গাণিতিকভাবে গেম থিওরির ব্যুৎপত্তি না ঘটলেও এই ধরনের স্ট্র্যাটিজিক সমস্যাগুলো প্রাচীনকালে দার্শনিক আর রাজনীতিবিদদেরও আকৃষ্ট করেছিল পুরোমাত্রায়। প্রাচীন কালে রাজা বাদশাহরা নিজেদের সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে নানা ধরনের ‘গেম প্ল্যান’ করতেন। কখন কোন রাজার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে, কখন পাশের রাজ্য আক্রমণ করতে হবে, আর কখন বা আবার আক্রমণ ভুলে দেশ রক্ষায় মনোনিবেশ করতে হবে এগুলো নিয়ে তারা চিন্তিত থাকতেন অহর্নিশি। যারা এ ব্যাপারে ভালো কূটবুদ্ধি দিয়ে রাজাদের সাহায্য করতে পারতেন, তাদেরকে রাজসভায় আপ্যায়ন করে নিয়োগ দেয়া হতো।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কথা আমরা সবাই জানি কূটবুদ্ধির জাল বুনে কীভাবে রাজাকে সহায়তা করা যায় তার শক্তিশালী দলিল এটি। রাজনীতি আর অর্থনীতির নানা প্যাঁচঘোচ খুঁজে প্রজাদের রোষ থেকে রাজার গদি রক্ষার তল্পিবাহক হিসেবে কৌটিল্যকে এখন অভিযুক্ত করা হলেও কৌটিল্যই সম্ভবত ছিলেন মানবেতিহাসের প্রথম অর্থনীতিবিদ যিনি গেম থিওরির মতো স্ট্র্যাটিজিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতির বিদ্যমান সমস্যাগুলোর এক ধরনের যৌক্তিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন।
শুধু রাজনীতিবিদেরাই নন, অর্থনীতিবিদ, গণিতবিদ কিংবা দার্শনিক থেকে শুরু করে যে কোনো সাধারণ মানুষই বিভিন্ন স্ট্র্যাটিজি পর্যালোচনা করেই জীবনের নানা সিদ্ধান্ত নেন। হাতে একাধিক ভালো চাকরির অফার থাকলে আমরা নতুন চাকরির বেতন, চাকরির স্টেবিলিটি কিংবা চাপ, সেখানকার পরিবেশ, তেলের খরচ, বাড়ি থেকে যাত্রাপথের দূরত্ব কিংবা সময় প্রভৃতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেই কোন চাকরিতে যোগ দিব। সামাজিকভাবে বন্ধুত্ব কিংবা মেশামেশির ক্ষেত্রেও আগাপাশতলা সব কিছু বিবেচনা করেই নেওয়া হয় কার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে, আর প্রতি থেকে যাওয়া হবে নিরপেক্ষ।
ফেসবুকে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে কিংবা বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখির ক্ষেত্রেও অনেকে নানা স্ট্রেটেজির আশ্রয় নেন কাকে সমালোচনা করা হবে, আর কার প্রতি যোগাতে হবে প্রচ্ছন্ন সমর্থন। আসলে আমরা নিজেদের অজান্তেই খেলি ক্রীড়াতত্ত্বের জটিল খেলা। প্রাচীনকালে যখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এখনকার মতো ছিল না, পরিস্থিতি ছিল যুদ্ধংদেহী, তখন প্রাচীন কালের মানুষদের মধ্যে ব্যাপারগুলো আরও স্পষ্ট ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে, এমন অনেক পরিস্থিতিই জীবনে আসে যখন নিজের একতরফা জয়লাভ করতে যাওয়ার চেয়ে ভালো কোনো স্ট্র্যাটিজি করে প্রতিপক্ষকে দীর্ঘক্ষণ ঘায়েল করে রাখতে পারলে সুবিধা বেশি।
কিংবা কখনো সরাসরি প্রতিযোগিতায় না নেমে তৃতীয় পক্ষের সাথে ঝামেলা তৈরি করে দিতে পারলে বেশি সুফল পাওয়া যেতে পারে। কখনো আবার এগুলো কোনোটাতেই না গিয়ে স্রেফ জনসমর্থন বাড়িয়ে কিংবা কিংবা সাময়িক সহযোগিতার মাধ্যমেও সর্বোচ্চ সুফল আদায় করে নেওয়া সম্ভব।
