মহাজাগতিক কালের পাল্লায় ফেলে হিসেব করলে হাজার বছর চট করে পার হয়ে যাওয়া এক ধূসর সন্ধ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। মােটা মােটা বই লেখা হয় মহামনিষীদের জীবন কাহিনী নিয়ে, কিন্তু কতদিনের জীবন সেটা? সত্তর-আশি-নব্বই বা একশাে বছর? আর ওদিকে আমাদের এই বুড়াে পৃথিবীর বয়স হাজার নয়, লক্ষ নয়, এমনকি দুই এক কোটিও নয়, প্রায় সাড়ে চারশাে কোটি বছর। মহাকালের বিস্তৃতিকে ঠিকমত উপলব্ধি করে ওঠা বা মাথা দিয়ে বুঝতে পারা আমাদের মত স্বল্পায়ু প্রাণীর জন্য এক দুসাধ্য প্রচেষ্টাই বলতে হবে।
আমরা যখন আমাদের ইতিহাসের কথা বলি আমরা হিসেব করি বছর, যুগ, শতাব্দীর বা খুব বেশি হলে সহস্রাব্দের। কিন্তু পৃথিবীর বয়সের হিসেব তাে আর সেভাবে করলে হবে না! মহাজগতের সওয়ারী হয়ে ছুটে চলা আমাদের এই পৃথিবী নামক গ্রহটার ইতিহাস বিচার করতে হবে মহাকালের ঘড়ির কাঁটার হিসেব দিয়ে। শুধু প্রচলিত হিসেবের পদ্ধতিটাকেই নয়, আমাদের চিন্তার পদ্ধতিটাকেও বদলে ফেলতে হবে, টেনে লম্বা করে নিয়ে যেতে হবে অনেকখানি – লক্ষ, কোটি বছরের চৌহদ্দিতে।

চলুন, এই কোটি কোটি বছরের বিশাল ব্যপ্তিটাকে একটা সহজ এবং বােধগম্য উদাহরণ দিয়ে বােঝার।চেষ্টা করি। ধরুন, সাড়ে চারশাে কোটি বছর ইতিহাসটাকে আমরা ১২ মাসের ক্যালেন্ডারে ফেলে প্রাণের বিকাশের সময়সীমাগুলাে সম্পর্কে একটা আপেক্ষিক বা তুলনামুলক ধারণা পেতে চাই। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা দাঁড়াবে অনেকটা এরকমঃ
পৃথিবীর জন্ম প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিলাে বছরের প্রথম দিন বা পয়লা জানুয়ারীতে, আর ফেব্রুয়ারী বা মার্চে প্রথম উৎপত্তি ঘটলাে ব্যকটেরিয়া বা নীলাভ শৈবাল জাতীয় প্রথম আদি প্রাণের। এই আদি জীবদের প্রতিপত্তি চলেছে বহুকাল ধরে। বছরের অর্ধেকেরও বেশী পেরিয়ে অক্টোবর মাস এসে গেছে বহুকোষী জীবের বিকাশ হতে হতে। জটিল ধরণের কোন প্রাণীর সন্ধান পেতে হলে আপনাকে কিন্তু সেই নভেম্বর মাসে এসে পৌছাতে হবে, যদিও তাদের রাজত্ব তখনও শুধুমাত্র পানিতেই সীমিত।
নভেম্বরের শেষের দিকে প্রথমবারের মত পানিতে চোয়ালওয়ালা মাছ আর মাটিতে উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, আর ওদিকে পানি থেকে ডাঙ্গায় বিবর্তিত হওয়া প্রাণীগুলাে পৃথিবীর মাটিতে রীতিমত জাঁকিয়ে বসেছে ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে। জুরাসিক পার্ক সিনেমায় দেখা সেই বড় বড় ডায়নােসরগুলাের আধিপত্য শুরু হলাে এ মাসের মাঝামাঝি, কিন্তু ২৬ তারিখ আসতে না আসতেই তারা আবার চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেলাে পৃথিবীর বুক থেকে। খেয়াল করে দেখুন যে বছর শেষ হতে আর মাত্র ৫ দিন বাকি, কিন্তু এখনও মানুষ নামক আমাদের এই বিশেষ প্রজাতিটির কোন নাম গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না পৃথিবীর বুকে।
ডিসেম্বরের ২৬ তারিখের দিকে আমাদের পুর্বপুরুষের বিবর্তন শুরু হয়ে গেলেও বানর জাতীয় প্রাণীর দেখা মিলছে ২৯ তারিখে আর নর বানরের উৎপত্তি ঘটতে দেখা যাচ্ছে ৩০ তারিখে। বছরের শেষ দিনে এসে উৎপত্তি ঘটলাে শিম্পাঞ্জির আর আমাদের এই মানুষ প্রজাতির কথা যদি বলেন তাহলে তাদের দেখা মিললাে বছর শেষের ঘন্টা বাজার মাত্র ২০ মিনিট আগে। আমরা এই আধুনিক মানুষেরা ইউরােপ অস্ট্রেলিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছি এই তাে মাত্র ৬ মিনিট আগে আর কৃষি কাজ করতে শিখেছি ঘড়িতে রাত বারােটা বাজার ১ মিনিট আগে [১]!
