তখন আমি ক্লাশ সিক্স বা সেভেনে পড়ি। কত প্রশ্ন সব কিছু নিয়ে, সমাজ নিয়ে, পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে। বিশেষ করে নিজের উৎপত্তি নিয়ে তাে এন্তার সব প্রশ্ন করে বিরক্ত করে চলেছি চারপাশের সবাইকে। ঠিক সে সময়েই আমার মামা দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘যে গল্পের শেষ নেই’ বইটি কিনে এনে দিলেন পড়ার জন্য। একটা ছােট বই একজনের জীবনে যে কি প্রভাব ফেলতে পারে তার প্রমাণ এই বইটা। বিবর্তনবাদ সম্পর্কে প্রথম জেনেছিলাম সেখানেই।
কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় এই বইটি থেকে আমি হয়তাে আরও বড় কিছু শিখেছিলাম – চারদিকের পৃথিবীকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেখতে শেখার হাতে খড়ি বােধ হয় হয়েছিল সেখানেই। তাই, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বইটাকে স্মরণ করেই আমার এই বিবর্তনের উপর বইটা শেষ করছি, এই শেষ অধ্যায়টির নাম রাখছি যে গল্পের শেষ নেই। আসলেই তাে অন্তহীন এই গল্পে – সেই সাড়ে তিনশ কোটি বছর আগে প্রথম প্রাণের উৎপত্তির পর থেকে হাটি হাটি পা পা করে এগিয়ে গেছে এই প্রাণের সমারােহ, হাজারাে প্রজাতির ভীরে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে এই। ধরণী, তাদের অনেকেই আবার টিকে থাকার খেলায় হেরে গিয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, উৎপত্তি-বিলুপ্তির এক। অনন্ত খেলায় মেতে আছে যেন এই প্রকৃতি।
বই এর এই শেষ অধ্যায়টা যখন লিখতে বসেছি তখনই দেখলাম ফসিলবিদ এবং জীববিদদের মধ্যে রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেছে নতুন এক আবিষ্কার নিয়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, লুসির ফসিল যদি বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হয়ে থাকে, তবে ৩৩ লক্ষ বছর আগের এই তিন বছর বয়সী বাচ্চার প্রায় সম্পূর্ণ ফসিলটা একুশ শতকের সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার। ফসিলটা পাওয়া গেছে ইথিওপিয়ার প্রত্যন্ত দিকিকা অঞ্চলে, লুসির ফসিল যেখানে পাওয়া গিয়েছিল তার খুবই কাছাকাছি জায়গায়।
এই শিশুটি লুসির প্রজাতিরই (Australopithecus afarensis) অন্তর্ভুক্ত, তাই অনেকেই তাকে আদর করে নাম দিয়েছেন ‘লুসির সন্তান’[৩]। ফসিলটার যে শুধু একটা পূর্ণাঙ্গ চেহারাই রয়েছে তাই নয়, তার দুধের দাঁতগুলাে, পায়ের হাড়, এমনকি আঙ্গুলগুলাে পর্যন্ত ফসিলে পরিণত হয়েছ[২]। কোন বাচ্চার তাে দুরের কথা, পূর্ণাঙ্গ মানুষের এত পুরনাে এবং সম্পূর্ণ ফসিল আগে কখনও পাওয়া যায়নি।
আমরা মানুষের বিবর্তন নিয়ে লেখা অধ্যায়ে দেখেছিলাম যে বিজ্ঞানীরা লুসিসহ এই প্রজাতির বহু ফসিলই খুঁজে পেয়েছেন। এই আবিষ্কারটির মাধ্যমে এখন বিজ্ঞানীরা মানুষের বিবর্তনের সেই উষালগ্নে এই প্রজাতির সন্তানপ্রসব, লালনপালন, শৈশব, বড় হওয়া সহ তাদের জীবনযাত্রার ছবিটা আরও সম্পূর্ণভাবে আঁকতে পারবেন। এ তাে শুধু একটা Australopithecus শিশুর জীবনের কোন এক মুহুর্তের ছবি নয়, এই ফসিলটা যেনাে বিলুপ্তির অতলে হারিয়ে যাওয়া আমাদের এই পূর্বপুরুষ প্রজাতির জীবন প্রবাহকে ছবির ফ্রেমে বেঁধে দিয়েছে।
