সহ-বিবর্তনের এক মজার উদাহরণ
বিজ্ঞানের চোখে একটা সুদৃঢ় তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এর সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যদ্বানী করার ক্ষমতা। মানে, আপনার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটা যদি ঠিক হয়ে থাকে তা দিয়ে আপনি ভবিষ্যতের অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারবেন, যা হয়তাে এখন চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে না। যেমন, পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আইনস্টাইন যখন সর্বপ্রথম আপেক্ষিকতার ব্যাপক তত্ত্বটি (General Theory of Relativity) প্রকাশ করলেন, তখন সে তত্ত্বের মধ্যেই কিন্তু লুকিয়ে ছিলাে মহাবিশ্বের প্রসারণের সম্ভাবনা, কিংবা ব্ল্যাক হােল নামের রহস্যময় বস্তুর অস্তিত্বের আলামত যা থেকে আলাে পর্যন্ত পালাতে পারে না।
এগুলাে সবগুলােই পরবর্তীতে নিখুঁত বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। কাজেই আইনস্টাইনের তত্ত্বটি পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সার্থক একটি তত্ত্ব। আর ঠিক একইভাবে, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা দেখি ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের অকল্পনীয় সার্থকতা – আজ থেকে দেড়শাে বছর আগে সীমিত সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তিনি এমনই এক তন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন যার সঠিকতা ও যৌক্তিকতা যে বারবার প্রমাণিত হয়েছে তাই শুধু নয়, এমনকি এ প্রসঙ্গে তার দেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প এবং ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও মিলে গেছে!
মজার একটা কাহিনী শােনা যাক তাহলে এবার। ডারউইন লন্ডনের এক গ্রীন হাউসে মাদাগাস্কারের বিশেষ একটা অর্কিড দেখেন যার মধু রাখার পুষ্পধারটি ১১ ইঞ্চি লম্বা (চিত্র ৪.৭ দ্রষ্টব্য)। তিনি তা দেখে মন্তব্য করেন যে, মাদাগাস্কারের যে জায়গায় এই অর্কিডটা দেখা যায়, সেখানে এমন এক ধরনের মথ জাতীয় কোন পােকা থাকতেই হবে যাদের সুর বা হুল হবে একই রকমের লম্বা। কারণ এই লম্বা মধুর পুষ্পধারের ভিতর শুর ঢুকিয়ে মধু খাওয়ার সময়ই মথগুলাে অর্কিডটার পরগায়ন ঘটাবে। এবং তাইই হলাে – কয়েক দশক পরে বিজ্ঞানীরা ঠিকই খুঁজে পেলেন সেই মাদাগাস্কার স্ফিংস মথ Xanthopan morganif praedicta। প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য অনেক প্রাণী এবং উদ্ভিদের মধ্যেই এ ধরণের সহযােগীতার সম্পর্ক গড়ে উঠতে দেখা যায়, এবং তার প্রয়ােজনেই।

তারা দুজনেই অভিযােজিত হতে থাকে। আর একেই বলে সহ-বিবর্তন (Co-evolution)। প্রকৃতিতে এমন কোন জীব নেই যে শুধু নিঃস্বার্থভাবে অন্য প্রজাতির সেবা করার জন্য বেঁচে থাকে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মেই সে বিলুপ্ত হয়ে যেতে বাধ্য। ডারউইন তার Origin of Species বইতে তার পাঠকদেরকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এ ধরণের একটা প্রজাতি খুঁজে বের করার জন্য, এবং আজ পর্যন্ত কেউ সে চ্যালেঞ্জের উত্তর দিতে পারেনি।
শেষের কিছু কথা
