উইলিয়াম প্যালে (১৭৪৩-১৮০৫)’র বিখ্যাত বই ‘Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, collected from the Appearences of Nature’ প্রকাশিত হয় ১৮০২ সালে। ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও প্যালে ভেবেছিলেন বিস্তর, কিন্তু নিজেই শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন ‘বুদ্ধিদীপ্ত স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান উপযুক্ত মাধ্যম নয়’[১০] ; এ ক্ষেত্রে প্যালের ‘উপযুক্ত মাধ্যম’ মনে হয়েছিল বরং জীববিজ্ঞানকে। আর পূর্ববর্তী অন্যান্য ন্যাচারাল থিওলিজিয়ানদের মতই প্যালেও জীবজগতকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে জীবের অভিযােজনের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্যালে লক্ষ্য করেছিলেন যে, প্রতিটি জীবদেহে নির্দিষ্ট কাজ করবার জন্য নির্দিষ্ট অংগ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, যা জীবটিকে একটি নির্দিষ্ট কোন পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। তিনি জটিল জীবদেহকে ঘড়ির কাঠামাের সাথে তুলনীয় মনে করেছিলেন, আর তার মধ্যেই দেখেছিলেন স্রষ্টার সুমহান পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য আর নিপুণ তুলির আঁচর। প্যালের ভাষাতেই[১১]:
‘ধরা যাক ঝােপঝারের মধ্য দিয়ে চলতে গিয়ে হঠাৎ আমার পা একটা পাথরে লেগে গেল। আমি নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এই পাথরটা কোত্থেকে এলাে? আমার মনে উত্তর আসবে- প্রকৃতির অন্য অনেক কিছুর মত পাথরটাও হয়ত সবসময়ই এখানে ছিল। … …কিন্তু ধরা যাক আমি পথ চলতে গিয়ে একটা ঘড়ি কুড়িয়ে পেলাম। এবার কিন্তু আমার কখনই মনে হবে না যে ঘড়িটিও সব সময়ই এখানে পড়ে ছিল।
নিঃসন্দেহে ঘড়ির গঠন পাথরের মত সরল নয়। একটি ঘড়ি দেখলে বােঝা যায়- ঘড়ির ভিতরের বিভিন্ন ছােট ছােট অংশগুলাে কোন এক কারিগর এমনভাবে তৈরী করেছেন যেন সেগুলাে সঠিকভাবে সমন্বিত হয়ে কাঁটাগুলােকে ডায়ালের চারপাশে মাপমত ঘুরিয়ে ঠিক ঠাক মত সময়ের হিসেব রাখতে পারে। কাজেই পথে ঘড়ি কুড়িয়ে পেলে যে কেউ ভাবতে বাধ্য যে ওখানে আপনা আপনি ঘড়ির জন্ম হয়নি বরং এর পেছনে একজন কারিগর রয়েছেন যিনি অতি যত্ন করে একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ঘড়িটি তৈরী করেছেন* Argument from Design ।
একই যুক্তিমালার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে প্যালে বেছে নিয়েছিলেন আমাদের জীবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ চোখকে। চোখ নামের এই অঙ্গটিকে প্যালে ঘড়ির মতই এক ধরনের জটিল যন্ত্র হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন, কারণ তার মতে, ‘ঘড়ির মতই এটি (চোখ) বহু ছােট-খাট গতিশীল কলকজা। সমন্বিত এক ধরণের জটিল যন্ত্র হিসেবে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়, যেগুলাের প্রত্যেকটি একসাথে কাজ করে অংগটিকে কমক্ষম করে তুলে[১২]।
চোখকে প্যালে অনেকটা জৈব-টেলিস্কোপ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, ঘড়ি কিংবা টেলিস্কোপ তৈরী করার জন্য যেহেতু একজন কারিগর দরকার, চোখ ‘সৃষ্টি করার জন্যও প্রয়ােজন একজন অনুরূপ কোন কারিগরের। সেই কারিগর যে একজন ব্যক্তি ঈশ্বর’ (Personal God)ই হতে হবে তা প্যালে খুব পরিস্কার করেই বলেন[১১] :
কোন পরিকল্পনাকারী (Designer) ছাড়া কোন পরিকল্পনা (Design) হতে পারে না, যেমনি আবিস্কর্তা ছাড়া কোন আবিস্কার হতে পারে না।……পরিকল্পনার ছাপ এতােই প্রবল যে একে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। এই পরিকল্পনাকারীকে অবশ্যই একজন ব্যক্তি হতে হবে। সেই ব্যক্তিই হচ্ছেন ঈশ্বর।
