ফসিল রেকর্ডের আলােয় এবার আমাদের ইতিহাসটা ঝালিয়ে নেওয়া যাক
চলুন এবার চোখ ফেরানাে যাক বিবর্তনের সুদূর ইতিহাসের পাতায় – প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগের ইতিহাসে, যখন অন্যান্য বনমানুষ থেকে মানুষের বিবর্তনের পথ আলাদা হয়ে যেতে শুরু করেছিলাে। আগের অধ্যায়গুলােতেই দেখেছিলাম ফসিল রেকর্ডগুলাে কিভাবে জীবের বিবর্তনের ইতিহাসের পদচিহ্ন বহন করে চলেছে। ডঃ রিচার্ড ডকিন্স যেমন একদিকে বলেছেন যে, কোন ফসিল রেকর্ডগুলাে না থাকলেও আমরা শুধু জেনেটিক তথ্য থেকেই বিবর্তনের সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখতে পারতাম, ঠিক তেমনিভাবে এও বলেছেন যে, আমাদের হাতের সামনে আর কোন সাক্ষ্য না থেকে শুধুই যদি ফসিল রেকর্ডগুলাে থাকত তাহলেও আমরা একইভাবে চোখ বন্ধ করে বিবর্তনবাদের সঠিকতা প্রমাণ করতে পারতাম। এটা আসলে আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত দু’টো পথ এক সাথে খুঁজে পেয়েছি [১১]।
আসলে মানুষের বিবর্তনের গল্পটা পুরোপুরি বলতে গেলে আমাদের শুরু করতে হবে মানুষ নামক কোন প্রাণীর উদ্ভবেরও অনেক আগে – তাদের সেই আদি পুর্বপুরুষ বানর এবং পরবর্তী পূর্বপুরুষ বনমানুষদের বিবর্তনের ইতিহাস থেকে। এই দীর্ঘ ইতিহাসের বইটির অনেক হারিয়ে যাওয়া পৃষ্ঠার সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু গত একশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মানুষ এবং এপের মধ্যবর্তী স্তরের এমন অনেক ফসিল খুঁজে পেয়েছেন যা থেকে মানব বিবর্তনের একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া কিন্তু আর কোন কঠিন ব্যাপার নয়। ফসিল রেকর্ডের প্রসঙ্গে ঢােকার আগে পাঠকদেরকে একটা বিষয়ে আগে থেকেই সাবধান করে দিতে চাই।
এই বইটি লেখার সময় সবচেয়ে বড় ভাবনা ছিল কিভাবে কঠিন কঠিন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকথা না কপচিয়ে সহজ ভাষায় বিবর্তন সম্পর্কে লিখতে পারা যায়। কতটুকু সফল হয়েছি জানি না, সেই বিচারের ভার না হয় পাঠকদের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি, তবে এখানে এসে যে বিপদে পড়ে গেছি তা বেশ ভালােভাবে বুঝতে পারছি। ফসিল রেকর্ডের ধারাবাহিক বিবরণ দিতে গেলে সেই প্রতিজ্ঞাটি আর রাখা সম্ভব কিনা তা ঠিক বুঝতে পারছিনা। এখানে বারবারই ইতিহাসের সময়সীমা, প্রজাতিদের বৈজ্ঞানিক সব দুর্বোধ্য নাম, শ্রেনীবিন্যাস, গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের মত অত্যন্ত শুষ্ক এবং একঘেয়ে বিষয়গুলাে চলে আসবে। এগুলােকে বাদ দিয়ে, কিন্তু আবার ওদিকে বৈজ্ঞানিক সততাও বজায় রেখে সঠিকভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করা আসলে বেশ শক্ত একটা কাজ। আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করবাে সহজ সরল ভাষায় লিখতে, আশা করি উৎসাহী পাঠকেরা একটু কষ্ট করে হলেও ধৈর্য বজায় রাখতে সক্ষম হবেন।
এই বইয়ে মানুষ ,এপসহ প্রাইমেটদের জন্য যে শ্রেণীবিন্যাস ব্যবহার করা হয়েছেঃ
মানব প্রজাতিসহ সব বনমানুষই স্তন্যপায়ী প্রাণীর অন্তর্গত প্রাইমেট বর্গের মধ্যে পড়েছে। এই প্রাইমেটদের মধ্যে এখন পর্যন্ত জানা মতে দুই শ’রও বেশী প্রজাতি রয়েছে, এখনকার আধুনিক শ্রেনীবিন্যাস অনুযায়ী এদেরকে তিনটি উপবর্গে ভাগ করা হয়ঃ প্রােসিমিই (যার মধ্যে রয়েছে লেমুর, লরিস, বুশবেবি জাতীয় আদি প্রাইমেট); টারসিফরম (টারশিয়ারদের আগে প্রােসিমিইর মধ্যে ফেলা হলেও এখন তাদেরকে আলাদা উপবর্গে ফেলা হয়); এবং আনথ্রোপইডি (সব ধরণের বানর, বনমানুষ এবং মানুষ)। আনথ্রোপইডি জাতীয় প্রাইমেটদেরকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছেঃ
১। নতুন দুনিয়ার বানর (New World Monkeys বা Platyrrhini)
২। পুরানাে দুনিয়ার বানর (Old World Monkeys বা Catarrhini )
হাউলার বা স্পাইডার বানর জাতীয় নতুন দুনিয়ার বানররা লেজ দিয়ে গাছে ঝুলে থাকতে পারে; আর ওদিকে ম্যাকাকু, বেবুন এবং হােমিনয়ডিয়া জাতীয় পুরানাে দুনিয়ার বানররা লেজ দিয়ে গাছে ঝুলে থাকতে পারে না। আগে বিজ্ঞানীরা হােমিনিড গ্রুপের মধ্যে শুধু আধুনিক মানুষ এবং তাদের দ্বিপদী পুর্বপুরুষদের ফেলতেন, আর গরিলা, শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য বনমানুষদের এক সাথে করে অন্য গ্রুপে ফেলা হত। কিন্তু আধুনিক জেনেটিক পরীক্ষা থেকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে, শিমাঞ্জিরা জেনেটিকভাবে গরিলা বা অন্যান্য বনমানুষের চেয়ে মানুষের অনেক কাছের প্রজাতি। তাদেরকে গরিলা বা ওরাং ওটাংদের সাথে এক করে শ্রেণীবিন্যাস করার কোন মানে হয় না।
এখানে আমি আজকালকার বেশীরভাগ আধুনিক প্যালেও-অ্যানথ্রোপলজীর বইয়ে ব্যবহৃত শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতিই ব্যবহার করবাে। এখানে মানুষসহ সব বনমানুষদের প্রথমে হােমিনয়ডিয়া (বা এপ) সুপার ফ্যামিলি বা অধি-গােত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, তারপর গিবনদেরকে আলাদা করে দিয়ে বাকিদেরকে ফেলা হয়েছে হােমিনিডি গােত্রে। এই গােত্রে রয়েছে তিনটি উপ-গােত্রঃ
ক) ওরাং ওটাং, খ) গরিলা এবং গ) শিম্পাঞ্জি ও মানুষ
মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির উপগােত্রকে বলা হয় হােমিনিনি। আমি এই বইয়ে সাধারণভাবে মানুষসহ হােমিনিডিয়া ফ্যামিলির সব বনমানুষ বা এপকে বনমানুষ’ বলে অভিহিত করেছি[৮] :

আদি পুর্বপুরুষ প্রাইমেটদের বিবর্তনঃ
আমরা আগের অধ্যায়ে দেখেছিলাম যে, প্রায় ২০ কোটি বছর আগে সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী জীবের বিবর্তন ঘটেছিল বটে, তবে সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পর্যন্ত তাদের তেমন কোন বিশেষ বিকাশ বা বিস্তৃতি দেখা যায়নি। তার পরের প্রায় ১০ কোটি বছর ধরে বিভিন্ন ধরণের ‘সরীসৃপ জাতীয় স্তন্যপায়ী’ বা ‘স্তন্যপায়ী জাতীয় সরীসৃপ প্রাণীর অর্থাৎ বিভিন্ন ধরণের মধ্যবর্তী ফসিলের সন্ধান পাওয়া যায়। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ডায়নােসররা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ারও বেশ পরে ইওসিন যুগে আদি প্রাইমেটদের বিবর্তন ঘটে।
সেই সময়েই পৃথিবীর জলবায়ু আবারও গরম হয়ে উঠতে শুরু করে, গ্রীষ্মমন্ডলীয় আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। অনেকেই মনে করেন এই গরম আবহাওয়া অরন্যচারী প্রাইমেটদের বিকাশে সহায়তা করেছিল। আদি প্রাইমেটদের বেশ কয়েকটি প্রজাতি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে (অষ্ট্রেলিয়া এবং আন্টার্কটিকা মহাদেশ দু’টো বাদ দিয়ে) দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এই যুগেই আ্যডাপিডি (family: Adapidae) এবং টারসিফরম (Tarsiiformes) জাতীয় প্রাণীর অনেক ফসিল পাওয়া গেছে যাদের মধ্যে প্রাইমেটদের মােটামুটি সব বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান ছিল[৮]।
প্রাইমেটদের কারা?