এ ধরণের উদাহরণের কিন্তু কোন শেষ নেই, বিজ্ঞানীরা গত একশাে দেড়শাে বছরে যে পরিমাণ গবেষণা করেছেন বিবর্তন নিয়ে তা এক কথায় ‘অচিন্তনীয়’, কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখবাে তা ঠিক করাই যেনাে একটা কঠিন কাজ। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা বিভিন্ন স্তরে পাওয়া ফসিল, বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে শারীরিক এবং জেনেটিক সাদৃশ্য, বিলুপ্তপ্রায় অংগগুলােসহ বিবর্তনবাদের পক্ষে পাওয়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে আলােচনা করেছিলাম। এখন পর্যন্ত যত ফসিল রেকর্ড পাওয়া গেছে তার সবগুলােই একবাক্যে বিবর্তনবাদের পক্ষে রায় দিয়েছে।
ফসিলবিদ এবং জীববিজ্ঞানীরা যখন প্রথমবারের মত বলেছিলেন যে ডলফিন এবং তিমি মাছ এক সময় বিবর্তিত হয়ে ডাঙ্গার প্রাণী থেকে জলচর প্রাণীতে পরিণত হয়েছে তা ‘অসম্ভব’ ভেবে নিয়ে বিবর্তনবাদ-বিরােধীরা মহা হইচই শুরু করে দিয়েছিলেন। অথচ আজকে ফসিলবিদরা এমন কিছু ফসিল খুঁজে পেয়েছেন যা দিয়ে তিমি বা ডলফিনের বিবর্তনের একটি বা দু’টি মধ্যবর্তী স্তর নয় বরং পাঁচ পাচটি স্তরকে পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। বিবর্তনবাদের পক্ষে এটি একটি অত্যন্ত চমৎকার উদাহরণ, এবং এ নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলােচনা করার ইচ্ছা রইলাে পরবর্তী অধ্যায়গুলােতে।
বিজ্ঞানীরা মাটির ভিন্ন সুরে পাওয়া লাখ লাখ ফসিলের মধ্যে এমন একটি ফসিলও এখনও খুঁজে পাননি যা কিনা জীবের বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে সমর্থন করে না। এরকম একটা ফসিলও যদি বের হয় এবং বিবর্তনবাদ দিয়ে যদি তার ব্যাখ্যা না দেওয়া যায় তাহলেই বিবর্তনবাদের তৈরি বিজ্ঞানের এই শক্ত ইমারতটি হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পরতে পারে। একবার বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী জে বি হ্যালডেন কে প্রশ্ন করা হয়েছিলাে কি দিয়ে বিবর্তনকে ভুল বলে প্রমাণ করা যাবে, তিনি উত্তরে বলেছিলেন যদি কেউ প্রিক্যামব্রিয়ান যুগে একটা খরগােশের ফসিল খুজে বের করে দিতে পারে তাহলেই হবে। সব ভালাে তত্তুের মতই বিবর্তনবাদও ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা তো ঘটেইনি , বরং এর উল্টোটাই ঘটে চলেছে আজকে দেরশো বছর ধরে।
গত কয়েক দশক ধরে অনুজীববিদ্যা, জেনেটিক্স, জিনােমিক্সের কল্যাণে বিবর্তনের পক্ষে আরও সুক্ষ এবং নিখুঁত সব প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর কিছু উদাহরণ আমরা উপরেও দেখেছি। বিংশ শতাব্দীর প্রথমে মেনডেল কতৃক জিনের আবিষ্কার আর ষাটের দশকে ডিএনএ-এর আবিষ্কার যেনাে বিবর্তনবিদ্যার জন্য
জীয়ণকাঠি হিসেবে কাজ করেছিলাে। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী আর্নেষ্ট মায়ার তার ২০০১ সালে প্রকাশিত What Evolution Is বইতে বলেছিলেন, অনুজীববিজ্ঞান যখন আবিষ্কার করলাে যে, জীবের দেহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুগুলােও (জীন, প্রােটিন ইত্যাদি) তার দেহের বিবর্তনের সাথে সাথে একইভাবে বিবর্তিত হয় সেটি ছিলাে আমাদের জন্য একটি অপ্রত্যাশিতরকম সুখের খবর। আমরা এখন আমাদের জীনের মধ্য থেকেই খুঁজে পেতে পারি বিবর্তনের কোটি কোটি বছরের অলিখিত ইতিহাস। Richard Dawkins তার ২০০৪ সালে প্রকাশিত Ancestor’s Tale বইতে বলেছিলেন —