পরিকল্পনাবিহীনভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে চোখের উৎপত্তির সম্ভাবনাকে এক্কেবারে উড়িয়ে দিয়ে প্যালে বলেছেন[১১]:
‘মানবদেহে স্রেফ দৈবাৎ প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ কোন ধরনের পরিকল্পনা (Design) বিহীন। ক্রিয়া-কলাপের মাধ্যমে হয়তাে আঁচিল, আঁব, জরুল, তিল, ব্রণের মত জিনিসপত্র তৈরী হতে পারে কিন্তু কোনভাবেই চোখ নয়। … কোথাও কোন উদ্দেশ্য বা অভিপ্রায় ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।
ডারউইন নিঃসন্দেহে প্যালের উক্তিগুলাে পড়েছিলেন এবং এর একটি যােগ্য জবাবও মনে মনে ঠিক করেছিলেন যা তিনি দিয়েছিলেন পরে তার প্রজাতির উদ্ভব বইয়ের মাধ্যমে। ডারউইন প্রস্তাব করলেন জীবদেহকে কেবল ঘড়ির মত যন্ত্রের মত কিছু ভেবে বসে থাকলে চলবে না। জীবজগৎ যন্ত্র নয়; কাজেই যন্ত্র হিসেবে চিন্তা করা বাদ দিতে পারলে এর পেছনে আর কোন কোন ডিজাইন বা পরিকল্পনার মত উদ্দেশ্য খোঁজার দরকার নেই।
জীবজগতে চোখের উদ্ভব ও বিবর্তনের পেছনে ডারউইন প্রস্তাব করলেন। এক ‘অন্ধ কারিগরের’, নাম প্রাকৃতিক নির্বাচন- যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা পরিবর্তনের ফলে চোখের মত অত্যন্ত জটিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটির নাম ক্রমবর্ধমান নির্বাচন (cumulative selection)। একাধিক ধাপের এই ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে যে ধাপে ধাপে যে জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভূত হতে পারে তা ইতােমধ্যেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত হয়েছে[১৩]।
শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতিতে আংশিকভাবে চোখের উৎপত্তি ও বিকাশ যে সম্ভব এবং তা বিভিন্ন প্রতিকূল। পরিবেশে যে একটি জীবের টিকে থাকার সম্ভাবনাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলতে পারে তারও অজস্র উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে। ডারউইন তার প্রজাতির উৎপত্তি (১৮৫৯) বইয়ে বলেন[১৪] :
চোখের আছে কিছু অনুকরণীয় উপকরণ, যা দিয়ে এটি বিভিন্ন দূরত্বের সাথে ফোকাস করতে পারে, বিভিন্ন মাত্রার আলাে এর ভিতরে ঢুকতে দিতে পারে, এবং গােলাকার ও বর্ণীয় অপেরণকে সংশােধন করতে পারে, সেটি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে উদ্ভূত। হয়েছে মনে করা হয়ত অসম্ভব ব্যাপার বলেই মনে হতে পারে। তবুও যুক্তি আমাকে বলে যে, যদি অত্যন্ত অসম্পূর্ণ ও সরল চোখ থেকে নিখুত ও জটিল চোখ পর্যন্ত অনেক কয়েকটি স্তর থেকে থাকে এবং প্রতিটি স্তর তার ধারকের জন্য উপকারী হয় বলে দেখানাে যায়; আর যদি চোখগুলাে সামান্য পরিমানেও পরিবর্তনশীল হয়, এবং বিভিন্নতাগুলাে বংশানুসৃত হয় (যা অবশ্যই সম্ভব), আর যদি অঙ্গের বিভিন্নতাগুলাে বা পরিবর্তনগুলাে জীবনের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে প্রাণীর জন্য উপকারী বলে বিবেচিত হয়, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে নিখুঁত ও জটিল চোখের উদ্ভব যতই অবাস্তব শােনাক না কেন, না ঘটার কোন কারণ নেই।
