বিবর্তনের পথ ধরে

বন্যা আহমেদ

০১. বিবর্তনের সাক্ষ্যি

ভুরিভুরি বই রয়েছে বাজারে বিবর্তনের উপরে, বিজ্ঞানীরা প্রতিদিনই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন কিভাবে আমাদের চারপাশের প্রকৃতি, আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিবর্তনের পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে। বিবর্তন তত্ত্ব আজকে আমাদের শুধু প্রাণের বিকাশ, বিলুপ্তি এবং টিকে থাকার ব্যাপারটাই বুঝতে সাহায্য করছে। না, আজকের এই জীবজগৎ কি করে ক্রমাগতভাবে বদলে যাচ্ছে এবং তা আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকে কিভাবে প্রভাবিত করছে তার একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাও দিচ্ছে।

একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন বিবর্তনবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনকে না দেখলে আজকের এই আধুনিক জীবনযাত্রা থেকে অবশ্য প্রয়োজনীয় অগ্রগতি ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনেকটুকুই বাদ দিয়ে দিতে হবে। আজকে বিবর্তন তত্ত্বকে বাদ দিলে – আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যাবে, মানুষ বা অন্যান্য জীবের ডিএনএ র গঠন বুঝে জটিল অসুখের চিকিৎসা বের করা এবং রােগ প্রতিষেধক ভ্যাকসিন তৈরির কাজ বাদ দিয়ে দিতে হবে, পরিবেশের ভারসাম্যতা রক্ষা, দূষণ রােধ, গ্লোবাল ওয়ারমিং সহ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা বন্ধ করে দিতে হবে, উন্নত জাতের ফসল তৈরি করার কাজ বা কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করে দিতে হবে – বন্ধ করে দিতে হবে আরাে হাজারটা গবেষণা ও আবিষ্কার যেগুলাে লিখতে গেলে সত্যিকার অর্থেই প্রমাণ আকারের ‘মহাভারত’ হয়ে যাবে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে বিবর্তন তত্ত্বের গুরুত্ব আজকে এতখানিই যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যন্ত এখন বিবর্তনীয় জীববিদ্যা, বিবর্তনীয় চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি নামে নতুন সব শাখারও সৃষ্টি করা হচ্ছে[১]

বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী টি, ডবঝানস্কি (T. Dobzhansky, ১৯০০-১৯৭৫) ঠিকই বলেছিলেন যে বিবর্তনের আলােয় বিচার না করলে জীববিজ্ঞানের কোন কিছুরই কোন অর্থ হয় না [২]

গত শতাব্দীতেই বিবর্তনবাদকে জীববিজ্ঞানের মূল শাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ডারউইন তার বিবর্তন তত্ত্ব প্রস্তাব করছিলেন প্রায় দেড়শাে বছর আগে, তারপর থেকেই জেনেটিক্স, অনুজীববিদ্যা, জিনােমিক্সসহ জীববিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখায় যত অভাবনীয় আবিষ্কার হয়েছে তার সবই এক বাক্যে বিবর্তনবাদের পক্ষে রায় দিয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ ফসিলের মধ্যে এখন পর্যন্ত এমন একটাও ফসিল পাওয়া যায়নি যা কিনা প্রাণের বিবর্তনের ধারাবাহিকতাকে ক্ষুন্ন করে।

কিন্তু তাতেই বা কি? ধর্মীয় কুসংস্কার, গােড়ামী, নােংরা রাজনৈতিক কারণে আজও কিন্তু বিজ্ঞানের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বটিকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আমেরিকাসহ সারা বিশ্বজুড়ে বিবর্তনবাদ বিরােধীরা অত্যন্ত সক্রিয়ভাবেই তাদের অপ-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মীয় এবং সামাজিক কুসংস্কারগুলাের বিরুদ্ধে ডারউইনের এই তত্ত্ব যে কত বড় আঘাত হেনেছে তা বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে বিংশ শতাব্দী জুড়ে রক্ষণশীলদের চালানাে আমরণ সংগ্রামের নমুনা দেখলেই পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তাদের একটা খুব প্রিয় যুক্তি হচ্ছে বিবর্তন নাকি চোখে দেখা যায় না, কাজেই তা অবৈজ্ঞানিক!