The DNA information in all living creatures has been handed down from remote ancestors with prodigious fidelity. The individual atoms in DNA are turning over continually, but the information they encode in the pattern of their arrangement is copied for millions, sometimes hundreds of millions, of years. We can read this record directly, using the arts of modern molecular biology to spell put the actual DNA letter sequences or, slightly more indirectly, the amino acid sequences of protein into which they are translated.[১৬]
বিজ্ঞানীরা এখন এধরণের বিভিন্ন ধরণের গবেষণায় নিমগ্ন রয়েছেন, ২০০৩ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা মিলে প্রথমবারের মত মানুষের জীনের সিকোয়েন্সিং করে শেষ করেছেন। হিউমেন জিনােম প্রজেক্টের ডিরেক্টর ফ্রান্সিস কলিন্স তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, আমাদের জিনােম (জীবের পুর্নাঙ্গ জেনেটিক তথ্য) আসলে একটি বইয়ের মত যাকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যায়। একদিকে একে ইতিহাসের বই হিসেবে ব্যবহার করা যায় যেখানে আমাদের প্রজাতির বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাস লিপিবদ্ধ। রয়েছে। অন্যদিকে এ হচ্ছে কোষ তৈরির একটি বু প্রিন্ট যা অবিশ্বাস্যরকমের বিস্তারিত নির্দেশাবলী দিয়ে
পরিপূর্ণ। আর চিকিৎসা জগতের জন্য এটি হচ্ছে এমনি একটি পাঠ্যবই যা কিনা বিভিন্ন ধরণের রােগ। ঠেকানাে এবং চিকিৎসার জন্য নতুন এক মহাশক্তি হিসেবে কাজ করবে [১৭]। বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা মানুষ, শিম্পাঞ্জী, ইঁদুর, কুকুর, গরু, ফুট ফ্লাই সহ বিভিন্ন প্রাণীর জীনের সিকোয়েন্সিং করেছেন বা করার কাজে নিয়ােজিত আছেন।
যে প্রাণী বিবর্তনের ঘড়ির হিসেব অনুযায়ী যত কাছাকাছি সম্পর্কিত ততই তাদের জেনেটিক গঠনও একই রকমের। আমাদের নিজেদের কথাই ধরা যাক, এতক্ষণ তাে আমাদের চারপাশের গাছপালা, জীব জন্তুর বিবর্তনের গল্প শুনলাম, নিজেদের প্রজাতির কথাটা বলে লেখাটা শেষ না করলে হয়তাে খামতি থেকে যাবে। আমরা এবং শিম্পাঞ্জিরা মাত্র ৫-৮ মিলিয়ন বছর আগে সাধারণ পূর্ব পুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে মানুষ নামের এই প্রজাতিতে পরিণত হয়েছিলাম।
ঊনিশ শতাব্দীতে ডারউইন এবং টি এইচ হাক্সলি যখন প্রথম এই কথাটি বলেছিলেন তখন সারা পৃথিবী জুড়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা তাে বিবর্তনবাদকেই অস্বীকার করেছিলাে, আর যারা অন্যান্য জীবের বিবর্তনকে যাওবা সঠিক বলে মনে করেছিলেন তাদের পক্ষেও নিজেকে ওই শিম্পাঞ্জিগুলোর উত্তরসুরী বলে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এই তাে সেদিন – ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মত মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির জিনােমের পাশাপাশি বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত করলেন যে, বিজ্ঞানীরা এত দিন ধরে ঠিকই ধারণা করে আসছিলেন। আসলেই আমাদের সাথে আমাদের এই পুর্বপুরুষের ডিএনএ ৯৮.৭% ই এক – আমরাও আসলেই এক ধরণের উন্নত প্রজাতির বানর ছাড়া আর কিছুই নই[১৮]। আমাদের হিমােগ্লোবিনের সাথে শিম্পাঞ্জির হিমােগ্লোবিনও প্রায় হুবহু মিলে যায়।
শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীরা কিছুদিন আগে তাদের আরেকটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ধাঁধারও উত্তর পেয়েছেন জেনেটিক্স এবং জিনােমিক্সের কল্যাণেই। আমরা বহুদিন ধরেই জানি যে শিম্পাঞ্জির কোষে ২৪ জোড়া ক্রোমজোম থাকলেও মানুষের কোষে আছে মাত্র ২৩ জোড়া। মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি যদি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকেই বিবর্তিত হয়ে আসবে তাহলে আরেক জোড়া ক্রোমজোমের হলটা কী? উধাও তাে হয়ে যেতে পারে না হঠাৎ করে, আর সেটা হলে ব্যাপারটা মােটেও কোন ভালাে দিকে গড়াতাে না।
তাই তারা ধারণা করে আসছিলেন যে নিশ্চয়ই বিবর্তনের কোন এক পর্যায়ে মানুষের কোন দু’টো ক্রোমজোম একে অপরের সাথে জোড়া লেগে গেছে বা মিলে গেছে। আর তা যদি না হয় তাহলে শিম্পাঞ্জীর সাথে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে মানুষের বিবর্তনের এই পুরাে ধারণাটাকেই ভুল বলে ধরে নিতে হবে। বিজ্ঞানের বােধ হয় এখানেই মাহাত্ম্যটা, কোন যুক্তি প্রমাণ দিয়ে একে ভুল দেখানাে গেলে তা যত বড় আবিষ্কারই হােক না কেনাে তাকে বিনা দ্বিধায় আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে কার্পণ্য করেন না বিজ্ঞানীরা।
সাইটোজেনিক্স (Cytogenetics) গবেষণা থেকে ঠিকই বের হল যে, আমাদের ২ নম্বর ক্রোমজোমটির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এর উত্তর। আমাদের পূর্বপুরুষের দুটি ক্রোমজোম এক হয়ে মিলে গেছে মানুষের এই ক্রোমজোমটির মধ্যে[১৯]। বিবর্তনের ধারা বুঝে জীন সিকোয়েনসিং করার মাধ্যমে শুধু যে আমরা আমাদের পূর্বসুরীদের সম্পর্কে জানতে পারছি তাই নয়, এর ফলে চিকিৎসাবিদ্যার অঙ্গনে এক নীরব বিপ্লব ঘটে চলেছে।
যেমন ধরুন না, এই আলজাইমার রােগটির কথাই – একটিমাত্র জীনের (Caspase-12 Gene) অনুপস্থিতির কারণে স্মৃতিবিভ্রমজনিত যে রােগটি ঘটে, সেই রােগটি কিন্তু আমাদের পূর্বপুরষসহ বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে খুজে পাওয়া ভার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে দু’টি, প্রথমতঃ বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কোন একসময় এই জিনটা আমরা হারিয়েছি, আর দ্বিতীয়তঃ এই জিনটাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে অর্থাৎ কোন মেকানিজমের সাহায্যে এই রােগ থেকে তারা রেহাই পেয়ে যাচ্ছে তা খুঁজে বের করতে পারলে হয়তাে আমরা এই দুরারোগ্য ব্যাধিটা নিরাময়ের একটা উপায়ও পেয়ে যেতে পারি[২০]।
বিবর্তনের উদাহরণ আমাদের চারপাশে, ছােটটো পৃথিবীটার বুকে এই অফুরন্ত প্রাণের স্পন্দনের উৎসই হচ্ছে বিবর্তন। একটু চোখ মেলে বাইরের পৃথবীটার দিকে তাকিয়ে দেখলেই আর একে অস্বীকার করার কোন উপায়ই থাকে না। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আজকে আমাদের সারা পৃথিবীর বেশীরভাগ মানুষই হয় বিবর্তনবাদ সম্পর্কে কিছুই জানেন না, বা জানলেও তাতে বিশ্বাস করেন না অথবা আরেক ডিগ্রি অগ্রসর হয়ে এর বিরুদ্ধে যারপর নাই মিথ্যা প্রচারণা চালান।
অথচ সাম্প্রতিককালে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞানের জয়জয়কারের পিছনে এর অবদান অপরিসীম। চিকিৎসাবিদ্যা, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা ওষুধ, কীটনাশক ও উচ্চফলনশীল শস্য তৈরীর ক্ষেত্রেই তাে শুধু নয়, জীববিজ্ঞানের সবগুলাে শাখার মিলনকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে বিবর্তনবিদ্যা। আমাদের চারদিকের প্রাণের বিস্তৃতিকে বিবর্তনের আলােয় বিচার না করলে জীবনের কোন শাখাই আর পূর্ণাঙ্গতা লাভ করতে পারে না। আজকে পরিবেশ দূষণ বা গ্লোবাল ওয়ার্মি রোধে, গাছপালা, জঙ্গল সংরক্ষণে, মাছ বা গৃহপালিত পশুর বংশবৃদ্ধিতে বিবর্তনবাদের জ্ঞানের প্রয়ােগ অপরিহার্য।
