বহির্বিশ্বে মহাজাগতিক সভ্যতা আছে কিনা তা যাচাই করার সহজ পন্থা হিসাবে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে বিজ্ঞানীরা বেতার সঙ্কেতকে বেছে নেন। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী গুইসেপ ককোনি (Giuseppe Cocconi) এবং ফিলিপ মরিসন (Philip Morrison) ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাময়িকী ‘Nature’-এ ‘Searching for Intersteller Communications’ নামে একটি গবেষণাপত্রে মত প্রকাশ করেন যে, বেতার তরঙ্গ হতে পারে মহাবিশ্বে বিভিন্ন সভ্যতার যােগাযােগের সবচেয়ে কার্যকর পন্থা এবং ফলশ্রুতিতে মহাজাগতিক সভ্যতা চিহ্নিত করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়।
বিজ্ঞানীদ্বয় এর জন্য ১ থেকে ১০ গিগাহার্জ বেতার তরঙ্গ, বিশেষ করে ১.৪২ গিগাহার্জের বেতার তরঙ্গের কথা উল্লেখ করেন। কারণ নিরপেক্ষ হাইড্রোজেন থেকে এই ফ্রিকোয়েন্সী নির্গত হয় এবং এই ফ্রিকোয়েন্সীরই ক্ষমতা আছে মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ঘন মেঘের আস্তরণ ভেদ করে যাওয়ার। আমাদের মতাে ভিন গ্রহের সভ্যতারাও বেতার তরঙ্গ সম্প্রচার করতে পারে। কাজেই তারা যুক্তি দেন যে আমাদের বেতার দূরবীক্ষণগুলােরও উচিত ওই সমস্ত সঙ্কেতগুলাে খুঁজে দেখা । যদিও তারা এ বিষয়ে সাফল্যের নিশ্চয়তা দিতে পারেননি, কিন্তু তাদের বক্তব্য হচ্ছে যে যদি আমরা কখনােই অনুসন্ধান না চালাই তবে সেক্ষেত্রে আমাদের সাফল্যের সম্ভাবনা একেবারে শূন্যই থেকে যাবে।
ককোনি এবং মরিসনের প্রবন্ধই মূলতঃ সেটির সুত্রপাতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ফলে অতি শীঘ্রই বৈজ্ঞানিক মহল পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব খোজার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হিসাবে গ্রহণ করে নেন।
তবে এ ধরণের গবেষণার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কোন ফ্রিকোয়েন্সীতে বেতার তরঙ্গ পাঠাতে হবে তা খুঁজে বের করা। যেহেতু, মহাজাগতিক বুদ্ধিমান প্রাণী কোন ফ্রিকোয়েন্সী গ্রহণ করতে পারবে তা জানা নেই সেহেতু মহাকাশের নির্দিষ্ট স্থানে বিভিন্ন মাত্রার ফ্রিকোয়েন্সী ব্যবহার করতে হয়।
বেতার সঙ্কেত গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও একই সমস্যা বিদ্যমান। আমরা আদৌই জানি না কি গ্রহণ করতে হবে, কেননা মহাজাগতিক প্রাণীরা কিভাবে সঙ্কেত প্রেরণ করবে বা তাদের প্রেরিত তথ্য কিভাবে পুনরুদ্ধার করতে হবে সে সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই নেই।
