সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি : কেন পুরুষেরা পর্নোগ্রাফি ভালোবাসে আর মেয়েরা প্রেমের উপন্যাস
নারীপুরুষের এ ধরনের চাহিদার পার্থক্য আরও প্রকট হয়েছে নারী-পুরুষদের মধ্যকার যৌনতা নিয়ে ‘ফ্যান্টাসি’ কেন্দ্রিক গবেষণাগুলোতেও। ব্রুস এলিস এবং ডন সিমন্সের করা ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে যে, পুরুষ এবং নারীদের মধ্যকার যৌনতার ব্যাপারে ফ্যান্টাসিগুলো যদি সততার সাথে লিপিবদ্ধ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তিনজনের মধ্যে একজন পুরুষ একাধিক নারীর সাথে যৌনতার ফ্যান্টাসিতে ভোগে, এমনকি সারা জীবনে তাদের পার্টনারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে কল্পনা করে তারা আমোদিত হয়ে উঠে আর মেয়েদের মধ্যে সে সংখ্যাটা মাত্র ৮ ভাগ।
এলিস এবং সিমন্সের সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করা অর্ধেক সংখ্যক নারীরা অভিমত দিয়েছে, যৌনতা নিয়ে কল্পনার উন্মাতাল সময়গুলোতেও তারা কখনো সঙ্গী বদল করে না, অন্য দিকে পুরুষদের মধ্যে এই সংখ্যাটা মাত্র ১২ ভাগ। মেয়েদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো তার নিজের পরিচিত যৌনসঙ্গীকে কেন্দ্র করেই সবসময় আবর্তিত হয়, আর অন্যদিকে পুরুষদের যৌনতার ফ্যান্টাসিগুলো সময় সময় সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েকে নিয়েও উথলে ওঠে । একারণেই গবেষক এলিস এবং সিমন্স তাদের গবেষণাপত্রে এই বলে উপসংহার টেনেছেন[১৬৮] —
পুরুষদের যৌনতার বাঁধন-হারা কল্পনাগুলো হয়ে থাকে সর্বব্যাপী, স্বতঃস্ফুর্ত, দৃষ্টিনির্ভর, বিশেষভাবে যৌনতাকেন্দ্রিক, নির্বিচারী, বহুগামী এবং সক্রিয়। অন্যদিকে মেয়েদের যৌন অভিলাস অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক, আবেগময়, অন্তরঙ্গ এবং অক্রিয়।
একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডেভিড বাসের ‘মেটিং স্ট্র্যাটিজি’ নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাতেও। এমনি একটি গবেষণায় দেখা গেছে একজন পুরুষকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে সাড়া জীবনে কতজন যৌনসঙ্গীর দরকার বলে তার মনে হয়, গড়পড়তা উত্তর পাওয়া গেছে-১৮। নারীদের ক্ষেত্রে সেটা মাত্র ৪.৫ (নীচের ছবি দ্রঃ)।
“এই মেয়ে শোন, তোমাকে আমি কয়েকদিন ধরেই ক্যাম্পাসে দেখছি। তুমি খুবই আকর্ষণীয়। ”
তারপরের তিনটি প্রশ্ন হবে এরকমের —
১। তুমি আমার সাথে ডেটে যেতে চাও?
২। তুমি কি আমার সাথে আমার এপার্টমেন্টে যেতে চাও?
৩। তুমি কি আমার সাথে সেক্স করতে ইচ্ছুক?
দেখা গেছে, এ ধরনের প্রশ্নে ৫০% ছাত্রী ডেট এ যেতে রাজি হয়েছে, ৬% ছাত্রী সেই ছাত্রের সাথে এপার্টমেন্টে যেতে রাজি হয়েছে এবং ০% ছাত্রী সেক্সে রাজি হয়েছে। শুধু তাই নয়, বহু ছাত্রী প্রথমেই এভাবে সেক্সের আবেদন হাজির করাকে ‘ইনসাল্ট’ বা অপমান হিসেবে নিয়েছে।
কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে ফলাফল পাওয়া গেছে ভিন্ন রকমের। কোনো মেয়ে যদি কোনো ছাত্রের কাছে গিয়ে ঠিক উপরের প্রশ্নগুলো করে, তবে দেখা গেছে, ৫০% ছেলে প্রথমেই ডেটে রাজি হয়েছে, ৬৯% সেই ছাত্রীর সাথে এপার্টমেন্টে যেতে রাজি হয়েছে, আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে ৭৫% ছাত্র প্রথমেই ছাত্রীর সাথে যৌনকর্মে সম্মতি দিয়েছে।
ছেলে মেয়েদের যৌন-অভিলাসের পার্থক্যসূচক এই প্রবণতার প্রভাব পড়েছে আজকের দিনের বাণিজ্যে এবং পণ্য-দ্রব্যে। এমনি একটি দ্রব্য হচ্ছে ‘পর্নোগ্রাফি’ অন্যটি হলো ‘রোমান্স নভেল’। পর্নোগ্রাফির মূল ক্রেতা নিঃসন্দেহে পুরুষ। পুরুষদের উদ্গ্র এবং নির্বিচারী সেক্স ক্রেজের চাহিদা পূর্ণ করতে বাজার আর ইন্টার্নেট সয়লাব হয়ে আছে সফট পর্ন, হার্ড পর্ন, থ্রি সাম, গ্রুপ সেক্সসহ হাজার ধরনের বারোয়ারি জিনিসপত্রে। এগুলো পুরুষেরাই কিনে, পুরুষেরাই দেখে। মেয়েরা সে তুলনায় কম। কারণ, মেশিনের মতো হার্ডকোর পর্ন পুরুষদের তৃপ্তি দিলেও মেয়েদের মানসিক চাহিদাকে তেমন পূর্ণ করতে পারে না। সমীক্ষায় দেখা গেছে নারীর নগ্ন দেহ দেখে পুরুষেরা যেমন সহজেই আমোদিত হয়, মেয়েরা তেমনি হয় না। কারণ মেয়েদের অবারিত সেক্স জাগ্রত করতে দরকার অবারিত ইমোশন!
