মার্টিন ড্যালি এবং মার্গো উইলসন তাদের বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাসের একটা বড় সময় জুড়ে মানবসমাজ আসলে একগামী ছিল না, বরং সে সময় পুরুষেরা ছিল বহুগামী। মানবসমাজ ছিল পলিজাইনাস (Polygynous) যেখানে শক্তিশালী কিংবা ক্ষমতাশালী পুরুষেরা একাধিক নারীকে বিয়ে করতে পারত, কিংবা তাদের দখল নিতে পারত[২০৬]। পলিজাইনাস সমাজে কিছু সৌভাগ্যবান পুরুষ তাদের অতুলনীয় শক্তি আর ক্ষমতার ব্যবহারে অধিকাংশ নারীর দখল নিয়ে নিত, আর অধিকাংশ শক্তিহীন কিংবা ক্ষমতাহীন পুরুষদের কপালে থাকত অশ্বডিম্ব! যত খারাপই লাগুক, এটাই ছিল রূঢ় বাস্তবতা।
নারীর দখল নেওয়ার জন্য পুরুষে পুরুষে একসময় প্রতিযোগিতা করতে হতো; আর এই প্রতিযোগিতা বহুক্ষেত্রেই ‘শান্তিময়’ ছিল না, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতা রূপ নিত রক্তাক্ত সংঘাতে, আর তার পরিণতি হতো হত্যা আর অপঘাতে। পুরুষেরা সম্পদ আহরণ করত কিংবা লড়াই আর যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করত মূলত নারীদের আকর্ষণের জন্য। যারা সম্পদ আহরণে আর শক্তি প্রদর্শনে ছিল অগ্রগামী তারা দখল নিতে পারত একাধিক নারীর।
সম্পদ আর নারী নিয়ে এই প্রতিযোগিতার কারণেই সমাজের পুরুষদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার চর্চার (সংঘাত, খুন, ধর্ষণ, অস্ত্রবাজি, গণহত্যা প্রভৃতি) প্রকাশ ঘটেছিল। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পুরুষালি সহিংসতার বড় একটা উৎস আসলে নিহিত সেই চিরন্তন ‘ব্যাটেল অব সেক্স’-এর মধ্যেই। এমনকি আধুনিক কালে ঘটা বিভিন্ন অপরাধ এবং ভায়োলেন্সগুলোকেও বহু সময়েই এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়।
জীববিজ্ঞানের চোখে পুরুষালি সহিংসতা
মানবসমাজে পুরুষরা কেন নারীদের চেয়ে অধিকতর সহিংস তার খুব সহজ ব্যাখ্যা আছে জীববিজ্ঞানে। আগের অধ্যায়ে এ ব্যাপারে খুব হাল্কাভাবে আভাস দেয়া হয়েছিল। প্রাকৃতিকভাবেই শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর প্রকৃতি আলাদা। পুরুষের স্পার্ম বা শুক্রাণু উৎপন্ন হয় হাজার হাজার, আর সে তুলনায় ডিম্বাণু উৎপন্ন হয় কম। ডিম্বাণুর আকার শুক্রাণুর চেয়ে বড় হয় অনেক। অর্থাৎ, জৈব বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করলে স্পার্ম সহজলভ্য, তাই কম দামি, আর সে তুলনায় ডিম্বাণু অনেক মূল্যবান। ‘স্পার্ম অনেক সহজলভ্য’ বলেই (সাধারণভাবে) পুরুষদের একটা সহজাত প্রবণতা থাকে বহু সংখ্যক জায়গায় তার প্রতিলিপি ছড়ানোর।
একজন পুরুষ তার সারা জীবনে অসংখ্য নারীর গর্ভে সন্তানের জন্ম দিতে পারে, অপরদিকে একজন নারী বছরে জন্ম দিতে পারে কেবল একটি সন্তানেরই। মূলত নারী পুরুষের যৌনতার পার্থক্যের কারণেই পুরুষরা মূলত নারীর চেয়ে সহিংস হয়ে বেড়ে ওঠে। কেবল মানুষ নয় মূলত সকল স্তন্যপায়ী জীবের ক্ষেত্রেই এই ধারা খুব প্রবলভাবেই বিদ্যমান।
জীববিজ্ঞানীরা জৈবিকভাবে নারী পুরুষদের মধ্যকার যৌনতার পার্থক্যকে অনেক সময় ‘ফিটনেস ভ্যারিয়েন্স’ (Fitness varience) এর মাধ্যমে প্রকাশ করেন। যৌনতার পার্থক্যের কারণেই পুরুষদের ফিটনেস ভ্যারিয়েন্স নারীর চেয়ে বেশি[২০৭]। আর তা ছাড়া, ইতিহাসের একটা বড় সময় জুড়ে মানবসমাজ আসলে একগামী ছিল না, বরং সে সময় পুরুষেরা ছিল বহুগামী। এখনও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানবসমাজ মনোগেমাস নয়, বরং মাইল্ডলি পলিজাইনাস[২০৮]। মনোগেমাস প্রজাতিতে নারী পুরুষের আকার আয়তন সমান হয়, অনেক সময় পার্থক্য করাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়।
