বিবর্তনের পথ ধরে

বন্যা আহমেদ

০১. মহান সৃষ্টির মধ্যে এত অনাসৃষ্টি কেন?

খটকা যে লাগছিলাে না তা তাে নয়। সব কিছুতেই গরমিল, চোখ মেলে একটু বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা করতে গেলেই কোথায় যেন গন্ডগােল বেঁধে যাচ্ছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রকৃতিবিদ, বিজ্ঞানী এবং ভূতত্ত্ববিদেরা বারবারই যেন হোঁচট খেয়ে পড়ছিলেন চারপাশের অসংখ্য পরিচিত এবং অপরিচিত প্রাণের সমাহার কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। তথাকথিত এই মহান সৃষ্টির মধ্যে এত অনাসৃষ্টি কেন, কেন এতাে অযথা অপচয়, কেন দেখলে মনে হয় এর পিছনে আদৌ কোন পরিকল্পনা বা প্ল্যান নেই? অবস্থাটা দাঁড়ালাে অনেকটা কুয়াের ব্যাঙের মত, কুয়াে থেকে বের না হলে তাে আর বাইরের পৃথিবীর নতুন নতুন জিনিসগুলাে পরখ করে দেখা যাচ্ছে না, আবার কুয়াে থেকে বের হওয়ার পথটাও যে কেউ বাতলে দিচ্ছে না।

ভূতাত্ত্বিক পরীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে আমাদের এই পৃথিবীর বয়স বহু কোটি বছরের কম নয়, বিজ্ঞানীরা তখনও জানতেন না পৃথিবীর আসল বয়স কত, পৃথিবীর বয়স হিসেব করে বের করার মত প্রযুক্তি তখনও তাদের হাতে ছিলাে না, কিন্তু ভুতত্ত্বের বিভিন্ন স্তর এবং ফসিল দেখে বুঝতে পারছিলেন যে এর বয়স বহু কোটি বছরের কম নয় (অনেক পরে, ১৯০৫ সালে রেডিওমেট্রিক ডেটিং আবিষ্কৃত হওয়ার পরও বেশ পরে বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করেন যে, পৃথিবীর বয়স আসলে প্রায় সাড়ে চারশাে কোটি বছর)। ফসিলগুলােও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে জীবজগতের সুদীর্ঘ ক্রমবিকাশের ইতিহাস! কিন্তু বাইবেল তাে বলছে, মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে সৃষ্টি করা হয়েছে সব গ্রহ, তারা, নক্ষত্রসহ আমাদের এই পৃথিবী, প্রকৃতিতে বিরাজমান সব প্রাণ একটি একটি করে সৃষ্টি হয়েছে সৃষ্টিকর্তার হাতে, আর তারপর তারা সেভাবেই রয়ে গেছে, বদলায়নি একটুও, আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত তারা থেকে যাবে অপরিবর্তনীয়!

এই শাশ্বত স্থায়িত্বের তত্ত্ব যেন সিন্দাবাদের ভুতের মতই ঘাড়ে চেপে বসেছিলাে। ষােড়শ শতাব্দীতে কোপার্নিকাস মানুষের কল্পনায় তৈরি স্থির পৃথিবীকে সূর্যের চারদিকে ঘুড়িয়ে দিলেন, ব্রুনােকে আগুনে পুড়তে হলাে এই ঘুর্নায়মান পৃথিবীর তত্ত্বকে সমর্থন করার জন্য। কিন্তু জীববিজ্ঞান ঘুরপাক খেতে থাকলাে সেই কাল্পনিক কয়েক হাজার বছরের অপরিবর্তনশীল এবং স্থবির প্রাণের আবর্তের ভিতরেই।

কিন্তু সেই প্রাচীন কালেই কি গ্রীক দার্শনিকদের মনে সন্দেহ জাগেনি প্রজাতির স্থিরতা নিয়ে? তাদের কেউ কেউ তখনই তাে প্রস্তাব করেছিলেন যে প্রজাতি আসলে পরিবর্তনশীল, এক প্রজাতি থেকেই হয়তাে আরেক প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে! তাহলে তারপর কি হলাে? আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হয় যে, খ্রিষ্টীয় ধর্ম তত্ত্বের অন্ধকুপে আবদ্ধ হয়েই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিলাে দীর্ঘ দুই হাজার বছর!

