ফ্ৰয়েডীয় কুসংস্কার, ও মনোবিশ্লেষণাত্মক-সমাজবৈজ্ঞানিক প্রতিক্রিয়াশীলতা
(প্রথম ভাগ)
বিশশতকের এক বড়ো স্থপতির মহিমা পেয়েছেন সিগমুন্ড ফ্ৰয়েড; অবচেতনার আবিষ্কারকরূপে তাঁর জুটেছে খণ্ডকালীন অমরতা। এ-শতকের মানবিক সমস্ত কিছুর ওপর পড়েছে এ-মনোবিশ্লেষকের প্রভাব, নারীও তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে নি। তার আবিষ্কার মূল্য পেয়েছে নতুন কোনো সৌরলোক আবিষ্কারের থেকেও বেশি, কেননা তিনি উদঘাটন করেছেন মহাজগতের দুর্জেয়তম সৌরলোক–মানুষের মন-এর সূত্র! তবে এখন খুব বিরক্তিকর প্রশ্ন জাগছে তাঁর আবিষ্কার সম্পর্কে বিশশতকের শ্রেষ্ঠ কিংবদন্তি যে-অবচেতনা, তাও আজ বিপন্ন।
নারীসম্পর্কে ফ্ৰয়েডের সমস্ত সিদ্ধান্ত এখন গণ্য হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক বলে; শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীলও : একরাশ পিতৃতান্ত্রিক, গোত্রীয় ও ব্যক্তিগত কুসংস্কার তিনি পেশ করেছিলেন মনোবিশ্লেষণরূপে। ফ্ৰয়েড যখন উদঘাটন ও প্রকাশ করে চলছিলেন ‘মনের অদৃশ্য’ সূত্র, শোনাচ্ছিলেন লিবিডো, অহম্, অবচেতনা, ইডিপাস-ইলেক্ট্রা গুঢ়ৈষা, শিশ্নাসূয়ার পুরাণ; কামকে ক’রে তুলছিলেন বিশশতকের আল্লা; বিহ্বল হয়ে পড়ছিলো চারদিক। কেউ কেউ বিরোধিতা করেছেন তার : অ্যাডলার, হোরনি, টমসন সরে এসেছিলেন ফ্রয়োড়ীয় আঁধার থেকে; তবে ফ্রয়েডীয় আদিম অন্ধকারের পাতালে নেমে-যাওয়া বিশশতক তাদের আলোর ডাকে সাড়া দেয় নি।
ফ্রয়েডের মানুষধারণাকেই ভুল মনে হয় আজ; পিতৃতন্ত্রের, গোত্রের ও নিজের দুঃস্বপ্ন মানুষ নামে তিনি উপস্থাপিত করেছিলেন বিজ্ঞানের মুখোশ পরিয়ে। ফ্রয়েডের মানুষ জৈবিকভাবে নিয়ন্ত্রিত, যার মুক্তি নেই প্রবৃত্তির কারাগার থেকে; ফ্রয়েডের মানুষ এমন জীব, যার জন্ম সংঘাত থেকে, যে চালিত প্রবৃত্তি দিয়ে, যাকে ঘিরে আছে স্তরেস্তরে নিরাশা; যে নিরন্তর সংঘাতরতা নিজের আর বিশ্বের সাথে। ফ্রয়েডের লিবিডোতত্ত্ব সহজাত প্রবৃত্তির তত্ত্ব; লিবিডো হচ্ছে মানুষের মৌল কামশক্তি; মানুষের বিকাশ ঘটে ওই অন্ধ আদিম কামশক্তির সাথের ভয়াল সংঘাতের মধ্য দিয়ে; এ-সংঘাতের ভেতর দিয়ে বিকশিত হয় মানুষের চরিত্র, বিবেক ও সৃষ্টিশীলতা। ফ্রয়েডের জৈবিক প্রবৃত্তিনিয়ন্ত্রিত কামচালিত মানুষের সমস্ত বাস্তব কাজ তার অবদমিত কামের বহিঃপ্রকাশ।
গীতাঞ্জলি অবদমিত কামের প্রকাশ, আপেক্ষিকতত্ত্বও তাই। তার তত্ত্ব যে বিশশতককে সম্মোহিত করতে পেরেছিলো, তার কারণ বাইরে তা নিখুঁতভাবে বৈজ্ঞানিক, কিন্তু ভেতরে আদিম কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ওই তত্ত্বের আপাতজটিলতা, রহস্যময় কাব্যিকতা, প্রতীক ও চিত্রকল্পের ভীতিকরতা মুগ্ধ করেছিলো মানুষকে, যদিও তা সৃষ্টি করেছে মানুষ সম্পর্কে আদিম ও ভুল ধারণা।
হোরনি ছেড়ে দিয়েছিলেন ফ্রয়েডের লিবিডোতত্ত্ব; মানুষকে আদিম প্রবৃত্তির সংঘাতে জর্জরিত জীবরূপে দেখার বদলে তিনি দেখেছিলেন অশেষ সম্ভাবনাময়রপে। অ্যাডলার বেরিয়ে এসেছিলেন ফ্রয়োডীয় বৃত্ত থেকে; দাবি করেছিলেন যে মানুষ জৈবিক প্রবৃত্তির ক্রীড়নক নয়; কাম প্রধান নিয়ন্ত্রক নয় মানুষের। মানুষ খেলার পুতুল নয় অবচেতন শক্তিরাশির। অবচেতনার থেকে চেতনার মূল্য ছিলো তার কাছে বেশি; কিন্তু বিশশতকের মানুষ বিজ্ঞানের বিস্ময়ের মধ্যে বাস করেও নিজেদের দেখতে পছন্দ করেছে আদিম প্রবৃত্তি ও কামের ক্রীড়নকারূপে।
ফ্ৰয়েডের লিবিডো, অবচেতনা, প্রবৃত্তি সবই খুব সন্দেহজনক ব্যাপার। ফ্রয়েড আধুনিক কালে জন্ম দিয়েছিলেন পালেপালে আদিম মানুষ। ফ্রয়েড বিশ্বাসী ছিলেন অতীতে, অ্যাডলার ভবিষ্যতে; ফ্রয়েড মনে করতেন মানুষের প্রত্যাশা করার কিছু নেই, অ্যাডলার বিশ্বাস করতেন প্রত্যাশা আর সম্ভাবনাই মানুষ। ফ্রয়েড যে-অন্ধকারকে মানুষ নামে উপস্থিত করেছিলেন, তার হাতছানি ছিলো তীব্র; তাতে বিজ্ঞান, আদিমতা, কবিতা, কল্পনা, পুরাণ, কুসংস্কার ছিলো প্রচুর, তাই তাতে সাড়া দিয়েছে মানুষ। ফ্রয়েড বিশশতকের এক বড়ো স্থপতি, এবং পিতৃতন্ত্র, কুসংস্কার ও প্রতিক্রিয়াশীলতারও এক বড়ো মহাপুরুষ।