হ্যা, এটা ঠিক কথা যে, প্রাণী বা উদ্ভিদের উপর বিবর্তন সাধারণত ঘটে খুবই ধীরে, মোটামুটি লক্ষ লক্ষ বছর লেগে যায় এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির বিবর্তন ঘটতে, যা হয়তাে এক প্রজন্মের জীবদ্দশায় দেখে যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বিজ্ঞান তাে শুধু যা চোখের সামনে দেখা যায় তাই নিয়ে কাজ করে না – যদি তাই করতাে তাহলে তাে ফসিলবিদ্যা, জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা, জৈব-ভূগােল কিংবা রসায়নবিদ্যার মত বিভিন্ন শাখাগুলােকে অনেক আগেই অবৈজ্ঞানিক বলে ধরে নিতে হত!

পদার্থবিদ্যার কথাই ধরুন না, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কি চোখে দেখা যায়, পৃথিবীটা যে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে সেটাই বা কে চোখে দেখেছে? খালি চোখে দেখলে তাে আসলেই মনে হয় সূর্যটা ঘুরে ঘুরে এদিক থেকে ওদিকে চলে যাচ্ছে, তাহলে কি প্রাচীনকালের মত আমরা তাই ভেবেই বসে থাকবাে?

কিন্তু তার চেয়েও মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, আজকাল আমরা আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সাহায্যে বিভিন্ন উদ্ভিদ, কীট পতঙ্গ, ভাইরাস এমনকি প্রাণীরও বিবর্তন যেমন পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারছি, তেমনি অনেক ক্ষেত্রেই তা সরাসরি পর্যবেক্ষণও করতে পারছি।

প্রকৃতিতে যেমন নিত্য নতুন প্রজাতির উৎপত্তি হচ্ছে তেমনি উন্নত ধরণের ফসল উৎপাদনের জন্য বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে নতুন নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ তৈরি করছেন – শুধু একটু বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাকিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যে আমাদের চোখের সামনেই অহরহ ঘটে চলেছে প্রাকৃতিক নির্বাচনসহ বিবর্তনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার খেলা। আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছিলাম পেপারড মথের বিবর্তন যেটা প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে ঘটেছিল আমাদের চোখের সামনেই। চলুন তাহলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাবলী থেকে নেওয়া কিছু জলজ্যান্ত উদাহরণ নিয়ে আলােচনা করা যাক, দেখা যাক আমাদের চোখের সামনে আসলেই বিবর্তন ঘটছে কিনা।

কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এইডস রােগের অপ্রতিরােধ্য এইচ আই ভি ভাইরাস?
এইডস রােগের জন্য দায়ী এইচ আই ভি (HIV, Human immunodeficiency Virus) ভাইরাস নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে আজ তােলপাড় চলছে। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিজ্ঞানীরা কেন নাকানি চুবানি খাচ্ছেন এই ভাইরাসটির প্রতিষেধক বা ভ্যাক্সিন (Vaccine) বের করতে? শুনলে হয়তাে অবাক হবেন, আর কিছুই নয় – এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, আনুবীক্ষণীক ভাইরাসগুলাে আমাদের সাথে খেলছে ‘মিউটেশন’ এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটানাে বিবর্তনের এক ভয়াবহ লুকোচুরি খেলা। বিজ্ঞানীরা একে মােকাবিলা করার জন্য যেই না একটা ওষুধ প্রয়ােগ করছেন সেই মাত্র তারা বিবর্তিত হয়ে নতুন রূপে দেখা দিচ্ছে, নতুন নতুন ওষুধগুলােকে আক্ষরিক অর্থেই যেন নাকে সঁড়ি দিয়ে ঘােরাচ্ছে। এই ‘লুকোচুরির ব্যাখ্যা তাে বিবর্তনবাদ ছাড়া আর কোন কিছু দিয়েই দেওয়া সম্ভব নয়!

