ভালোবাসা কারে কয়

অভিজিৎ রায়

০৬. ভালোবাসার উপঢৌকন

কেন হীরার আংটি কিংবা সোনার গয়না হয়ে উঠে ভালোবাসার উপঢৌকন ?

আমি যখন এই অংশটি বইয়ের জন্য লিখছিলাম তখন প্রিন্স উইলিয়াম এবং কেট সবে বিয়ে করেছেন। মিডিয়ার গরম খবর এটি তখন। এই একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের নাগরিক হিসেবে আমার অবশ্য এই সব অথর্ব রাজা রানি আর তাদের সুপুত্র কিংবা কুপুত্রদের বিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না কখনই। কেবল বিনোদন হিসেবে মাঝে মধ্যে এ ধরনের খবরে চোখ বোলানোই সার হতো। কিন্তু সেসময় গত কয়েক দিন ধরে এই কেট উইলিয়ামের বিয়ে নিয়ে মিডিয়া যা শুরু করেছিল তাতে আমি রীতিমতো হতভম্ব। সে সময় এই মিডিয়া কাঁপানো বিয়ের একদিন আগে আমেরিকার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে সময়কালের ভয়ঙ্করী প্রলঙ্করী এক ঘূর্ণিঝড়। চারশ’র মতো লোক মারা গিয়েছিল। আলাবামার অবস্থা তো যাচ্ছে তাই, এমনকি আমি যে জর্জিয়া স্টেটে থাকি সেখানকার আশেপাশের বেশ কিছু বাড়িঘর ভেঙেছে, মানুষও মারা গেছে কম বেশি।

অথচ সিএনএন-এর মতো সংবাদমাধ্যম সে সময় সেসব কিছু বাদ দিয়ে কেবল কেট আর উইলিয়ামের বিয়ের আয়োজন প্রচার করে চলছিল সারা দিন ধরে যেন পৃথিবীতে এটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু! কেট কোন রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেছেন, কীরকম পোশাক পড়েছেন, বিয়ের পরে কীভাবে ব্যালকনিতে পরস্পরকে চুম্বন করলেন, আটটি স্তরের কত বড় আয়তনের কেক ছিল বিয়েতে, কীভাবে তারা জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন এগুলো নিয়ে বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণ চলছে। অবশ্য মিডিয়ার আর কী দোষ। আমার মতো আদার ব্যাপারীর এই রাজকীয় বিয়ে নিয়ে আগ্রহ না থাকলেও সাড়া বিশ্বের মানুষের আগ্রহের কমতি দেখছি না!

৫০০০ পুলিশ অফিসারসহ আর্মি নেভি আর এয়ারফোর্সের নিয়োগদান সহ কেবল নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই নাকি খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ মিলিয়ন ডলার। কাজেই পুরো বিয়ের আয়োজনের খরচ কত হতে পারে সহজেই অনুমেয়! নিঃসন্দেহে এই বিশাল খরচের বড় একটা অংশের ব্যয়ভার বহন করতে হয় সেই জনগণকেই। তাতেও যে কারো কোনো আপত্তি আছে তা মনে হচ্ছে না। খোদ বাকিংহাম প্যালেসের বাইরেই নাকি প্রায় ৫০০,০০০ মানুষ জমায়েত হয়েছিল বর-বধূকে এক-নজর দেখার জন্য। কাজেই এই অপব্যয়িতাকে সাদরে গ্রহণ করার ব্যাপারে নিরাসক্ত হলে আপনিও আমার মতো বিবর্তনীয়ভাবে ‘মিসফিট’ বলে বিবেচিত হয়ে যাবেন!

royal-engagement-rings-expensive-engagement-rings
চিত্র : প্রায় ৮ ক্যারট হীরার আংটিটি উইলিয়াম কেট কে বাগদানের সময় উপহার দিয়েছেন, তার মূল্যমান খোলাবাজারে প্রায় আকাশ ছোঁয়া