স্ট্র্যাটিজির ব্যাপারগুলো বোঝার জন্য এবার একটি পরিচিত ধাঁধা নিয়ে আলোচনা করা যাক। গেম থিওরির প্রয়োগ সংক্রান্ত অত্যন্ত সহজ সরল কিন্তু শক্তিশালী এই ধাঁধাটির নাম দেয়া হয়েছে আসামির সংকট (Prisoner’s dilemma)। মুক্তমনায় অপার্থিব ‘বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব’ নামের একটি চমৎকার লেখায় আসামির সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করেছিলেন[২৯০]। ব্যাপারটা অনেকটা এরকমের —
ধরা যাক একজন পুলিশ একটি হত্যা মামলায় দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু সাক্ষ্যপ্রমাণ খুবই অপ্রতুল। ফলে পুলিশ কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। এখন আসামিদের দুজন সত্যই অপরাধ করেছে কি না কিংবা কে আসল অপরাধী তা নির্ধারণ করতে নীচের শর্তগুলো আসামিদের সামনে হাজির করা হলো –
- একজন আসামি যদি দাবি করে (বিশ্বাসঘাতকতা) যে, অপর জন অপরাধী আর অপর জন যদি নিশ্চুপ থাকে (সহযোগিতা), তাহলে প্রথম জন মুক্তি পাবে এবং দ্বিতীয়জন ৫ বছরের কারাদণ্ড পাবে।
- উভয়েই যদি নিশ্চুপ থাকে (দুজনের মধ্যে সহযোগিতা) তাহলে উভয়েরই ২ বছরের কারাদণ্ড হবে।
- উভয়েই যদি একে অপরকে দোষারোপ করে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করে (দুইজনের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা), তবে তাদের প্রত্যেকের ৪ বছরের কারাদণ্ড হবে।
এখন তাহলে আসামিদ্বয় কী করবে? তারা উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করবে, কী করে নিজের সর্বোচ্চ লাভ হবে কিংবা নিজের সর্বোচ্চ ক্ষতি এড়ানো যাবে। প্রথমে হয়তো এক আসামি ভাববে, আমি যদি অপরকে দোষী বানাতে পারি, তাহলে আমি মুক্তি পাব। সুতরাং সে অপরজনকে দোষারোপ করবে। এখন দ্বিতীয়জন যদি নিশ্চুপ থাকত তাহলে প্রথমজন মুক্তি পেয়ে সর্বোচ্চ লাভ অর্জন করে ফেলতো। কিন্তু মুশকিলটা হলো দ্বিতীয় আসামি যে নিশ্চুপ থাকবে তার তো কোনো গ্যারান্টি নেই। দ্বিতীয়জনও যদি প্রথমজনের মতোই অপরকে দোষারোপের কৌশল নেয়, তাহলেই হবে সমস্যা।
দুইজনেরই সর্বোচ্চ ৪ বছর করে কারাদণ্ড হয়ে যাচ্ছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুজন দুজনকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেরাই সর্বোচ্চ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তারচেয়ে বরং দুইজনই যদি নিশ্চুপ থাকত, তখন হয়তো শাস্তিরমাত্রা কমে আসত। এই পুরো খেলাটা একাধিকবার পরিচালনা করা হলে হয়তো কারাবন্দিদের মধ্যে একটা সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠবে, ফলে তারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপরা করে গেম থিওরির মাধ্যমে ঘটা স্থিতিশীল কৌশল আয়ত্ব করে নেবে। বাস্তবেও তাই হয়। সেজন্যই আমরা দেখি দাগি ভয়ংকর সব আসামিদের মধ্যেও কিংবা মাফিয়া চক্রের মধ্যেও এক ধরনের সহযোগিতার সম্পর্ক থাকে। তারা পারতপক্ষে একে অপরকে ধরিয়ে দেয় না।
