পৃথিবীর বাইরে এই সৌরজগতে আর যে দুটো জায়গায় প্রাণ থাকার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন তার একটি হচ্ছে মঙ্গল গ্রহ এবং অন্যটি বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরােপা। বর্তমানে মঙ্গলের যে পরিবেশ তাতে করে সেখানে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রতিদিনের গড় তাপমাত্রা ২২০ কেলভিনের উপর সচরাচরই উঠে যেটা পানির জমাটাংকের চেয়েও ৫৩ কেলভিন নীচে। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রচুর তথ্য প্রমান রয়েছে যা থেকে ধারণা করা হয় যে মঙ্গলে একসময় তরল পানির অস্তিত্ব ছিল এবং বর্তমানেও সম্ভবত এর ভূ-গর্ভে পানি রয়ে গেছে।
পানির আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের কাছে সবসময়ই আকর্ষণীয়, কেননা পৃথিবীতে খুব সম্ভবত প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে পানিতে এবং প্রাণের টিকে থাকার জন্য পানির কোন বিকল্প নেই। পানি এমন একটি তাপমাত্রার সীমায় তরল অবস্থায় থাকে যেখানে প্রাণের অধিকাংশ রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলি সংঘটিত হতে পারে। দুটি হাইড্রোজেন এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু নিয়ে গঠিত হয় পানির অণু। যেহেতু হাইড্রোজেন পরমাণু দু’টি অক্সিজেন পরমাণুর পুরােপুরি বিপরিত দিকে অবস্থান করে না, সে কারণে পানি মেরু অণু (Polar molecule) হিসাবে বিবেচিত অর্থাৎ এটি ইলেকট্রিক চার্জ দিয়ে সামান্য প্রভাবিত হয়। এ ছাড়া জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানগুলাের প্রায় সবই পানিতে দ্রবীভূত হতে পারে। পানি ছাড়া অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়াই সম্ভব নয়।

এছাড়া পানির আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে এটি এর হিমাঙ্কের সামান্য উপরে কিছুটা প্রসারিত হয় অর্থাৎ পানি সবচেয়ে ভারি এবং এর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি চল্লিশ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা চার ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ফলে বরফ যেহেতু পানির তুলনায় হালকা কাজেই অনায়াসে ভেসে থাকে পানির উপর। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই কোন হ্রদের পানি যখন ক্রমান্বয়ে শীতল হতে শুরু করে তখন উপরের পানির ঘনত্ব বেড়ে যায় এবং সেগুলাে নীচের দিকে চলে যেতে থাকে। ফলে শুধুমাত্র উপরিভাগের পানিই বরফে পরিনত হয় এবং সেখানেই থেকে যায়। বরফ যদি লেকের তলদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত হতাে তবে সেখানে কোন জলজ প্রাণীরই বেঁচে থাকা সম্ভবপর হতাে না।
জোতির্বিজ্ঞানীরা অবশ্য এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে জীবনের সহায়ক হিসাবে পানির বিকল্পের কথাও চিন্তা করেছেন। তবে সেই সম্ভাবনার পরিমানও খুবই কম। মাত্র তিনটি অণু আছে যাদের পানির যে সমস্ত বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে তার কিছু কিছু আছে। এরা হচ্ছে মিথেন, এমােনিয়া এবং হাইড্রোজেন ফ্লোরাইড। এরা প্রত্যেকেই একটি বেশ বড় ধরনের তাপমাত্রার সীমায় তরল অবস্থায় থাকে। মহাবিশ্বে এদের পরিমাণও প্রচুর বা বলা যেতে পারে যে সমস্ত পরমাণু প্রয়ােজন এগুলাে তৈরি করার জন্য তা বিপুল পরিমাণে বিদ্যমান। তবে এটা ঠিক যে পানির অণু গঠনের উপাদান হাইড্রোজেন বা অক্সিজেনের মতাে এতাে ব্যাপক পরিমাণে নেই। প্রত্যেকেই পানির মতাে না হলেও মােটামুটি বেশ ব্যাপক পরিমাণ রাসায়নিক বিক্রিয়াকে সহায়তা করে এবং বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থকে দ্রবীভূত করতে পারে।
