আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের এলাকার ঘাড়ত্যাড়া আর রগচটা ছেলেপিলেদের দিকে দেখিয়ে বলতে শুনেছি— ‘তরুণ বয়স তো, তাই ছেলের রক্ত গরম। দেখবেন বয়স হলে রক্তও ঠান্ডা হয়ে আসবে’। বয়োজ্যেষ্ঠদের এই মন্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে এই অধ্যায়ের ‘বয়সের দোষ’ অংশে এ নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি। পাশাপাশি আরেকটি কথাও বাংলাদেশে খুব শোনা যায় । বিশেষ করে উড়নচণ্ডি ছেলের উন্মাদনা যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়, তখন প্রায়ই অন্য অভিভাবকেরা ভাগ্যবিড়ম্বিত পিতাকে উপদেশ দেন— ‘পোলার বিয়া দিয়া দাও, মাথা ঠান্ডা হইবো’।
সব ক্ষেত্রে যে উপদেশ কাজ করে তা নয়, বরং অনেক সময় অযাচিতভাবে আরেকটি নিরীহ মেয়ের জীবন নষ্ট করা হয়। গ্রামের দিকে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই ‘পাগল চিকিৎসার’ দাওয়াই হিসেবে পাগলের বিয়ে দেয়াটা খুবই জনপ্রিয়। ছোটবেলায় শুনেছিলাম, আমাদের গ্রামের ‘দীনু পাগলা’ নামে বদ্ধ উন্মাদকে একবার জোর করে মমতাজ বেগমের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারপর দেখা গেল পাগলামি তো কমেইনি, বরং বউয়ের জীবনও দীনু পাগলা অতিষ্ঠ করে তুলেছে। শেষমেশ শুনেছিলাম দীনুকে গাছের সাথে বেঁধে রেখে নাকি ‘পাগলের বউ’ মমতাজ বেগম কাজের সন্ধানে বের হতো।
কিন্তু কথা হচ্ছে মেয়ের জীবন নষ্ট করা সংক্রান্ত এই ক্ষতিকর ব্যাপারগুলো জানা সত্ত্বেও কেন অভিভাবকেরা অনেক সময়ই ছেলের পাগলামি সারানোর জন্য বিয়ের দাওয়াই বাতলে দেন? কারণ হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে তারা লক্ষ করেছেন আসলেই বিয়ে দিলে ছেলের ‘মাথা ঠান্ডা হয়’ (অবশ্য দীনু পাগলার মতো বদ্ধ উন্মাদ যাদের পাগলা গারদে রেখে চিকিৎসা প্রয়োজন, তাদের কথা এখানে বলা হচ্ছে না)! একটি উদাহরণ দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।
মুক্তমনায় জাহেদ আহমদ নামে আমাদের এক বন্ধু লেখালিখি করতেন, শুধু লেখালিখি নয় এক সময় আমাদের সাইটে ছিলেন খুবই সক্রিয়, মুক্তচিন্তা এবং মানবতার প্রসারে ছিলেন অন্তপ্রাণ। গত বছর জোর করে বড় ভাই তার ‘পাগলামি সারানোর’ জন্য বিয়ে দিয়ে দিলেন। তারপর থেকেই জাহেদ দেখি উধাও! ঘর সংসার করে নিপাট ভালো মানুষ হয়ে গেছেন। হয়েছেন স্ত্রীর অনুগত আদর্শ স্বামী। চাকরি-বাকরি, ঘর সংসার, সপ্তাহান্তে বউকে নিয়ে মল-এ ঘুরাঘুরি, কিংবা নির্জনে কোথাও একটু বেড়িয়ে আসা। মুক্তচিন্তা আর মানবতাভিত্তিক সমাজ গড়ার ‘পাগলামি’ মাথা থেকে বিদায় হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
আসলে বিয়ের পরে ‘জাহিদ পাগলা’র মতো কারো কারো মাথা ঠান্ডা হবার ব্যাপারটি কিন্তু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। আগেই আভাস দেয়া হয়েছে যে, পুরুষেরা তাদের অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্মান, প্রতিভাসহ অনেক কিছুই বিনিয়োগ করে মূলত নারীকে আকর্ষণের কাজে। পুরুষদের অপরাধপ্রবণতা কিংবা তাদের পাগলামিকেও সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখতে হবে। বহুক্ষেত্রেই দেখা গেছে বিয়ের পরে পুরুষেরা আগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয় না। এমনকি দাগি অপরাধীদেরও অপরাধপ্রবণতা কমে আসে বিয়ের পরে, বহুক্ষেত্রে অপরাধজগৎ থেকে অবসর নেয় বহু অপরাধী[২৬৭]।
