কেন বুড়োভামদের মধ্যে স্ত্রী হত্যার প্রকোপ বেশি?
আমরা আগের কিছু অধ্যায়ের আলোচনা থেকে জেনেছি যে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অনুকল্প অনুযায়ী যৌনতা সংক্রান্ত হিংসা কিংবা ঈর্ষার ব্যাপারটি আসলে জৈবিকভাবে পুরুষদের মধ্যে অঙ্কুরিত। এর পেছনের কারণটি নিয়ে বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ে (সখি, ভালোবাসা কারে কয়?) কিছুটা আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানেও সঙ্গত কারণে কিছুটা পুনরুল্লেখ করতে হচ্ছে।
আমরা জানি যে, পুরুষেরা কেবল সঙ্গম করেই খালাস, আর ওদিকে গর্ভধারণ এবং বাচ্চা প্রসবের পুরো প্রক্রিয়াটা নারীদের নিজেদের মধ্যেই ধারণ করতে হয়, পুরুষদের কোনো ভূমিকা থাকে না। ফলে একটি সন্তান জন্মানোর পরে পুরুষরা নিজেদের পিতৃত্ব নিয়ে কখনোই ‘পুরোপুরি’ নিশ্চিত হতে পারে না (আধুনিক ডিএনএ টেস্ট আসার আগে সেটা প্রযুক্তিগতও সম্ভব ছিল না)।
কিন্তু একজন মাকে যেহেতু গর্ভধারণ করতে হয় এবং শারীরিকভাবে বাচ্চার জন্ম দিতে হয়, প্রত্যেক মা-ই জানে যে সেই তার সন্তানের মা। অর্থাৎ, পিতৃত্বের ব্যাপারটা শতভাগ নিশ্চিত না হলেও মাতৃত্বের ব্যাপারটা নিশ্চিত। ফলে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের অভিমত হলোপুরুষেরা মূলত ‘সেক্সুয়ালি জেলাস’ হিসেবে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বেড়ে উঠেছে।
তরুণদের মধ্যে সহিংসতা এমনিতেই বেশি। সাদা চোখে মনে হতে পারে যে তারাই বেশি স্ত্রীদের উপর নির্যাতন করবে, কিংবা রাগের মাথায় স্ত্রীদের হত্যা করবে। অনেক সমাজবিজ্ঞানী এই ভবিষ্যদ্বাণীর সপক্ষে যুক্তিও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী মার্গো উইলসন অনেক আগেই অভিমত দিয়েছিলেন, তরুণদের মধ্যে সহিংসতা
বেশি হলেও যৌনতার ঈর্ষার কারণে বয়স্ক ব্যক্তিদের ঢের বেশি তরুণী স্ত্রীদের হত্যা করার কথা। কারণ তরুণী স্ত্রীরা প্রজননগতভাবে অনেক বেশি আক্রমণ্য এবং অরক্ষিত থাকে। তারা তাদের স্বামীদের চেয়ে প্রজননগত দিক থেকে অনেক উর্বর, এবং তাদের পরকীয়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশি। বয়োবৃদ্ধ স্বামীরাও সেটা খুব ভালো করেই জানে।
তাই তারা থাকে স্ত্রীদের প্রতি অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ। তাদের এই শকুনাচরণ খুব সহজেই সহিংসতায় রূপ নিতে পারে কোনো ধরনের পরকীয়ার আলামত পেলে কিংবা এ সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক সন্দেহের বশে। এ নিয়ে পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেল সমাজবিজ্ঞানীরা নন, বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী মার্গো উইলসনই সঠিক প্রমাণিত হয়েছেন।
যেমন ক্যানাডায় গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, মধ্যবয়সি পুরুষেরা (৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সের পরিসীমায়) স্বামীরা যদি সদ্য তরুণী নারীকে (১৫ থেকে ২৫ বছরের পরিসীমায়) বিয়ে করে, তবে তাদের জন্য স্ত্রী হত্যার প্রকোপ তরুণ স্বামীদের তরুণী স্ত্রী (যারা উভয়েই ১৫ থেকে ২৫ বছরের পরিসীমায় রয়েছেন) হত্যার চেয়ে ছয়গুণ বেশি পাওয়া গেছে[২৬৯]। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানকে যারা মিথ্যা প্রতিপাদনযোগ্য নয় কিংবা পরীক্ষণযোগ্য নয় বলে মনে করেন, তারা এ গবেষণাটির কথা স্মরণ রাখতে পারেন।
এই গবেষণার উপসংহার থেকে জানা যায়, যদিও একজন পঞ্চাশ বছর বয়স্ক ব্যক্তি একজন পঁচিশ বছর বয়স্ক ব্যক্তির চেয়ে কম সহিংস এবং কম অপরাধপ্রবণ (বয়স বনাম অপরাধপ্রবণতার রেখচিত্রটি স্মরণ করুন), কিন্তু পঞ্চাশ বছর বয়সি ব্যক্তি যদি পঁচিশ বছর বয়স্ক নারীকে বিয়ে করেন, তার স্ত্রীকে প্রহার, নির্যাতন এবং হত্যার সম্ভাবনা একজন পঁচিশ বছর বয়সি স্বামীর চেয়ে (যার সমবয়সি স্ত্রী রয়েছে) বেশি। যৌনতার ঈর্ষা তাদের বেশি থাকার কারণেই এটি ঘটে বলে মনে করা হয়।
কেন সারা পৃথিবী জুড়ে জাতিবিদ্বেষ এবং সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার রয়েই যাচ্ছে?