মঙ্গলের ওডিসি মিশনের (Odyssey) Thermal Emission Imaging System (THEMIS)। এর মাধ্যমে প্রাপ্ত ছবি থেকে দেখা গেছে যে মঙ্গলের উপত্যকায় অসংখ্য শাখা-প্রশাখা সম্বলিত নালা রয়েছে। এই ধরনের নালা পৃথিবীতে গঠিত হয়েছে শুধুমাত্র পানি প্রবাহের জন্য। মঙ্গলের পানি হয়তাে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে এসেছে বা ভূ-গর্ভস্থ সঞ্চয় থেকেও আসতে পারে। যেখান থেকেই আসুক না কেন এই সমস্ত নালা গঠনের পেছনে পানি যে ভূমিকা রেখেছে সেটা নিশ্চিত। উপত্যকার নালাসমূহের অসংখ্য শাখা-প্রশাখা প্রমাণ করে যে এগুলাে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয়েছে অর্থাৎ একসময় মঙ্গলের পৃষ্ঠে পানির প্রবাহ ছিল।
যদিও মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ইতিহাস অজানা, তারপরও ধারণা করা হয় যে, সাড়ে তিন বিলিয়ন থেকে চার বিলিয়ন বছর আগে বায়ুমন্ডল হয়তাে আরাে ঘন ছিল। ফলে শক্তিশালী গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার কারণে মঙ্গল এখনকার তুলনায় অনেক বেশি উষ্ণ ছিল সেই সময়। ফলে মঙ্গলের পৃষ্ঠে পানি তরল আকারে থাকতে পেরেছে। সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে। মঙ্গলের ভূ-গর্ভে অনেক বেশি পরিমানে পানি সঞ্চিত ছিল। মাঝে মাঝেই সেখান থেকে বন্যার আকারে পানি বের হয়ে এসেছে ভূ-পৃষ্ঠে, তৈরি করেছে জল নিষ্কাষণের অসংখ্য নালা। এই তথ্যের ভিত্তিতে এখনাে মঙ্গলের পৃষ্ঠের কয়েক কিলোমিটার নিচে যেখানে তাপমাত্রা বরফের গলনাংকের চেয়ে বেশি সেখানে পানি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

মঙ্গল সবসময়ই শক্তির প্রাচুর্যে ভরপুর। আগ্নেয়গিরিগুলাে সেই আদিম সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত উষ্ণতা যুগিয়ে চলেছে। এ ছাড়া জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় অতিরিক্ত শক্তি আসতে পারে আগ্নেয়গিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত প্রস্তরখন্ড থেকে। ব্যাসাল্টের মধ্যে লােহার অক্সিডাইজেশন যে শক্তি নির্গত করে তাও প্রাণীরা ব্যবহার করতে পারে। জৈবিক পদার্থে অফুরন্ত উপস্থিতি জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় আর যা যা দরকার তার ঘাটতি পূরণ করেছে। পানি এবং শক্তির উপস্থিতি থাকার কারণে মঙ্গলে হয়তাে আলাদাভাবেই জীবনের উদ্ভব ঘটেছিল।
দু’টো ভাইকিং রােবট স্পেসক্রাফট ১৯৭৬ সালে মঙ্গলের বুকে নেমেছিল। এদের ভিতরে ছিল ক্ষুদ্রাকার স্বয়ংক্রিয় রাসায়নিক এবং জীব বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। এই রােবট স্পেসক্রাফট মঙ্গলের মাটির নমুনা সংগ্রহ করে এবং তাতে কোন ধরণের বিপাক ক্রিয়ার অস্তিত্ব আছে কিনা দেখার চেষ্টা করে। পৃথিবীতে বিপাক কার্বন ডাই অক্সাইডের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ভাইকিং এক্সপেরিমেন্ট মঙ্গলের মাটিতে কার্বন ডাই অক্সাইডের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু জীববিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌছান যে এই কার্বন ডাই অক্সাইড বিপাকের ফল নয় বরং বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে গঠিত মঙ্গলের ওই মাটি ভিন্ন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড তৈরি করেছে। এর অর্থ হচ্ছে খুব সম্ভবত মঙ্গলের মাটিতে। বর্তমানে প্রাণের কোন চিহ্ন নেই।