কিন্তু মানব সভ্যতার ইতিহাসের পাতাগুলাে একটু মনযােগ দিয়ে উল্টালে দেখা যায় যে, এই স্থির বিশ্ব বা অপরিবর্তনশীলতার দর্শনের আসল নাটের গুরু আমাদের বিশ্বজোড়া পূজনীয় দার্শনিকদ্বয়, প্লেটো এবং এরিস্টোটল ছাড়া আর কেউ নয়। এরিস্টোটল তার গুরু প্লেটোর মতই প্রাণশক্তি, স্থবির মহাবিশ্ব, স্থির এবং অপরিবর্তনশীল প্রজাতিতে আস্থাবান ছিলেন। তার মতে, বিশ্বজগতের সব কিছুর পিছনে একটা উদ্দেশ্য ঠিক করা আছে আর এই উদ্দেশ্যের মূলে রয়েছে অপরিবর্তনশীলতা [১]। সব কিছুর ‘বিদ্যমান স্বভাব ধর্ম’ জানাটাই নাকি বিজ্ঞান।

মানব সভ্যতা তার এই স্থবির জাগতিক দর্শনের বােঝা বয়ে বেড়িয়েছে প্রায় দুই হাজার বছর! বার্ট্রান্ড রাসেল তার পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাস’ বইতে এ প্রসঙ্গে বলেছেন যে,

এরিস্টোটলের এই মতবাদ বিজ্ঞান এবং দর্শনের জন্য পরবর্তীতে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে [২]। তারপর যত বড় বড় বুদ্ধিবৃত্তিক অথবা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঘটেছে তাদের প্রায় সবাইকেই কোন না কোন ভাবে কোন না কোন এরিস্টোটলীয় মতবাদকে উৎখাত করে এগুতে হয়েছে। এখনও পর্যন্ত পৃথিবী জুড়ে তারই ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি আমরা।

আঠারশ শতাব্দীর কার্ল লিনিয়াসকে (১৭০৭-১৭৭৮) জীবের শ্রেনিবিন্যাসের জনক বলে ধরা হয়, তিনিই প্রথমবারের মত জীবের শ্রেনিবিন্যাসের একটি সাধারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তৈরী করেন। লিনিয়াসও তখনকার দিনের রেওয়াজ অনুযায়ী একজন প্রকৃতিবিদ হিসেবে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর শ্রেনীবিন্যাস করে স্রষ্টার তুষ্টি লাভেই বেশী আগ্রহী ছিলেন[৩]। এমনকি প্রথম জীবনে তিনি মনে করতেন যে প্রজাতিরা উৎপত্তির লগ্ন থেকে অপরিবর্তনীয় অবস্থায়ই রয়ে গেছে, যদিও পরবর্তীতে এই মত কিছুটা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

তিনি বললেন, এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির হয়তাে সৃষ্টি হয় এবং ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রকৃতিতে অনবরত সংগ্রামও চলে, তবে এর সব কিছুই ঘটে স্বর্গীয় নির্দেশে। বিজ্ঞানীরা গত ২০০ বছর ধরে লিনিয়াসের এই শ্রেনীবিন্যাসের পদ্ধতিকে (অল্প কিছু পরিবর্তনসহ) স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। শুধুমাত্র পার্থক্য এই যে, লিনিয়াস এই মডেল আবিষ্কার করেছিলেন মহান স্রষ্টার সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য আর আজকের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন জীবকে বিভিন্ন শ্রেনীতে ভাগ করেন তাদের মধ্যকার সঠিক বিবর্তনীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ।

জীবের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রা শুরু হয় আসলে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ চার্লস ডারউইনের (১৮০৯- ১৮৮২) হাত ধরে। তিনি বললেন,

কোন প্রজাতিই চিরন্তন বা স্থির নয়, বরং এক প্রজাতি থেকে পরিবর্তিত হতে হতে আরেক প্রজাতির জন্ম হয়, পৃথিবীর সব প্রাণই কোটি কোটি বছর ধরে তাদের পুর্বধূরুষ থেকে বিবর্তিত হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে।

বিবর্তনের ইতিহাসের বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে কয়েকশ কোটি বছর পিছনে গেলে দেখা যাবে যে মানুষ সহ সকল জীবেরই আদি উৎপত্তি হয়েছিল সেই একই আদিম এক কোষী প্রাণী থেকে, তার পর নানা ভাবে, নানা প্রজাতির মাধ্যমে তা বিবর্তিত হয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ডারউইনের দেওয়া এই বিবর্তন তত্ত্বটি আজকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত; এটি অত্যন্ত সফল একটি তত্ত্ব যা সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আজকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ তিনি অন্যদের মত শুধু একটি ধারণা প্রস্তাব করেই ক্ষান্ত হননি, বিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি কিভাবে কাজ করে তার পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন সবিস্তারে, প্রথমবারের মত।