ফ্রয়েডের কুসংস্কার ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মর্মস্পশী রূপ ধরা পড়ে তাঁর নারীধারণায় ও নারীবিশ্লেষণে; তাই নারীবাদীরাই প্রথম প্রবলভাবে আক্রমণ করেন তাকে। নারীবাদীদের বহুমুখি তীব্র যৌক্তিক আক্রমণে তার জ্যোতিশ্চিক্রটি এখন ম্লান। দ্য বোভোয়ার (১৯৪৯, ৬৯-৮৩) ফ্রয়েডকে অনেকটা মেনে নিয়ে অনেকখানি প্রতিবাদ করেছিলেন চার দশক আগে, তাঁর অনেক কিছু বাতিল ক’রে দিয়েছিলেন বিনয়ের সাথে; তবে নবনারীবাদীরা তার মতো বিনয়ী নন : ফ্রাইডান (১৯৬৩, ৯১-১১১) ফ্রয়েডের প্রতিক্রিয়াশীল কুসংস্কারের রূপটি তুলে ধ’রে দেখান তাঁর ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা; আর মিলেট (১৯৬৯, ১৭৬-২২০) প্রচণ্ড আক্রমণ চালান ফ্রয়েড ও উত্তর-ফ্রয়েডীয়দের বিরুদ্ধে। তিনি কোনো কিছুই বিনাপ্রশ্নে মেনে নিতে রাজি নন; এবং বিজ্ঞানের নামে প্রচলিত সমস্ত কুসংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করতে দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ। প্রধানত মিলেটের মূর্তিভাঙা আক্রমণের ফলেই ফ্রয়েড নারীবাদীদের, এবং অন্যদের কাছেও, হয়ে ওঠেন এক প্রতিক্রিয়াশীল অবৈজ্ঞানিক নাম।
মিলেটের আক্রমণ তুলনাহীন ভাষায় ও যুক্তিতে। পরে নারীবাদীদেরই কেউকেউ, যেমন মিশেল (১৯৭৪), কিছুটা ভুল ধরার চেষ্টা করেন মিলেটের; অভিযোগ করেন যে মিলেট কোনো কোনো স্থলে বিশ্বস্তভাবে ফ্রয়েডকে উপস্থাপিত করেন নি। এসব সত্ত্বেও মিলেটের আক্রমণ যথাৰ্থ: ফ্রয়েড যেখানে উদঘাটন করেছেন মানুষ ও নারীর জৈবিক-মানসিক সূত্র, মিলেট সেখানে উদঘাটন করেছেন ফ্রয়েডের সীমাবদ্ধতার সামাজিক-সাংস্কৃতিক সূত্র; এবং দেখিয়েছেন পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব ও ভিক্টোরীয় রক্ষশীলতাই ফ্ৰয়েডকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে নারীত্ব সম্পর্কে ফ্ৰয়েডীয় সূত্ররাশি। ১৯৩০-১৯৬০ সময়টিতে পশ্চিমে ঘটেছিলো রক্ষণশীলতার প্ৰত্যাবর্তন; নানা ধরনের রক্ষণশীলতার মধ্যে একটি ছিলো নারীকে আবার নারী ক’রে তোলা, নারীকে আবার চিরন্তনী ক’রে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া।
এ-সময় পিতৃতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীলতার বন্যা ধর্ম থেকে আসে নি, এসেছিলো পশ্চিমের ঝকঝকে শাস্ত্রগুলো থেকে : সাহিত্য থেকে, এবং বিজ্ঞান থেকে, বিশেষ ক’রে মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব থেকে। বিজ্ঞানের মলাটের ভেতরে এ-সময়ের মহাপুরুষেরা পরিবেশন করেন পুরোনো পৃথক এলাকা ও ভূমিকাতত্ত্ব। মিলেটের (১৯৬৯, ১৭৮) মতে এঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী সিগমুন্ড ফ্রয়েড, যিনি ছিলেন ওই সময়ের ‘লৈঙ্গিক রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিমান একক প্রতিবিপ্লবী শক্তি’। নারীসম্পর্কে যতো কুসংস্কার তৈরি করা হয়েছিলো গত কয়েক সহস্ৰকে, নারীবাদীদের প্রতিবাদে যা হ’টে গিয়েছিলো অনেকখানি, তার সবই এ-সময়ে ফিরে এসেছিলো ফ্রয়েডীয় ছদ্মবেশে। ফ্রয়েডের জনপ্রিয় বাজারি ভাষ্যকারেরা তা ছড়িয়ে দিয়েছিলো দিকে দিকে।
এতোদিন যে-নারী ছিলো ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে বিকলাঙ্গ আর অধম, ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞানে সে হয়ে ওঠে বৈজ্ঞানিকভাবে বিকলাঙ্গ ও বিকৃত; ফ্ৰয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের কুসংস্কার নারীকে যতোটা শোচনীয় জীবে পরিণত করে, তা করে নি কোনো ধর্মগ্রন্থও। ফ্রয়েড যদিও মেরি বোনাপার্তের কাছে স্বীকার করেছিলেন [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ১০১), মিলেট (১৯৬৯, ১৭৮)] : ‘যে-বিশাল প্রশ্নটির উত্তর কখনো দেয়া হয় নি এবং তিরিশ বছর ধরে নারী-আত্মা সম্পর্কে গবেষণা ক’রে যার উত্তর আমিও দিতে পারি নি, তা হচ্ছে নারী কী চায়?”, তবু নারীমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে তৈরি করেছিলেন তিনি এক ‘বৈজ্ঞানিক’ তত্ত্ব, যার ভিত্তি তাঁর এক ধ্রুববিশ্বাস যে ‘দেহই নিয়তি : অ্যানাটমি ইজ ডেসটিনি’। ফ্রয়েডের নারী নিজের বিকলাঙ্গ শরীরের শিকার।
