বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান: যে হেত্বাভাসগুলো নিয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন
‘কী’ বনাম ‘উচিত’ এর হেত্বাভাস (“Is” vs. “Ought” fallacy): এই বইটি পড়লে পাঠকেরা মানব প্রকৃতির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের একটা প্যাটার্নের ব্যাখ্যা পাবেন বেশিরভাগ জায়গাতেই। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেই প্যাটার্নটাই আপনার আমার সবার জন্যই প্রযোজ্য, কিংবা সেটাই সর্বোত্তম। কেন সমাজ বা মানব প্রকৃতির বড় একটা অংশ কোনো একটা নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ থাকে সেটা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়, সমাজ কী রকম হওয়া ‘উচিত’ তা নয়।
আরও পরিষ্কার করে বললে বিবর্তন কোনো অথোরিটি দাবি করে না। কাজেই বিবর্তনের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য কেউ ব্যক্তিগত জীবনে কিংবা সমাজে প্রয়োগ করার ঔচিত্যের আহ্বান জানালে সেটা নিঃসন্দেহে একটি ভ্রান্তি বা হেত্বাভাস হবে। ‘কী’ বনাম ‘উচিত’ এর কুযুক্তিকে হেত্বাভাস হিসেবে সর্বপ্রথম তুলে ধরেন আঠারো শতকের বিখ্যাত স্কটিশ দার্শনিক এবং ইতিহাসবিদ ডেভিড হিউম[৩২]।
প্রাকৃতিক হেত্বাভাস (Naturalistic fallacy): আগেই বলেছি, এই বইয়ে বহু জৈবিক প্যাটার্নের প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা পাবেন পাঠকেরা। কিন্তু কোনো কিছু প্রাকৃতিক হলেই সেটা ‘ভালো’—এরকম সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াটা একটি বড় ধরনের ভ্রান্তি। যেমন, বিবর্তনের মাধ্যমে আমরা একটা প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা পাই কেন পুরুষদের মন মানসিকতা প্রতিযোগিতামূলক হয়ে বেড়ে উঠেছে, কিংবা কেন তারা অপেক্ষাকৃত সহিংস আর কেন মেয়েরা গড়পড়তা পুরুষদের চেয়ে জৈবিকভাবে বেশি স্নেহপরায়ণ। কিন্তু তার মানে কেউ যদি মনে করেন যে, তাহলে মেয়েরা কেবল গৃহস্থালির কাজ করবে, শিশু আর তার স্বামীপ্রভুর যত্ন-আত্তি করবে, আর ছেলেরা বাইরে ডাণ্ডাগুটি মেরে বেড়াবে- সেটা হবে একটি প্রাকৃতিক হেত্বাভাসের উদাহরণ।
আমরা জানি এই বাংলাতেই এমন একটা সময় ছিল যখন বাল্যবিবাহ করা ছিল ‘স্বাভাবিক’ (রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম-সহ অনেকেই বাল্যবিবাহ করেছিলেন) আর মেয়েদের বাইরে কাজ করা ছিল ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত মেয়েদের বাইরে কাজ করার বিপক্ষে একটা সময় যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন এই বলে[৩৩]—
যেমন করেই দেখ প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সেরকম অভিপ্রায় না হতো, তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাতো। যদি বল, পুরুষদের অত্যাচারে মেয়েদের এই দুর্বল অবস্থা হয়েছে, সে কোনো কাজেরই কথা নয়।
অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথের যুক্তি এখন মানতে গেলে কপালে টিপ দিয়ে, হাতে দু-গাছি সোনার বালা পরে গৃহকোণ উজ্জ্বল করে রাখা রাবীন্দ্রিক নারীরাই সত্যিকারের ‘প্রাকৃতিক’। আর শত সহস্র আমিনা, রহিমারা যারা প্রখর রোদ্দুরে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে ইট ভেঙে, ধান ভেনে সংসার চালাচ্ছে, কিংবা পোশাক শিল্পে নিয়োজিত করে পুরুষদের পাশাপাশি ঘামে শ্রমে নিজেদের উজাড় করে চলেছে—তারা সবাই আসলে ‘প্রকৃতি বিরুদ্ধ’ কুকর্মে নিয়োজিত কারণ, ‘প্রকৃতিই বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না’।
বাংলাদেশের অখ্যাত আমিনা, রহিমাদের কথা বাদ দেই, নাসার মহাজাগতিক রকেট উৎক্ষেপন থেকে শুরু করে মাইনিং ফিল্ড পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে মেয়েরা পুরুষদের পাশাপাশি আজ কাজ করছেন না। তাহলে? তাহলে আর কিছুই নয়। নিজের যুক্তিকে তালগাছে তোলার ক্ষেত্রে ‘প্রকৃতি’ খুব সহজ একটি মাধ্যম, অনেকের কাছেই। তাই প্রকৃতির দোহাই পাড়তে আমরা ‘শিক্ষিত জনেরা’ বড্ড ভালোবাসি।
প্রকৃতির দোহাই পেড়ে আমরা মেয়েদের গৃহবন্দি রাখি, জাতিভেদ বা বর্ণবাদের পক্ষে সাফাই গাই, অর্থনৈতিক সাম্যের বিরোধিতা করি, তেমনি সময় সময় সমকামী, উভকামীদের বানাই অচ্ছুৎ। কিন্তু যারা যুক্তি নিয়ে একটু আধটু পড়াশোনা করেছেন তারা জানেন যে, প্রকৃতির দোহাই পাড়লেই তা যুক্তিসিদ্ধ হয় না। বরং প্রকৃতির কাঁধে বন্দুক রেখে মাছি মারার অপচেষ্টা জন্ম দেয় এক ধরনের কুযুক্তি বা হেত্বাভাসের (Logical fallacy)।
ইংরেজিতে এই হেত্বাভাসের পুঁথিগত নাম হলো- ‘ফ্যালাসি অব ন্যাচারাল ল’ বা ‘অ্যাপিল টু নেচার’[৩৪]। এমনি কিছু ‘অ্যাপিল টু নেচার’ হেত্বাভাসের উদাহরণ দেখা যাক—
১। মিস্টার কলিন্সের কথাকে এত পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। কলিন্স ব্যাটা তো কালো। কালোদের বুদ্ধি সুদ্ধি একটু কমই হয়। কয়টা কালোকে দেখেছ বুদ্ধি সুদ্ধি নিয়ে কথা বলতে? প্রকৃতি তাদের পাঁঠার মতো গায়ে গতরে যেটুকু বাড়িয়েছে, বুদ্ধি দিয়েছে সেই অনুপাতে কম। কাজেই তাদের জন্মই হয়েছে শুধু কায়িক শ্রমের জন্য, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চার জন্য নয়।
২। মারামারি, কাটাকাটি হানাহানি, অসাম্য প্রকৃতিতেই আছে ঢের। এগুলো জীবজগতের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। কাজেই আমাদের সমাজে যে অসাম্য আছে, মানুষের উপর মানুষের যে শোষণ চলে তা খারাপ কিছু নয়, বরং ‘কমপ্লিটলি ন্যাচারাল’।
৩। প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না। যদি প্রকৃতির সেরকম অভিপ্রায় না হতো, তা হলে মেয়েরা বলিষ্ঠ হয়ে জন্মাতো।
৪। সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। প্রকৃতিতে তুমি কয়টা হোমোসেক্সুয়ালিটির উদাহরণ দেখেছ?