তাই আমার মতো বিবর্তনীয়ভাবে মিসফিট হবার হাত থেকে বাঁচতে হলে দু-চারটি কথা জেনে রাখতে পারেন। প্রিন্স উইলিয়াম তার হবু বধূ কেট মিডেলটনকে বিয়ের প্রস্তাব দেন আট বছর ধরে প্রেম করার পর ২০১০ সালের নভেম্বরের ১৬ তারিখ। প্রায় ৮ ক্যারট হীরার আংটিটি উইলিয়াম কেট কে সে সময় উপহার দিয়েছেন, সেটি একসময় তার মা প্রিন্স ডায়না পরতেন। কাজেই আংটিটি নিয়ে উইলিয়ামের আবেগ সহজেই অনুমেয়। তিনি সেটা মিডিয়ায় বলেছেনও ‘এটা আমার মায়ের বিয়ের অঙ্গুরি। কাজেই এটা আমার কাছে অবশ্যই বিশেষ কিছু। আমি চাই যে আমার মার স্মৃতি আমার বিয়ের সময় অক্ষুণ্ণ থাকুক’।

কাজেই এই আংটির পেছনে এত আবেগময় স্মৃতি জড়িত যে, কখনো যদি এই আংটি নিলামে উঠে, তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরাও এই আংটিটি কেনার জন্য দরদাম করতে ভয় পাবেন। এমনকি যদি শুধু হীরার মূল্যমান হিসেবেও বিচার করি, তাহলেও খোলাবাজারে এ ধরনের আংটি ২০০, ০০০ থেকে ২৫০, ০০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।

কিন্তু কেন এত ব্যয়বহুল বিনিয়োগ? হয়তো ভাবছেন রাজরাজড়াদের ব্যাপারস্যাপারই আলাদা। তারা যদি হীরার আংটি নিয়ে লালায়িত না হন, তো হবে কে? কিন্তু আপনি খুঁজলেই দেখতে পাবেন, সাধারণদের মধ্যেও হিরের আংটি নিয়ে বিহ্বলতা কম নয়।

আমার অফিসের এক বান্ধবী প্রায় ৩/৪ ক্যারেটের এক ডায়মন্ডের রিং পরে অফিসে আসে (যদিও ওটা সত্যিকারের হীরা কি না আমার কিছুটা সন্দেহ আছে)। হীরকখচিত আঙুল দুলিয়ে দুলিয়ে এমনভাবে কথা বলে যে, হীরার আংটিটার দিকে যে কারো নজর যেতে বাধ্য। আর সুযোগ পেলেই সে সবাইকে শুনিয়ে ফেনিয়ে-ফেনিয়ে গল্প শোনায় কোন সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কোন হীরক রাজার দেশ থেকে তার প্রেমিক এই বিশাল এই হীরার আংটি বানিয়ে নিয়ে এসেছিল, আর কত রোমান্টিকভাবে তাকে বিয়ের প্রস্তাব করেছিল!

আমার অফিসের আরেক কলিগ গ্রাজুয়েশন করে নতুন চাকরি শুরু করেছে। কিন্তু বেচারা গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করতে পারছে না, কারণ গার্লফ্রেন্ডকে তুষ্ট করার মতো হীরের আংটি কেনার সামর্থ নাকি এখনও অর্জন করতে পারেনি। তার গার্লফ্রেন্ড নাকি এমনিতে খুব ভালো, কোনো কিছুই চায় না তার কাছে, কিন্তু একটি কথা নাকি সম্পর্কের প্রথমেই তাকে বলে দিয়েছে বাগদানের সময় যেনতেন হীরের আংটি হলে কিন্তু তার চলবে না। এমন আংটি দিয়ে তাকে প্রপোজ করতে হবে যেন সেটা সবাইকে দেখিয়ে বাহবা কুড়াতে পারে। বেচারা বয়ফ্রেন্ডটি এখন চোখ কান বুজে চাকরি করছে, টাকা জমাচ্ছে। ওভারটাইম করে টু-পাইস একটু বেশি কামানো যায় কি না তার নানা ফন্দি ফিকির খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। হীরের আংটি দিয়ে প্রেমিকার মন তুষ্ট করতে হবে না!