ফ্ৰয়েড ছিলেন নিপুণ পর্যবেক্ষক; তবে রোগিনীদের সমস্যা বর্ণনা ও ব্যাখ্যায় তিনি ছিলেন ইহুদি পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির বন্দী। তিনি জন্মেছিলেন মধ্য ইউরোপের প্রবল পিতৃতান্ত্রিক ইহুদি পরিবারে; বেড়েছিলেন ওই সমাজে যেখানে নারীপুরুষের এলাকা ও ভূমিকা ছিলো সুস্পষ্টভাবে ভিন্ন। সেখানে পুরুষেরা প্রতিদিন প্রার্থনায় বিধাতাকে ধন্যবাদ জানাতো : ‘তোমাকে ধন্যবাদ, প্ৰভু, তুমি আমাকে নারী করে সৃষ্টি করো নি ব’লে’; আর নারীরা বিধাতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলতো : ‘তোমাকে ধন্যবাদ, প্ৰভু, আমাকে তুমি তোমার অভিলাষ অনুসারে সুষ্টি করেছে বলে।’
তাদের পরিবারে বাবা ছিলো জিহোভার সমান প্রতাপশালী, মা পতঙ্গের মতো অসহায়। পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা ছিলো ওই পরিবারে ও সমাজে প্রকৃতির শাশ্বত বিধান। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন পুরুষাধিপত্যবাদীরূপে, নারীমুক্তি ছিলো তার কাছে উদ্ভট ব্যাপার। মিলের নারী-অধীনতা (১৮৬৯) পড়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তিনি; নারী পুরুষের মতো বাইরে বেরিয়ে জীবিকা অর্জন করবে। এটা ভাবতে গিয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছেন তিনি, এবং উদ্বিগ্ন বোধ করেছেন যে এতে নষ্ট হয়ে যাবে নারীর নারীত্ব ও রমণীয়তা। তিনি নিজের পরিবারে ছেলেবেলা থেকে পুরুষকে দেখেছেন প্রবল, নারীকে অসহায়, পর্যুদস্ত, দুর্বল; এবং এটা তার কাছে মনে হয়েছে স্বাভাবিক।
নারীর যে-স্বভাব ও অবস্থা তিনি দেখেছেন, তা যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাপের ফল হতে পারে, এমন বোধ তাঁর মনে জাগে নি কখনো; বরং একে তিনি ভেবেছেন প্রাকৃতিক ও জৈবিক। বিয়ের আগে ফ্রয়েড তাঁর ভাবী স্ত্রী মাৰ্থ বারনেইসকে লিখেছিলেন ন-শোর মতো চিঠি : ওই চিঠিগুলোতে পাওয়া যায় এক পিতৃতান্ত্রিক, পুরুষাধিপত্যবাদী ফ্ৰয়েডকে, যিনি ভাবী স্ত্রীকে করেন ‘আমার মিষ্টি মেয়ে’, ‘প্ৰিয় ছোট্ট নারী’, ‘রাজকন্যা, আমার ছোট্ট রাজকন্যা’র মতো সম্বোধন। ওই তরুণীকে তিনি মনে করেছেন বালিকা; বিয়ের পর তাকে মনে করেছেন বালিকাবধু, যার কোনো বিকাশ ঘটা অসম্ভব। একটি চিঠিতে লিখেছেন [দ্র ফ্রাইডান (১৯৬৩, ৯৭-৯৮)] : ‘আমি জানি তুমি কতো মিষ্টি, কীভাবে তুমি গৃহকে পরিণত করতে পারো স্বর্গে…যতোটা চাও আমি তোমাকে শাসন করতে দেবো আমাদের গৃহ, আর তুমি আমাকে পুরস্কৃত করবে তোমার মধুর প্রেমে’; আরেক চিঠিতে (৫ ১১ ১৮৮৩) স্টুয়ার্ট মিলের নারীমুক্তির প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি লেখেন :
‘তাঁর সম্পূর্ণ রচনায় এটা কখনো ধরা পড়ে নি যে নারীরা পুরুষের থেকে ভিন্ন–নিকৃষ্ট বলবো না, বলবো বিপরীত৷… পুরুষের মতো নারীকেও জীবনসংগ্রামে পাঠাতে হবে, এটা সত্যিই একটা মৃতজাত ভাবনা। যদি আমি আমার মিষ্টি মেয়েকে কল্পনা করি এমন প্রতিযোগীরূপে, তাহলে তাকে আমি শুধু বলতে চাই, যেমন সতেরো মাস আগে বলেছি যে আমি তাকে ভালোবাসি এবং আমি চাই সে নিজেকে ওই সংগ্রাম থেকে গুটিয়ে নিয়ে আশ্রয় নেবে আমাব গৃহের শান্ত প্রতিযোগিতাহীন কাজে৷…প্রকৃতি নারীর নিয়তি নির্দিষ্ট ক’রে দিয়েছে রূপ, মোহনীয়তা, ও মাধুর্যের মধ্য দিয়ে। আইন ও প্রথার নারীকে তার অনেক প্রাপ্য দেয়ার আছে, তবে নারীর নিশ্চিত মৰ্যাদা হচ্ছে : যৌবনে পূজিত প্রিয়তমা আর বাৰ্ধক্যে প্ৰিয় পত্নী।
ফ্ৰয়েড ছিলেন রক্ষণশীল, আদর্শ ভিক্টোরীয়; তিনি সর্বত্ৰ কাম দেখতে পেয়েছেন, কিন্তু নিজে কামপরায়ণ ছিলেন না। তিনি ছিলেন অনেকটা আইবুড়ো আচারনিষ্ঠ নারীর মতো যে চারদিকে দেখতে পায় শুধু কাম। যে-মার্থকে বিয়ের আগে ন-শো চিঠি লিখেছিলেন তিনি, বিয়ের পর তাকে আর চিঠি লিখেন নি; বিয়ের পর তাকে ফ্রয়েড দায়িত্ব দেন পত্মীর, যে তার সংসার দেখে আর দেয় ছটি সন্তান। তার সংসারকে মার্থা স্বর্গে পরিণত করতে পারে নি, অবধারিতভাবে সেটি হয়ে ওঠে একটি পিতৃতান্ত্রিক ইহুদি সংসার, যেখানে স্ত্রীর কাজ স্বামীসেবা প্রসব ও লালনপালন।
