেন যে পুরুষ যেহেতু জৈবিকভাবেই আক্রমণাত্মক, তাই তার আধিপত্য অনিবাৰ্য। এ-সবই হচ্ছে ফ্ৰয়েডীয় তত্ত্বকে ধ্রুব মনে ক’রে চরমে নিযে যাওয়া, ফ্রয়েডেব কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমৰ্পণ করা, ও নারীকে সমর্পণ করা পুরুষের কাছে। বোনোপার্ত আত্মসমর্পণ করেছিলেন সম্পূর্ণরূপে ফ্রয়েডের কাছে, তাই নারী তার কাছে চরম মর্ষকামী; তিনি মনে করেন নারী সঙ্গমে যে সুখ পায়, তা আসলে উৎপীড়িত হওয়ারই সুখ। তার মতে সঙ্গমে নারী উপভোগ করে শিশ্নের প্রহার; সে শিশ্নের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়, সে ভালোবাসে শিশ্নের সন্ত্রাস! নারী যদি পছন্দ না করে শিশ্নের সন্ত্রাস, তাহলে?
তাহলে, ফ্রয়েড যেমন বলেছেন, তা নারীরই অপরাধ বা বিকার; যে-নারী এটা পছন্দ করে না সে পুংগূঢ়ৈষাগ্ৰস্ত, পুরুষালি প্রতিবাদের শিকার! ফ্রয়েড বলেছেন, স্বাভাবিক নারী সঙ্গমে সুখ বোধ করে যোনির ভেতরে, স্বাভাবিক নারীর পুলক হচ্ছে যোনীয় পুলক; শুধু বিকৃতরা পুলক বোধ করে ভগাঙ্কুরে, তারা ভগাঙ্কুরীয়। ভগাঙ্কুরীয় হওয়া বিকার ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে; তাই এমনভাবে সঙ্গম করতে হবে যাতে শিশ্ন একটুও স্পর্শ না করে ভগাঙ্কুরটিকে। বোনাপার্ত নারীকে শুধু মর্ষকামী হিশেবে বর্ণনা করেন নি, তিনি অনুশাসন দিয়েছেন যে নারীকে হতেই হবে মর্ষকামী। যে হবে না সে বিকৃত। তবে এতে কোনো বিজ্ঞান নেই, রয়েছে ভিক্টোরীয় কুসংস্কার; ফ্রয়েডের ভুল পদতলে নারীসমৰ্পণ।
ফ্রয়েডের ভ্রান্তি আর কুসংস্কারগুলোকে ধ্রুব সত্যরূপে মেনে নিয়েছিলেন আরেক নারী মনোবিজ্ঞানী। তিনি হেলেন ডয়েটশ, যার দু-খণ্ডের ‘নারীমনোবিজ্ঞানমনোবিশ্লেষণাত্মক ভাষ্য’ (১৯৪৪) এক সময় হয়ে উঠেছিলো খুবই প্রভাবশালী, এমনকি দ্য বোভোয়ারও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন তার নানা অপব্যাখ্যা। তিনি নারীত্বকে অক্রিয়তার ও পুরুষত্বকে সক্রিয়তার সাথে অবিচ্ছেদ্য ক’রে তুলেছিলেন; শুধু কামে নয়, জীবনের সব এলাকায়। লৈঙ্গিক রাজনীতি তিনি শুরু করেছিলেন শয্যায়, এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন জীবনের সবখানে। যে-নারী সক্রিয়, তার মতে সে-ই পুংগূঢ়ৈষাগ্রস্ত; ওই পুংগূঢ়ৈষ্যার মূলে রয়েছে নারীর খোজাত্ব, তার শিশ্ন আর অণ্ডকোষের অভাব। তার মতেও নারীর তিন মৌল বৈশিষ্ট্য আত্মপ্রেম, ক্রিযতা, ও মর্ষকাম।