তিরিশের দশকের শেষের দিকে ইলিনয়ের হুইটন শহরে বেতার ইঞ্জিনিয়ার গ্রোট রবার (Grote Rober) তার বাড়ির পিছনের আঙ্গিনায় ডিশ আকৃতির একটি বেতার এন্টেনা তৈরি করেন। রবার্ট তার একত্রিশ ফুট ব্যাসের বেতার এন্টেনা মিল্কিওয়ে ছায়াপথের দিকে তাক করে অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন যে মহাবিশ্বের বিভিন্ন বস্তু থেকে বেতার সঙ্কেত ভেসে আসছে। রবার্টের এই এন্টেনাই ছিল বিশ্বের প্রথম বেতার দূরবীক্ষণ।
বেতার দূরবীক্ষণকে বলা হয় “জোতির্বিদদের কান”, যদিও ঠিক প্রচলিতভাবে আমরা যেভাবে বেতার শুনি জোতির্বিদরা ঠিক সেভাবে বেতার সঙ্কেত শােনেন না। একটি বেতার দূরবীক্ষণের কমপক্ষে একটি ডিশ আকৃতির এন্টেনা আছে যা মহাশূন্য থেকে প্রাপ্ত বেতার তরঙ্গ সংগ্রহ করে। এই সঙ্কেতগুলােকে পাঠানাে হয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে, সেখানে কম্পিউটার সিস্টেমের মাধ্যমে বেতার তরঙ্গগুলােকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে বস্তু থেকে বেতার সঙ্কেত এসেছে তার চিত্রও তৈরি করা হয়।
অপটিক্যাল দূরবীক্ষণের তুলনায় বেতার দূরবীক্ষণে বেশ কিছু বাড়তি সুবিধা আছে। বেতার তরঙ্গ অপটিক্যাল তরঙ্গের তুলনায় মহাশূন্যের অনেক গভীরে যেতে পারে এবং কি রােদ কি বৃষ্টি দিন রাত চব্বিশ ব্যবহার করা যেতে পারে। কেননা এগুলাে মেঘ ভেদ করে যেতে পারে। মহাকাশের বস্তুসমূহ দিনের বেলাতেও বেতার তরঙ্গ বিকিরণ করে থাকে। বেতার তরঙ্গের মাধ্যমেই আবিষ্কার করা হয়েছে মহাকাশের অনেক কোয়াসার এবং পালসার।
তবে মহাকাশের বস্তুসমূহই একমাত্র বেতার তরঙ্গের উৎস নয়। ১৮৯৫ সালে মার্কনী বেতার আবিষ্কার করার পর থেকে এই পৃথিবীর মানুষেরাও বেতার তরঙ্গ ট্রানসমিট করে চলেছে।
১৯২৯ সাল থেকে আমরা টেলিভিশন সম্প্রচার করা শুরু করেছি যাও একধরনের বেতার তরঙ্গ। AM বেতার তরঙ্গ আমাদের বায়ুমন্ডলে ধাক্কা লেগে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে, কিন্তু এফএম বেতার তরঙ্গ আলাের গতিতে চিরকালের জন্য মহাশূন্যে ধাবিত হয়। পৃথিবীর টেলিভিশন সম্প্রচারে এফএমবেতার তরঙ্গ ব্যবহৃত হয়।
দূরবর্তী কোন নক্ষত্রের কোন গ্রহ থেকে কেউ বেতার দূরবীক্ষণ নিয়ে বসে থাকলে তারপক্ষে আমাদের পৃথিবী থেকে আগত বেতার সঙ্কেত চিহ্নিত করা সম্ভব। তবে সেটা কয়েকটা ফ্যাক্টরের উপর নির্ভরশীল। যেহেতু আমরা এফ এম বেতার এবং টিভি সঙ্কেত গত ৭৫ বছর ধরে ব্যবহার করছি, কাজেই সেই গ্রহকে হতে হবে পৃথিবী থেকে ৭৫ আলােকবর্ষের ভিতরে।
এছাড়া সঙ্কেত যেহেতু কয়েক বিলিয়ন ফ্রিকোয়েন্সিতে পাঠানাে সম্ভব, কাজেই শ্রোতাদেরকেও সঠিক চ্যানেল বা স্টেশনে টিউন করতে হবে। যদি এই মুহূর্তে চল্লিশ আলােকবর্ষ দূরের কোন গ্রহ থেকে কেউ তাদের দূরবীক্ষণ পৃথিবীর দিকে সঠিক ফ্রিকোয়েন্সীতে তাক করে রাখে তাহলে তারা আমাদের ১৯৬৬ সালের বেতার এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুনতে বা দেখতে পারবে।
