বিবর্তনের পথ ধরে

বন্যা আহমেদ

০৩. তিমি মাছের উলটো পথে যাত্রা

তিমি মাছের উলটো পথে যাত্রা

বিবর্তনের কিছু কাহিনী যদি বিজ্ঞানীদের ভীষণভাবে অবাক করে থাকে তাহলে তিমি মাছের বিবর্তনের গল্পই বােধ হয় সেই তালিকার সবচেয়ে উপরে স্থান পাবে। এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু বিচলিত হয়ে ডারউইন যখন বলেছিলেন যে, ভালুকের মত কোন প্রাণী থেকে তিমি মাছের বিবর্তন ঘটে থাকলেও তিনি মােটেও আবাক হবেন না, তখন অনেকেই হেসেছিলেন। ব্যাপারটা একটু গােলমেলে তাে বটেই! সমুদ্রে বসবাস তাদের, মাছের মতই সাঁতরে বেড়ায় তারা, কিন্তু মেরুদন্ড থেকে শুরু করে পুরাে শরীরের গঠনটায় আবার স্তন্যপায়ী প্রাণীর মত।

সামনের হাতদুটো সাতারে কাজে লাগে, পিছনে কোন পা দেখা না থাকলেও শরীরের ভিতরে পেলভিসের বা বস্তিদেশের অবশিষ্টাংশ এখনও দিব্যি বয়ে বেড়াচ্ছে সে। ডারউইনের কথা না হয় বাদই দিলাম, প্রায় দেড়শাে বছর পর আধুনিক অণুজীববিদ্যা এবং ফসিলবিদ্যার আবিষ্কার থেকে যখন আমরা জানতে পারি যে আসলে প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর আগে জলহস্তির পূর্বপুরুষের মত একধরণের স্তন্যপায়ী চতুষ্পদী ডাঙ্গার প্রাণী থেকে আজকে তিমি মাছের

বিবর্তন ঘটেছে তখন রিচার্ড ডকিনসের মত বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীর পক্ষেও আঁতকে না উঠে উপায় থাকে না। তিনি ২০০৪ সালে লেখা The Ancestor’s Tale বইতে লিখেছেন [৯]

I have now learned something so shocking that I am still reluctant to believe it, but it looks as though I am going to have to. Hippo’s closest living relatives are whales…. Whales are wonders of the world. They include the largest organisms that have ever moved…. All this supposes that we believe the testimony of the molecules. What do fossils say? To my initial surprise, the new theory fits quite nicely.

তিমি এবং ডলফিনদেরকে বলা হয় সিটাসিন (Cetacean), এরা স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়ে পানিতে অভিযােজিত হয়েছে। বিবর্তনের হিসেবে বংশ পরিচয় বিচার করলে যে কোন মাছের তুলনায় জলহস্তি, উট, গরু বা ভেড়ার সাথে তিমি মাছের আত্মীয়তা অনেক কাছের। আধুনিক অনুজীববিদ্যার জিনােমিক টেষ্টের ফলাফল অনুযায়ী তাে তারা জলহস্তিদের খালাতাে ভাই বলেই মনে হচ্ছে।

চিত্র ৮.১০: এলােমেরিক্স (ElomoryX), পাকিসিটাস (Pakicetus) তুলনামুলক চিত্র
চিত্র ৮.১০: এলােমেরিক্স (ElomoryX), পাকিসিটাস (Pakicetus) তুলনামুলক চিত্র

ওদিকে আবার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডঃ ফিলিপ গিংরিচ এবং তার সহযােগীরা গত ৩০ বছরের গবেষণার ফলাফল হিসেবে যেসব ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন তাও এই জেনেটিক টেষ্টের সাথে যেন হুবহু মিলে যাচ্ছে [১১]। ইওসিন যুগে (সাড়ে ৫ কোটি বছর আগে থেকে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি বছর আগে পর্যন্ত) তিমি মাছের পুর্বপুরুষের বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের বহু ফসিল আবিষ্কার করেছেন তারা পাকিস্তান এবং মিশরে। বেশ অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীরা খুরবিশিষ্ট বিলুপ্ত প্রাণী এলােমেরিক্স (Elomoryx) কে সিটাসিনের পূর্বপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ৭০ দশকের শেষের দিকে ডঃ গিংরিচ পাকিস্তানে তিমি মাছের সবচেয়ে পুরনাে যে ফসিল পার্কিসিটাসের (Pakicetus, ৫.৩ কোটি থেকে ৪.৮ কোটি বছর আগের) সন্ধান পান, তার সাথে এলােমেরিক্সের তেমন বেশী কোন পার্থক্য দেখা যায় না। তার চেয়ে বয়সে একটু ছােট আ্যম্বুলােসিটাস (Ambulocetus, ৪.৮ কোটি থেকে ৪.৭ কোটি বছর আগের) তাদের দৈর্ঘ্যও বাড়তে শুরু করে।

