জন টুবি আর লিডা কসমাইডস লেখাটিতে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মূলনীতি হিসেবে কতগুলো সূত্রেরও প্রস্তাব করেন। সেগুলো হলো—
প্রথম সূত্র:
মস্তিষ্ক একটি ভৌত যন্ত্র যা অনেকটা কম্পিউটারের মতো কাজ করে। এর বর্তনীগুলো পরিবেশ উপযোগী স্বভাব তৈরি করে।
দ্বিতীয় সূত্র:
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের স্নায়বিক বর্তনীগুলো গড়ে উঠেছে। বিবর্তনের ইতিহাসে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল সেগুলো সমাধান করার জন্যই প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করেছে।
তৃতীয় সূত্র:
আমাদের মনন বা চেতনাকে হিমশৈলের চূড়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। হিমশৈলের বেশিরভাগ অংশই থাকে পানির নীচে লুকানো, ঠিক তেমনি আমাদের মনের মধ্যে যা কিছু ঘটে তার অধিকাংশই গোপন থাকে। সুতরাং চেতনা আমাদের এই বলে বিভ্রান্ত করতে পারে যে, মস্তিষ্কের বর্তনী বোধ হয় খুব সরল। আমরা প্রত্যহ যেসব সমস্যার সম্মুখীন হই সেগুলো সমাধান করা আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তার জন্য অনেক জটিল স্নায়বিক বর্তনীর জটিল যোগসাজোশের প্রয়োজন পড়ে।
চতুর্থ সূত্র:
প্রতিটি অভিযোজনগত সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথক পৃথক স্নায়বিক বর্তনী আছে। প্রতিটি বর্তনী কেবল নিজ কাজ করার জন্যই বিশেষায়িত।
পঞ্চম সূত্র:
আমাদের আধুনিক করোটির ভিতরে বাস করে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক[১৬]।
শিকারি-সংগ্রাহক পরিস্থিতি এবং সাভানা অনুকল্পঃ
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান মনে করে প্রায় ৬ মিলিয়ন বছর আগে শিম্পাঞ্জি থেকে আলাদা হওয়ার পর সেখান থেকে শুরু করে আজ থেকে দশ হাজার বছর পর্যন্ত আমরা মানুষেরা মূলত বনে জঙ্গলেই কাটিয়েছি। সেই সময় থেকে শুরু করে আধুনিক সময়কাল বিবর্তনের পঞ্জিকায় হিসেব করলে খুবই ক্ষুদ্র একটা সময়। আর কৃষি কাজের উদ্ভব কিংবা তারো পরে শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি তো আরও তুচ্ছ। সঠিকভাবে বলতে গেলে, মানুষ শিকারি-সংগ্রাহক ছিল প্লাইস্টোসিন যুগের পুরো সময়টাতে: ২৫ লক্ষ বছর পূর্ব থেকে ১২,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত। ‘হোমো’ গণ এর উদ্ভবের সময়কালটাও ২৫ লক্ষ বছর পূর্বের দিকে। তার মানে মানুষের ২৫ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে ৯৯% সময়ই তারা ছিল শিকারি-সংগ্রাহক। অর্থাৎ, ইভল্যুশনারি স্কেলে মানুষেরা ‘মানব সভ্যতার’ শতকরা নিরানব্বই ভাগ সময়টাই বনে জঙ্গলে আর ফলমূল শিকার করে কাটিয়েছে।
কাজেই আমাদের মস্তিষ্কের মূল নিয়ামকগুলো হয়তো তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখনই, সে সময়কার বিশেষ কিছু সমস্যা মোকাবেলার জন্য আজকের দিনের অত্যাধুনিক সমস্যাগুলোর জন্য নয়। এখনও অনেকেই মাকড়শা, তেলাপোকা কিংবা টিকটিকি দেখলে আঁতকে উঠে, কিন্তু বাস ট্রাক দেখে সেরকম ভয় পায় না। এটা বিবর্তনের কারণেই ঘটে বলে মনে করা হয়। বনে-জঙ্গলে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে বিষধর কীটপতঙ্গকে ভয় পাওয়ার স্মৃতি আমরা নিজেদের অজান্তেই বহন করি। সেজন্যই লিডা কসমাইডস এবং জন টুবি আধুনিক মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন- আমাদের আধুনিক করোটির ভিতরে বাস করে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক।