ফ্রয়েডের নারীতত্ত্বে প্রতিটি নারীর জীবনী হচ্ছে শিশ্নাসূয়ার ইতিহাস। প্রতিটি নারী ধারাবাহিক শিশ্নাসূয়া [পেনিস এনভি]। লিঙ্গপুজোর ইতিহাসে ফ্রয়েড অতুলনীয়; তাঁর তত্ত্বে শিশ্ন বা (পুং)লিঙ্গই বিধাতা; লিঙ্গের এমন বৈজ্ঞানিক উত্থান কখনো ঘটে নি। লিঙ্গপুজোয় অদ্বিতীয় হিন্দুরা; ফ্রয়েড তাদেরও ওপরে। শিবলিঙ্গপুজোর একটি মন্ত্র আছে : ‘পবিত্র শিব, স্বগীয লিঙ্গধারী, স্বর্গীয় মূল, স্বর্গীয় শিশ্ন, প্ৰভু লিঙ্গ, তোমার জ্যোতির্ময় লিঙ্গ এতো বিশাল যে ব্ৰহ্মা আর বিষ্ণুও তা পরিমাপ করতে পারে না’ [দ্র মাইলস (১৯৮৮, ৩৬)]।
প্রাচীন কালে দেবীদের উৎখাত ক’রে দেবতাদের প্রতিষ্ঠার পর (পুং)লিঙ্গের যে-উত্থান ঘটে, তা চরম পরিণতি পায় ফ্রয়েডের তত্ত্বে। ফ্রয়েডের তত্ত্বে নারীর ব্যক্তিত্বের মূলে রয়েছে তার শাশ্বত শিশ্নাসূয়া; নারীর জীবন কাটে পুরুষের লিঙ্গটিকে অবিরাম ঈর্ষা করে। নারী পুরুষের প্রচণ্ড লিঙ্গের ঈর্ষায় পোড়ায় নিজের সমগ্র অস্তিত্ব। নারী সম্পর্কে ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের পরিণত রূপ উপস্থাপিত হয়েছে ‘নারীমনস্তত্ত্ব’ বা ‘নারীত্ব’ (১৯৩৩) নামক বক্তৃতায়। ফ্রয়েড নারীকে স্বায়ত্তশাসিত মানুষ রূপে না দেখে দেখেছেন পুরুষের ঋণাত্মক প্রাণী রূপে; নারী এমন মানুষ, যে পুরুষ নয়; নারী এমন মানুষ বা পুরুষ, যার কিছু একটা হারিয়ে গেছে। নারী হারিয়ে ফেলেছে তার শিশ্ন; নারী হচ্ছে শিশ্নহীনতা। ফ্রয়েডের মতে নারী যখন আবিষ্কার করে তার লিঙ্গ, দেখতে পায় তার শিশ্ন নেই, তখন সে মুখোমুখি হয় ভয়াবহ বিপর্যয়ের, যা নিয়ন্ত্রণ করে তার ব্যক্তিত্ব ও সারা জীবনকে। ফ্রয়েডের নারীমনস্তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে একটি বিপন্নকর অভিজ্ঞতার ওপর যে তার রয়েছে শিশ্নের বদলে একটি যোনি।
নারী তার রন্ধটিকে কী চোখে দেখে? ফ্রয়েড বলেন, বালিকা নিজের যোনিটি দেখেই মনে করে বা বুঝে ফেলে যে ওখানে একটি শিশ্ন থাকার কথা ছিলো; কিন্তু সেটি কেটে ফেলা হয়েছে, তাকে খোজা ক’রে ফেলা হয়েছে। নারী হচ্ছে খোজা পুরুষ, যে নিজের খোজাত্বের যন্ত্রণায় আমরণ ঈর্ষা ক’রে চলে পুরুষের অনন্য অসাধারণ অঙ্গটিকে।
ফ্রয়েড পুরুষনারীর কামবিকাশকে ভাগ করেছেন কয়েকটি স্তরে। শিশুর প্রথম বছরটি তার মনোকামিক বিকাশের মৌখিক স্তর, এ-সময় মুখই তার কাম-এলাকা। দ্বিতীয় বছরে শিশু উত্তীর্ণ হয় পায়ুস্তর-এ, পায়ুতে বোধ করে কামসুখ। তৃতীয়-চতুর্থ বছরে শিশু পৌঁছে লিঙ্গস্তর-এ, ছেলেরা শিশ্নে আর মেয়েরা ভগাঙ্কুরে বোধ করে কামসুখ। ছ-বছরের দিকে শিশুর কামবোধ কিছুটা ঘুমিয়ে পড়ে, তখন চলে তার সুপ্তিস্তর। এরপর কৈশোর আসে তার জননেন্দ্ৰিয় স্তর, যখন আবার জাগে তার কাম। এ-সময়ে সে আকর্ষণ বোধ করে অন্য লিঙ্গের প্রতি; এবং সম্পন্ন হয় তার মনোকামিক বিকাশ।
তবে ফ্রয়েডে ছেলে ও মেয়ের মনোকামিক বিকাশ অভিন্ন নয়; লিঙ্গস্তরে এসে তাদের মধ্যে ঘটে ভয়ঙ্কর ভিন্নতা। এ-স্তর থেকেই ফ্রয়েড ছেলেকে পুরুষ আর মেয়েকে বিকলাঙ্গ নারী ভাবতে শুরু করেন; এ-স্তরেই ঠিক হয়ে যায় যে ছেলে হবে পুরুষ আর মেয়ে হবে শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত নারী। ফ্রয়েড জানিয়েছেন শিশুরা এ-স্তরেই আবিষ্কার করে তাদের লিঙ্গ, লিপ্ত হয় হস্তমৈথুনে; ছেলেরা শিশ্নের, মেয়ের ভগাঙ্কুরের সাহায্যে। ফ্রয়েড ছেলের শিশ্ন ও মেয়ের ভগাঙ্কুরের মধ্যে দেখেছেন মহত্ত্ব ও নিকৃষ্টতা; তিনি শিশ্নকে বলেছেন ‘ছেলের বহুগুণে উৎকৃষ্ট হাতিয়ার’, ভগাঙ্কুরকে বলেছেন ‘তার নিকৃষ্ট ভগাঙ্গুর’, ‘জননেন্দ্রিয়গত ত্রুটি’, ‘আদি যৌন নিকৃষ্টতা’। ফ্রয়েডের মতে লিঙ্গস্তরে প্রতিটি মেয়ের নিয়তি হচ্ছে একটি ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের’ মুখোমুখি হওয়া; সে আবিষ্কার করে যে ছেলেদের রয়েছে একটি দৃষ্টিগ্রাহ্য বৃহৎ শিশ্ন, এবং সাথেসাথে বুঝে ফেলে যে ওটা তার নিজের তুচ্ছ ভগাঙ্কুরের থেকে কতো উৎকৃষ্ট!
