দ্বিতীয়তঃ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার সময় টিকে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগাের এডওয়ার্ড এন্ডার্স (Edward Anders) দেখিয়েছেন যে, ইন্টারপ্লানেটারি ধূলিকণাগুলাে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সবচেয়ে উঁচু স্তরে ধীরে ধীরে নেমে আসে। ফলে সেগুলাে তেমন একটা উত্তপ্ত হয় না। কিন্তু অন্যদিকে কিছুটা ভারী প্রস্তরখন্ড ধেয়ে আসে আক্ষরিক অর্থেই উল্কার গতিতে। ফলে তাদের উপরিভাগ প্রচন্ড তাপে গলে যায় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করার পর পরই। তবে এই তাপ উল্কাপিন্ডের অভ্যন্তরে মাত্র কয়েক মিলিমিটার পর্যন্ত ঢুকতে পারে। কাজেই প্রস্তরখণ্ডের অভ্যন্তরে অবস্থিত অণুজীবগুলাের টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির ক্ষেত্রে পতিত উল্কাপিন্ডের সম্পর্ক থাকা পুরােপুরি অসম্ভব নয়। কিন্তু উল্কাপিন্ড শুধু পৃথিবীতেই আঘাত হানে না, অন্যান্য গ্রহেও তা টুপ টাপ ঝরে পড়ছে হর হামেশা। কাজেই অন্যান্য গ্রহেও জীবনের অস্তিত্ব থাকাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না একেবারেই। মহাবিশ্বের অন্যত্র প্রাণের অস্তিত্ব থাকার এই তত্ত্ব জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল ALH84001 নামের উল্কাপিন্ডটি। গত কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা দুই ধরনের মঙ্গলের উল্কাপিন্ডকে বিশ্লেষণ করে আসছেন। এগারাে মিলিয়ন বছর আগে উল্কা বা ধূমকেতুর আঘাতে মঙ্গল থেকে বিচ্যুত একগুচ্ছ প্রস্তর খন্ড যাদেরকে বলা হয় নাখলাইট (Nakhlite) এবং এদেরও আরাে চার মিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল ত্যাগকারী উল্কাপিন্ড ALH84001.
NASA-র বিজ্ঞানী ডােনালড বােগার্ড (Donald Bogard) এবং প্রাট জনসন (Prat Johnson) প্রস্তর খন্ডের বুদ্বুদের মধ্যকার বাতাসকে অবিকৃত অবস্থায় উদ্ধার করে তাদের হিউস্টন গবেষণাগারে পরীক্ষা করেন। তারা দেখেন যে এই বাতাস মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান ভাইকিং প্রেরিত মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের সাথে পুরােপুরি মিলে যায়। কাজেই সন্দেহের কোন অবকাশ নাই যে, ALH84001 একসময় মূলত মঙ্গলেরই অংশ ছিল। ১৯৯৬ সালে নাসার বিজ্ঞানী ডেভিড ম্যাককে (David Mckay) এবং তার সহকর্মীরা উল্কাপিন্ডটির মধ্যেকার মাইক্রোস্কোপিক ব্যাক্টেরিয়ার ফসিলের আকৃতির ছবি তােলেন। বিজ্ঞানীদের অবশ্য কোনভাবেই প্রমাণ করার উপায় নেই যে, এই আকৃতি সত্যিই মঙ্গলের ব্যক্টেরিয়ার ফসিল নাকি মাইক্রোস্কোপিক প্রস্তর গঠনের বিচিত্ররূপ মাত্র।

ALH84001-এর বিস্ময়কর যাত্রা শুরু হয়েছিল মঙ্গল গ্রহ থেকে। এ গ্রহটি দীর্ঘদিন ধরেই পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার নিরিখে বিজ্ঞানীদের পছন্দের তালিকার প্রথম দিকে আছে। পৃথিবী এবং মঙ্গলসহ সৌরজগতের সব গ্রহই তৈরি হয়েছে বিশাল ধুলি মেঘ সৌর নীহারিকা (Solar Nebula) থেকে। মধ্যাকর্ষ এবং ঘূর্ণায়মান গতির কারণে ধূলিকণাগুলো কাছাকাছি এসে প্রথমে তৈরি হয়েছে নুড়ি, তারপর পাথর এবং সবশেষে বিশালাকৃতির পাথর যাকে বলা হয় “Planetesimals”.