কিন্তু উনবিংশ শতকের সেই সময়ে রক্ষণশীল খ্রীষ্ট ধর্মের প্রবল প্রতাপে প্রকৃতিবিজ্ঞান যখন মুখ থুবড়ে পড়ে ছিল তখন ডারউইন এরকম একটি বৈপ্লবিক মতবাদ দিতে পারলেন কিভাবে? আসলে ডারউইনের আগের হাতে গােনা কয়েকজন সাহসী পুর্বসুরী ইতিমধ্যেই কাজ কিছুটা এগিয়ে নিয়েছিলেন; পৃথিবী তখন অধীর হয়ে অপেক্ষা করছিলাে এমন একজনের জন্য, যিনি তখন পর্যন্ত পাওয়া, বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন তথ্য এবং সিদ্ধান্তগুলােকে এক বিনি সুতাের মালায় গেঁথে জীববিজ্ঞানকে এগিয়ে দেবেন তার পরবর্তী স্তরে। তিনিই হলেন চার্লস রবার্ট ডারউইন।

তাই, ডারউইনের গল্পে আসার আগে তার এই পূর্বসুরীদের কয়েকজনের অবদান সম্পর্কে দু’ একটি কথা না বলে নিলে বিবর্তনের ইতিহাসের গল্পটি হয়তাে অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে। প্রথমেই বলতে হয় ফরাসী জীববিজ্ঞানী জ্যাঁ ব্যাপ্তিস্তে ল্যামার্কের (১৭৪৪-১৮২৯) কথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, জীববিজ্ঞানে ল্যামার্ক তাঁর অবদানের জন্য যতখানি পরিচিত, তার চেয়ে ঢের বেশি পরিচিত বিবর্তনতত্ত্ব নিয়ে তার ভুল মতবাদের কারণে। ল্যামার্ক সঠিকভাবেই সিদ্ধান্তে আসেন যে, প্রজাতি সুস্থির নয়, এক প্রজাতি থাকে আরেক প্রজাতির বিবর্তন ঘটে, তবে তিনি যে পদ্ধতিতে এই পরিবর্তন ঘটে বলে ব্যাখ্যা দেন তা পরবর্তীতে সম্পূর্ণভাবে ভুল বলে প্রমাণিত হয়।

কিন্তু এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ল্যামার্কই হচ্ছেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি প্রজাতির স্থিরতাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে চ্যালেঞ্জ করে বিবর্তনের চালিকাশক্তি এবং পদ্ধতি সম্পর্কে একটি যুক্তিযুক্ত উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলেন। তার মতবাদ সাড়া পৃথিবী জুড়ে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়, এবং এখনও প্রায়ই দেখা যায় যারা বিবর্তন সম্পর্কে ভাসা ভাসা ধারনা রাখেন তাদের অনেকেই ল্যামার্কিয়ান মতবাদকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্বের সাথে ল্যামার্কিয়ান দৃষ্টিভঙ্গীর পার্থক্য নিয়ে আলােচনা করার ইচ্ছা রইলাে পরবর্তী অধ্যায়ে।

ডারউইনের দাদা ডঃ ইরেমাস ডারউইনও (১৭৩১ – ১৮০২) ছিলেন একজন প্রখ্যাত চিকিৎসাবিদ এবং জীবের বিবর্তনের মতবাদের সক্রিয় সমর্থক। তিনি কোন ধর্মীয় বিধি বিধানে বিশ্বাস করতেন না, তবে মনে করতেন যে, এক পরমেশ্বরের নির্দেশেই জীব জগৎ, তার চারদিকের প্রতিকুল প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য, অনবরত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, আর এই পরিবর্তন চলছে বাইবেলে বলা কয়েক হাজার বছর নয়, বরং বহু কোটি বছর ধরে। এ দু’জন ছাড়াও জর্জ বুফো, সেন্ট-ইলার, রবার্ট চেম্বার্স, শিখার, উঙ্গার, হার্বাট স্পেন্সর, শােপেন হাওয়ার সহ অনেক ডারউইনপূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদের নাম করা যায় যারা বুঝতে পেরেছিলেন প্রজাতি আসলে স্থিতিশীল নয়। এরা বিবর্তনকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিলেও এর প্রক্রিয়া কি তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন নি।

এবার আসা যাক, প্রখ্যাত ভুতত্ত্ববিদ চার্লস লায়েলের (Charles Lyell, ১৭৯৫ – ১৮৭৫) কথায়, ডারউইনের বিবর্তনবাদ মতবাদের আবিষ্কারের পিছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ডারউইন লায়েলের এর লেখা ‘Principle of Geology’ বইতে ভুতত্ত্বের সদাপরিবর্তশীলতার ধারনা দিয়ে খুবই প্রভাবিত হন। লায়েল বললেন,