এ-মহৎ আবিষ্কারের পর তার আর কোনো ক্ষমা নেই; ফ্রয়েড বলেন, ‘সে-মুহূর্ত থেকেই চিরকালের জন্যে সে আক্রান্ত হয় শিশ্নাসূয়ায়’! বালিকা মনে করে তার শিশ্নটি কেটে ফেলে খোজা ক’রে ফেলা হয়েছে তাকে, সে বইছে একটি ঘা; আর ওই ঘা’টি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক। এর ফলে জন্মে তার চিরজীবী হীনমন্যতাবোধ–হীনমন্যতা গূঢ়ৈষ্যা। ফ্রয়েডের বর্ণনা ও সিদ্ধান্ত খুবই মন্ময়, যা যুক্তিতে টেকে না। ছেলেমেয়েরা শিশুকালে পরস্পরের লিঙ্গ দেখে, তবে বালিকার পক্ষে বালকের শিশ্ন দেখা কেনো হবে এতো গুরুত্বপূর্ণ? কেনো বালিকা বালকের ‘বৃহৎ’ শিশ্নটিকে মনে করবে উৎকৃষ্ট? বড়ো হ’লেই হয় উৎকৃষ্ট? তার কাছে বালকের ঝুলন্ত মাংসাটুকরে মনে হ’তে পারে হাস্যকর, নিজের প্রত্যঙ্গটিকে স্বাভাবিক। বালিকা কেনো নিজের প্রত্যঙ্গটি দেখেই মনে ক’রে ফেলবে ওটি বিকল, বালকেরটিকে মনে করবে উৎকৃষ্ট, এবং সাথেসাথে আক্রান্ত হবে চিরশিশ্নাসূয়ায়? বালিকাদের অভিজ্ঞতা জানায় যে ফ্রয়েডীয় ওই সব অনুমান সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, তারা বালকদের শিশ্ন দেখে ঈৰ্ষায় কাতর হয়ে ওঠে না।
ফ্রয়েডের তত্ত্ব অনেকখানি দাঁড়িয়ে আছে বালিকার ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ আবিষ্কারের ওপর যে তার শিশ্ন নেই। ফ্রয়েড একে উপস্থাপিত করেছেন ভয়াবহভাবে, তার বর্ণনা শিউরে দিতে পারে যে-কাউকে; মিলেট একে বলেছেন বাইবেলি স্বৰ্গচ্যুতির পুনরাভিনয়। তবে পৌরাণিক বিধাতা স্বৰ্গচ্যুত কবেছিলেন দুজনকেই; কিন্তু বিশশতকের মনোবিজ্ঞানের বিধাতা স্বৰ্গচ্যুতি ঘটান শুধু ইভের। ফ্রয়েড বিশ্বাস করেন, এবং আমাদের বিশ্বাস করতে বলেন যে বালিকা তার ভগাঙ্কুরকে মনে করে শিশ্ন। কেনো বালিকা তার ওই শিউলিবোটাটিকে শিশ্ন মনে করে? ফ্রয়েড বলেন, বালিকা হস্তমৈথুন করে ওটি দিয়ে, তাই ওটিকে সে মনে করে শিশ্ন। যেনো ওই কাজটির জন্যে রয়েছে এক আদর্শ হাতিয়ার, যার নাম শিশ্ন; তাই যা দিয়েই করা হবে ওই কাজটি, তাকেই মনে করতে হবে শিশ্ন, বা নকল শিশ্ন, যা প্লাতোর দর্শন অনুসারে বাস্তবতা থেকে দ্বিগুণ দূরবর্তী, এবং ফ্রয়েডীয় বিজ্ঞানে নিকৃষ্ট! তিনি আরো বলেন, বালিকা ওটি দিয়ে হস্তমৈথুন করতে গিয়েই বুঝে ফেলে যে এ-কাজের জন্যে শ্রেষ্ঠ সামগ্ৰী হচ্ছে শিশ্ন।
ফ্রয়েডের বালিকা তার মতোই জ্ঞানী, সে নিজের ভগাঙ্কর ছুঁয়েই সব বুঝে ফেলে; তুলনা ক’রে ফেলে শিশ্ন ও ভগাঙ্কুরের মধ্যে, এবং পৌঁছে যায় নিজের নিয়তিতে। এসব কি বালিকার ভাবনা, বালিকার বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত? পুরুষতান্ত্রিক ফ্রয়েডই বালিকা হয়ে মনে করছেন এসব, নিজের ভাবনাকে তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন বালিকার ওপর। মেয়েশিশু যখন প্রথম দেখে কোনো ছেলেশিশুর শিশ্ন, তখনই সে কীভাবে বোঝে যে ওই সম্রান্ত প্রত্যঙ্গটি দিয়ে হস্তমৈথুন করে ছেলেশিশুটি? ধরা যাক কোনো মেয়েশিশু জীবনে প্রথম শিশ্ন দেখে এমন এক ফ্রয়েডীয় বালকের, যখন সে লিপ্ত ছিলো হস্তমৈথুনে; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সে কী ক’রে বোঝে যে, ওইটিই সর্বোত্তম এ-ক্রিয়ার জন্যে? ফ্রয়েড নিজের সিদ্ধান্ত বালিকার ওপর চাপিয়ে দিয়ে তৈরি করেছেন এমন কিংবদন্তি, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
