বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি গ্রীসের নিকটবর্তী ঐতিহাসিক ক্রীট দ্বীপে (এই ক্রীট দ্বীপের সাথেই প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা মহেঞ্জোদারাের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলাে বলে ধারণা করা হয়) খুঁজে পেয়েছেন আদিম দানবাকৃতি হাতি Deinotherium Giganteum-এর ফসিল[৩]। এই প্রকান্ড ১৫ ফুট লম্বা, সারে চার ফুট দাঁতওয়ালা স্তন্যপায়ী প্রাণীটাকে আজকের আধুনিক হাতীদের দুঃসম্পর্কের খালাতাে ভাই হিসেবে ধরা যেতে পারে। আদি থেকে এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বুকে হেটে বেড়ানাে বিশালতম প্রাণীদের মধ্যে এরা অন্যতম।
আজকের যুগের বিজ্ঞানীরা যখন মাথার মাঝখানে বিশাল গােলাকৃতি গর্তসহ এদের মাথার খুলির ফসিল খুঁজে পান তখন তারা বহু অভিজ্ঞতার আলােকে ধরে নেন যে এখানে নিশ্চয়ই লম্বা একটা শুড়ই ছিল। কিন্তু ভেবে দেখুন তাে কয়েক হাজার বছর আগের আমাদের পূর্বপুরুষদের কথা – পাহাড়ের গায়ে, নদীর পাড়ে বা মাটি খুঁড়ে ভাঙ্গাচোরা, আংশিক ফসিলগুলাের হাড়গােড়ের মধ্যে হঠাৎ করে এধরনের একটা দানবীয় মাথা ছুঁড়ে বেরােলে এমনিতেই তাে তাদের চমকে ওঠার কথা, তার উপরে আবার যদি দেখা যায় সেই মাথার মাঝখানে এক বিশালাকার গর্ত, তাহলে তাকে একচোখা রাক্ষস হিসেবে কল্পনা করা ছাড়া আর কিইবা উপায় খােলা থাকে তাদের সামনে?
গ্রীক রূপকথায় বর্ণিত ভয়ানক মানুষ খেকো একচোখা দৈত্য সাইক্লোপের উৎপত্তি যদি এখান থেকেই ঘটে থাকে তাহলেও আবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা প্রাচীন কাব্যকার হােমারের গল্পেও এই একচোখা দৈত্য সাইক্লোপের কথা শুনতে পাই। ক্রীট দ্বীপের আশেপাশের এলাকায় এধরণের অনেক বিশাল বিশাল আদিম প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেছে, তাই অনেক গবেষক মনে করেন যে, এ অঞ্চলে তৈরি হওয়া মিথগুলাের সাথে হয়তাে এদের একটা সম্পর্ক ছিলাে।
ড্রাগনের অস্তিত্ব দেখা যায় পৃথিবীর অনেক দেশের রূপকথায়ই, তবে চীন দেশের রঙবেরঙের, মুখ থেকে আগুনের ফুলকি ছােটানাে, বিভিন্ন ধরণের ড্রাগনের গল্পই বােধ হয়। সবচেয়ে বেশী শােনা যায়। দুই হাজার বছরেরও আগে খ্রীষ্ট পূর্ব ৩০০ শতাব্দীতে চ্যাং কুর লেখায় আমরা যে ডাগনের হাড় খুঁজে পাওয়ার গল্প শুনি তাও মনে হয় ডায়নােসরের ফসিলই ছিলাে। পাশাপাশি রাখা ডায়নােসরের ফসিল এবং আমাদের পুর্বপুরুষদের কল্পনার তুলিতে বানানাে ড্রাগনের মধ্যে মিল দেখে এরকম সন্দেহ জাগাটাই বােধহয় স্বাভাবিক। এমনকি মধ্যযুগেও চীন থেকে শুরু করে ইউরােপের বিভিন্ন জায়গায় দাঁতের ফসিল গুড়ো করে সর্বরােগের নিরামক হিসেবে ওষুধ বানানাের রেওয়াজ ছিলাে।

ইউরোপে মনে করা হতাে যে, এই ফসিলগুলাে নূহের প্লাবনে ভেসে যাওয়া মৃত প্রাণীদের ধ্বংসাবশেষ। অনেকেই ধারণা করেন যে, ভুমধ্যসাগরীয় এবং মধ্যপ্রাচ্যীয় অঞ্চলে বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণীর ফসিল পাওয়া যেতাে বলেই প্রাচীনকালে সেখানকার মানুষের মনে মহাপ্লাবনের ধারণাটা বদ্ধমূল হয়ে যায়। তারা বিশ্বাস করতাে একসময় নিশ্চয়ই সমগ্র পৃথিবীটাই পানির নীচে ডুবে গিয়েছিলাে, না হলে পাহাড়ের উপরে, উচ্চভূমির পাথরের বুকে কেনাে এতাে সামুদ্রিক প্রাণীর ধ্বংসাবশেষ বা ফসিল খুঁজে পাওয়া যাবে! আর সেখান থেকেই শুরু হয় নুহের মহাপ্লাবনের কল্পকাহিনী।