আর মেয়েদের এই ‘অবারিত ইমোশন’ তৈরি করতে বাজারে আছে ‘রোমান্স নভেল’। এই রোমান্টিক নভেলের মূল ক্রেতাই নারী। দেদারসে প্রেম-পিরিতি-বিচ্ছেদের পসরা সাজিয়ে শ’য়ে শ’য়ে বই সাড়া দুনিয়া জুড়ে বের করা হয়, আর সেগুলো দেদারসে বিক্রি হতে থাকে সাড়া বছর জুড়ে, মূলত মেয়েদের হাত দিয়ে। বাংলাদেশে যেমন আছে ইমদাদুল হক মিলন, তেমনি আমেরিকায় সুসান এলিজাবেদ ফিলিপ্স, ভারতে তেমনি সুবোধ ঘোষ কিংবা নীহাররঞ্জন গুপ্ত । প্রেম কত প্রকার ও কী কী তা বুঝতে হলে এদের উপন্যাস ছাড়া গতি নেই।
আমি শুনেছি, রোমান্স নভেলের জন্য প্রকাশকেরা ইদানীংকালে বিশেষত ঊঠতি লেখকদের নাকি বলেই দেয় কীভাবে তার উপন্যাস ‘সাজাতে’ হবে, আর কী কী থাকতে হবে। একটু প্রেম, অনুরাগ, কমিটমেন্ট, মান-অভিমান, বিচ্ছেদ, ক্লাইম্যাক্স তারপর মিলন। আবেগের পশরা বেশি থাকতে হবে, সে তুলনায় সেক্সের বাসনা কম। বইয়ে নায়িকার সেক্সের সাথে আবার ইমোশন মিলিয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি। এভাবে প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে রোমান্স নভেলের ম্যানুফ্যাকচারিং। মেয়েরা দেদারসে কিনছে, আবেগে ভাসছে, হাসছে, কখনো বা চোখের পানি ফেলছে। আর বই উঠে যাচ্ছে বেস্ট সেলার তালিকায়।
আরও কিছু আনুষঙ্গিক মজার বিষয় আলোচনায় আনা যাক। পশ্চিমা বিশ্বে এক সময় ‘প্লেবয়’-এর পাশাপাশি একসময় ‘প্লে গার্ল’ এবং ‘ভিভা’ চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। চলেনি। মেয়েরা এ ধরনের পত্রিকা কেনেনি, বরং কিনেছে সমকামী পুরুষেরা ঢের বেশি। ছেলেদের প্রেম অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব যান্ত্রিক। পর্নোগ্রাফি সেজন্যই ছেলেদেরকেই বেশি আকর্ষণ করে। আরও একটি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ভায়াগ্রা পুরুষের জন্য কাজ করলেও মেয়েদের জন্য করে না। ভায়াগ্রা কাজ করে খুব সাধারণ একটি পদ্ধতিতে। পুরুষাঙ্গে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দিয়ে। ঠিক একই পদ্ধতিতে ক্লায়টোরিসে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দিয়ে মেয়েদের জন্য ‘পিঙ্ক ভায়াগ্রা’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, সফল হয়নি।
একটি বড় কারণ মেয়েদের প্রেম এত যান্ত্রিক নয়, তাদের প্রেম অনেক বর্ণময়, অনেক ধরনের আবেগের সুগ্রন্থিত মিশ্রণ। তাই ছেলেদের ভায়াগ্রার মতো মেয়েদের জন্য ভায়াগ্রা তৈরি করতে গিয়ে বড় বড় কারখানাগুলো চুল ছিঁড়ে ফেলছে কিন্তু পণ্ডশ্রমই সার হয়েছে, সফলতা আসেনি। এদিকে ছেলেরা শুধু কেন বল খেলবে আর মেয়েরা পুতুল এই শিকল ভাঙার অভিপ্রায়ে ভিন্ন ধরনের খেলনা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল চলেনি। কারণ কী?