নূহের আমলের এক মহাপ্লাবন দিয়ে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন হয়নি, বরং হয়েছে ধীরে ধীরে বহু কোটি বছর ধরে প্রাকৃতিক শক্তিগুলাের কারণে বৃষ্টি, আগ্নেয়গিরি থেকে অনুৎপাত, ভূমিকম্প, বাতাসের মত অসংখ্য প্রাকৃতিক শক্তি যুগে যুগে ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন ঘটিয়ে এসেছে এবং এখনও একইভাবে এই পরিবর্তন ঘটে চলেছে।

যদিও লায়েলই প্রথম এই মতবাদটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন, তার মতবাদের বেশীরভাগ অংশই এসেছিল তার পূর্বসূরি ভূতত্ত্ববিদ, ইতিহাসের পাতায় প্রায় হারিয়ে যাওয়া, জেমস হাটনের দেওয়া মতবাদ থেকে। সে গল্প আপাতত তােলা থাকলাে পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য। লায়েলের এই মতবাদ তখনকার সমাজে তীব্রভাবে সমালােচনার সম্মুখীন হলেও পরবর্তীতে তা ডারউইনকে খুবই প্রভাবিত করে।

অনেকেই মনে করেন যে লায়েলের এই মতবাদ সামনে না থাকলে ডারউইন এত সহজে বিবর্তনবাদের পক্ষে তার যুক্তি এত বলিষ্ঠভাবে খাড়া করতে পারতেন না। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের পিছনে লায়েলের প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষ অবদান এতখানিই যে, তাকে ছাড়া এই গল্প বলা একরকম অসম্ভবই বলতে হবে, তাই পরবর্তী কয়েকটি অধ্যায়ে দেখা যাবে তাঁর প্রসংগ বারবারই সামনে এসে পড়ছে।

অনেকটা হঠাৎ করেই ১৮৩১ সালে ডারউইন বিগ জাহাজে করে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ৫ বছরের জন্য ঘুড়ে বেড়ানাের সুযােগ পেয়ে যান। তখন তিনি মােটে কেমব্রিজের ক্রাইষ্ট কলেজ থেকে বি এ পাশ করে বেড়িয়েছেন। ছেলেকে ডাক্তার এবং আইনজ্ঞ বানানাের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ডারউইনের বাবা ডঃ রবার্ট ডারউইন শেষ পর্যন্ত তাকে ধর্মযাজক বানানাের জন্য এই ক্রাইষ্ট কলেজে পাঠান।

darwin
চিত্র ২.১: ডারউইনের ২২ বছর বয়সের ছবিঃ এ সময়ই তিনি বিগেল জাহাজের যাত্রা শুরু করেন।

কিন্তু তাতে আপাতভাবে হিতে বিপরীতই হলাে! ধর্মযাজক হওয়া তাে দূরের কথা, তিনিই শেষ পর্যন্ত চরম আঘাত হানলেন সানতন ধর্মের উপর তার বিবর্তন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বিগেল জাহাজে ওঠার সময়ও কিন্তু তিনি অন্যান্য ছাত্রদের মতই সৃষ্টিতত্ত্ব এবং জীবের স্থিতিশীলতার তত্ত্বে বিশ্বাসী একজন প্রকৃতিবিদ ছিলেন, লায়েলের তত্ত্ব তখনও তার পড়া হয়ে ওঠেনি। তাহলে, এই পাঁচ বছরের বিশ্ব-অভিযানে বেড়িয়ে ডারউইন এমন কি দেখলেন যে তার এই ধারনাগুলাের আমুল পরিবর্তন ঘটে গেলাে?

মহান সৃষ্টির মধ্যে এত
চিত্র ২.২: বিগেল জাহাজে করে ডারউইন যে পথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছিলেন

আসলে, হঠাৎ করে পুরাে পৃথিবী ঘুরে দেখার সুযােগ ও দক্ষিণ আমেরিকার বৈচিত্রময় প্রকৃতির সাথে তার স্বভাবজাত ধৈর্য, গভীর পর্যবেক্ষন শক্তি, অনুসন্ধিৎসু মন এবং সর্বোপরি বৈজ্ঞানিক চিন্তা পদ্ধতিকে সমন্বয় করে জীবের উৎপত্তি এবং বিকাশ সম্পর্কে তিনি যে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন তা আমাদের হাজার বছর ধরে লালন করা সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্রান্ত প্রাচীন এবং ধর্মীয় চিন্তা পদ্ধতিগুলােকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলাে। ডারউইনের নিজের কাছেই বিবর্তন তত্ত্বটি এতখানি বিপ্লবাত্মক মনে হয়েছিল যে তিনি তা প্রচার করতেও যথেষ্ট দ্বিধা বােধ করছিলেন।