এখন আমরা আধুনিক ভূতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে বুঝতে পারছি যে, বিভিন্ন সময়ে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের পানির লেভেল ওঠানামা করলেও এধরনের পৃথিবীব্যাপী মহাপ্লাবন আসলে কখনই ঘটেনি। তবে অবাক করা কান্ড হচ্ছে যে, প্রথমবারের মত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই নুহের মহাপ্লাবনের ধারণাটিকে প্রত্যাখ্যান করে দেন যে ব্যক্তি তিনি। আর কেউ নন আমাদের সেই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী লিওনারদো দ্য ভিঞ্চি[৪]। হ্যা, মােনালিসার চিত্রকর দ্য ভিঞ্চিকে আমরা সাধারণত একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হিসেবে গণ্য করলেও জ্ঞান বিজ্ঞানে তার বহুমুখী প্রতিভার কথা সর্বজনবিদিত। লিওনারদো দ্য ভিঞ্চির জীবনীকার জর্জিও ভাসারি তার বহুমুখী প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন —
তার এতই বিরল ধরণের প্রতিভা ছিলাে যে তিনি যাতেই মনােনিবেশ করতেন তাতেই পান্ডিত্য অর্জন করে ফেলতেন।
তিনি এতদিকে তার প্রতিভার উন্মেষ না ঘটালে হয়তাে একজন। সেরা বৈজ্ঞানিক হতে পারতেন। সে যাই হােক, এই কালজয়ী ব্যক্তির প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আসছি, আগে দেখা যাক তার পূর্বপুরুষেরা ইতিহাসের কোথায় কখন কিভাবে ফসিলের কথা উল্লেখ করে গেছেন।

কখন মানুষ প্রথম ফসিলের সংস্পর্শে আসে তা হয়তাে আমাদের কখনই আর জানা হবে না। লিখিত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কয়েকজন গ্রীক দার্শনিক তাদের লেখায় ফসিলের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সমসাময়িক ধর্মীয় উপকথার উপর ভিত্তি করে লেখা হলেও প্রথম প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষ এবং পৃথিবীর উৎপত্তির কথা শােনা যায় গ্রীক দার্শনিক আনাক্সিম্যন্ডারের (Anaximander, 611 – 546 B. C.) কাছ থেকে।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে যে, সেই প্রাচীনকালেই তিনি মনে করতেন বিশ্বব্রহ্মান্ডকে কেউ সৃষ্টি করেনি, এর উৎপত্তি হয়েছে বিবর্তনের ফলে! প্রাণের উৎপত্তির পিছনে রয়েছে ভিজা স্যাঁতস্যাঁতে এক ধরণের বস্তু, যা সুর্যের তাপে শুকিয়ে গিয়ে প্রাণ তৈরি করেছে এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীর মতই মানুষের উৎপত্তি হয়েছে মাছ থেকে [৬]। তিনি ফসিলের সংস্পর্শে এসেছিলেন কিনা তা জানা না গেলেও পরবর্তীতে, তার শিষ্য জেনােফেন (Xenophanes of Colophon, death 490 B.C) তার এই ধারণাগুলাের বিস্তৃতি ঘটান, তিনিই প্রথমবারের মত পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়ে ফসিলের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তার মতে পৃথিবীর জন্ম হয়েছিলাে পানির ঘনীভবন এবং আদিম কাঁদার মেলবন্ধনে।