প্রাইমেটদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলাে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের চেয়ে বেশ অগ্রসর ধরণের[৬]। তাদের মধ্যে গাছে বসবাস করার জন্য ব্যয়জনীয় অভিযােজন ক্ষমতাটি এখানে উল্লেখযােগ্য তাদের হাত পা গাছে গাছে চলেফিরে বেড়াবার জন্য অত্যন্ত উপযােগী, আঙ্গুলগুলাে কমবেশী নাড়াতেও পারে, বুড়াে আঙ্গুলকে অন্যান্য আঙ্গুলের বিপরীতে নিতে পারে, নখরের পরিবর্তে বিকাশ ঘটেছে নখের এবং সেই সাথে রয়েছে সংবেদনশীল হাতের তালু। তারা পা ,হাত এবং আঙ্গুল দিয়ে যেমন গাছের ডাল আঁকড়ে ধরতে পারে, তেমনি আবার হাত দিয়ে যে কোন জিনিষ বা খাদ্য মুখেও তুলতে পারে, বাহু ঘুরাতে পারে।
চলাফেরার সময় পিছনের পা প্রধান ভুমিকা পালন করে যার ফলে দেখা যায় তাদের অনেকেই অর্ধ-খাড়া বা প্রায় খাড়া হয়ে দাঁড়াবার (এদের মধ্যে শুধু মানুষই পুরােপুরিভাবে দ্বিপদী) ক্ষমতা অর্জন করেছে। তাদের চোখ দুটো আপেক্ষাকৃতভাবে কাছাকাছি, দেখার সময় দর্শন ক্ষেত্রের অধিক্রমণ (Overlap) করতে পারে বলে তাদের দৃষ্টিশক্তি ত্রিমাত্রিক, যা দিয়ে তারা খাদ্য এবং গাছের ডালপালার মধ্যে ব্যবধাণ খুব ভালােভাবে নির্ণয় করতে পারে। প্রাইমেটদের মধ্যে সবধরণের খাবারের উপযােগী দাঁত এবং পরিপাকযন্ত্র বিকাশ লাভ করে। তাদের দেহের আকারের তুলনায় মস্তিষ্কের আকার অনেক বড় এবং জটিল, এবং তারা বেশ জটিল সামাজিক জীবন যাপন করতে সক্ষম[৬]।
এপ বা বনমানুষদের বিবর্তনঃ
প্রায় ৪ কোটি বছর আগে, ইওসিন যুগের শেষ দিকে, আবার বেশ ঠান্ডা পড়তে শুরু করে, ক্রমশঃ জঙ্গলের বিস্তৃতি কমে যেতে থাকে। সেই সাথে সাথে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের, বিশেষ করে প্রাইমেটদের, বিবর্তনের ধারায়ও পরিবর্তন দেখা দেয়। ফসিল রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে, এ সময় তাদের বেশীর ভাগ প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে ওদিকে প্রায় সাড়ে তিন কোটি বছর আগে মিশরসহ উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েক ধরণের আদি আনথ্রোপয়েড জাতীয় প্রাইমেটের বিস্তৃতি ঘটতে দেখা যায়। ফসিল রেকর্ডে বিভিন্ন প্রজাতির বানর এবং বনমানুষ উভয়ের অস্তিত্ব দেখে মনে হয় যে, ইতােমধ্যেই বনমানুষের বিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে।
আসলে এই সময়ে এত ধরণের বানর, বনমানুষ এবং না বানর এবং না বনমানুষের মধ্যবর্তী ফসিল পাওয়া গেছে যে বিজ্ঞানীরা কাকে বানর বলবেন আর কাকে বনমানুষের জাতে ফেলবেন তা নিয়ে রীতিমত সংশয়ে পড়ে যান। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে, অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মত আদি প্রাইমেটদেরও লেজ ছিল, বনমানুষের পূর্বপুরুষদের মধ্যেই প্রথম লেজের বিলুপ্তি ঘটে। এ সময়েই বােধ হয় তাদের খাদ্যাভ্যাসেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, তাদের বেশীরভাগই গাছের পাতা খাওয়া ছেড়ে ফলমুল খাওয়ার অভ্যাসে অভিযােজিত হয়ে যায়[৮]।
বনমানুষ বা এপ কারা?
