শচীন দেব বর্মনের গাওয়া আমার একটা খুব প্রিয় গান আছে। গানটির কথাগুলোর সাথে অবশ্য অনেকেই পরিচিত (এখানে একটি কথা বলে রাখি, গানটির গীতিকার কিন্তু হলেন মীরা দেব বর্মন; শচীন কর্তার স্ত্রী[৮০]!) –
বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে
হৃদয়ে দিয়েছ দোলা
রঙেতে রাঙিয়া রাঙাইলে মোরে
একি তব হোলি খেলা
তুমি যে ফাগুন রঙেরও আগুন
তুমি যে রসেরও ধারা
তোমার মাধুরী তোমার মদিরা
করে মোরে দিশাহারা
মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে
তেমনি আমাতে তুমি
আমার পরানে প্রেমের বিন্দু
তুমিই শুধু তুমি …
প্রেমের কথা বলতে গেলে গন্ধের কথা আলাদাভাবে বলতেই হবে। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে গন্ধের অনুভূতিই সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। এমনকি এককোষী ব্যাকটেরিয়া পর্যন্ত কেবল ‘গন্ধ শুঁকে’ বুঝতে পারে কোন খাবারটা পুষ্টিকর আর কোনটা তাদের জন্য মরণ বিষ। এখন দেখা যাচ্ছে শুধু খাদ্যদ্রব্য শোঁকাই নয় যৌনতার পছন্দ অপছন্দের ক্ষেত্রে কিংবা যৌনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও গন্ধ খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইঁদুর, বিড়াল, কুকুরসহ অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীই বেঁচে থাকা কেবল নয়, যৌনসম্পর্কের ব্যাপারেও অনেকাংশে নির্ভরশীল থাকে গায়ের গন্ধের উপর। আসলে যৌনতার নির্বাচনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয় শরীরের গন্ধকে।
আমাদের প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ যেমন আলাদা, তেমনি আমাদের প্রত্যেকের শরীরের গন্ধও আলাদা, যা অবচেতন মনেই সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, গন্ধের এই তথ্যগুলো জীবদেহে লিপিবদ্ধ থাকে এক ধরনের জিনের মধ্যে, যার নাম— ‘হিস্টোকম্পিট্যাবিলিটি কমপ্লেক্স জিন’ বা সংক্ষেপে MHC gene[৮১]।
বিজ্ঞানীরা অবশ্য জিনের পাশাপাশি গন্ধ পরিবহনের পিছনে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থেরও ভূমিকা খুঁজে পেয়েছেন সেটাকে ফেরোমোন (Pheromone) বলে তারা অভিহিত করেন। এই ফেরোমোন ‘নার্ভ জিরো’ নামে এক ধরনের করোটিক স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কে সঞ্চালিত হয়ে প্রাণিজগতে সঙ্গী নির্বাচন এবং প্রজননকে ত্বরান্বিত করে বলে ধারণা করা হয়[৮২]।
দেখা গেছে গন্ধের উপর নির্ভর করে অনেক প্রাণীই লিঙ্গ চিহ্নিতকরণ, সামাজিক পদমর্যাদা, অঞ্চল, প্রজননগত অবস্থানসহ অনেক কিছু নির্ণয় করতে পারে। যেমন, ১৯৫৯ সালে ইঁদুরের উপর হিল্ডা ব্রুসের একটি গবেষণা[৮৩] থেকে পাওয়া গেছে যে, সঙ্গমের পর যদি কোনো ইঁদুর অপরিচিত কোনো ইঁদুরের গন্ধের খোঁজ পায়, তাহলে তার জরায়ুতে ভ্রুণ প্রতিস্থাপিত না হয়ে ঝরে পড়ে। কিন্তু পরিচিত বা পছন্দের সঙ্গীর গন্ধ গর্ভধারণে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। তার মানে ফেরোমোনের সাহায্যে পছন্দের সঙ্গীর মাধ্যমে গর্ভধারণ নিশ্চিত করতে কিংবা বাতিল করতে পারে এ ধরনের ইঁদুরেরা।