এক্কেবারে হলফ করে সঠিক বয়সটা নির্ধারণ করতে না পারলেও ডারউইনের অনেক আগেই ভূতত্ত্ববিদেরা মােটামুটি ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্তরের আপেক্ষিক বয়সের ব্যাপারটা বের করে ফেলেছিলেন। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অধ্যায়েই আমরা দেখছি যে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আবিষ্কারের পিছনে পৃথিবীর এই দীর্ঘ বয়সের ব্যাপ্তি এক অনিবার্য ভুমিকা পালন করেছিলাে। ধীরে ধীরে কোটি কোটি বছরের সময়ের বিস্তৃতিতে জীবের মধ্যে গড়ে ওঠা মিউটেশন, হাজারাে রকমের প্রকরণ, ভৌগলিকভাবে একত্রীকরণ বা বিচ্ছিন্নতা, তাদের টিকে থাকার জন্য নিয়ত সংগ্রাম ইত্যাদির সমন্বয় ঘটাতে না পারলে ডারউইনের পক্ষে প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্বকে কোনভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব হত না।
বিংশ শতাব্দীর বেশ কিছুটা সময় পার করে দেওয়ার পরও কিন্তু বিজ্ঞানীদের ভূতাত্ত্বিক সময় মাপার জন্য আপেক্ষিক সময় নিরূপণ বা আপেক্ষিক ডেটিং পদ্ধতি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলাে। শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে রেডিওমেট্রিক ডেটিং বা তেজস্ক্রিয় সময় নিরূপন পদ্ধতির মাধ্যমে পরম সময় (Absolute Time) নির্ধারণের উপায় আবিষ্কৃত হওয়ার আগে পর্যন্ত আপেক্ষিক পদ্ধতিতেই শীলাস্তর বা ফসিলের বয়স নির্ধারণ করা হত। কিন্তু আপেক্ষিক বা পরম ডেটিং পদ্ধতি বলতে কি বােঝায়?
এখনও যেহেতু আপেক্ষিক এবং পরম উভয় পদ্ধতি ব্যবহার করেই ভূত্বক, শিলাস্তর বা ফসিলের বয়স নির্ধারণ করা হয়, তাই পদ্ধতিগুলাে নিয়ে একটু বিস্তারিতভাবে আলােচনা করলে বােধ হয় মন্দ হয় না। ফসিল কিভাবে তৈরি হয়, সেগুলাে কিভাবে প্রাণের বিবর্তনের পক্ষে সাক্ষ্য বহন করে, তা নিয়ে আগে অনেক কথাই বলা হয়েছে, বিজ্ঞানমনস্ক কৌতুহলী পাঠকের মনে এখন প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক – তাহলে বিজ্ঞানীরা কিভাবে এত নিশ্চিত হয়ে বলে দিচ্ছেন কোন ফসিলের বয়স কত, তারা কোন ভূতাত্ত্বিক সময়সীমার প্রতিনিধিত্ব করে, কি করেই বা ভূত্বকের বিভিন্ন স্তরের বয়স নির্ধারণ করা হয়, এর জন্য কোন ধরণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, ইত্যাদি, ইত্যাদি?