ভালােই হল ‘লুসির সন্তান’ এর ফসিলের খবরটা পেয়ে, মানব বিবর্তনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল যে বিষয়টা নিয়ে আলােচনা করা বাকি ছিল তা একটু হলেও সহজ হয়ে গেল। আমাদের গল্প অধ্যায়ের শেষে বলেছিলাম, মানুষের সামাজিক গঠন, ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশ নিয়ে শেষ অধ্যায়ে আরেকটু বিস্তারিতভাবে আলােচনা করবাে। মানুষের বিবর্তনে এগুলাে যেরকম গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে তা। হয়তাে অন্য কোন প্রাণীর ক্ষেত্রে সেভাবে প্রযােজ্য নয়। আর সেখানেই কি আমাদের প্রজাতির অনন্যতার রহস্যটি লুকিয়ে রয়েছে?
এ প্রশ্নটির দেওয়ার আগে বােধ হয় তার আগের প্রশ্নটির উত্তর দিয়ে নেওয়া প্রয়ােজন। বিপুল এই প্রাণীজগতে আমরা কি আসলেই অনন্য? এর উত্তর তাে সােজাসাপ্টা ‘হ্যা’ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। মানুষ এই প্রকৃতিরই অংশ, অন্যান্য প্রাণীর মতই লাখ লাখ বছর ধরে প্রাকৃর্তিক। নির্বাচনের প্রক্রিয়ায়ই তার উৎপত্তি ঘটেছে। কিন্তু বিবর্তনের এই প্রক্রিয়াতেই মানুষের মধ্যে অনন্যসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটেছে যা প্রকৃতিতে আগে কখনও ঘটতে দেখা যায়নি।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় যে কি ধরণের অভিনব এবং জটিল বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি ঘটতে পারে তা আমরা আগেই দেখেছি। মানুষের বুদ্ধিমত্তার এই অনন্য স্বকীয়তা যেন তারই আরেক । বিশেষ সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আমাদের সামনে। বর্তমানে হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনােবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক স্টিভেন পিঙ্কার (তিনি এমআইটির মস্তিষ্ক এবং বৌদ্ধিক বিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক, ভাষা, ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ এবং তার সাথে বিবর্তনবাদের সম্পর্ক, মানুষের মন, সচেতন জ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য বিখ্যাত) এক সাক্ষাৎকারে মজা করে বলেছিলেন,
হুট করে দেখলে মানুষের বিবর্তনকে তাে অসাধারণ বলেই মনে হয়। যে পদ্ধতি থেকে শামুক, বট গাছ বা মাছের। মত জীবের জন্ম হয় তা থেকেই কি করে আবার চাঁদে পৌঁছে যাওয়া, মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়া বা ইন্টারনেটের জন্মদাতা এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণীর উৎপত্তি ঘটতে পারে? তাহলে কি কোন স্বর্গীয় স্পর্শ।আমাদের মস্তিষ্ককে বিশেষভাবে তৈরি করেছিল? না, আমি তা মনে করি না, কারণ ডারউনের দেওয়া | প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া দিয়েই মানুষের বিবর্তনকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। [১]
