১৮৩৭ থেকে ১৮৫৮ – দীর্ঘ ২০ বছর! ডারউইন মনােনিবেশ করলেন তার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায়। লােকজনের সাথে বেশী মেশেন না, নিজের মনে গাছপালা, পােকা মাকড় নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। এমনকি লন্ডন থেকে ১৬ মাইল দুরে বাড়ি কিনে পরিবার নিয়ে উঠে আসেন নিরিবিলিতে সময় কাটানাের জন্য। কিন্তু বারবারই অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকলেন তিনি, সে এক অদ্ভুত অসুস্থতা, প্রায়ই শরীরটা খারাপ থাকে, মাথা ব্যথা, পেটের অসুখ কখনই নাকি পিছ ছাড়ে না। কোন ডাক্তারই অসুখটা কি তা ধরতে পারেন না। অনেকেই এখন মনে করেন যে তার অসুখটা হয়তাে ছিলাে নিতান্তই মানসিক, এত বড় একটি আবিষ্কারকে নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখার অসহ্য ভার আর বইতে করতে পারছিলেন না তিনি।
খুব সাবধানে এবং গােপনে কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন তিনি। ভূতত্ত্ব এবং জীববিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের উপর বই প্রকাশ করতে থাকলেও তার এই বিবর্তনের উপর কাজ সম্পর্কে লায়েল, হুকার, বা হাক্সলির মত দুই চারজন বিজ্ঞানী বন্ধু ছাড়া আর কাউকে কিছু জানাতেন না তিনি। বিবর্তন যে ঘটছে তা সম্পর্কে নিশ্চিত হলেও কি প্রক্রিয়ায় তা ঘটছে বা এর চালিকাশক্তি কি হতে পারে তা সম্পর্কে তখনও কোন নির্দিষ্ট ধারণায় পৌঁছাতে পারেননি। সিদ্ধান্ত নিলেন, বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত তথ্য প্রমাণসহ একটি তত্ত্ব আবিষ্কার করতে না পারা পর্যন্ত কোনভাবেই এই আবিষ্কারের কথা জনসমক্ষে প্রচার করবেন না। তাই পরবর্তী বিশ বছর ধরে তিনি অত্যন্ত গভীর অধ্যাবসায়ের সাথে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলাে চালিয়ে যেতে থাকলেন।
১৮৫৮ সালে অপ্রত্যাশিত একটি চিঠি এসে পৌঁছায় ডারউইনের হাতে। তার ভিতরে ছিলাে আলফ্রেড ওয়ালেসের (১৮২৩-১৯১৩) বিবর্তন নিয়ে লেখার একটি পান্ডুলিপি। ডারউইন বিস্ময়ের সাথে দেখলেন যে আজকে ২০ বছর ধরে যে তত্ত্ব নিয়ে তিনি গােপনে কাজ করে আসছেন তা মাত্র তিন বছরেই ওয়ালেস আবিষ্কার করে ফেলেছেন। তিনি অত্যন্ত আশাহত মনে সিদ্ধান্ত নিলেন যে এখন পর্যন্ত করা সব কাজ ধ্বংস করে ফেলবেন। কিন্তু এরপর বন্ধুদের অনুরােধে শেষ পর্যন্ত ‘On the origin of species by means of Natural Selection’ বা ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ বইটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকাশ করে ফেলতে রাজী হলেন।
তখনই ঠিক করা হয় যে, ১৮৫৮ সালে লন্ডনের লিনিয়ান সােসাইটির এক অধিবেশনে ডারউইনের এবং অ্যালফ্রেড ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩) এর বিবর্তন তত্ত্ব আলাদা আলাদাভাবে প্রস্তাব করা হবে। অনেকে মনে করেন প্রজাতির উৎপত্তি বইটিতে ডারউইন যেভাবে অগুনতি উদাহরণ, পর্যবেক্ষণ এবং সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ওয়ালেস তার ধারে কাছেও যেতে পারেন নি। ডারউইন এত বিস্তারিতভাবে বইটি না লিখলে শুধুমাত্র ওয়ালেসের লেখা দিয়ে যুগান্তকারী এই বিবর্তনবাদ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা পেতে পারতাে না। ওয়ালেস নিজেই পরবর্তীতে ‘ডারউইনবাদ’ নামক একটি বই লেখেন এবং তাতে বিবর্তন তত্ত্বের মূল কৃতিত্ব যে ডারউইনেরই, তা স্বীকার করে নেন ।