প্রাচীন গ্রীক ইতিহাসবিদ, হেরােডােটাসও (Herodotus (484 425 B.C.) শামুকসহ বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক প্রাণীর শেল বা খােলসের ফসিল দেখে সিধান্তে আসেন যে- মিশর দেশ একসময় পানির নীচে নিমজ্জিত ছিল। তিনি মােকাত্তাম নামের আরবের এক উপত্যকায় বর্ণনাতীত রকমের বিশাল আকারের মেরুদন্ডওয়ালা সাপের ফসিলের কথাও উল্লেখ করেন। এছাড়াও আরও কয়েকজন গ্রীক দার্শনিকের লেখায়ও আমরা ফসিলের কথা দেখতে পাই। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তি হলেন বিখ্যাত প্রাচীন গ্রীক ডাক্তার হিপােক্রিটস (Hippocrates of Cos 460-357 B.C) যিনি নিজে একজন ফসিল সংগ্রাহক ছিলেন। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় তার বিখ্যাত মেডিকেল স্কুলের ভিতর থেকে আদিম হাতীর দাঁতের ফসিলও পাওয়া গেছে[৫]।
তবে লিওনারদো দ্য ভিঞ্চি সেই পনেরশাে শতাব্দীতে যে বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন ইতিহাসে তার জুড়ি মেলা ভার। তিনি নিজে ইতালির মিলান শহরের সরকারি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন, কিন্তু তার প্রতিভার স্ফুরণ দেখা যায় ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে শুরু করে চিত্রকলা, শারীরস্থানবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, ভুগােল, জোতির্বিদ্যা এমনকি ফসিলবিদ্যা পর্যন্ত। তিনিই বােধ হয় প্রথম আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ফসিলের ব্যাখ্যা দেন। ইঞ্জিনিয়র হিসেবে কাজ করার সময় তাকে প্রায়শই পাহাড়ের গা কেটে সুরঙ্গ বা রাস্তা বানাতে হত। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে, পাহাড়ের স্তরীভুত শীলাগুলাে বিভিন্ন সময়ের তলানি থেকে উৎপত্তি হয়ে বিভিন্ন স্তরের জন্ম দিয়েছে, তাই আমরা সবসময়ই পাহাড়ের গায়ে বা মাটিতে বিভিন্ন স্তর Strata) দেখতে পাই।
অদ্ভুত ব্যাপার হল, তিনি সে সময়ই স্তরের পর্যায়ক্রম বা উপরিপাতন (Superposition) এর ব্যাপারগুলাে বুঝতে পেরেছিলেন, যার ব্যাখ্যা পেতে পেতে আমাদের আরও প্রায় দু’শাে বছর লেগে গিয়েছিলাে! ১৬৬৯ সালে ডেনিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস ষ্টোন প্রথম উপরিপাতন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হাজির করেন। স্তরীভুত পাললিক শিলার সবচেয়ে নীচের স্তরটা হচ্ছে সবচেয়ে পুরনাে, আর তার উপর ক্রমান্বয়িকভাবে একটার পর একটা স্তর তৈরি হয়েছে, তাই স্তরে স্তরে খুঁজে পাওয়া ফসিলগুলাে থেকে আমরা বিভিন্ন যুগের জীবদের অস্তিত্ব কিংবা বিলুপ্তির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারি।