১৯৮১ সালে এইডস রােগ ধরা পড়ার পর এখন পর্যন্ত ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি লােক মারা গেছে এই মারাত্মক রােগে, ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন ওষুধের আবিষ্কারের পরও এর নিরাময়ের তেমন কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪ কোটি মানুষ ভুগছে আজ এইডস রােগে, শুধু ২০০৫ সালে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৪৩-৬৬ লক্ষ মানুষ, আর মারা গেছে ২৮-৩৬ লক্ষ মানুষ । তাহলে চলুন আরেকটু ভালাে করে খতিয়ে দেখা যাক কেনাে এখনও বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসটাকে কোন মতেই বাগে আনতে পারছেন না।

বিবর্তনের সাক্ষ্যি
চিত্র : ৪.১: মানুষের কোষের ভিতরের ক্রোমসম, ডি এন এর (DNA) এবং জিনের গঠন, ভাইরাসের এক কোষী দেহে এই ডিএনএ নেই, তার বদলে আছে আরএনএ

এই এইচ আই ভি ভাইরাসগুলাের গঠন কিন্তু অত্যন্ত প্রাচীণ ধরণের, বংশগতির মূল উপাদান হিসেবে তারা আমাদের মত ডিএনএ (DNA, Deoxyribonucleic Acid) ব্যবহার করে না। তাদের এক কোষী দেহে ডিএনএ বলে কিছু নেই, আছে সেই প্রাচীণ আরএনএ (RNA, Ribonucleic Acid) – এই আরএনএ এর মাধ্যমেই তারা পরবর্তী প্রজন্মে তাদের জিন ছড়িয়ে দেয়। আর গােল বাঁধলাে সেখানেই – ডিএনএ নেই বলে তারা নিজে নিজে স্বাধীনভাবে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না!

বংশবৃদ্ধি করার জন্য ডিএনএ -ওয়ালা কোন উপযুক্ত পােষকের (Host) দেহ কোষের ভিতরে ঢুকে পড়া ছাড়া আর উপায় কি? এক্ষেত্রে এইচ আই ভি ভাইরাসগুলাে পােষক হিসেবে মানুষের দেহের কোষকে ব্যবহার করে (চিত্র ৪.১)। দেহকোষে একবার ঢুকে পরার পর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে লক্ষ লক্ষ কপি তৈরি করার মাধ্যমে নিজের বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করে দেয়। মানুষের কোষে বিশেষ কিছু প্রােটিন আছে যাদেরকে বলা হয় গ্রাহক (Receptor, যেমন ধরুন, CD4, CCR5 ইত্যাদি); – এদের সাথে নিজেকে জুড়ে দিয়েই তারা কোষের ভিতর ঢুকে পরে। তারপর বিশেষ এক প্রক্রিয়ায় সে মানুষের কোষের ডিএনএ-এর উপর ভর করে তার ভিতরেই আরএনএ-এর কপি তৈরি করে ফেলে।

বিবর্তনের সাক্ষ্যি
চিত্র :৪২: মানুষের কোষের (নীল অংশ) ভিতর এইচ আই ভি ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির বিভিন্ন ধাপ

সেখান থেকেই ভাইরাসটির অসংখ্য কপি তৈরি হয়ে মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পরে এবং ধীরে ধীরে তার রােগ প্রতিরােধ ব্যবস্থাকে (Immune System) ধ্বংস করে দিতে থাকে। আচ্ছা, এ ভাবেই না। হয় ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করে, তাতে অসুবিধাটা কোথায়? এর সাথে তাকে প্রতিরােধ করার বা বিবর্তনেরই বা কি সম্পর্ক আছে?

আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে দেখেছি, কোন জীবের উপর প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করতে হলে তার নিজস্ব জনপুঞ্জের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে প্রকারণ (Variation) থাকতে হয়। জীবন সংগ্রামে যে সব প্রকারণ জীবকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে বেশী সুবিধা করে দেয় সেই সব জিনের অধিকারী জীবগুলােই বড় হওয়া পর্যন্ত টিকে থাকে।

আর অন্যদিকে যারা পরিবেশের সাথে কম খাপ খাওয়াতে পারে তারা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যায়। এটাই সংক্ষেপে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মুল কথা। আবার অন্যদিকে, জিনের মধ্যে বিভিন্ন সময় আকসিক কিছু পরিবর্তন ঘটে থাকে যার ফলশ্রুতিতে অনেক সময় ডি এন এর গঠন বা সংখ্যারও পরিবর্তন ঘটে যায় – আর একেই বলা হয় পরিব্যক্তি (Mutation)।

