২) প্রকৃতিতে মাইক্রো-বিবর্তন ঘটতে দেখা গেলেও ম্যাক্রো-বিবর্তন ঘটার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাঃ
এই (কু)যুক্তিটি বিবর্তনবাদের বিরােধীদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়, তারা সুযােগ পেলেই এই ব্যাপারটাকে সামনে নিয়ে আসেন। শুধুমাত্র বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তারা এটা বলেন বললে বােধ হয় পুরােটা বলা হয়। ম্যাক্রো-বিবর্তনের ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝে ওঠার জন্য বিবর্তনবাদের গভীরে যতটুকু ঢােকা দরকার। সেটা তারা করেন না, কিন্তু তারা জানেন যে, ম্যাক্রো-বিবর্তনের মাধ্যমে পূর্বসুরী প্রজাতি থেকে নতুন। প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে হাজার, লক্ষ কোটি বছর লেগে যেতে পারে। এ তাে আর চোখের সামনে ঘটতে দেখা যায় না, তাই এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুব সহজেই সংশয় সৃষ্টি করা সম্ভব – আর সেটারই সুযােগ নেন তারা।
প্রজাতির সংজ্ঞা কি? বিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুলভাবে প্রচলিত সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রজাতি হচ্ছে এমন এক জীবসমষ্টি যারা নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম, তারা অন্য প্রজাতির সাথে প্রজননগত দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। আমরা চোখের সামনেই ঘটছে বিবর্তন অধ্যায়ে উদ্ভিদের মধ্যে বেশ অল্প সময়েই এ ধরণের নতুন প্রজাতি উৎপন্ন হতে দেখেছি, রিং বা চক্রাকার প্রজাতির মধ্যে ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার ফলে নতুন ধরণের প্রজাতি তৈরী থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রজাতি তৈরীর উদাহরণও দেখেছি।
এখন বিবর্তনবাদের বিরােধীরা বলতে শুরু করবেন, এই সব ক্ষেত্রেই তাে এক ধরণের উদ্ভিদ থেকে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন উদ্ভিদ বা টিকটিকি থেকে আরেক ধরণের টিকটিকিই তৈরী হচ্ছে, এমন তাে নয় যে বানর থেকে মানুষ বা ডায়নােসর থেকে পাখি বা জলহস্তীর মত স্থলচর জীব থেকে সমুদ্রের দৈত্যাকার মাছ তিমি উৎপন্ন হয়ে যাচ্ছে – যে ধরণের ব্যাপার স্যাপারগুলাে বিবর্তনের মাধ্যমে ঘটে বলে বিজ্ঞানীরা দাবী করেন। হুমম্, অবশ্যই একটি যৌক্তিক প্রশ্ন।
বিবর্তনবাদের পিছনে যে বিজ্ঞান কাজ করছে তা বুঝলে প্রশ্নটার উত্তর একটু কঠিন হলেও অবােধ্য হওয়ার কথা নয়। বিভিন্ন সময় আগের অধ্যায়গুলােতে এই বিষয়গুলাে নিয়ে বারবার আলাপ করা হলেও তাদেরকে একসাথে করে বিস্তারিতভাবে না হয় আরেকবার প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া যাক। আগের লেখায় বিবর্তনের তত্ত্ব নিয়ে অনেক আলােচনা করেছি, এখন আর বেশী তত্ত্ব কথায় না গিয়ে কিছু উদাহরণ, গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আলােচনা করা যাক।