বিগেল জাহাজের পাঁচ বছরব্যাপী বিশ্বভ্রমণ শেষ করে এসে, ১৮৩৭ সালের দিকেই প্রজাতির উৎপত্তি নিয়ে লিখতে শুরু করলেও ১৮৫৯ সালের আগে তিনি ‘On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life’ বা ছােট করে বললে ‘প্রজাতির উৎপত্তি’ বইটি প্রকাশ করেননি। হুকারের কাছে লেখা এক চিঠিতে ডারউইন এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছিলেন যে এই তত্ত্বটি প্রস্তাব করতে গিয়ে তার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে, বিবর্তনের এই গল্প বলতে গিয়ে মনে হচ্ছে তিনি যেন একজন নরঘাতক হিসেবে স্বীকারােক্তি দিচ্ছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, ডারউইনের শিক্ষক এবং প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী প্রফেসর হেনস্লো ১৮৩১ সালে লায়েলের লেখা বইটি উপহার দেন জাহাজে বসে পড়ার জন্য। গভীরভাবে ইশ্বরে বিশ্বাসী শিক্ষকমশাই পইপই করে এও বলে দেন ডারউইন যেনাে লায়েলের সব সিদ্ধান্তই আবার বােকার মত বিশ্বাস না করে বসেন! কিন্তু আবারও হিসেবে গন্ডগােল হয়ে গেলাে, তিনি যতই বিশ্ব-প্রকৃতি ঘুড়ে দেখতে থাকলেন। ততই এর পক্ষে আরও বেশি করে সাক্ষ্য প্রমান পেলেন[৪] এবং লায়েলের সদাপরিবর্তশীলতার ধারনাতে দীক্ষিত হয়ে উঠলেন। ডারউইন এ সময়ে মুলত ভুতত্ত্ব নিয়েই গবেষনা করছিলেন, এবং ভ্রমন শেষে তিনি ভূ-প্রকৃতি নিয়ে উল্লেখযােগ্য তিনটি বইও লেখেন।

কিন্তু এর মধ্যে দিয়েই জীবজগত নিয়ে তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার বিকাশ ঘটতে থাকে, বিচিত্র ভূ-প্রকৃতির সাথে বিচিত্র সব জীবের সমারােহ দেখতে দেখতে তিনি আরও গভীরভাবে জীবের উৎপত্তি এবং বিকাশ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের চিলির উপকূলে নােঙ্গর করা বিগেল জাহাজের ভিতরে হঠাৎ একদিন ভীষণভাবে আঁতকে উঠলেন ডারউইন সহ জাহাজের অন্যান্য বাসিন্দারা, দুই মিনিট ধরে যেনাে এক মহাপ্রলয় ঘটে গেলাে সারা পৃথিবী জুড়ে। ভুমিকম্প শেষ হলে ডারউইন এবং বীগেলের ক্যাপটেন ফিটজরয় সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন যে, উপকুলের ভূমির উচ্চতা বেড়ে গেছে প্রায় ৮ ফুট! তাহলে কি লায়েলের হিসাবই ঠিক?

সেই অনাদিকাল থেকে প্রাকৃতিক শক্তিগুলােই পরিবর্তন করে আসছে আমাদের এই পৃথিবীর চেহারা? আবার একদিন কেপ ভার্ডে নামে এক দ্বীপপুঞ্জে নেমে তিনি দেখলেন একটি সাদা দাগ চলে গেছে মাইলের পর মাইল জুড়ে পাহাড়ের গা বেয়ে[১]। কৌতুহলী ডারউইন পরীক্ষা করে বুঝলেন যে, এগুলাে আর কিছুই নয়, বহু বছর ধরে শামুক ঝিনুকের খােলসের চুনাপাথর থেকে এই সাদা দাগের উৎপত্তি ঘটেছে, ঠিক একইরকম দাগ বয়ে চলে গেছে সমুদ্রের পার বেয়েও।

ডারউইন আবারও লায়েলের তত্ত্বের স্মরণাপন্ন হতে বাধ্য হলেন, তার মানে সমুদ্রের পার থেকে ৪৫ ফুট উপরের এই এলাকাটি এক সময় সমুদ্রের নীচে ছিলাে এবং অগ্নৎপাতের ফলে সমুদ্রের নীচ থেকে এত উপরে উঠে এসেছে। প্রকৃতিতে এরকম বড় বড় পরিবর্তনের উদাহরনের তাে কোন অভাব নেই, যেমন, মানচিত্র খুললে আজ যে ৭ টি মহাদেশ আমরা একেক জায়গায় দেখি, তিনশাে কোটি বছর আগে কিন্তু এভাবে ছিলাে না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন যে, মহাদেশীয় সঞ্চারনের (Continental drift) মাধ্যমে এক সময় তারা আলাদা হয়ে বিভিন্ন মহাদেশের উৎপত্তি হয় এবং এই সঞ্চারন আজও ঘটে চলেছে বিরামহীনভাবে।