২০০৬ সালে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী লিন্ডা বাক এবং তার সহযোগী সিয়াটলের একটি ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে গবেষণারত অবস্থায় নতুন গ্রাহক প্রোটিনের পরিবারের ১৫টি সদস্যকে সনাক্ত করতে সমর্থ হন। ইঁদুরের নাকে খুঁজে পাওয়া এই গ্রাহকগুলো ফেরোমোনকে সনাক্ত করতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রাণিজগতে ফেরোমোনের ভূমিকা খুব ভালোভাবে প্রমাণিত হলেও মানুষের মধ্যে এর সরাসরি সম্পর্ক যে খুব জোরালো- সেটা কিন্তু এখনও বলা যাবে না[৮৪]। আসলে অন্য প্রাণীরা তাদের বেঁচে থাকা এবং সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে গন্ধের উপর খুব বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হলেও বিবর্তনের ক্রমধারায় গন্ধের উপযোগিতা এবং গুরুত্ব মানব প্রজাতিতে কমে এসেছে।
মানুষ তার দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণেন্দ্রিয় কিংবা বুদ্ধিমত্তার উপর যেভাবে নির্ভর করে, ঠিক তেমনভাবে গন্ধের উপর নয়। তারপরেও বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের ঘ্রাণজ আবরণীকলায় (Olfactory Epithelium) এখনও প্রায় ৩৪৭টি ভিন্ন ধরনের সংবেদনশীল নিউরনের অস্তিত্ব আছে[৮৫]। এই নিউরনগুলো ভিন্ন ভিন্ন গন্ধ সনাক্ত করতে পারলেও আমাদের মাথায় বহুসময়েই গন্ধগুলো মিশ্রিত হয়ে উপস্থাপিত হয়, অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে যেটা আলাদাই থাকে। লিন্ডা বাক ইঁদুরের ক্ষেত্রে যে সমস্ত ফারমোনের গ্রাহক জিনে খুঁজে পেয়েছিলেন, তার অন্তত ছয়টি মানুষের মধ্যেও আছে।

অন্য প্রাণীদের মতো মানুষের জীবন যাত্রাতেও ফেরোমোনের প্রভাব থাকতে পারে এ ব্যাপারটি বোঝা যেতে শুরু করে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্থা ক্লিনটক এবং ক্যাথলিন স্টার্নের একটি গবেষণা থেকে। বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই জানেন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মে কিংবা ছাত্রী-আবাসে একই কক্ষে একাধিক ছাত্রীরা অবস্থান করলে তাদের ঋতু বা রজঃস্রাব একই সময়ে সমাপতিত হয়ে যায়। এই রহস্যময় ব্যাপারটিকে বলে ঋতুচক্রের সমলয়ীকরণ (Menstrual Synchrony)। মার্থা ক্লিনটক তার ১৯৭১ সালের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছিলেন যে এটার পেছনে মূল ভুমিকা পালন করে ফেরোমোন[৮৬]।
১৯৯৮ সালে মার্থা ক্লিনটক তার আগের গবেষণাকে আরও বিস্তৃত করেন। তিনি তার এ পরীক্ষায় দেখান, যে ফেরোমোন শুধু ঋতুচক্রের সমলয়ীকরণই নয়, সেই সাথে মেয়েদের অনিয়মিত মাসিককে নিয়মিত করতেও ভূমিকা রাখে। সাধারণত দেহের লোমশ জায়গাগুলোকে (যেমন, বগলের তলা কিংবা যৌনাঙ্গের এলাকা প্রভৃতি) ফেরোমোনের উৎস বলে মনে করা হয়। মার্থা ক্লিনটক এই পরীক্ষায় কিছু স্বেচ্ছাসেবক পুরুষের বগল থেকে নেওয়া ঘামের ফেরোমোন নারীদের ঠোঁটে লাগিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে পরীক্ষা করে দেখেন, এর ফলে মেয়েদের অনিয়মিত মাসিক নিয়মিত হয়ে যাচ্ছে[৮৭]। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, অন্য প্রাণীদের মতো এত ব্যাপক আকারে না হলেও শরীরের গন্ধ মানব শরীরেরও রোগ প্রতিরোধতন্ত্র গঠনে বড় ভূমিকা রাখে, এবং এর পেছনে আছে বিবর্তনীয় কারণ। হেলেন ফিশার তাঁর অ্যানাটমি অফ লাভ বইয়ের ৪২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন[৮৮] —