সংখ্যালঘুরা সর্বত্রই সংখ্যালঘু। হিন্দুরা বাংলাদেশে যে যন্ত্রণায় থাকেন, ঠিক একই ধরনের যন্ত্রণা হয়তো একটি মুসলিমও ভোগ করেন অন্য কোনো রাষ্ট্রে। ৯/১১ এর ঘটনার পরে নির্বিচারে মুসলিমদের গায়ে সন্ত্রাসের ট্যাগ লাগিয়ে হেনস্থা করা হয়েছে আমেরিকা সহ অনেক রাষ্ট্রেই। অনেক নিরপরাধীকেও জেল-জরিমানা খাটতে হয়েছে প্রমাণ ছাড়াই, কেবল সন্দেহের ফলশ্রুতিতে।
বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুদের উপর আগ্রাসন প্রবল। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বেছে বেছে হিন্দু বাড়িগুলোতে আক্রমণ চালানো হয়। পূর্ণিমা রানির মতো বহু কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার প্রথম ৯২ দিনের মধ্যে ২২৮টি ধর্ষণের ঘটনা, এবং পরবর্তী তিন মাসে প্রায় ১০০০টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগ ছিল হিন্দু কিংবা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্গত।
২০০১ সালের ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বাংলাদেশে ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ ভাগ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের অব্যবহিত পরে তা শতকরা ২২ ভাগে এসে দাঁড়ায়। এরপর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার এবং নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় দেশটিতে ক্রমশ হিন্দুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৬১ সালে ১৮.৫% , ১৯৭৪ সালে কমে দাঁড়ায় ১৩.৫%, ১৯৮১ সালে ১২.১%, এবং ১৯৯১ সালে ১০% এ এসে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে হিন্দুদের শতকরা হার কমে ৮ ভগের নীচে নেমে এসেছে বলে অনুমিত হয়।
শুধু হিন্দুদের ওপরেই নয়, বাঙালিরা আবার একজোট হয়ে চাকমা এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর উপর আগ্রাসন এবং নিপীড়ন চালিয়েছে নিজ দেশে। স্বাধীনতার পরপরই আমাদের বাংলাদেশের স্থপতি শেখমুজিব পাহাড়িদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- ‘তোরা সব বাঙালি হইয়া যা ’। যে দেশটি দীর্ঘ নয় মাসের সাম্রাজ্যবাদী শোষণ তুচ্ছ করে স্বাধীন হয়েছিল, তার নির্বাচিত প্রতিনিধি, স্বাধীন রাষ্ট্রের কর্ণধার মুজিব সেই একই পাকিস্তানি কায়দায় সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল তুলে দিলেন সংখ্যালঘু পাহাড়িদের উপর, অস্বীকার করলেন আদিবাসীদের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয়টুকু।
তারপরে জেনারেল জিয়া তার রাজত্বকালে পার্বত্য চটগ্রামে ৪ লাখ বাঙালিকে পুনর্বাসনের জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন। তাদের কিছু অংশকে খাগড়াছড়ি জেলা শহরের ৩ মাইল দক্ষিণে ভুয়াছড়ি মৌজায় একটি চাকমা গ্রামের পাশে বসান হয়েছিল । সেই থেকে শুরু হয়েছিল পাকিস্তানি কায়দায় পাহাড়িদের সংস্কৃতির উপর বাঙালি আগ্রাসন। ২০০৩ সালের ১৯ এপ্রিল গভীর রাতে সেই গ্রামের সেটেলার বলে কথিত উদ্বাস্তু বাঙালিরা সেনা ক্যাম্পের কিছু সেনা সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে পাশের চাকমা গ্রামে গিয়ে লুটপাট কর, এরপর করে অগ্নিসংযোগ।