ট্রপিকাল রেইন ফরেস্টের দীর্ঘকায়া গাছগুলো আসামির সংকটের বাস্তব উদাহরণ। সেখানে গাছগুলোকে কেবল বংশবৃদ্ধির ব্যাপারটিই কেবল দেখতে হয় না, পাশাপাশি বাড়াতে হয় নিজেদের উচ্চতাকেও। সেই ঘন বনভূমিগুলোতে সূর্যের আলো নীচ পর্যন্ত পৌঁছয় না। কাজেই উচ্চতায় খাটো হলে থেকে যায় সূর্যের আলো না পেয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা। কাজেই অন্য জায়গার গাছেদের মতো উচ্চতা বাদ দিয়ে কেবল বংশবৃদ্ধি করা কোনো অপশনই নয় তাদের জন্য।
তাই রেইন ফরেস্টের গাছের জন্য কখন বংশবৃদ্ধি করতে হবে, আর কখন উচ্চতা বাড়াতে হবে এ নিয়ে সবসময় চলে ক্রীড়াতত্ত্বের জটিল এক খেলা। ক্রীড়াতত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ লক্ষ করা যায় জমিতে কৃষকদের কীটনাশক প্রদানের ক্ষেত্রেও। কৃষকেরা দেখেছেন যে একটি কীটনাশক ব্যবহার করে কোনো একটি ক্ষতিকর কীট ধ্বংস করলে অনেক সময় হিতে বিপরীত হয় দেখা যায় সেই কীট মরলেও তার প্রতিযোগী অন্য কোনো ক্ষতিকর কীটের সুবিধা করে দেবার ঘটনা ঘটছে; যার নীট ফলাফল ফসলের জন্য ক্ষতি।
দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই কৃষকেরা সিদ্ধান্ত নেন কখন কীটনাশক প্রয়োগ করবেন, কখন ছাড় দেবেন, আর প্রয়োগ করলে কোনো কোনো কীটের জন্য ওষুধ প্রয়োগ করবেন ইত্যাদি। আসলে কৃষকের মনে চলতে থাকে আসামির সংকটের মতোই গেম তত্ত্বের নিরন্তর খেলা। জীবজগতের বিবর্তন ভারসাম্যও কিন্তু অনেকটা এভাবেই কাজ করে।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চলমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন আদিমকালের মানুষের মধ্যে বহু সংঘর্ষ, সহাবস্থান, পারস্পরিক যোগাযোগ, প্রতিযোগিতা এবং সামাজিক লাভ ক্ষতির হিসেবে থেকে এক ধরনের নৈতিক চেতনার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটিয়েছে। কীভাবে সেটা সম্ভব তা বুঝতে হলে আমাদের রিচার্ড ডকিন্সের স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে ঘটা ‘বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল’ সম্বন্ধে একটু জানতে হবে।

স্বার্থপর জিন এবং বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল
রিচার্ড ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটির কথা আমরা আগেও বলেছি। ডকিন্স বইটি লেখেন ১৯৭৬ সালে। এটি রিচার্ড ডকিন্সের প্রথম বই এবং তার শ্রেষ্ঠ কীর্তিগুলোর একটি। এই বইয়ের মাধ্যমেই ডকিন্স সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করলেন যে, বিবর্তন কাজ করে জিনের উপর, একক কোনো জীবের উপর নয়। আমাদের দেহ যাই করুক শেষ পর্যন্ত ‘অত্যন্ত স্বার্থপর’ভাবে জিনকে রক্ষা করা আর জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছে দেয়াতেই উদ্দেশ্য খুঁজে নিতে বাধ্য করে, বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের কোনো ‘উদ্দেশ্য’ যদি থেকে থাকে তবে সেটাই সে উদ্দেশ্য।