বিবর্তন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধাপে ধাপে ঘটে। আজকে আমরা চোখের যে পূর্ণাংগ গঠন দেখে মুগ্ধ হই তা একদিনে তৈরি হয়নি, তা বহুকাল ধরে ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকা ছােট ছােট পরিবর্তনের ফলশ্রুতি হিসেবে বিকাশ লাভ করেছে। ডারউইনের পরে গত দেড়শাে বছরে আমরা চোখসহ বিভিন্ন অঙ্গের বিবর্তন সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানতে পেরেছি। বিবর্তনের ইতিহাসে, খুব সম্ভবত, বেশ কয়েকবারই আলাদা আলাদাভাবে চোখের বিকাশ ঘটেছে- কখনও মাকড়সা, কাঁকড়া, বিভিন্ন পােকার মত সন্ধিবদ্ধ (arthropod) প্রাণীদের মধ্যে, আবার কখনও অক্টোপাস, শামুক, ঝিনুক জাতীয় মলাস্ক (Mollusk) প্রাণীদের মধ্যে এবং কখনও বা আমাদের মত মেরুদন্ডী (Vertebrates) প্রাণীদের মধ্যে।
এই তিনটি গ্রুপের মধ্যেই আলাদা আলাদাভাবে চোখের সৃষ্টি এবং বিকাশ ঘটেছে – এই বিভিন্ন ধরনের চোখগুলাে একেটা একেক রকম পদ্ধতিতে কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত এরা সবাই চোখের ভুমিকাই পালন করে। খুব সম্ভবত আলাের প্রতি সংবেদনশীল একধরনের স্নায়বিক কোষ থেকে প্রথম চোখের বিকাশ শুরু হয়। তারপর হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত হতে হতে আজকে তারা এই রূপ গ্রহন করেছে। কতগুলাে সংবেদনশীল কোষকে কাপের মত অবতলে যদি ঠিকমতভাবে সাজানাে যায়। তাহলে যে নতুন একটি আদি-চোখের উদ্ভব হয় তার পক্ষে আলাের দিক নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে উঠে।

এখন যদি এই কাপটির ধারগুলােকে কোনভাবে বন্ধ করা যায় তাহলে আধুনিক pin-hole camera-এর মত চোখের উৎপত্তি ঘটবে। তারপর একসময় গতি নির্ধারণ করতে পারে এমন একটি অক্ষিপট (Retina) বা রং বুঝতে পারে কোনের (cone) মত এমন একটি অংশ বিকাশ লাভ করে তাহলে আরও উন্নত একটি চোখের সৃষ্টি হবে। এরপর যদি বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইরিস ডায়াফ্রামের (Iris diaphragm) উৎপত্তি ঘটে তাহলে চোখের ভিতরে কতখানি আলাে ঢুকবে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। এরপর আস্তে আস্তে যদি লেন্সের (lens) উদ্ভব ঘটে তা তাকে আলাের সমন্বয় এবং ফোকাস করতে সহযােগিতা করবে আর এর ফলে চোখের উপযােগীতা আরও বাড়বে।
এইভাবেই সময়ের সাথে সাথে মিউটেশনের মাধ্যমে চোখের ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা এখনও আমাদের চারপাশে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত বিভিন্ন ধাপের চোখের অস্তিত্ব দেখতে পাই, অনেক আদিম প্রাণীর মধ্যে এখনও বিভিন্ন রকমের এবং স্তরের আদি-চোখের অস্তিত্ব দেখা যায়। কিছু এককোষী জীবে একটা আলােক-সংবেদনশীল জায়গা আছে। যা দিয়ে সে আলাের দিক সম্পর্কে খুব সামান্যই ধারণা করতে পারে, আবার কিছু কৃমির মধ্যে এই আলােক-সংবেদনশীল কোষগুলি একটি ছােট অবতল কাপের মধ্যে বসানাে থাকে যা দিয়ে সে আরেকটু ভালােভাবে দিক নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। সমতলের উপর বসানাে নামমাত্র আলােক সংবেদনশীলতা। থেকে শুরু করে পিনহােল ক্যামেরার মত মেরুদন্ডী প্রাণীদের অত্যন্ত উন্নত চোখ পর্যন্ত সব ধাপের চোখই। দেখা যায় আমাদের চারপাশে, এবং তা দিয়েই বিবর্তন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তর ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

বিবর্তনবাদ : একইউনিভার্সাল এসিড
পৃথিবীতে বৈজ্ঞানিক ধ্যন ধারণার কোন কমতি নেই, কিন্তু খুব কম বৈজ্ঞানিক ধারণাই জনসাধারণের মানসপটে স্থায়ীভাবে বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক থমাস কুন (Thomas Kuhn) এ ধরনের যুগান্তকারী বিপ্লবাত্মক ধারণাকে “প্যারাডিম শিফট (Paradigm Shift) নামে অভিহিত করতেন[১৫]। প্যারাডিম শিফট কিন্তু হর-হামেশা ঘটে না। মানব সভ্যতার ইতিহাস তামা-তামা করে খুঁজলেও দু’একটির বেশি প্যারাডিম শিফটের উদাহরণ পাওয়া যাবে না। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব ছিল একটি প্যারাডিম শিফট, যা আমাদের চিরচেনা বিশ্বব্রহ্মান্ডের ছবিটাই দিয়েছিল আমূল বদলে। ঠিক একই ভাবে জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্যারাডিম শিফটে উদাহরণ হল বিবর্তনতত্ত্ব[১৬]।
