জিনের আলােয় ফিরে দেখা
বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স তার ‘Unweaving the Rainbow” বইতে বলেছিলেন যে, ডিএনএ হচ্ছে। ‘মৃতের জেনেটিক বই’- আমাদের পুর্বপুরুষের ইতিহাসের রােজনামচা যেন তারা। বিবর্তনবিদ্যা বলে যে, জীবের শরীরের সবকিছুই তার পূর্বপুরুষ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া। আর এদিকে ডি এন এ-র মধ্যে বিস্তারিতভাবে লেখা রয়েছে সেই কাহিনীর পূর্ণ ধারাবাহিক বিবরণী – কখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা কিভাবে বিবর্তিত হয়েছে, কোন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ করেছে, প্রজননের ইতিহাস থেকে শুরু করে কোথায় কখন কোন মিউটেশন তাদের বিবর্তনের গতিকে নিয়ে গেছে নতুন দিগন্তে – সবকিছু লেখা আছে আমাদের ডি এন এ-র ভিতরে।
প্রজননের মাধ্যমে পরের প্রজন্ম তৈরির ধারাবাহিকতা যদি ছিন্ন না হয় তাহলে ডিএনএ-এর ভিতরে লেখা তথ্যগুলাে এক অণু থেকে আরেক অণুতে, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে অবিচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। প্রতিটি জীব তার দেহকোষের ভিতরে হাজার লক্ষ এমনকি কোটি বছর ধরে এই ঐতিহাসিক তথ্য বয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা মােটে গত কয়েক দশক ধরে আণবিক জীববিদ্যার প্রভূত অগ্রগতির ফলে সঠিকভাবে ডিএনএ-এর ভিতরে লেখা এই তথ্যগুলাে পড়তে এবং বুঝতে শুরু করেছি।
ডঃ রিচার্ড ডকিন্স মনে করেন যে পৃথিবীতে যদি একটাও ফসিলের অস্তিত্ব না থাকতাে বা কেউ যদি তাদেরকে কোন ম্যাজিক করে উড়িয়ে দিত তাহলেও পৃথিবী জোড়া জীবের বিস্তৃতির প্যাটার্ণ এবং তাদের জেনেটিক তথ্য থেকেই সম্পূর্ণ বিবর্তনের ইতিহাস বর্ণনা করা সম্ভব হতাে [১১]। কথাটা শুনতে অতিরঞ্জণ বা ঔদ্ধত্য বলে মনে হলেও, আজকে একবিংশ শতাব্দীর গােড়ায় দাঁড়িয়ে, আণবিক জীববিদ্যার সাম্প্রতিক আবিষ্কারগুলােকে একটু মনযােগ দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেই বােঝা যায় যে, কথাটা আদৌ মিথ্যা নয়।
মানুষের জিনােমের সিকোয়েন্সিং বা অনুক্রমের ঐতিহাসিক প্রথম খসড়াটি প্রকাশিত হয় ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা এই প্রজেক্টে অংশগ্রহণ করেন। ২০০৩ সালে এর চুড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয় [১২]। এর কিছুদিন পরেই, ২০০৫ সালে, আমাদের বিবর্তনের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় শিম্পাঞ্জির জিনােমও পড়ে শেষ করা হয়।
(ওদিকে আবার গত কয়েক বছরে ইদুর, মৌমাছি, ইষ্টসহ বেশ কয়েকটি জীবের জিনােমের অনুক্রমও বের করা হয়েছে, www.ncbi.nih.gov/Genbank বা www.genome.ucsc.edu ওয়েব সাইটগুলােতে এখন মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি সহ বিভিন্ন জীবের জিনােমের অনুক্রমের বিস্তারিত তথ্য রাখা আছে) [১৩]। পৃথিবী জোড়া ৬৭ জন বিজ্ঞানী এই শিমাঞ্জি সিকোয়েন্সিং অ্যান্ড অ্যানালিসিস কনসােরটিয়ামে অংশগ্রহণ করেন, নেচার জার্নালের ২০০৫ সালের সেপটেম্বর ইস্যুতে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির জিনােমের তুলনামুলক বিশ্লেষণের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয় [১৩]।