পুরুষের গায়ের গন্ধ (ঘাম) মেয়েদের ঋতুচক্রকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। সেজন্যই ছেলেদের ঘামের গন্ধের প্রতি মেয়েদের (অবচেতন) আকর্ষণ খুব সম্ভবত বিবর্তনজনিত। পুরুষদের সুগন্ধি ব্যবহার করার ও মেয়েদের তা পছন্দ করার কারণ হলো পণ্য উৎপাদনকারীর বিজ্ঞাপকদের আগ্রাসী সাংস্কৃতিক মগজ ধোলাই যার দরুন ঘাম হওয়াকে অপরিচ্ছন্নতার সঙ্গে এক করে দেখা হয়।
অর্থাৎ, এ ব্যাপারটি মনে রাখতে হবে যে, ঘামের পচা গন্ধ যে আমরা অপছন্দ করি সেটা এবং ফেরোমোনের গন্ধ কিন্তু এক নয়। ঘামের দুর্গন্ধ তৈরি হয় ঘামের ব্যাক্টেরিয়া পচনের ফলে, যা আবহাওয়ায় ছড়ায় কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু অন্যদিকে ফেরোমোনের গন্ধ মূলত দেহজাত যা খুবই সূক্ষ্ণ এবং সেটা সচেতনভাবে পাওয়া যায় না। আমরা যতই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকি না কেন, সেটা সবসময়ই দেহ থেকে বের হতে থাকে বলে মনে করা হয়। ছেলেরা যখন এগারো বারো বছর বয়সের দিকে বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছায়, তখন তাদের দেহ হয়ে উঠে নানা ধরনের নতুন ধরনের গন্ধের আড়ত, যা তার আগেকার শিশু বয়সের গন্ধ থেকে একেবারেই আলাদা। স্নায়ুবিজ্ঞানী লোয়ান ব্রিজেন্ডিন তার সাম্প্রতিক ‘মেইল ব্রেন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এই নতুন গন্ধটি টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রভাবে পুরুষের দেহজ ঘামগ্রন্থি থেকে নির্গত ফেরোমোন এবং এন্ড্রোস্টেনেডিওনের একধরনের সুষম মিশ্রণ[৮৯]। আর ছেলেদের এই গন্ধটা মেয়েরা পায় প্রবৃত্তিগতভাবে, ঘ্রাণজ আবরণীকলার মাধ্যমে নয়, বরং এর বাইরে আরেকটি পৃথক অঙ্গের মাধ্যমে যাকে বলা হয় ভোমেরোনাসা তন্ত্র (Vomeronasal Organ) বা সংক্ষেপে VNO[৯০]।

গন্ধ যে মানুষের মনের মেজাজ মর্জি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে তা কিন্তু আমরা প্রাত্যহিক জীবনের নানা উদাহরণ থেকে খুব সাধারণভাবেই জানি। পুজা-অর্চনার সময় ধূপধুনা জ্বালানো, কিংবা মিলাদ মাহফিলে আগর বাতি জ্বালানো হয় গন্ধের মাধ্যমে চিত্ত চাঞ্চল্য দূর করে মানসিক ভাবগাম্ভীর্যতা বজায় রাখার প্রয়োজনেই। গোলাপের গন্ধে মন প্রফুল্ল হওয়া, লেবুর গন্ধে সতেজ থাকা, ফিনাইল এলকোহলের গন্ধে রক্তচাপ কমার কিংবা ইউক্যালিপ্টাস পাতার ঘ্রাণে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়মিত হবার কিছু প্রমাণ বিজ্ঞানীরাও পেয়েছেন। আর বিভিন্ন সৌগন্ধিক কোম্পানিগুলো টিকেই আছে পারফিউমের সুবেশী গন্ধকে প্রফুল্লতায় নিয়ে যাওয়ার নানা রকম চেষ্টার উপকরণের উপরেই। কিন্তু এসবের বাইরেও বিজ্ঞানীরা গন্ধের আরও একটি বড় ভূমিকা খুঁজে পেয়েছেন। আমরা যে ‘হিস্টোকম্পিট্যাবিলিটি কমপ্লেক্স জিন’ বা MHC জিনের কথা আগে জেনেছি, দেখা গেছে অনেক প্রাণী গন্ধের মাধ্যমে MHC জিন সনাক্ত করতে পারে।