এখন তাহলে দেখা যাক ডারউইন এমন কি সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন বিবর্তনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে, যার ফলে জীববিজ্ঞানের ইতিহাসের মােড় ঘুরে গেলাে চিরতরে। তিনি তার সময়ের থেকে এতখানিই অগ্রগামী ছিলেন যে, তার এই আবিষ্কারের প্রমাণ পেতে বিজ্ঞানীদের আরও প্রায় এক শতক সময় লেগে গেলাে! ডারউইন দেখলেন, হাজার হাজার বছর ধরে কৃষকেরা এবং পশু পালকেরা কৃত্রিম নির্বাচনের (Artificial Selection) মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বাড়িয়েছে, গৃহপালিত পশুর মধ্যে প্রয়ােজন মত বিভিন্ন জাতের প্রাণীর সৃষ্টি করেছে।
সে সময়ে জীববিজ্ঞান কিংবা এর শাখা জেনেটিক্স সম্পর্কে কিছুই না জেনেও, তারা শুধুমাত্র বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সঠিকভাবেই বুঝেছিলাে যে, অনেক বৈশিষ্ট্য বংশগতভাবে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। যেমন, যে ধানের গাছের জাত থেকে অনেক বেশী বা উন্নত মানের ধান উৎপন্ন হয়, ক্রমাগতভাবে শুধু সে ধরনের ধানের বীজই যদি চাষের জন্য নির্বাচন করা হয় তাহলে এক সময় দেখা যাবে শুধু উন্নত মানেরই ধান উৎপন্ন হচ্ছে।
যে গরু বেশী দুধ দেয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যদি শুধু সেই ধরনের গরুকেই বংশবৃদ্ধি করতে দেওয়া হয় তাহলে এক সময় দেখা যাবে যে পুরাে গরুর পালের মধ্যেই গড়পড়তা দুধ দেওয়ার পরিমান বেড়ে গেছে। তার মানে কয়েক প্রজন্মের প্রচেষ্টায় ক্রমাগতভাবে সতর্ক, কৃত্রিম নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমন জাতের পশু বা উদ্ভিদ তৈরি করা সম্ভব যাদের মধ্যে শুধু কাক্ষিত বৈশিষ্ট্যগুলােই দেখা যাবে। এক সময় তাদের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যগুলাে এত বেশী হয়ে যায় যে তারা সম্পূর্নভাবে এক নতুন প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদে পরিণত হয়ে যেতে পারে, যার সাথে তাদের পূর্বপুরুষের প্রজনন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবেই মানুষ হাজার বছর ধরে বুনাে নেকড়েকে পােষ মানিয়ে কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে বিভিন্ন জাতের কুকুরের বিবর্তন ঘটিয়েছে[৪]। এখন যদি অন্য কোন গ্রহ থেকে কেউ আমাদের এই পৃথিবীতে এসে প্রথমবারের মত বিভিন্ন রকমের কুকুরগুলােকে দেখে, তাহলে তাদের পক্ষে কোনভাবেই অনুমান করা সম্ভব হবে না যে এরা এক সময় সবাই নেকড়ে প্রজাতির বংশধর ছিলাে[৪]। ফার্মের মােটা মােটা মুরগী বা বিশাল বিশাল মাংসওয়ালা অস্ট্রেলিয়ান গরুগুলােকে দেখে আমাদের যে ভিমরি খাওয়ার জোগাড় হয় তাদেরকে এভাবেই কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে (এখন অবশ্য অনেক ধরনের কৃত্রিম পদ্ধতি এবং ওষুধ ব্যবহার করা হয়ে থাকে)।

তার মানে মানুষ কৃত্রিমভাবে নির্বাচন করে নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি করে আসছে সেই অনাদি কাল থেকেই! ডারউইন দেখলেন, এরকম কৃত্রিমভাবে নির্বাচিত প্রজননের মাধ্যমে তার আশে পাশে মানুষ প্রায় ১০ রকমের কবুতর তৈরি করেছে। এদের মধ্যে পার্থক্য এতখানিই যে, প্রকৃতিতে আগে থেকে দেখতে পেলে এদেরকে খুব সহজেই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি বলে ধরে নেওয়া হত[৩]। তাহলে কি প্রকৃতিতেও এমনই কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ঘটছে?

