আগের পর্বে আমরা সহিংসতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সহিংসতার একটি নৃতাত্ত্বিক এবং সামাজিক বিশ্লেষণ হাজির কারার চেষ্টা ছিল আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের পটভূমিকায়। এই পর্বে আমরা দেখব সহিংসতার বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে গিয়েই কীভাবে একসময় পরার্থিতা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উদ্ভব ঘটেছিল মানবসমাজে।
সহিংসতা আর নৈতিকতা দুটি বৈশিষ্ট্যকে সাদা চোখে দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা মনে হবে। কিন্তু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন সহিংসতা আর নৈতিকতার মধ্যে একধরনের অলিখিত সম্পর্ক আছে। গবেষক স্যামুয়েল বাওয়েল তার একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখিয়েছেন আদিম শিকারি সংগ্রাহক সমাজে বিদ্যমান নৃশংস সহিংসতা থেকেই শেষ পর্যন্ত সহযোগিতা আর সহমর্মিতার উদ্ভব হয়েছিল[২৭১]। ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।
আমরা জানি আমাদের ২৫ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাসে শতকরা প্রায় ৯৯ ভাগ সময়ই আমরা শিকারি-সংগ্রাহক হিসেবে কাটিয়েছি। শিকারি সংগ্রাহক সমাজের শতকরা ৯০ ভাগ গোত্রই হানাহানি মারামারিতে লিপ্ত থাকত, আর ১৫ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভাবনা থাকত যুদ্ধ কিংবা খুনোখুনিতে মানুষের মারা যাওয়ার। বাওয়েল তার গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, আদিম শিকারি সংগ্রাহকদের এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে যে গোত্রের সদস্যরা অনেক বেশি নিজেদের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা করেছে, স্বার্থত্যাগ করে সদস্যদের জীবন রক্ষায় কাজ করতে পেরেছে, তারাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ছাকুঁনিতে তারাই টিকতে পেরেছে অন্যদের চেয়ে বেশি। অর্থাৎ, সোজা বাংলায় বললে, মূঢ় সহিংসতা থেকেই একসময় জন্ম হয়েছে মূঢ় পরার্থিতার, নীচের কার্টুনটিতে তার একটি আলামত তুলে ধরা হয়েছে —

কিন্তু কীভাবে স্বার্থপরতা কিংবা সহিংসতার মতো বদখত ব্যাপার-স্যাপার থেকে নৈতিকতার মতো একটি ‘আপাত বিপরীতমুখী’ গুণাবলির জন্ম হতে পারে? আসুন ব্যাপারটি একটু বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার চেষ্টা করি। তবে এ ব্যাপারটি বুঝতে আগে হলে আমাদের চোখ মেলে প্রকৃতির দিকে তাকাতে হবে, তাকাতে হবে প্রাণিজগতের দিকেও। আমাদের জানতে হবে নৈতিকতার ব্যাপারটি কি কেবল মানবসমাজেরই একচেটিয়া নাকি অপরাপর প্রাণিজগতেও এর হদিস মেলে?
প্রাণিজগতে পরার্থিতা এবং নৈতিকতা
১৯৯৬ সালের আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ। শিকাগোর ব্রুকফিল্ড চিড়িয়াখানা। বিন্তি জুয়া (Binti Jua) নামে এক মেয়ে গরিলা খাঁচার ভিতর পায়চারি করছিল। হঠাৎ, খাঁচার বাইরে দর্শকদের মধ্য থেকে একটি তিন বছরের শিশু দেয়ালের উপর বসে গরিলাকে দেখতে গিয়ে খাঁচার ভিতরে প্রায় বিশ ফুট নীচে কংক্রিটের মেঝেতে আছরে পড়ে। পড়েই জ্ঞান হারায় ছেলেটি। বিন্তি পায়চারি বাদ দিয়ে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যায়। ১৬০ পাউন্ডের দীর্ঘদেহী গরিলাটিকে ছেলেটির দিকে এগিয়ে যেতে দেখে দর্শকদের মধ্যে মুহূর্তেই চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে যায়।
বিন্তি কাছে গিয়ে অনেক মনোযোগ দিয়ে ছেলেটিকে দেখতে লাগল। তারপর এক সময় দুই হাতে শিশুটিকে বগলদাবা করে ফেলল। দর্শকদের মধ্যে তখন আতংক চরম মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। অনেকেই ভাবছিলেন, এবারে নিশ্চয়ই বাচ্চাটাকে ছিঁড়ে খুড়ে খেয়ে ফেলবে ঐ পাষণ্ড গরিলা। কিন্তু তারপরে যা ঘটল, তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।
এ কাহিনী কেবল আমরা রূপকথাতেই কিংবা কল্পকাহিনিতেই শুনেছি। বিন্তি শিশুটিকে নিয়ে বিশফুট দেয়াল পার হয়ে খাঁচার এক প্রান্তের একটি প্রবেশ দ্বারে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো যাতে নিরাপত্তাকর্মীরা তার কাছ থেকে এসে নিয়ে যেতে পারে। নিরাপত্তাকর্মীরা বিন্তির কাছ থেকে বাচ্চাটি নিয়েই সোজা হাসপাতালের দিকে ছুটলেন। শিশুটি পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করল দিন কয়েকের মধ্যেই। এভাবেই ব্রুকফিল্ড চিরিয়াখানার বিন্তি নামের গরিলাটি বাঁচিয়ে দিয়েছিল একটি ছোট্ট শিশুর জীবন।

এ ধরনের পরার্থিতামূলক কাজ যে কেবল বিন্তিই করেছে তা কিন্তু নয়। ১৯৮৬ সালে জার্সি চিড়িয়াখানায় জাম্বো নামে আরেকটি গরিলাও ঠিক এমনিভাবে আরেকটি মানব শিশুর জীবন বাঁচিয়েছিল। সেখানেও শিশুটি খাঁচার ভিতরে পড়ে গিয়েছিল, আর জাম্বো বিন্তির মতো শিশুটিকে কোলে করে নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে তুলে না দিলেও বহুক্ষণ ধরে শিশুটির কাছে দাঁড়িয়ে তাকে রক্ষা করেছিল, যাতে অন্য গরিলারা আক্রমণ করতে না পারে।
এতোদিন মানবিকতা, সহিষ্ণুতা, পরার্থিতা, সহযোগিতা, নৈতিকতা প্রভৃতি শব্দগুলোকে ‘মানুষের’ একচেটিয়া সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করার যে রেওয়াজ ছিল, বিন্তি কিংবা জাম্বোর প্রয়াস সে সব স্বতঃসিদ্ধ ধারণার প্রতি শক্তিশালী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল যেন। বিজ্ঞানীরা বলেন, শুধু গরিলা নয় শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাং, কিংবা বনোবোদের মধ্যে এ ধরনের পরার্থিতার সন্ধান খোঁজ করলেই পাওয়া যায়, তারা একে বলেন সহমর্মিতা (Empathy)। সহমর্মিতা মানুষ শুধু নয়, অন্যান্য অনেক প্রাণীর মধ্যেও দৃশ্যমান (Animal Empathy)। আর সহমর্মিতার সাথে নৈতিকতার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
বিজ্ঞানী ফ্র্যান্স ডি ওয়াল তার ‘আওয়ার ইনার এপ’ গ্রন্থে বিন্তির ঘটনাটি বিশ্লেষণ করে অভিমত দিয়েছেন যে, নৈতিকতার ব্যাপারগুলোকে কেবল মানবসমাজের সাংস্কৃতিক অংগ বলে ভেবে নেওয়া হতো তা মোটেও ঠিক নয়; আসলে মানবসমাজে নৈতিকতার উদ্ভবের উৎস লুকিয়ে আছে আমাদের বিবর্তনীয় যাত্রাপথে[২৭২]। ছয় মিলিয়ন বছর আগে আমরা আমাদের শিম্পাঞ্জি জাতীয় পূর্বপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম।
বিজ্ঞানী ফ্রান্স ডি ওয়াল তার সাম্প্রতিক ‘প্রাইমেটস এন্ড ফিলোসফারস’[২৭৩] গ্রন্থে বেশ কিছু আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করে দেখিয়েছেন যে শিম্পাঞ্জি এবং বনমানুষেরাও অনেকটা মানুষের মতো করেই ব্যথা-বেদনায় আক্রান্ত হয়, এমনকি গোত্রে যুদ্ধে পরাজিত হলে পরাজিত শিম্পাঞ্জিকে অন্য একটি শিম্পাঞ্জি সান্ত্বনা জানানোর উদাহরণও তিনি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছেন। কাজেই শিম্পাঞ্জি, গরিলা, বনোবো সহ আমাদের খুব কাছাকাছি প্রজাতিগুলোর আবেগানুভূতি বা সহমর্মিতা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই মানবসমাজে নৈতিকতার প্রকৃত উৎস বৈজ্ঞানিকভাবে জানা সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা আজ মনে করেন।

নৈতিকতার ব্যাপারটি মানুষ, গরিলা কিংবা কিংবা অন্য প্রাইমেটদেরই আছে তা কিন্তু নয়। ছোট স্কেলে তথাকথিত অনেক ‘ইতর প্রাণী’র মধ্যেও কিন্তু এটি দেখা যায়। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়েরা নিজেদের মধ্যে খাদ্য ভাগাভাগি করে, বানর এবং গরিলারা তাদের দলের কোনো সদস্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকলে তাকে সহায়তা করার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে, এমনকি ‘দশে মিলে’ কাজ করে তার জন্য খাবার পর্যন্ত নিয়ে আসে।
ডলফিনেরা অসুস্থ অপর সহযাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সৈকতের দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে অসুস্থ ডলফিনটির পর্যাপ্ত আলো বাতাস পেতে সুবিধা হয়, তিমি মাছেরা তাদের দলের অপর কোনো আহত তিমি মাছকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে চেষ্টা করে। হাতিরা তাদের পরিবারের অসুস্থ বা আহত সদস্যকে বাঁচানোর জন্য সবোর্চ্চ ত্যাগ স্বীকার করে[২৭৪]।
এ ধরনের দৃষ্টান্ত বিরল নয়। অনেক সময় পরার্থিতার ব্যাপারটি কেবল নিজেদের প্রজাতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, বহু ক্ষেত্রেই অতিক্রম করে প্রজাতির আঙ্গিনা। যেমন, ডলফিনেরা হাঙ্গরের আক্রমণ থেকে বিপন্ন মানুষজনকে বাঁচিয়েছে এমন বেশ কিছু নথিবদ্ধ ঘটনার উল্লেখ আছে বিজ্ঞানীদের গবেষণায়[২৭৫], [২৭৬], [২৭৭]।
ভালোবাসা কারে কয়
২৭১.↑ Samuel Bowles, Did Warfare Among Ancestral Hunter-Gatherers Affect the Evolution of Human Social Behaviors?, Science 5 June 2009: Vol. 324. no. 5932, pp. 1293 – 1298
২৭২.↑ Frans De Waal, Our Inner Ape, Riverhead Books; 2005.
২৭৩.↑ Frans de Waal, Stephen Macedo and Josiah Ober, Primates and Philosophers: How Morality Evolved, Princeton University Press, 2006
২৭৪.↑ অভিজিৎ রায়, নৈতিকতা ও ধর্ম, সতন্ত্র ভাবনা (সম্পাদনা সাদ কামালী ও অভিজিৎ রায়, চারদিক, ২০০৮) গ্রন্থে সংকলিত।
২৭৫.↑ Caldwell, M. C. & Caldwell, D. K. (1966). Epimeletic (caregiving) behaviour in cetacea. In: Whales, Dolphins and Porpoises. (Ed. K. S. Norris). University of California Press. pp. 755-789.
২৭৬.↑ V. G. Cockcroft and W. Sauer, Observed and inferred epimeletic (nurturant) behaviour in bottlenose dolphins, Aquatic Mammals 1990, 16.1, 31-32
২৭৭.↑ Connor R.C. and K.S. Norris. Are dolphins reciprocal altruists?. American Naturalist. 119: 358-374.