এভাবে তারা গন্ধ শুঁকে নিজেদের পরিবারে কিংবা নিকটাত্মীয়দের সাথে সঙ্গম করা থেকে বিরত থাকতে পারে। এই বিরত থাকার ব্যাপারটা কিন্তু বিবর্তনীয় পথেই সৃষ্ট হয়েছে। মানবসমাজেও খুব কাছের পরিবার পরিজনদের (বাবা, মা ভাই বোন কিংবা নিকটাত্মীয়) মধ্যে যৌনসঙ্গমকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, সামাজিকভাবেই একে ‘ব্যাভিচার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর কারণ হচ্ছে, খুব কাছের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাভিচারের ফলে যে সন্তান জন্মায় দেখা গেছে তার বংশাণু বৈচিত্র্য হ্রাস পায়, ফলে সে ধরনের সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়।
শুধু তাই নয় জীববিজ্ঞানীরা গবেষণা থেকে দেখেছেন যে, বাবা কিংবা মায়ের পরিবারে যদি কোনো জিনবাহিত রোগ থাকে, তবে শতকরা ২৫ ভাগের মতো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সম্ভাবনা থেকে যায় ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে সন্তান জন্মানোর। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘কনজেনিটাল বার্থ ডিফেক্ট’ (Congenital Birth Defects) বা জন্মগত সমস্যা। নিঃসন্দেহে আমাদের আদিম পূর্বপুরুষেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্যাপারটি অনুধাবন করেছিলেন যে কাছাকাছি পারিবারিক সম্পর্কযুক্ত মানুষজনের মধ্যে যৌনসম্পর্ক হলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে এবং সে সমস্ত শিশুর মৃত্যু হার বেশি।
সামাজিকভাবেই এটিকে প্রতিহত করার প্রবণতা দেখা দেয়। সেজন্যই বিবর্তনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় আমাদের প্রবৃত্তিগুলো এমনভাবে তৈরী হয়েছে যে, বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের পরিবারের সদস্যদের দেখে যৌন আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয় না। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন অন্য প্রাণীদের মতো মানুষও অবচেতনভাবেই গন্ধের সাহায্যে ব্যাপারটির ফয়সলা করে। এর একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে জীববিজ্ঞানী ক্লাউস ওয়েডেকাইণ্ডের একটি গবেষণায়[৯১]।
সেই পরীক্ষায় সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লাউস ওয়্যাইন্ড ১০০ জন কলেজ ছাত্রকে আলাদা করে তাদের সুতির জামা পরিয়ে রেখেছিলেন দুই দিন ধরে। সেই দুই দিন তারা কোনো ঝাল-ঝোলওয়ালা খাবার খায়নি, ধূমপান করেনি, কোনো ডিওডারেন্ট ব্যবহার করেনি, এমনি কোনো সুগন্ধি সাবানও নয়, যাতে করে নমুনা ক্ষেত্র প্রভাবান্বিত হবার ঝামেলা-টামেলাগুলো এড়ানো যায়। তারপর যেটা করা হল তা বেশ মজার। তাদের সবগুলো জামা একত্রিত করে একটি বাক্সে ভরে আরেকদল অপরিচিত ছাত্রীদের দিয়ে শোঁকানো হল। মেয়েদেরকে গন্ধ শুঁকে বলতে বলা হলো কোনো টি-শার্টের গন্ধকে তারা ‘সেক্সি’ বলে মনে করে।
দেখা গেল মেয়েরা সেসমস্ত টি-শার্টের গন্ধকেই পছন্দ করছে কিংবা যৌনোদ্দীপক বলে রায় দিচ্ছে যে সমস্ত টি-শার্টের অধিকারীদের দেহজ MHC জিন নিজেদের থেকে অনেকটাই আলাদা। আর যাদের MHC জিন নিজের জিনের কাছাকাছি বলে প্রতীয়মান হয়, তাকে মেয়েরা অনেকটা নিজের ভাইয়ের মতো মনে করে[৯২]!