ডারউইন আরও লক্ষ্য করলেন, আমাদের চারপাশের উদ্ভিদ এবং প্রাণীরা যে পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করে তার বেশীরভাগই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে না। একটা পুরোপুরি বড় হওয়া কড মাছ বছরে প্রায় ২০ থেকে ৫০ লাখ ডিম পাড়ে, একটি মেপল বা আম বা জাম গাছে হাজার হাজার ফুল এবং ফল ধরে, কিন্তু এর বেশীরভাগই পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করার আগেই মৃত্যুবরণ করে, আমাদের দেশের ইলিশ মাছের কথাই চিন্তা করে দেখুন না। সমুদ্র থেকে নদীগুলােতে এসে তারা কি হারে ডিম পারে আর তাদের মধ্যে কটাই বা শেষ পর্যন্ত পুর্ণাঙ্গ মাছে পরিণত হয়ে টিকে থাকতে পারে।
বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখিয়েছেন যে একটা কড মাছের ডিমের ৯৯% ই প্রথম মাসেই কোন না কোন ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, বাকি যা বেঁচে থাকে তার প্রায় ৯০% জীবনের প্রথম বছরেই কোন না কোনভাবে মৃত্যুবরণ করে[৮]। ডারউইনও এই একই জিনিস দেখিয়েছেন হাতীর বংশবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে। অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় হাতীর বংশবৃদ্ধির হার তুলনামুলকভাবে খুবই কম, কিন্তু তারপরও একটা হাতী তার জীবনে যে ক’টা বাচ্চার জন্ম দেয় তার মধ্যেও সবগুলি শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে না। ডারউইন হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, হাতী অন্য সব প্রাণীর তুলনায় সবচেয়ে কম বংশবৃদ্ধি করেও তার ৯০-১০০ বছরের জীবনে প্রায় ৬ টি বাচ্চার জন্ম দিতে পারে। অর্থাৎ যদি সবগুলাে বাচ্চা বেঁচে থাকে তাহলে এক জোড়া হাতী থেকে ৭০০-৭৫০ বছরে প্রায় ১৯০ লক্ষ হাতীর জন্ম হবে[৮]।
প্রকৃতিতে প্রায় সব জীবই এরকম বাড়তি শিশুর জন্ম দিয়ে থাকে, একটা ব্যকটেরিয়া প্রতি ২০ মিনিটে বিভক্ত হয়ে দুটো ব্যকটেরিয়ায় পরিণত হয়, হিসেব করে দেখা গেছে যে এরা সবাই বেঁচে থাকলে এক বছরে তারা বংশ বৃদ্ধি করে সারা পৃথিবী আড়াই ফুট উচু করে ঢেকে দিতে পারতাে। একটা ঝিনুক কিংবা কাছিম একবারে লাখ লাখ ডিম ছাড়ে, একটা অর্কিড প্রায় ১০ লাখ বীজ তৈরী করতে পারে[৩]। মানুষের জনসংখ্যার কথাই চিন্তা করা যাক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের এতখানি উন্নতি ঘটার আগে অর্থাৎ মাত্র একদেড়শাে বছর আগেও শিশু মৃত্যর হার ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশী। (আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে, কৃত্রিমভাবে আমরা এখন একদিকে জন্ম নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছি, অন্যদিকে শিশু আধুনিক চিকিৎসার কল্যানে মৃত্যুর হারও কমিয়ে আনতে পেরেছি)।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, এভাবেই সব জীব যদি বংশবৃদ্ধি করতে থাকতাে, অর্থাৎ একেকটা জীব তার সারা জীবনে যতগুলাে ডিম বা বাচ্চার জন্ম দিতে সক্ষম তার সব গুলাে যদি টিকে থাকতাে তাহলে এতদিনে পৃথিবীতে আর কারােরই থাকার ঠাঁই হতাে না। আসলে খেয়াল করলে দেখা যায় যে, প্রকৃতিতে ঠিক এর উল্টোটা ঘটছে – সংখ্যার দিক থেকে যত উদ্ভিদ বা প্রাণীর জন্ম হয় বা বেঁচে থাকে, তার তুলনায় তাদের বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতা বহু গুণ বেশী। শেষ পর্যন্ত এর মধ্যের ছােটটো একটা অংশই শুধু বড় হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। যে কোন প্রজাতি হঠাৎ করে অনেক বেশী হারে বংশবৃদ্ধি করে ফেলতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের বিস্তৃতি প্রাকৃতিক নিয়মেই বন্ধ হতে হবে। কারণ, তাদের সবার বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমান খাদ্যের বা অন্যান্য সম্পদের প্রয়ােজন তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ডারউইন ভাবলেন, তাহলে প্রকৃতিতে প্রাণের এই বিশাল অপচয় এবং বাড়তি বংশবৃদ্ধির (Prodigality of Reproduction বা Over Production) ব্যাপারটার অবশ্যই কোন ব্যাখ্যা থাকতে হবে!