পাশ্চাত্যের মতো আমাদের দেশেও মেয়েদের মধ্যে গয়নাগাটি পছন্দ করার চল আছে। শুধু চল বললে ভুল হবে, বিয়ের সময় কতভরি সোনার গয়না দিয়ে বৌকে কেমনভাবে সাজানো হলো সেটা সবসময়ই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। একটা সুযোগ পেলে অনেক মেয়েই বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে পাওয়া গয়নাগাটি বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনদের দেখিয়ে কিংবা কোনো বিয়ে বাড়িতে বা বড় কোনো পার্টিতে গলা কিংবা কানে স্বর্ণালঙ্কারের ঝলক দেখিয়ে সবার মাঝে বাহবা কুড়াতে পছন্দ করে এগুলো আমরা হর-হামেশাই দেখি। কেন পাশ্চাত্যে হীরের আংটি কিংবা আমাদের দেশে সোনার গয়না মেয়েদের এত পছন্দের?

এই প্রশ্নটা আমার বরাবরই মনে খচখচ করত। হীরার অঙ্গুরি সোনার গয়নার কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই। ভাত, মাংস, পোলাও-কোরমা খেয়ে যেমন উদরপূর্তি করা যায়, বিলাসবহুল বাড়িতে থেকে গা এলিয়ে দিয়ে আরাম-আয়েশ করা যায়, মার্সিডিস কিংবা রোলস রয়েসে বসে রাজার হালে ঘুরে বেড়ানো যায়, আই ফোনে যেমন সেকেন্ডে সেকেন্ডে কথা বলা যায়, আই প্যাডে যেমন রেস্তোরায় বসে কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে ব্রাউস করা যায় — হীরা কিংবা সোনার সেরকম কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা কেউ কখনোই খুঁজে পায়নি। অথচ তারপরেও হীরা বা সোনার গয়নার জন্য সুযোগ পেলেই হামলে পড়ে মেয়েরা। আর ছেলেরাও ভালোবাসার প্রমাণ হিসেবে রাজ-রাজ্য চষে হাজির করে প্রায়োগিকভাবে মূল্যহীন কিন্তু নারীর কাছে অমূল্য সেই সব রত্ন পাথর আর সোনা দানা। কিন্তু কেন?

উত্তরটা খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক পরে। ডারউইনের সেক্সুয়াল সিলেকশন তথা যৌনতার নির্বাচনের মধ্যেই যে এই জটিল প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে ছিল সেটা কি আর আমি তখন জানতাম?

প্রাণিজগৎ থেকেই শুরু করি। যৌনতার নির্বাচনের বহুল প্রচলিত ময়ূরের পেখমের উদাহরণটি আবারো এখানে চলে আসবে। আমরা জানি, ময়ূরের দীর্ঘ পেখম টিকে আছে মূলত নারী ময়ূর বা ময়ূরীর পছন্দ তথা যৌনতার নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়ে। কীভাবে? ১৯৭৫ সালে ইসরাইলি জীববিজ্ঞানী অ্যামতোজ জাহাভি (Amtoz Zahavi) প্রস্তাব করলেন যে, ময়ূরীর এই দীর্ঘ পেখম ময়ূরের কাছে প্রতিভাত হয় এক ধরনের ‘ফিটনেস ইন্ডিকেটর’ বা সুস্বাস্থ্যের মাপকাঠি হিসেবে। জাহাবির মতে, সততার সাথে সুস্বাস্থ্যের বিজ্ঞাপন দিতে গেলে এমন একটা কিছুর মাধ্যমে সেটা প্রকাশ করতে হবে যাতে খরচের প্রাচুর্যটা এমনকি সাদা চোখেও ধরা পড়ে। সোজা ভাষায় সেই বিজ্ঞপ্তি অঙ্গটিকে নিঃসন্দেহে হতে হবে ‘কস্টলি অর্নামেন্ট’। ঠিক এজন্যই যৌনতার অলংকারগুলো প্রায় সবসময়ই হয় বেঢপ আকারে বিবর্ধিত, ব্যয়বহুল, অপব্যয়ী কিংবা জবরজং ধরনের জটিল কিছু।