আমাদেরকে প্রথমে বুঝতে হবে যে রাতারাতি ঘটে যাওয়া নাটকীয় কোন চটকদার পরিবর্তনের ধারণা। বিবর্তনের তত্ত্বে জায়গা পায়নি। আগেই দেখেছি আমরা যে, বিবর্তন ঘটে অত্যন্ত মন্থর গতিতে, প্রাকৃতিক নির্বাচন, মিউটেশন, জেনেটিক ড্রিফট, ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতা, বংশীয় বা জেনেটিক রিকম্বিনেশন সহ বিভিন্ন কারণে প্রজাতির মধ্যে ছােট ছােট পরিবর্তন বা মাইক্রো-বিবর্তন ঘটতে থাকে। আর বহু মাইক্রোবিবর্তনের মাধ্যমে ঘটা সম্মিলিত পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে একসময় প্রজাতি বা প্রজাতিটির একটি অংশ অন্য আরেকটি প্রজাতিতে পরিণত হয়।
অনেক বিজ্ঞানী বিবর্তনে উল্লম্ফন এবং মেগাবিবর্তনের কথা বলেন, এই উল্লম্ফনগুলােও এক প্রজন্মে ঘটে না, বিশেষ কোন সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে (যেমন, আকস্মিক কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা পরিবেশগত পরিবর্তন লক্ষ লক্ষ বছরের জায়গায় হয়তাে হাজার। হাজার বছর লাগে এই ‘তড়িৎ’ বিবর্তনগুলাে ঘটতে। ব্যাপারটা এমন নয় যে একদিন সকালে উঠে দেখা গেলাে যে, বনমানুষ থেকে এক মানব শিশু জন্ম নিয়ে ফেলেছে এবং সবাই অবাক হয়ে দাড়িয়ে তা পর্যবেক্ষণ করার সুযােগ পাচ্ছে।
যেমন ধরুন এক ধরণের বন-মানুষ থেকে প্রায় ৮০-৪০ লক্ষ বছর আগে যখন মানুষের পূর্বপুরুষদের বিবর্তন ঘটতে শুরু করে তখন খুব ধীরে হাজার হাজার বছরের বহু ছােট ছােট পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা দুই পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে শুরু করে এবং সেই সাথে সাথে ক্রমাগতভাবে তাদের মস্তিষ্কের আকারও বড় হতে শুরু করে। প্রায় ৫৫-৩০ লক্ষ বছর আগের মানুষের পূর্বপুরুষদের যে অসংখ্য ফসিল পাওয়া গেছে সেগুলাে পর্যবেক্ষণ করলে পরিষ্কারভাবে দেখা যায়, কিভাবে সময়ের সাথে সাথে ক্রমশঃ বনমানুষের চারপায়ী বৈশিষ্ট্যগুলাে বদলে যাচ্ছে এবং ফসিলগুলাে যত আধুনিক সময়ের দিকে এগিয়ে আসছে ততই আরও বেশী করে আমাদের মানুষের মত হয়ে উঠছে।
কিন্তু এই পরিবর্তনগুলাে এতই ধীরে ধীরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ঘটেছে যে কোন এক প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে তা বােঝার কোন উপায় থাকে না। সেই সময়ে আরেক গ্রহ থেকে কোন এক বুদ্ধিমান প্রাণী এসে এই পূর্বপুরুষদের দেখলে অবাক হয়ে বলতাে না, “ও আচ্ছা ওরা তাে দেখছি অর্ধেক মানুষে পরিণত হয়ে বসে আছে, এখনও গাছেও ঝুলছে, দু’পায়ের উপর ভর করে মাটিতেও হাঁটতে শিখেছে, মস্তিষ্কের আকারও আগের চেয়ে বড় হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে তাে ওদের আরও কয়েক লক্ষ বছর লেগে যাবে’!