তার চোখেও নারী বিকলাঙ্গ পুরুষ, যার শিশ্ন নেই, রয়েছে একটি অক্ষম খর্ব ভগাঙ্কুর; এবং দেহসংস্থানই নারীর নিয়তি। যে-নারী আত্মপ্রেমিক, অক্রিয়া, মধকামী, সে-ই স্বাভাবিক নারী তার চোখে; আর অস্বাভাবিক তারা, যারা বর্জন করে আত্মপ্ৰেম, যারা পোষণ করে বাস্তব জীবনে সাফল্যের লক্ষ্য, যারা উপভোগ করে না মর্ষকাম। স্বাভাবিক হয়ে ওঠার জন্যে নারীকে ছেড়ে দিতে হবে সব লক্ষ্য, জীবনকে চরিতার্থ ক’রে তুলতে হবে স্বামী বা পুত্রের কাজ ও সাফল্যের মধ্যে। তার মতে যে-নারীরা অর্জন করেছে নানা সাফল্য, তারা তা অর্জন করেছে স্বাভাবিক নারীত্ব বিসর্জন দিয়ে; তাই তারা বিকৃত।
স্বাভাবিক নারী, ডয়েটশের মতে, হবে কামপরায়ণ; তার জীবনের লক্ষ্যই হবে প্রেম দেয়া ও পাওয়া; এ-স্বাভাবিক নারীরা বিশিষ্ট ক’রে তুলতে চায় না নিজেদের, তারা একাত্ম বোধ করে কোনো পুরুষের সাথে, এবং এর মধ্য দিয়েই বোধ করে জীবনের চরিতার্থতা। যে-নারী সাফল্য অর্জন করতে চায় সে বিকৃত, সে পুরুষালি প্রতিবাদের শিকার, যেমন তিনি দেখিয়েছেন যে, জর্জ স্যা শিকার ওই রোগের। এ-মনোবিজ্ঞানী, যিনি নিজে নারী ও সাফল্য অর্জন করেছিলেন পুরুষের ক্ষেত্রে, আসলে বিশ্বাসী ছিলেন নারী সম্পর্কে কুসংস্কারে, এবং প্রথাগত নারী ধারণায় [দ্র গ্রিয়ার (১৯৭০, ৯৪-৯৫)] :
‘যদি তাদের থাকে প্রচুর পরিমাণে বোধি, যেটা নারীর বৈশিষ্ট্য, তারা হয় আদর্শ সহচরী, যারা নিয়ত অনুপ্রাণিত করে তাদের পুরুষদের, এবং তারা এ-ভূমিকায় পায় সবচেয়ে বেশি সুখ। তাদের সহজেই প্রভাবিত করা যায় এবং তারা তাদের সঙ্গীদের সাথে খাপ খাইয়ে নেয় এবং তাদের বুঝতে পারে। তারা সুন্দরতম ও সবচেয়ে কম আক্রমণাত্মক সঙ্গিনী এবং তারা থাকতে চায় ওই ভূমিকায়ই তারা নিজেদের অধিকারের জন্যে চাপ দেয় না-বরং তার বিপবীত। শুধু প্রেম দিয়ে তাদের যে-কোনোভাবে সহজে চালানো যায়। কামে তারা সহজেই উদ্দীপিত হয় এবং খুব কম সময়ই তারা কামশীতল; তবে কামে তারা আরোপ করে মর্ষকামী শর্ত যা অবশ্যই পরমভাবে পরিতৃপ্ত করতে হবে। তারা প্রেম চায় এবং প্রত্যাখান কবে সব ধরনের সক্রিয় প্রবণতা।
যদি তাদের কোনো প্রতিভা থাকে তবে তারা ওই শক্তিকে মৌলিক ও সৃষ্টিশীলভাবে কাজে লাগায়, তবে তারা প্রতিযোগিতামূলক সংগ্রামে যোগ দেয় না। তারা সব সময়ই নিজেদের অর্জন বিসর্জন দিতে প্ৰস্তুত, এতে তারা একটুও মনে করে না যে তারা কিছু বিসর্জন দিচ্ছে, এবং তারা তাদের সহকর্মীদেব সাফল্যে উল্লাস বোধ করে, যাদের তারা অনুপ্রাণিত করেছে। যখন তারা নিয়োজিত হয়। কোনো বহির্মুখি কাজে তখন তারা অত্যন্ত প্রয়োজন বোধ করে সহায়তার, তবে তারা যখন তাদের অন্তর্জীবনের কোনো অনুভূতি বা চিন্তায় জড়িত হয়, অর্থাৎ নিয়োজিত হয় অন্তর্মুখি কাজে তখন তারা চূড়ান্ত স্বাধীন। তাদের পুরুষেব সাথে একাত্মতাবোধের শক্তি কোনো আন্তর দারিদ্র্যের প্রকাশ নয়, বরং আন্তব সম্পদের প্রকাশ।‘