সেই একই বছর আগস্ট মাসে খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মহালছড়ি বাজারের দোকানি এবং মহালছড়ি ইউনিয়নের উদ্বাস্তু বাঙালিরা আবারো আদিবাসীদের বাড়িঘরে লুটপাট চালায়, এরপর বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে । এতে ৯টি গ্রামের ৩৫০টির ও অধিক বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মহালছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়াররম্যান বিনোদ বিহারী খীসা যিনি সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন তাকে পিটিয়ে হত্যা করে।
এছাড়া সন্ত্রাসীরা ২টি বৌদ্ধ মন্দির পুড়িয়ে দেয়, ২টি বৌদ্ধ মন্দির তছনছ করে এবং মুল্যবান ধাতুর তৈরি ৪টি বুদ্ধ মূর্তি লুট করে নিয়ে যায়; মা-মেয়ে সহ ৮ জন মহিলা এবং একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকাকে ধর্ষণ করে। এদের মধ্যে কয়েকজন গণধর্ষণের শিকার হয়। ২০০৭ সালের মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি সদর থানার ২টি ইউনিয়নে এবং মহালছড়ি উপজেলার ২টি ইউনিয়নে মোট ১৪টি গ্রামের ১৩৩ ব্যক্তির এবং একটি স্কুলের ৩৯৯.২২ একর জমি সেটেলার বাঙালিরা ইতিমধ্যে দখল করে নিয়েছে।
তাছাড়া রাঙামাটির বুড়িঘাটে ১০জন আদিবাসীর ২৫ একর জমি সন্ত্রাসী বাঙালিরা দখল করে নিয়েছে। এগুলো পত্রিকাতেই এসেছে। তবে পত্রিকায় যা এসেছে তা মহাসমুদ্রের মাঝে এক দু-ফোঁটা জলবিন্দু ছাড়া কিছু নয়। হাজারো কান্না, কষ্ট আর হতাশ্বাসের কথা হারিয়ে গেছে বিস্মৃতির অন্তরালে। কেন এই জাতিসত্তার বিরোধ? কেন এই অন্তহীন সংঘাত?
সংখ্যালঘুতত্ত্ব, জাতিসত্তার সংঘাত প্রভৃতি নিয়ে তো সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যা অনেক দেয়া হয়েছে। আমি এই বইয়ে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কিছু মতামত দেয়ার প্রচেষ্টা নিব। এ ব্যাখ্যাগুলো এরকমভাবে আগে কোথাও দেয়া হয়নি। হয়তো পাঠকেরা কিছু নতুনত্ব খুঁজে পেতে পারেন।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ধারণা অনুযায়ী, আমরা জাতীয়তাবোধে কিংবা দেশপ্রেমে কিংবা জাতিগত ভাতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হই খুব সহজ কারণে, এবং সেই কারণটি নিহিত আছে (রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির পাশাপাশি) জীববিজ্ঞানে। প্রতিটি মানুষ, যতই উদার হোক না কেন, খুব স্বার্থপরভাবেই প্রথমে নিজের সন্তান এবং পরিবারের (ছেলে মেয়ে, ভাই বোন, বউ, বাবা মা) মঙ্গল-অমঙ্গলের ব্যাপারটা অবার আগে দেখে। এটা জানা কথাই।
কারণ, জেনেটিকভাবে চিন্তা করলে তারাই একটি মানুষের সবচেয়ে ‘আপন জন’, তাই সবচেয়ে কাছের জিনপুলকে সে রক্ষা করতে চায়, তারপরে একটু দূরের (যেমন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী) এবং এ ব্যাপারটা জৈবিকভাবেই অঙ্কুরিত। এগুলো আমাদের সমাজে হরহামেশাই দেখি। ঠিক আমরা যে কারণে সন্তান কিংবা পিতামাতা এবং পরিবারের মঙ্গলের জন্য জৈবিক তাড়না অনুভব করি, ঠিক একই কারণে স্বজাতিমোহেও উদ্বুদ্ধ হই। ‘স্বজাতি’ ব্যাপারটা আর কিছুই নয় আমাদের ‘এক্সটেন্ডেড জেনোটাইপের’ দ্বারা নির্ধারিত ‘এক্সটেন্ডেড পরিবার’ (Extended Family)।