যেমন পেঙ্গুইনের ক্ষেত্রে। নারী পেঙ্গুইন আর পুরুষ পেঙ্গুইনের আকার একেবারে সমান সমান। কিন্তু যে সমস্ত প্রজাতিতে পুরুষে পুরুষে প্রতিযোগিতা হয় নারীর দখল নেওয়ার জন্য সেখানে পুরুষের দৈহিক আকার নারীর চেয়ে বড় হয় । যেমন গরিলার ক্ষেত্রে একটি পুরুষ গরিলার গড়পড়তা ওজন হয় ৪০০ পাউন্ড, অপর দিকে নারী গরিলার মাত্র ২০০ পাউন্ড। অর্থাৎ, পুরুষ গরিলা ওজনে নারী গরিলার চেয়ে শতকরা একশ ভাগ বেশি থাকে। এখন মানবসমাজের দিকে তাকালে আমরা কি দেখি? গড়পড়তা একটি পুরুষের ওজন মোটামুটি ১৯০ পাউন্ড, আর নারীর ওজন ১৬০ পাউন্ড, অর্থাৎ গড়পড়তা পুরুষের ওজন নারীর চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি।
পুরুষদের দৈহিক আকার মেয়েদের চেয়ে বেশি হওয়া, শক্তিমত্তা এবং আপার বডি ম্যাস সব কিছুই প্রমাণ করে বিবর্তনীয় পথ পরিক্রমায় সম্ভবত খুব ভায়োলেন্ট পুরুষ-পুরুষ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। এ ধরনের সমাজে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষে পুরুষে দ্বন্দ্ব হয়, হয় প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার কারণেই বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার চর্চার (আধুনিক মানবসমাজে সংঘাত, খুন, ধর্ষণ, অস্ত্রবাজি, গণহত্যা প্রভৃতি হচ্ছে কিছু উদাহরণ) প্রকাশ ঘটে।
জীববিজ্ঞান থেকে কিছু উলটো (ব্যতিক্রমী) উদাহরণ হাজির করেও যৌনতার সাথে আগ্রাসনের সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা যায়। কিছু মাছ আর পাখি আছে যেখানে পুরুষেরা নারীদের মতোই নয় মাস ধরে যে গর্ভধারণের সমতুল্য কিছু নমুনা প্রদর্শন করে থাকে। যেমন, মাছের ক্ষেত্রে কিছু পুরুষ মাছ নিজেদের মুখে ডিম নিয়ে বসে থাকে যতক্ষণ না তা থেকে বাচ্চা বের হয়। কিছু পুরুষ পাখি আছে যারা একই রকমভাবে ‘ফার্টিলাইজড এগ’ বহন করে। সে ধরনের প্রজাতিগুলোতে নারীদের ‘ফিটনেস সিলিং’ অনেক বেশি থাকে পুরুষদের তুলনায়।
কারণ এখানে নারীরা বোহেমিয়ানভাবে ইচ্ছেমত ‘ঘুরে ফিরে’ বেড়াতে পারে, আর পুরুষেরা ‘গর্ভবতী’ থাকে (আক্ষরিক অর্থে নয়) অনেকটা সময় জুড়ে আর বাচ্চার তদারকের একটা বড় দায়িত্ব পালন করে। এই ধরনের প্রজাতিতে নারীরা অধিকতর সহিংস, আগ্রাসী এবং প্রতিযোগিতামূলক হয়ে থাকে[২০৯]। এই ‘ব্যতিক্রমী উদাহরণ’গুলো থেকেও স্পষ্ট হয় যে, মূলত যৌনতার পার্থক্য তথা ফিটনেস ভ্যারিয়েন্সের কারণেই প্রাণিজগতে লিঙ্গভিত্তিক আগ্রাসনের পার্থক্য সূচিত হয়।
আধুনিক বিশ্বেও পুরুষেরা সম্পদ আহরণের জন্য, ক্যারিয়ারের জন্য, অর্থ উপার্জনের জন্য মেয়েদের তুলনায় অধিকতর বেশি শক্তি এবং সময় ব্যয় করে। কারণ এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিত করে অধিকসংখ্যক নারীর দৃষ্টি, এবং সময় সময় তাদের অর্জন এবং প্রাপ্তি। অর্থাৎ, একটা সময় পুরুষেরা নারীর দখল নিতে নিজেদের মধ্যে শারীরিক প্রতিযোগিতা আর দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিজেদের নিয়োজিত রাখত, এখন সেটা পরিণত হয়েছে অর্থ, বৈভব, ক্যারিয়ার তৈরীর লড়াইয়ে।
বিত্তশালী ছেলেরা বিএমডাব্লিও কিংবা রোলসরয়েসে চড়ে বেড়ায় নিজেদের বৈভবের মাত্রা প্রকাশ করতে, কিংবা হাতে ফ্যাশানেবল মোভাডো ঘড়ি কিংবা ব্র্যান্ডনেমের কেতাদুরস্ত কাপড় পরিধান করে, যার মাধ্যমে ‘শো অফ’ করে নিজেকে অন্য পুরুষদের চেয়ে ‘যোগ্য’ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায়। শুধু কেতাদুরস্ত কাপড়, গাড়ি কিংবা ঘড়ি নয় কথাবার্তা, চালচলন, স্মার্টনেস, শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি সবকিছুকেই পুরুষেরা ব্যবহার করে নারীকে আকর্ষণের কাজে। সেজন্যই বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অর্থ-প্রতিপত্তি আর ক্ষমতায় বলীয়ান পুরুষেরাই পরকীয়ায় বেশি আসক্ত হন (এ নিয়ে সামনে আরও আলোচনা আসবে)।