শুধু যে আমাদের চারপাশে অনেক বাড়তি প্রাণের জন্ম হয় তাই তাে নয়, প্রত্যেক প্রজাতির জীবের নিজেদের মধ্যেই আবার অসংখ্য ছােট বড় পার্থক্য দেখা যায়। মানুষের কথাই ধরুন না, আমাদের একজনের সাথে আরেক জনের তাে কোন মিল নেই। গায়ের রং এ পার্থক্য, চোখের রং এ, আকারে পার্থক্য, দেখতে একেক জন একেকরকম, কেউ বা বেশী দিন বাঁচে, কেউ বা কম, কাউকে বেশী রােগে ধরে, কাউকে কম, কারও গায়ে বেশী শক্তি আবার কারও কম – এমন হাজারতর পার্থক্য।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা এর বিভিন্নরকম উদাহরণ দেখেছিলাম। বংশ পরম্পরায় বিভিন্ন প্রজাতির শিশুরা তাদের বাবা-মার থেকে বিভিন্ন রকমের বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে, যৌন পদ্ধতি থেকে জন্মানাে এই প্রতিটি প্রাণী বা উদ্ভিদ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। এর ফলে যে কোন প্রজাতির জনসংখ্যার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রচুর পরিমানে পার্থক্য বা প্রকারণ দেখা যায় । সে সময় জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যার আবিষ্কার না হওয়ায় ডারউইন প্রকারণ সম্পর্কে সঠিক ধারণায় পৌঁছুতে পারেন নি, কিন্তু তিনি এই সব পর্যবেক্ষণ থেকে সঠিকভাবেই সিধান্তে আসেন যে, প্রকৃতিতে সবসময় খাদ্য, বেঁচে থাকা, জায়গা, সঙ্গী নির্ধারণ, আশ্রয়, এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে একধরনের প্রতিযােগিতা চলতে থাকে।
এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলতে থাকে একই ধরনের প্রজাতির ভিতরের প্রতিটি জীবের মধ্যে এবং এক প্রজাতির সাথে আরেক প্রজাতির মধ্যে। আবার প্রতিটি জীবের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য বা প্রকারণের কারণে এই অনন্ত প্রাকৃতিক সংগ্রামে কেউ বা সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়ে বেশীদিন টিকে থাকতে সক্ষম হয়, আর অন্যরা আগেই শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রতিটি জীবের মধ্যে প্রকৃতি তুলনামুলকভাবে বেশী উপযুক্ত বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের টিকিয়ে রাখে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে,
একটা নির্দিষ্ট পরিবেশে সংগ্রাম করে যারা টিকে থাকতে সক্ষম হয়, তারাই শুধু পরবর্তী প্রজন্মে বংশধর রেখে যেতে পারে, এবং তার ফলে তাদের বৈশিষ্ট্যগুলােরই পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে অনেক বেশী প্রকটভাবে দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ, যে কারণগুলাে তাদের পরিবেশের সাথে অপেক্ষাকৃত বেশি অভিযােজনের (Adaptation) ক্ষমতা রাখে, তাদের বাহক জীবরাই বেশীদিন টিকে থাকে এবং বেশী পরিমানে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এভাবে প্রকৃতি প্রতিটা জীবের মধ্যে পরিবেশগতভাবে অনুকূল বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের নির্বাচন করতে থাকে এবং ডারউইন প্রকৃতির এই বিশেষ নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন ( Natural Selection)