সৌরজগতের ইতিহাসের প্রথম এক বিলিয়ন বছরে Planetesimal গুলাে একটার সাথে আরেকটার অনবরত তৈরি হয়েছে মুহুর্মুহ সংঘর্ষ। বৃহৎ বস্তুর মধ্যাকর্ষ শক্তি সংঘর্ষর্মান বড় বড় পাথরগুলােকে একত্রিত করেছে এবং এই প্রক্রিয়া সৌর নীহারিকা পুরােপুরি গ্রহজগত এবং অন্যান্য উপাদান তৈরি হওয়া পর্যন্ত চলেছে। ইতােমধ্যে হালকা গ্যাস দিয়ে তৈরি কিন্তু গ্রহগুলাের তুলনায় অনেক বেশি ভর সম্পন্ন সূর্য নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছিল সৌরজগতের কেন্দ্রে।
৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে বৃহৎ বৃহৎ প্রস্তরগুলােই কয়েকটি গ্রহে পরিণত হয়। আভ্যন্তরীণ তাপ এদেরকে আংশিকভাবে গলিয়ে ফেলে এবং মধ্যাকর্ষ এদের স্ফেরিক্যাল আকৃতি গঠন করে দেয়। মঙ্গলের পৃষ্ঠে সামান্য পরিমাণ কিছু রাসায়নিক পদার্থ রুবিডিয়াম (Rubidium), স্ট্রনটিয়াম (Strontium), আরগন (Argon), সামারিয়াম (Samarium), এবং নিওডাইমিয়াম (Neodymium) এর সংমিশ্রণে ছােট ছােট পাথরগুলাে ক্রিস্টালাইজড হয়ে যায়। ALH84001 এদেরই একজন। এই সমস্ত পদার্থের সামান্য তেজস্ক্রিয়তাই উল্কাপিন্ডের মঙ্গলের উৎস সম্পর্কে ধারণা দেয়।
মঙ্গলে পানি আছে কি নেই তা এক রহস্য। যদিও বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে বর্তমানে পানি আছে। কিনা সে সম্পর্কে সরাসরি প্রমাণ পাননি, কিন্তু মঙ্গলের ইতিহাসে কোন একসময় যে পানি ছিল সে সম্পর্কে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্কাপিন্ড ALH84001-এ কার্বনেট, সালফেট এবং হাইড্রেট এর মত রাসায়নিক যৌগ পাওয়া গেছে যা বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে শুধুমাত্র প্রস্তর খন্ডের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হলেই কেবল এগুলাে পাওয়া সম্ভব। এই যৌগগুলাে গঠিত হয়েছে যখন উল্কাপিন্ডটি মঙ্গলের অংশ হিসাবে ছিল।
এরমধ্যে মঙ্গলে উল্কাপিন্ডের আঘাতে সৃষ্ট তরঙ্গাঘাতের ফলে ALH84001 এ কিছু বুদবুদও তৈরি হয়েছে। উল্কার আঘাতে যে তাপের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে ALH84001 এর বেশ কিছু অংশ গলে যায় এবং পরবর্তীতে ঠান্ডা হওয়ার পর এতে তৈরি হয় বুদবুদ। এই বুদবুদের মধ্যেই আটকা পড়ে গিয়েছিল মঙ্গলের বাতাস।
ALH84001 মঙ্গলের অংশ হিসাবে কাটিয়ে দেয় চার বিলিয়ন বছর। মঙ্গলে যদি কোন সময় চরমজীবী ব্যাক্টেরিয়া তৈরি হয়ে থাকে তবে সেগুলাের মধ্যে কিছু হয়তাে এই ক্ষুদ্র প্রস্তর খড়ের চারপাশে বা ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর প্রায় ১২ থেকে ১৭ মিলিয়ন বছর আগে অন্য এক উল্কার আঘাতে মঙ্গলের মায়া চিরতরে কাটিয়ে ALH84001 উৎক্ষিপ্ত হয় মহাশুন্যে। মহাশূন্যে থাকা অবস্থায় কসমিক রশ্মির (Cosmic Ray) পাল্লায় পড়ে ALH84001. এই কসমিক রশ্মি পৃথিবী বা মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের কারণে ঢুকতে পারে না।