ময়ূরের পেখম কেবল ময়ূরীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সস্তা প্রচারণা নয়। ময়ূরের পেখম দীর্ঘ, ভারী আর ভয়ানক বিপদসঙ্কুল। দীর্ঘ পেখম এত অনায়াসে তৈরি করা যায় না, আর এমনকি এই বেয়াক্কেল পেখমের কারণে তার শিকারিদের চোখে পড়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেক। বেচারা ময়ূরকে কেবল নিজের দেহটিকেই বয়ে বেড়াতে হয় না, টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে বেড়াতে হয় তার পশ্চাৎদেশের সাথে জুড়ে থাকা এই অবিশ্বাস্য বড় ধরনের বাড়তি একটা পেখমের ঝাঁপি (জাহাভির মতে এই বিলাসিতা এমনই দৃষ্টিকটু যে এটা প্রায় পঙ্গুত্বের সামিল, তার তত্ত্বের নামই এজন্য Handicap principle)। এজন্য ময়ূরকে হতে হয় স্বাস্থ্যবান এবং নীরোগ।

কখনোসখনো কোনো স্বাস্থ্যহীন ময়ূরের দীর্ঘ পেখম গজাতে পারে বটে, কিন্তু সেটা বয়ে নিয়ে বেড়িয়ে খাবার খোঁজা, কিংবা শিকারিরা তাড়া করলে দ্রুত দৌঁড়িয়ে পালিয়ে যাওয়া সেই স্বাস্থ্যহীন ময়ূরের পক্ষে দুঃসাধ্যই হবে। কেবল মাত্র প্রচণ্ড শক্তিশালী কিংবা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ময়ূরের পক্ষেই এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে এ ধরনের পেখমের বিলাসিতা ধারণ করা সম্ভব হয় ।

তাই পেখমওয়ালা বিলাসী ময়ূর ময়ূরীর পালের কাছে গিয়ে সোচ্চারে ঘোষণা করতে পারে –

এই যে মহীয়সী ময়ূরী, আমার ন্যাজের দিকে তাকাও; দেখো আমি সুস্থ, আমি সুন্দর! আমি এমনই স্বাস্থ্যবান আর শক্তিশালী যে, আমি আমার ষাট ইঞ্চি ব্যাসার্ধের পেখম বয়ে বেড়াতে পারি অবলীলায়। আমি আমার খাদ্য আর দৈহিক পুষ্টিকে সাইফন করে আমার পেখমের আকার-আকৃতিকে তোমারই জন্য বর্ণাঢ্য করে রেখেছি। কোনো শিকারি আমাকে পেছন থেকে আক্রমণ করে পরাস্ত করতে পারে না। ভারী লেজ থাকা সত্ত্বেও আমি উসেইন বোল্টের মতো এক দৌড়ে শিকারিকে পেছনে ফেলে দিতে পারি, আমার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্দান্ত, আমার দেহ কোনো রোগ জীবাণুর আবাসস্থল নয়। তুমি দেখলেই বুঝবে উজ্জ্বল পেখম আর অন্য সব কিছু মিলিয়ে আমার সঞ্চিত সম্পদ অঢেল; ধন সম্পদ আর প্রাচুর্যে আমি ভরপুর। আমাকে সঙ্গী হিসেবে নির্বাচণ করলে তুমি সুখে থাকবে হে নারী…’’।

তাই ময়ূরীকে আকর্ষণের জন্য স্বভাবগতভাবেই ময়ূরকে বিলাসী হতে হয়। আমরা যতই অপচয়কারীকে ‘শয়তানের ভাই’ বলে গালমন্দ করি না কেন, অপচয় এবং ব্যয়বাহুল্য জৈবজগতে যৌনসম্পর্ক গঠনের (Sexual Courtship) এক অত্যাবশকীয় নিয়ামক। একটা পুরুষ কোকিলকে তার অতিরিক্ত বিশ ভাগ শক্তি ব্যয় করতে নিজের গলাকে সুরেলা করে তুলতে। কারণ এই সুরেলা গলাই তার আকর্ষণের হাতিয়ার। ঠিক একই কারণে হরিণের শিং-কে হতে হয় বর্ণাঢ্য, তার প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি। তার মানে, যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির বিবর্তন হতে গেলে অপচয় প্রবণতার প্রকাশ হতে হবে একরকম অবশ্যম্ভাবী।

