ভালোবাসা কারে কয়

অভিজিৎ রায়

০৬. নারী পুরুষ শেষ পর্যন্ত অভিন্ন মানব সত্তারই অংশ

পুরো অধ্যায়টিতে মূলত জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে নারী পুরুষের পার্থক্য উল্লেখ করা হলেও এটা মনে রাখতে হবে যে, নারী পুরুষ কোনো আলাদা প্রজাতির জীব নয়, নয় কোনো ভিন্ন ভুবনের দুই বাসিন্দা, বরং তারা শেষ পর্যন্ত তারা অভিন্ন মানব প্রকৃতিরই অংশ। হ্যাঁ নারীপুরুষের মধ্যে শরীরবৃত্তীয় দিক থেকে এবং আচরণগত বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্য আছেই, সেটার কারণ বহুবিধ। বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের মতে, নারী এবং পুরুষকে বিবর্তনের যাত্রাপথে ভিন্ন ধরনের অভিযোজনগত সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়েছে, তারা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান করেছে, যেগুলোর প্রকাশ আজও তাদের মানসপটে রয়ে গিয়েছে।

যেমন, গর্ভধারণ, শিশুকে স্তন্যপান করানো সহ বহুকিছুর অভিযোজনগত সমাধান জৈবিকভাবে করতে হয়েছে কেবলমাত্র নারীকেই। আবার অন্য দিকে অনাগত সন্তানের পিতৃত্বের নিশ্চয়তার সংশয় সংক্রান্ত ঈর্ষা নিয়ে জুঝতে হয়েছে মূলত পুরুষকেই, নারীকে নয়। এগুলোর পার্থক্য সূচক প্রভাব নারী পুরুষের শরীরে এবং মনোজগতে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়।

বিভিন্ন সমস্যা নারী পুরুষ যেমন ভিন্নভাবে যেমন সমাধান করেছে, তেমনি আবার অতীতের পৃথিবীতে বহু অভিযোজনগত সমস্যাই ছিল যেগুলো আবার তারা সমাধান করেছে প্রায় একইরকমভাবে, একই পদ্ধতিতেই। যেমন, নারী পুরুষ উভয়েরই দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য সঠিক সঙ্গী খুঁজে নিতে হয়েছে, তাদেরকে বুঝতে হয়েছে তার সঙ্গী তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে বিশ্বস্ত থাকবে কিনা, সন্তানকে বড় করলে তুলার ব্যাপারে শতভাগ নিয়োজিত থাকবে কি না ইত্যাদি।

ভালোবাসা, সম্পর্কের স্থায়িত্ব, সুস্থ জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা, নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধি প্রভৃতি বহু ব্যাপারে নারীপুরুষের চাহিদাগুলো নির্বিশেষে একইরকমই হয়[১৮২]। নারী পুরুষ উভয়েই চায় নিজেরা সুখী হতে, নিজেদের সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত এবং সুখী দেখে যেতে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব প্রভৃতির ব্যাপারে কারো অবদানই কম নয়। বিজ্ঞানী জেনেট শিবলী হাইড তার একটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন, নারীপুরুষের পার্থক্যসূচক অভিব্যক্তিগুলোর চেয়ে তাদের মধ্যে জেন্ডারগত সাম্যই বেশি পরিলক্ষিত হয়[১৮৩]

নারীবাদী বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, যৌনতার বৈচিত্র্য এবং শারীরিক আগ্রাসনসহ কিছু ক্ষেত্রে একটি নারীর সাথে একটি পুরুষের পার্থক্য রয়েছে সত্য[১৮৪], কিন্তু সেটা জেন্ডারগত সাম্যকে লঙ্ঘন করে না, বরং আন্তঃযৌনতা প্রতিযোগিতা (Intrasexual Competition) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়[১৮৫]। রোজালিন ফ্র্যাঙ্কলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের (শিকাগো মেডিকেল স্কুল) বিজ্ঞানী লিসি এলিয়ট তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, নারী পুরুষের মধ্যে শারীরিক এবং জৈবিক দিক থেকে পার্থক্য আছে, কিন্তু সেই পার্থক্যগুলো এমন কিছু বড় নয়।