যখন যে প্রজাতি যে অবস্থায় থাকে সেটাই তার পূর্ণাঙ্গ রূপ, সেই সময় এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ওই বৈশিষ্ট্যগুলােই তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। অতীতের দিকে তাকিয়ে, আমরা কয়েক লক্ষ বা কোটি বছরে বিবর্তিত হতে থাকা প্রাণীদের ফসিল রেকর্ড দেখে যেভাবে মধ্যবর্তী প্রজাতি বলে সনাক্ত করতে পারি, কোন এক নির্দিষ্ট সময়ে তা বােঝার কোন উপায় থাকে না, এই মধ্যবর্তী প্রজাতির ধারণাটি এখানে সম্পুর্নভাবে আপেক্ষিক। এভাবে চিন্তা করলে একদিকে যেমন বলা যায় মধ্যবর্তী ফসিল বলে কিছু নেই। আবার উল্টোভাবে সেই আদি জীবের উদ্ভবের পর সবাই আসলে কারও না কারও মধ্যবর্তী জীব।
সব উভচর প্রাণী মাছ এবং সরীসৃপের মধ্যবর্তী অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে, আবার ওদিকে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীরা উভচর এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মাঝখানের অবস্থা ধারণ করে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা সাম্প্রতিককালে আবিষ্কার করেছেন যে গত কয়েক হাজার বছর ধরে আমাদের মস্তিষ্ক ক্রমাগতভাবে আরও বড় হচ্ছে, অর্থাৎ আমরা এখনও বিবর্তিত হচ্ছি, তার মানে তাে এই নয় যে আমরা কোন মধ্যবর্তী অবস্থায় আটকে আছি। ডঃ রিচার্ড ডকিন্স তার The Ancestor’s Tale বইতে বেশ মজা করেই বলেছেন,
এই যে আমরা প্রায়ই প্রশ্ন করি ‘মানুষের প্রথম পুর্বপূরুষ কে ছিলাে’ – এটা আসলে বােকার মত একটা প্রশ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়, অত্যন্ত ধীরগতিতে ধারাবাহিকভাবে ঘটতে থাকা বিবর্তনের প্রক্রিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে এই ধরণের প্রশ্নগুলাের আসলে কোন অর্থই হয় না। বিবর্তনের দৃষ্টিতে অর্থপূর্ণভাবে প্রশ্ন করতে হলে এভাবে হয়তাে জিজ্ঞেস করা যেতে পারে, মানুষের সবচেয়ে আগের কোন পূর্বপুরুষ বা পূর্বপুরুষরা স্বাভাবিকভাবে দুই পায়ের উপর হাটতে শিখেছিলাে?’ বা ‘আমাদের কোন পূর্বপুরুষের মস্তিষ্কের আকার ৬০০ সিসির চেয়ে বড় ছিলাে? [৩]
কিন্তু এখন সমস্যা হচ্ছে এই পরিবর্তন তাে চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে না। তাহলে বিজ্ঞানীরা কি করে বলছেন যে এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির উৎপত্তি আসলেই ঘটেছিলাে? বিজ্ঞানের সব তত্ত্বই তাে শুধু চোখের সামনে দেখে প্রমাণ করা হয় না। তাহলে তাে ভূতত্ত্ববিদ্যার প্লেট টেকটনিক্স, মহাদেশীয় সঞ্চরণ থেকে শুরু করে পদার্থবিদ্যার পরমাণুর গঠন বা বিগ ব্যাং এর মত সব তত্ত্বকেই আজকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে।
সত্যি কথা বলতে কি, প্রজাতির উদ্ভব বা জীবের ম্যাক্রো-পরিবর্তনের তত্ত্বটি আজকে ফসিল রেকর্ড ছাড়াও আধুনিক বিজ্ঞানের এত শাখার সাহায্যে এত উপায়ে পরীক্ষিত যে, যারা এ নিয়ে এখনও সন্দেহ করেন তাদের পায়ের নীচে মাটি নেই বললেই চলে। পানির মাছ থেকে স্থলচর চারপায়ী প্রাণীর বিবর্তন কিংবা সরীসৃপ থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিবর্তনের প্রত্যেকটি ধারাবাহিক ধাপের একটি দুটি নয় বরং অসংখ্য ফসিল পাওয়া গেছে[৪]।