বিবর্তনের মূল কাজই হচ্ছে যত বেশি সংখ্যক প্রতিলিপি তৈরি করা আর ‘নিজস্ব’ জিনপুলকে রক্ষা করে চলা। কাজেই বিবর্তনে আমাদের সেই সমস্ত প্রচেষ্টাই ‘অধিক হারে’ উপযোগিতা পাবে, যেটি সদৃশ কিংবা কিংবা সমরূপ জিনকে রক্ষা করে চলবে। জোসেফ এম হুইটমেয়ার নামের এক বিজ্ঞানী এ নিয়ে গবেষণা করছিলেন বহুদিন ধরেই। তিনি বলেন, গাণিতিকভাবে এটি দেখানো যায় যে, একটি জিন সেই দিকেই ঝুঁকে পড়বে কিংবা টিকে থাকার উপযোগিতা দেখাবে যেখানে এটার বাহক, বা তার সন্তান সন্ততি কিংবা নাতিপুতির সমবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জিনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ কিংবা সম্ভাবনা থাকবে[২৭০]। হুইটমেয়ারের যুক্তি হলো, এথনিক গ্রুপগুলো আসলে পরষ্পরের সম্পর্কিত ‘বর্ধিত পরিবার’ (Extended Family) বই কিছু নয়, কারণ তাদের দূরবর্তী সদস্যদের মধ্যে ভবিষ্যতে সম্পর্কের সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
ঠিক এই কারণেই সম্ভবত বাঙালি আমেরিকায় পাড়ি দিয়েও বাঙালি কমিউনিটি খুঁজে ফেরে, অফিসেও দেখা যায় ভারতীয়রা একসাথে নিজেরা লাঞ্চে যায়, চৈনিকেরাও তাদের স্বজাতি খুঁজে ফেরে। ব্যাপারটি আর কিছুই নয়, ‘বর্ধিত পরিবার’ হিসেবে বিবেচনা করে জিনপুল রক্ষার প্রচেষ্টা।
এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, মানুষ আসলে জন্মগতভাবেই কিছু না কিছু সাম্প্রদায়িক বা রেসিস্ট মনোভাব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে (যতই অস্বস্তি লাগুক না কেন শুনতে)। নিজের সম্প্রদায়কে সবার আগে ভালোবাসা মানুষের মজ্জাগত, তাই স্বভাবগতভাবেই কিছুটা হলেও সাম্প্রদায়িক বলা যেতে পারে।
পরবর্তীতে সামাজিকীকরণ, শিক্ষা, সুগুণের চর্চার মাধ্যমে আমরা সাম্প্রদায়িকতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারি, তবে অনেকেই পারেন না সেটাও কিন্তু দেখি। অনেক সময় একভাবে সাম্প্রদায়িকতা অস্বীকার করলেও আবার ভিন্নভাবে সাম্প্রদায়িকতার উদ্গীরণ ঘটে। কিছু উদাহরণ আমাদের হাতের কাছেই আছে। আমরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছিলাম রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে। আমরা অস্বীকার করতে পেরেছিলাম জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্বকে।
অনেকেই একাত্তুরে বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ফসল হিসেবে দেখেন। ভালো কথা। কিন্তু সেই ‘অসাম্প্রদায়িক’ আমরাই আবার দেশপ্রেমের মোহে উজ্জীবিত হয়ে চাকমাদের উদ্বাস্তু করেছি, গৃহহীন করেছি, তাদের গায়ে ‘পাকিস্তানি কায়দায়’ লেবাস লাগিয়েছি রাষ্ট্রদ্রোহিতার। পাকিস্তানি কায়দায় ধর্ষণ, অত্যাচার কোনো কিছুই বাদ দেইনি। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া গেলেও জৈববৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উহ্যই ছিল। এদিক থেকে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা খুব সহজ। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমরা সহজেই ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছি, একসাথে যুদ্ধ করতে পেরেছি কারণ আমরা বাঙালি জাতি নিজেদের একটি ‘বর্ধিত পরিবার’ বলে ভাবতে পেরেছি, আমরা বাঙালিরা জেনেটিকভাবে পাকিস্তানিদের তুলনায় অনেক কাছাকাছি।
