এক নজরে এই বিশাল সময় ধরে প্রাণের বিবর্তনের ধারাটিকে তুলে ধরার জন্য নীচের টেবিলটিতে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা এবং বিভিন্ন যুগে প্রাণের বিবর্তনের প্রধান ঘটনাগুলাের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল। কয়েকটি বিভিন্ন ধরণের ভূতাত্ত্বিক সময়ক্রমের প্রচলন থাকলেও বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে বহুলভাবে ব্যবহৃত ছকটাই এখানে তুলে ধরা হল। সেই প্রাণের উৎপত্তি শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কতদিন এই যুগগুলাে টিকে ছিলাে তার একটা মােটামুটি সময়সীমা এবং সেই সময়ে প্রাণের বিবর্তনের প্রধান ঘটনাগুলাে দেখানাে হলাে নীচের সারণিতে।
সারনি ৭.৩ : এক নজরে ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা এবং বিবর্তনের প্রধান ঘটনাগুলাে [২]
এই আপেক্ষিক সময় নিরূপণ বা ডেটিং পদ্ধতি দিয়ে মােটামুটিভাবে একটা আপেক্ষিক বয়স নির্ধারণ করা গেলেও কোন একটা ফসিলের আসল বয়সটা কত তা তাে আর বলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্য বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত। পরম ডেটিং পদ্ধতি দিয়ে আজকে আমরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বলে দিতে পারি কত বছর আগে কোন শীলাটি তৈরি হয়েছিলাে, পৃথিবীর বয়স কত এবং কোন একটা ফসিলেরই বা বয়সটা কত! আর এর জন্য প্রধানত রেডিওমেট্রিক বা তেজস্ক্রিয় ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আপেক্ষিক ডেটিং ঘটনাগুলােকে তাদের ক্রমানুসারে সাজিয়ে দেয় আর তেজস্ক্রিয় ডেটিং তাদেরকে বেঁধে দেয় নির্দিষ্ট সময়ের ছকে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, হিসেব নিকেশ করে সুনির্দিষ্ট বয়সটাই যদি বলে দেওয়া যায় তবে আর আপেক্ষিক বয়স নিয়ে মাথা ঘামানাে দরকারটা কি!
আসলে শুনতে যতটা সহজ শােনায় ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়, ভূপৃষ্ঠের সব শীলা বা ফসিলের বয়স এই তেজস্ক্রিয় ডেটিং পদ্ধতি দিয়ে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, তাই সেসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের আপেক্ষিক ডেটিং এর আশ্রয় নিতে হয়। আর তা ছাড়া, এই কোটি কোটি বছরের পুরনাে শীলা বা ফসিলের বয়স বের করাটা তাে আর কোন মুখের কথা নয়, এর জন্য বিজ্ঞানীদের বহু রকমের পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়। অনেক সময়ই বিজ্ঞানীরা একাধিক পরম এবং আপেক্ষিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তবেই নিশ্চিতভাবে একটা ফসিলের বা শীলার বয়স নির্ধারণ করতে পারেন। একদিক থেকে চিন্তা করলে স্বীকার করতেই হয় যে, আমরা এ ব্যাপারে বেশ সৌভাগ্যবান, এত ধরণের পদ্ধতি না থাকলে বিজ্ঞানীরা বারবার ক্রস-নিরীক্ষণ করে এতাে আস্থা নিয়ে হয়তাে বয়সগুলাে বলে দিতে পারতেন না।
সুনির্দিষ্টভাবে সময় নির্ধারণের জন্য প্রয়ােজন ছিলাে একধরণের ভূতাত্ত্বিক ঘড়ির, যা আমাদেরকে বলে দিবে পৃথিবীর বিভিন্ন শীলাস্তরের কবে তৈরি হয়েছিলাে আর কোন প্রাণী বা উদ্ভিদের ফসিলটির বয়সই বা কত। আর বিজ্ঞানীরা সেটাই খুজেঁ পেলেন বিভিন্ন ধরণের তেজস্ক্রিয় (Radioactive) পদার্থের মধ্যে, এই ভূতাত্ত্বিক ঘড়িগুলােকে বলা হয় রেডিওমেট্রিক ঘড়ি। কারণ, তারা প্রাকৃতিক তেজস্ক্রিয়তার মাপ থেকে। আমাদেরকে সময়ের হিসেব বলে দেয়। পদার্থের তেজস্ক্রিয়তার ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝতে হলে। আমাদেরকে একটু জীববিদ্যার আঙিনা পেরিয়ে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার উঠোনে পা রাখতে হবে।
আধুনিক বিজ্ঞান আজকে এমনি এক অবস্থায় চলে এসেছে যে, তার এক শাখা আরেক শাখার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে, কোন এক শাখার মধ্যে গন্ডীবদ্ধ থেকে পুরােটা বােঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে। দাঁড়িয়েছে। সে যাই হােক, চলুন দেখা যাক, এত যে আমরা অহরহ তেজস্ক্রিয়তা, তেজস্ক্রিয় ক্ষয় (Radioactive decay) অথবা রাসায়নিক বা নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার কথা শুনি তার মুলে আসলে কি। রয়েছে। চট করে, খুব সংক্ষেপে, একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক অণু পরমাণুর গঠন এবং তাদের মধ্যে ঘটা বিভিন্ন বিক্রিয়া এবং তেজস্ক্রিয়তার মূল বিষয়টির উপর।