যেমন ধরুন, স্তন্যপায়ী প্রাণীর উত্তরসূরী সরীসৃপের নীচের চোয়ালে পাঁচটি পৃথক পৃথক হাড় রয়েছে, কিন্তু স্তন্যপায়ী প্রাণীর চোয়ালে রয়েছে মাত্র একটি হাড়। সরীসৃপের চোয়ালের হাড় গুলাে ধাপে ধাপে কমতে শুরু করে এবং ফসিল রেকর্ড থেকে আজকে আমরা সুনির্দিষ্টভাবে দেখতে পাই কিভাবে তা স্তন্যপায়ী প্রাণীর কানের হাড়ে রূপান্তরিত হয়েছিলাে। এই ধাপে ধাপে পরিবর্তনের সাক্ষ্য হিসেবে ফসিলবিদেরা একাধিক মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ট্রায়াসিক যুগের তথাকথিত স্তন্যপায়ী জাতীয় সরীসৃপ প্রাণীর ফসিল খুঁজে পেয়েছেন।
এদের মধ্যে এই বিবর্তনের মধ্যবর্তী ধাপের দুটি স্তরই অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে দেখা যায়[২], এদের রয়েছে দু’টো চোয়ালের জয়েন্টঃ একটি হচ্ছে ক্রমশঃ ছােট হতে থাকা সরীসৃপের চোয়াল আরেকটি হচ্ছে নতুন ধরণের চোয়াল। পরবর্তীতে ট্রায়াসিক যুগের শেষের দিকে দেখা যায় যে, সরীসৃপের চোয়ালটির কাজ ধীরে ধীরে বদলে কানের হাড়ে পরিণত হচ্ছে।
আজ পর্যন্ত আমরা এই বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছি, একারণেই কিছু চিবানাের সময় আমরা কানের ভিতরে চোয়ালের হাড়ের নাড়াচাড়া আনুভব করতে পারি। এই প্রত্যেকটি বিষয়ের উপর হাজারাে বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য প্রমাণ সহ শয়ে শয়ে বই লেখা হয়েছে। এ ‘Vertebrate Evolution বা ‘Evolution of Mammals’ লিখে www.amazon.com নামের অনলাইন বইয়ের সাইটে সার্চ দিলেই এই সব বিষয়ের উপর গবেষণারত বিজ্ঞানীদের লেখা গাদি গাদি বইয়ের নাম বেরিয়ে পড়বে।
এটা কি একটা শুধুই কাকতলীয় ব্যাপার যে, ফসিল রেকর্ডে উভচর প্রাণীর উৎপত্তির আগে কোন সরীসৃপের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না, বা সরীসৃপের আগে কোন স্তন্যপায়ী প্রাণীর ফসিল খুঁজে পাওয়া যায় না? এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে যে, এখন পর্যন্ত এমন কোন স্তরে এমন একটি অদ্ভুত ফসিল পাওয়া যায়নি যা দিয়ে বিবর্তন তত্ত্বের ধারাবাহিকতাকে ভুল প্রমাণ করা যায়। আজকে বিজ্ঞানীরা বলছেন মানুষ এক ধরণের বনমানুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে, এখন যদি দেখা যায় বন মানুষ জাতীয় প্রাইমেট তাে দুরের কথা স্তন্যপায়ী প্রাণী উৎপন্ন হওয়ার অনেক আগে সেই ক্যামব্রিয়ান যুগেই মানুষের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে, তাহলেই তাে বিবর্তনের তত্ত্ব ভেঙ্গে পড়ার কথা।