এই আধুনিক করোটির ভিতরে আদিম প্রস্তরযুগের মস্তিষ্ক বাস করার ব্যাপারটাকে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে ‘সাভানা অনুকল্প’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই প্রিন্সিপলটির মূল কথা হলো[১৭] —
মানব মস্তিষ্কের মডিউলগুলো যখন তৈরি হয়েছিল, তখন আধুনিক সমাজের বিদ্যমান উপকরণগুলোর অনেকগুলোই ছিল না। ফলে আধুনিক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আমাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ প্রস্তুত নয়, বরং মস্তিষ্কে অনেকাংশেই রাজত্ব করে আদিম পরিবশের উপজাতসমূহ।
১৯৯৪ সালে রবার্ট রাইট নামে একজন গবেষক একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখলেন ‘মরাল এনিমেল’ নামে[১৮]। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার উপর একটি পূর্ণাঙ্গ বই। এই বইয়ের লেখক প্রথমবারের মতো ‘সাহস করে’ ডারউইনের বিবর্তনের আলোকে মনোবিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করতে উদ্যোগী হন। শুধু তাই নয়, ডারউইনের জীবন থেকে অজস্র দৃষ্টান্ত হাজির করে দেখালেন, ভদ্র, সৌম্য, লাজুক স্বভাবের ডারউইনও শেষ পর্যন্ত আমাদের মতোই জৈব তাড়নায় তাড়িত একধরনের ‘এনিমেল’ ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। রবার্ট রাইটের বইটির পর এই বিষয়ে গণ্ডা গণ্ডা বই লেখা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। গবেষকেরা এই ‘মনের নতুন বিজ্ঞান’ নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছেন।
গবেষকদের মধ্যে স্টিভেন পিঙ্কার, ডেভিড বাস, হেলেন ফিশার, জিওফ্রি মিলার, রবিন বেকার, ম্যাট রিড্লী, ভিক্টর জন্সটন, সাতোসি কানাজাওয়া, ডনাল্ড সায়মন্স সহ অনেকেই আছেন। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিষয় উপজীব্য করে বিগত কয়েক বছরে বিজ্ঞানী এবং গবেষকেরা লিখেছেন ‘হাও মাইন্ড ওয়ার্ক্স’[১৯], ‘এন্ট এন্ড দ্য পিকক’[২০], ‘দ্য রেড কুইন’[২১], ‘এনাটমি অব লাভ’[২২] ‘মেটিং মাইন্ড’[২৩], স্পার্ম ওয়ার্স[২৪] সহ অসংখ্য জনপ্রিয় ধারার বই। এছাড়া সফল টিভি প্রোগ্রামের মধ্যে আছে ‘ দ্য সায়েন্স অব সেক্স’, ‘জেন্ডার ওয়ার্স’ ইত্যাদি।
ইংরেজিতে বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে প্রচুর কাজ হলেও বাংলাভাষায় এ নিয়ে লেখা একদমই চোখে পড়ে না। মুক্তমনায় আমার সিরিজটির আগে এ নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণও চোখে পড়েনি আমার। আমার এ সিরিজটি প্রকাশিত হবার পর অপার্থিব, বন্যা, স্বাধীন, পৃথিবী, বিপ্লব পাল, সংসপ্তক, মুহম্মদ (শিক্ষানবিস) সহ অনেকেই এ নিয়ে আলোচনা করেছেন, প্রবন্ধও লিখেছেন অনেকেই[২৫]।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নামের সাম্প্রতিক এই শাখাটি তাহলে আমাদের কী বলতে চাচ্ছে? সাদামাটাভাবে বলতে চাচ্ছে এই যে, আমাদের মানসপটের বিনির্মাণে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় প্রক্রিয়ার একটি ছাপ থাকবে, তা আমরা যে দেশের, যে সমাজের বা যে সংস্কৃতিরই অন্তর্ভুক্ত হই না কেন। ছাপ যে থাকে, তার প্রমাণ আমরা দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুতেই কিন্তু পাই। মিষ্টিযুক্ত কিংবা চর্বিযুক্ত খাবার আমাদের শরীরের জন্য খারাপ, কিন্তু এটা জানার পরও আমরা এ ধরনের খাবারের প্রতি লালায়িত হই।