হস্তমৈথুনের উৎকৰ্ষই যদি মানদণ্ড হয় শ্রেষ্ঠত্বের, তবে স্বীকার করতেই হবে যে শিশ্নের থেকে ভগান্ধুর অনেক উৎকৃষ্ট! এর স্পর্শকাতরতা, বৈদ্যুতিক পুলকের প্রতিভা নেই পুরুষের কোনো প্রত্যঙ্গের। ফ্রয়েডের বিশ্বাসে পুরুষ শ্রেষ্ঠ, নারী নিকৃষ্ট; এবং পুরুষকে, শুধু পুরুষকে নয় পুরুষের সভ্যতাকে, তিনি সংহত করেছিলেন একটি প্রতীকে: প্রতীকটি হচ্ছে শিশ্ন। ফ্রয়েডীয় বিশ্বে শিশ্নই বিধাতা; তাই তার চোখে শিশ্নের পাশে ভগাঙ্কুর শোচনীয়ভাবে নিকৃষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন যে নারী জৈবিকভাবেই নিকৃষ্ট পুরুষের থেকে। ক্লারা টম্পসন বলেছেন, ফ্রয়েড নারী সম্পর্কে ভিক্টোরীয় মানসিকতা থেকে কখনোই মুক্তি পান নি। তাঁর সমগ্ৰ চিন্তার দুটি মূল ভাবনা, খোজা গৃঢ়ৈষা ও শিশ্নসূয়া, প্রস্তাব করা হয়েছে এ-ধারণা থেকে যে নারী জৈবিকভাবে পুরুষের থেকে নিকৃষ্ট’ [দ্র ফ্ৰাইডান (১৯৬৩, ১০২)]।
নারী কি সত্যিই ঈৰ্ষা করে পুরুষের প্রত্যঙ্গটিকে, নাকি কি ঈর্ষা করে ওই প্রত্যঙ্গধারীদের শিশ্নাসূয়ার পেছনে যে কোনো জৈবিক কারণ নেই, রয়েছে সামাজিক কারণ, এটা ফ্রয়েড উপেক্ষা করেছেন পুরোপুরি। তাঁর পরিভাষাটি খুবই আপত্তিকর; এটি নারীকে চিহ্নিত করে পুরুষের একটি নির্বোধ প্রত্যঙ্গের অসূয়ায় জর্জরিত জীব ব’লে, গোপন ক’রে যায় নারীর দ্ৰোহকে।
শিশ্নাসূয়ার সাথে শিশুনারীকে, ফ্রয়েডের মতে, ধরে আরেকটি রোগে; তার নাম খোজাগূঢ়ৈষ্যা। ছেলেকেও ধরে এ-ব্যাধিতে; ফ্রয়েড বলেন, সে যখন দেখতে পায় মেয়েদের নেই তার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গ, তখন তাকে পায় খোজা হয়ে যাওয়ার ভয়ে। সে মনে করে কোনো কুকর্মের শাস্তি হিশেবে কেটে নেয়া হয়েছে মেয়েদের শিশ্ন; এবং তখন সে ভয় পেতে থাকে যে তার শিশ্নটিকেও কেটে ফেলে হয়তো খোজা ক’রে দেয়া হবে তাকে।
তার ভয়ের কারণ সে বাবাকে হটিয়ে, ইডিপাসের মতো, কামনা করছে মাকে। সে কিছুকাল থাকে উদ্বেগ আর ভয়ের মধ্যে; কিন্তু একদিন সে অর্জন করে পৌরুষ, নিজেকে অভিন্ন মনে করে পিতার সাথে; কেটে যায় তার রোগ। মেয়ের বেলা তা ঘটে না, তা হয়ে থাকে দুরারোগ্য জন্মব্যাধি। মেয়ে যখন দেখে তার নেই শিশ্ন, সে বুঝে ফেলে তাকে খোজা ক’রে দেয়া হয়েছে; সে ভুগতে থাকে ঈর্ষায় ও হীনমন্যতায়। যখন সে দেখে তার মতো অন্য মেয়েদের, তার মায়েরও, নেই শিশ্ন, সে তখন ঘেন্না করতে শুরু করে নারীজাতিকেই। ফ্ৰয়েড (১৯৩৩, ১৬০-১৬১) বলেছেন :
‘দু-লিঙ্গের শারীরিক পার্থক্য ছাপ ফেলে মানসিক জীবনের ওপর। বিশ্লেষণ থেকে এটা আবিষ্কার করা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিলো যে মেয়ে নিজের শিশ্নের অভাবের জন্যে দায়ী কবে তার মাকে; আর এ-অভাবের জন্যে তাকে কোনোদিন ক্ষমা করে না …মেয়েদের বেলাও খোজা গূঢ়ৈষা দেখা দেয় অন্য লিঙ্গের জননেন্দ্ৰিয় দেখার পর। সে তৎক্ষণাৎ পার্থক্যটা লক্ষ্য করে, এবং বুঝতে পারে, স্বীকার করতেই হবে, এর তাৎপৰ্য সে বোধ কবে মারাত্মক অসুবিধা, এবং মাঝেমাঝেই ঘোষণা করে সেও ‘চায় ওরকম একটা কিছু’; এবং হয়ে পড়ে শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত, যা তার বিকাশ ও চরিত্রগঠনের ওপব অমোচনীয় ছাপ ফেলে যায়, যা অশেষ মানসিক শক্তি ছাড়া জয় করা যায় না।
বালিকা বুঝতে পারে তার শিশ্ন নেই, এর অর্থ এ নয় যে এর অভাবকে সে মেনে নেয় হাল্কাভাবে। ঘটে এর বিপরীত, সে দীর্ঘকাল ধ’রে থাকে আমন একটা কিছু পাওয়ার বাসনায়; এবং এর সম্ভবপরতায় বিশ্বাস কবে বহু বছর; এমনকি যখন তার বাস্তবতাবোধ তাকে বাধ্য করে ওই বাসনা ত্যাগ করতে, কেননা তা চরিতাৰ্থ কিবা অসম্ভব, বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে তখনো তা বিরাজ করে তার অবচেতনায়, এবং ধারণ করে বেশপরিমাণ শক্তি। শিশ্ন লাভের যে-বাসনা এতো বেশি সে পোষণ কবে, তাই হয়তো প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের মনোবিশ্লেষণে আসার পেছনে থাকে; এবং মনোবিশ্লেষণ থেকে তারা যুক্তিসঙ্গতভাবেই যা প্রত্যাশা কবে, যেমন কোনো মননশীল কর্মজীবন চালানো, তাকেও অনেক সময মনে করা যায় এ-অবদমিত বাসনার উৎকর্ষিত রূপ ব’লে।‘