বিবর্তনবাদের চর্চা কিন্তু শুধুমাত্র জীববিজ্ঞানের শাখাগুলাের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, আমাদের অন্তরে সাথে জড়িয়ে গেছে সে ওতপ্রোতভাবে। আমাদের নিজেদের ইতিহাসটা সঠিকভাবে বােঝার জন্য কিংবা ভবিষ্যতে আরও বহুদিন কিতাবে আমাদের প্রজাতিটিকে পৃথিবীর বুকে টিকিয়ে রাখা যায় তা জানার জন্য অর্থাৎ আমাদের অতীত, বর্তমান এক বিকে বুঝতে হলে বিবর্তন তত্ত্বের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি! আমাদেরকে উত্তর পেতে হবে। হাজারাে প্রশ্নের বুঝতে হবে কখন কতগুলাে প্রজাতির অস্তিত্ব ছিলাে অতীতে, তারা কিভাবে নির্মূল হয়ে গেলাে, কেনাে ডাইনােসরগুলাে হারিয়ে গেলাে, কিছু টিকে গেলাে এই আরশােলাগুলাে। জানতে হবে আমাদের মস্তিষ্কের আকার কখন হঠাৎ করে বড় হতে শুরু করেছিলাে, তার উৎপত্তি কখন কি করে হল, এর পিছনে মস্তিষ্কের বিবর্তন কি ভুমিকা পালন করেছিলাে, আমাদের এই সত্যতা সৃষ্টির পিছনে তাদের আবদানই বা কতটুকু?
সমাজবিজ্ঞানীরাও আজকে বিবর্তনবাদের বিভিন্ন তত্ত্বের সাথে সমাজ ও সভ্যতার কমবিকাশ এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত ব্যর ও বৈশিষ্ট্যগুলােকে মিলিয়ে দেখতে শুরু করেছেন – আমরা কেন শুধু নিজের ছেলেমেয়ে বা আত্নীয় স্বজনের কথাই ভাবি, কখনও বানও আবার নিঃস্বার্থভাবে আত্মোৎসর্গ করি, কেনাে বিভিন্ন প্রাণী দলবদ্ধ হয়ে বাস করে, কেনই বা মানুষ ভালােবাসে, প্রেমে পড়ে, সংসারের গন্নিতে আবদ্ধ হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয় – এর কতটুকু সামাজিক, সাংস্কৃতিক আব কতটুকুই বা জেনেটিকভাবে আমাদের দেহকোষেই লেখা রয়েছে তাও মিলিয়ে দেবার সময় হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানী এক জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে এ নিয়ে তর্কের কোন সীমা পরিসীমা নেই, বিএলান যতই এগিয়ে যাবে ততই খােলাসা হয়ে উঠবে এর উত্তরগুলাে।
বিবর্তনবাদের আরেকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা না বলে আজকের লেখাটা বােধ হয় শেষ করা ঠিক হবে না, আমাদের আধুনিক সভ্যতার চেতনা এই মননশীলতায় এর ভূমিকা অত্যন্ত গভীর। বিবর্তনবাদ আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছে হাজার বছরের ধর্মীয় কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত ধারণাগুলাে থেকে – নিজের সৃষ্টি রহস্যের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হতবিহ্বল মানব প্রজাতি এক সময় নিজেকে যে আদিম রূপকথা আর অপ্রাকৃত কল্পনার জালে আটকে ফেলেছিলাে তা থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে মুক্তি দিয়েছে ডারউইনের এই বিবর্তনবাদের তত্ত্বটিই। আশা করা যায় অচিরেই তার এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যাবে আমাদের এই ক্ষণজন্মা প্রজাতিটির উপর।
বিবর্তনের পথ ধরে
১৬.↑ Dawkins R, 2004, The Ancestors Tale, The Houghton Mifflin Company, Boston, NY, p 19.
১৭.↑ Life Code of Chimps laid Bare, 2005, BBC News↑
১৮.↑ SEED, Year In Science 2005, Dec/Jan 2006. p 92
১৯.↑ Initial sequence of the chimpanzeegenome and comparison with the human genome, 2005, Vol 437, doi:10.1038/nature04072
২০.↑ An Overview of Human Genome Project, 2006, National Human Genome Research Institute↑