লুসির প্রজাতির অন্যান্য ফসিলের মতই এই দিকিকা শিশুও কোমড় থেকে নীচে দ্বীপদী বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। কিন্তু উপরের সব বৈশিষ্ট্যগুলােই তখনও বনমানুষের মতই রয়ে গেছে। এখান থেকে এবং অন্যান্য আদি মানুষ প্রজাতির ফসিল থেকে বােঝা যায় যে, আমরা আজকে আধুনিক মানুষের যে সব বৈশিষ্ট্যগুলাে দেখি তা একদিনে দেখা দেয়নি। পরিষ্কারভাবেই প্রাকৃতিক নির্বাচন এখানে প্রথমে দ্বিপদী হওয়ার জন্য প্রয়ােজনীয় কোমড়ের নীচের অংশের এবং পায়ের গঠনের বিবর্তনকে নির্বাচন করেছে। তারপর ধাপে ধাপে অন্যান্য পরিবর্তনগুলাে ঘটেছে লক্ষ লক্ষ বছরের পরিক্রমায়।
ব্যাপারটা এমন নয় যে, একটা কোন বিবর্তনের বােতাম টিপে দিলাম বা ম্যাজিকের মত একটা মিউটেশন ঘটে গেল আর আমরা রাতারাতি দু’পায়ে ভর করে দাড়িয়ে গেলাম কিংবা কথা বলার শক্তি পেয়ে গেলাম। প্রাকৃতিক নিয়মে চলা বিবর্তন কখনই এভাবে ঘটে না। ঠিক একইভাবে বলা যায় যে, মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি বা মস্তিষ্কের বিবর্তনও ঘটেছিল ধাপে ধাপে বহুকাল ধরে। আসলে শুধু তাে মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধিই এখানে একমাত্র নিয়ামক হিসেবে কাজ করেনি। মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং বুদ্ধিদীপ্ত আচরণের পিছনে কাজ করে চলেছে মস্তিষ্কের ভিতরের লক্ষ কোটি স্নায়ু কোষ, তাদের বিশেষ গঠন ও জটিল সমন্বয়।
কয়েকশ কোটি স্নায়বিক কোষের সাথে সাথে উন্মেষ ঘটেছে কয়েক হাজার কোটি স্নায়বিক জালিকা দিয়ে তৈরি স্নায়ুতন্ত্রের[১]। প্রায় ৫ লক্ষ বছর ধরে আমরা মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির যে ফসিল রেকর্ডগুলাে পাচ্ছি তাতে শারীরিক পরিবর্তনের পাশাপাশি বুদ্ধিমত্তা এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনেরও ধীর এবং ক্রমান্বয়িক বিকাশ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। শারীরিকভাবে আধুনিক মানুষের কাছাকাছি প্রজাতির উদ্ভব প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে ঘটলেও বৌদ্ধিকভাবে আধুনিক মানুষের বিবর্তন কিন্তু খুব বেশীদিন আগের কথা নয়।
মানব সভ্যতা বলতে আমরা যা বুঝি তার সুচনা হয়েছে এই তাে সেদিন, তারপর হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে যেতে যেতে এসে পৌঁছেছে আজকের স্তরে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে কিছুই হঠাৎ করে একদিনে টুপ করে আকাশ থেকে পড়েনি। আজকে আমরা যে অকল্পনীয় বুদ্ধিমত্তা দেখে অভিভুত হই তার উৎপত্তি এবং বিকাশ বহু লক্ষ বছর ধরে বিবর্তনের ইতিহাসের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ধাপে ধাপেই ঘটেছে।
দিকিকা শিশুর ফসিলটিতে এক অভাবনীয় কান্ড ঘটেছে। তার মাথার খুলির ভিতরের মস্তিষ্কের নরম অংশগুলাে পর্যন্ত পাথরের বুকে ফসিলীভুত হয়ে গেছে। তার মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান থেকে বিজ্ঞানীরা অভুতপূর্ব সব তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের স্তরগুলাে বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখান থেকেই তারা বুঝতে পারবেন প্রথম কখন মানুষের মস্তিষ্ক বড় হতে শুরু করেছিল এবং তা কিভাবে তাদের সামগ্রিক জীবনব্যবস্থায় প্রভাব ফেলেছিল। আসলে মস্তিষ্কের এই আকার বৃদ্ধির সাথে মানুষের সামগ্রিক বিকাশের এত কিছু জড়িয়ে আছে যে তা নিয়ে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে সত্যিই অবাক হতে হয়।