দূর অতিতে কি মঙ্গলের বুকে প্রাণ ছিল? এর উত্তর নির্ভর করছে কত দ্রুত জীবন উৎপন্ন হতে পারে তার উপর। জ্যোতির্বিদরা মোটামুটি নিশ্চিত যে প্লানেটেসিমাল (Planetesimals) এর পারস্পরিক সংঘর্ষের কারণে পৃথিবীর আদি অবস্থা প্রাণের জন্য পুরােপুরি বিরূপ ছিল। সেই সময় আমাদের এই ধরিত্রী ম্যাগমা বা গলিত পাথরের আচ্ছাদন দিয়ে আবৃত ছিল। ম্যাগমা শীতল হওয়ার পর যদি কোন প্রাণ থেকেও থাকে তবে সেগুলাে মাঝে মাঝে বিশালাকৃতির যে সমস্ত প্লানেটেসিমাল তখনও পৃথিবীতে আঘাত হানতাে তাদের অত্যাচারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বলেই ধরে নেওয়া যেতে পারে।
চার বিলিয়ন বছর আগে এই ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অবস্থায় স্থিতি আসে। প্রাপ্ত ফসিল থেকে দেখা যায় যে, ৩৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রচুর পরিমাণে অণুজীব ছিল। প্রাথমিক ধরনের এই সরল প্রাণগুলাে প্রাণ-রসায়নগতভাবে বেশ কার্যকর ছিল। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল সালােকসংশ্লেষী, ফলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের অক্সিজেন বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে এগুলাে। ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউট অফ কেমিস্ট্রির (Max Planck Institute of Chemistry) ম্যানফ্রেড শিডলােস্কি (Manfred Schidlowski) আদিম পাথরের কার্বন আইসােটোপের অনুপাত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ৩৮০ কোটি বছর আগেও পৃথিবীতে প্রাণের সমাহার ছিল। পৃথিবীতে প্রাণ বিকাশের এই দ্রুততা দেখে কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রয়াত) খ্যাতনামা জ্যোতির্পদার্থবিদ কার্ল সাগান (Carl Sagan) যুক্তি দিয়েছিলেন যে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ অনেকটা অবশ্যম্ভাবী ছিল; অর্থাৎ, পর্যাপ্ত সময় পাওয়া গেলে প্রাণের উৎপত্তি ও বিবর্তন একটি মহাজগতিক অবশ্যম্ভাবিতা (Cosmic Inevitability)। একই ধরণের মত প্রকাশ করেন নােবেল বিজয়ী প্রাণরসায়নবিদ খ্রীষ্টান দ্য দুভে (Christian de Duve)ও। তিনি অনেকটা নিঃসংশয় হয়েই বলেন :
জীবনের উৎপত্তি অবশ্যাম্ভাবী … যেখানেই প্রাণ সহায়ক পরিবেশ পাওয়া যাবে, যা আমাদের পৃথিবীতে প্রায় চারশ কোটি বছর আগে ছিল, সেখানেই প্রাণের বিকাশ ঘটবে (Crawford, 2002)।
চারশ কোটি থেকে তিনশ আশি কোটি বছর আগে মঙ্গলের পরিবেশও পৃথিবীর মতােই প্রাণ উদ্ভবের সহায়ক ছিল। মঙ্গলের পৃষ্ঠে প্রাচীন নদী, লেক এমনকি ১০০ মিটার গভীরতার সাগরেরও চিহ্ন রয়ে গেছে। চারশ কোটি বছর আগে মঙ্গল এখনকার তুলনায় অনেক বেশি উষ্ণ এবং সিক্ত ছিল। এই সমস্ত তথ্য ধারণা দেয় যে, প্রাচীন পৃথিবীর মতাে প্রাচীন মঙ্গলেও প্রাণের বিকাশ ঘটে থাকা সম্ভব। যদি তাই হয়ে থাকে তবে মঙ্গল বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থা থেকে বন্ধুর পরিবেশের দিকে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে প্রাণও হয়তাে সর্বশেষ আশ্রয় হিসাবে বেছে নিয়েছে মঙ্গলের অভ্যন্তরীণ তাপের ফলে স্থায়ী বরফের নিচের বিগলিত লবণাক্ত হৃদে বা সিক্ত স্থানগুলােতে। বেশিরভাগ প্লানেটারি বিজ্ঞানী মনে করেন যে, ভবিষ্যত মঙ্গল অভিযানে আদিম প্রাণের রাসায়নিক বা অঙ্গসংস্থানিক জীবাশ্ম খুঁজে বের করা অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।
বর্তমানে এটা পরিষ্কার যে, সৌরজগত এবং এর বাইরে সর্বত্রই জৈব রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মঙ্গলের ছােট্ট উপগ্রহ ফোবােস (Fobos) এবং ডেইমােস (Deimos)-এর গাঢ় রং দেখে ধারণা করা হয় যে, এই দু’টি উপগ্রহ জৈব পদার্থ দিয়ে তৈরি বা নিদেনপক্ষে জৈব পদার্থের আস্তরণ দিয়ে আচ্ছাদিত। অনেকেরই ধারণা যে এরা সৌরজগতের দূরবর্তী প্রান্তের গ্রহাণু (Asteroid) যা আটকে পড়েছে মঙ্গলের কক্ষে। জৈব পদার্থ দিয়ে আচ্ছাদিত এই রকম ছােট ছােট