১৯৯৭ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বংশগতিবিদ ক্যারোল ওবারের এ ধরনের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে একই MHC জিন বিশিষ্ট বাহকেরা সাধারণত একে অপরের সাথে যৌন সম্পর্কে অনিচ্ছুক হয়[৯৩]। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন এই পৃথিবীতে দম্পতিদের বন্ধ্যাত্ব এবং গর্ভপাত সমস্যার একটি বড় কারণ আসলে লুকিয়ে আছে দম্পতিদের MHC জিনের সমরূপতার মধ্যে।
ডাক্তাররা ১৯৮০ সালের পর থেকেই কিন্তু এ ব্যাপারটা মোটামুটি জানেন। তারা দেখেছেন অনেক নারী দৈহিক এবং মানসিকভাবে কোনো ধরনের সমস্যার মধ্যে না থাকা সত্ত্বেও সন্তান হচ্ছে না কেবল দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার MHC জিন তার স্বামীর জিনের কাছাকাছি হওয়ায়। অনেক সময় যদিওবা সন্তান হয়ও তা থাকে পর্যাপ্ত ওজনের অনেক নীচে। আর এ ধরনের একই MHC জিন বিশিষ্ট সম্পর্কের ক্ষেত্রে গর্ভপাতের হারও থাকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি[৯৪]। ‘হিউম্যান লিউকোসাইট এন্টিজেন’ (সংক্ষেপে HLA) নামে আমাদের ডিএনএ-এর একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ আছে যা দেহের রোগ প্রতিরোধের সাথে জড়িত।
জুরিখের বংশগতি বিশেষজ্ঞ তামারা ব্রাউনের সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে এই HLAর বৈচিত্র্যই ‘সঠিক ভালোবাসার মানুষ’ নির্বাচনে বড় সড় ভুমিকা রাখে। সাধারণভাবে বললে বলা যায়, আপনার হবু সঙ্গীর HLA-র বিন্যাস আপনার থেকে যত বেশি বৈচিত্র্যময় হবে, তত বেশি বাড়বে তার প্রতি আপনার আকর্ষণের মাত্রা এবং সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হবার সম্ভাবনা[৯৫]। এই ধরনের জেনেটিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ সঙ্গী খুঁজে পাওয়ার কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য জিনপার্টনার ডট কম (genepartner.com↑)-এর মতো সাইটগুলো ইতোমধ্যেই বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে। এর মাধ্যমে এর মক্কেলরা নাকি তাদের থুতু পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে পারবেন, তার ভবিষ্যত সঙ্গীর HLA’র বিন্যাস বৈচিত্র্য তাকে কতটুকু আকর্ষিত কিংবা বিকর্ষিত করতে পারে, আর এতে খরচ পড়বে পরীক্ষা প্রতি ৯৯ ডলার! কে জানে হয়তো তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশগুলোতে বহুদিন ধরে চলে আসা ‘এরেঞ্জড ম্যারেজ’-এর জেনেটিক রূপ দেখা যাবে ভবিষ্যতের ‘উন্নত পৃথিবীতে’। MHC জিন কিংবা HLAর বিন্যাস দেখে গুনে শুনে দল বেধে সঙ্গী নির্বাচন করছে প্রেমিক-প্রেমিকেরা কিংবা বিবাহ ইচ্ছুকেরা![৯৬]
তবে পাঠকদের নিশ্চয় বুঝতে দেরি হবার কথা নয় যে, কেবল ‘জেনেটিক ম্যাচ’ বা বংশগতীয় জুড়ির উপর নির্ভর করে সঙ্গী নির্বাচনের চেষ্টা খুব বেশি সফল হওয়ার কথা নয়, কারণ মানব সম্পর্ক এমনিতেই অন্য প্রাণীর চেয়ে অনেক জটিল। মানুষের সম্পর্কের স্থায়িত্ব জিনের বাইরেও অনেক বেশি নির্ভরশীল পরিবেশ এবং সম্পর্কের সামাজিকীকরণের উপর। সেজন্যই দেখা যায় অনেক সময় বংশগতীয় পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না আসা সত্ত্বেও অনেকের ক্ষেত্রেই সম্পর্ক তৈরি এবং বিকাশে সমস্যা হয়নি, কেবল সামাজিক উপাদানগুলোর কারণেই।