বহুক্ষেত্রেই ছেলেদের বাচনক্ষমতা, সহমর্মিতা যেমন চেষ্টা করলে বাড়ানো যায়, ঠিক তেমনি আবার মেয়েদের গাণিতিক কিংবা ত্রিমাত্রিক প্রক্ষেপণের ক্ষমতাগুলোও বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে[১৮৬]। যেমন, দেখা গেছে, গণিত বা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে চেষ্টা করলে নারীরা শুধু পুরুষদের সমান নয়, এমনকি ছাড়িয়েও যেতে পারে। আসলে জগতের বহু বিষয় যেগুলো একসময় কেবল ‘পুরুষদের এলাকা’ বলে চিহ্নিত করা হতো, সেগুলোতে নারীরা কেবল পদার্পণই করেনি, ছাড়িয়েও গিয়েছে। যেমন, সারা পৃথিবীতে গণিতকে ঢালাওভাবে ‘পুরুষদের’ আধিপত্যময় বিষয় বলে বিবেচনা করা হলেও দেখা গেছে আইসল্যান্ডে মেয়েরা গড়পড়তা ছেলেদের চেয়ে অনেক ভালো ফলাফল করেছে[১৮৭]

Case-of-Iceland
চিত্র : গণিত এবং বিজ্ঞানে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অনাগ্রহ এবং অসফলতার কথা ঢালাওভাবে মিডিয়ায় বলা হলেও আইসল্যান্ডে গণিতে গড়পড়তা নারীরাই পুরুষদের চেয়ে অনেক ভালো ফলাফল করছে।

আবার ছেলেরা গড়পড়তা যে সব ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়ে দুর্বল বিশেষত সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিংবা সহমর্মিতা আর সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে সম্মিলিত চর্চার মাধ্যমে সেগুলোর অব্যাহতভাবে উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে অনেক ছেলেরই। কাজেই উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এবং সঠিক প্রচেষ্টা থাকলে নারী পুরুষ সবার পক্ষেই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন সম্ভব। পাথরের গায়ে কখনোই খোদাই করে লেখা নেই নারীরা ‘ইহা পারিবে’, আর পুরুষেরা ‘উহা’। বরং অভিন্ন মানব বৈশিষ্ট্যের বহু কিছুই আমরা নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের মধ্যে ধারণ করি, এবং নিজ নিজ পছন্দ, অভিরূচি এবং আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়ে সেগুলোর পরিস্ফূটন ঘটাই।

truth-about-boy-girl
চিত্র : ছেলেরা গড়পড়তা যে সব ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়ে দুর্বল বলে চিহ্নিত – বিশেষতঃ সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিংবা সমবেদনা বা সহমর্মিতা প্রদর্শন কিংবা সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে – সম্মিলিত চর্চার মাধ্যমে সেগুলোর অব্যাহতভাবে উন্নতি করা সম্ভব হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন, ছেলেদের তার বোন, সাথী কিংবা সমরূপ কারো সাথে ছোটবেলা থেকেই পুতুল খেলার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের এবং পরিচর্যামূলক দক্ষতাগুলো বাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে যথেষ্ট পরিমাণেই।

এই জায়গায় আমার মতে, নারীদের নিয়ে একটু বেশি বলা দরকার, যেহেতু সামাজিক স্টেরিও টাইপিং এর ব্যাপারগুলো মূলত নারীদের ঘিরেই, এবং সেগুলো নারীদের অবদমনের কাজেই বেশি ব্যবহৃত হয়। একটা সময় ছিল যখন নারীদের পুরুষের সমকক্ষ হওয়া তো দূরের কথা মানুষ হিসেবেই গণ্য করা হতো না। অথচ উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আজ দেখা যাবে, নারীরা জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি ক্ষেত্রেই পুরুষদের সাথে পাল্লা দিয়ে অংশগ্রহণ করেছে। যেমন, সবচেয়ে দুর্গম এবং মেধাশীল ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত মহাকাশযাত্রায় নারীদের অবদানের কথাই বলা যাক।

