আগের লেখাগুলােতে বিভিন্ন ধরণের মাইক্রো বিবর্তনের উদাহরণ দেখেছি আমরা, এখন চলুন ম্যাক্রো বিবর্তনের কিছু উদাহরণ নিয়ে আলােচনা করা যাক।
উদ্ভিদের নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি হচ্ছে অহরহ।
আমাদের চোখের সামনে প্রাকৃতিকভাবে মিউটেশনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভবের ঘটনাটা একটু বিরলই বটে। তবে এধরনের ঘটনা যে একেবারে ঘটেই না তাও নয়। বিজ্ঞানীরা গত একশাে বছরে বেশ কিছু উদ্ভিদের মধ্যে এধরণের নতুন প্রজাতি তৈরির ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। আর ল্যাবরেটরিতে নতুন ধরনের আরও উন্নত ফলনশীল ধান, গম বা ভুট্টার প্রজাতি তৈরির ঘটনা তাে হরহামেশা আমরা খবরের কাগজেই দেখতে পাই।
১৯১০-১৯৩০ এর মধ্যে আমেরিকার ওয়াশিংটন এবং আইডাহাে স্টেটে স্যালসিফাই নামে অনেকটা মুলার মত দেখতে এক ধরণের খাদ্যযােগ্য মুলের গাছের তিনটি প্রজাতির (Tragapogon dubius, Tragapogon pratensis, Tragapogon porrifolius) চাষ শুরু করা হয়। এর আগে আমেরিকায় স্যালসিফাই এর কোন অস্তিত্বই ছিলােনা, এদেরকে ইউরােপ থেকে এনে প্রথমবারের মত এখানে বােনা হয় [১৩]। ১৯৫০ সালের দিকে বিজ্ঞানীরা আবাক হয়ে দেখলেন, তিনটি তাে নয়, পাঁচ ধরণের স্যালসিফাই দেখা যাচ্ছে মাঠে! তাহলে এই নতুন দু’ধরণের প্রজাতি এলাে কোথা থেকে?
এরা তাে ইউরােপ থেকে আনা প্রথম তিনটি প্রজাতির সাথেও প্রজননেও সক্ষম নয়, তাহলে কি এখানে সম্পূর্ণ দুটি নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে এই কয়েক দশকের মধ্যেই? – ব্যাপারটা আসলেই তাই, বিস্মিত বিজ্ঞানীরা নিজের চোখে দেখলেন প্রকৃতিতে নতুন প্রজাতি সৃষ্টির ঘটনা। প্রথম তিনটি প্রজাতি থেকে পলিপ্লয়ড সংকরায়নের (Poliploid Hybridization) ফলে দুটি নতুন প্রজাতির জন্ম হয়েছে। আমরা জানি যে, সাধারণত সন্তানেরা তাদের প্রতিটি বৈশিষ্ট্যের জন্য বাবা এবং মার প্রত্যেকের থেকে একটি করে ক্রোমজোম পেয়ে থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটছে একটু গােলমেলে ভাবে।
মিউটেশনের ফলে নতুন প্রজাতিগুলাের মধ্যে মা বাবার দুজনের থেকেই এক সেটের বদলে দুই সেট করে ক্রোমজোম এসেছে। এর ফলে এরা নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম হলেও মা বাবার প্রজাতির স্যালসিফাই এর সাথে আর প্রজনন করতে পারছে না। তার মানে দাঁড়াচ্ছে এই যে, এখানে মিউটেশনের ফলশ্রুতিতে সম্পূর্ণ দুটি নতুন প্রজাতির জন্ম হয়েছে প্রাকৃতিকভাবে আমাদের চোখের সামনেই। গত কয়েক দশকে জেনেটিক্সের অভূতপূর্ব আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা এই নতুন প্রজাতিগুলাের ডিএনএ-র কোথায় কিভাবে এই মিউটেশনগুলাে ঘটেছিলাে তার সম্পূর্ণ চিত্রটি তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন আমাদের সামনে।
আমরা এখন কৃত্রিমভাবে পলিপ্লয়েড সংকরায়সহ অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ তৈরি করতে সক্ষম। আমাদের বাগানে যে সব ডালিয়া, টিউলিপ বা আইরিস ফুলের সমারােহ দেখা যায় তাদের বেশিরভাগ প্রজাতিকেই কিন্তু কোন না কোন সময় কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল বিভিন্ন ধরণের ফসলের উদ্ভিদও তৈরি করা হচ্ছে এ নিয়মে। প্রকৃতিতেও, বিশেষ করে উদ্ভিদের মধ্যে, এই পলিপ্লয়েড সংকরায়নের প্রচুর উদাহরণ দেখা যায়।
এক জেনারেশনেই কি বিবর্তন সম্ভব?