ন্যাশনাল হিউম্যান জিনােম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের(NHGRI) এর ডিরেকটর ফ্রান্সিস কলিন্স এর মতে, এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস, শারিরীক গঠন, বিভিন্ন ধরণের অসুখ বিসুখের উৎপত্তি বুঝতে হলে বিবর্তনের ধারায় উদ্ভুত এবং অত্যন্ত কাছাকাছি সম্পর্কিত বিভিন্ন জীবের জিনােমের সাথে আমাদের জিনােমের তুলনামুলক ব্যাখ্যা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের জিনােমের পরীক্ষার সাথে ফসিল রেকর্ড এবং শারীরবিদ্যার তুলনামুলক ব্যাখ্যা থেকে বিজ্ঞানীরা আগে শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে যা ভেবেছিলেন তা প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। এদের বর্তমান জিনােমের মধ্যে সাদৃশ্য প্রায় ৯৯% এবং তাদের প্রােটিনের গঠনও খুবই কাছাকাছি। ডি এন এ-র সন্নিবেশন (Insertion) এবং বিলুপ্তি (Deletion) হিসাব করলে এই সাদৃশ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৬% এ।
প্রােটিন লেভেলে বিচার করলে দেখা যায় যে তাদের ২৯% জিন একই প্রােটিনের কোডিং এ নিয়ােজিত। অর্থাৎ, দু’টো মানুষের ডি এন এ তুলনা করলে যে পার্থক্য দেখা যাবে, একটা মানুষ এবং শিপঞ্জির মধ্যে সে পার্থক্যটা মাত্র ১০ গুণ বেশী, কিংবা ধরুন ইঁদুরের সাথে মানুষের যে পার্থক্য তার তুলনায় শিম্পাঞ্জির সাথে পার্থক্য ৬০ গুণ কম [১৩]! বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন যে, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জিতে কিছু কিছু জিন অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর তুলনায় ক্রমাগতভাবে দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে।
এর মধ্যে রয়েছে শব্দ শােনা এবং বােঝার জন্য প্রয়ােজনীয় জিন, স্নায়ুতন্ত্রের সংকেত আদান প্রদানের জিন, শুক্রানু তেরির জিনসহ আরও কয়েকটি জিন। এদিকে আবার দেখা যাচ্ছে যে বিবর্তনের ধারায় মানুষ এবং শিল্পঞ্জির ডি এন এ তে ইঁদুর বা খরগােশের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে ক্ষতিকর মিউটেশন ঘটেছে। তার ফলে একদিকে যেমন তাদের অসুখের পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু অন্যদিকে আবার তা তাদেরকে পরিবেশের সাথে অভিযােজিত হতে বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা মানুষের জিনােমের এই ধরণের মিউটেশনগুলাে আরও খতিয়ে দেখছেন।
শিম্পাঞ্জি, অন্যান্য প্রাইমেট বা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাথে আমাদের মিলগুলাে বােঝা যেমন দরকার ঠিক তেমনিভাবেই গুরুত্বপূর্ণ এদের সাথে আমাদের পার্থকগুলাে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পারা। তাহলেই হয়তাে আমরা বলতে পারবাে কোন কোন পরিবর্তনগুলাের ফলে আমরা মানুষে বিবর্তিত হয়েছি, কিংবা ঠিক কোন কোন বৈশিষ্ট্যগুলাের কারনে আমরা তাদের থেকে বুদ্ধিমত্তায় এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে এত আলাদা হয়ে গেছি। ইতোমধ্যেই আমরা এই ধরনের বিশ্লেষণ থেকে এমন কিছু কিছু তথ্য জানতে পেরেছি যা আমাদের স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে।