সে যাই হােক, এখন আবার ফিরে যাওয়া যাক আমাদের আসল গল্পে। ডারউইন লায়েলের এই তত্ত্বকেই পরবর্তীতে কাজে লাগান জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে, যদিও লায়েল নিজে প্রজাতির পরিবর্তনের ধারণাকে ভুল বলে মনে করতেন। চারপাশের বিচিত্র প্রাণী আর উদ্ভিদের সমারােহ দেখতে দেখতে ডারউইনের সন্দেহ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে যে জীবজগতও স্থির হতে পারে না, এদের অতীতে পরিবর্তন ঘটেছে এবং আজও তা ঘটে চলেছে। বিগেল জাহাজে ভ্রমনকালীন সময়ে তিনি দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বড় বড় অভিযান চালান।

এরকম একটি থেকে ফিরে এসে তিনি তার বােন সুজানকে লেখা একটি চিঠিতে বলেন যে এটি ছিলাে তার সবচেয়ে সফল অভিযান কারণ এর পরই তিনি নিশ্চিত হন যে,

আমলে এত দিন ধরে চলে আসা ভূ-প্রকৃতির স্থিতিশীলতার তত্ত্বটি ভুল, লায়েলের সদৗ-পরিবর্তনশীল ভূ-প্রকৃতির ধারণাই আসলে সঠিক। এই উপলব্ধিটিই পরবর্তিতে প্রাণের বিবর্তন সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসার ব্যাপারে অগ্রনী ভুমিকা পালন করে [৮]

তখনও অন্যান্য ফসিলবিদদের আবিষ্কৃত বেশ কিছু ফসিলের উদাহরণ ছিলাে ডারউইনের সামনে, কিন্ত সেগুলাের উপর তার মূল সিদ্ধান্ত ভিত্তি না করে তিনি বেশীরভাগ উদাহরণই সংগ্রহ করেন প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিচিত্র প্রাণী এবং উদ্ভিদ থেকে। তিনি প্রকৃতিতে এত বৈচিত্রময় প্রাণের সমাহার এবং তাদের মধ্যকার বিপুল সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য দেখে বিস্মিত হন। একই ধরনের কাছাকাছি শারীরিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রজাতিগুলােকে কেন সাধারণত একই মহাদেশে বা কাছাকাছি দ্বীপপুঞ্জেই দেখা যায়? আবার অন্যদিকে এই প্রতিটি প্রজাতির খাদ্যাভ্যাস, বা বসবাসের পরিবেশের মধ্যে কেন এতাে লক্ষণীয় রকমের পার্থক্য দেখা যায়?

কেন আফ্রিকা মহাদেশেই শুধু বিভিন্ন প্রজাতির জেব্রা দেখা যায়, মারসুপিয়াল (পেটের কাছের থলিতে বাচ্চা বড় করতে পারে এমন ধরনের প্রাণীদের মারসুপিয়াল বা Marsupian জাতীয় প্রাণী বলা হয়) জাতীয় ক্যাঙ্গারু বা কোয়ালা কেন পাওয়া যায় শুধু অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে? আবার দক্ষিণ আমেরিকার দ্বীপে উড়তে অক্ষম দু’ধরনের বেশ বড় আকৃতির পাখি দেখা গেলেও অস্ট্রেলিয়ার ইমু বা আফ্রিকার উটপাখীর সাথে তাদের কোন মিল নেই।

স্থলচর প্রাণীর মধ্যে ইউরােপের মত এখানে খরগােশ নেই, আছে কয়েক ধরনের তীক্ষ দাঁতসম্পন্ন অন্য ধরনের ইঁদুর, জলচর প্রাণীর মধ্যে কয়পাস (Coypus) বা ক্যাপিব্যারাসের (Capybaras) মত প্রাণী থাকলেও, বিবর জাতীয় (Beaver) প্রাণীর তাে দেখা পাওয়া যাচ্ছে না এখানে! গ্যালাপ্যাগাস দ্বীপপুঞ্জে এবং তার কাছাকাছি এলাকাগুলােতে ১৪ ধরনের প্রজাতির ফিঞ্চ পাখী, ১৬ প্রজাতির শামুক, তিন রকমের প্রকান্ড আকারের কচ্ছপ এবং গিরগিটির মত দেখতে কয়েক প্রজাতির ইগুয়ানা দেখা যায় যেগুলাে পৃথিবীর আর কোন অঞ্চলে দেখা যায় না।