যারা বিবর্তনবাদের বিরােধিতা করেন তাদের একবার ভেবে দেখা দরকার কেনাে আজ পর্যন্ত যত হাজার হাজার ফসিল পাওয়া গেছে তার একটিও ভুল স্তরে পাওয়া যায়নি! এক কোষী প্রাণী, বহু কোষী প্রাণী, মাছ, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ফসিলগুলাে তাদের বিবর্তনের ধারাবাহিক স্তর ছাড়া অন্য পূর্ববর্তী কোন স্তরে হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠে না কেনাে। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী হ্যালডেন একবার বলেছিলেন কেউ যদি প্রিক্যামব্রিয়ান স্তরে একটি খরগােশের ফসিল খুঁজে পায় তাহলে তিনি বিবর্তনবাদে আর আস্থা রাখবেন না।
আমি ‘মিসিং লিঙ্কগুলাে আর মিসিং নেই’ অধ্যায়ে পাখি, তিমি মাছ, মানুষ এবং চারপায়ী স্থলচর প্রাণীদের মধ্যেবর্তী ফসিলগুলাে নিয়ে আলােচনা করেছি। স্থলচর প্রাণী থেকে পানিতে অভিযােজিত হয়ে সম্পূর্ণ এক নতুন ধরণের প্রজাতি তিমি মাছে পরিণত হওয়ার বিস্তারিত সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করেছি সেখানে। এই তিমির বিবর্তনটা বেশ গােলমেলে, বিজ্ঞানীরা প্রায় কয়েকশাে বছর ধরে ব্যাপারটা নিয়ে হিমশিম খেয়ে শেষ পর্যন্ত খুব সাম্প্রতিককালে রহস্যটার কুলকিনারা করতে পেরেছেন।
ব্যাপারটা যেহেতু বেশ একটু অন্যরকম তাই ম্যক্রো-বিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে এখানে এটাকেই বেছে নিচ্ছি বিস্তারিত আলােচনার জন্য। দেখা যাক তাহলে এই বৈজ্ঞানিক আবিস্কারটির পিছনে কতগুলাে ছিলাে বিজ্ঞানীদের কল্পনার তুলিতে আঁকা ছবি এবং মনগড়া ব্যাখ্যা আর কতগুলাে এসেছিলাে ফসিল রেকর্ড, জেনেটিক্স বা আণবিক জীববিজ্ঞানের মত বিজ্ঞানের আধুনিক শাখাগুলাে থেকে পাওয়া প্রমাণগুলাের অত্যন্ত পুখানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ থেকে।
এই বিশাল বপুর তিমি মাছগুলাে বেশ অদ্ভুত। আমরা আর সব মাছের মতই এই গভীর সমুদ্রে বাস করা প্রাণীটাকে ‘মাছ’ই বলি কিন্তু এদের সাথে মাছের বৈশিষ্ট্যের মিল খুব কম বললেই চলে। সেই ১৬৯৩ সালে ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ জন রে তিমিকে ডাঙ্গার স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সাথে লিপিবদ্ধ করেছিলেন, ডারউইনের আগের বিজ্ঞানীরা ভেবে কুল কিনারা পাননি এই তিমিগুলাে কি স্তন্যপায়ী প্রাণীর পুর্বপুরুষ নাকি তারা তাদের উত্তরসুরী! ডারউইন যখন বললেন যে তিমিগুলাে ভালুকের মত কোন প্রাণী থেকে বিবর্তিত হলেও তিনি অবাক হবেন না তখন এটি নিয়ে এমনই হাসাহাসি করা হয়েছিল যে, তিনি তার Origin of species বই এর পরের সংস্করণ থেকে তা বাদই দিয়ে দিয়েছিলেন[৪]।
এরপরেও বিভিন্ন বিজ্ঞানী তিমি মাছের বিবর্তন নিয়ে হিমসিম খেয়েছেন, তাদের শরীরের বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গগুলাে যে তাদের মাটি থেকে পানিতে বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে তা তাে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। তিমির দেহে এখনও রয়ে গেছে পাঁজরের এবং পায়ের হাড়ের অংশবিশেষ, তাদের কানের পাশে এখনও বেশ কয়েকটি মাংশপেশী রয়ে গেছে যেগুলাে শুধুমাত্র কান নাড়ানাের জন্য প্রয়ােজন হতে পারে (কিছু কিছু স্থলচর স্তন্যপায়ী প্রাণী তা করে থাকে) , বেলুগা জাতের তিমিতে এখনও লুপ্তপ্রায় বহির্কণের অংশ রয়ে গেছে যেগুলাে গভীর সমুদ্রে বাস করা জীবের কোন কাজেই আসতে পারে না[১১]।