The-Extraction-of-the-Extended-Phenotype
চিত্র ৮.১১: স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে তিমি মাছের বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপের চিত্র

তারপরের স্তরের রােডসিটাসে (Rodhocetus, ৪.৯ কোটি থেকে ৩.৯ কোটি বছর আগের) এর ফসিলের গঠন থেকে দেখা যায় যে তারা ইতােমধ্যেই উপকূলবর্তী অল্প পানির জীবনে অভিযােজিত হয়ে গেছে। এখান থেকেই ক্রমান্বয়ে কোটি বছর আগের) মেরুদন্ড এবং দাঁতের বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আর তার সাথে আরেকটি লক্ষণীয় জিনিষ চোখে পড়ে যে, তাদের নাকের ছিদ্র ক্রমশঃ পিঠের পিছনের দিকে সরে যেতে শুরু করেছে। এখনও খুরের অবশিষ্টাংশ রয়ে গেলেও পিছনের পাগুলাে যেন মাটির উপরে তাদের ভার বহন করার জন্য অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। এর পরের পর্যায়ের ফসিল ৩.৫ কোটি বছর আগের ডরুডনের (Dorudon) মধ্যে পানিতে সম্পূর্ণভাবে অভিযােজনের নমুনা দেখতে পাই।

dorudon
চিত্র ৮.১২ :ডঃ গিংরিচের দল তিমি মাছের পূর্বপুরুষ ডরুডনের প্রায় সম্পূর্ন এই ফসিলটি আবিষ্কার করেন। মিশরের ওয়াডি হিটানে পাওয়া এই ফসিলটি প্রায় ৫ মিটার লম্বা।

নাকের ছিদ্র আরও পিছিয়ে গেছে, সামনের পা ফ্লিপারের মত আকার ধারণ করছে, পিছনের পা এবং বস্তিদেশ আর অকেজো হয়ে পড়েছে, বস্তিদেশটি আলাদা হয়ে পড়েছে। মেরুদন্ড থেকে। তাদের সাথে আধুনিক তিমি মাছের (Phocona) পার্থক্য খুব সামন্যই [৩]। তিমি মাছের এই বিবর্তনকে অনেক বিজ্ঞানী ইওসিন এবং ওলগােসিন যুগের ব্যাপক জলবায়ু এবং মহাসমুদ্রগুলাের পানির গতির পরিবর্তনের সাথে জড়িত বলে মনে করেন।

লুসি হচ্ছে মানুষ আর এপের মধ্যে মিসিং লিঙ্ক

এর আগের আরও কিছু ফসিল পাওয়া গেলেও ‘লুসি’কেই এখনও অনেক বিজ্ঞানী আধুনিক মানুষ (Homo sapiens) এবং এপ বা বনমানুষের মধ্যবর্তী ফসিল বা মিসিং লিঙ্ক বলে মনে করেন। ১৯৭৮ সালে তানজেনিয়ায় পাওয়া, প্রায় ৩২ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর বুকে বিচরণ করে বেড়ানাে Australopithecus afarensis প্রজাতির এক মহিলার, ফসিলকেই ‘লুসি’ নাম দেওয়া হয় [১৪]। লুসির প্রায়-সম্পূর্ণ ফসিল, মস্তিষ্কের খুলি, পাঁজরের হাড় এমনকি সেই সময়ের পাওয়া পায়ের ছাপের ফসিল থেকে এটা খুব পরিষ্কারভাবে বােঝা যে, তারা ইতােমধ্যেই সােজা হয়ে হাটতে শিখেছিলাে। কিন্তু তাদের মস্তিষ্ক, চোয়াল এবং শরীরের আকার তখনও কিন্তু তাদের পূর্বপুরুষের মতই রয়ে গিয়েছিলাে। সেজন্যই অনেকে তাদের গলার উপরে বনমানুষের মত আর গলার নীচে মানুষের মত একধরনের মাঝামাঝি মানুষ’ বলে অভিহিত করেন। সে যাই হােক, এ আলােচনা আপাতত তােলা থাক, এর পরের অধ্যায়ে আমাদের নিজেদের প্রজাতি অর্থাৎ আধুনিক মানুষের বিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করার ইচ্ছা রইলাে।

ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তনের তত্ত্ব বলে, খুব ধীরে ধীরে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই জীবের পরিবর্তন ঘটে। কোন প্রজাতি যখন তার মূল প্রজাতি থেকে কোন কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে | যায়, তখন এই প্রক্রিয়া আরও তরান্বিত হতে পারে কারণ এই বিচ্ছিন্ন অংশের মধ্যে বিবর্তন ঘটতে থাকে তাদের নিজস্ব গতিতে। যদিও স্টিফেন জে গুলডের মত কয়েকজন বিখ্যাত ফসিলবিদ বিবর্তনের গতিতে হঠাৎ হঠাৎ উল্লম্ফন বা বড় ধরনের কোন পরিবর্তন (Punctuated Equilibrium theory) ঘটে যেতে পারে মনে করেন, বেশীর ভাগ জীববিদই কিন্তু ডারউইনের এই ধীর এবং ধারাবাহিক বিবর্তনের প্রক্রিয়াকেই সমর্থন করেন [১২]