সমাজ-সংস্কৃতি নির্বিশেষেই এটা ঘটতে দেখা যায়। কেন? বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, একটা সময় মানুষ জঙ্গলে থাকত, খুব কষ্ট করে খাবারদাবার সংগ্রহ করতে হতো। শর্করা এবং স্নেহজাতীয় খাবার এখনকার মতো এত সহজলভ্য ছিল না। শরীরকে কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনেই এ ধরনের খাবারের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তখন তো আর কারো জানার উপায় ছিল না যে, হাজার খানেক বছর পর মানুষ নামের অদ্ভুত এই ‘আইলস্যা’ প্রজাতিটি ম্যাকডোনাল্ডসের বিগ-ম্যাক আর হার্শিজ হাতে নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে বসে ব্লগ আর চ্যাট করে অফুরন্ত অলস সময় পার করবে আর গায়ে গতরে হোঁদল কুতকুতে হয়ে উঠবে।
কাজেই খাবারের যে উপাদানগুলো একসময় ছিল আদিম মানুষের জন্য শক্তি আহরণের নিয়ামক কিংবা ঠান্ডা থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ, আজকের যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে সেগুলোর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে উঠেছে তাদের জন্য মরণ-বিষ। কিন্তু এগুলো জেনেও আমরা আমাদের লোভকে সংবরণ করতে প্রায়শই পারি না; পোলাও বিরিয়ানি কিংবা চকলেট বা আইসক্রিম দেখলেই হামলে পড়ি। আমাদের শরীরে আর মনে বিবর্তনের ছাপ থেকে যাওয়ার কারণেই এটি ঘটে।
এ ধরনের আরও উদাহরণ হাজির করা যায়। আমরা (কিংবা আমাদের পরিচিত অনেকেই) মাকড়শা, তেলাপোকা কিংবা টিকটিকি দেখলে আঁতকে উঠি। কিন্তু বাস ট্রাক দেখে সেরকম ভয় পাই না (উপরে শিকারি-সংগ্রাহক পরিস্থিতি ব্লক দ্রষ্টব্য)। অথচ কে না জানে, প্রতি বছর তেলাপোকার আক্রমণে যত মানুষ না মারা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষ মরে ট্রাকের তলায় পড়ে। অথচ ট্রাককে ভয় না পেয়ে আমরা ভয় পাই নিরীহ তেলাপোকাকে। এটাও কিন্তু বিবর্তনের কারণেই ঘটে। বনে –জঙ্গলে দীর্ঘদিন কাটানোর কারণে বিষধর কীটপতঙ্গকে ভয় পাওয়ার স্মৃতি আমরা নিজেদের অজান্তেই আমাদের জিনে বহন করি। সে হিসেবে, বাস ট্রাকের ব্যাপারগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষাকৃত নতুন, তাই এগুলোকে ভয় পাওয়ার কোনো স্মৃতি আমরা এখনও আমাদের জিনে (এখনও) তৈরি করতে পারিনি। সেজন্যই বোধ হয় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিডা কসমিডস এবং জন টুবি আধুনিক মানুষকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেন —
‘Our modern skull house a stone age of mind’।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান : চেনা সমীকরণের ভুলে যাওয়া অংশটুকু
মানুষের প্রকৃতি গঠনে পরিবেশ এবং জিন দুইয়েরই জোরালো ভূমিকা আছে। পরিবেশের যে ভূমিকা আছে সেটা সবারই জানা। বড় বড় সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, শ্রমিক, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাই পরিবেশের গুরুত্বের কথা জানেন। কিন্তু সেই তুলনায় মানবপ্রকৃতি গঠনের পেছনে যে জিনেরও জোরালো ভূমিকা আছে সেটা কিন্তু বহু লোকেই জানে না। সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তো বটেই, এমনকি শিক্ষায়তনেও ব্যাপারাটা উহ্যই ছিল এতদিন। এখন সময় পাল্টেছে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা আকর্ষণীয় গবেষণায় প্রতিদিনই হারিয়ে যাওয়া অংশের খোঁজ পাচ্ছেন।
এই বইয়ে পরিবেশ এবং জিন নিয়ে কমবেশি আলোচনা করা হলেও, প্রাজ্ঞ পাঠকদের দৃষ্টি এড়াবে না যে, অনাদরে উপেক্ষিত অংশটির উপরেই বেশি জোর দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং তা করা হয়েছে সঙ্গত কারণেই। আমার মতে জিন তথা জৈববিজ্ঞানের অংশটুকু আমাদের অতি চেনা সমীকরণের ‘ভুলে যাওয়া’ অংশ। আধুনিক গবেষণার নিরিখে নতুন নতুন তথ্য আমরা জানতে পারছি, তা বস্তুনিষ্ঠভাবে বাঙালি পাঠকদের কাছে তুলে ধরাই এই বইয়ের মূল উদ্দেশ্য।