১৯৪৫ সালে জর্জ গেলর্ড সিম্পসন লিখেছিলেন যে, এই তিমিরা হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত এবং তার জানা ফসিল রেকর্ড থেকে তিমির উৎপত্তি এবং শ্রেনীবিভাগ করা একধরণের অসম্ভবই বলতে হবে [৬]। কিন্তু এরপরপরই ১৯৫০ সালে বিজ্ঞানীরা জৈব-রাসায়নিক পরীক্ষা করে জানালেন যে, তারা সেরাম প্রােটিনের তুলনামুলক পরীক্ষার ফলাফল থেকে দেখতে পাচ্ছেন যে Cetacea জাতের অন্তর্ভুক্ত তিমি মাছের সাথে Artiodactyla (এই অর্ডার বা বর্গের মধ্যে জোড় সংখ্যক আঙ্গুল বিশিষ্ট গরু, হরিণ, জলহস্তী ইত্যাদি রয়েছে) জাতের প্রাণীদের সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্য রয়েছে [৬]।
কিন্তু ১৯৬৬ সালে ভ্যান ভ্যালেন আবার তিমিকে Mesonychid condylarths নামক বিলুপ্ত এক মাংশাসী স্তন্যপায়ী প্রাণীর উত্তরসুরী বলে সনাক্ত করেন। ৭০ এর দশকে আমেরিকান ফসিলবিদ ডঃ ফিলিপ গিরিচ (Philip D. Gingerich) এবং তার দল তিমির পুর্বপুরুষের বেশ কয়েকটি প্রাচীন ফসিল খুঁজে পান মিশর এবং পাকিস্তানে[৯]। প্রায় পাঁচ কোটি বছরের পুরনাে Pakicetus নামক (তিমির বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের ছবিগুলাের জন্য ‘মিসিং লিঙ্কগুলাে আর মিসিং নেই’ অধ্যায়টি দেখুন) এক ধরণের স্থলচরী স্তন্যপায়ী প্রাণীর ফসিল পাওয়া যায় যার কানের হাড় গুলাে তিমির মত হলেও করােটিটি দেখতে কুকুর জাতীয় প্রাণীর মত।
তারপর তারা আরেকটু পরের সময়েয় ফসিল খুঁজে পেলেন যার পায়ের পাতা হাসের পায়ের পাতার মত ছড়ানাে, কিন্তু পাগুলাে তখনও হাটা বা সাতারের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তারা মজা করে এর নাম দিয়েছিলেন Walking and swimming whale। তারপর পাওয়া গেলাে পরবর্তী স্তরের প্রাণী Rodhocetus -এর ফসিল, যারা ইতােমধ্যেই পানিতে সম্পূর্ণভাবে অভিযােজিত হয়ে গেছে, এদের নাকের ছিদ্র সরে গেছে অনেক পিছনে (আধুনিক তিমির মত তার পিঠের যে ছিদ্র থেকে পানি উৎক্ষেপন করে তার প্রায় অর্ধেক পথ দুরে), পাগুলাে হয়ে গেছে অনেকটা ফ্লিপারের মত।
তিমির বিবর্তনের ধারাবাহিকতার চিত্রটি যেনাে ফুটে উঠতে শুরু করেছে চোখের সামনে। ফিলিপ গিরিচ-এর দল তখন ভাবছেন আর কয়েকটি ফসিল পেলেই তারা প্রমাণ করে ফেলতে পারবেন যে তিমি আসলেই Mesonychid থেকেই বিবর্তিত হয়েছে [৭], [৮]। কিন্তু এর মধ্যে আবার আণবিক জীববিদেরা ডিএনএ সংকরায়ন এবং অন্যান্য পরীক্ষা থেকে জানালেন যে, মাংশাসী Mesonychid নয় বরং ক্ষুরবিশিষ্ট তৃণভােজী Artiodactyla দের সাথেই তিমির সবচেয়ে বেশী জেনেটিক সাদৃশ্য আছে বলে মনে হচ্ছে। গিজরিচ-এর দল তখন আবার ফিরে গেলেন পাকিস্তানের নতুন এক জায়গায় আরও নতুন ফসিল আবিষ্কারের আশায়।