বইটির নাম ‘সেলফিশ জিন’ হলেও বইটির মূল লক্ষ্য ছিল ঠিক বিপরীত। জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই ক্রমান্বয়ে কীভাবে উদ্ভব হয় পরার্থিতার মতো একটি বিপরীতমুখী অভিব্যক্তির তা ব্যাখ্যা করাই ছিল বইয়ের মূল উদ্দেশ্য। ডকিন্স কিন্তু নতুন কিছু লেখেননি, বরং জর্জ উইলিয়ামস এবং উইলিয়াম হ্যামিলটনের কাজগুলোকেই জনপ্রিয় বিজ্ঞানের মোড়কে মলাটবন্দি করেছেন। তথ্যে নতুনত্ব না থাকলেও নিঃসন্দেহে নতুনত্ব আর অভিনবত্ব ছিল উপস্থাপনায়। উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ ছিল একেবারেই কাঠখোট্টা একাডেমিক লেভেলে।
ডকিন্স তাদের কাজকেই সাধারণ মানুষের দরবারে নিয়ে গেলেন একাডেমিক জার্গন সরিয়ে। আসলে এমনকি একাডেমিক স্তরেও ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে এত ব্যাপকভাবে উইলিয়ামস এবং হ্যামিলটনের কাজ সম্বন্ধে কারও এতো জানাশোনা কিংবা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। এই বইয়ের মাধ্যমেই আসলে জীববিজ্ঞানীরা সমাজ এবং জীবনকে ভিন্নভাবে দেখা শুরু করলেন। পরার্থিতা, আত্মত্যাগের মতো যে বিষয়গুলো আগে বিজ্ঞানীরা পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না, সেগুলো আরও বলিষ্ঠভাবে জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করতে পারলেন তারা।
ডকিন্সের বইটি প্রকাশের আগে জীববিজ্ঞানীরা পরার্থিতা এবং আত্মত্যাগকে ব্যাখ্যা করতেন গ্রুপ সিলেকশন বা দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। অর্থাৎ, আত্মত্যাগ ব্যাপারটি ব্যক্তির জন্য খারাপ হলেও পুরো দলের জন্য ভালো এটাই ছিল আত্মত্যাগের মতো প্রবৃত্তিগুলো টিকে থাকার কারণ এভাবেই ভাবতেন জীববিজ্ঞানীরা। কিন্তু ডকিন্সের সেলফিশ জিন বইটি এসে দাবার ছক একেবারেই উলটে দিল। ডকিন্স দেখালেন যে, দলের কথা মাথায় রেখে বিবর্তন কখনোই কাজ করে না। আসলে দলগত নির্বাচন ব্যাপারটাই বিবর্তনের পরিভাষা থেকে উঠিয়ে দেয়া উচিত।
যে ব্যাপারগুলোকে আপাতঃভাবে দলগত নির্বাচনের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে, তার সবগুলোকেই আসলে স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে আরও অনেক ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। কারণ, নির্বাচন হয় জিন লেভেলে, গ্রুপ লেভেলে নয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন নিজের জিনকে রক্ষা কিংবা যাদের সাথে জিনের নৈকট্য বেশি থাকে, তাদেরকেই রক্ষার তাগিদ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। আর তা থেকেই ঘটে বৃহৎ স্কেলে পরার্থিতার সূত্রপাত।
পিঁপড়া, মৌমাছি, উইপোকা থেকে শুরু করে বানর, শিম্পাঞ্জি কিংবা মানুষ – সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জিনগত স্বার্থপরতা থেকেই উদ্ভব ঘটে পরার্থিতার, যা এতোদিন ভুল ভাবে ব্যাখ্যা করা হতো দলগত নির্বাচনের মাধ্যমে। জীববিজ্ঞানে এ এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। মানবসমাজের বিভিন্ন সামাজিক প্যাটার্ন ব্যখ্যা করার নতুন এক দুয়ার খুলে দিল ডকিন্সের স্বার্থপর জিন তত্ত্ব। স্বার্থপর জিনতত্ত্বই দলগত নির্বাচনকে সার্থকভাবে প্রতিস্থাপন করল উইলিয়ামস- হ্যামিলটন-স্মিথের প্রস্তাবিত স্বজাতি নির্বাচন (Kin selection) দিয়ে।