যেমন ধরুন, দেখা যাচ্ছে যে, শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের সাধারণ পূর্বসুরী থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর মানুষ Caspase- 12 নামক জিনের কার্যকরিতা হারিয়ে ফেলেছে যার ফলেই সে এখন আলজাইমারস বা স্মৃতিভ্রংশ (Alzheimer’s) রােগে আক্রান্ত হয়। এখন আমরা যদি শিম্পাঞ্জির মধ্যে এই জিনের কাজগুলােকে ঠিকমত বুঝতে পেরে আমাদের শরীরে মধ্যে তার প্রয়ােগ ঘটাতে পারি তাহলে হয়তাে এই মারাত্মক রােগটির একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিভিন্ন রােগের সাথে আমাদের জেনেটিক গঠনের বিবর্তনের ইতিহাস যে কি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত তা এখন ধীরে ধীরে আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করেছে।
বিজ্ঞানীরা জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে পাওয়া তথ্যগুলাের ক্রস পরীক্ষণ করে যত সঠিকভাবে প্রজাতির উৎপত্তি এবং বিকাশের সময়সীমা নির্ধারণ করতে পারেন ব্যাপারটা কিন্তু কয়েক দশক আগেও ঠিক এত সহজ ছিল না। ফসিল রেকর্ড পড়ার জন্য এত অত্যাধুনিক উপায়গুলাে যেমন তাদের হাতে ছিল, ঠিক তেমনিভাবে ডিএনএ বা আণবিক গঠণের তুলনামুলক বিশ্লেষণের পদ্ধতিগুলােও তখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
আজকের দিনে ব্যাপারটা কিন্তু আর সেরকম নেই। আমরা এখন যে কোন ফসিলের আবিষ্কারকে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিভিন্ন ধরণের স্বতন্ত্র পরীক্ষা দিয়ে এক বার দু’বার নয়, বহুবারই যাচাই করে নিতে পারি। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের সময়সীমা নির্ধারণের ব্যাপারটা এর এক উজ্জ্বল নমুনা। যেমন ধরুন, গত শতাব্দীর প্রথম দিকে কিন্তু মানুষের তেমন কোন মধ্যবর্তী ফসিলের সন্ধান পাওয়া যায়নি, অনেকেই তখন মনে করতেন যে, মানুষ হয়তাে অন্যান্য বনমানুষদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৫ কোটি বছর আগে।
তারপর ধীরে ধীরে যখন আরও অনেক ফসিল পাওয়া যেতে শুরু করলাে, ওদিকে আবার বিজ্ঞানীরা মানুষের সাথে ওরাং ওটাং, গরিলা, শিম্পাঞ্জির মিলগুলাে আরও ভালাে করে বুঝতে শুরু করলেন তখন মনে করা হত যে, হয়তাে দেড় কোটি বছর আগে মানুষের বিবর্তন ঘটতে শুরু করেছিল। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ডিএনএর আবিষ্কারের পর আমাদের সামনে আণবিক জীববিদ্যার গবেষণার দুয়ার খুলে যায়। এখন শুধু অতীতের ফসিল থেকেই নয়, আমাদের নিজেদের শরীরের জলজ্যান্ত ডিএনএ-র ভিতরেই আমরা পড়ে ফেলতে পারছি আমাদের বিবর্তনের ইতিহাস।
সত্তরের দশকে মানুষ এবং অন্যান্য এপদের প্রােটিনের এমাইনাে এসিডের তুলনামুলক বিশ্লেষণ করে জানা যায় যে, বিবর্তনের যাত্রায় মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির আলাদা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা ৫০ লক্ষ বছরের বেশী পুরনাে হতে পারেনা। এদিকে আবার গত তিরিশ, চল্লিশ বছরে ফসিলবিদেরা আফ্রিকা থেকে মানুষের ‘আধা’ এবং সম্পূর্ণ আদিপুরুষদের যে সব ফসিল খুঁজে পেয়েছেন তা থেকেও কিন্তু আমরা এখন একই ধরণের তথ্য পেতে শুরু করেছি।
পরবর্তীকালে করা বিভিন্ন আণবিক গবেষণা এবং ডিএনএ সংকরায়ণের ফলাফলগুলােও এই একই সময়ের কথাই বলেছে। আর এদিকে আজকের জিনােমিক্সের অত্যাধুনিক গবেষণা থেকেও আমরা এ বিষয়ে অত্যন্ত জোড়ালাে সাক্ষ্য পেতে শুরু করেছি। ২০০৬ সালের মে মাসে এমআইটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভারসিটির বিজ্ঞানীরা নেচার জার্নালে যে গবেষণাটি প্রকাশ করেন তা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি তাদের সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল ৫৪ লক্ষ থেকে ৬৩ লক্ষ বছর ।