এটা নারীর বৈজ্ঞানিক বর্ণনা নয়, এটা অনুশাসন; তিনি চান এমন আদর্শ নারী, যা শুধু দুষ্প্রাপ্যই নয়, অসম্ভব। তাঁর নারী বর্জন করবে নিজের সত্তা। এমন নারী কোনো মানুষ নয়, সে নিজের জন্যে বাঁচে না; তবে নারী নিজের জন্যেও বেঁচে থাকে। এমন নারী জীবিত থাকে যখন তার পাশে থাকে কোনো পুরুষ, যার ওপর সে শুধু নির্ভরই করে না, যে তার প্রাণধারণের নিশ্বাস। ডয়েট্শ নারীকে পরামর্শ দিয়েছেন নিজেকে প্রত্যাখ্যান করার, পুরুষের সহচরী হয়ে ওঠার, পুরুষের সাথে খাপ খাওয়ানোর ও একাত্মাতাবোধের; এর বদলে নারী পাবে সব কিছু। সে পাবে পুরুষের আদর, কাম, প্রেম, গৃহ; পুরুষ তাকে প্রভাবিত করবে, যেমন ইচ্ছে চালাবে, চাষ করবে, যেখানে ইচ্ছে রাখবে।
এমন নারী আকর্ষণীয় মনে হ’তে পারে অনেকের কাছে, কিন্তু আসলে এমন ডয়েটুশীয় নারী আপাদমস্তক ক্লান্তিকর। সে আত্মবিসর্জনের মর্মস্পৰ্শী উদাহরণ। একে মনোবিশ্লেষণ হিশেবে চালিয়েছেন ডয়েট্শ, তবে এ হচ্ছে নারী সম্পর্কে প্রথাগত কুসংস্কার। তাঁর বইয়ের দু-খণ্ডকে এক সময় মনে করা হতো নারী সম্পর্কে শেষকথা, কিন্তু তিনি নিজে নারী হয়েও প্রচার করেছিলেন পুরুষতান্ত্রিক কুসংস্কার; বোনাপার্ত ও ডয়েট্শ্ পুরুষতন্ত্রে দীক্ষার মর্মস্পশী উদাহরণ।
চল্লিশের দশকে শুরু হয় ফ্রয়েডীয় নারীতত্ত্বের জনপ্রিয়করণ, বিচিত্র ধরনের রচনা ও বইয়ে চারপাশ ছেয়ে যায়, প্রতিক্রিয়াশীলতা উপচে পড়তে থাকে ঝকঝকে ছাপা পৃষ্ঠার ভেতর থেকে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মনোবিশ্লেষক ফার্ডিনান্ড লুন্ডবার্গ ও সমাজতাত্ত্বিক মারিনিয়া ফার্নহ্যামের আধুনিক নারী, বিলুপ্ত লিঙ্গ (১৯৪৭) নামের একটি চরম প্রতিক্রিয়াশীল বই। বইটি সাধারণ পাঠকদের ও পাঠ্যপুস্তক হিশেবে তরুণতরুণীদের অত্যন্ত প্রভাবিত করে। বইটি মধ্যযুগের একটি প্রচারপুস্তক; এটিতে আধুনিক সমস্ত কিছুকে নিন্দা করা হয়, মধ্যযুগকে চিত্রিত করা হয় স্বর্ণযুগ রূপে, আর সমস্ত আধুনিক প্রগতিশীল আন্দোলনগুলোর বিরুদ্ধে প্রচার করা হয় ঘৃণা। তাদের বিশেষ আক্রমণের লক্ষ্য নারীমুক্তি আন্দোলন। লেখকদের মতে, যাদের একজন নারী, বর্তমান কালের অনেক নিষ্টের মূলেই রয়েছে নারীবাদ, এবং এরই জন্যে নারী পরিণত হয়েছে ‘বিলুপ্ত লিঙ্গ’-এ। তাদের মতে নারীবাদের মূলকথা বিদ্বেষ, নারীবাদ একধরনের নাৎসিবাদ।