৫। প্রকৃতিতে প্রায় প্রতিটি প্রজাতিতেই বহুগামিতা দৃশ্যমান, কাজেই মানবসমাজে বহুগামিতা গ্রহণ করে নেওয়াই সমীচীন।
উপরের উদাহরণগুলো দেখলে বোঝা যায়, ওতে যত না যুক্তির ছোঁয়া আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি লক্ষনীয় ‘প্রকৃতি’ নামক মহাস্ত্রকে পুঁজি করে পাহাড় ঠেলার প্রবণতা। এমনি উদাহরণ দেওয়া যায় বহু। আমি আমার সমকামিতা (২০১০) বইয়ে[৩৫] এ ধরনের বহু প্রাকৃতিক হেত্বাভাসের উল্লেখ করেছিলাম। সেগুলো এই বইয়ের জন্যও প্রযোজ্য। প্রাকৃতিক হেত্বাভাসের ব্যাপারটি হেত্বাভাস হিসেবে সর্বপ্রথম তুলে ধরেন বিশ শতকের প্রথমভাগে ইংরেজ দার্শনিক জর্জ এডওয়ার্ড মুর[৩৬]।
নৈতিক হেত্বাভাস (Moralistic fallacy): নৈতিক হেত্বাভাস হচ্ছে প্রাকৃতিক হেত্বাভাসের ঠিক উলটো। এর প্রবক্তা হার্ভাডের মাইক্রোবায়োলজিস্ট বার্নাড ডেভিস[৩৭]। এই ধরনের ভ্রান্তি যারা করেন, তারা ‘উচিত’কে ‘কী’ দিয়ে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেন। কোনো কিছু নৈতিকভাবে সঠিক বলে মনে হলেই সেই ব্যাপারটাকে প্রাকৃতিক মনে করাটাই এই ভ্রান্তির মোদ্দাকথা। যেমন, ‘ধর্ষণ করা অনৈতিক, ফলে প্রকৃতিতে জীবজগতে কোথাও ধর্ষণ নেই’- এটা একটি নৈতিক হেত্বাভাসের উদাহরণ। কিংবা কেউ যদি বলেন, ‘মানবসমাজের শিক্ষায়তনে কোনো ধরনের বৈষম্য লালন করা হয় না, ফলে প্রকৃতিতেও কোনো ধরনের বৈষম্য নেই’- এটাও নৈতিক হেত্বাভাসের উদাহরণ হবে।
এই বইয়ে যতদূর সম্ভব এ ধরনের হেত্বাভাসগুলো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়েছে। এই বইয়ের উদ্দেশ্য কেবল নির্মোহ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখানো কীভাবে প্রকৃতি কিংবা সমাজের বিভিন্ন প্যাটার্ন কাজ করে, কিন্তু সমাজ কিংবা প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে কোনো মতামত দেয়া হয়নি। আমার প্রত্যাশা থাকবে আমার এই বইয়ের পাঠকেরাও এই বই থেকে কোনো ধরনের বৈধতাসূচক কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হবার আগে উপরের হেত্বাভাসগুলোকে স্মরণ করবেন।
ভালোবাসা কারে কয়
৩২.↑ David Hume, A Treatise of Human Nature, London: John Noon. p. 469, 1739.
৩৩.↑ রামাবাই এর বক্তৃতা উপলক্ষ্যে, জৈষ্ঠ, ১২৯৬, রবীন্দ্র রচনাবলী, বিশ্বভারতীয় সুলভ সংস্করণ। এছাড়া মুক্তমনায় রাখা ‘Tagore without Illusion‘ পাতাটিও দেখা যেতে পারে।
৩৪.↑ কুযুক্তি বা হেত্বাভাস – Logical Fallacies
৩৫.↑ অভিজিৎ রায়, সমকামিতাঃ একটি বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-মনতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, শুদ্ধস্বর, ২০১০
৩৬.↑ G. E. Moore, Principia Ethica, Cambridge: Cambridge University Press., 1903
৩৭.↑ B. D. Davis ,The moralistic fallacy, Nature. 30;272(5652):390, 1978