এর ফলে মানুষ যে শুধু বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হয়েছে তাইই নয়, মায়ের সন্তান প্রসব, লালন পালন, পুরুষ ও নারীর জোড় বাঁধা থেকে শুরু করে সামগ্রিক সামাজিক অবকাঠামোতে বিশাল পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিশ লাখ বছর আগে H. erectus দের মধ্যেই মস্তিষ্কের আকার বেশ বড় (প্রায় ১০০০ সিসি) হয়ে যেতে দেখা যায়। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে এই প্রজাতির মায়েরা এত বড় মস্তিষ্কের শিশুর জন্মদান করতাে কিভাবে? তাদের কোমর বা পেলভিক অঞ্চলের যে গঠন তা দিয়ে তাে এত বড় মস্তিষ্কসম্পন্ন শিশুর তাে জন্ম দেওয়া সম্ভব নয় (ঠিক যেমন আমাদের প্রজাতির পক্ষেও তা সম্ভব নয়)! অর্থাৎ প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় কোন এক সময় নিশ্চিয়ই সন্তান ধারণ, সন্তান প্রসব, এবং তাদের লালন পালনের প্রক্রিয়ায় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটেছিল[২]।
মানুষের শিশু অপরিণত অবস্থায় জন্ম লাভ করে, জন্মের সময় তার মস্তিষ্কের আকার যা থাকে তা প্রাপ্তবয়স্ক হতে হতে প্রায় ৩ গুণ বড় হয়, জন্মের পর প্রথম বছরেই তা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে যায়। একটা শিম্পাজি শিশু জন্মের সময় যেটুকু চলাফেরার ক্ষমতা এবং স্বনির্ভরতা নিয়ে জন্মায় তা মানব শিশুতে দেখা যায় জন্মেরও ১৭ মাস পরে[৪]। মানুষের শিশু যদি আরও পরিণত হয়ে জন্মাতাে তাহলে গর্ভাবস্থায়তার মাথার আকারও আরও বড় হত। মায়ের পক্ষে দ্বিপদী গঠন নিয়ে সেই বড় মাথাওয়ালা শিশুর জন্ম দেওয়া সম্ভব হত না[৫]।
তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এ রকম, বিবর্তনের ধারায় কোন এক সময়ে যদি এই অপরিণত শিশুর জন্মের ব্যাপারটা নির্বাচিত না হত তাহলে মানুষের মস্তিষ্কও পরে এত বড় হওয়ার সুযােগ পেত না। আসলে এই পরিবর্তনটির ফলেই পরবর্তী কয়েক লক্ষ বছরের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মানুষের মস্তিষ্কের আকার দ্বিগুণ হতে পেরেছে। এই তিন বছর বয়সী দিকিকা শিশুর মস্তিস্কের আকার থেকে দেখা যাচ্ছে যে এই বয়স পর্যন্ত তার মস্তিষ্কের ক্রমবৃদ্ধি শিম্পাঞ্জির থেকে ধীর গতিতে ঘটেছে।
তাহলে খুব অল্প হলেও সেই ৩০-৪০ লাখ বছর আগেই তাদের শৈশব প্রলম্বিত হতে শুরু হয়ে গিয়েছিল[২]। এদিকে আবার সম্পূর্ণভাবে দ্বিপদী হওয়ার ফলে তাদের হাত স্বাধীন হয়ে গিয়েছিল এবং মায়েরা এই অপরিণত শিশুকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে যত্ন নিতে পেরেছে। তাই দেখা যায়, একসময় মানব শিশু বনমানুষের শিশুদের মত জন্মের পরেই মায়ের পিঠ আঁকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে।