এ-প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের মতে মার্ক্স আর মিল বিকৃত পুরুষ, আর বিশেষভাবে বিকৃত হচ্ছেন মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্। ওই নারীই শুরু করেছিলেন নারীবিপ্লব নামক উন্মত্ততা! তাঁদের মতে নারীবাদ শুধু অশুভই নয়, একটি রোগ, মনোবিকার, গৃহের শত্রু; নারীবাদ আবেগগত রুগ্নতার প্রকাশ। তাদের মতে নারীপুরুষের মধ্যে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, সাম্য প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষ্য থাকলে তারা শারীরিকভাবে একই হতো। তারা ঘোষণা করেন যে নারীবাদীরা পুরুষ হ’তে চায়, তারা ভোগে চরম শিশ্নাসূয়ায়। তাদের মতে, ‘নারীবাদ হচ্ছে নারীর আত্মহত্যা, পুরুষের মতো বাঁচার প্রয়াস’ [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ২০০৮)]।
তাঁদের মতে মা হওয়া ছাড়া নারীর অন্য কোনো ইচ্ছে পোষণ করাই অসম্ভব অভিলাষ, পুরুষ হওয়ার অভিলাষ; এবং তারা ওই অভিলাষকে তিরষ্কার করেন প্ৰাণ ভরে। তাঁরা চান নারী থাকবে নারী হয়ে; তারা মা হবে, পুরুষের অধীনে থাকবে, পুরুষের ওপর নির্ভরশীল থাকবে। নারী সৃষ্টি হয়েছে শুধু এ-জন্যেই। তাদের মতে নারীবাদী আন্দোলন কমিয়ে দিয়েছে বিবাহ ও সংসারের মহিমা; আর নারীবাদীরা যে পুরুষের জন্যে এক নৈতিকতা আর নারীর জন্যে আরেক নৈতিকতার বিরুদ্ধে প্ৰতিবাদ জানায়, তার কারণ তাদের ভেতরে রয়েছে। অবৈধ কামের গভীর বাসনা। তাঁরা বিবাহপূর্ব কৌমাৰ্য চান, তবে তা শুধু নারীর জন্যে; আর মনে করেন যে নারীপুরুষের ভিন্ন নৈতিকতা শুধু অনিবাৰ্যই নয়, বিশেষভাবেই কাম্য। তারা জয়গান করেন নারীত্বের, পরিবারের, নারী-অধীনতার, মাতৃত্বের। তাদের মতে পুরুষ থাকবে পুরুষের এলাকায়, নারী নারীর এলাকায়। যে-নারী খাপ খাওয়াতে পারে না পুরুষতন্ত্রের সাথে, তারা বিকৃত, ব্যাধিগ্রস্ত। এ-দুই লেখক মনোবিজ্ঞানের নামে প্রচার করেছেন প্রতিক্রিয়াশীলতা; তাদের বইয়ের ভেতর কোনো মনোবিজ্ঞান নেই, আছে অপবিজ্ঞান।
এক মনোবিশ্লেষক, এরিক এরিকসন, নারীকে ঘরে আটকে রাখার জন্যে বের করেন ইনার স্পেস বা অন্তর বা আভ্যন্তর জগততত্ত্ব। তিনি গবেষণা করেন কিশোরকিশোরীদের নিয়ে, তাদের হাতে দেন নানা মালমশলা এবং তৈরি করতে বলেন মনের মতো কাঠামো। তিনি দেখতে পান মেয়েরা বানাতে পছন্দ করে কোনো গৃহের অভ্যন্তর, যেখানে আছে সুখশান্তি; তারা তৈরি করে স্থির নানা অবস্থা, যেমন কেউ পিয়ানো বাজাচ্ছে। অন্যদিকে ছেলেরা তৈরি করে উঁচু অট্টালিকা, অট্টালিকার ভেঙে পড়া, এবং সড়ক, যেখান দিয়ে ছুটে চলছে যানবাহন। এ দেখেই এরিকসন ঠিক ক’রে ফেলেন যে এর সাথে সম্পর্ক আছে নারীপুরুষের লিঙ্গসংস্থানের; পুরুষ চায় উচ্চতা, সক্রিয়তা; নারী চায় অবরোধ, নিরাপত্তা।