কিন্তু স্বাধীনতার পরে আমরাই আবার চাকমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, কারণ চাকমারা আবার জেনেটিকভাবে আমাদের থেকে একটু দূরের। এই ক্ষেত্রে বর্ধিত পরিবার-এর মাধ্যমে তৈরি হওয়া দেশপ্রেমই রূপ নিয়েছিল অন্ধ স্বজাতি মোহে, যা চাকমাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রয়োগ করতে বাধেনি। এ ধরনের অনেক উদাহরণই দেয়া যায়, বইয়ের আকারের কথা মনে রেখে একটি উদাহরণেই আপাতত সীমাবদ্ধ রইলাম।
এখন কথা হচ্ছে, এই সংঘাত দূর করার উপায় কী? যেহেতু আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু জাত্যভিমানী প্রবণতা নিয়ে জন্মাই, এবং বড় হয়ে বিভিন্ন পরিবেশে এবং সময়ে এর পরিস্ফূটন ঘটে, আমরা হয়তো কখনোই এ ধরনের সংঘাত পুরোপুরি দূর করতে পারবো না। কিন্তু পুরোপুরি দূর না করতে পারলেও কমিয়ে আনতে পারি, সেটা কিন্তু ঠিক। শিক্ষা, মানবিকতার চর্চা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড প্রভৃতি মানসজগৎ-কে ঋদ্ধ করতে পারে সেগুলো আমরা জানি। নিজের জগতে কূপমণ্ডূক হয়ে না পড়ে থেকে যদি আমরা ভিন্ন সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানতে চেষ্টা করি, নিজেদের মনের দুয়ার উদার করতে পারি, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সাম্প্রদায়িকতার বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। তারপরেও ব্যাপারগুলো আরোপিত।
জেনেটিক ব্যাপারটায় আসলে কোনো প্রভাব ফেলছে না সেভাবে। জেনেটিকভাবে তৈরি রেসিজম কমাতে হলে একভাবেই আমরা তা কমাতে পারি। জোসেফ এম হুইটমেয়ার-এর গাণিতিক মডেল বলছে- সমাধান হচ্ছে ‘ক্রস কালচারাল ইন্টারম্যারেজ’ বা বিভিন্ন জাতিসত্তার মধ্যে বিয়ে। তাদের মতে পারস্পরিক সংঘাতময়তা প্রদর্শনকারী গ্রুপের সদস্যরা যদি স্বজাতিমোহ ছেড়ে অন্য সংস্কৃতির/ধর্মের সদস্যদের বিয়ে করতে শুরু করে, তবেই একমাত্র কনফ্লিক্ট (মজ্জাগত রেসিজম?) কমে আসবে।
নিঃসন্দেহে এটা বলা সহজ, কিন্তু করা কঠিন। এথনোসেন্ট্রিক ব্যবহার আমাদের মজ্জাগত বলেই আমরা বাঙালিরা বিয়ের সময় আরেকজন বাঙালিই খুঁজি। যারা ট্রাডিশনাল তারা আবার পরহেজগার মেয়ে খুঁজবেন, আর যারা একটু উদার তারা গান গাওয়া একটু আধটু সংস্কৃতির চর্চা করা মেয়ে খোঁজেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সীমাবদ্ধ ছকেই।
জাতিসত্তাকে অস্বীকার করতে পারি খুব কমই। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অন্তত আশা দেখেন এই ক্ষেত্রেই। যদিও আমার কাছে এটি অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ জাতীয় সমস্যা। সংঘাত থাকার কারণে ‘ক্রস কালচারাল ইন্টারম্যারেজ’ হচ্ছে না, নাকি ক্রস কালচারাল ইন্টারম্যারেজ হচ্ছে না বলে সংঘাতগুলো মানবসমাজে বজায় আছে, তা বের করা কঠিনই। তারপরেও হুইটমেয়ার-এর সমাধান অন্তত এই মুহূর্তে দ্বিতীয়টির দিকেই।
ভালোবাসা কারে কয়
২৬৯.↑ M Wilson, M Daly, C Wright Uxoricide in Canada: demographic risk patterns . Canadian Journal of Criminology 35: 263-291, 1993
২৭০.↑ Whitmeyer Joseph M. 1997. “Endogamy as a Basis for Ethnic Behavior.” Sociological Theory 15 2: 162-178.