এটা যে কেউই বুঝবে যে, একটা ময়ূর তার পেখম না থাকলে বরং আরও ভালোভাবে চলে ফিরে বেড়াতে পারত। তার এই বেঢপ পেখমের পেছনে এত শক্তি অপচয় না করে খেয়ে দেয়ে আমোদ-ফুর্তি করে বেড়াতে পারত। পেখমের পিছনে শক্তি খরচ না করে শক্তি সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করতে পারত। কিন্তু যৌনতার নির্বাচনী চাপ তাদের মানসজগতে অবিরতভাবে কাজ করে যায় বলেই, সে পেখম গঠনের ব্যাপারে নির্লিপ্তভাবে অপব্যয়ী হয়ে ওঠে; উঠতে তাকে হবেই। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রকৃতিতে দৃষ্টিকটু রকমের অপব্যয়িতাই হচ্ছে সততার সাথে নিজের সম্পদকে অন্যের সামনে তুলে ধরার একমাত্র সহজ মাধ্যম।

বিজ্ঞানীরা বলেন, বিবর্তনের যাত্রাপথে নারী অভিরুচির ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। নারী অভিরুচির কারণেই পুরুষ ময়ূরের পেখম দীর্ঘ হয়েছে। পুরুষ কোকিলের গলা সুরেলা হয়েছে। পুরুষ বাবুই পাখি শিখেছে মনোরম বাসা বানাতে। নীচে একটি টেবিলের সাহায্যে দেখানোর চেষ্টা করা হলো, কীভাবে নারী অভিরুচিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিভিন্ন প্রজাতিতে ব্যয়বহুল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিংবা নানা অপব্যয়ী বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটেছে[১০৬]

what-female-want

মানবসমাজেও কি আমরা এরকমের অপব্যয়িতার হাজারো প্রমাণ পাই না? যাদের বেশি টাকা পয়সা আছে, তারা দামি অট্টালিকা বানায়, বনেদি এলাকায় থাকে, রোলস রয়েস কিংবা পাজেরো গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়ায়, সৌখিন এবং দামি ডিজাইনার ব্র্যান্ডের পোশাক-আশাক কিংবা জুতো পরে ঘুরে বেড়ায়। বৈষয়িক দিক থেকে চিন্তা করলে এগুলোর কোনোটারই কিন্তু দরকার ছিল না। বরং দামি গাড়ি কিংবা পোশাক-আশাকের পেছনে নিয়মিত অর্থ ব্যয় না করে টাকাগুলো ব্যাংকে তুলে রাখলে অপব্যয়িতার হাত থেকে মুক্ত থাকা যেত, পয়সা কড়িও একটু বেশি জমতো।

কিন্তু তাই কি হয়? কোনো পয়সাওয়ালাই কেবল সুইস ব্যাংকে তার সব টাকা-পয়সা তুলে রেখে ছেঁড়া গেঞ্জি, পায়জামা আর ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে টো-টো করে ঘুরে বেড়ায় না। বরং উলটো নিজের অর্জিত সম্পদের সংকেতকে বস্তুনিষ্ঠভাবে অন্যের কাছে তুলে ধরতে চায় আর রাজপ্রাসাদোপম বাড়ি কিংবা দামি গাড়ি, জুতো জামাকেন্দ্রিক অপব্যয়িতা গুলোই হচ্ছে তাদের জন্য সর্বসাধারণের কাছে সম্পদ প্রকাশের ‘ফিটনেস মার্কার’।