বিজ্ঞানীরা তাে আজকে সেটাই বলছেন – বলছেন, প্রাণীর বিবর্তনের পদ্ধতিকে খুব জটিল এবং দীর্ঘ মেয়াদী হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। কোন কোন সময় এক জেনারেশনে কিংবা শুধুমাত্র একটি জীনের পরিবর্তনের ফলেই বিবর্তন ঘটে যাওয়া সম্ভব, এবং তারা তা ইতোমধ্যে প্রকৃতিতে এবং ল্যাবরেটরিতে প্রমাণও করে ছেড়েছেন। স্টিকেলব্যাক (Sticlebacks) বলে এক ধরণের মাছ আছে, এদের বিভিন্ন প্রজাতিকে সমুদ্রের লােনা পানি এবং নদীর মিঠা পানিতেও সমানভাবে দেখতে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের মতে মাত্র হাজার দশেক আগে, সর্বশেষ বরফ যুগের শেষে, যখন পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়েছিলাে, তখনই তাদের একটা অংশ সমুদ্র থেকে নদীতে গিয়ে পড়ে এবং পরবর্তীতে নদীর পানির নতুন পরিবেশের সাথে অভিযােজিত হয়ে যায়।
সমুদ্রের মাছগুলাের গায়ে ৩৫টি বাড়তি প্লেটের মত হাড্ডি বা কাঁটার স্তর দেখা যায়, যা দিয়ে তারা নিজেদেরকে ভয়ঙ্কর সব সামুদ্রিক শিকারী প্রাণীর দাঁতালাে আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু নদীতে বাস করা স্টিকেলব্যাকের প্রজাতিগুলাের জন্যে তাে আর নিজের দেহে এত ভারী ভারী যুদ্ধাস্ত্র বয়ে বেড়ানাের কোন প্রয়ােজন নেই। তাই তারা বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়ই অভিযােজিত হয়ে এই অপ্রয়ােজনীয় স্তরটা থেকে রেহাই পেয়ে গেছে।

বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে বের করেছেন যে, এই বিবর্তনের পিছনে কাজ করছে Pitx1 gene নামে একটি মাত্র জিন। গত বছর বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে, সমুদ্র থেকে নদীর পানিতে মাছগুলােকে স্থানান্তরিত করা হলে তারা নাকি এক জেনারেশনেই এই বিবর্তনটা ঘটিয়ে ফেলতে পারে, এই বাড়তি স্তরটি আর থাকে না তাদের পরের প্রজন্মে। শুধু তাই নয়, আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে যে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভারসিটির জেনেটিসিস্ট ডঃ কিংসলির দলটি আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে তা হাতে নাতে পরীক্ষা করেও দেখিয়ে দিয়েছেন। তারা এই বিশেষ জিনটিকে সমুদ্রের মাছের কোষ থেকে আলাদা করে নদীর মাছের ডিমের মধ্যে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এই ডিম থেকে বের হওয়া মাছের পােনার মধ্যে ঠিকই বাড়তি কাঁটার স্তরটা জন্ম লাভ করেছে যা তাদের পূর্ব প্রজন্মে ছিলাে না।
বিজ্ঞানীরা একটু অবাকই হয়েছেন প্রকৃতিতে বিবর্তনের এত সহজ এবং দ্রুত একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পেরে, এত বড় একটা পরিবর্তনের জন্য যে মাত্র একটা জীনই দায়ী হতে পারে তাও তারা আশা করেননি। তারা এখন বলছেন যে, প্রকৃতিতে হয়তো খুব খুব সরল উপায়েও বিবর্তন ঘটে এবং তা খুব সহজেই খুজে বের করা সম্ভব [১৪]।
গ্র্যান্ড ক্যানিয়ানের দু’পাড়ের কাঁঠবিড়ালীগুলাে কিভাবে বদলে গেলাে?