সোভিয়েত নারী ভ্যালেন্টিনা তেরেস্কোভা ছিলেন প্রথম মহাকাশ বিজয়ী নারী, এ কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না, বর্তমানে নাসার বহু উল্লেখযোগ্য মহাকাশ মিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুদক্ষ নারীরা। যেমন, আইলিন কলিনস ১৯৯৯ সালের স্পেস শাটলের প্রথম মহিলা কমান্ডার হিসেবে কলাম্বিয়া মিশনের সময় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে তিনি মার্কিন বিমান বাহিনীর সি-১৪১ বিমানের প্রধানের দায়িত্বেও ছিলেন। ২০০৭ সালের স্পেস শাট্‌ল ডিস্কভারি এবং আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের মিলনের সময় উভয়েরই প্রধান ছিলেন নারী।

ডিস্কভারির নেতৃত্বে ছিলেন পামেলা মেলরয় আর আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন পেগি হুইট্‌সন। নাসায় কর্মরত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রয়াত ড. কল্পনা চাওলাও কলম্বিয়া মিশনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মহাকাশচারণায় যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন; এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এ পিএইচডি ডিগ্রি ছিল তার। আরেকজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী মার্কিন নভোচারী শ্যানন লুসিড একসময় মহাকাশে দীর্ঘতম সময় কাটানোর রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন। এ ছাড়া ড. স্যালী রাইডের কথাও অনেকে জানেন যিনি স্পেস শাট্‌লের প্রথম মহিলা সদস্য হন ১৯৮৩ এ।

মহাকাশ জয়ে এখনও অবদান রাখতে না পারলেও বাঙালি মেয়েরা পিছিয়ে নেই যাত্রীবাহী বিমান চালনায়। যেমন, বাংলাদেশ বিমানের ইয়াসমিন রহমান এশিয়ার প্রথম মহিলা ডিসি-১০ বিমানের ক্যাপ্টেন হবার গৌরব অর্জন করেন ১৯৯১ তে। ডিসি-১০ বিমানের ক্যাপ্টেন হয়ে পাঁচ বছর বিমান চালাবার পর রাজনৈতিক কারণে তাকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও ইয়াসমিন রহমানের অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। স্থাপত্য বিজ্ঞানে ডিগ্রি নিয়ে পাঁচ বছর স্থপতির পেশায় নিয়োজিত থেকে আবার সাফল্যের সাথে পরীক্ষা দিয়ে সক্রিয় বিমান চালনায় প্রত্যাবর্তন করে বিমানের এয়ারবাস এর ক্যাপ্টেন হন ২০০১ সালে। নারীদের জন্য তিনি এক উজ্জীবিত উদাহরণ।

পাশাপাশি বাংলাদেশের সুলেখক এবং গবেষক সেলিনা হোসেনের কন্যা ফারিয়া লরার কথাও আমরা জানি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে স্নাতক হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন একজন সফল পাইলট। ১৯৯৬ সালে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের কাছ থেকে তিনি প্রাইভেট পাইলটের লাইসেন্স অর্জন করেন। এর দু’বছর পরে ১৯৯৮ সালের ১৯ শে মার্চ লারা বাণিজ্যিক পাইলট হওয়ার লাইসেন্স পান। তিনি এরপরই পাইলটদের প্রশিক্ষক হবার প্রশিক্ষণ দেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী যিনি এই পেশায় আসেন। ১৯৯৮ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর একটি বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। দুর্ঘটনায় অকাল মৃত্যু না হলে তিনিই হতেন বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট প্রশিক্ষক।

মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস: নারীরা সব পারে’ নামের একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশের পাপিয়া নামের এক সাহসী মেয়ের উদাহরণ নিয়ে এসেছিলেন[১৮৮]। ১৯৯৮ সালের দিকে পাপিয়া জীবিকার তাগিদে ঢাকার রাস্তায় রিকশা চালাতে শুরু করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। পাপিয়া তার রিক্সায় বাহক নারী নাকি পুরুষ তা বিচার না করে সবাইকে বহন করতেন। কিস্তু দুঃখের বিষয় সেটাই বোধহয় প্রথম আর শেষ উদাহরণ। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতা এখনও এরকম দুঃসাহসিক কাজে মেয়েদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।

সামাজিক বাস্তবতার জন্য মেয়েরা বাসের ড্রাইভার বা কন্ডাক্টরও হয়তো হতে পারবেন না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও, যদিও ট্রাফিক ও যাত্রীসংখ্যার দিক দিয়ে সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক আর ঢাকার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই তবু সিঙ্গাপুর শহরে কিংবা ব্যাংককে মেয়ে বাস কন্ডাক্টর এক অতি পরিচিত দৃশ্য। আমি নিজেই দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে থেকেছি। বহুবারই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে এমন বাসে আমার উঠতে হয়েছে যেখানকার চালক পুরুষ নন, নারী। শুধু বাসের চালক বা কন্ডাক্টর হওয়া নয়, রাস্তায় রাস্তায় ফটোকপি মেশিন চালনা, মাল পরিবহন, মালামালের ক্রয়বিক্রয়সহ সব ধরনের মানসিক এবং শারীরিক শ্রমসাধ্য কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা অংশগ্রহণ করেছে সমান তালে।

সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন সময়ের একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। ১৯৯৯/২০০০ সালের ঘটনা। আমি তখন সবেমাত্র বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে পাড়ি দিয়ে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে মাস্টার্স করছি। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে সিঙ্গাপুরের ক্লেমেন্টি এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকতাম, আর সেখান থেকে বাস নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতাম। বাসে সিটের তুলনায় যাত্রী উঠতো বেশি, অনেকটা ঢাকা শহরের বাসগুলোর মতোই।

বাসের সিট ভরে যাওয়ার পর অনেক যাত্রীকেই দাঁড়িয়ে যেতে হতো তাদের মধ্যে নারী পুরুষ সবাই থাকতেন। স্বভাবতই আমরা যারা বাংলাদেশ থেকে সবেমাত্র এসেছি তাদের জন্য ব্যাপারটা ছিল খুব অস্বস্তিকর। আমরা সব তাগড়া জোয়ানেরা সিট দখল করে বসে আছি, আর হয়তো পাশেই একটি মেয়ে পুরো রাস্তা বাসের রড ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আমার বন্ধু সাইফুল ছিল খুব মানবদরদি টাইপের। একদিন ঠিক তার সিটের পাশেই একটি নরমসরম মেয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, দেখে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে নিজ সিটে মেয়েটিকে বসতে অনুরোধ করল। কিন্তু মেয়েটি তাতে খুশি হলো না মোটেই, বরং অবাক হয়ে জানতে চাইলেন,