ডকিন্স তার বইয়ে দেখিয়েছেন স্বার্থপর জিন তত্ত্বের মাধ্যমে খুব সফলভাবে জীবজগতে পরার্থিতার উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যায়। শুধু তাই নয়, জীবজগতে সবসময়ই স্বার্থপরতা আর পরার্থিতার মধ্যে এক ধরনের ‘দড়ি টানাটানির’ খেলা চলতে থাকে। সেই টানাটানি থেকেই শেষপর্যন্ত নির্ধারিত হয় বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল (Evolutionary Stable Strategy)। কীভাবে স্থিতিশীল কৌশল জীবজগতে রাজত্ব করে, তা বাংলায় একটি চমৎকার প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন মুক্তমনা ব্লগার দিগন্ত সরকার[২৯১]। দিগন্ত লেখা শুরু করেছিলেন একটি মজার উদাহরণ দিয়ে —
ধরা যাক মুক্তমনায় অপার্থিব আর বন্যা আমার প্রতিযোগী দুই সদস্য। এটা ভাবা খুবই স্বাভাবিক যে আমি এখন অপার্থিবের মুখোমুখি হলেই তাকে মেরে ফেলতে উদ্যত হব। কিন্তু, এমন যদি হয় যে অপার্থিব আবার বন্যারও প্রতিযোগী, তাহলে অপার্থিবকে মারলে আদপে বন্যার সুবিধাই হয়ে যাবে। বরং, বন্যা আর অপার্থিবের মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হলেই আমার লাভ বেশি। তাই, প্রতিযোগিতার জটিল ঘূর্ণাবর্তে প্রতিযোগীদের নির্বিচারে হত্যা করাটা নির্বাচিত হবার জন্য খুব একটা ভালো কৌশল নাও হতে পারে।
অর্থাৎ কেবল মার-মার কাট-কাট করলেই লাভ হবে না। কারণ ‘মার-মার কাট-কাট’ স্ট্র্যাটিজি অনেক সময়ই টিকে থাকার জন্য কোনো ভালো স্ট্র্যাটিজি নয়। মারামারির পাশাপাশি রপ্ত করতে হবে সহযোগিতার কৌশলও। ব্যাপারটা গাণিতিকভাবেই সহজে প্রমাণ করা যায়। দিগন্ত তার লেখায় এই আকর্ষণীয় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ডকিন্সের বইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ হাজির করে। আমি কিছুটা পরিবর্তিত আকারে উদাহরণটি পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। বলা বাহুল্য, এই উদাহরণটি মূলত মায়নার্ড স্মিথের দেয়া কাল্পনিক ‘Hawk and Dove’ এর ঈষৎ পরিবর্তিত উদাহরণ[২৯২]।
ধরা যাক, একটি জীবগোষ্ঠীর মধ্যে দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী কৌশল অবলম্বনকারী জীব রয়েছে। প্রথমটি আগ্রাসী নীতি (আনী), আরেকটি ধান্দাবাজ-বিবাদ নীতি (ধানী)। আনীরা হচ্ছে আগ্রাসী, এরা মার মার কাট কাট। তারা সবসময় শেষ রক্তবিন্দু অবধি লড়াই করে, মৃতপ্রায় না হলে রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করে না। অপরদিকে ধানীরাও বিবাদী, কিন্তু একটু ধান্দাবাজ টাইপের। এরা মারামারি না করে অন্য উপায়ে লড়াই করে। এরা ঝগড়া করে, রক্তচক্ষু দেখায়, আক্রমণের ভাব করে কিন্তু রক্তপাত করে না।
কিন্তু তারপরেও দুই ধানীতে লড়াই বাধলে শেষপর্যন্ত একজন জিতে আরেকজন হারে। এদের পার্থক্যটা অনেকটা অনেকটা ডিপ্লোম্যাট আর আর্মির পার্থক্যের মতো। আনীর সাথে ধানীর লড়াই হয় না, কারণ ধানী পালিয়ে যায়। কিন্তু দুই আনীর লড়াইতে সর্বদা কোনো না কোনো একজন মারা যায় (বা গুরুতর আহত হয়)।