কসমিক রশ্মির কারণে ALH84001 এর হিলিয়াম, নিওন এবং আরগন অণুর পারমাণবিক কেন্দ্রে কিছু পরিবর্তন ঘটায়। এই পরিবর্তন কোন গ্রহে অবস্থিত পাথর খন্ডের মধ্যে লক্ষ্য। করা যায় না। কোন একটি প্রস্তর খন্ডের রাসায়নিক পদার্থ, এয়ার বাবল এবং এর পরমাণুর মধ্যে কি ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা বলে দিতে পারেন এর উৎস কোথায় এবং কোথা থেকে এসেছে।
এক অক্ষ থেকে অন্য অক্ষে ঘােরাঘুরি করতে করতে প্রায় তের হাজার বছর আগে ALH84001 জড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের মায়াজালে এবং এসে পতিত হয় দক্ষিণ মেরুর আল্যান হিল (Allan Hill) নামের একটি হিমবাহের উপর। ১৯৮৪ সালে ভূতত্ত্ববিদ রবার্টা স্কোর (Roberta Score) দক্ষিণ মেরু যান উল্কাপিন্ডের সন্ধানে। মঙ্গল থেকে আগত ৪.২ পাউন্ডের ALH84001 খুঁজে পান তিনি। উল্কাপিন্ডের নামের ALH এসেছে Allan Hill থেকে এবং 84 এসেছে ১৯৮৪ সালে আবিষ্কৃত হওয়ার কারণে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় অবশ্য দেখা গেছে যে ALH84001 এন্টার্কটিকা বরফের এমিনাে এসিড দিয়ে ব্যাপকভাবে দূষিত হয়ে গিয়েছিল। এই কারণে অবশ্য ALH84001-এ মঙ্গলের মাইক্রো-ফসিলের দাবী দুর্বল হয়ে পড়েছে।
উল্কাপিন্ডদের চৌম্বকীয় ধর্ম এবং এদের অভ্যন্তরে আটকে পড়া গ্যাসের গঠন-উপাদান বিশ্লেষণ করে বি পি ওয়েস (B. P. Weiss) এবং তার সহকর্মীরা দেখতে পেলেন যে, ALH84001 এবং সাতটি নাখলাইটের মধ্যে কমপক্ষে দু’টো মঙ্গলের পৃষ্ঠ ছাড়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মাত্র কয়েকশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উত্তপ্ত হয়নি। অধিকন্তু নাখলাইটগুলাে যেহেতু অবিকৃত, তারমানে উচ্চ-চাপযুক্ত শকওয়েভ এদের গায়ে আঁচড় বসাতে পারেনি এবং এদের তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি উঠেনি।
পৃথিবীর অনেক আদিকোষী Prokaryote (সরল এককোষী জীব যাদের নিউক্লিয়াসে ঝিল্লি নেই, যেমন ব্যাক্টেরিয়া) এবং প্রকৃতকোষী Eukaryotes (সুনির্দিষ্ট নিউক্লিয়াস-বিশিষ্ট জীব) এই তাপমাত্রার টিকে থাকতে পারে। ওয়েসের গবেষণার এই ফলাফলই সর্বপ্রথম পরীক্ষাপ্রাপ্ত প্রমাণ যাতে দেখা যায় যে, বস্তুখণ্ড মূল গ্রহ থেকে উৎক্ষিপ্ত হওয়া থেকে শুরু করে পতন পর্যন্ত কোন পর্যায়েই এমন তাপমাত্রায় না পৌঁছেও এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে পরিভ্রমণ করতে পারে যাতে এর অভ্যন্তরস্থ জৈবিক প্রাণ পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে না যায়।
প্যাস্পারমিয়া সংঘটনের ক্ষেত্রে অণুজীবদের শুধুমাত্র প্রথম গ্রহের বিচ্যুত এবং দ্বিতীয় গ্রহের বায়ুমন্ডলে প্রবেশের সময়ই টিকে থাকতে হয় না বরং একই সাথে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে ভ্রমনের মধ্যবর্তী সময়টাতেও টিকে থাকতে হয়।