এর কারণ হচ্ছে, বিয়ের পর নারীকে আকর্ষণের সেই প্রবৃত্তিগত তাড়না সে আর সেভাবে অনুভব করে না, স্বাভাবিকভাবেই এধরনের চাহিদা অনেক কমে আসে। বিবাহিত পুরুষদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ একেবারে বাদই দিয়ে দেয়; ফলে প্রতিভার স্ফুরণ হোক, অপরাধ প্রবণতা হোক, কিংবা হোক কোনো নির্দোষ পাগলামি সবই কমে আসে।
সেটাকেই বোধ হয় সাধারণ চোখে ‘পাগলা মাথা’কে ‘ঠান্ডা করে’ বলে ধরে নেওয়া হয়। আমেরিকায় গাড়ির ইন্স্যুরেন্স সংক্রান্ত বেশ কিছু জরিপে দেখা গেছে যে, বিবাহিত চালকেরা অবিবাহিত চালকদের চেয়ে অনেক কম দুর্ঘটনায় পতিত হয়। বলাই বাহুল্য, বিবাহিত ড্রাইভাররা অবিবাহিতদের চেয়ে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং আগ্রাসী ড্রাইভিং করে বলেই তারা তুলনামূলকভাবে কম দুর্ঘটনার শিকার হয়।
পুরুষদের প্রতিভার জ্যোতি কি বিয়ের পরে কমে আসে?
নচিকেতার একটা গান আছে —
জনতা জনার্দন শুনে হবেন বড় প্রীত
পুরুষ মানুষ দু’প্রকারের, জীবিত ও বিবাহিত।
পুরুষ মানুষ বেঁচে থাকে বিয়ে করার আগে গো
বিবাহিত পুরুষ মানে প্রকারন্তরেতে মৃত
পুরুষ মানুষ দু’প্রকার, জীবিত ও বিবাহিত। …
বিবাহিত মানে যে প্রকারান্তরে মৃত উপরে আমাদের বন্ধু জাহেদের ঘটনাটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জাহেদ বিয়ের পর লেখালিখি একদমই ছেড়ে দিয়েছে, হয়ে উঠেছে ঘোর সংসারি। লেখক লেখা ছেড়ে দিলে তো এক অর্থে প্রতিভার সমাপ্তি, আর সমাপ্তি মানেই প্রকারান্তরে মৃত, কী বলেন! তবে সবাই যে বিয়ে করে জাহেদের মতো মৃত হয় তা নয় অবশ্য, আমার মতো ‘অর্ধমৃত’ হয়েও বেঁচে থাকে অনেকে!
আসলে যে কারণে বিয়ের পর ‘পাগল-ছাগলদের মাথা ঠান্ডা হয়’, ঠিক একই কারণে প্রতিভার স্ফুরণও ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। এটাকে হালকা কথা বলে উড়িয়ে দিলে কিন্তু ভুল হবে। আমরা আগের একটি অংশে বিজ্ঞানীদের বয়স-প্রতিভা রেখচিত্রের (Age-Genius Curve) সাথে পরিচিত হয়েছি। আমরা সেখানে দেখেছি যে, যৌবনের পরে বয়সের সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের প্রতিভা প্রদর্শনের হার কমতে থাকে। তবে একটি জায়গায় একটু ব্যতিক্রম পাওয়া গেছে।
বিজ্ঞানী যদি অবিবাহিত হন, তবে তার প্রতিভা বয়সের সাথে সাথে অন্য সবার মতোই সামান্য কমে আসলেও তা লোপ পায় না, বরং প্রতিভার ঝিলিক কম বেশি বিচ্ছুরিত হতে থাকে পুরো জীবনকাল জুড়েই। উদাহরণ চান? হাতের সামনেই একটা বিখ্যাত উদাহরণ আছে স্যার আইজ্যাক নিউটন। চিরকুমার এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে আমরা আগেও দু’চারটি কথা বলেছি।
তার সফল এবং বিখ্যাত আবিষ্কারগুলো তরুণ বয়সেই (চব্বিশ বছরের মধ্যেই) করে ফেললেও এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তার প্রতিভা কিন্তু লোপ পায়নি। ত্রিশ বছর বয়সে রিফ্লেক্টিং টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন, ৪৪ বছর বয়েসের সময় তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের জন্য রয়েল সোসাইটিতে পাঠিয়েছিলেন (সেখানেই তিনি মাধ্যাকর্ষণ সূত্র এবং তিনটি গতিসূত্রের ব্যাখ্যা প্রথমবারের মতো হাজির করেছিলেন), ৬২ বছর বয়সে প্রকাশ করেন অপটিক্স।