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও কিন্তু আমরা ভেবে এসেছি যে, কোন পদার্থের পরমাণু অবিভাজ্য, তাকে আর কোন মৌলিক অংশে ভাগ করা যায় না। একশােটির মত মৌলিক পদার্থ রয়েছে – লােহা, সােনা, অক্সিজেন, ক্লোরিন বা হাইড্রোজেনের মত মৌলিক পদার্থগুলাের পরমাণুই হচ্ছে তার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম অংশ, একে আর ছােট অংশে ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান আমাদেরকে নিয়ে গেছে জ্ঞানের এক নতুন দিগন্তে। আমরা এখন জানি যে, প্রত্যেকটি মৌলিক পদার্থের পরমাণুই ইলেকট্রন, প্রােটন এবং নিউট্রনের সমন্বয়ে তৈরি। পরমাণুর মাঝখানে কেন্দ্রে রয়েছে নিউক্লিয়াস যা প্রােটন এবং নিউট্রনের সমন্বয়ে তৈরি আর তার চারপাশের অক্ষে ঘুরছে ইলেকট্রনগুলাে। নিউট্রনের কোন চার্জ নেই, সে নিরপেক্ষ, ইলেকট্রন ঋণাত্মক আর প্রােটন ধনাত্মক চার্জবিশিষ্ট্য। সাধারণতঃ একটি পরমাণুতে ইলেকট্রন, প্রটোনের সংখ্যা
সমান থাকে বলে তাদের ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক চার্জ কাটাকাটি হয়ে তার মধ্যে নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মৌলিক পদার্থগুলাের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে আমরা যে আকাশ পাতাল পার্থক্য দেখি তার কারণ আর কিছুই নয়, তাদের পরমাণুর ভিতরে ইলেকট্রন, প্রােটন এবং নিউট্রনের সংখ্যার তারতম্য। অর্থাৎ সােনার পরমাণু বা নিউক্লিয়াস কিন্তু সােনা দিয়ে তৈরি নয়, তাদের মধ্যে সােনার কোন নাম গন্ধও নেই। অক্সিজেন বা হাইড্রোজেন বলুন, সােনা বলুন, রূপা বলুন, হেলাফেলা করা তামা বা সীসাই বলুন সব মৌলিক পদার্থই এই তিনটি মুল কণা, ইলেকট্রন, প্রােটন এবং নিউট্রনের সমন্বয়েই গঠিত।
লােহার সাথে সােনার পার্থক্যের কারণ এই নয় যে তার নিউক্লিয়াস সােনার মত দামী বা চকচকে কণা দিয়ে তৈরি। এর কারণ তাদের পরামাণুর ভিতরে এই মুল কণাগুলাের সংখ্যার পার্থক্য- সােনার নিউক্লিয়াসে রয়েছে ৭৯টি প্রােটন এবং ১১৮টি নিউট্রন; আর ওদিকে লােহার নিউক্লিয়াসে রয়েছে ২৬টি প্রােটন এবং ৩০টি নিউট্রন। একই ধরণের ব্যাপার দেখা যায় আমাদের ডিএনএ-এর গঠনের ক্ষেত্রেও। মানুষ, ঘােড়া, ফুলকপি বা আরশােলার জিনের উপাদানে তাদের আলাদা আলাদা কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাবে না, তারা সবাই ডিএনএ-এর সেই চারটি নিউক্লিওটাইডের (A=adenine, G= guanine, C=cytosine T=thymine) বিভিন্ন রকমফেরে তৈরি [৫]।
আমাদের চারদিকে আমরা যে সব পদার্থ দেখি তার বেশীরভাগই যৌগিক পদার্থ, সাধারণভাবে বলতে গেলে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থগুলাের মধ্যে ইলেকট্রন বিনিময়ের ফলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেই এই যৌগিক পদার্থগুলাের উৎপত্তি হয়। একটা ইলেকট্রন কণা শুষে নিয়ে একটা প্রােটন কণা নিউট্রনে পরিণত হয়ে যেতে পারে, আবার ঠিক উলটোভাবে একটা নিউট্রন তার ভিতরের একটি ঋণাত্মক চার্জ বের করে দিয়ে পরিণত হতে পারে প্রােটন কণায়। কিন্তু শুনতে যতটা সােজা সাপ্টা শােনাচ্ছে ব্যাপারটা আসলে কিন্তু ঠিক সেরকম নয়। এ ধরণের পরিবর্তন সম্ভব শুধুমাত্র নিয়ক্লিয়ার বা পারমাণবিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে।
এর জন্য প্রয়ােজন হয় বিশাল পরিমাণ শক্তির (Energy), আর তাই যে কোন পারমাণবিক বিক্রিয়া থেকে যে শক্তি নির্গত হয় তার সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কোন তুলনাই করা সম্ভব নয়। সাধারণ বােমার চেয়ে নিউক্লিয়ার বােমা বহুগুণ শক্তিশালী। হিরােসিমায় পারমাণবিক বােমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা তাই আমাদেরকে স্তম্ভিত করে দেয়। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসের গঠন বদলে যায়, কিন্তু রাসায়নিক বিক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের কোন পরিবর্তন ঘটে না। আর ঠিক এ কারণেই সেই আরবীয় আলকেমিষ্টরা বহু শতকের চেষ্টায়ও অন্য ধাতুকে সােনায় পরিণত করতে পারেননি, কারণ এর জন্য প্রয়ােজন ছিলাে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার। প্রায় হাজার বছর আগে, সে সময়ে পরমাণুর গঠন বা পারমাণবিক বিক্রিয়ার কথা জানা না থাকায় তারা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেই মৌলিক ধাতুর পরিবর্তনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন যুগ যুগ ধরে [৫]।
বিবর্তনের পথ ধরে
২.↑ http://www.actionbioscience.org/evolution/benton.html
৫.↑ Dawkins, R, 2004, The Ancester’s tale, Houghton Miffin Company, NY, Boston: USA, pp 516-523.