এবারে লড়াইয়ের কৌশলটি গাণিতিকভাবে হিসেব করা যাক। হিসাবের সুবিধার্থে আমরা ধরে নিব, কোনো জীবই জীবদ্দশায় তার কৌশল বদলায় না, এবং এমনকি প্রতিযোগিতার শুরুতে একে অন্যের কৌশল সম্বন্ধেও অবগত থাকে না। আমাদের এই মডেলের কাল্পনিক পয়েন্ট সিস্টেমে ধরা যাকঃ
প্রতিযোগিতায় জিতলে ৫০ পয়েন্ট,
প্রতিযোগিতায় হারলে ০ পয়েন্ট,
সময় নষ্টের জন্য ১০,
গুরুতর আহত হলে ১০০ পয়েন্ট বরাদ্দ করা হলো।
– জিনের নির্বাচনের সম্ভাবনার সাথে মিল রেখেই এরকম পয়েন্ট সিস্টেম।
আমরা হিসাব করতে চাই যে এদের মধ্যে কোন্ কৌশলটি (বা এদের কোনো সংমিশ্রণ) স্থিতিশীল হয়ে উঠবে।
মনে করা যাক, জীবগোষ্ঠীর সব জীবই প্রথমে ধানী (ধান্দাবাজ বিবাদী নীতি) ছিল। তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিটি প্রতিযোগিতায়, একজন জেতে (+৫০), একজন হারে (০); আর দুজনেই সময় নষ্ট করে (-১০x২ = -২০), কিন্তু কেউই আহত হয় না। সমষ্টিগতভাবে লাভ হয় ৩০ পয়েন্ট, প্রত্যেকের ভাগে যায় ১৫ পয়েন্ট করে। এবার ধরা যাক একটা আনী (আগ্রাসী নীতি) জীব হঠাৎ এসে হাজির হলো এই গোষ্ঠীতে। সে ধানীদের সহজেই লড়াইতে হারিয়ে দেবে, প্রতি যুদ্ধে +৫০ পয়েন্ট হাসিল করবে। তার ফলে তার আগ্রাসী জিন খুব সহজেই জীব গোষ্ঠীতে বিস্তার লাভ করবে।
বিস্তার লাভ করতে করতে, ধরা যাক, একটা সময় পরে জীবগোষ্ঠীতে ধানীদের সংখ্যা একেবারেই কমে যাবে আর গোষ্ঠীর প্রায় সবাই আনী হয়ে যাবে। এখন স্বভাবতই দুই আনীতে লড়াই বাধবে। দুটি আগ্রাসী জীবের লড়াইয়ে প্রত্যেকে গড়ে -২৫ পয়েন্ট পায় (জেতায় +৫০, আর গুরুতর আহত হওয়ায় -১০০)। একটি বিবাদী সেই দলে থাকলে সে সব লড়াইতে হারে, কিন্তু গড়ে সে ০ পয়েন্ট পায় (আগের গণনা থেকে )। -২৫ পয়েন্ট এর চেয়ে ০ পয়েন্ট অনেক ভালো। +৩৫ পয়েন্টের সুবিধা থাকায় সহজেই ধানী কৌশল নিয়ন্ত্রক জিন জনপুঞ্জে বিস্তার লাভ করতে থাকবে।
এতদূর পর্যন্ত গল্পটা শুনে মনে হতে পারে যে জীব গোষ্ঠীতে সবসময় এই দুই কৌশলের জীবদের মধ্যে একটা বাড়াকমা চলবে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে দেখেছেন যে ধানী আর আনীদের অনুপাত ৫:৭ অনুপাতে পৌঁছলে সমাজ স্থিতিশীলতা লাভ করবে! মানে, ওই অনুপাতে পৌঁছনর পরে প্রতিটি আগ্রাসী (আনী) আর প্রতিটি ধান্দাবাজ বিবাদী (ধানী)র গড়পড়তা লাভ-ক্ষতির তুলনামূলক হিসাব মিলে যায়। অর্থাৎ ধানী : আনী = ৫:৭ হয়ে গেলে নির্বাচনে আর কেউই অন্যের তুলনায় সুবিধা পায় না। এই অনুপাতই এক্ষেত্রে বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল।
স্থিতিশীল কৌশল কেবল আনী-ধানীর ক্ষেত্রেই নয়, চমৎকারভাবে কাজ করে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন মানবসমাজে নারী পুরুষের অনুপাত থাকে ১০০ : ১০৫ অনুপাতে। ক্রীড়াতত্ত্বের সাম্যাবস্থার জন্যই এটি ঘটে। রিচার্ড ডকিন্স তার সেলফিশ জিন বইয়ের ‘ব্যাটেল অব সেক্স’ অধ্যায়ে উপরের আনী-ধানীর মতোই নারীপুরুষের মধ্যে প্রতারণা এবং বিশ্বস্ততা নিয়েও একটি সরল ‘গেম থিওরির’ অবতারণা করে দেখিয়েছেন যে, সেখানেও দড়ি টানাটানির একটা খেলা চলে, ফলে পূর্ণ বিশ্বস্ত নারী-পুরুষে ভর্তি সমাজ যেমন আমরা পাই না, তেমনি পাই না এমন সমাজও যেখানে সবাই অবিশ্বস্ত। বরং সমাজে দেখা যাবেবিশ্বস্ততা এবং প্রতারণা রাজত্ব করে একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে যা শেষ পর্যন্ত বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশল বা Evolutionary stable strategy তৈরি করে।