যে কথাটি এই বইয়ে বারবার আসবে তা হলো, বিবর্তন মনোবিদ্যা শুধু নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজ এবং জীবনকে ব্যাখ্যা করছে না, সেই সাথে সামাজিক বিজ্ঞানের বহু প্রচলিত অনুকল্প এবং ধারণাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। সারমর্ম করলে ব্যাপারগুলো দাঁড়াবে অনেকটা এরকম —
ক) মানুষ বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, জীবজগতেরই অংশ: বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের প্রথম স্বীকার্যই হচ্ছে মানুষকে জীবজগতেরই অংশ হিসেবে চিন্তা করা। যতই অস্বস্তি লাগুক আমাদের শুনতে, জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মানুষ এক ধরনের পশু বৈ আর কিছু নয়[২৬]। তার মানে কিন্তু এই নয় যে মানবসমাজে কোনো অনন্য বৈশিষ্ট্য নেই। নিশ্চয় আছে। সে জন্যই তো মানুষ আলাদা একটি প্রজাতি। কুকুর, বিড়াল, হাতি, গরিলা যেমন আলাদা প্রজাতি, ঠিক তেমনি মানুষও একটি প্রজাতি। আর মানুষের মতো সব প্রজাতিতেই অনন্য বৈশিষ্ট্য খুঁজলে পাওয়া যাবে।
মেরুভালুকের লোমশ শরীর, মৌমাছিদের ফুল থেকে মধু আহরণের ক্ষমতা, কুকুরের ঘ্রাণ শক্তি কিংবা চিতা বাঘের ক্ষীপ্রতা নিঃসন্দেহে তাদের নিজ নিজ প্রজাতির জন্য অনন্য বৈশিষ্ট্য। সেই বৈশিষ্ট্যগুলো আমরা জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই ব্যাখ্যা করি। অথচ মানব প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে গেলেই জীববিজ্ঞান বাদ দিয়ে কেবল সামাজিক মডেলগুলোর শরণাপন্ন হন সমাজবিজ্ঞানীরা। এমন একটা ভাব যে, মানুষ অন্য প্রাণিজগৎ থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কিছু, জীববিজ্ঞান এখানে অচল। না, এই দৃষ্টিভিঙ্গিটিকেই ভুল বলে মনে করেন সামাজিক জীববিজ্ঞানী এবং বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীরা। বিখ্যাত সামাজিক জীববিজ্ঞানী পিয়ারি এল ভ্যান দেন বার্গি (Pierre L. van den Berghe) সেজন্যই বলেন—
নিঃসন্দেহে আমরা অনন্য। কিন্তু আমরা স্রেফ অনন্য হবার জন্য অনন্য নই। বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলেপ্রতিটি প্রজাতিই আসলে অনন্য, এবং তাদের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো পরিবেশের সাথে অভিযোজন করতে গিয়ে দীর্ঘদিনের বিবর্তনের ফলশ্রুতিতেই উদ্ভূত হয়েছে।
মানবসমাজের কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য কিংবা জটিলতা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও মানুষ শেষ পর্যন্ত জীবজগতেরই অংশ। অথচ, সমাজবিজ্ঞানের প্রচলিত প্রমিত মডেল মানুষকে অন্য প্রাণিজগৎ থেকে একেবারেই আলাদা করে ফেলে দেখার পক্ষপাতি। অতীতে বহু সমাজবিজ্ঞানীই জৈবিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে মানবসমাজের গতি প্রকৃতি ব্যাখ্যার ব্যাপারে অনাসক্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেছেন। গবেষক এলিস লী দাবি করেছেন জৈবিক ব্যাখ্যার ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানীদের অনীহা, বিরক্তি এবং ভীতি যেটাকে এলিস ‘বায়োফোবিয়া’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, ধীরে ধীরে শাখাটির পতন ডেকে আনছে[২৭]।
খ) মানব মস্তিষ্ক স্বর্গীয় কিছু নয়, বিবর্তন প্রক্রিয়ারই উপজাত: প্রতিটি জীব সেটা মানুষই হোক আর তেলাপোকাই হোক, কতগুলো কর্মক্ষম অংশের (Functional parts) সমাহার। জীবের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ, যেমন— হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, চোখ, রক্ত, হাড়, মাংশপেশী, যকৃত, চামড়া, অন্ত্র, জননগ্রন্থি সবগুলোরই আলাদা কাজ আছে।