দক্ষিণ আমেরিকায় আরও আছে টেপির, চিনচিলা, আর্মাডিলা, লামা, জাগুয়ার, প্যান্থার, বিশাল আকৃতির পিপিলিকাভূক এবং আরও অনেক প্রাণী যাদেরকে আফ্রিকা মহাদেশে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার আফ্রিকার সিংহ, হাতি, গন্ডার, জলহস্তী, জিরাফ, হায়েনা, লেমুর, শিম্পাঞ্জির মত প্রাণীগুলাে সম্পূর্নভাবে অনুপস্থিত সেই মহাদেশে। এ প্রসংগে বলতে গিয়ে তিনি তার বইতে লিখেন, জৈব-ভৌগলিক উদাহরণগুলাে নিয়ে যারা কাজ করছেন, তারা নিশ্চয়ই ‘কাছাকাছি প্রজাতিগুলাের মধ্যে একই ধরনের বৈশিষ্ট্যের বা প্যাটার্নের রহস্যময় সমন্বয় দেখে অবাক না হয়ে পারেন না[৫]

ডারউইন এই গ্যালাপ্যাগাসের দ্বীপগুলােতেই সবচেয়ে বিচিত্র ধরনের প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন, যা তাকে পরবর্তীতে বিবর্তনের পক্ষের প্রমাণগুলাে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করে। গ্যালাপ্যাগাসের বিভিন্ন দ্বীপগুলােতে যে ১৪ ধরনের ফিঞ্চ দেখতে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ডারউইন নিজেই ১৩ টি সংগ্রহ করেছিলেন। এই ফিঞ্চ পাখিগুলাে হচ্ছে বিবর্তনীয় অভিযােজন (Adaptation) বা বিবর্তনের ফলে এক প্রজাতি থেকে বিচিত্র বহু ধরনের প্রজাতি উৎপত্তি হওয়ার একটি চমৎকার উদাহরণ।

বিস্মিত ডারউইন লক্ষ্য করলেন যে, তাদের সার্বিক দৈহিক গঠনে প্রচুর মিল থাকলেও ঠোটের আকৃতি ও গঠনে বেশ উল্লেখযােগ্য রকমের পার্থক্য রয়েছে। এদের মধ্যে আবার ছয়টি মাটিতে বাস করে এবং বাকিরা থাকে গাছে। যারা মাটিতে থাকে তাদের মধ্যে একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের বীজ খেয়ে বেঁচে থাকে আর বাকীদের প্রধাণ খাদ্য হচ্ছে ক্যাকটাস জাতীয় গাছের ফুল। দেখা গেলাে যারা বীজ খায় তাদের ঠোঁট বেশ মােটা যা তাদেরকে বীজ ভাঙ্গতে সহায়তা করে, আবার যারা ক্যাকটাসের ফুল খায় তাদের ঠোঁটগুলাে হচ্ছে সােজা এবং খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ফুল খাওয়ার উপযােগী।

যারা গাছে থাকে এবং পোঁকা মাঁকড় ধরে খায় তাদের ঠোঁটের আকৃতি আবার ঠিক সেরকমই লম্বা যাতে তারা গর্ত থেকে পোঁকা ধরে নিয়ে আসতে পারে। ডারউইন এই পর্যবেক্ষণ থেকে লিখেলেন, ‘সবচেয়ে কৌতুহলােদ্দীপক বিষয় হচ্ছে এই প্রজাতিগুলাের ঠোঁটের নিখুঁত ধাপে ধাপে ঘটা ক্রমবিকাশ …একটি ছােট ও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত পাখির দলের মধ্যে বৈশিষ্ট্যের এই ক্রমাগত রূপান্তর ও বৈচিত্র দেখে যে কেউ অবশ্য কল্পনা করতে পারে যে এই দ্বীপগুলােতে পাখির প্রাথমিক অভাব দুর করার জন্য একটি মুল প্রজাতি থেকে নিয়ে বিভিন্ন পরিবেশের জন্য উপযােগী ও পরিবর্তন করে অন্যদের তৈরী করা হয়েছে [৬]

finch beak
চিত্র ২.৩: ডারউইনের আঁকা কয়েকটি প্রজাতির ফিঞ্চের ছবি (1) large ground finch (2) medium ground finch (3) small tree finch (4) warbler finch)

তিনি পরবর্তিতে তার বইতে লেখেন,

বিভিন্ন জীবের মধ্যে এলাকা এবং সময় বিশেষে এই নিবিড় সম্পর্কের কারণ উত্তরাধিকার ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না, অর্থাৎ এই কাছাকাছি ধরনের প্রজাতিরা সাধারণত খুব কাছাকাছি এলাকায় বাস করে কারণ তারা একসময় একই পুর্বপুরুষ থেকে পরিবর্তিত হতে হতে বিভিন্ন প্রজাতিতে পরিণত হয়েছে [৫]