জীবনবাহক উল্কাপিন্ডদেরকে মহাকাশের শুন্যতা, তাপমাত্রার চরম অবস্থা এবং কয়েকটি বিভিন্ন ধরনের বিকিরণকে মােকাবিলা করতে হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে সূর্যের উচ্চ-শক্তিসম্পন্ন অতিবেগুনী রশ্মি (Ultra violet Ray বা UV) যা জৈবিক অণুর কার্বন পরমাণুর বন্ধনকে ভেঙ্গে দেয়। তবে UV থেকে বাঁচার উপায়ও খুব সােজা। এক মিটারের মিলিয়ন ভাগের একভাগ সমান দৈর্ঘের অসচ্ছ বস্তুই একটি ব্যক্টেরিয়াকে রক্ষা করার জন্যই যথেষ্ট।

১৯৮৪ সালে উৎক্ষিপ্ত এবং এর ছয় বছর পর কক্ষপথ থেকে ফিরিয়ে আনা নাসার স্যাটেলাইট Long Duration Exposure Facility (LDEF) কে ব্যবহার করা এক পরীক্ষায় দেখা যায় যে, পাতলা একটি এলুমিনিয়ামের আস্তরনই ব্যক্টেরিয়া প্রজাতি Bacillus subtilis এর অণুবীজ (Spore) এর ক্ষেত্রে অতিবেগুনী রশ্মির বিপক্ষে ঢাল হিসাবে যথেষ্ট ছিল। UV থেকে রক্ষিত হওয়া কিন্তু মহাকাশের অসীম শূন্যতা এবং চরম তাপমাত্রা মােকাবেলা করা ওই সমস্ত স্পােরের আশি শতাংশই মিশন শেষে টিকে ছিল। অন্যদিকে এলুমিনিয়াম ঢাল দিয়ে প্রতিরােধ না করা অণুবীজগুলাের যদিও অধিকাংশই অতিবেগুনী রশ্মির আক্রমনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারপরও সবগুলাে কিন্তু নয়।
UV ঢালবিহীন অণুবীজগুলাের প্রতি দশ হাজারে অন্ততঃ একটি অণুবীজ বেঁচে ছিল। গ্লুকোজ এবং লবনের মতাে উপাদানের উপস্থিতি তাদের টিকে থাকার হারকে বাড়িয়ে দেয়। দেখা গেছে ক্ষুদ্র ধূলিকণার আস্তরণের মধ্যে বসবাসকারী ব্যক্টেরিয়ার কলােনীকে সৌর বিকিরণ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারে না। আর এই কলােনি যদি নুড়ি আকৃতির কোন প্রস্তর খন্ডের মধ্যে থাকে তবে সেটার অতিবেগুনী রশ্মি প্রতিরােধের ক্ষমতা বেড়ে যায় অনেক অনেক বেশি পরিমাণে।
যেহেতু এই গবেষণা হয়েছিল পৃথিবীর চৌম্বকীয় প্রতিরক্ষা ব্যুহের অনেক ভেতরে স্বল্পমাত্রার দূরত্বের কক্ষপথে। কাজেই এই গবেষণা আন্তঃগ্রহিক আহিত কণা (Charged Particles) এর প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দিতে সক্ষম হয়নি। কারণ এই চার্জড পার্টির্কল পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। মাঝে মাঝে সূর্য বিপুল পরিমাণ এনার্জেটিক আয়ন এবং ইলেকট্রন উদগীরণ করে থাকে। এ ছাড়া মহাজাগতিক বিকিরণের মূল উপাদান চার্জড পার্টিকলগুলাে প্রতি মুহুর্তেই আঘাত হানছে সৌরজগতে। জীবন্ত সত্তাকে চার্জড পার্টিকল বা গামা রশ্মির মতাে উচ্চ শক্তি সম্পন্ন বিকিরণ থেকে রক্ষা করা অতি বেগুনী রশ্মির হাত থেকে রক্ষা করার চেয়ে অনেক জটিলতর। সামান্য কয়েক মাইক্রণ প্রশস্ত প্রস্তরের স্তর বা ঢাল (Shielding) অতি বেগুনী রশ্মিকে প্রতিরােধ করতে সক্ষম। কিন্তু অতিরিক্ত শিলডিং বস্তুত অন্য ধরনের বিকিরণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। আহিত কণা এবং উচ্চ শক্তির ফোটন শিলডিং এর সাথে মিথস্ক্রিয়া করে উল্কাপিন্ডের অভ্যন্তরে অসংখ্য মাধ্যমিক বিকিরণের জন্ম দেয়।