অর্থাৎ শিশ্নের ঈর্ষায় ও খোজা মনোভাবের জন্যে চিরকালের জন্যে বিকৃত হয়ে যায় নারী।
শিশ্নাসূয়া ও খোজাগূঢ়ৈষার কুফল ফলে আরো; জীবনের শুরুতে মেয়েশিশু মাকে নেয় নিজের প্ৰেমাস্পদরূপে, কিন্তু এ-স্তরে এসে সে ত্যাগ করে মাকে। ফ্রয়েড বলেন, সে ছেড়ে দেয় মাকে গর্ভবতী করার বাসনা! মাকে সে বর্জন করে, কেননা মা-ই ‘দায়ী তার শিশ্নহীনতার জন্যে’; মা-ই ‘তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে এমন অপ্রস্তুতভাবে’। ফ্ৰয়েড বলেন, ‘নিজের খোজাত্ব আবিষ্কার তার জীবনের এক মোড়-বিন্দু’; এ-সময় থেকে মা ও সব নারীর মূল্য কমে যায় তার চোখে, যে-শিশ্নহীনতার কারণে পুরুষের চোখেও নারীর মূল্য কম। এ-সময়ে তার লিবিডো ছোটে পিতার দিকে, কেননা তার আছে একটি শিশ্ন। পিতা হয়ে ওঠে তার প্ৰেমাস্পদ, মাকে সে দেখতে থাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। শিশুমেয়ে, ফ্রয়েড বলেন, মনে করে যে তার পিতা খুব উদার হয়ে তাকে উপহার দেবে একটি শিশ্ন।
কিন্তু হতাশ হ’তে তার দেরি হয় না; তখন সে নিজের কামনা পূরণ করতে চায় গৰ্ভে সন্তান ধারণ করে। তবে ওই সন্তান শিশ্নের বিকল্প, শিশু নয়। ওটি এক ‘শিশ্নশিশু’। ফ্রয়েড বলেন, নারীর শিশ্নকামনা কখনো কাটে না, কেননা ‘শিশ্নকামনাই হচ্ছে একান্ত নারীর কামনা’। নারী শিশু চায়, কিন্তু কেনো চায়? নারী শিশুর জন্যে শিশু চায় না; ফ্রয়েড বলেন, নারী শিশু চায়, কেননা ওই শিশু ছাড়া শিশ্নের কাছাকাছি আর কিছু পাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব! নারী শিশ্নাতুর, শিশ্ন ছাড়া আর কিছু নারী চায় না; না পেয়ে সে চায় শিশু; তাই নারীর প্ৰেমাস্পদ হয়ে ওঠে শিশু। পুরুষ ঠিকমতো বেড়ে নারীকে ভালোবাসতে শেখে, তবে নারী পুরুষকে ভালোবাসতে শেখে না; শেখে শিশুকে ভালোবাসতে, কেননা শিশুর মধ্যেই পায় সে তার হারানো শিশ্নকে। নারীর শিশ্নকামনা একদিন চরম চরিতার্থতা লাভ করে ফ্রয়েডের (১৯৩৩, ১৬৫) মতে এভাবে :
‘তার সুখ হয় সত্যিই অসামান; যেদিন চরিতাৰ্থ হয় তার শিশুলাভের বাসনা; এ-সুখ আরো বিশেষ হয়ে ওঠে যদি শিশুটি হয় ছেলে, যে তার জন্যে নিয়ে আসে বহুকামনার শিশ্নটি।‘
ফ্রয়েডীয় মনোবিজ্ঞানে নারীর সন্তানকামনাও হয়ে ওঠে শিশ্নের জন্যে অনন্ত মৃগয়া। নারীর সন্তান কামনাকে ফ্রয়েড চমৎকারভাবে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন শিশ্নকামনার সাথে; এবং নারীকে উৎখাত ক’রে দিয়েছেন তার কীর্তিত আসন থেকেও। নারীর সন্তান কামনাও জৈবিক নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক; পিতৃতন্ত্র নারীকে দেখতে চায় জননীরূপে, তাই নারী মা হয়ে পিতৃতন্ত্রের কাছে হ’তে চায় গ্রহণযোগ্য। পুত্রের শিশ্নটির প্রতি তার নেই কোনো আকর্ষণ; তার আকর্ষণ পুত্রের প্রতি, কেননা পিতৃতন্ত্রের মধ্যে টিকে থাকার জন্যে তার দরকার এমন একজন যে হবে পিতৃতন্ত্রের সদস্য।
বালক তার গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যঙ্গটি নিজে নিজে ব্যবহার করে সুখ পায়, এটা ফ্ৰয়েড অনুমোদন করেন; কিন্তু বালিকা তার নিকৃষ্ট অন্ধুরটি নেড়ে সুখ আহরণ করবে, ফ্রয়েড তা অনুমোদন করেন না। কেননা তার কাছে হস্তমৈথুন একটি একান্ত পুরুষি কাজ। বালিকাকে নারী হয়ে উঠতে হবে; তাই তাকে বন্ধ করতে হবে পুরুষি কাজটি, নইলে নষ্ট হবে তার নারীত্ব। পরিপূর্ণ নারীত্ব অর্জনের জন্যে এটা দরকার। বালিকা যখন নিজের খোজাত্ব উপলব্ধি করে মর্মেমর্মে, তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হয়? ফ্ৰয়েড বলেন [দ্র মিলেট (১৯৬৯, ১৮৬)] :