শেষ পর্যন্ত বহুদিনের গবেষণার পর তাঁরা Artiocetus clavis এবং Rodhocetus balochistanensis-এর বিভিন্ন ফসিল খুঁজে পেলেন যাদের কঙ্কাল, গােড়ালীর হাড় এবং জয়েন্ট এবং করােটি থেকে বেশ পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে যে তিমির পুর্বপুরুষেরা আসলে তৃণভােজী ক্ষুরবিশিষ্ট জলহস্তীর পুর্বপুরুষ থেকেই বিবর্তিত হয়েছিলাে।
বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত আধুনিক তিমির পাঁচটি মধ্যবর্তী স্তর খুঁজে পেয়েছেন তার মধ্যে Rodhocetus (এবং Artiocetus)-এর বেশ কয়েকটি প্রায়-সম্পূর্ণ ফসিল পাওয়া গেছে, Basilosaurus এবং Doruden-এরও একাধিক সম্পূর্ণ ফসিল পাওয়া গেছে [৭]। বিজ্ঞানীরা কয়েক দশকের গবেষণার পর তিমির ম্যাক্রোবিবর্তন নিয়ে সিদ্ধান্তে পৌছাতে শুরু করেছেন, এর পিছনে যে অক্লান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণা, ক্রস পরীক্ষা, তথ্য এবং সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে তা জানলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না।
ফিলিপ গিরিচ Paleobiology, জার্নালের ২০০৩ সালের ২৯.৩ সংস্করণে প্রকাশিত রিসার্চ পেপারে তার আবিষ্কার এবং সেই সাথে অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণের বিস্তারিত বর্ণনা করে যে উপসংহার টানেন, তা আমি এখানে ইংরেজীতে হুবহু তুলে দিচ্ছিঃ
“The fossils we know well support the idea of a unidirectional trend of increasing aquatic adaptation through Rodhocetus and Dorudon stages of whale evolution. However, superimposed on this is simultaneous change in locomotor adaptation involving a distinct reversal of specialization, from hindlimb-dominated swimming in Rodhocetus, to lumbusand tail-dominated swimming in Dorudon.
Thus the overall pattern is neither simple nor direct. It is common to see microevolutionary histories zig-zag back and forth through time as they reverse themselves to track changing opportunities, and the land-to-sea transition of early whales provides a macroevolutionary example.”
বিবর্তনের পথ ধরে
২.↑ Gould SJ, 1994, Evolution as Fact and Theory.
৩.↑ Dawkins R, 2004, The Ancestor’s Tale, A pilgrimage to the dawn of evolution, Houghton Miffin Company, Boston, New york, p 86.
৪.↑ Futuyma, DJ, 2005, Evolution, Sinauer Associates, INC, MA, USA, p 76.
৬.↑ Gingerich PD, 2005 . Cetacea. In K. D. Rose and J. D. Archibald (eds.), Placental mammals: origin, timing, and relationships of the major extant clades, Johns Hopkins University Press, Baltimore, pp. 234-252. http://www-personal.umich.edu/~gingeric/PDFfiles/PDG432_rosearch_cetacea_opt.pdf
৭.↑ Gingerich PD, Research on the Origin and Early Evolution of Whales (cetacea)
৮.↑ Gingerich PD, 2003, The Land to Sea Transition in early Whales, Paleobiology, 29(3), pp.429-454
৯.↑ Was Darwin Wrong, 2004, National Geographic, November issue.