এতদিনের সৃষ্টিতত্ত্ব আমাদেরকে যা শিখিয়ে এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করলে ধরে নিতে হবে যে, কোন এক সৃষ্টিকর্তা বিভিন্ন পরিবেশের সাথে উপযােগী করে বিভিন্ন জায়গার প্রাণী এবং উদ্ভিদ তৈরী করেছিলেন। কিন্তু এই যুক্তির সাথেই কি বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমান উদাহরণের কোন মিল পাওয়া যাচ্ছে? তাহলে তাে একই ধরনের জলবায়ু এবং ভৌগােলিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জায়গাগুলােতে একই রকমের প্রাণী দেখা যাওয়ার কথা ছিলাে!

ডারউইন দেখলেন যে, বিভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে মিল বা অমিল – কোনটাকেই শুধুমাত্র পরিবেশগত পার্থক্য দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। যেমন, অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের প্রাণীগুলাের সাথে অন্য মহাদেশের প্রাণীর তেমন কোন মিল নেই, আবার আমরা দেখেছি যে, দক্ষিণ আমেরিকার প্রাণীগুলােও দেখতে বেশ অন্যরকম। অথচ ইউরােপ, এশিয়া বা আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় তাে অস্ট্রেলিয়া বা দক্ষিণ আমেরিকার মত পরিবেশ দিব্যি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আবার গ্যালাপ্যাগাস বা দক্ষিণ আমেরিকার কাছাকাছি দ্বীপগুলাের প্রাণীদের সাথে তার মুল ভুখন্ডের প্রাণীদের যেরকম মিল পাওয়া যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জীবজন্তুর সাথে তা পাওয়া যাচ্ছে না।

ডারউইন যদি  এই দ্বীপগুলােতে সম্পূর্ন নতুন ধরনের প্রাণী দেখতেন তাহলে সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে তার মনে হয়তাে প্রশ্ন উঠতাে না, কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার মুল ভুখন্ডের সাথে তাদের এই পরিমাণ সাদৃশ্য তাকে ভাবিয়ে তুলেছিলাে। তিনি প্রশ্ন করলেন, সৃষ্টির সময় এইসব দ্বীপে যদি বিভিন্ন জীবদের রেখে দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে এদের গায়ে দক্ষিণ আমেরিকার ছাপ কেনাে? আবার ঠিক বিপরীতভাবে দেখা যাচ্ছে, কাছাকাছি জায়গার দ্বীপগুলােতে বাস করা বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তুর মধ্যে রয়েছে অকল্পনীয় রকমের বৈচিত্র! বিস্মিত হয়ে ডারউইন লিখলেন যে তিনি এত কাছাকাছি, মাত্র ৫০-৬০ মাইল দুরে অবস্থিত দীপগুলাে, যাদের একটি থেকে অন্যটিকে খালি চোখে দেখা যায়, যারা একই শীলায় তৈরী, একই জলবায়ুর অধীন, এমনকি যাদের উচ্চতাও এক – তাদের মধ্যে এত ভিন্ন ধরনের বাসিন্দা দেখা যাবে তা স্বপ্নেও আশা করেননি[১]


 বিবর্তনের পথ ধরে


১.↑    আখতারজ্জামান,ম, ২০০২, বিবর্তনবাদ, হাসান বুক হাউস, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃঃ ১৩-১৬।
২.↑    Russel B, 1946, History of Western Philospphy, George Allen and Unwin Ltd, London, p 157.
৩.↑    Carl Linnaeus, The University of California Museum of Paleontology ↑
৪.↑    Charles Lyell: Principles of Geology, PBS ↑
৫.↑    Was Darwin, 2004, Wrong, National Geographic Magzine, Nov. ed.
৬.↑    Berra MT, 1990, Evolution and the Myth of Creationism. Stanford University Press, Stanford, California
৮.↑    সুশান্ত মজুমদার, ২০০৩, চার্লস ডারউইন এবং বিবর্তনবাদ, প্রকাশকঃ সােমনাথ বল, কোলকাতা, ইন্ডিয়া।

5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top
১ম অধ্যায়

২য় অধ্যায়

৩য় অধ্যায়

৪র্থ অধ্যায়

৫ম অধ্যায়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

৭ম অধ্যায়

৮ম অধ্যায়

৯ম অধ্যায়

১০ম অধ্যায়

১১ম অধ্যায়

পরিশিষ্ট
রঙ্গীন প্লেট

বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো

গ্রন্থ আলোচনা