বনমানুষেরা প্রাইমেট বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী। হােমিনয়ডিয়া বা মানুষসহ সব ব্রণের বনমানুষের মধ্যে দু’টো বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছেঃ এই অধিগােত্রের অন্তর্ভুক্ত কোন প্রাণীর মধ্যেই আর লেজ দেখতে পাওয়া যায় না এবং তাদের হাতের কনুই এর জয়েন্টে বিশেষ এক ধরণের গঠন বিকাশ লাভ করেছে। এই অংশটির বিশেষ গঠনের কারণেই আমরা এত সহজে হাত বাঁকাতে বা নােয়াতে পারি, হাতের উপর ভর করে ঝুলে থাকতে পারি। এই ধরণের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলাের উপর নির্ভর করেই বিজ্ঞানীরা অন্যান্য প্রাইমেটদের ফসিল থেকে বনমানুষের পূর্বপুরুষের ফসিলের পার্থক্য নির্ধারণ করেন।
আফ্রিকায় বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েক প্রজাতির ‘না বানর না বনমানুষ’ জাতীয় প্রােকনসুলের (Proconsul) প্রজাতির ফসিল পাওয়া গেছে। এরা গাছে গাছে থাকতাে, বানরের মত এদের নমনীয় মেরুদন্ড এবং সংকীর্ন বুকের গড়ণ থাকলেও নাড়াচাড়ার দিক থেকে তাদের বুড়াে আঙ্গুল এবং কোমড় বনমানুষদের মতই ছিল[১০]। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, এরাই হােমিনয়ডিয়া বা সব বনমানুষদের পূর্বপুরুষ।

এ সময়ের দিকেই বেশ কিছু মজার ব্যাপার ঘটতে শুরু করে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে আমরা মহাদেশীয় সঞ্চরণের কথা শুনেছি, এও দেখেছি যে এর সাথে প্রাণের বিবর্তনের প্যাটার্নের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আগে আফ্রিকা ইউরেশিয়া থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন ছিল কিন্তু ১.৭ কোটি বছর আগে প্রথম আফ্রিকা মহাদেশের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের একটা সংকীর্ণ সংযােগ স্থাপিত হয়। তারপর ধীরে ধীরে ভুমি সংযাগটা বেশ প্রশস্থ হলে প্রথমবারের মত পূর্ব এবং মধ্য ইউরােপে আফ্রিকা থেকে ইঁদুর, এ্যন্টিলােপ এবং প্রাইমেটসহ বিভিন্ন প্রাণীর আগমন ঘটতে শুরু করে। জার্মানী, টারকী, চেক প্রজাতন্ত্রের মত বিভিন্ন দেশে এ সময়েই প্রথম বনমানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়[৮]।

বিভিন্ন ফসিল রেকর্ড থেকে দেখা যায় যে, সেই ১.৯ কোটি বছর আগে প্রােকনসুল জাতীয় বনমানুষের সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে গিবনদের উৎপত্তি ঘটে। কিন্তু ওরাং ওটাংদের বিবর্তন ঘটে বেশ পরের দিকে, ১.৬ কোটি বছর আগে Sivapithekas জাতীয় বনমানুষের প্রজাতি থেকে। এদের ফসিলের গঠন থেকে বােঝা যায় যে এরা বেশ কিছুটা সময় মাটিতে কাটাতাে, হাত পায়ের হাড়ের গড়নে মাটিতে অভিযােজনেরও সাক্ষ্য পাওয়া যায়। Sivapithecus এর আগের বনমানুষদের মধ্যে বানরের অনেক বৈশিষ্ট্যের মিশাল পাওয়া যায়, কিন্তু এর উত্তরসুরীদের মধ্যে তা ক্রমশঃ কমে আসতে থাকে এবং এরাই যে হমিনয়ড লাইনেরই পূর্বসুরী তাতে কোন সন্দেহ নেই[৮]।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ১.৪-১.