এই মিউটেশন কিন্তু প্রাণীর প্রয়ােজনে ঘটে না, ঘটে একেবারেই বিক্ষিপ্ত এবং এলােমেলােভাবে। অঙ্ক কষার সময় কখন আনমনা হয়ে একটা ভুল করে ফেলবেন সেটা যেমন আগে থেকে বলা যায় না তেমনি বংশবৃদ্ধি করার করার সময় আপনার জিনের কোন অংশটার কপি করতে ভুল হয়ে যাবে সেটাও বলার কোন উপায় নেই। পরিবেশ, প্রাণীর কোষের গঠন ইত্যাদির উপর এটা নির্ভর করলেও করতে পারে। কিন্তু এই মিউটেশনের

ফলে যে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যগুলাে তৈরি হয় তা দিয়ে যদি কোন জীব বেঁচে থাকার জন্য বাড়তি কোন সুবিধা পায়, তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মেই সেগুলাে টিকে যায়। এখন ভাইরাসের বংশবৃদ্ধির জন্য এক ধরনের বিশেষ এনজাইমের প্রয়ােজন হয়, যেটা মানুষের শরীরে থাকে না, শুধুমাত্র ভাইরাসের কোষেই তা খুঁজে পাওয়া যায়। রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস (Reverse Transcriptase) ৪ নামের এই এনজাইমটি খুবই দুর্বল ধরণের প্রাচীন এক মেকানিজমে তৈরি, আর সে কারণেই দেখা যায় বংশবৃদ্ধির সময় সে জেনেটিক কোডগুলােকে সব সময় ঠিক মত প্রতিলিপি তৈরী করতে পারছে না।

ফলে পরবর্তী প্রজন্মের ভাইরাসগুলাের মধ্যে অনবরতভাবে অসংখ্য মিউটেশন (Mutation) ঘটতে থাকে। আর তাই দেখা যায় যে, প্রতি নতুন প্রজন্মেই অসংখ্য রকমের নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ভাইরাসের উৎপত্তি হচ্ছে, অর্থাৎ  মিউটেশনের কারণেই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রকারণের। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মানুষের দেহের ভিতরে ভাইরাস যে শুধু অত্যন্ত দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি করে তাই ই নয়, তাদের মধ্যে এই মিউটেশনের কারনেই প্রকারণের হারও থাকে অত্যন্ত বেশি।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়মেই এইচ.আই.ভি ভাইরাসের মধ্যে পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটতে থাকে অত্যন্ত দ্রুত হারে, আর তারই ফলশ্রুতিতে মানুষের দেহে তারা খেলতে থাকে অদম্য এক ভয়াবহ বিবর্তনের খেলা। বিজ্ঞানীরা অতীতে বিভিন্ন পদ্ধতিতে এইচ.আই.ভি প্রতিষেধক ওষুধ আবিষ্কার করেছেন এবং এখনও নতুন নতুন ওষুধ তৈরির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন ধরুন, এক ধরণের ওষুধ দিয়ে তারা চেষ্টা করেছেন ভাইরাসটির রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেসের কাজে বাঁধা দিতে, যাতে তারা মানুষের কোষের ডিএনএ-এর ভিতরে ঢুকতে না পারে।

আবার অন্য আরেক ধরণের ওষুধ তৈরি করা হয়েছে যাতে করে ভাইরাসগুলাে মানুষের দেহের কোষের গ্রাহকের সাথে জুড়তেই না পারে। কিন্তু ব্যাপারটা এত সােজা নয়, এখানে আরেকটু গােলমেলে ব্যাপার আছে। এই ওষুধগুলাে দিয়ে আপাতভাবে এইডসের রােগীর দেহে ভাইরাসের প্রকোপ অল্প কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করা গেলেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় এদের কোনটা দিয়েই কোন কাজ হচ্ছে না। কয়েক মাস বা বছর ফুরােলেই এইচআইভি ভাইরাসগুলাে আবার প্রবল বিক্রমে রােগীর দেহে ফিরে আসে। চলুন তাহলে দেখা যাক কেনাে এই ওষুধগুলাে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।

ঘটনাটা আসলে আর কিছুই নয়। আমরা আগেই দেখেছি, ভাইরাস খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে এবং খুব কম সময়ে ভাইরাসগুলাের মধ্যে খুব বেশী হারে মিউটেশন হয় বলে এদের মধ্যে হাজারাে রকমের বৈশিষ্টে হের ফের দেখা যায়। তার ফলে রােগীর দেহে কোন একটা বিশেষ ওষুধ প্রয়ােগ করার পর বেশীরভাগ ভাইরাস মরে গেলেও, এমন কিছু বৈশিষ্ট্যের ভাইরাস সবসময়েই থেকে যায় যাদের উপর ওই ওষুধ কোন কাজ করতে পারে না। তারাই বেঁচে থাকে এবং কিছুদিনের মধ্যে আবারাে বংশবৃদ্ধি করে সারা দেহে ছড়িয়ে পরে। তবে এবার যে ভাইরাসগুলাে বেঁচে থাকলাে এবং তাদের থেকে যে এক নতুন ভাইরাসে প্রজন্ম উৎপত্তি হলাে তাদের সবার মধ্যেই ওষুধটি প্রতিরােধ করার ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেছে। তার ফর কিছুদিনের মধ্যেই ওষুধটি সম্পূর্নভাবে অকেজো হয়ে যায় ওই রােগীর শরীরের রােগ নিরাময়ে।

আসলে এখানে আমরা খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছি ডারউনের বলে যাওয়া সেই প্রাকৃতিক নিবাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তনের এক মােক্ষম উদাহরণ। পার্থক্য এতটুকুই যে এই বিবর্তনগুলাে ঘটছে আমাদের চোখের সামনে, অতি দত, আনুবীক্ষনীকভাবে মানুষের শরীরের ভিতর আর ডারউইন তাদেরকে দেখেছিলেন প্রকৃতির বিভিন্ন পরিবেশে বা দক্ষিণ আমেরিকার গ্যালাপোগাস দ্বিপপুঞ্জে।

একেকটা রােগীর দেহ যেনাে ডারউইনের সেই গ্যালাপ্যগাস দ্বীপপুঞ্জের একেকটা দ্বীপ – ফিঞ্চ পাখিগুলাে যেমন তাদের নিজস্ব দ্বীপের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে স্বতন্ত্রভাবে বিবর্তিত হয়েছিলাে, তেমনিভাবে ভাইরাসগুলােও প্রত্যেকটা মানব শরীরের ভিতরকার বিচ্ছিন্ন পরিবেশে অনবরত বদলে যাচ্ছে – পােষকের শরীরের বিশেষ সব বৈশিষ্ট্য, রােগ প্রতিরােধক ক্ষমতা, রােগের চিকিৎসার ধরণ, ওষুধের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে স্বতন্ত্রভাবে বিবর্তন ঘটে চলেছে এই ভয়াবহ ভাইরাসগুলাের! কখন, কিভাবে, কোন আকস্মিক মিউটেশনের ফলশ্রুতিতে ভাইরাসগুলাের কিরকম বিবর্তন ঘটবে তা আগে থেকে বলা মুশকিল।

এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে, প্রত্যেক এইডসের রােগীর পরিস্থিতি এবং তার দেহের ভিতরে এইচআইভি ভাইরাসের বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে তারপর বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন ধরনের ওষুধের আবিষ্কার করতে হবে, তবেই এ রােগ সারানাে যাবে। এখন তাহলে একবার ভেবে দেখুন তাে, যে বিজ্ঞানীরা আজকে এইডস রােগের ভাইরাসের ওষুধ বের করার কাজে নিযুক্ত আছেন তাদের এই পরিস্থিতিতে নিজের মাথার চুল ছেড়া ছাড়া আর কিইবা করার থাকতে পারে! ওনারা কি বছরের পর বছর ধরে প্রত্যকটা রােগীকে আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা করে প্রত্যেকের জন্য নতুন নতুন ওষুধ বানাবেন?

এই জটিল সমস্যাটা সমাধানের জন্য চিকিৎসাবিদ এবং বিজ্ঞানীরা এখন দেখছেন শুধু একটি মাত্র ভ্যাক্সিন ব্যবহার না করে, অনেকগুলাে ভ্যাক্সিনের ককটেল ব্যবহার করলে ঘটনা কি দাঁড়ায়; কয়েক বছর ধরে এ ধরনের ওষুধের প্রয়ােগে এইডসের চিকিৎসার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলেও শােনা যাচ্ছে। এ যেনাে অন্ধের তীর ছোঁড়ার মত, কখন কোন তীরটা নিশানাকে ভেদ করবে, আদৌ করবে কিনা তা আগে থেকে নিশ্চিত করে বলার কোন উপায় নেই। বিজ্ঞানীরা আজকে মানুষের দেহে এইচআইভি ভাইরাসের এই দ্রুত বিবর্তনের প্রক্রিয়া এবং বিভিন্ন ধরণের ওষুধের প্রয়ােগে তাদের প্রতিক্রিয়া কি হয় তা আরও ভালাে করে বােঝার চেষ্টা করছেন।