ডারউইনও বুঝেছিলেন যে, কোন কোন সময় খুব আকস্মিক বা দ্রুত প্রাকৃতিক পরিবর্তন এই বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে দিতে পারে, তবে তা কোন মতেই দুই একশাে বছরের ব্যাপার নয়। সাধারণ অবস্থায় যা ঘটতে লাগে লাখ লাখ বা কোটি কোটি বছর তা হয়তাে ঘটে কয়েক হাজার বছরে। এর কোন বাঁধা ধরা নিয়ম নেই, চার পাশের পরিবেশ, মিউটেশনের হার, ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা, আকস্মিকভাবে ঘটা কোন প্রাকৃতিক পরিবর্তন বা বিপর্যয়, প্রজাতির নিজস্ব জনন বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সহ বহু কারণেই এর রকম ফের ঘটতে পারে। তবে কোন ভালাে জীববিদই, এমনকি উল্লম্ফন মতবাদের প্রবর্তক বিজ্ঞানীরাও, মনে করেন না যে, এই পরিবর্তন এক বা দুই প্রজন্মে ঘটতে পারে।

আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে আধুনিক ঘােড়ার বিবর্তনের যে স্তরগুলাে দেখেছিলাম ফসিল রেকর্ডগুলাে বলে তাও এভাবেই ঘটেছিলাে। তাদের বিভিন্ন ধরণের প্রজাতির মধ্যে একেকটা অবস্থা বা দশা বহুদিন ধরে বিরাজ করেছে, খুব অল্প অল্প করে হয়তাে নগন্য কিছু পরিবর্তন ঘটেছে কয়েক লক্ষ এমনকি কোটি বছরে, তারপর হঠাৎ করেই কয়েক হাজার বছরে অত্যন্ত দ্রুত কিছু বড় বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে।

ভূতাত্ত্বিক সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তাদেরকে খুব দ্রুত বলে মনে হলেও আসলে তাে আমাদের হিসেবে হাজার হাজার বছর পেরিয়ে গেছে, কোন পরিবর্তনই হঠাৎ করে রাতারাতি ঘটেনি। অনেক সময়ই ফসিল রেকর্ডে আমরা এই ধারাবাহিক পরিবর্তনের সব ধাপগুলাে দেখতে পাই না। তার কারণ এই নয় যে, হঠাৎ করে আকাশ ছুঁড়ে তাদের সৃষ্টি হয়েছে বা রাতারাতি তাদের বিবর্তন ঘটে গেছে। বরং বােধগম্য কারণেই আমরা তা দেখতে পাচ্ছি না [১৩]

আমরা ফসিল নিয়ে আলােচনার সময়ই দেখেছি যে, যত জীব এই পৃথিবীর বুকে চড়ে বেড়িয়েছে তাদের এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশই শুধু ফসিলে পরিণত হয়েছে। তাই বেশীর ভাগ জীবের ফসিলই আমরা হয়তাে কোনোদিনও খুঁজে পাবাে না, অথবা তিমি বা পা-ওয়ালা মাছ বা উড়ন্ত ডায়নােসরের মত দুই একটা মিসিং লিঙ্ক পেয়েও যাবাে হঠাৎ করে, যারা কিনা হঠাৎ করেই বিবর্তনবাদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের মাত্রার উল্লম্ফন ঘটিয়ে দেবে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে।


 বিবর্তনের পথ ধরে


৩.↑  Futuyma, Douglus (2005), Evolution, pg.74-78 Sinauer Associates, INC, MA, USA

৯.↑  Dawkins R, 2004, The Ancester’s tale, Houghton Miffin Company, NY, Boston: USA, pp 196-202

১১.↑ Research on the Origin and Early Evolution of Whales (Cetacea) ↑

১২.↑  Berra TM, 1990, Evolution and the Myth of Creationism, Stanford University Press, Stanford, California, pp 47-48.

১৩.↑  Mayr E, 2001, What Evolution Is, Basic Books, USA, pp 13-19.

১৪.↑  Prominent Hominid Fossils ↑

 

শেয়ার করুন —
0 0 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top
১ম অধ্যায়

২য় অধ্যায়

৩য় অধ্যায়

৪র্থ অধ্যায়

৫ম অধ্যায়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

৭ম অধ্যায়

৮ম অধ্যায়

৯ম অধ্যায়

১০ম অধ্যায়

১১ম অধ্যায়

পরিশিষ্ট
রঙ্গীন প্লেট

বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো

গ্রন্থ আলোচনা