বলা বাহুল্য, আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে এই কর্মক্ষম অংশগুলোর কাজকে আলাদাভাবে দেখার এবং সঠিকভাবে বিশ্লেষণের উপরেই। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় বিভিন্ন অঙ্গের আলাদা কাজ করার ক্ষমতাকে বলে অভিযোজন বা এডাপ্টেশন। আর এই অভিযোজন ঘটে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ নামে একটি ধীর স্থির এবং দীর্ঘকালীন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের মতে প্রাকৃতিক নির্বাচন দেহের অন্যান্য অঙ্গের বিকাশে যেভাবে প্রভাব রেখেছে, ঠিক সেরকমভাবেই প্রভাবিত করেছে মস্তিষ্ককে এবং এর সাথে জড়িত স্নায়বিক বর্তনীকেও। কাজেই মস্তিষ্ককেও বিবর্তনের উপজাত হিসেবেই দেখতে হবে, চিন্তা করতে হবে অভিযোজনের মিথস্ক্রিয়ার সমন্বিত প্রতিরূপ হিসেবেই[২৮]।
সমাজবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশই ভুলভাবে মনে করেন বিবর্তন বোধ হয় ঘাড়ের কাছে এসে থেমে গেছে, এর উপরে আর উঠেনি[২৯]। বিবর্তন মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা সমাজবিজ্ঞানীদের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে একেবারেই ভুল মনে করেন। মানুষের হাতের আঙুল কিংবা পায়ের পাতা তৈরিতে যদি প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং যৌনতার নির্বাচনসহ বিবর্তনের নানা প্রক্রিয়াগুলো ভূমিকা রেখে থাকে, মস্তিষ্ক তৈরির ব্যাপারেও এটি ভূমিকা রাখবে এটাই স্বাভাবিক। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা বিবর্তনের যে সূত্রগুলো শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠন এবং অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য সত্যি মনে করেন, সেগুলো মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্যও ব্যবহার করতে চান। তারা (যৌক্তিকভাবেই) মনে করেন, বিবর্তন কখনোই ঘাড়ের কাছে হঠাৎ করেই এসে শেষ হয়ে যায়নি, বরং উঠে গেছে একদম উপর পর্যন্ত।
গ) মানবপ্রকৃতি কোনো ব্ল্যাঙ্ক স্লেট নয়: সমাজবিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশ মানবপ্রকৃতিকে একটি ব্ল্যাঙ্ক স্লেট বা তাবুলা রাসা (Tabula rasa) হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন[৩০]। তারা মনে করেন, প্রতিটি মানুষ একটা স্বচ্ছ স্লেটের মতো প্রকৃতি নিয়ে জন্মায়, আর তারপর মানুষ যত বড় হতে থাকে তার চারপাশের পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার মাধ্যমে ঐ স্বচ্ছ স্লেটে মানুষের স্বভাব ক্রমশ লিখিত হতে থাকে। কিন্তু বিবর্তন মনোবিজ্ঞান সংক্রান্ত বেশ কিছু সাম্প্রতিক গবেষণায় সমাজবিজ্ঞানীদের এই স্বতঃপ্রবৃত্ত বিরুদ্ধে বেশ কিছু জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়ছে এই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ে। সেজন্যই জীববিজ্ঞানী উইলিয়াম হ্যামিলটন জোরের সাথে বলেন[৩১], ‘The tabula of human nature was never rasa and it is now being read’।