মানুষের জিনােম: কিছু মজার তথ্য

– মানুষের জিনােমে ৪৬ টি করে ক্রোমােজোম এবং ৩ বিলিয়ন ডি এন এ বেস রয়েছে। ডি এন এর ভিতরে ৪ ধরণের বেস A, T, C এবং G রয়েছে। খুব সংক্ষপে বলতে গেলে বলতে হয়, জিন হচ্ছে এই বেসগুলাের বিভিন্ন রকমের সমন্বয়ে তৈরি ডি এন এ র অংশ যারা আমাদের শরীরের বিভিন্ন ধরণের প্রােটিনের কোড নির্ধারণ করে। ব্যাপারটা অনেকটা লিখিত ভাষার মত। কতগুলাে অক্ষর দিয়ে যেমন আমরা হাজার হাজার শব্দের জন্ম দেই তেমনিভাবে এই ৪ টি বেসের সমন্বয়েই হাজার হাজার জিনের উদ্ভব ঘটে।

– ডি এন এর মধ্যে উল্লেখিত তথ্যগুলােকে যদি কাগজে কলমে লেখা হয় তাহলে তা দিয়ে ২০০টা ৫০০ পৃষ্ঠার ডিকশেনারী ভরিয়ে ফেলা যাবে। এর মধ্যেই লেখা রয়েছে আমাদের কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরের সব তথ্যাবলী।
– মানুষের শরীরে ১০০ ট্রিলিয়ন কোষ আছে, এবং তাদের ভিতরে যে পরিমাণ ডি এন এ রয়েছে তাদের সবগুলােকে কে পাশাপাশি করে সাজালে এখান থেকে সুর্য পর্যন্ত ৬০০ বার আসা যাওয়া করা যাবে।
– মানুষের জিনােমে ২০,০০০ – ২৫,০০০ জিন রয়েছে। দু’টো মানুষের মধ্যে ডি এন এর পার্থক্য মাত্র ০.২%, অর্থাৎ, ৫০০ টি বেলের মধ্যে মাত্র একটিতে পার্থক্য দেখা যায়। আর শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের জিনােমের পার্থক্য হচ্ছে ২% এর কম [১৫]।
আগে এবং তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার ইতিহাসটি বেশ জটিল [১৪]। কিছুদিন আগেও বিজ্ঞানীরা মনে করতেন যে এই দুই প্রজাতির মধ্যে প্রজননে বিচ্ছিন্নতা ঘটেছিল ৬০-৮০ লক্ষ বছর আগে, কিন্তু এখন জেনেটিক তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, তা আসলে ঘটেছে আরও পরে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে, সম্পূর্ণভাবে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগে এই দুই প্রজাতি বা উপপ্রজাতির মধ্যে বেশ লম্বা সময় ধরে প্রজনন ঘটেছিল যা আমাদের ক্রোমােজোম X এর মধ্যে গভীর ছাপ ফেলে গেছে।
কে জানে, এ জন্যই হয়তাে আমরা এত লম্বা সময় ধরে আফ্রিকা জুড়ে ‘না-এপ না-মানুষ’ জাতীয় মধ্যবর্তী ফসিলের সন্ধান পাচ্ছি! পরবর্তীতে ফসিল রেকর্ড নিয়ে আলােচনার সময় আমরা এ বিষয়টি দেখতে পাবাে। উপরে বলা গবেষণাটিতে আরও উল্লেখ করা হয় যে, গরিলা এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের জিনােমের গবেষণা থেকে এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাবে এবং বিজ্ঞানীরা ইতােমধ্যেই তার কাজ শুরু করে দিয়েছেন [১৪]।
এবার আসা যাক আণবিক জীববিদ্যার কল্যাণে বিবর্তন তত্ত্বের একটি উল্লেখযােগ্য সংশয়ের নিষ্পত্তি কিভাবে ঘটলাে সেই গল্পে। শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাং ওটাং সবার মধ্যে ক্রোমােসােমের সংখ্যা ৪৮, হঠাৎ করেই দেখা যাচ্ছে যে, একই হােমিনয়ডিয়া দলের সদস্য হওয়া স্বত্ত্বেও, মানুষের ক্রোমােসােমের সংখ্যা হয়ে গেছে ৪৬। বিবর্তনের তত্ত্বানুযায়ী এরা যদি একই পুর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে থাকে এবং অন্যদের সবার মধ্যে ৪৮টি ক্রোমােসােমের অস্তিত্ত্ব থাকে, তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে এখন প্রশ্ন করতে হবে, মানুষের জিনােম থেকে দুটো ক্রোমােজোম কোথায় হারিয়ে গেল?
বিবর্তন তত্ত্ব যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে তাে একদিন হঠাৎ করে ক্রোমােজোম দুটো হাওয়া হয়ে যেতে পারে না, তাদের কোন না কোন রকমের চিহ্ন থাকতেই হবে মানুষের জিনােমের মধ্যে। আর যদি এ ধরণের কোন নমুনা একেবারেই না পাওয়া যায় তাহলে তাে বিবর্তনবাদের মুল বিষয়টি নিয়েই সন্দেহের অবকাশ থেকে যাচ্ছে। জীববিদরা প্রকল্প দিলেন যে, যেহেতু সব বনমানুষদের মধ্যে এখনও ৪৮টা ক্রোমােজোম আছে কিন্তু এদের দলের মধ্যে শুধুমাত্র মানুষেরই দু’টো ক্রোমােজোম কম আছে তাহলে বােঝা যাচ্ছে যে, শেষ সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর বিবর্তনের পথে চলতে চলতে কোন এক সময়ে মানুষের প্রজাতির মধ্যে আদি দু’টো ক্রোমােজোম সংযুক্ত হয়ে গিয়েছিল, যা অন্যান্য বনমানুষদের ক্ষেত্রে ঘটেনি।
শেষ পর্যন্ত, এই তাে কিছুদিন আগে, ২০০২ সালে বিজ্ঞানীরা দেখালেন যে, আসলে শিম্পাঞ্জিদের যে ১২ এবং ১৩ নম্বর ক্রোমােজোম (এখন তাদেরকে ২A এবং ২B বলে নামকরণ করা হয়েছে, নীচের ছবিতে মানুষের ক্রোমােজোম ২ এর সাথে শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাং ওটাং এর এই দুইটি ক্রোমােসােমের তুলনা দেখানাে হয়েছে) রয়েছে সে দু’টো মানুষের মধ্যে মুখােমুখীভাবে সংযুক্ত হয়ে ক্রোমােজোম ২ তৈরি করেছে [১৬]। এই দু’টো ক্রোমােজোমের সংযুক্তির বিন্দুটির গঠন নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা থেকেও মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের আরও অনেক তথ্য বের হয়ে এসেছে, কিন্তু তা নিয়ে এখানে আর আমি বিস্তারিত আলােচনায় যাচ্ছি না। আসলে এ ধরণের ক্ষেত্রগুলােতেই আমরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে বিবর্তনবাদের শক্তি এবং সঠিকতা বুঝতে পারি।

কোন সঠিক তত্ত্ব থেকে বিভিন্ন ধরণের প্রকল্প বা পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হয় যা অবৈজ্ঞানিক কোন কিছুর উপর ভিত্তি করে দেওয়া সম্ভব নয়। যেমন ধরুন, মানুষের শরীরে কোনভাবেই এই হারিয়ে যাওয়া ক্রোমােজোম টির অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়া যেত তাহলে বিবর্তন তত্ত্বের সঠিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে বাধ্য হতেন বিজ্ঞানীমহল।
এছাড়াও মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির জিনােম বিশ্লেষণ থেকে বিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্কের অত্যন্ত দ্রুত বিকাশের জন্য দায়ী জিনগুলাে, তাদের বিকাশের সময়সীমা, বিভিন্ন ধরণের প্রােটিনের গঠন, বনমানুষদের মধ্যে ঘ্রাণশক্তি লােপ এবং সেই সাথে সাথে শক্তিশালী দৃষ্টিশক্তির বিকাশের মত অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়গুলাে সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য পেতে শুরু করেছেন। এমআইটি এবং হার্ভার্ড ইউনিভারসিটির ব্রড ইনস্টিটিউটের সদস্য বিজ্ঞানী টি মিকেলসনের মতে, আগামী কয়েক বছরে আরও অনেক স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং প্রাইমেটের জিনােমের অনুক্রম বের করে ফেলা যাবে, সেখান থেকে খুব সহজেই মানুষের বিবর্তনের জন্য দায়ী বিশেষ ডিএনএর অনুক্রমগুলাে বেড়িয়ে পড়বে।