নিজের সম্পদকে তথা ব্যয়বহুল অলংকারগুলোকে সততার সাথে প্রকাশ করে নিজের ‘ফিটনেস’কে বিজ্ঞাপিত করতে চায় সকলেই। সম্পদ বলতে কেবল শুধু বাড়ি-গাড়ি, টাকা-পয়সা, জুতো-জামার কথাই আমি বোঝাচ্ছি না, সেই সাথে আমাদের বিজ্ঞাপিত সম্পদের তালিকায় চলে আসবে শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞান, সাহস, দৈহিক-শক্তি, সংগীত প্রতিভা, বাকচাতুর্য, সুদর্শন চেহারা, কৃষ্টি, নৃত্যপটুতা, প্রগতিশীলতা, অধিকার সচেতনতা, উদ্ভাবনী শক্তি, দৈহিক সৌন্দর্য, সততা, নৈতিকতা, দয়াপরবশতা, রসিকতা, হাস্যরসপ্রিয়তাসহ অনেক কিছুই। কারণ দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে মানুষ শিখেছে যে এই দৃষ্টিনন্দন গুণাবলিগুলোর প্রতিটিই বিপরীত লিঙ্গের কাছে হয়ে উঠে আকর্ষণের বস্তু, আর সম্ভবত যৌনতার নির্বাচনের পথ ধরেই সেগুলো মানবসমাজে বিকশিত হয়েছে বিপরীত লিঙ্গের বিভিন্ন চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে। কিন্তু তার পরেও বলতে বাধ্য হচ্ছি এর কোনোটিই বিয়ের সময় হীরার আংটির মতো গুরুত্বপূর্ণ ‘ভালোবাসার উপঢৌকন’ হিসেবে উঠে আসে না। কিন্তু কেন?

nuptial-gift
চিত্র : যৌনতার নির্বাচন যদি সঠিক হয়ে থাকে তবে, প্রকৃতিতে দৃষ্টিকটু রকমের অপব্যয়িতাই হচ্ছে সততার সাথে নিজের সম্পদকে অন্যের সামনে তুলে ধরার একমাত্র সহজ মাধ্যম। সেজন্যই কি হীরার আংটি মানবসমাজে এত পছন্দনীয় ‘নাপশাল গিফট’?

হীরার আংটি দিয়ে প্রস্তাব না করে আপনি আপনার প্রেমিকাকে বাজার থেকে একটা আইদাহ আলু কিনে কিংবা সিলেটি কমলালেবু নিয়ে এসে প্রস্তাব করতে পারতেন। যত হাস্যকরই শোনাক না কেন, আলু কিংবা কমলালেবুর ব্যবহারিক উপযোগিতা কিন্তু হীরা কিংবা সোনাদানার চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষুধার সময় আলু খেয়ে কিংবা মনের আনন্দে কমলা চিবিয়ে আপনি খিদে দূর করতে পারেন। কিন্তু হীরার আংটি দিয়ে সেসব কিছুই আপনি করতে পারবেন না। কিন্তু তারপরেও বাগদানের রোমান্টিক সময়ে হীরার বদলে আলু নিয়ে হাজির হলে, আপনার কপালে কী দুর্গতি হবে সেটা বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে!

আলু পটল তো কোনো ছার, এমনকি দামি গাড়ি-বাড়ি, কম্পিউটার, আইফোন কোনোকিছু দিয়েই আপনি বিয়ের সম্পর্ক তৈরি করতে পারবেন না, যদিও এগুলোর সবগুলোরই কিছু না কিছু ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে। রহস্যটি হলো, জাহাভির হ্যান্ডিক্যাপ প্রিন্সিপল অনুযায়ী, বিয়ের প্রস্তাবের (প্রাণিজগতে অবশ্য যৌনসম্পর্কের) উপহার এমন হতে হবে যার কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই (এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা হতে পারে ময়ুরের পেখমের অপকারী), কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের চোখে তা হতে হবে অমূল্য। জৈববিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলে ‘কোর্টশিপ গিফট’ (Courtship Gift) বা ‘নাপশাল গিফট’ (Nuptial Gift)[১০৭], [১০৮]। গাড়ি-বাড়ি, আইদাহ আলু কিংবা আইফোন সবকিছুরই ব্যবহারিক কিছু না কিছু উপযোগিতা আছে পুরুষের কাছে। তাই সেগুলো কখনোই ‘কোর্টশিপ গিফট’ হয়ে উঠার যোগ্য নয়। কোর্টশিপ গিফট হতে পারে কেবল হীরা কিংবা স্বর্ণালঙ্কারের মতো অপদ্রব্যগুলোই, যেগুলোর কোনোই ব্যবহারিক উপযোগিতা নেই পুরুষের কাছে, অথচ নারীর মানসপটে সেটি অমূল্য এক ‘ফিটনেস মার্কার’[১০৯]