ফসিলবিদেরা এখনও দিকিকা শিশুর পায়ের আঙ্গুলগুলােকে শিলাস্তর থেকে আলাদা করে উঠতে পারেন নি। তারা আশা করছেন এর পায়ের আঙ্গুলের গঠন থেকেই বােঝা যাবে যে, লুসির প্রজাতির সময় থেকেই শিশুরা মাকে আঁকড়ে ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল নাকি তা আরও পরের কোন প্রজাতিতে ঘটেছিল[২]।
এ তাে না হয় গেলাে শারীরিক বিবর্তনের অংশটি, চলুন এখন দেখা যাক এই আপরিণত শিশুর জন্ম দেওয়ার ফলে মানুষের বিভিন্ন প্রজাতির সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনে কি বিশাল প্রভাব পড়েছিল। অপরিণত শিশুকে বড় করার জন্য সাহায্যের প্রয়ােজন, বাবা মার আরও বেশী সময় দিতে হয় তাকে বড় করে তুলতে। অনেকে মনে করেন যে, সন্তানের এই বিশেষ লালন পালন পদ্ধতির সাথে মানুষের জোড়া বাঁধা এবং সামাজবদ্ধ হওয়ার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।
মেয়েরা বেশী সময় ঘরে থেকে সন্তান লালন পালন শুরু করে, পুরুষেরা খাওয়া সংগ্রহ করে ঘরে ফেরে। দ্বিপদী হওয়ার ফলে তাদের হাত দুটো স্বাধীন, তারা বাড়তি খাওয়া হাতে করে নিয়ে আসতে পারে। একজন পুরুষ একজন মেয়ের সাথে দীর্ঘ মেয়াদি সময় ধরে জোড়া বাঁধার ফলে তাদের যৌন সম্পর্কের নিশ্চয়তাও যেমন থাকে আবার অপরিণত শিশুর দেখাশােনার মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়। এদিকে মাংস খেতে শুরু করার পর তাদের আর অরন্যের বা গাছগাছালির উপরও নির্ভর করতে হয় না। তারা যে কোন জায়গায় বসতি স্থাপন করে দুর দুরান্ত থেকে খাওয়া সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে পারে।
হাতিয়ারের ব্যবহারও কিন্তু এক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। বিজ্ঞানীরা ২০ লক্ষ বছরেরও বেশী পুরনাে ফসিলের সাথে বিভিন্ন ধরনের সরল হাতিয়ায়ের সন্ধান পেয়েছেন। এইসব জায়গায় ফসিলীভুত বিভিন্ন জিনিস থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে মানুষের আদি পূর্বপুরুষেরা তখন শিকার করতে শুরু করেছিল। এই সরল হাতিয়ারগুলাের উন্নতি ঘটতে দেখা যায় ১৫-১৭ লক্ষ বছর আগে H. erectus প্রজাতির মধ্যে। তবে এই হাতিয়ারগুলাের গঠনে লক্ষ্যনীয় রকমের গুণগত পরিবর্তন দেখা যায় দুই লক্ষ বছর আগে। এদের বিশেষ রকমের ধারালাে গঠন দেখে বােঝা যায় যে, এ সময়ে নিশ্চয়ই মানুষের বৌদ্ধিক বিকাশে এক বিশেষ অগ্রগতি ঘটেছিল। তারা পরিকল্পণা, কার্যকরন এবং তার প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছিল, কিভাবে হাতিয়ারগুলাে বানালে তা দিয়ে নির্দষ্ট কর্ম সম্পাদন করা যাবে সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল।
বিবর্তনের পথ ধরে
১.↑ Pinker, S. Evolution Of Mind, 2003↑
২.↑ Wong, K. 2006 edition, Lucy’s Baby, Scientific American Magazine
৩.↑ Sloan, C. Nov 2006 edition, Meet the Dikika Baby, National Geographic Magazine.
( লিংকটি পাওয়া যায় নি, রিলেটেড আর্টিকেলটি পড়তে পারেন এখানে↑ )
৫.↑ Mayr E, 2004, What Evolution Is, Basic Books, NY, USA