গ্রহাণু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সৌরজগতের বিভিন্ন জায়গায়। বৃহস্পতি এবং মঙ্গলের মধ্যবর্তী প্রধান গ্রহাণুপুঞ্জ বেল্টের (Asteroids Belt) C এবং D ধরনের গ্রহাণুগুলি, ধুমকেতুর কেন্দ্র যেমন হ্যালির ধুমকেতু এবং সাম্প্রতিককালে আবিষ্কৃত সৌরজগতের দূরবর্তী প্রান্তের একগুচ্ছ গ্রহাণুও রয়েছে। ১৯৮৬ সালে ইউরােপিয়ান স্পেস এজেন্সির নভােযান Gitto হ্যালির ধুমকেতুর চারপাশের ধূলির মেঘের মধ্য দিয়ে সরাসরি উড়ে যায়। Giotto-র দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হ্যালির ধুমকেতুর কেন্দ্র ২৫ শতাংশ জৈব পদার্থ দিয়ে তৈরি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
পৃথিবীতে প্রাপ্ত বহুল পরিমানে Carbonaceous chondrite উল্কাপিন্ডগুলাে প্রধান গ্রহাণুপুঞ্জ বেলটের C ধরনের গ্রহাণুদের অংশ বলে মনে করা হয়। Carbonaceous উল্কাপিন্ডগুলাের মধ্যে প্রচুর পরিমানে এরােম্যাটিক এবং অন্যান্য হাইড্রোকার্বন পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক এমিনাে এসিড এবং নিউক্লিওটাইড বেসও খুঁজে পেয়েছেন।
ধারণা করা হয় যে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে আঘাত করা উল্কাপিন্ড এবং ধুমকেতুগুলাে হয়তাে প্রাচীন সময়ে প্রচুর পরিমানে জৈব অণু বহন করে নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে। এদের মধ্যে কোন কোনটি হয়তাে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সময় প্রচন্ড তাপকে উপেক্ষা করে অক্ষত থেকে গিয়েছিল এবং ফলশ্রুতিতে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশের ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। একইধরনের ঘটনা অন্য গ্রহেও ঘটতে পারে। উল্কা এবং ধুমকেতু পানিসহ অন্যান্য জৈবিক পদার্থ বয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই সব গ্রহে। ওই গ্রহগুলােতে পৃথিবীর মতাে প্রাণ-পূর্ব রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটার জন্য যে বিপুল পরিমানে পানি থাকতে হবে তা কিন্তু নয়। ছােট্ট একটু পানির পুকুর, বরফের আস্তরণের নিচের সামান্য কিছু পানিই কিন্তু প্রাণ বিকাশের জন্য যথেষ্ট।
উপগ্রহ ট্রাইটন, ক্যালিস্টো এবং টাইটানের আকার এবং রাসায়নিক গঠন এদেরকে প্রাণ সহায়ক উপগ্রহ হিসাবে বিজ্ঞানীদের কাছে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু যে উপগ্রহটি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে সবচেয়ে বেশি সেটা হচ্ছে বৃহস্পতির তৃতীয় বৃহত্তম উপগ্রহ ইউরােপা। মনুষ্যবিহীন রােবট স্পেসক্রাফট ইউরােপা এবং সৌরজগতের দূরবর্তী প্রান্তের প্রায় মােটামুটি সব উপগ্রহগুলিরই ছবি তুলেছে। পৃথিবীতে প্রেরিত এই সব ছবিতে উপগ্রহগুলাের অনেক খুঁটিনাটি প্রকাশ পেয়েছে। এই ছবিগুলাে থেকে দেখা যায় যে প্রতিটি উপগ্রহেরই আলাদা ধরনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

ইউরােপার প্রথম ঝাপসা ছবি পাঠায় ভয়েজার মহাকাশযান ১৯৭৯ সালে। পরবর্তীতে গ্যালিলিও মিশন আরাে নিখুঁত ছবি পাঠিয়েছে ইউরােপার। সাদা চাদরে মােড়া এই উপগ্রহের ছবিতে দেখা যায় যে অসংখ্য আঁকাবাঁকা রেখা এর সারা গা বেয়ে বিস্তৃত। ইউরােপার সাদা চাদর হচ্ছে বরফ, আর কিছু নয়। ইউরােপা প্রায় এক মাইল চওড়া বরফে আচ্ছাদিত। আঁকাবাঁকা রেখাগুলাে হচ্ছে বিশালাকার হিমবাহগুলাের প্রান্তদেশের মিলন মেলায় উৎপন্ন সুদীর্ঘ দেয়াল (Ridge)। হিমবাহগুলাে পরস্পর পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে তৈরি করেছে বিশালাকার বরফের চুড়া।
২০০০ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার জোতির্বিদ মার্গারেট কিভেলসন (Margaret Kivelson) ঘােষণা করেন যে, মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান গ্যালিলিওর ম্যাগনেটিক সেন্সর বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরােপায় বরফের আস্তরণের নীচে জলীয় সাগরের প্রমাণ পেয়েছে। জলের এই আবিষ্কার বিজ্ঞানীদেরকে দারুণভাবে উৎসাহিত করে তােলে। কেননা পৃথিবীতে খুব সম্ভবত প্রাণের প্রথম উদ্ভব হয়েছে পানিতে এবং পানি ছাড়া প্রাণ টিকে থাকতে পারে না। যদিও প্রাণ আশ্চর্যজনকভাবে যে কোন পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, তবুও। পানি ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা খুবই কঠিন। বৃহস্পতির মাধ্যাকর্ষণের সামান্য হেরফেরই ইউরােপার উষ্ণতার মূল উৎস। ইউরােপার অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত তাপ আছে যা পানিকে তরল অবস্থায় রাখতে সক্ষম। পৃথিবীর সাগরের তলদেশের মতই ইউরােপার জলীয় সাগরের নিচেও উষ্ণ খাদ থাকতে পারে।
সৌরজগতের আটটির মধ্যে সাতটি গ্রহেরই ঘন বায়ুমন্ডল রয়েছে। এই গ্যাসীয়মন্ডলও জীবনের অস্তিত্বের জন্য খুব ভাল জায়গা হতে পারে। জীবনের জন্য প্রয়ােজনীয় সব রাসায়নিক উপাদানই যেমন কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন গ্যাসীয়মন্ডলের অণুগুলােতে বিদ্যমান। পানির বাষ্প এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় তরলগুলােও সেখানে প্রচুর পরিমানে রয়েছে। সূর্যের আলাে উপর থেকে শক্তি জোগাতে পারে এবং সামান্য কিছু পরিমান তাপ আসতে পারে গ্রহগুলাের গলিত লাভা থেকে। বাতাসে চলাচলের মুক্ত স্বাধীনতা এবং ভেসে থাকার সামর্থের কারণে এই পরিবেশের প্রাণীদের শক্ত কাঠামােরও প্রয়ােজন নেই।
সূর্যের আলােকে ভেনাসের বায়ুমন্ডল ভেদ করে যেতে দেয়। ফলে উপগ্রহের পৃষ্ঠদেশ এবং বায়ুমন্ডলের নিচের অংশ উত্তপ্ত হয়ে উঠে। গ্রীন হাউজ এফেক্টের কারণে পরবর্তীতে বায়ুমন্ডল সমপরিমান তাপকে মহাশূন্যে চলে যেতে বাঁধা দেয়। গ্রীন হাউজ প্রতিক্রিয়ার কারণে ভেনাস মােটামুটি নরকের মতাে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এর পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা প্রায় ৪৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা সীসাকেও গলিয়ে ফেলতে সক্ষম। বায়ুর চাপও ভয়ঙ্কর রকমের বেশি সেখানে। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের তুলনায় প্রায় নব্বই গুন বেশি। প্রচন্ড তাপমাত্রার কারণে সেখানে বায়ু প্রবাহিত হয় ২৪০ মাইলের বেশি গতিতে। তীব্র উষ্ণতার কারণে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি কোন বাতাসও নেই বলতে গেলে।
কিন্তু ভেনাসের বায়ুমন্ডলে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে তিরিশ মাইল উপরে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের। এখানকার তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এর অবস্থান বায়ুমন্ডলের মাঝামাঝি পর্যায়ে। এই অবস্থাকে বলা হয় Goldilock effect. ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের জোতির্বিদ ড্রিক শুলজ-মাকুচ (Drik Schulze-Makuch) বলেন যে ভেনাসের বায়ুমন্ডলে দৃশ্যমান তিনটি এসিডিক রাসায়নিক পদার্থ হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই অক্সাইড এবং কার্বনিল সালফাইড সেখানকার বাতাসে ভেসে থাকা অণুজীবের উপজাতও হতে পারে। পৃথিবীতে কিছু কিছু চরমজীবী যে পরিবেশে টিকে আছে এই পরিবেশ তার চেয়ে খুব একটা খারাপ কিছু নয়। পৃথিবীর বায়ুমন্ডলেও ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে যেগুলাে ভেসে বেড়ায় এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে।