প্রথম অধ্যায় শুরু করেছিলাম মন্টু মিয়ার গল্প দিয়ে যে কি না ইলাস্টিক দিয়ে জানালার কাঁচ ভাঙতো সেই মন্টু মিয়া হয়তো মনোবিকারগ্রস্ততার একটু ছোট স্কেলের উদাহরণ। বড় বড় উদাহরণগুলোর কথা আমরা সবাই কম বেশি জানি। জ্যাক দ্য রিপার, ‘বিটিকে কিলার’ ডেনিস রেডার, ‘গ্রীন রিভার কিলার’ গ্রে রিজ ওয়ে, ‘সন অব স্যাম’ ডেভিড বার্কোউইজ, ‘বুচার অব রুস্তভ’ আঁদ্রে চিকাতিলো, চার্লস এং, ডেরিক টড লি, জন ওয়েন গেসি প্রমুখ। কিন্তু সবচেয়ে অস্বস্তিকর যে বিষয়টি তুলে এনেছেন তার বইয়ে পিঙ্কার, সেটি হলো- ‘‘মনোবিকারগ্রস্তদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিরাময় করা যায় না’’। তিনি বলেন,
আমরা যতদূর জানি, বিকারগ্রস্ত খুনিদের (সাইকোপ্যাথ) নিরাময় করা যায় না। বরং ম্যারিন রাইস দেখিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে মানসিক চিকিৎসা প্রদান – যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, সামাজিক দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা হিতে বিপরীত হয়ে বিকারগ্রস্ত খুনিদের আরও বিপজ্জনক করে তুলে।
সমাজের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ শেখানোর মাধ্যমে যে মনোবিকারগ্রস্ত মানুষদের স্বভাব অনেক সময়ই পরিবর্তন করা যায় না সেই ‘সত্যটি’ (?) পিঙ্কার তার বইয়ে তুলে ধরেছেন উপরে উল্লিখিত জ্যাক এবট্-এর একটি বাস্তব ঘটনা উল্লেখ করে। ঘটনাটি এরকম : পুলিতজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক নর্মান মেইলার জেলখানায় বন্দি দাগি আসামি জ্যাক এবট্-এর কিছু চিঠি পড়ে এতই মুগ্ধ হন যে, যে তিনি নর্মান মেইলারকে জামিনে মুক্তি পেতে সাহায্য করেন। নর্মান মেইলার সে সময় গ্যারি গিলমোর নামের আরেক অপরাধীকে নিয়ে একটি বই লেখার কাজ করছিলেন।
জ্যাক এবট্ তার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখককে সহায়তা করার প্রস্তাব দেন। জ্যাক এবট্-এর রচনা এবং চিন্তা ভাবনা নর্মান মেইলারকে এতটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যে, তিনি এবট্কে ‘প্রথাবিরুদ্ধ বুদ্ধিজীবী এবং সম্ভাবনাময় লেখক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন; শুধু তাই নয়, তাঁকে লেখা এবট্-এর চিঠিগুলো সংকলিত করে তিনি ১৯৮০ সালে এবট্-এর একটি বই প্রকাশ করতে সহায়তাও করেন, বইটির নাম ছিল ‘জানোয়ারের উদরে’ (In the belly of the beast)[৪৩]।
বইটি সে সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। নর্মান মেইলারের তদ্বিরে ছাড়া পাওয়ার পর এবট্ বেশ নামিদামি মহলে অনেক বিদগ্ধ লোকজনের সাথে নৈশভোজেও আমন্ত্রিত হতেন। অথচ এর মধ্যেই ছ’সপ্তাহের মাথায় নিজের সাইকোপ্যাথেটিক চরিত্রের পুনঃপ্রকাশ ঘটালেন এবট এক রেস্তোরার বেয়ারাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। ভাগ্যের কী পরিহাস- এবট যেদিন দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করে পুলিশের খাতায় নাম লেখাচ্ছিলেন, ঠিক তার পরদিনই তার ‘জানোয়ারের উদরে’ বইটির চমৎকার একটি রিভিউ বেরিয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমস-এ । পত্রিকার সম্পাদক খুব আগ্রহ ভরেই সেটি ছাপিয়েছিলেন এবটের আগের দিনের হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না থেকে।
এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। আমরা খুব স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেই মনোবিকারগ্রস্ত কিংবা শিশুনিপীড়নকারীরা নিজেদের শিশুবয়সে নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, সেজন্যই বোধহয় তারা বড় হয়ে অন্য মানুষদের মেরে কিংবা শিশুদের ধর্ষণ করে নিজেদের জিঘাংসা চরিতার্থ করে। এ ব্যাপারটি অনেকাংশেই ঠিক নয়। আমি যে বিটিকে খুনি ডেনিস রেডার, ‘গ্রীন রিভার কিলার’ গ্রে রিজ ওইয়ের উদাহরণ দিয়েছি, তারা কেউই শিশু বয়সে নিপীড়নের শিকার হয়নি। ডেনিস রেডার ছোটবেলায় খুব ভালো পরিবেশেই বড় হয়েছিলেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন, স্ত্রী, এবং দু’ ছেলে নিয়ে আর দশটা সাধারণ পরিবারের মতোই জীবনযাপন করতেন[৪৪]।
গবেষক জোয়ান এলিসন রজার্স তাঁর ‘যৌনতা : একটি প্রাকৃতিক ইতিহাস’ বইটিতে লিখেছেন যে বেশীর ভাগ শিশু যৌন নিপীড়নকারীদের নিজেদের জীবনে শিশু নিপীড়নের কোনো ইতিহাস নেই বলেই প্রমাণ মেলে[৪৫]। বংশাণুবিজ্ঞানী ফ্রেড বার্লিনের উদ্ধৃতি দিয়ে রজার্স তার বইয়ে বলেছেন যে, ‘বিকৃত যৌন আচরণ শেখান নয়, এটা জৈবিকভাবেই অঙ্কুরিত’। অবশ্য তিনি এটাও বলতে ভুলেননি যে, সমাজকে রক্ষা করার জন্যই অপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি দেয়া হয়, কিন্তু একই সাথে ঐ আচরণকে অর্থাৎ এ ধরনের প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টাও আমাদের চালিয়ে যাওয়া উচিত।
স্টিভেন পিঙ্কারও তাঁর বইয়ের ৩১১ পৃষ্ঠায় বলেন যে কানাডীয়রা আমেরিকানদের মতো একই টিভি শো দেখে কিন্তু কানাডায় অপরাধজনিত হত্যার হার আমেরিকার ১/৪ ভাগ মাত্র। তার মানে সহিংস টিভি শো দেখে দেখে আমেরিকানরা সহিংস হয়ে উঠেছে – এই সনাতন ধারণা ঠিক নয়। আমাদের দেশে আমরা প্রায়ই বলি ‘হিন্দি ছবি দেখতে দেখতে পোলাটা বখে গেছে’ কিংবা বলি ‘ছোটবেলায় বাবা মা পিস্তল জাতীয় খেলনা কিনে দেয়াতেই আজকে পোলা মাস্তানি করে বেড়াচ্ছে’।
কিন্তু এ ধরনের ‘বিশ্লেষণ’ আসলে কতটুকু বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে তুলে ধরে? সত্যি বলতে কী- ‘জেনেটিক ডিটারমিনিজম’ ঠেকাতে আমরা নিজের অজান্তেই ‘কালচারাল ডিটারমিনিজমের’ আশ্রয় নিয়ে নেই। খুন-খারাবির পেছনে জেনেটিক কোনো প্রভাব থাকতে পারে, এটা অস্বীকার করে আমরা দোষারোপ করি ছোটবেলার খেলনাকে। কিংবা ধর্ষণের পেছনে পর্নোগ্রাফিকে।
কিন্তু এই মনোভাবও যে আসলে উন্নত কোনো কিছু নয় তা ম্যাট রীডলী তার ‘এজাইল জিন’ বইয়ে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে ‘সাংস্কৃতিক নির্ণয়বাদ বংশাণু নির্ণয়বাদের মতোই ভয়ঙ্কর হতে পারে’[৪৬]। একই কথা বলেছেন নারীবাদী ডারউইনিস্ট হেলেনা ক্রনিন তার ‘মানব প্রকৃতির সঠিক পরিচিতি’ প্রবন্ধে একটু অন্যভাবে- ‘কেউ যদি বংশাণু নির্ণয়বাদকে ভয় পায়, তবে তার একই কারণে পরিবেশ নির্ণয়বাদকেও ভয় পাওয়া উচিত’[৪৭]। পিঙ্কারও তার বইয়ে সহিংসতা নিয়ে আমাদের সনাতন ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, এ সমস্ত শিশুরা যুদ্ধ বা সহিংস খেলনার সাথে পরিচিত হবার অনেক আগেই সহিংস প্রবণতার লক্ষণ দেখায়।
কাজেই শিশুরা আসলে আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা যেরকমভাবে অনাদিকাল থেকে শিখিয়ে আসছেন সেরকম ব্ল্যাঙ্ক স্লেট হয়ে জন্মায় না কখনই। আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের গবেষণার আলোকে অনেক ক্ষেত্রেই এর স্বপক্ষে সত্যতা পাওয়া গেছে। তারপরেও ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট’ ডগমা আমাদের মানসপট আচ্ছন্ন করে আছে বহু কারণেই। বাংলায় ‘ব্ল্যাঙ্ক স্লেট ডগমাকে’ খণ্ডন করে মানব প্রকৃতির উপর জৈববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা একেবারেই নেই বললেই চলে। মুক্তান্বেষার ২য় সংখ্যায় (জানুয়ারী ২০০৮) প্রকাশিত ‘মানবপ্রকৃতি কি জন্মগত নাকি পরিবেশগত?’ নামের প্রবন্ধটি এ দিক দিয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বলা যায়।
পাঠকদের মনে হয়তো চিন্তা আঁকিবুকি করতে শুরু করেছে এই ভেবে যে, এবটের মতো উদাহরণগুলো যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তো আমাদের কপালে ঘোর ‘খারাবি’ আছে। সব কিছু যদি ‘জিন’ই নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে তবে তো তা আমাদের ‘জেনেটিক ডিটারমিনেজম’ বা বংশাণু নির্ণয়বাদের দিকে ঠেলে দেবে। চিন্তা করে দেখুন সবকিছু যদি জিনেই লেখা থাকে তাহলে আর আমাদের চেষ্টা করেই বা কি লাভ? ‘জিনেই লেখা আছে ছেলে বড় হয়ে সিরিয়াল কিলার হবে’, আর ‘মনোবিকারগ্রস্ত মানুষদের স্বভাব পরিবর্তন করা যায় না’ – তা তো উপরেই দেখলাম। এই আপ্তবাক্যদ্বয় মেনে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে আর ভাগ্যবাদীদের সাথে পার্থক্য থাকল কোথায়?
না রসিকতা করছি না একেবারেই। আমার এই কথাকে হাল্কা কথা ভেবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলে কিন্তু ভুল হবে। আমি হাল্কাভাবে ভাগ্যের কথা বললেও জেনেটিক্সের এই সমস্ত নতুন দিক বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই একদল ‘বিশেষজ্ঞ’ মানুষের আচার ব্যবহার, আনন্দ, হাসি কান্না, দুঃখ যাবতীয় সবকিছুকেই ‘জিনের’ মধ্যে খুঁজে পাওয়া শুরু করে দিলেন।
এক দিকে রইলো ব্ল্যাঙ্ক স্লেটওয়ালারা যারা সবকিছু পরিবেশ বদল করেই সমাধান করে ফেলতে চান, আর আর অন্যদিকে তৈরি হলো আরেক চরমপন্থি ‘জেনেটিক ডিটারমিনিস্ট’-এর দল যারা পরিবেশ অস্বীকার করে সব কিছু বংশাণু দিয়েই ব্যাখ্যা করে ফেলেন। এই গ্রুপের একদল আবার আরও এক কাঠি সরেস হয়ে ‘জিন কেন্দ্রক ভাগ্যবাদ’ কিংবা ‘বংশাণু নির্ণয়বাদ’ প্রচার করা শুরু করে দিলেন। যেমন, জিনোম প্রজেক্ট শেষ হবার পর পরই ডাবল-হেলিক্সের আবিষ্কারক অধ্যাপক জেমস ওয়াটসন বলা শুরু করলেন—
আগে মানুষ ভাবত আকাশের তারায় বুঝি ভাগ্য লেখা আছে। এখন মানুষ বুঝবে, ভাগ্য তারায় লেখা নেই, তার ভাগ্য লেখা রয়েছে জিনে!
কিন্তু সত্যই কি তাই? ব্যাপারটা কি এতই সরল? ওয়াটসনের কথা মতো মানুষের সমস্ত ভাগ্য কি তাহলে জিনেই লেখা আছে?
ভালোবাসা কারে কয়
৪৩.↑ Jack Henry Abbott, In the Belly of the Beast: Letters From Prison, Vintage, 1991
৪৪.↑ উৎসাহী পাঠকেরা বিটিকে সিরিয়াল কিলার ডেনিস রেডারের উপর একটা ডকুমেন্টারী দেখতে পারেন এখান↑ থেকে।
৪৫.↑ Joann Ellison Rodgers, Sex: A Natural History, W. H. Freeman, 2002
৪৬.↑ ‘Cultural determinism can be as cruel as genetic determinism’, Quoted from Agile Gene, Matt Ridley, 2003
৪৭.↑ Helena Cronin, Getting Human Nature Right; John Brockman (Editor), Science at the Edge, Union Square Press, 2008