দ্য ভিঞ্চি বুঝেছিলেন যে, ফসিলগুলাে আসলে পৃথিবীর আদিম জীবদের নিদর্শন এবং পাহাড়ের গায়ে যে সামুদ্রিক সব প্রাণীর ফসিল দেখা যাচ্ছে তার কারণ আর কিছুই নয়, একসময় আসলে এই পাহাড় গুলাে সমুদ্রের নিচে ছিল। তবে বিশ্বব্যাপী প্লাবণের ধারণাটার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তাকেই প্রথম আমরা বলতে শুনি যে, বিশ্বব্যাপী নুহের প্লাবণের কাহিনীটা একটা অসম্ভব ঘটনা, সারা পৃথিবীই যদি পানির নিচে ডুবে যাবে তাহলে এই পরিমাণ পানি সরে গেলাে কোথায়। আর এই ফসিলগুলাে কোনভাবেই বন্যায় ভেসে যাওয়া প্রাণীদের দেহাবশেষ হতে পারে না, কারণ সব কিছু বানের জলে ভেসে গেলে তাদের বিস্তীর্ন এলাকাজুড়ে এলোমেলোভাবে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকার কথা, তারা এ ভাবে সুগঠিতভাবে মাটির স্তরে স্তরে সাজানাে থাকতে পারতাে না[৪]।
তারপর আমরা আঠারশাে শতাব্দীর শেষ দিকে এবং উনিশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ‘Age of enlightment এর ফসিল সংগ্রহের অনেক কাহিনীই শুনতে পাই। এদিকে ফসিলবিদ্যার জনক জর্জ কুভিয়ে এবং ভূতত্ত্ববিদ্যার জনক উইলিয়াম সিথ শীলার গঠন, স্তর এবং সেই অনুযায়ী ফসিলের বিন্যাসেরও বিস্তারিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন। কিন্তু তখনও পর্যন্ত কুভিয়ে থেকে শুরু করে সব বিজ্ঞানীই বাইবেলের জ্ঞানানুযায়ী ছয় হাজার বছর বয়সের পৃথিবী এবং নুহের প্লাবনের মত কাহিনীগুলােকে বাস্তব সত্য বলে মেনে নিয়ে তাদের কাজ চালিয়ে গেছেন।
তার ব্যতিক্রম আমরা প্রথম দেখলাম জেমস হাটনের ব্যাখ্যায় যিনি বললেন, একটা কোন বড় ধরণের দূর্যোগ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের সৃষ্টি হতে পারেনা, এর পিছনে রয়েছে অত্যন্ত লম্বা সময় ধরে ধীরে ধীরে ঘটা পরিবর্তন। আমরা তৃতীয় অধ্যায়েই এই বিষয়ে হাটন এবং পরবর্তীতে চালর্স লায়েলের অবদানের কথা নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছিলাম; এর উপর ভিত্তি করেই আসলে ডারউইন পরবর্তীতে বিবর্তনের তত্ত্ব প্রস্তাব করতে সক্ষম হন।
ফসিলের ইতিহাসের গল্প বলতে গিয়ে ফসিল জিনিসটা আসলে কী তাই এখনও বলা হয়ে ওঠেনি। আবার ওদিকে ফসিলের ব্যাপারটা পুরােপুরি বুঝতে হলে আরও কয়েকটা বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়ােজন। আপনারা খেয়াল করেছেন বােধ হয় যে, ফসিল নিয়ে আলােচনা করতে গেলে প্রায়শই ভূতাত্ত্বিক সময়সীমা এবং বিভিন্ন যুগ বা পিরিয়ডের কথা এসে পড়ছে। এই যুগগুলােকে ঠিকমত না বুঝলে ফসিলের গুরুত্ব এবং অর্থও ঠিকমত বােঝা সম্ভব নয়।
পৃথিবীর এই বিভিন্ন স্তরগুলাে বুঝতে হলে তারা কিভাবে উৎপত্তি হল তার সম্পর্কেও একটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়ােজন, আর সেখানেই চলে আসে প্লেট টেকটনিক্স এবং মহাদেশীয় সঞ্চরণের প্রসঙ্গ। ওদিকে আবার ফসিলগুলাের বয়স কিভাবে আধুনিক উপায়ে সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হয় সেটা বুঝতে হলে দরকার তেজস্ক্রিয় কার্বন ডেটিং সহ বিভিন্ন ধরণের ডেটিং প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিতি। এই বিষয়গুলােকে নিয়েই লেখার আশা রইলাে পরবর্তীতে
বিবর্তনের পথ ধরে
৩.↑ Mayell H, 2003, Cyclops Myth Spurred by One-Eyed Fossils?, National Geographic News↑
৫.↑ Evolution and Paleontology in the Ancient World↑
৬.↑ Bertrand Russel, 1946, History of Western Philosophy, p 36.