দুই মিটার বা তার চেয়ে বেশি ব্যাসের প্রস্তর না হলে এই বিকিরণ উল্কাপিন্ডের অভ্যন্তরের যে কোন অণুজীবকে ধ্বংস করে দিতে পারে। আমরা আগেই আলােচনা করেছি যে, বড় ধরনের প্রস্তরখন্ডগুলাে খুব দ্রুত আন্তঃগ্রহিক পরিভ্রমন সাধারণত করে না। কাজেই UV প্রতিরােধের সাথে সাথে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মহাকাশের বিকিরণকে একটি অণুজীব কতখানি সফলভাবে প্রতিরােধ করতে পারে এবং কত দ্রুত জীবন বহনকারী উল্কাপিন্ড এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যেতে পারে। ভ্রমণ যত দ্রুত হবে বিকিরণের মাত্রা তত কম হবে। ফলশ্রুতিতে অণুজীবের টিকে থাকার সম্ভাবনাও তত বেশি হবে।
B. Subtilis বিকিরণ প্রতিরােধের ক্ষেত্রে বেশ শক্তপােক্ত। ১৯৫০ সালে কৃষি বিজ্ঞানী আর্থার ডব্লিউ এভার্সনের (Arthur W. Anderson) আবিষ্কৃত ব্যাক্টেরিয়াল প্রজাতি Deinococus Radiodurans অবশ্য B. Subtilis এর চেয়েও বেশি বিকিরণ প্রতিরােধে সক্ষম। খাদ্যকে জীবাণুমুক্ত করতে যে পরিমাণ বিকিরণ প্রয়ােগ করা হয় তা উপেক্ষা করেও এরা টিকে থাকতে পারে। এমনকি আণবিক চুল্লিতেও এরা বেঁচে বর্তে থাকতে পারে।
Deinococus Radiodurans এর ডিএনএ মেরামত করার জন্য যে কোষীয় প্রক্রিয়া সাহায্য করে তাই এর কোষের চারপাশে অতিরিক্ত মােটা দেয়াল তৈরি করে ফেলে। এই ডিএনএ বিকিরণ থেকে বাঁচানাের সাথে সাথে পানিশূন্যতার ফলে যে ক্ষতি হয় তাও পূরণ করার চেষ্টা করে। তাত্ত্বিকভাবে, উপরােক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীবাণুসমূহ যদি মঙ্গল থেকে উৎক্ষিপ্ত কোন উল্কাপিন্ড যা ALH84001 বা অন্য কোন নাখলাইটের মত উত্তপ্ত না হয় তবে ওই সমস্ত জীবাণুর একটা অংশ দীর্ঘ সময় পরেও টিকে থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের বাইরে স্পাের বা জটিল অণুদের সুদীর্ঘকাল টিকে থাকার বিষয়ে সত্যিকার অর্থে তেমন কোন পরীক্ষা করা হয়নি। এই ধরনের পরীক্ষা চন্দ্রপৃষ্ঠে করা সম্ভব জৈবিক বস্তুসমুহ সিম্যুলেটেড উল্কাপিন্ডের মধ্যে ভরে মহাকাশে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে এবং পরবর্তীতে দেখা যেতে পারে সেগুলােতে কি ধরনের প্রভাব পড়েছে। এপােলাে মিশনে কিন্তু জৈবিক নমুনা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তবে যেহেতু এই নমুনা নভােযানের ভেতরেই ছিল কাজেই সেগুলাে পুরােপুরি মহাজাগতিক বিকিরণে আক্রান্ত হয়নি। ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা জৈবিক নমুনা চন্দ্রপৃষ্ঠে বা মহাকাশের কোথাও রেখে দিতে পারেন এবং বেশ কয়েক বছর পর পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে গবেষণাগারে বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে বেশ গুরুত্বের সাথেই এই ধারণাটি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।
ইতােমধ্যে অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী Martian Radiation Environment Experiment (MARIE) চালু হয়ে গেছে। ২০০১ সালে মঙ্গলের ওডিসি অর্বিটারের (Odyssey Orbiter) অংশ হিসাবে এই প্রকল্প চালু হয়। MARIE-এর যন্ত্রপাতিসমূহ নভােযান মঙ্গলের চারপাশে ঘােরার সময় মহাজাগতিক বিকিরণ এবং সূর্যের আহিত কণাদের পরিমাণ মেপে নিচ্ছে। যদিও MARIEতে কোন জৈবিক বস্তু নেই তবুও এর সংবেদক (Sensor) এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এটা ডিএনএ এর জন্য ক্ষতিকর বিকিরণকে চিহ্নিত করতে সক্ষম।
উপরের আলােচনা থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তাত্ত্বিকভাবে প্যানস্পারমিয়া ঘটা অসম্ভব নয়। এই অনুকল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান একে সম্ভাবনা থেকে বস্তুনিষ্ঠ (Quantitative) বিজ্ঞানের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। উল্কা সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণাদি থেকে দেখা যাচ্ছে যে, সৌর জগতের আদি থেকেই বস্তুপিন্ড এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছে এবং বর্তমানেও তা বেশ ব্যাপকভাবেই ঘটে চলেছে। তাছাড়া, গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, মঙ্গল থেকে বিচ্যুত উল্কাপিন্ডের অভ্যন্তরে বেশ ভাল সংখ্যক অণুজীবই বিচ্যুতির ধাক্কা এবং পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে প্রবেশের বিপদসংকুল অবস্থাকে সামাল দিয়ে টিকে থাকতে পারে।
কিন্তু প্যানস্পারমিয়া অনুকল্পের অন্য অংশগুলাে এতাে সহজে প্রমাণ করা যায় না। B. Subtilis বা D. Radidurans-এর মতাে বিকিরণ প্রতিরােধক জীবাণুর আন্তঃগ্রহিক পরিভ্রমণে টিকে থাকতে পারবে কিনা সে সম্পর্কে গবেষকদের আরাে অনেক বেশি তথ্যপ্রমাণ দরকার। তারপরও এ ধরনের গবেষণা পৃথিবীর প্রাণিমন্ডলে সত্যিকার অর্থে কি ঘটেছিল তা কখনই প্রকাশ করতে পারবে না, কেননা পরীক্ষাগুলাে বর্তমান পৃথিবীর প্রাণ নিয়ে জড়িত। কয়েক বিলিয়ন বছর আগের জীবাণুদের টিকে থাকার ক্ষমতা হয়তাে একনকার তুলনায় ভিন্ন ছিল। হয়তাে বা বেশি ছিল বা হয়তাে কম ছিল।
এছাড়াও, বিজ্ঞানীরা এখনাে সুনির্দিষ্ট কোন প্রমাণ হাজির করতে পারেননি যে পৃথিবীর বাইরে অন্য কোন গ্রহে একসময় প্রাণ ছিল। অন্য কোন গ্রহে অজৈবজনি (Abiogenesis) ঘটার সম্ভাবনা সম্পর্কে কোন ধরনের সিদ্ধান্তে আসার জন্য বিজ্ঞানীরা কোন ধরণের প্রাণেরই উৎপত্তি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ নন। সহায়ক উপাদান এবং পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ‘প্রাণ’-এর উৎপত্তি হতে হয়তাে কয়েক মিলিয়ন বছর সময় লেগেছে অথবা এর বিপরীত হতে পারে। প্রাণের বিকাশের জন্য হয়তাে মিনিট পাঁচেক সময় লেগেছে। আমরা শুধু এইটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, ২.৭ বিলিয়ন বা তার কয়েক মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে ‘প্রাণ’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