বিবর্তনবাদকে গভীরভাবে বােঝা এবং তার যথাযথ প্রয়ােগ ছাড়া এই মারাত্মক এইডস রােগের চিকিৎসা কি করে সম্ভব, বলুন তাে? আজকে বিবর্তনবাদ বিরােধীরা যদি এই ওষুধ তৈরির কাজে নিয়ােজিত হন তাহলে কোটি কোটি এইডসের রােগীর কপালে কি আছে তা তাে আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না।

আজকে ‘বার্ড ফ্লু’ নিয়ে যে বিশ্বজোড়া মহামারীর আশঙ্কা করা হচ্ছে তার পিছনেও রয়েছে একই কারণ।। এই বার্ড ফ্লুর ভাইরাসটিও খুব দ্রুত নিজেকে বদলে ফেলতে সক্ষম। আগে তারা শুধুমাত্র মুরগী বা পাখির মধ্যে রােগটির বিস্তার ঘটাতে পারতাে, কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে যে এক ধরনের মিউটেশনের। ফলে তারা ইদানীং পাখি থেকে মানুষের দেহেও রােগ বিস্তার করতে সক্ষম হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তুরস্কসহ বেশ কয়েকটি দেশেই এই রােগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছু মানুষ মারা গেছে। বিজ্ঞানীরা ভয় পাচ্ছেন যে মিউটেশনের ফলে যদি এদের মধ্যে মানুষ থেকে মানুষের দেহে সরাসরি রােগ ছড়ানাের ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায় তাহলে তাে আর উপায়ই নেই, বিশ্বজোড়া এক ভয়াবহ মহামারী ছড়িয়ে পড়তে পারে যে কোন মুহুর্তে। আবার এ রােগের ওষুধ আগে থেকে তৈরি করে অনেকদিন রেখে দেওয়া যায় না, তাই মহামারী শুরু হওয়ার পর এই রােগের ভ্যাক্সিন তৈরি করতে লেগে যাবে প্রায় ৮ মাস, ততদিনে হয়তাে ভাইরাসগুলাে বিবর্তিত হয়ে এমন একটা রূপ ধারণ করবে যে ওই ওষুধে আর কোন কাজই হবে না [৫]

২০০৫ সালের এক রিপাের্ট অনুযায়ী এখন আমরা জানতে পারছি যে, ১৯১৮ সালের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারীতে যে দুই কোটি লােক মারা গিয়েছিলাে তার কারণ ছিলাে এই একই ভাইরাস। আকস্মিক এক মিউটেশনের ফলেই তারা হঠাৎ করে পাখির বদলে মানুষের দেহে রােগ বিস্তার করতে শুরু করে দেয় – যার ফলাফল হয়েছিলাে ভয়াবহ। আজকে এই মারাত্মক জীবাণুগুলোর বিবর্তনের ধারাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত ভ্যাক্সিন তৈরি করতে পারার উপরই নির্ভর করছে বিশ্বজোড়া মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার এক মাত্র উপায়।


 বিবর্তনের পথ ধরে

 


১.↑  Evolution’s Importance to society: An Interview with renowned scientist Massimo Pigliucci, 2005

২.↑  Myer E, 2001, What is Evolution, Basic Books, New York, USA. p 39

৫.↑   New Bird Flu Vaccine Might Not Work in Time, Discover, Special Issue, vol 27, no 1, January 2006. p 44

0 0 votes
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top
১ম অধ্যায়

২য় অধ্যায়

৩য় অধ্যায়

৪র্থ অধ্যায়

৫ম অধ্যায়

৬ষ্ঠ অধ্যায়

৭ম অধ্যায়

৮ম অধ্যায়

৯ম অধ্যায়

১০ম অধ্যায়

১১ম অধ্যায়

পরিশিষ্ট
রঙ্গীন প্লেট

বিবর্তন সম্পর্কে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো

গ্রন্থ আলোচনা