ফ্রাঙ্ক ড্রেক সর্বপ্রথম সেটি (SETI) প্রকল্প চালু করেন ১৯৬০ সালে, যার নাম ছিল “প্রজেক্ট ওজমা” (Project Ozma)। ওয়েষ্ট ভার্জিনিয়ার গ্রীন ব্যাংকের ন্যাশনাল বেতার এস্ট্রোমী অবজার্ভেটরী থেকে প্রজেক্ট ওজমা ২৮ মিটার বেতার দূরবীক্ষণের সাহায্যে ১৫০ ঘন্টা ধরে ১৪২০ মেগা ফ্রিকোয়েন্সি বিশিষ্ট সঙ্কেত শােনার চেষ্টা করে। সুর্যের অনুরূপ মাত্র দূ’টো নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা হয়, টাউ সেটি (Tau Ceti) এবং এপসিলন এরিডানি (Epsilon Eridani)। কিন্তু ড্রেক কোন মহাজাগতিক সভ্যতার সঙ্কেতের হদিস দিতে সমর্থ হননি।
১৯৭০-৭২ সালের মধ্যে পালমার ও জুকারম্যান ‘প্রােজেক্ট ওজমা’-এর মাধ্যমে ৬৭৪টি নক্ষত্রকে অনুসন্ধান করেন। ১৯৭১ সালের এক গ্রীষ্মে দূরবর্তী নক্ষত্রমন্ডল গুলােতে বুদ্ধিমান সভ্যতা থাকার সম্ভাব্যতা যাচাই-এর জন্য নাসা এবং আমেরিকান সােসাইটি ফর ইঞ্জিনিয়ারিং এডুকেশন, চব্বিশজন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর সমাবেশ ঘটায়।
‘প্রােজেক্ট সাইক্লোপস’ নামে অভিহিত আলােচনাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, বহির্জাগতিক বুদ্ধিমত্তা অনুসন্ধানের প্রযুক্তি আমাদের আয়ত্বের মধ্যেই। কিন্তু অনুসন্ধানের জন্য কয়েকশ ডলার খরচ হবে। সাফল্য হয়ত কয়েক দশকের মধ্যে আসতে পারে। সাইক্লোপস প্রকল্পে প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯৭১ সালে ১০০ মিটার ব্যাস বিশিষ্ট ১৫’শ বেতার দূরবীক্ষণ বসানাের। কিন্তু অর্থায়নের অভাবে এটি শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখেনি।
সেটি ইনস্টিটিউট-এর জোতির্বিদ সেথ সােস্টাক (Sheth Shostak)। সেটি প্রকল্প কিভাবে কাজ করে তা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ
❛প্রাথমিক ভাবে জ্যোতির্বিদরা তাদের বেতার দূরবীক্ষণযন্ত্রের সাহায্যে কেবল পৃথিবীর কাছাকাছি নক্ষত্রেই অনুসন্ধান চালাবেন। এভাবে বেতার দূরবীনগুলাে সমস্ত দিক থেকে মহাজাগতিক উপাত্ত সংগ্রহ করবে। কম্পিউটারের মাধ্যমে তখন উপাত্তগুলােকে বিভিন্ন চ্যানেলে ভাগ করে দেওয়া হবে। যেহেতু সেটি গবেষকেরা একসাথে সবগুলাে চ্যানেলের দিকে দৃষ্টি রাখতে পারেন না, সেহেতু অন্য একটি কম্পিউটার এই তদারকিতে সাহায্য করবে; এটি বিদঘুটে ধরণের কোন সংকেত পেলেই সেটি ‘বিপ’, ‘বিপ’ শব্দ করে গবেষকদের তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দেবে।