অপ্টিক্সের তৃতীয় সংস্করণ নিউটন প্রকাশ করেছিলেন ৮৪ বছর বয়সে, মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে। পঁচাশি বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো জীবনকাল জুড়েই নিউটন কর্মক্ষম ছিলেন গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, এমনকি জীববিজ্ঞানসহ এমন কোনো শাখা নেই নিউটনের পাদস্পর্শে ধন্য হয়নি। নিউটন যে এত কর্মক্ষম একটা সময় অতিবাহিত করতে পেরেছিলেন-এর একটা কারণ অনেকেই মনে করেন তিনি অবিবাহিত ছিলেন; ফলে ‘প্রকারান্তরে মৃত’ হবার হাত থেকে বেঁচে গেছেন।
ব্যাপারটি কিন্তু কেবল নিউটনের ক্ষেত্রেই সত্য বলে ভাবলে ভুল হবে। গবেষকেরা দেখেছেন যে, অন্তত শতকরা পঞ্চাশভাগ (৫০%) ক্ষেত্রে অবিবাহিত বিজ্ঞানীরা তাদের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলো যেমন জীবনের প্রাথমিক সময়ে (বিশ বছর বয়সের দিকে) করেন, ঠিক তেমনি পুনর্বার সেরকম কিছু করে দেখাতে পারেন যখন বয়স পঞ্চাশ পেরোয়, কিন্তু বিবাহিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে সে ধরনের সফলতার হার শতকরা মাত্র ৪.২ ভাগ[২৬৮]। নীচে গবেষণাপত্র থেকে বিবাহিত এবং অবিবাহিত বিজ্ঞানীদের সফলতার একটা তুলনামূলক চিত্র দেয়া হলো —

গ্রাফগুলোর ট্রেন্ড দেখলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, বিবাহিত বিজ্ঞানীরা আসলে ‘প্রকারান্তরে মৃত’!
অবশ্য এ ধরনের ট্রেন্ডের ফলাফল যাই হোক এর কারণ নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ আছে পুরোমাত্রায়। ‘কমন সেন্স’ থেকেই বোঝা যায় যে, পেশার বাইরেও বিবাহিত বিজ্ঞানীদের বড় একটা সময় সংসার, বাচ্চাকাচ্চা মানুষ-করাসহ আনুষঙ্গিক পার্থিব কাজে ব্যয় করতে হয়। আর আধুনিক বিশ্বে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েদেরও কিন্তু নিজস্ব ক্যারিয়ার থাকে।
ফলে গৃহস্থালির কাজগুলো প্রায়শই স্বামী-স্ত্রীতে ভাগাভাগি করে নিতে হয়; আর এগুলো করতে গিয়ে তাদের একাডেমিক গবেষণার সময় কমে আসে। অবিবাহিত বিজ্ঞানীরা যেহেতু পুরোটা সময় এসমস্ত ঝুটঝামেলা থেকে মুক্ত থাকেন সেহেতু তারা গবেষণায় প্রতিভা স্ফুরণের সুযোগ এবং সময় পান বেশি। কাজেই প্রতিভা লোপের ব্যাপারটা কতটা জৈবিক আর কতটা সামাজিকতা নিয়ে সন্দেহ কিংবা বিতর্ক করার যথেষ্টই অবকাশ আছে।
তারপরেও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত কিছু গবেষক দেখিয়েছেন যে, সত্তুরের দশকে কিংবা তার আগে মেয়েদের খুব একটা ‘নিজস্ব ক্যারিয়ার’ ছিল না। সে সময় গৃহস্থালির কাজগুলো মূলত মেয়েরাই করত। ফলে বিবাহিত পুরুষ বিজ্ঞানীদের তেমন একটা বাচ্চাকাচ্চা ঘর-সংসার নিয়ে মাথা ঘামাতে হতো না। কিন্তু তারপরেও বিবাহিত বিজ্ঞানীদের প্রতিভার স্ফুরণে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পাওয়া যায়নি। ভিক্টোরীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হোক, আর আধুনিক জেন্ডার সচেতন সমাজ হোক, ট্রেন্ড একটাই বিয়ের পর একইভাবে প্রতিভার স্ফুরণ কমে আসে প্রায় একই ধারায়।
ভালোবাসা কারে কয়
২৬৭.↑ Criminologists have long known that criminals tend to “settle down” and desist (stop committing crime)
once they get married, while unmarried criminals continue their criminal careers.
২৬৮.↑ Satoshi Kanazawa, Why productivity fades with age: The crime–genius connection, Journal of Research in Personality 37, 257–272, 2003