এই বিবর্তন তত্ত্বই আমাদের শিখিয়েছে যে, কোন প্রজাতিই চিরন্তন বা স্থির নয়, বরং আদিম এক কোষী প্রাণী থেকে শুরু করে এক প্রজাতি থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আরেক প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে, আর মানুষ সহ পৃথিবীর সব প্রাণীই আসলে কোটি কোটি বছর ধরে তাদের পুর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। ডারউইন শুধু এ ধরনের একটি বিপ্লবাত্মক ধারণা প্রস্তাব করেই ক্ষান্ত হননি, বিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি (প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে) কিভাবে কাজ করে তার পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন সবিস্তারে[১৭], প্রথমবারের মত ১৮৫৯ সালে প্রজাতির উদ্ভব বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’ বইয়ে।
খুব অবাক হতে হয় এই ভেবে, যে সময়টাতে সৃষ্টি রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে প্রায় সকল বিজ্ঞানী আর দার্শনিকই সবে ধন নীলমনি ওই বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে মুখ থুবরে পড়ে ছিলেন আর বাইবেলীয় গণনায় ভেবে নিয়েছিলেন পৃথিবীর বয়স সর্বসাকুল্যে মাত্র ছ’হাজার বছর আর মানুষ হচ্ছে বিধাতার এক বিশেষ সৃষ্টি, সে সময়টাতে জন্ম নিয়েও ডারউইনের মাথা থেকে এমনি একটি যুগান্তকারী ধারণা বেরিয়ে এসেছিলাে যা শুধু বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকেই তরান্বিত করেনি, সেই সাথে চাবুক হেনেছিলাে আমাদের ঘারে সিন্দাবাদের ভুতের মত সওয়ার হওয়া সমস্ত ধর্মীয় সংস্কারের বুকে। দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট এজন্যই বােধ হয় বলেছিলেন,
আমাকে যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণাটির জন্য কাউকে পুরষ্কৃত করতে বলা হয়, আমি নিউটন, আইনস্টাইনদের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় ডারউইনকেই বেছে নেব। [১৮]
‘ডারউইনের বুলডগ’ বলে কথিত বিজ্ঞানী টি এইচ হাক্সলি ডারউইনের ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বইটিকে নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়ার’ পর জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী ‘মহাস্ত্র হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন; আবার সেই সাথে আবার দুঃখও করেছিলেন এই ভেবে –
‘এতােই নির্বোধ আমি যে এত সহজ ব্যাপারটা আগে আমার মাথায় আসেনি।[১৯]
বিজ্ঞানী আর্নেস্ট মায়ার বলেছেন,
‘ডারউইনিয়ীয় বিপ্লব যে মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণা – এটি যে কারাে পক্ষে খন্ডন করা কঠিনই হবে।[২০]
স্টিফেন জে গুল্ড মনে করতেন তাবৎ পশ্চিমা বিশ্বের আধা ডজন বাছা বাছা তত্ত্বের মধ্যে ডারউইনের তত্ত্ব থাকবে শীর্ষস্থানে[২১]। আর অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্স তাে মনেই করেন যে, শুধু পৃথিবী নয় সমগ্র মহাবিশ্বে কোথাও প্রাণের বিকাশ ঘটলে তা হয়ত ডারউইনীয় পদ্ধতিতেই ঘটবে, কারণ ডারউইনীয় বিবর্তন সম্ভবতঃ একটি সার্বজনীন সত্য। (universal truth)[২২]। সমগ্র মহাবিশ্বের প্রেক্ষাপটে সার্বজনীন সত্য কিনা তা এখনাে প্রমাণিত না হলেও স্বীকার করে নিতেই হবে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব আর এর নান্দনিক বিকাশকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের চেয়ে ভাল কোন তত্ত্ব এ মুহূর্তে আমাদের হাতে নেই। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে বলেছি পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব যেমন একটি সফল তত্ত্ব, জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইনের তত্ত্ব তেমনি একটি অত্যন্ত সার্থক তত্ত্ব।
দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট বিবর্তনতত্ত্বকে ‘ইউনিভার্সাল এসিড’ (universal acid) বা রাজা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন[৮] । ইউনিভার্সাল এসিড যেমন তার বিধ্বংসী ক্ষমতায় সকল পদার্থকে পুড়িয়ে-গলিয়ে ছারখার করে দিতে পারে, তেমনি। ডারউইনের বিবর্তনবাদী তত্ত্ব সমস্ত প্রথাগত ধর্মীয় ধ্যান ধারণা আর কুসংস্কারকে একেবারে দুর করে দিতে পারে। অধ্যাপক ডেনেট তার বিখ্যাত বইটিতে[৮] বিবর্তন তত্ত্বকে ‘ডারউইনের বিপজ্জনক প্রস্তাব’ (Darwin’s dangerous idea) বলে উল্লেখ করেছেন। এটি বিপজ্জনক কারণ এটি বলে যে, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী কোন উপরওয়ালার নির্দেশনা ছাড়াই শুধুমাত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতির মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত সরল জীব থেকে ক্রমান্বয়ে উদ্ভূত হতে পারে।
বিবর্তনের পথ ধরে
৮.↑ Dennett DC, 1995, Darwin’s Dangerous Idea: Evolution and Meanings of Life, Penguin (UK), Simon and Schuster (USA).
১০.↑ Rees M, 2001, Our Cosmic Habitat, Princeton University Press, p 163
১১.↑ Paley W, (1801) 1850, Natural Theology or Evidence of the Existence and Attributes of the Deity, Collected from the Appearances of Nature, American Tract Society.
১২.↑ Shanks N, 2004, God, the Devil and Darwin: A critique of Intelligent Design theory, Oxford University Press.
১৩.↑ বিস্তারিত তথ্যের জন্য Dawkins R, (1986) 1996, The Blind Watchmaker : Why the Evidence of Evolution Reveals a Universe Without a Design, Norton Paperback এর “Accumulating Small change’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
১৪.↑ Darwin C, (1859), 1999 The Origin of Species, Bantam Books, p 155.
১৫.↑ Kuhn T, 1970, The Structure of Scientific Revolutions, University Of Chicago Press, USA
১৬.↑ স্টেংগর ভি, ডারউইনিজমের আতংক, (অনুবাদ : বন্যা আহমেদ), জুন ২, ২০০৫, একুশ শতক বিভাগ, দৈনিক ভােরের কাগজ।
১৭.↑ আজকের দিনের বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীরা অবশ্য প্রজাতির উৎপত্তির পেছনে প্রাকৃতিক নির্বাচনের পাশাপাশি বিবর্তনের জন্য অন্য অনকে ফ্যাক্টর (যেমন জিন মিউটেশন, ক্রোমজম মিউটেশন, জেনেটিক রিকম্বিনেশন, জেনেটিক ড্রিফট এবং অন্তরণ বা আইসােলেশন) খুঁজে পেয়েছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে।
১৮.↑ Dawkins R, Darwin and Darwinism, Mukto-Mona Darwin Day celebration
১৯.↑ Huxley TH, 1880, The Origin of Species (review), Westminster Review, vol 17, pp 541-570
২০.↑ Mayr E, 1988, Toward a New Philosophy of Biology, Cambridge, Mass, Harvard University press.
২১.↑ Gould SJ, 2002, The Structure of Evolutionary Theory, Belknap Press
২২.↑ Dawkins R, 2004, A Devil’s Chaplain: Reflections on Hope, Lies, Science, and Love, Mariner Books; Reprint edition