গবেষক পিটার সজু এবং রবার্ট সেইমোর ২০০৫ সালের ‘Costly but worthless gifts facilitate courtship’ নামের একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে, সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে এ ধরনের ‘কোর্টশিপ গিফট’-ই কার্যকরী যা হবে দৃষ্টিকটুভাবে অপব্যয়ী এবং ব্যবহারিকভাবে মূল্যহীন[১১০]। মানবসমাজের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে সেজন্যই হীরার আংটি কিংবা স্বর্ণালঙ্কার খুব চমৎকার একটি ‘কোর্টশিপ গিফট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। একটি কারণ, এর কোনো ব্যবহারিক মূল্য পুরুষের কাছে নেই। কোনো পুরুষই হীরা কিংবা সোনার জন্য লালায়িত থাকে না।

হীরা বা সোনা দোকানে নিয়ে বেচে দেয়া ছাড়া একজন পুরুষ কিছুই করতে পারে না। সেটা নিয়ে সে বাঁচতে পারে না, সেটা খেয়ে উদরপূর্তি করতে পারে না, পারে না আমোদিত হতে। কেবল একটি কাজই সে হীরা দিয়ে করতে পারে নারীকে উপহার দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, আর ভালোবাসার সম্পর্কের সূচনা করতে হতে পারে সেই সম্পর্ক স্বল্পমেয়াদি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি। শোনা যায়, কেউ কেউ নাকি স্বল্পমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি করার ক্ষেত্রে হীরার অলংকারের উপর নির্ভর করতেন। চলচ্চিত্রের নায়িকা, গায়িকা, অভিনেত্রী, মডেল থেকে শুরু করে খবর পাঠিকাসহ শোবিজের সাথে যুক্ত বিভিন্ন সুন্দরী ললনাদের শয্যাসঙ্গী করার অভিপ্রায়ে তাদের পৃথিবীর আধুনিক নামিদামী কোম্পানির জুয়েলারি পাঠাতেন।

তাদের স্বল্পমেয়াদি সম্পর্ক বা শর্ট-টার্ম স্ট্র্যাটিজির জন্য যে ধরনের বিনিয়োগ করতেন দেখা গেছে, সে ধরনের বিনিয়োগ একই রকম কার্যকরী লং-টার্ম স্ট্র্যাটিজির ক্ষেত্রেও। সেজন্যই বাংলাদেশের বিয়েতে সোনাদানা কিংবা পাশ্চাত্যে হীরার আংটি বৈবাহিক সম্পর্কের সূচনায় এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।

মেরেলিন মনোরোর কথা আমরা সবাই জানি। পঞ্চাশ ষাটের দশকের সুদর্শনা অভিনেত্রী ছিলেন তিনি, এবং মাত্র ৩৬ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন বহু পুরুষের হার্টথ্রব। অভিনয়ের পাশাপাশি গানও গাইতেন মনোরো। মনোরোর গাওয়া চমৎকার গান আছে ‘Diamonds are a Girl’s Best Friend’ নামে। মেরোলিন মনোরো গানটি গেয়েছিলেন ১৯৫৩ সালে ‘Gentlemen Prefer Blondes’ নামের একটি ছবির জন্য । গানের কথাগুলো এরকমের[১১১]

The French were bred to die for love
They delight in fighting duels
But I prefer a man who lives
And gives expensive jewels
A kiss on the hand may be quite continental
But diamonds are a girl’s best friend
A kiss may be grand but it won’t pay the rental
On your humble flat, or help you at the automat
Men grow cold as girls grow old
And we all lose our charms in the end
But square cut or pear shaped
These rocks don’t lose their shape
Diamonds are a girl’s best friend…

আরেকটা বিখ্যাত গান আছে ‘ডায়মন্ডস আর ফরএভার’ নামে। গানটি ১৯৭১ সালের শন কনরি অভিনিত জেমস বন্ডের একটি সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছিল। গায়িকা ছিলেন শার্লি ব্যাসি, পঞ্চাশের দশকের আরেকজন জনপ্রিয় শিল্পী (এবং আমার এখনও প্রিয় গায়িকা)। গানের কথাগুলো এরকমের[১১২]

Diamonds are forever,
They are all I need to please me,
They can stimulate and tease me,
They won’t leave in the night,
I’ve no fear that they might desert me.