মানুষের বিবর্তনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে, যেমন ধরুন, দুই পায়ের উপড় ভর করে দাঁড়াতে পারা, মস্তিষ্কের বিবর্ধন বা জটিল ভাষাগত দক্ষতার মত বিবর্তনের বিশেষ ধাপগুলােতে কি ধরণের জেনেটিক পরিবর্তন কাজ করেছিল সেগুলাে আবিষ্কার করতে পারলে হয়তাে আমরা মানুষের বিবর্তনের একটা সম্পূর্ণ রূপরেখা তৈরি করতে পারবাে [১৩]। আবার অন্য দিকে এই জেনেটিক পরিবর্তনগুলাে তাদেরকে টিকে থাকার জন্য কি বিশেষ ধরণের সুবিধা করে দিয়েছিল – এগুলাে কি তাদের পরিবর্তনশীল পরিবেশে সাথে খাপ খাইয়ে নিতে বাড়তি সুবিধা করে দিয়েছিল নাকি দ্রুত চলাচলে বা পারস্পরিক সংযােগ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল, নাকি সামাজিকভাবে দলবদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকার ক্ষমতা যুগিয়েছিল – এই প্রশ্নগুলাের উত্তরের মধ্যেই হয়তাে লুকিয়ে রয়েছে আমাদের উৎপত্তি এবং বিকাশের দীর্ঘ ইতিহাসের রহস্য।
আর এই প্রশ্নগুলাের উত্তর লুকিয়ে রয়েছে আমাদেরই দেহকোষের ভিতরের ডিএনএ মধ্যে। এই ‘জিনের আলােয় ফিরে দেখা’ পর্বটা শুরু করেছিলাম রিচার্ড ডকিন্সের উক্তি দিয়ে, চলুন তার আরেকটা উক্তি দিয়েই এর পরিসমাপ্তি ঘটানাে যাক। তিনি ঠিকই বলেছেন,
আমরা এই পৃথিবীতে ক্ষণিকের অতিথি, আমাদের জীবনের কাজ যখন শেষ হয়ে যায় তখন আমাদের দেহটাও পৃথিবীর বুকে বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু জিনগুলাে হচ্ছে আবহমানকালের নাগরিক, তারা চিরঞ্জীব। তাদের মধ্যেই লেখা আছে আদি থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের সব কাহিনী।
বিবর্তনের পথ ধরে
১১.↑ Dawkins R, 2004, The Ancestor’s Tale, 2004. Houghton Mifflin Company, Boston, New York.
১৩.↑ New Genome Comparison Finds Chimps, Humans Very Similar At DNA Level,2005, Science Daily Magazine.
১৪.↑ Human and Chimp Genomes Reveal New Twist on Origin of Species
১৫.↑ The Human Genome: Quick Facts http://genome.wellcome.ac.uk/doc_WTD020745.html
(লিংকটি পাওয়া যায় নি। তবে রিলেটেড তথ্য পড়তে পারেন এখানে↑ এবং এখানে↑ )
১৬.↑ (i) Chimpanzee Sequencing and Analysis Consortium ,2005. “Initial sequence of the chimpanzee genome and comparison with the human genome”. Nature 437: 69-87. PDF
(iii) National Human Genome Reserach Institue4, 2005, ‘Scientists Analyze Chromosomes 2’