ঘ) মানবপ্রকৃতি এবং সংস্কৃতি বংশাণু এবং পরিবেশের মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল : এই বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ব্যাপৃত হয়েছে পরিবেশ নির্ণয়বাদ বনাম বংশাণু নির্ণয়বাদকে কেন্দ্র করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমাজবিজ্ঞানীর যেহেতু ধরেই নেন যে, মানবপ্রকৃতি অনেকটা ব্ল্যাঙ্ক স্লেটের মতো, তাই তারা কেবল পরিবেশ এবং সামাজিকীকরণের উপরই জোর দেন, অস্বীকার করেন বংশগতি সংক্রান্ত যে কোনো উপাত্তকে যা মানব প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু এই বইয়ে আধুনিক বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে দেখানো হয়েছে যে, জেনেটিক এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের সুষম মিশ্রণেই মূলত গড়ে উঠে মানবপ্রকৃতি। মানবপ্রকৃতি গঠনে জিন বা বংশাণুর প্রভাব যেমন আছে, তেমনি আছে পরিবেশের। তাই সম্পূর্ণ বংশাণুনির্ণয়বাদী হওয়া কিংবা সম্পূর্ণ পরিবেশ নির্ণয়বাদী হওয়াটা চরম এবং ভুল অবস্থান, এবং প্রায় সকল ক্ষেত্রেই। পাঠকেরা বইয়ের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অধ্যায়ে এ নিয়ে চিন্তার উদ্রেককারী গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনার সন্ধান পাবেন বলে আশা করছি।
প্রতিটি অধ্যায়েই উপরে উল্লিখিত বিষয়গুলো নানাভাবে উঠে আসবে, দেখানোর চেষ্টা থাকবে যে, মানবপ্রকৃতি আসলে জিন-কালচার কো-এভুলুশনেরই ফল, এবং এ দুয়ের সুষম সংমিশ্রণ। কিন্তু সেখানে যাওয়ার আগে গুরুত্বপূর্ণ যে কয়েকটি হেত্বাভাস (Fallacy) নিয়ে সতর্ক থাকা দরকার, তা নিয়ে একটু আলোচনা প্রয়োজন।
ভালোবাসা কারে কয়
১৬.↑ এই সূত্রটিকে ‘সাভানা অনুকল্প’ হিসেবেও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে চিহ্নিত করা হয়, ‘শিকারী-সংগ্রাহক পরিস্থিতি এবং সাভানা অনুকল্প’ বাক্স দ্রষ্টব্য।
১৭.↑ Alan S Miller, Satoshi Kanazawa, Why Beautiful People Have More Daughters: From Dating, Shopping, and Praying to Going to War and Becoming a Billionaire– Two Evolutionary Psychologists Explain Why We Do What We Do, Perigee Trade, 2008
১৮.↑ Robert Wright, The Moral Animal: Why We Are, the Way We Are: The New Science of Evolutionary Psychology, Vintage, 1995.
১৯.↑ How the Mind Works, Steven Pinker, W.W. Norton & Co., 1999
২০.↑ Helena Cronin and John Maynard Smith, The Ant and the Peacock: Altruism and Sexual Selection from Darwin to Today, Cambridge University Press, 1993.
২১.↑ The Red Queen: Sex and the Evolution of Human Nature, Matt Ridley, Penguin, 1995.
২২.↑ Helen Fisher, Anatomy of Love: A Natural History of Mating, Marriage, and Why We Stray, Ballantine Books 1994
২৩.↑ Geoffrey Miller, The Mating Mind: How Sexual Choice Shaped the Evolution of Human Nature, Anchor, 2001.
২৪.↑ Robin Baker, Sperm Wars: Infidelity, Sexual Conflict, and Other Bedroom Battles
২৫.↑ এ প্রসঙ্গে মুক্তমনায় আর্কাইভ থেকে পড়ুন বিবর্তন, বিবর্তন মনোবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে রাখা বিভিন্ন প্রবন্ধ।
২৬.↑ Laura Betzig, People are Animals, Human Nature: A Critical Reader, New York: Oxford University Press, 1997
২৭.↑ Ellis Lee, A Discipline in Peril: Sociology’s Future Hinges on Curing Biophobia, American Sociologist 27, : p 21–41, 1996
২৯.↑ Anne Campbell, Staying alive: Evolution, culture, and women’s intrasexual aggression, Behavioral And Brain Sciences 22, 203–252, 1999. গবেষণাপত্রটির প্রাসঙ্গিক অংশবিশেষ
৩০.↑ Steven Pinker, The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature, Viking; 2002
৩১.↑ Endorsement of cover of Laura Betzig’s book, People are Animals, Human Nature: A Critical Reader, New York: Oxford University Press, 1997.