ডারউইনের বেশ আগে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ভূতত্ত্ববিদেরা যে ভূত্বকের বিভিন্ন স্তরের আপেক্ষিক বয়স। নির্ধারণ করতে শুরু করে দিয়েছিলেন তার ভিত্তি ছিলাে কিন্তু বেশ সহজ। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, আগের পাললিক শীলা স্তরের উপর ধীরে ধীরে নতুন পলিমাটি এসে জমা হতে হতে নতুন শীলাস্তরের জন্ম হয়, অর্থাৎ, খুব বেশি বড় ধরণের কোন ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন বা ওলটপালট ঘটে না গেলে আগের স্তরটি পরবর্তী সময়ে তৈরি নতুন স্তরের নীচেই অবস্থান করে। এগুলােকে বলে স্ট্যাটা (Strata) বা স্তর। নীচে, বিশ্ব বিখ্যাত গ্রন্ড ক্যানিয়নের ছবিতে, পরিষ্কারভাবে এই বিভিন্ন স্তরের খাজগুলাে দেখা যাচ্ছে, এখানকার অনেক শীলাস্তরই তাদের সেই উৎপত্তির সময় থেকে এখন পর্যন্ত একই অবস্থাতে রয়ে গেছে।
ষােলশ শতাব্দীতেই বিখ্যাত ডেনিশ বিজ্ঞানী নিকোলাস স্টেনাে এই শীলাস্তরের আপেক্ষিক অবস্থানের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছিলেন। স্তরে স্তরে জমা হওয়াটা পাললিক শীলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এভাবে পুরনাে স্তরের উপর নতুন স্তরের জমা হওয়ার পদ্ধতিকেই বলে স্তরের পর্যায়ক্রমিক উপরিপাতন (Superposition)। আর এ থেকেই হিসেব কষে বের করা সম্ভব বিভিন্ন স্তরের আপেক্ষিক বয়স।
তারপর জেমস হাটন এবং চার্লস লায়েল যে পৃথিবী এবং তার বিভিন্ন শীলাস্তরের বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে এক বিশাল ভুমিকা রেখেছিলেন তা তাে আমরা আগের আধ্যায়েই দেখেছি। বিভিন্ন শীলাস্তরের আপেক্ষিক বয়স নির্ধারণের ব্যাপারে স্তরে স্তরে খুঁজে পাওয়া ফসিলগুলােও এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলাে। সেই সময়েই বিজ্ঞানীরা খেয়াল করতে শুরু করেন যে, একেক স্তরে একেক ধরণের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে।

আঠার এবং উনিশ শতাব্দীতে ভূতত্ত্ব্ববিদ উইলিয়াম সিথ এবং ফসিলবিদ জর্জ কুঁভিয়ে প্রথম দেখালেনঃ একই বয়সের পাথর বা শীলাস্তরে সাধারণভাবে একই রকমের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি এই শীলাস্তরগুলাে একটা আরেকটা থেকে অনেক দুরে অবস্থিত হলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের ভিতর একই রকমের ফসিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
হাজার হাজার মাইল দুরের শীলাস্তরে যখন একই ধরণের প্রাণীগুলাের ফসিল পাওয়া যায় তখন তাদেরকে বলা হয় নির্দেশক ফসিল (Indicator Fossil)। এদের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা শীলাস্তরের বয়স সম্পর্কে একটা আপাত ধারণায় পৌঁছুতে পারেন। শীলাস্তরগুলাে একটা আরেকটা থেকে বহুদূরে অবস্থিত হলেও তারা আসলে একই ভূতাত্ত্বিক সময়ের প্রতিনিধিত্ব করে কারণ সেই নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই শুধুমাত্র এ ধরণের প্রাণীর অস্তিত্ব ছিলাে।
এরকম বিভিন্ন ধরণের পর্যবেক্ষণ থেকেই বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত দু’টো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে আসতে শুরু করেন, ব্যাপারটা যেনাে অনেকটা একই মুদ্রার এ পিঠ আর ওপিঠ। একদিকে তারা বিভিন্ন স্তরের অবস্থান অনুযায়ী ফসিলের আপেক্ষিক বয়স বের করতে শুরু করলেন, আর ঠিক উল্টোভাবে একেক স্তরে পাওয়া ফসিলের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্যেগুলাের উপর নির্ভর করে ভূতাত্ত্বিক স্তরগুলাের আপেক্ষিক বয়স এবং নামকরণ করলেন।
উনিশশাে শতাব্দীর প্রথম দিক থেকেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছিলেন যে, নীচের স্তরগুলাে অপেক্ষাকৃত আদিমতর জীবের ফসিল বহন করে চলেছে, ধীরে ধীরে যতই উপরের স্তরে উঠে আসা হচ্ছে ততই আধুনিকতর জীবের ফসিল দেখা যেতে শুরু করছে [২]। ব্যাপারটা অনেকটা এরকম : ধরুন, আমি বা আপনি, ভূতত্ত্ববিদ্যা এবং ফসিলবিদ্যা সম্পর্কে অত্যন্ত জ্ঞানী দু’জন ব্যক্তি, মাটি খুঁড়তে শুরু করলাম – আর আমরা এমনি ভাগ্যবান বা বুদ্ধিমান যেটাই বলুন না কেনাে, এমন সব জায়গায়ই খােড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম যেখানে ভুরিভুরি ফসিল পাওয়া যাচ্ছে (যুক্তির খাতিরেই কেবল এটা ধরে নিচ্ছি, বাস্তবে মাটি খুড়লেই যে ফসিল পাওয়া যাবে না সেটা নিয়ে তাে আগেই আলােচনা করেছি)। সেক্ষেত্রে যতই আমরা নীচের দিকে খুড়তে থাকবাে ততই আমরা কি দেখবাে? আমরা যা দেখবাে তার সারাংশ অনেকটা এরকমঃ উপরের দিকের স্তরে পর্যায়ক্রমিকভাবে খুঁজে পাবাে মানুষ, তারপর বন মানুষ এবং বানরের ফসিল। কিন্তু যত নীচের দিকে যেতে থাকবাে সময়ের সাথে সাথে ততই আর এদের ফসিলগুলাে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
একটা একটা করে আরও নীচের দিকের স্তরগুলােতে নামতে থাকলে পর্যায়ক্রমিকভাবে দেখা যাবে প্রথমে সপুষ্পক উদ্ভিদের ফসিলগুলাে হারিয়ে যাচ্ছে, ধীরে। ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ, চারপায়ী মেরুদন্ডী প্রাণী, স্থলজ উদ্ভিদ, মাছগুলাে, শেল বা খােলস-ওয়ালা শামুকজাতীয় প্রাণীগুলাে, আদিম সরল বহুকোষী এবং এক কোষী জীবগুলাের ফসিল [৩]। আর তারপর এক্কেবারে নীচে, প্রায় সাড়ে তিনশাে কোটি বছরের চেয়েও পুরনাে স্তরগুলােতে নেমে আসলে কোনরকম কোন প্রাণেরই হদিস পাওয়া যাবে না!
অর্থাৎ, সঠিক সময়সীমাটা না জানলেও উনবিংশ শতাব্দীতেই এই আপেক্ষিক ভূতাত্ত্বিক সময়ের স্কেলটি তৈরি করা ফেলা হয়েছিল। এখানে মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এই যে, বিভিন্ন শিলাস্তরে ধারাবাহিকভাবে পাওয়া ফসিল রেকর্ডগুলাে এই সময়ক্রম নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখলেও, ডারউইনের পূর্ববর্তী সময়ের এই বিজ্ঞানীরা কিন্তু প্রাণের বিবর্তনের ধারণাটাকে গ্রহনযােগ্য মনে করতেন না।
অথচ, এই সময়সীমাগুলােকে ভাগ করা হয়েছিলাে ফসিল রেকর্ডে পাওয়া প্রাণীকুলের বিবর্তনের অনুক্রম এবং বিভিন্ন যুগে ঘটা বিশাল গণ-বিলুপ্তিগুলাের উপর ভিত্তি করেই। তারপর ১৮৫৯ সালে ডারউইন তার অরিজিন অফ স্পেশিজ বইটি বের করার পর সব কিছুই আমাদের সামনে পানির মত পরিষ্কার হয়ে গেলাে – বিবর্তনের ব্যাপারটা অস্বীকার করেই হােক বা না বুঝেই হােক বিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে যে ভুতাত্ত্বিক সময়ক্রমটি তৈরি করেছেন তা আসলে সামগ্রিকভাবে প্রাণের বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকেই যথাযথভাবে তুলে ধরে।
তবে প্রতিনিয়ত বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ভিত্তিতে এই ভূতাত্ত্বিক সময়ের স্কেল বা অনুক্রমটিকেও অনবরত আপডেট করার প্রয়ােজন হয় বৈকি। বিজ্ঞান বলেই তা করতে হয়। বিজ্ঞান তাে স্থবির নয়, সতত গতিশীল সে। সে যাই হােক, এখন তাহলে চলুন দেখা যাক, এই ভূতাত্ত্বিক সময়ের স্কেল বা সময়ক্রমটিকে কিভাবে ভাগ করা হয়েছে। আমাদের এই ইতিহাসকে প্রথমে ৪ টি বড় ইয়ন বা অতিকল্পে ভাগ করা হয়েছেঃ ৪৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর উৎপত্তি থেকে শুরু করে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে প্রি-আরকিয়ান যে সময়টাতে কোন জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