তিনি তত্ত্ব তৈরি করে ফেলেন যে নারীর শরীরসংগঠনই, তার জরায়ু ও যোনির আভ্যন্তর জগতই স্থির করে দেয় নারীর সত্তা, যা ভিন্ন পুরুষের থেকে। যেনো নারীর দেহসংগঠন পরিকল্পনার মধ্যেই রয়েছে শিশুপালনের শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক অঙ্গীকার! ফ্রয়েড বলেছিলেন যে নারী বোধ করে তার শিশ্ন নেই, আর এরিকসন আবিষ্কার করেন যে নারী বোধ করে যে তার অভ্যন্তরে একটি জগত রয়েছে, যেটির নাম জরায়ু। এরিকসন যে-উপাত্ত থেকে এতো বড়ো সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন, তা একটু ভালোভাবে দেখলেই তার ইনার স্পেস ও আউটার স্পেসতত্ত্ব ভেঙে পড়ে। মধ্যবিত্ত কিশোরকিশোরীরা বড়ো হয় যে-আবহাওয়ার মধ্যে, তাই তাদের শিখিয়ে দেয় যে মেয়েরা ভালোবাসবে ঘর, আর ছেলেরা বাইর, তাই তারা মেয়েলি ব্যাপারগুলোই বেছে নেয়, ছেলেরা বেছে নেয় পুরুষের ব্যাপারগুলো। এরিকসনের ইনার স্পেস, আউটার স্পেসতত্ত্ব আমেরিকার মহাকাশ বিজয়ের সময়ের এক মার্কিন মনোবিশ্লেষকের অপবৈজ্ঞানিক পাগলামো! অন্যরা অন্তত পুরুষের জন্যে বাইর রেখে নারীর জন্যে রেখেছিলেন ঘর; মার্কিন মহাজগতমত্ততার কালে এ-বিজ্ঞানী পুরুষের জন্যে রাখেন মহাজগত, আর নারীর জন্য রাখেন জরায়ু।
মনোবিশ্লেষণাত্মক কুসংস্কারের পর পশ্চিমে নারী সম্পর্কে ছড়িয়ে পড়ে সমাজতাত্ত্বিক কুসংস্কার; সমাজবিজ্ঞানীরা সমাজকে স্থির ক’রে দেয়ার জন্যে তৈরি করেন এক ঝকঝকে তত্ত্ব, তার নাম দেন ফাংশনালিজম বা ভূমিকাবাদ। তাঁরা কাজ করেন সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্ব নিয়ে, ঢুকে পড়েন পরিবারের ভেতরে, এবং তাদের বিদ্যাকে বিজ্ঞানসম্মত করার জন্যে নানা ধারণা ধার করতে থাকেন শরীরবিজ্ঞান থেকে, বিভিন্ন সামাজিক সংস্থাকে বর্ণনা করতে থাকেন সংগঠন, ভূমিকা ইত্যাদি ধারণার সাহায্যে, যেনো, যেমন ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১২) বলেছেন, ওই সব সংস্থার রয়েছে শক্ত অস্থি-পেশি প্রভৃতি।
তাঁরা তাদের বিদ্যাকে ক’রে তোলেন ছদ্মবিজ্ঞান। তাঁরা বর্ণনার বদলে প্রচার করতে থাকেন অনুশাসন; কে কী ভূমিকা পালন করে, তার বদলে নির্দেশ দিতে থাকেন কার কর্তব্য কী ভূমিকা পালন। নারী হয়ে ওঠে ভূমিকাবাদের শিকার; নারীকে তারা বন্দী ক’রে ফেলেন নারী-ভূমিকায়। ভূমিকাবাদ বিবর্তনে বিশ্বাস করে না, মনে করে যে সব কিছু চিরস্থির হয়ে থাকবে, যে আছে