Diamonds are forever,
Hold one up and then caress it,
Touch it, stroke it and undress it,
I can see every part,
Nothing hides in the heart to hurt me.

I don’t need love,
For what good will love do me?
Diamonds never lie to me,
For when love’s gone,
They’ll luster on….

আমাদের দেশ সহ ভারতবর্ষে হীরার মতো সোনাকেও ভালোবাসার খুব মূল্যবান উপঢৌকন হিসেবে ধরা হয়, এবং সেটাও একই কারণে।

bengali-bride
চিত্রঃ ভারতবর্ষে হীরার মতো সোনাকেও ভালোবাসার খুব মূল্যবান উপঢৌকন বা ‘নাপশাল গিফট’ হিসেবে দেখা হয়।

সোনা দানার কোনো ব্যবহারিক উপযোগিতা পুরুষদের কাছে নেই, কিন্তু নারীর কাছে তা অমূল্য। কেন ভারতবর্ষের নারীরা স্বর্ণালঙ্কার ভালোবাসে? এর ব্যাখ্যা হিসেবে জনপ্রিয় rediff.com একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে[১১৩]

স্বর্ণালঙ্কার নারীর জন্য কেবল কেবল শক্তিশালী আবেগই তৈরি করে না, পাশাপাশি নারীর অবয়বকে সার্বিক পূর্ণতা দেয়। নারী স্বর্ণালঙ্কার পরে নিজেকে মনে করে লাস্যময়ী, সুন্দরী, সফল, আত্মপ্রত্যয়ী, এবং যৌনাবেদনময়ী।

রোমান কবি অভিড প্রায় একহাজার বছর আগে তার একটি লেখায় বলে গিয়েছিলেন —

নারীরা কবিতা ভালোবাসে। কিন্তু তার জন্য মূল্যবান কিছু উপহার দাও। … Gold buys honor; gold procures love।

অভিডের মৃত্যুর পর সহস্র বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু তবুও আমরা সেই স্বর্ণযুগেই পড়ে রয়েছি!


 ভালোবাসা কারে কয়


১০৬.↑  Lee Alan Dugatkin and Jean-Guy J. Godin, How Females Choose Their Mates, Scientific American, March, 2002.

১০৭.↑  Randy Thornhill, Sexual Selection and Nuptial Feeding Behavior, in bittacus apicalis (insecta: mecoptera), The American Naturalist, 1976.

১০৮.↑  K Vahed, The function of nuptial feeding in insects: a review of empirical studies. Biol. Rev. 73, 43– 78, 1998

১০৯.↑  ফিটনেস মার্কার

১১০.↑  Peter D Sozou and Robert M Seymour, Costly but worthless gifts facilitate courtship, Proceedings of the royal society of london, 272 (1575), pp. 1877-1884, 2005.

১১১.↑  ইউটিউব ভিডিওঃ Marilyn Monroe – Diamonds are a Girl’s Best Friend↑

১১২.↑ ইউটিউব ভিডিওঃ Diamonds Are Forever Theme Song – James Bond

১১৩.↑  “Wearing gold not only enhances strong emotional feelings for its wearer but also completes a woman’s appearance – it makes women feel indulgent, beautiful, successful, confident and sexy. Women who wear gold jewellery consider it to be an integral part of their appearance, and consider it as a necessary item rather than just an accessory.”; Why do people wear gold jewellery? ↑

0 0 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top
১ম অধ্যায়

২য় অধ্যায়

৩য় অধ্যায়

৪র্থ অধ্যায়

৫ম অধ্যায়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

৭ম অধ্যায়

৮ম অধ্যায়