কারণ হচ্ছে, আমরা যত আড়াল করার চেষ্টাই করি না কেন, ছেলেমেয়েদের মানসিকতায় পার্থক্য আছে আর সেটা দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় ছাপ থাকার কারণেই। এই ব্যাপারটিই প্রকাশিত হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্টে এক মায়ের আর্তিতে। সেই মা পত্রিকায় (নভেম্বর ২, ১৯৯২) তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন —
আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনার পত্রিকার বিজ্ঞ পাঠকেরা কী বলতে পারবেন কেন একই রকমভাবে বড় করা সত্ত্বেও যতই সময় গড়াচ্ছে আমার দুই জমজ বাচ্চাদের মধ্যকার নারী-পুরুষজনিত পার্থক্যগুলো প্রকট হয়ে উঠছে? কার্পেটের উপর যখন তাদের খেলনাগুলো একসাথে মিলিয়ে মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখা হয়, তখন দেখা যায় ছেলেটা ঠিকই ট্রাক বা বাস হাতে তুলে নিচ্ছে, আর মেয়েটা পুতুল বা টেডি বিয়ার।
শুধু মানব শিশু নয়, মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি ‘ভার্ভেট মাঙ্কি’ নিয়ে গবেষণা করেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তাদের হাতে যদি খেলনা তুলে দেয়া হয়, ছেলে বানরেরা ট্রাক বাস গাড়ি ঘোড়া নিয়ে বেশি সময় কাটায় আর মেয়ে বানরেরা পুতুল কোলে নিয়ে। মানবসমাজে দেখা গেছে খুব অল্প বয়সেই ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে খেলনা নিয়ে এক ধরনের পছন্দ তৈরি হয়ে যায়, বাবা-মা’রা সেটা চাপিয়ে দিক বা না দিক। দোকানে নিয়ে গেলে ছেলেরা খেলনা-গাড়ি কিংবা বলের দিকে হাত বাড়াতে শুরু করে, আর মেয়েরা পুতুলের প্রতি। এই মানসিকতার পার্থক্যজনিত প্রভাব পড়েছে খেলনার প্রযুক্তি, বাজার এবং বিপণনে। যে কেউ টয়সেরাসের মতো দোকানে গেলেই ছেলেমেয়েদের জন্য খেলনার হরেক রকম সম্ভার দেখতে পাবেন। কিন্তু খেলনাগুলো দেখলেই বোঝা যাবে এগুলো যেন দুই ভুবনের দুই বাসিন্দাদের চাহিদাকে মূল্য দিতে গিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে বানানো।

শুধু শিশু বয়সে নয়, পরিণত বয়সেও ছেলে মেয়েদের মধ্যকার মানসিকতার প্রভেদমুলক পার্থক্য বজায় থাকে পুরোমাত্রায়। পুরুষদের একটা বড় অংশ অর্থ, প্রতিপত্তি এবং যৌনতার প্রতি যেভাবে লালায়িত হয়, মেয়েরা গড়পড়তা সেরকম হয় না। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান ছেলে মেয়েদের এই মানসিক পার্থক্যকে খুব সহজেই ব্যাখ্যা করতে পারে । ডকিন্সের ‘সেলফিশ জিন’ তত্ত্ব সঠিক হলে, আমাদের দেহ জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে চাইবে ‘জিন সঞ্চালনে’।
পুরুষদের জন্য যেহেতু নয় মাস ধরে গর্ভধারণের ঝামেলা নেই, নেই অন্য আনুষঙ্গিক ঝামেলা মেয়েদের যেগুলো পোহাতে হয় গর্ভধারণের জন্য, সেহেতু তাদের মধ্যে একটা অংশ থাকেই যারা মনে করে যত বেশি জিন সঞ্চালন করা যাবে ততই বেশি থাকবে ভবিষ্যত প্রজন্ম বেঁচে থাকার সম্ভাবনা। তাই ইতিহাসে দেখা যাবে শক্তিশালী পুরুষেরা কিংবা গোত্রাধিপতিরা কিংবা রাজা বাদশাহরা হেরেম তৈরি করে সুন্দরী স্ত্রী আর উপপত্নী দিয়ে প্রাসাদ ভর্তি করে রাখত। পর্নোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ পুরুষদেরই বেশি থাকে কিংবা পতিতাপল্লীতে পুরুষেরাই যায় আদিম সেই উদগ্র ‘যৌনস্পৃহা’ মানসপটে রাজত্ব করার কারণেই।
ভালোবাসা কারে কয়
১৬৮.↑ B.J. Ellis, D. Symons (1990), “Sex Differences in Sexual Fantasy: an Evolutionary Psychological Approach”, Journal of Sex Research, Vol. 27 pp.527 – 555.
১৬৯.↑ David Buss, Human Mating Strategies. Samfundsokonomen, 4, 47-58, 2002.
১৭০.↑ Clark, R. D., III & Hatfield, E. (1989). Gender differences in receptivity to sexual offers. Journal of Psychology and Human Sexuality, 2, 39-55.