যে-ভূমিকায় সে থাকবে তাতেই। লৈঙ্গিক বিপ্লবের লক্ষ্য হচ্ছে প্রথাগত লিঙ্গভেদ অস্বীকার করা, বিশেষ লিঙ্গের ব’লেই কাউকে পালন করতে হবে বিশেষ ভূমিকা বা হ’তে হবে বিশেষ মেজাজের, তা মেনে না নেয়া; আর ভূমিকাবাদের মূলকথা ওই সব মেনে নেয়া। ভূমিকাবাদীরা ফ্ৰয়েডীয় মনোবিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক নৃতত্ত্ব, গণিত প্রভৃতি মিশিয়ে তৈরি করেছিলেন এমন এক অপবিজ্ঞান, যার সারবাণী হচ্ছে গৃহই নারীর স্থান। ‘আধুনিক বিবাহ’ (১৯৪২) নামের এক বইয়ে এক সমাজবিজ্ঞানী লিখেছেন [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১৪)] :
‘নারীপুরুষ পরিপূরক!…পুরুষ ও নারী মিলে গ’ড়ে তোলে এক কার্যকর একক। একলা প্রত্যেকেই অসম্পূর্ণ। তারা পরিপূরক।… পুরুষ ও নারী যখন নিয়োজিত হয় একই পেশায় বা সম্পন্ন করে একই ভূমিকা, তখন এ-পরিপূরক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।’
একথা বলার জন্যে নতুন সমাজবিজ্ঞানীর দরকার ছিলো না; টেনিসন, রাসকিন ও অনেক ভিক্টোরীয় মহাপুরুষ একথা বলে গেছেন আরো আকর্ষণীয় মৌলিক ভঙ্গিতে; কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হচ্ছে যে একথা আবার বলা হয়েছে বিশশতকের চল্লিশের দশকে, বলেছেন ‘বিজ্ঞানী’!
এ-বিজ্ঞানীরা তরুণীদের শিখিয়েছেন যে সারা জীবনের জন্যে কোনো পেশা গ্রহণ করা ঠিক নয়। যদি কোনো পেশা নিতে হয়, তবে নিতে হ’বে কিছু কালের জন্যে; ওই সময় চেষ্টা চালাতে হবে বিয়ের জন্যে, আর বিয়ে হয়ে গেলে পেশাকে বিদায় দিয়ে ঢুকতে হবে ঘরে, জরায়ুকে চরিতার্থ ক’রে তুলতে হবে মাতৃত্বে। তাঁরা শিখিয়েছেন বিয়ে আর পেশা একসাথে চালানো খুব খারাপ, পেশার থেকে বিয়ে অনেক ভালো; তাই ছেড়ে দিতে হবে বাইরের জীবন। কারণ মেয়েরা গৃহেই সুন্দর। তাঁরা শিখিয়েছেন যদি মেয়েরা পেশাই বেছে নেয়, তবে তাদের থাকতে হতে পারে চিরঅবিবাহিত; যদি তারা মিলন ঘটাতে চায় বিয়ে ও পেশার, তবে তা ডেকে আনবে বিপর্যয়।
ওই বিজ্ঞানীরা পরিসংখ্যানের পর পরিসংখ্যান ছেপে প্রমাণ ক’রে দিয়েছেন যে খুব বেশি মানুষের পক্ষে একই সাথে দুটি পেশা, সংসার ও চাকুরি, চালানো সম্ভব নয়, তা পারে শুধু অসাধারণেরা। কেননা এ-পেশা দুটির দাবি দু-রকম: সংসার চমৎকারভাবে চালানোর জন্যে দরকার নিজেকে পুরোপুরি অস্বীকার করা, দরকার পারস্পরিক সহযোগিতা; আর চাকুরির জন্যে দরকার আত্মবিকাশ, প্রবল প্ৰতিযোগিতা। তারা তরুণীদের জানিয়েছেন যে আত্মবিকাশ খুব বিপজ্জনক ব্যাপার, খুবই সহজ ও মনোরম হচ্ছে আত্মঅস্বীকার। তারা শিখিয়েছেন সংসারে