একই ধরনের মডেল তৈরি করা যায় সত্যবাদী আর মিথ্যাবাদীদের মিথস্ক্রিয়ার মধ্যেও। বিবর্তনীয় স্থিতিশীল কৌশলের কারণেই পরিপূর্ণ সত্যবাদী সমাজ যেমন আমরা পাই না, ঠিক তেমনি এমন সমাজও আমরা পাব না যেখানে সবাই মিথ্যা কথা বলছে। এমনকি একই মানুষের মধ্যেও দেখা যাবে কারো পক্ষেই জীবনের সবসময় সত্য কথা বলা যেমন সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি সম্ভব নয় সর্বদা মিথ্যে কথা বলাও। পদার্থবিদ হাইন্য পেগেল্স তাঁর ‘‘যুক্তির স্বপ্ন” বইয়ে এজন্যই বলেছেন[২৯৩] —
জটিলতার নতুন বিজ্ঞান আর কম্পিউটারের প্রতিরূপ (মডেল) তৈরির মাধ্যমে আমরা মূল্যবোধ সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানতে পেরেছি, যা আগে কখনোই সম্ভব ছিল না। নৈতিকতা নিয়ে বিতর্কের সুরাহা করতে না পারুক, বিজ্ঞান অন্তত মডেলের সাহায্যে ব্যাপারগুলোর একটা যৌক্তিক কাঠামো তৈরি করতে পারে। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। যেমন মিথ্যা বলা।
আমরা সত্য বলাকে একটা পুণ্য বলে মনে করি আর মিথ্যা বলাকে পাপ হিসেবে গণ্য করি। এখন একটি সমাজ কল্পনা করি যেখানে সবাই সর্বদা সত্য কথা বলছে। এখন সেই সমাজে কোনো এক মিথ্যেবাদী এসে হাজির হলো (অনেকটা উপরের ধানী সমাজে আনীর আগমনের মতো)। এখন সত্যবাদী সমাজে এরকম একজন মিথ্যা বললে তার বিপুলভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
কিন্তু এই সম্ভাবনা সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য সহায়ক নয়। অপরদিকে যে সমাজে সবাই সর্বদা মিথ্যা বলে, সেই সমাজও বেশিদিন স্থিতাবস্থায় থাকতে পারে না এবং একসময় ভেঙে পড়তে বাধ্য। সবচেয়ে স্থিতাবস্থার দশা হলো যখন সবাই অধিকাংশ সময় সত্য বলে কিন্তু মাঝে মধ্যে মিথ্যা বলে, যা বাস্তব জগতে দেখা যায়। এক অর্থে বলা যায় যে আমাদের মধ্যে যারা মিথ্যাবাদী তারাই আমাদের বাকি সবাইকে সত্যবাদী ও সতর্ক থাকতে সহায়তা বা বাধ্য করে। মিথ্যা কথনের এই বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আমরা কেন মিথ্যা বলি সেটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
ক্রীড়াতত্ত্ব এইরকম বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণকে সমর্থন দেয়, শুধু জীববিজ্ঞানে নয়, বিজ্ঞানের নানা শাখাতেই। যেমন অর্থনীতি নিয়ে যারা পড়াশুনা করেছেন তারা জানেন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ তথা বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে, গেম থিওরি প্রচ্ছন্নভাবে কাজ করে। প্রথমে কোনো দ্রব্যের মনোপলি বাজার থাকলে দ্রব্য প্রস্তুতকারীর একচেটিয়া মুনাফা থাকে। দ্রব্যের দামও হয়তো বসাতে পারে ইচ্ছেমতো। কিন্তু একটা সময় পরে অন্য প্রতিযোগীরাও একই দ্রব্য তৈরিতে নেমে পড়লে কারো একতরফা মুনাফা থাকে না।
দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হয় গেম থিওরির মাধ্যমে বোঝাপড়ার নিরিখে। আবার কোনো ব্যবসায়ী একই দ্রব্য কমদামে বিক্রি শুরু করলে তার সাময়িকভাবে লাভ হয় বটে, কিন্তু তার অন্য প্রতিযোগীরাও সাথে সাথেই দাম কমিয়ে ফেললে তার আখেরে অনেক লোকসানই হবে। তাই শেষমেষ নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়ার মাধ্যমে বাজারে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হওয়া শুরু করে। স্বার্থপরতা আর পরার্থিতাও ঠিক একইভাবে কাজ করে। তারা মিলেমিশে এক হয়ে থাকে ক্রীড়াতত্ত্বের দড়ি টানাটানির মাঝখানে।
চীনের অধিবাসীদের অনেকেই ইন এবং অ্যান (Yin and yang) নামক দুই পরস্পরবিরোধী শক্তিতে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে মানুষসহ সবকিছুই আসলে ইন এবং অ্যান-এর সুষম মিশ্রণ। শুধু চীনারা কেন, আমরাও ছোটবেলায় স্কুলে ভাব সম্প্রসারণ করতে গিয়ে শিখেছিলাম“শুভ’র জন্যই অশুভ’র দরকার”, কিংবা “আলোর জন্যই অন্ধকারের প্রয়োজন”।
নিরঙ্কুশ সত্যবাদী সমাজ তৈরির মতো প্রদীপ জ্বেলে আঁধার দূর করার চেষ্টা হলেও দেখা যায় প্রদীপের নীচেই থেকে যাচ্ছে গাঢ় অন্ধকার। ঠিক একইভাবে বলা যায়, আমরা পরার্থিতার যতই বিজয় কেতন উড়াই না কেন, স্বার্থপরতাকে বাদ দিয়ে তা সম্ভব নয়। প্রদীপের অন্ধকারের মতোই তা নীচের স্তরে থেকে যাবে। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পরার্থিতার মূল উৎস আসলে স্বার্থপর জিনের উপস্থিতির কারণেই। ক্রীড়াতত্ত্বের আধুনিক মডেলগুলো যেন তারই বাস্তব প্রতিধ্বনি। সেজন্যই ম্যাট রিডলী তার ‘নৈতিকতার উদ্ভব’ বইয়ে বলেন[২৯৪] —
Cooperation was first used, not for virtuous reasons, but as a tool to achieve selfish results. And if we are to celebrate the unusually cooperative result of the societies, we must first recognize the base metal from which it was forged.
এই স্বার্থপরতার উপস্থিতির কারণেই কীভাবে পরার্থিতার উদ্ভব ঘটে তা আরও স্পষ্ট হবে নীচের কিছু উদাহরণে।
ভালোবাসা কারে কয়
২৯০.↑ অপার্থিব জামান, বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব, বিজ্ঞান ও ধর্ম– সংঘাত নাকি সমন্বয়, মুক্তমনা ই-বুক
২৯২.↑ In the biological literature, this game of game theory is referred to as Hawk-Dove. The earliest presentation of a form of the Hawk-Dove game was by John Maynard Smith and George Price in their 1973 Nature paper, “The logic of animal conflict”, Nature 246: 15–18.
২৯৩.↑ Heinz R. Pagels, The Dreams of Reason: The Computer and the Rise of the Sciences of Complexity, Bantam, 1989; অনুবাদের কিয়দংশ অপার্থিব জামান, বিবর্তনের দৃষ্টিতে নৈতিকতার উদ্ভব, বিজ্ঞান ও ধর্ম– সংঘাত নাকি সমন্বয়, মুক্তমনা ই-বুক
২৯৪.↑ Matt Ridley, The Origins of Virtue: Human Instincts and the Evolution of Cooperation, Penguin; 1998