ডারউইনের সময় বিজ্ঞানীদের বংশগতিবিদ্যা (Genetics) সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। জীবাশ্মবিদ্যা (Paleontology) বা ফসিল রেকর্ডও তখন তেমন জোড়দারভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভাবতেও অবাক লাগে ডারউইন কিভাবে এই সব জ্ঞান ছাড়াই বিবর্তনবাদ সম্পর্কে এত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার এই বিবর্তন তত্ত্ব ইউরােপের সেই সময়ের খ্রিষ্ট ধর্মসহ অন্যান্য সব ধর্মের ভিতকেই টলিয়ে দিলাে, আদম হাওয়া থেকে শুরু করে আলাদা আলাদাভাবে প্রজাতির সৃষ্টির সব গল্পই হল পরিণত হল রূপকথায়, নুহের মহাপ্লাবনের সময় প্রজাতির নতুন করে টিকে যাওয়ার কেচ্ছা গেলাে বানের জলে ভেসে।
আগেই বলেছি, জীববিজ্ঞানে ডারউইনের মূল অবদান দু’টি, প্রথমত যুক্তি প্রমাণ উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করা যে, প্রাণের বিবর্তন ঘটছে এর উৎপত্তির পর থেকে (দ্বিতীয় অধ্যায়ে দ্রষ্টব্য) আর দ্বিতীয়তঃ এই বিবর্তন ঘটছে প্রাকৃতিক নির্বাচন নামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। হইচই পরে গেলাে সারা দুনিয়া জুড়ে ১৯৫৮ সালে ডারউইন এবং ওয়ালেস এই তত্ত্বটা প্রস্তাব করার পর। যুগে যুগে বিভিন্ন প্রজাতি বদলাচ্ছে- তা বিশ্বাস করা এক কথা, আর প্রকৃতিতে হাজারাে রকমের নতুন নতুন প্রজাতি তৈরি হচ্ছে এবং এই পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটছে সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় – কোন সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপ ছাড়াই, তা মেনে নেওয়া আরেক কথা!
সে সময়ের ইউরােপে প্রাণের উৎপত্তি সংক্রান্ত দর্শনের পুরােটাই ছিলাে বিখ্যাত ঈশ্বরতত্ত্ববাদী উইলিয়াম প্যালের (William Paley, 1743-1805) সৃষ্টিতত্ত্ববাদ দিয়ে প্রভাবিত।
তিনিই বলেছিলেন যে প্রত্যেকটা ঘড়ির যেমন একজন কারিগর থাকে তেমনি প্রত্যেকটা প্রাণের পিছনে একজন অষ্টা থাকতেই হবে। ঘড়ির মত একটা জটিল জিনিস যেমন কারিগর ছাড়া সৃষ্টি হতে পারে না তেমনি এত জটিল অংগ প্ৰত্যংগ সম্পন্ন জীবগুলােও সৃষ্টিকর্তা ছাড়া পৃথিবীতে জন্মাতে পারে না। তাই ডারউইন এবং ওয়ালেস যখন দেখলেন যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মত অন্ধ, অচেতন কিন্তু অনাকস্মিক এবং নিতান্তই একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুধু জীবের বিবর্তনই ঘটছে না, নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটছে এবং ধাপে ধাপে জটিল থেকে জটিলতর প্রাণের উন্মেষ ও বিলুপ্তি ঘটছে তখন স্বভাবতই ইউরােপের রক্ষণশীল এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাথায় যেনাে বাজ পড়লাে।
বিবর্তনের পথ ধরে
৩.↑ আখতারজ্জামান ম, ২০০২, বিবর্তনবাদ। হাসান বুক হাউস, ঢাকা, বাংলাদেশ।
৪.↑ Artificial Selection, The University of California Museum of Paleontology ↑
৮.↑ Ridley M, 2004, Evolution, BlackwellPublishing, Oxford, United Kingdom.