সুখী হওয়া যায়। তখনই যখন স্বামী-স্ত্রী হয় পরস্পরের পরিপূরক, স্ত্রী থাকে ঘরে স্বামী বাইরে। দুর্ঘটনা ঘটে যখন দুজনই করে একই কাজ। এ হচ্ছে বিজ্ঞানসম্মত ভূমিকাবাদ। ভূমিকাবাদীদের প্রধান ছিলেন ট্যালকট পারসন্স্, যিনি মার্কিনদেশে নারীপুরুষের ভূমিকা বিশ্লেষণ ক’রে দেখান যে নারীর শ্রেষ্ঠ ভূমিকা হচ্ছে গৃহিণীর ভূমিকা! তাঁর মতে [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১৬)] :
‘নারীর মৌল মর্যাদা হচ্ছে স্বামীর স্ত্রী, আর সন্তানের মায়ের মর্যাদা।‘
এটা অসার মর্যাদা; নিজের নয়, অন্যের থেকে তার ওপর পতিত মৰ্যাদা; আর একথা বলার জন্যে কোনো নতুন সমাজবিজ্ঞানীর দরকার ছিলো না, পুরুষতন্ত্রের বিভিন্ন বই আর মনীষী এসব বলে আসছে কয়েক হাজার বছর ধরে। পুরুষ তো পিতা আর স্বামী হওয়ার মর্যাদায় গৌরব বোধ করে না। নারী ব্যস্ত থাকবে ঘর আর সন্তান নিয়ে? তবে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন নারীর ঘরকন্নার কাজ গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে, দিনভর করার মতো কাজ আর সংসারে নেই; তিনি স্ত্রীর জৌলুশপূর্ণতার কথা বলেছেন, তবে দেখেছেন ওটা থাকে শুধু যৌবনের কালে; তারপর সব কিছু ধ’সে পড়ে।
পারসন্স চান সমাজ যেভাবে চলছে চলবে সেভাবেই, নারী পালন ক’রে যাবে তার প্রথাগত দাসীর ভূমিকা। তিনি, ও তাঁর সঙ্গীরা, জানেন সমাজ চলছে, কেননা বিপুল জনগোষ্ঠি মেনে নেয় তাদের অবস্থা, তারা খাপ খাইয়ে নেয় তাদের ভূমিকার সাথে। সমাজ তাদের বিন্যস্ত করে যেখানে সেখানে থেকেই তারা পালন করে তাদের ভূমিকা; ব্ৰাহ্মণ পালন করে ব্ৰাহ্মণের শূদ্ৰ পালন করে শূদ্রের ভূমিকা; তাঁরা চান এ-ভূমিকা পালন চলবে চিরকাল। বালিকা, যেহেতু ভবিষ্যতে হবে স্ত্রী, প্রস্তুতি নেবে স্ত্রী হওয়ার; বালক নেবে স্বামী হওয়ার প্রস্তুতি। বালিকা প্ৰস্তুতি নেবে আনুগত্যের, নির্ভরতার; বালক নেবে স্বাধীনতা, আধিপত্য, আক্রমণাত্মকতা, ও প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি।
এক ভূমিকাবাদী সমাজবিজ্ঞানী একটি আদর্শ সমকালীন তরুণীর চিত্র এঁকেছেন এভাবে [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১১৮)] :
‘আজকের ঐতিহাসিক মুহূর্তে, শ্ৰেষ্ঠ খাপ-খাওয়া মেয়ে সম্ভবত সে, যার পরীক্ষায় ভালো করার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি আছে, তবে সব বিষয়ে ‘এ’ পাওয়ার মতো মেধা নেই…যে বেশ উপযুক্ত, তবে সে-সব বিষয়ে নয় যেগুলো নারীদের কাছে নতুন; যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে এবং নিজের জীবিকা অর্জন করতে পাবে, কিন্তু পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো ভালোভাবে পারে না; কোনো কাজ ভালোভাবে করতে পারে (যদি সে বিয়ে না করে, বা অন্য কোনো কারণে তাকে কাজ করতে হয়) তবে সে তার পেশার সাথে একাত্ম বোধ করে না, নিজের সুখের জন্যে তা দরকারি মনে করে না।‘