আমেরিকার গ্রান্ড ক্যানিয়ানেও দু ধারে খুব কাছাকাছি দেখতে দ’প্রজাতির কাঠ বিড়ালী বা স্কুইরেল দেখা। যায়। তারা দেখতে শুনতে ব্যবহারে প্রায় এক রকম হলেও একে অপরের সাথে প্রজননে অক্ষম। এই প্রকান্ড এবং দুর্ভেদ্য গিরিখাতের দক্ষিণ দিকের কালাে পেট আর সাদা লেজ সহ প্রজাতিটির নাম হচ্ছে। কাইবাব কাঠবিড়ালী আর উত্তর দিকের সাদা রং এর পেট এবং ধুসর রং এর লেজ সহ প্রজাতিটার নাম হচ্ছে আবার্ট কাঠবিড়ালী।
সর্বশেষ বরফ যুগে গ্রান্ড ক্যানিয়ানের পরিবেশ এবং গাছগাছালিতে বিশাল পরিবর্তন ঘটে যায়। এর আগে কিন্তু তারা একই প্রজাতিই ছিলাে এবং এক ধরনের বিশেষ পাইন গাছের কান্ড খেয়েই এরা বেচে থাকে। কিন্তু বরফযুগে গিরিখাতের মাঝখানের সমস্ত পাইন গাছ ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের মধ্যে যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যায়, তারা হয়ে পড়ে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন। আর তার ফলশ্রুতিতেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় তাদের বিবর্তন ঘটতে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে, ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন নিয়মে।
দীর্ঘ দিন ধরে স্বতন্ত্র ধারায় বিবর্তনের ফলে তারা আজকে সম্পুর্ন দুটি ভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা এরকমই একটা উদাহরণ দেখেছিলাম গ্যালাপ্যগাস দ্বীপপুঞ্জে ডারউইনের দেখা বিভিন্ন প্রজাতির ফিঞ্চদের মধ্যে। প্রায় ৫ লাখ বছর আগে দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক ধরণের ফিঞ্চ পাখি থেকে এখন গ্যালাপ্যগাস দ্বীপপুঞ্জে ১৪ ধরণের স্বতন্ত্র প্রজাতির ফিঞ্চের জন্ম হয়েছে।
টিকটিকিগুলাে এরকম রিং এর মত করে তাদের বাসা সাজালাে কেনাে?