যেহেতু এই মুহুর্তে প্যানস্পারমিয়া দৃশ্যপটের সবগুলো ধাপকেই পরিমাপযোগ্য করা সম্ভব নয়, কাজেই গবেষকরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে কি পরিমাণ জৈবিক পদার্থ বা জীবন্ত কোষ পৃথিবীতে এসেছে তা পরিমাপ করতে পারছেন না। অধিকন্তু, জীবন্ত কোষের স্থানান্তরই প্রমাণ করে না যে গ্রহনকারী গ্রহে এর কারণেই প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। বিশেষ করে ওই গ্রহে যদি আগে থেকেই প্রাণের অস্তিত্ব থাকে তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে আরাে কঠিন। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় যে, যদি পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তির পর মঙ্গলের অণুজীব পৃথিবীতে এসেও থাকে তবে তা হয়তাে পৃথিবীর প্রাণসমূহকে প্রতিস্থাপিত বা পৃথিবীর প্রাণের সাথে সহাবস্থান কোনটাই করতে পারেনি। তবে এটাও সম্ভব যে, মঙ্গলের প্রাণ হয়তাে পৃথিবীতে আমাদের নাকের ডগাতেই আছে কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাননি। এ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল ব্যাক্টেরিয়া প্রজাতির মাত্র কয়েক শতাংশকে চিহ্নিত করা গেছে। পৃথিবীর প্রাণের সঙ্গে উত্তরাধিকারসূত্রে অসম্পর্কযুক্ত প্রাণগুলাে এখন পর্যন্ত চিহ্নিত না হয়ে থাকা বিচিত্র কিছু না।
অন্য কোন গ্রহে প্রাণ আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা হয়তাে প্যানস্পারমিয়া আদৌ ঘটেছে কিনা বা কি পরিমানে ঘটেছে তা জানতে সক্ষম হবেন না। ধরা যাক, ভবিষ্যতের কোন অনুসন্ধান মঙ্গলে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেল এবং জানালাে যে মঙ্গলের জৈব-রসায়ন আমাদের পৃথিবীর তুলনায় পুরােপুরি ভিন্ন। সেক্ষত্রে বিজ্ঞানীরা তাৎক্ষনিকভাবেই জেনে যাবেন যে, পৃথিবীর ‘প্রাণ’ মঙ্গল থেকে আসেনি। কিন্তু জৈব-রসায়ন যদি একই রকমের হয় তবে এই ধরনের একটি অনুমানে আসা যেতে পারে যে এদের উৎস হয়তাে বা একই। ধরে নেওয়া যাক যে, মঙ্গলের ‘প্রাণ’ বংশগতীয় তথ্য মজুদ করার জন্য ডিএনএ ব্যবহার করে থাকে। বিজ্ঞানীরা নিউক্লিওটাইড অণুক্রম বিশ্লেষণ করে বের করতে পারবে যে মঙ্গল এবং পৃথিবীর প্রাণের উৎস একই কিনা। পৃথিবীর প্রাণীদের মত প্রােটিন তৈরির জন্য মঙ্গলের প্রাণীদের ডিএনএ অণুক্রম যদি একই বংশগতীয় সঙ্কেত অনুসরণ না করে তবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানাে যেতে পারে যে, মঙ্গল-পৃথিবী প্যানস্পারমিয়া অনিশ্চিত।
কিন্তু এর বাইরেও আরাে অনেক সম্ভাবনা থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা হয়তাে দেখতে পারেন যে, মঙ্গলের প্রাণীরা প্রতিরূপ সৃষ্টির জন্য আরএনএ বা অন্য কিছুকে ব্যবহার করে থাকে। পৃথিবীতে প্রাণ নিজস্বভাবে তৈরি হােক বা বহির্বিশ্ব থেকে আসুক অথবা এর মধ্যবর্তী অন্য কোন পরিস্থিতিতেই উৎপন্ন হােক না কেন সঠিক উত্তরটি জানা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গল-পৃথিবীর প্যানস্পারমিয়া যদি সত্যি হয় তবে বােঝা যাবে যে, প্রাণ যেখানেই উৎপন্ন হােক না কেন, উৎপত্তির পর তা মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। তবে অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা যদি দেখেন যে মঙ্গলের প্রাণ স্বতন্ত্রভাবে উৎপত্তি হয়েছে সেক্ষেত্রেও এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যাবে যে জড় থেকে জীবের ‘অজৈবজনি’ মহাবিশ্বের যে কোন জায়গাতেই খুব সহজেই ঘটতে পারে।