তারপরেও অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন বংশগতীয় ব্যাপারটা মিলে গেলে সম্পর্ক তৈরীতে সেটা অনুকূল প্রভাব আনতে পারে ভবিষ্যত পৃথিবীতে সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে। ক্লাউস ওয়্যাইন্ড, ক্যারোল ওবার, তামারা ব্রাউন সহ অনেক বিজ্ঞানীই মনে করেন, আমাদের ডিএনএতে প্রকাশিত এই ভালোবাসার সংকেতগুলো শেষ পর্যন্ত ফেরোমোন প্রবাহের মাধ্যমেই আমাদের মস্তিকে পৌঁছায়, যার ভিত্তি মূলত লুকিয়ে আছে সঙ্গীর গায়ের গন্ধের মধ্যেই। সেজন্যই বিলিয়ন ডলারের ম্যাচ-মেকিং সাইটগুলো এখন ভালোবাসার রসায়ন বুঝতে ডিএনএ বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি গায়ের গন্ধ নিয়েও আগ্রহী হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা জানতে শুরু করেছি যে, আর সব প্রাণীর মতো মানুষও অবচেতন মনেই গন্ধ শোঁকার মাধ্যমে সঙ্গী বাছাইয়ের কাজটি করে থাকে। কথিত আছে, ১৫ শতকে ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় হেনরীর শাসনামলে সম্রাটের আমন্ত্রণে মারিয়া নামে এক নর্তকী রাজপ্রাসাদে নাঁচতে এসেছিল। শোনা যায়, নাঁচ শেষ হবার পর ঘর্মাক্ত শরীর একটি তোয়ালে দিয়ে মুছে মারিয়া সম্রাটের দিকে ছুড়ে দেয়। সম্রাট সেই তোয়ালে পেয়ে ‘ভালোবাসার গন্ধে’ এমনই বিমোহিত হন, যে মারিয়াকে আর প্রাসাদ থেকে যেতে দেননি, তাকে সম্রাজ্ঞী হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। অবশ্য বলা বাহুল্য, আমাদের মতো অধিকাংশ ছা-পোষা মানুষের ক্ষেত্রে এই ধরনের গন্ধকেন্দ্রিক পছন্দগুলো সম্রাট হেনরীর এত প্রকটভাবে দৃশ্যমান নয়। আর আগেই বলেছি, গন্ধের মাধ্যমে পছন্দের এই ব্যাপারটি আসলে সচেতনভাবে নয়, বরং প্রবৃত্তিগতভাবেই ঘটে, এবং এটি উদ্ভূত হয়েছে বিবর্তনেরই ক্রমিক ধারায়।
ভালোবাসা কারে কয়
৮০.↑
মীরা দেব বর্মন
৮১.↑ Meredith F. Small, Nosing Out A Mate, Scientific American, 1999
৮২.↑ R. Douglas Fields, Sex and the Secret Nerve, Scientific American Mind, February 2007
৮৩.↑ H.M. Bruce An exteroceptive block to pregnancy in the mouse, Nature, 184:105, 1959
৮৪.↑ Warren S. T. Hays, Human pheromones: have they been demonstrated? Behavioral Ecology and Sociobiology, 54:89-97, 2003
৮৫.↑ R. Douglas Fields, Sex and the Secret Nerve, Scientific American Mind, February 2007
৮৬.↑ MK McClintock, Menstrual synchrony and suppression. Nature 229 (5282): 244–5, 1971
৮৭.↑ K Stern, MK McClintock, “Regulation of ovulation by human pheromones”. Nature 392 (6672): 177–9, 1998.
৮৮.↑ Helen Fisher, Anatomy of Love: A Natural History of Mating, Marriage, and Why We Stray, Ballantine Books , January 3, 1994; || বাংলা অনুবাদঃ ভালবাসা ও বিবর্তন↑
৮৯.↑ Louann Brizendine M.D., The Male Brain, Broadway; March 23, 2010
৯০.↑ Vomeronasal Organ – An organ thought to supplement the olfactory system in receiving pheromonic communication. The sensory part of the organ is in two long, thin sacs, situated on either side of the nasal septum at its base.
৯১.↑ C Wedekind; T. Seebeck, F. Bettens, and A. J. Paepke, “MHC-dependent mate preferences in humans”. Proc Biol Sci 260 (1359): 245–249, 1995
৯২.↑ ইউটিউবে একটি চমৎকার ডকুমেন্টারি আছে – Evolution Sweaty T-shirts and Human Mate Choice↑
৯৩.↑ Nicholas Wade, Scent of a Man Is Linked To a Woman’s Selection, NY Times, 2002.
৯৪.↑ F. Bryant Furlow, The Smell of Love, Psychology Today, published on March 01, 1996 – last reviewed on August 13, 2010
৯৬.↑ ইউটিউবের ভিডিওঃ New Matchmaking System uses DNA↑