তারপর থেকে শুরু করে প্রায় ২৫০ কোটি বছর আগে পর্যন্ত সময়টাকে বলা হয় আরকিয়ান। এ সময়ই ব্যাকটেরিয়া জাতীয় বিভিন্ন ধরণের আদি কোষীজীবের উৎপত্তি ঘটতে শুরু করে। এর পরে প্রটেরােযােয়িক অতি কল্পটির বিস্তৃতি ব্যাপক, ২৫০ কোটি বছর আগে থেকে শুরু করে প্রায় ৫৫ কোটি বছর পর্যন্ত।
এ সময়েই বহুকোষী জীবের বিবর্তন ঘটে, আর তার সাথে সাথে দেখা যায় নরম শরীরের কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী। এর পরের সময়টিকে বলা হয় ফ্যানেরােযোয়িক অতিকল্প, যাকে পর্যায়ক্রমিকভাবে শুরু থেকে আজকের আধুনিক সময় পর্যন্ত তিনটি ইরা বা কল্পে ভাগ করা হয়: প্যালিওযােয়িক, মেসযােয়িক এবং সিনযােয়িক।
জীবের বিকাশের ধারার উপর ভিত্তি করে এই কল্পেগুলােকে আবার বিভিন্ন পিরিয়ড বা কালে ভাগ করা হয়েছে। এই তিনটি কালেই পৃথিবী বিভিন্ন ধরণের আধুনিক প্রাণী এবং উদ্ভিদের সমারােহে মুখরিত হয়ে উঠেছে। আমাদের কাছে কালগুলাের নাম বেশ খটমটা শােনালেও ভূতত্ত্ববিদদের কাছে তারা কিন্তু বিশেষ অর্থ বহন করে। যেমন ধরুন, ‘যােয়িক অর্থ হচ্ছে প্রাণীর জীবন, আর ‘প্যালিও’ মানে প্রাচীন, ‘মেসাে’ মানে মধ্যবর্তী এবং ‘সি’-এর অর্থ হচ্ছে আধুনিক।
সুতরাং, সময়ের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী জীবের বিকাশের সাথে অর্থবহুল করেই কল্পগুলাের নাম রাখা হয়েছে: প্যালিওযােয়িক, মেসােযােয়িক এবং সিনােযােয়িক। নীচের টেবিলটিতে এই অতিকল্পে, কল্প, কাল এবং যুগের ভাগগুলােকে খুব সহজ করে দেখানাে হয়েছে।

আর নীচের সারণিটিতে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন কালের সাপেক্ষে প্রাণের সামগ্রিক বিবর্তনের ধারাটিকে। এরকম ধারাভিকভাবে বিভিন্ন স্তরে ফসিল পাওয়া যাওয়াটকে বলে ফসিলের পর্যায়ক্রমের নীতি (Law of Fossil Succession), যা থেকে আমরা ৩ টি বিষয় সম্পর্কে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণা পাই : প্রথমতঃ ফসিলগুলাে কোন এক সময়ের জীবিত প্রাণের নিদর্শন বহন করে, দ্বিতীয়তঃ এদের মধ্যে অনেকের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবীর বুক থেকে এবং তৃতীয়তঃ বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক স্তরে এত ধরণের ফসিল পাওয়া যাওয়ার কারণ একটাই, আর তা হল সুদীর্ঘ সময়ের বিস্তৃতিতে প্রাণের বিবর্তন ঘটে অনবরতই নতুন নতুন প্রজাতির জন্ম হয়ে চলেছে।
ফসিলের পর্যায়ক্রম এবং শিলাস্তরের পর্যায়ক্রমিক উপরিপাতনের নীতির উপর ভিত্তি করে ভূতত্ত্ববিদ এবং ফসিলবিদরা ১৮৪১ সালে, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আবিষ্কারেরও প্রায় ১৮ বছর আগেই, আপেক্ষিক সময়ক্রমের ছকটি তৈরি করে ফেলেন। অবাক করা ব্যাপার হল যে, তারপর গত দেড়শাে বছরে কালজয়ী সব আবিষ্কারের ভিত্তিতে এর অনেক পরিবর্তন করা। হলেও মূল ছকটি আজও প্রায় একই রকমই রয়ে গেছে।

আধুনিক সব ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা আজকে বেশীরভাগ ফসিলের বয়সই আরও সঠিক এবং সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিতে পারছি, এবং তার ফলে এই টেবিলটি প্রতিদিনই আরও সঠিক এবং পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করছে।
বিবর্তনের পথ ধরে
১.↑ Stringer C and Andrews P, 2005, The Complete World of Human Evolution, Thames and Hudson Ltd, London, p 22.
২.↑ http://www.actionbioscience.org/evolution/benton.html
৩.↑ http://pubs.usgs.gov/gip/fossils/intro.html