সে ক্ষেত্রে কম্পিউটারটি থেকে উঁচু-নীচু পাহাড়ের ঢালের মত তরঙ্গাকারে সংকেত উৎপন্ন হতে থাকবে। যদি একটি সংকেত অন্যগুলাের চেয়ে উঁচুমানের হয়, তার মানে দাঁড়াবে সে সংকেতটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া সঙ্কেতের চেয়ে অনেক শক্তিশালী অর্থাৎ সঙ্কেতটি বহির্জাগতিক সংকেত হওয়ার দাবীদার। কিন্তু পরবর্তী পরীক্ষণে যদি দেখা যায় যে, সঙ্কেতগুলাে কোন এক পার্থিব টিভি স্টেশনের বা যন্ত্রের কাছে রাখা মাইক্রো-ওভেনের ব্যতিচারের কারণে সৃষ্ট হয়েছে, তবে তা নিঃসন্দেহে বাতিল হয়ে যাবে।❜
১৯৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের সেটি প্রকল্প হিসাবে ‘Search for Extraterrestrial Radio from Nearby Developed populations (SERENDIP)-93’ কার্যক্রম শুরু হয়। সেটি ইনস্টিটিউট বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের বেতার এস্ট্রোনমি ল্যাবের সহযােগিতায় সেটি গবেষণার জন্য বিশেষ এক ধরনের দূরবীক্ষণ ATP (Allen Telescope Array) উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছে। এই দূরবীক্ষণ দিয়ে ‘Multibeaming’ নামক এক ধরনের কৌশলের মাধ্যমে একই সাথে অসংখ্য পর্যবেক্ষণ অবলোকন করা সম্ভবপর।
বার্কলের আরেকটি চমকপ্রদ উদ্যোগ হচ্ছে SETI@home যা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। এটা এমন একটি প্রকল্প যেখানে যে কেউই ইচ্ছা করলেই ঘরে বসে এই প্রজেক্টে কাজ করতে পারবে। এর জন্য প্রয়ােজন শুধু ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি ছােট্ট প্রােগ্রাম ডাউনলােড করা। যেহেতু বেতার দূরবীক্ষণ বিপুল পরিমাণ মহাজাগতিক উপাত্ত সংগ্রহ করে, কাজেই বিজ্ঞানীদের এই বিপুল সংখ্যক উপাত্তকে বিশ্লেষণ করতে হয় ভিনগ্রহের সভ্যতার সঙ্কেত কিনা তা যাচাই করার জন্য। কোন একক কম্পিউটারের পক্ষেই এতাে ব্যাপক পরিমান তথ্য সামলানাে সম্ভব নয়।
কাজেই বার্কলের বিজ্ঞানী ড্যান ওয়ার্দির (Dan Werthimer) এবং ডেভিড এন্ডারসন (David Anderson) কয়েক মিলিয়ন কম্পিউটারকে এই কাজে লাগানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ওয়ার্দিমার এমন একটি সফটওয়ার তৈরি করেন যা ব্যক্তিগত কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের কম্পিউটার অবসরকালীন সময়ে সঙ্কেত অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকবে। ফলে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর কাজে কোন বিঘ্ন ঘটবে না। কিন্তু কফি ব্রেকের সময় বা রাতের বেলায় এটি মূলগ্রাহক যন্ত্র থেকে বিপুল সংখ্যক উপাত্ত ডাউনলােড করবে এবং সেগুলাে বিশ্লেষণ করবে। শতাধিক দেশের পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি মানুষ এই প্রােগ্রামের সাথে বর্তমানে জড়িত রয়েছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ব্যাপী সেটি প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির ‘বৃহৎ কর্ণ’ (Big Ear) বেতার দূরবীক্ষণের মাধ্যমে। বিগ ইয়ার সেটি প্রােগ্রামের ডিরেক্টর ডঃ রবার্ট এস ডিক্সন (Robert S. Dixon)-এর মতে সেটি অনুসন্ধান দুই ধরনের মহাজাগতিক সংকেত চিহ্নিত করতে পারে। একটি বেতার দূরবীক্ষণ হয়তাে কোন একটি সভ্যতার অভ্যন্তরীণ এফএম বেতার টেলিভিশন সম্প্রচারের বেতার সঙ্কেত গ্রহণ করতে পারে। এই ধরনের সঙ্কেতকে বলা হয় নিঃসরণ (Leakage) এবং এর অনুসন্ধানকে বলা হয় আড়িপাতা (Evesdropping)।
আরেকধরনের সঙ্কেত হতে পারে যা হয়তাে কোন সভ্যতা পরিকল্পিতভাবে পাঠাচ্ছে এই আশায় যে আমরা সেই সংকেত গ্রহণ করবাে। যেহেতু এই সংকেতের মাধ্যমে কোন সভ্যতা তার অস্তিত্ব জাহির করছে তাই এই ধরনের সঙ্কেতকে বলা হয় বাতিঘর (Beakon)। ডঃ ডিক্সন বলেন যে, ‘দুই ধরনের সংকেতই গ্রহণ করা যেতে পারে, কিন্তু বাতিঘরকে চিহ্নিত করা সহজতর হবে এই জন্য যে এটা অন্য সংকেতের চেয়ে শক্তিশালী হওয়ার কথা।’
শক্তিশালী হওয়া ছাড়াও অন্য একটি কারণে বাতিঘরকে চিহ্নিত করা সহজ হতে পারে। যােগাযােগের সম্ভাবনা বাড়ানাের জন্য, মহাজাগতিক সভ্যতা ম্যাজিক ফ্রিকোয়েন্সিতে সংকেত পাঠাতে পারে। এই ম্যাজিক ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে ১.৪ গিগাহার্জ (নিরপেক্ষ হাইড্রোজেনের ফ্রিকোয়েন্সি, যা মহাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিমানে বিদ্যমান) এবং ১.৭ গিগাহার্জ (হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের সমাহারে তৈরি হাইড্রোক্সিলের ফ্রিকোয়েন্সি)।
সেটি প্রকল্পগুলাে মাঝে মাঝে যে সংকেত পায়নি তা কিন্তু নয়। বেশ কিছু সংকেত মাত্র একবার পাওয়ার পরই আর কখনােই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এধরনের সঙ্কেতগুলাের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সঙ্কেত হচ্ছে ‘WOW signal‘ যা এসেছিল মিল্কিওয়ে ছায়াপথের মধ্যবর্তী আঞ্চলের একটি নক্ষত্র থেকে। ১৯৭৭ সালে ‘বৃহৎ কর্ণ’ এই সংকেত গ্রহণ করে। কর্মরত প্রকৌশলী সে সময় উত্তেজিত হয়ে চার্টের মধ্যে WOW লিখে ফেলেছিল আর সেখান থেকেই এই সঙ্কেতের নাম হয়ে যায় WOW সঙ্কেত।
মহাজাগতিক সভ্যতার সঙ্কেত হিসাবে এটি একটি উদাহরণ হতে পারতাে, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এটা আসার সাথে সাথেই আবার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ডিক্সন বলেন, মনে হল যেন কেউ হঠাৎ করে সুইচ বন্ধ করে দিয়েছে। হতে পারে এটি কোন অতি গােপনীয় কোন সামরিক স্যাটেলাইটের অজানা কোন ফ্রিকোয়েন্সি, অথবা কোন বহির্জাগতিক সভ্যতার সঙ্কেত বা কোন ভিন গ্রহবাসীদের মহাকাশযান। আমরা হয়তাে কোনদিনই জানতে পারবাে না।