২ কোটি বছর আগের Ouranopithecus কিংবা Dryopithecus জাতীয় কোন বনমানুষরাই হমিনয়ডিয়া সুপার ফ্যমিলির পূর্বপুরুষ। এদের কোন এক প্রজাতি থেকেই প্রায় ৯০ লক্ষ বছর আগে গরিলাদের বিবর্তন ঘটে। আর তারও বেশ পরে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জি এবং মানুষ তাদের সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে নিজ নিজ পথে বিবর্তিত হতে শুরু করে। আর এখান থেকেই শুরু হয় আমাদের পূর্বপুরুষদের নিজস্ব যাত্রা, দীর্ঘ আকাবাঁকা বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজকের মানুষে বিবর্তিত হওয়ার সেই মহাযাত্রা।
এ তাে গেল আমাদের সেই আদিতম পুর্বপুরুষের কাহিনী, এখন আমরা প্রায় মানুষের আদি পুর্বপুরুষদের বিবর্তনের ইতিহাসের পাতায় এসে পড়েছি, সেই গল্পে ঢােকার আগে আমাদের নিকটতম আত্মীয় শিম্পাঞ্জিদের নিয়ে একটা সাধারণ ভুল ধারণা সম্পর্কে দু’একটা কথা বলে নিলে বােধ হয় খারাপ হয় না। আমরা প্রায়ই অনেককে বলতে শুনি যে, শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে, ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক সেরকম নয়।
প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের পুর্বপুরুষেরা এক ছিল, তারপর তাদের সেই সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে দুটো ভিন্ন প্রজাতির উদ্ভব ঘটে – এরই এক ধারা থেকে ঘটে মানুষের বিবর্তন আর অন্য ধারা থেকে উদ্ভব ঘটেছে শিম্পাঞ্জীদের। শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের সম্পর্কটা আসলে অনেকটা খালাতো ভাইবােনের মত, নানা নানি এক হলেও আমরা সরাসরি কেউ কারও পুর্বপুরুষ নই।
বিবর্তনীয় সম্পর্কের হিসেবে অংক কষলে দেখা যাবে যে, আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জির সম্পর্কটা সবচেয়ে কাছের, তারপরে আমাদের নিকট আত্মীয় হচ্ছে গরিলা। আর ওরাং ওটাংরা যেহেতু গরিলাদেরও আগে আমাদের সবার সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল, তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কটাও আরেকটু দুরের। আগেই দেখেছিলাম যে জেনেটিক দিক থেকে আমাদের সাথে শিম্পাজির মিল প্রায় ৯৯%, চিত্র ৯.১↑ এ শিম্পাঞ্জিসহ আমাদের অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের মধ্যে জেনেটিক পার্থক্যের তুলনাগুলাে দেখানাে হয়েছে।
বিবর্তনের পথ ধরে
৬.↑ আখতারুজ্জামান, ম, ২০০৪, বিবর্তনবিদ্যা, হাসা বুক হাউজ, ঢাকা, পৃষ্ঠাঃ ২৭৭-৩৭৫ ।
৮.↑ Stringer, C and Andrews, P, 2005, The complete Wrold of Human Evolution, Thames and Hudson Ltd, London
১০.↑ The Human Origins Progam Resource Guide to Paleoanthropology, Smithsonian National Museum of Natural History http://www.mnh.si.edu/anthro/humanorigins/faq/encarta/encarta.html
(লিংকটি পাওয়া যায় নি, তবে রিলেটেড তথ্যটি পড়তে পারেন এখানে↑ )
১১.↑ Dawkins R, 2004, The Ancestor’s Tale, 2004. Houghton Mifflin Company, Boston, New York.