– ‘আপনার জায়গায় কেন আমি বসব?’ অবাক চোখে প্রশ্ন মেয়েটির।
– ‘কারণ, আপনি দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন। আর আমি বসে …’ সাইফুলের জবাব।
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি বসলে তো আবার আপনাকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়’।
– ‘তাতে অসুবিধা নেই’।
– ‘আমার আছে। আপনি তো আমার আগে বাসে উঠেছেন, আপনি কেন আমার জন্য সিট ছেড়ে দেবেন? আর দিলেই বা আমি বসব কেন?’
– ‘কিন্তু আপনি তো মেয়ে…’ আমতা আমতা কণ্ঠ সাইফুলের।
– ‘মেয়ে তো কী হয়েছে? আমি তো আর অথর্ব নই। আপনি যেভাবে দাঁড়িয়ে যেতেন, আমি ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছি। এতে তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’
-‘তা বটে, কিন্তু …’
– ‘আমরা এখানে কেবল বয়োবৃদ্ধ নাগরিক বা সিনিয়র সিটিজেনদের কিংবা পঙ্গু বা প্রতিবন্ধীদের জন্য আসন ছেড়ে দেই। অন্য কারো জন্যে নয়। আপনাদের দেশে কি নিয়ম আলাদা?’
– ‘হ্যাঁ, আমাদের দেশে বাসে নারীদের জন্য আলাদা আসন থাকে। কোনো নারী দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা তাদের জন্য আসন ছেড়ে দেই। নইলে অভদ্রতা করা হয়। আমি ভেবেছিলাম এই ভদ্রতার ব্যাপারটা সব জায়গায় একই রকম হবে…।’
– ‘কিন্তু আপনি কি বুঝতে পারছেন, যে এই ভদ্রতার আড়ালে একটি মানসিকতা কাজ করছে যে, নারীরা অথর্ব, তারা আপনাদের মতো দাঁড়িয়ে বাসে করে যেতে পারবেন না…’।

ঘটনার অনেক দিন পার হয়ে গেলেও এই সংলাপগুলো আমার এখনও মনে আছে আমার, সাইফুলের দুজনেরই। ‘এই ভদ্রতার আড়ালে একটি মানসিকতা কাজ করছে যে, নারীরা অথর্ব’ মেয়েটির এই ধাক্কার জের আমাদের বহন করতে হয়েছিল অনেকদিন।

আসল কথা হলো, সভ্যতার বিনির্মাণে কারো অবদানই কম নয়, দুজনেই একে অন্যের পরিপূরক। নারী পুরুষ উভয়েই সভ্যতা তৈরিতে অবদান রেখেছে বিপুলভাবে, এ নিয়ে কারোই কোনো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। অধ্যায়টি শেষ করছি কাজী নজরুল ইসলামের ‘নারী’ কবিতাটি থেকে অবিস্মরণীয় কিছু লাইন তুলে দিয়ে —

‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
বিশ্বে যা কিছু এল পাপ তাপ বেদনা অশ্রুবারি,
অর্ধেক তার আনিয়াছে নর অর্ধেক তার নারী।

জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান
মাতা ভগ্নি বধূদের ত্যাগে হইয়াছে মহান।
কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে
কত নারী দিল সিঁথির সিঁদুর, লেখা নাই তার পাশে।

কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি, কত বোন দিল সেবা
বীর স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোনো কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী’।

সে যুগ হয়েছে বাসি
যে যুগে যে যুগে পুরুষ দাস ছিল না ক, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি!


 ভালোবাসা কারে কয়


১৮২.↑   D.M. Buss & , D. P. Schmitt, Evolutionary Psychology and Feminism. Sex Roles, 64, 768-787, 2011.

১৮৩.↑   J. S. Hyde, The gender similarities hypothesis. The American Psychologist, 60, 581–592, 2005

১৮৪.↑   M. B. Oliver, & J. S.Hyde, Gender differences in sexuality: A meta-analysis. Psychological Bulletin, 114, 29–51, 1993.

১৮৫.↑   J. Archer, Does sexual selection explain human sex differences in aggression? The Behavioral and Brain Sciences, 32, 249–311, 2009.

১৮৬.↑   Lise Eliot, The Truth about Boys and Girls, Scientific American Mind, April 1, 2010.

১৮৭.↑   Vivienne Walt , The Iceland Exception: A Land Where Girls Rule in Math, Feb. 27, 2005

১৮৮.↑   অপার্থিব, আন্তর্জাতিক নারী দিবসঃ নারীরা সব পারে -১, মুক্তমনা

5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top
১ম অধ্যায়

২য় অধ্যায়

৩য় অধ্যায়

৪র্থ অধ্যায়

৫ম অধ্যায়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

৭ম অধ্যায়

৮ম অধ্যায়