ডঃ ডিক্সন ব্যাখ্যা দেন এভাবে যে, আমরা কখনােই দাবি করতে চাই না যে আমরা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যােগাযােগ করেছি যা পরে ভুল প্রমানিত হােক। কাজেই সেটি অনুসন্ধানে জড়িত প্রত্যেকেই একটি সেটি সনাক্তকরণ বিধি-তে (SETI detection protocol) সই করেছে। আমরা যদি কখনাে অচেনা কোন সঙ্কেত পাই যা মনে হতে পারে ভিন গ্রহ থেকে এসেছে, প্রথম কাজ আমরা যেটা করবাে তা হচ্ছে খুব ভাল করে যাচাই করে দেখবাে যে যন্ত্রপাতির কোন সমস্যা আছে কিনা। তারপর অন্যান্য সেটি অনুসন্ধান কেন্দ্রে খোঁজ নেয়া হবে যে তারা একই ধরনের কোন সঙ্কেত পেয়েছে কিনা।
পল হরােউইজ তার ৮.৪ মিলিয়ন চ্যানেল META অনুসন্ধান প্রকল্প প্রায় দশ বছর ধরে চালিয়ে যান। এরমধ্যে মহাকাশ অভিযান এবং সেটি গবেষণায় আগ্রহী একটি দল প্লানেটারী সােসাইটির আর্থিক সহযােগিতায় তৈরি করেন তার Billion-Channel Extraterrestrial Assay (BETA)- যা দুই বিলিয়ন বেতার চ্যানেল পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম ছিল। ১৯৯৫ সালে BETA কার্যক্রম শুরু হওয়ার সময় ডঃ হরােইজ বলেন, ❛এটা ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে টিউন করা। বহু লক্ষ বেতারযন্ত্র একসাথে আপনার ডেস্কে থাকার মত ব্যাপার।❜
সেটি অনুসন্ধানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমান মনুষ্য-সৃষ্ট বেতার ফ্রিকোয়েন্সী। এগুলাে এই অনুসন্ধানে বিঘ্ন সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। সেল ফোন, পুলিশ রাডার, বিমান চলাচলের যােগাযােগ যন্ত্রগুলাে প্রতি মুহূর্তে তৈরি করে চলেছে অসংখ্য বেতার ফ্রিকোয়েন্সী। এছাড়া পৃথিবীতে অবস্থিত বেতার দূরবীক্ষণ পৃথিবীর মাত্র এক অর্ধাংশ মহাকাশের সঙ্কেত গ্রহণ করতে পারে।
সেটি বিজ্ঞানীরা এই সমস্ত সমস্যার সমাধানের কথা চিন্তা ভাবনা করেছেন। বেতার ফ্রিকোয়েন্সির বিঘ্ন এড়ানাের জন্য চাঁদের অপর পৃষ্ঠে একটি সেটি পর্যবেক্ষণকেন্দ্র গড়ে তােলা যেতে পারে। অবশ্য এতে করে পৃথিবীর মতােই চাঁদও মহাকাশের অর্ধেককে ঢেকে রাখবে। অন্য একটি চিন্তা হচ্ছে, পৃথিবীর কক্ষপথে সেটিবেতার দূরবীক্ষণ স্থাপন করা। এতে করে যেমন মানব সৃষ্ট বেতার ফ্রিকোয়েন্সীর হাত থেকে বাঁচা যাবে, তেমনিভাবে একই সাথে কোন প্রতিবন্ধকতা ছাড়ায় সম্পূর্ণ মহাকাশকে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে।
আরেসিবাে মানমন্দিরের আশাবাদী বিজ্ঞানী মাইক ডেভিস বলেন যে, ❛হয়তাে দেখা যেতে পারে যে সারা মহাবিশ্বে জীবন কিলবিল করছে এবং প্রতিটি নক্ষত্র থেকে বুদ্ধিমান প্রাণীরা সঙ্কেত পাঠাচ্ছে❜। মাইক ডেভিস এবং তার বেশিরভাগ সহকর্মীরা মনে করেন যে আমরা একদিন না একদিন বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাবাে। অবশ্য এর বিপরীত সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।