আরও মজার মজার কিছু উদাহরণ রয়েছে আমাদের চোখের সামনেই। রিং বা চক্রাকার প্রজাতির উদাহরণটির কথা উল্লেখ না করলে বিবর্তনের গল্পটা যেনাে অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। আমেরিকার দক্ষিণ পশ্চিম উপকুল এলাকা ধরে কয়েক প্রজাতির টিকটিকি (Ensatina eschscholtzil group) মিলে এধরনের একটা রিং তৈরি করেছে। গত শতাব্দীতে ডঃ রবার্ট স্টেবিনস প্রথম এদেরকে পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলেন যে, এদের পুর্বপুরুষেরা যখন উত্তর থেকে দুই দিকে ভাগ হয়ে দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়তে থাকে (নীচের ছবিতে দেখুন) তখনই শুরু হয়েছিলাে এই রিং তৈরির চক্রাকার খেলা [১৫]। তারপর যতই তারা দুদিকে থেকে দুরে সরে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকলাে ততই তাদের মধ্যে ভিন্ন ধারায় বিবর্তন ঘটতে শুরু করলাে।

তারপর দীর্ঘদিন পরে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়াগােতে এসে যখন তারা আবার মিলিত হলাে তখন ইতােমধ্যেই তারা দুটি ভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে আর প্রজনন সম্ভব হচ্ছে না। অনুজীববিদ্যা এবং ডি.এন.এ সিকোয়েন্সিং এর অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এখন এদের জীনের বৈশিষ্ট্যগুলােও খুঁজে বের করেছেন[১৫], আর তাদের পরীক্ষার ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ডঃ স্টেবিনস ঠিকই ধরেছিলেন – ক্রমান্বয়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হতে হতেই এদের মধ্যে এক প্রজাতি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির জন্ম হয়েছিলাে।
আপনি উত্তরে, রিং এর গােড়া থেকে জীনের ধারা পরীক্ষা করতে করতে যতই দু’ধার বেয়ে দক্ষিণে নেমে যেতে থাকবেন ততই দেখবেন ধারাবাহিকভাবে জীনের গঠন এবং বৈশিষ্ট্যগুলাে বদলে যাচ্ছে। এধরণের রিং প্রজাতিগুলাে বিবর্তনবাদের মূল বক্তব্যকে অত্যন্ত জোড়ালােভাবে তুলে ধরে – একদিকে তারা যেমন ক্রমান্বয়ে ঘটা বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপগুলোকে স্পষ্ট করে প্রতিষ্ঠিত করে, আবার অন্যদিকে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার ফলে কিভাবে ধীরে ধীরে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয় তারও সাক্ষ্য বহন করে।
এ ধরণের পরীক্ষা করে ল্যাবরেটরিতে একই রকমের ফলাফল পাওয়া গেছে। ডড (Dodd, 1989), রাইস এবং হসটারট (Rice & Hostert, 1993) সহ আরও অনেক বিজ্ঞানীই ফুট ফ্লাই নিয়ে পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন যে, কিছু ফুট ফ্লাইকে প্রজননগতভাবে আলাদা করে ফেলে ভিন্ন পরিবেশে বড় করলে, বেশ কিছু জেনারেশন পরে তাদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য তৈরি হতে দেখা যায়।
নতুন পরিবেশের সাথে ক্রমাগতভাবে অভিযােজিত হতে হতে এক সময় তারা এতই বদলে যায় যে, আর একে অপরের সাথে প্রজনন করে বংশবৃদ্ধি করতে পারে না, পরিণত হয় এক নতুন প্রজাতিতে[১৫]। এরকম ধরণের বহু পরীক্ষাই করা হয়েছে গবেষণাগারে গত এক শাে বছরে, তাদের ফলাফলগুলােও আমাদের হাতের কাছেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আজকের দিনে বাজারে গিয়ে ট্যাকের পয়সা খরচ করে বই কিনে তাে আর এগুলাে তথ্য খুজে বের করার প্রয়ােজন হয় না, যে কেউ ইচ্ছে মাফিক Google এ একটা সার্চ দিয়েই পেয়ে যেতে পারেন এধরণের উদাহরণ বা পরীক্ষার শ’য়ে শ’য়ে রিপাের্ট।
বিবর্তনের পথ ধরে
১৩.↑ Tate J, Evolution of Polyploidy in Plants (Link found dead: This link↑ may help)
১৪.↑ Single Gene Transforms Fish in One Genration, Discover, Special Issue, vol. 27, no.1, 2006. p 62
১৫.↑ ActionBioscience