‘সে মেনে নেয় তার খোজাত্ত্বের সত্য, এবং এর পরিণতিরূপে পুরুষের শ্ৰেষ্ঠত্ব ও নিজের নিকৃষ্টতা, তবে সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে এ-অপ্ৰিয সত্যের বিরুদ্ধে।‘
তখন নারীর শরীরের ভেতর শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ; এ-যুদ্ধে স্বাভাবিক নারীরা জীবনের পূর্ণতা লাভ করে মাতৃত্ত্বে, কেননা জৈবিকভাবে এরই জন্যে তৈরি করা হয়েছে তাদের। বিকৃত নারীরা যায় ভুল পথে, তারা যায় সে-দিকে জৈবিকভাবে তারা যার অনপুযুক্ত। তারা বিকৃতির শিকার। ফ্রয়েড এর নাম দিয়েছেন পুংগূঢ়ৈষা। যে-নারীরা মাতৃত্ব ছাড়া অন্য কোনো কাজে সাফল্য পেতে চায়, ফ্রয়েডের চোখে তারা ব্যাধিগ্রস্ত; তারা আক্রান্ত পুংগূঢ়ৈষ্যায়। তারা সন্তানের মধ্য দিয়ে পেতে চায় না কাম্য শিশ্নটিকে, শিশ্ন পেতে চায় তারা অধ্যাপক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, রাজনীতিক হয়ে বিভিন্ন পদের মধ্য দিয়ে। তারা ব্যাধিগ্রস্ত, তাই তাদের চিকিৎসা দরকার মনোবিকলনগ্রস্ত’ রূপে!
ফ্রয়েডের মতে এরা অবিকশিত, ‘নাবালেগ’ নারী। নারী যদি তার ভাগ্যকে, নিকৃষ্টতাকে, মেনে নেয়, তাহলে সে একধরনের তৃপ্তি পেতে পারে মাতৃত্বে; কিন্তু উদ্ধত অবাধ্য নারীরা নিজেদের ব্যাধির জন্যেই ঢুকতে চায় পুরুষোল এলাকায়। এমন নারী দেখলেই বুঝতে হবে সে পুংগূঢ়ৈষ্যাগ্ৰস্ত বা পুরুষালি প্রতিবাদের শিকার। ফ্ৰয়েড ও ফ্রয়েডীয়দের মতে এদের চিকিৎসা দরকার। ফ্রয়েড বিজ্ঞানের নামে যা চালিয়েছেন, তার সবটাই কুসংস্কার : তিনি প্রথাকে ভেবেছেন সহজাত, পুরুষাধিপত্যকে মনে করেছেন প্রাকৃতিক। শিশ্নাসূয়াকে তিনি মনে করেছেন জৈবিক, যদিও তা আসলে সাংস্কৃতিক প্রতিক্রিয়া।
ভিক্টোরীয় সমাজব্যবস্থায় পুরুষ ছিলো দেবতার মতো, তাই নারীর পক্ষে পুরুষকে ঈর্ষা করা ছিলো স্বাভাবিক। ওই নারীরা শিশ্নকে ঈর্ষা করতো না, বা এখনো করে না, কিন্তু তারা দেখে একটি শিশ্ন কতো সুযোগ এনে দিতে পারে। তাই তারা ঈর্ষা করে, তবে শিশ্নকে নয়, করে শিশ্নধারীদের। ফ্রয়েড নারীকে পুরুষের সাথে জড়িত দেখেছেন শুধু কামসম্পর্কে, মুছে ফেলেছেন আর সব সম্পর্ক। তাঁর সময় সমাজ নারীকে কোনো সুযোগাই দিতো না, এখনো সমাজ নারীকে দেয় না। তার প্রাপ্য সুযোগ; সমাজ রোধ করে তার সমস্ত সম্ভাবনা।
তাই নারীর পক্ষে পুরুষকে ঈর্ষা করা খুবই স্বাভাবিক, এটা কোনো ব্যাধি নয়, বরং সুস্থতা; কিন্তু ফ্ৰয়েড নারীর এ-সুস্থ মানবিক ব্যাপারটিকেই নির্দেশ করেছেন রোগ হিশেবে। ফ্রয়েড তার নারী রোগীদের সমস্যাগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন, কিন্তু সেগুলোর ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন শিশ্নাসূয়া নামে। তিনি দেখেছেন নারী অর্জন করতে চায় পুরুষের সাফল্য, বা মানবিক সাফল্য; একে যখন তিনি বাতিল ক’রে দিয়েছেন শিশ্নাসূয়া নামে, তখন তিনি বিজ্ঞানচর্চা করেন নি, প্রকাশ করেছেন নিজের কুসংস্কার। তাঁর কুসংস্কারটি হচ্ছে যে নারী কখনো পুরুষের সমান হবে না, যেমন নারী পাবে না একটি মহামানা শিশ্ন।
ফ্রয়েড সমাজপরিবর্তনে উৎসাহী ছিলেন না, তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজসংস্কৃতির চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করেছেন : নারীপুরুষকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি ওই পীড়াদায়ক সমাজের সাথে। ফ্রয়েড মানুষের মনোলোকের বৈজ্ঞানিক সূত্র লেখেন নি, তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বাহ্যিক সূত্ৰগলোকে মনোবিজ্ঞানের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে খাপ খাইয়ে দিয়েছেন মানুষের মনের সাথে।