যৌনতার এই ধরনের পার্থক্যের কারণেই পুরুষেরা সামগ্রিকভাবে অধিকতর বেশি ঝুঁকি নেয়, ঝুঁকিপূর্ণ কাজকর্ম, পেশা কিংবা খেলাধুলায় (কার রেসিং, বাঙ্গি জাম্পিং কিংবা কিকবক্সিং) জড়িত হয় বেশি, একই ধারায় অপরাধজগতেও তারা প্রবেশ করে অধিক হারে। এর সত্যতা মিলে সহিংসতা নিয়ে গবেষকদের বাস্তব কিছু পরিসংখ্যানেও।
সাড়া বিশ্বে যত খুন-খারাবি হয় তার শতকরা ৮৭ ভাগই হয় পুরুষের দ্বারা[২১০]। আমেরিকার মধ্যে চালানো জরিপে পাওয়া গেছে যে শতকরা ৬৫ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ দ্বারা পুরুষ হত্যার ঘটনা ঘটে। শতকরা ২২ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের হাতে নারী হত্যার ঘটনা ঘটে। খুন-খারাবির ১০ ভাগ ক্ষেত্রে নারী হত্যা করে পুরুষকে, আর মাত্র ৩ ভাগ ক্ষেত্রে নারী হত্যা করে নারীকে[২১১]।
সারা বিশ্বে পুরুষদের হাতে পুরুষদের হত্যার হার আরও বহুগুণে বেশি পাওয়া গেছে ভিন্ন কিছু পরিসংখ্যানে। যেমন, ব্রাজিলে শতকরা ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রে, স্কটল্যান্ডে ৯৩ ভাগ ক্ষেত্রে, কেনিয়ায় ৯৪ ভাগ ক্ষেত্রে, উগান্ডায় ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রে এবং নাইজেরিয়ায় ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ কর্তৃক পুরুষের হত্যার ঘটনা ঘটে থাকে[২১২]। এর মাধ্যমে পুরুষ-পুরুষ প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত এবং জিঘাংসার বিবর্তনীয় অনুকল্পই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।
গড়পড়তা নারীরা পুরুষদের চেয়ে কম ঝুঁকি নেয়।
বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী এনি ক্যাম্পবেল (Anne Campbell) মনে করেন, অনর্থক ঝুঁকি নেওয়ার ব্যাপারগুলো মেয়েদের জন্য কোনো রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস প্রদান করে না[২১৩]। আদিমকাল থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করার চেয়ে মেয়েরা বরং সন্তানদের দেখভাল করায় অর্থাৎ জিনপুল রক্ষায় নিয়োজিত থেকেছে বেশি। অনেক গবেষকই মনে করেন, মেয়েরা যে কারণে পুরুষদের মতো ঘন ঘন সঙ্গী বদল করে না, ঠিক সেকারণেই তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও জড়িত হয় কম, কারণ, বিবর্তনগত দিক থেকে সেগুলো কোনো প্রজননগত উপযোগিতা (Reproductive Benefit) প্রদান করে না।
এ কারণেই মেয়েদের মানসজগৎ কম প্রতিযোগিতামূলক এবং সর্বোপরি কম সহিংস হিসেবে গড়ে উঠেছে। যে কোনো সংস্কৃতি খুঁজলেই দেখা যাবে, নৃশংস খুনি বা সিরিয়াল কিলার পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে একেবারেই কম, ঠিক যে কারণে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি মেয়েদের মধ্যে কম থাকে পুরুষের তুলনায়।
ভালোবাসা কারে কয়
২০৬.↑ Margo Wilson and Martin Daly, পূর্বোক্ত, pp 137-161
২০৭.↑ Fitness variance is the difference between the “winners” and “loosers” in the reproductive game – how much more reproductively successful the “winners” are compared to the “losers”. Because anisogamy and internal gestation, men have much greater fitness variance than women.
২০৮.↑ Laura Betzig, Despotism and differential reproduction: A Darwinian View of History, Newyork, Aldine Transaction, 1986.
২০৯.↑ 209 Tim Clutton-Brock, Sexual Selection in Males and Females, Science 21 December 2007
২১০.↑ David M. Buss, The Murderer Next Door, Why the Mind is Designed to Kill, Penguin Books, 2005
২১১.↑ David M. Buss, The Murderer Next Door, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২২।
২১২.↑ Margo Wilson and Martin Daly, পূর্বোক্ত।
২১৩.↑ Anne Campbell, Staying Alive: Evolution, Culture, and Women’s Intrasexual Aggression, Behaviour and Brain Sciences, v.22 , pp203-52