যে-আদর্শ মেয়েটিকে তিনি কামনা করেছেন, সে চিরবালিকা; ভূমিকাবাদীরা চান তাই। এখানে পাই একটি শোচনীয় মেয়েকে, যার শরীরের ভাজ আর মস্তিষ্কের কোষ সবই পুরুষের জন্যে। পরীক্ষায় সে ভালো করবে, কিন্তু বেশি ভালো করবে না; সে চাকুরি করবে, কিন্তু বেশি ভালো চাকুরি করবে না। ওসব করবে ছেলে। সে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেবে নারীর ভূমিকায়। এসব কথা অনেক আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে অনেক আগে বলেছেন রাসকিন ও অন্যান্য ভিক্টোরীয়। তবে ভিক্টোরীয়রা বিজ্ঞানের বেশে এগুলো প্রকাশ করেন নি, এরা প্রতিক্রিয়াশীলতা প্ৰকাশ করেছেন বিজ্ঞানের বেশে। বিজ্ঞানীরা, ও বিজ্ঞান, হয়ে থাকেন ভবিষ্যৎমুখি, কিন্তু ভূমিকাবাদী এ-সমাজবিজ্ঞানীরা পুরোপুরি বর্তমানগ্রস্ত; না, তারা সম্পূর্ণরূপে অতীতগ্রস্ত।
তাঁরা তাদের তত্ত্বে শক্তিশালী ক’রে তুলেছেন বাতিল অতীতের কুসংস্কার, এবং রোধ করতে চেয়েছেন পরিবর্তন। ভূমিকাবাদ বিজ্ঞান নয়, অনুশাসন; আগে যে-বিধান দেয়া হতো ধর্মের নামে, ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞান থেকে পারসন্সীয় ভূমিকাবাদ তাই করে ছদ্মবিজ্ঞানের নামে। ধর্মকে অস্বীকার করা সম্ভব, কিন্তু বিজ্ঞানকে অস্বীকার আজকাল অসম্ভব; তাই এসব নারীর ক্ষতি করেছে খুবই বেশি। ভূমিকাবাদ চায় যে মানুষ খাপ খাইয়ে চলবে তার অবস্থার সাথে, কেননা খাপ খাওয়ানোই স্বাভাবিকতা। ভূমিকাবাদীরা দেখেছেন প্রথাগত ব্যবস্থা বেশ কার্যকর, তাই তারা বিধান দিয়েছেন যে তাই ঠিক, এবং তাই মেনে চলতে হবে। তারা নারীদের আবার ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন ঘরে, নারীদের ক’রে তুলতে চেয়েছিলেন মাৰ্গারেট মিডের ভাষায় আধুনিক ‘গুহামানবী’।
মিড নিজে যদিও মুক্তি আদায় ক’রে নিয়েছিলেন পুরুষতন্ত্রের শেকল থেকে, তবু তিনি নিজেও পরে অজ্ঞাতসারে কাজ করেছেন পুরুষতন্ত্রের পক্ষে; এবং শেষে বুঝতে পেরেছেন ভুল ক’রে ফেলেছেন অনেকখানি। বিশশতক আধুনিক সময় হিশেবে চিহ্নিত, কিন্তু এর বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানে ছড়িয়ে আছে কুসংস্কার, যার একটি বড়ো লক্ষ্য নারীকে পুরুষাধীন ক’রে তোলা।