ফসিলের কথা লিখতে গিয়ে আগের অধ্যায়গুলােতে প্রাসঙ্গিকভাবেই প্লেট টেকটনিক্স, মহাদেশীয় সঞ্চরণ, রেডিওঅ্যাকটিভ ডেটিংসহ এন্তার বিষয়ের আলােচনা চলে এসেছে। তবে এবার বােধ হয় অধ্যায়টি শেষ করার সময় এসেছে, চলুন, বিবর্তনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ের আলােচনার মধ্য দিয়েই ইতি টানা যাক ফসিলের আলােচনার। তত্ত্বকথা তাে অনেক হলাে এই অধ্যায়ে, তাই এবার চেষ্টা করবাে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে না ঢুকে এক্কেবারে সহজ ভাষায় মিসিং লিঙ্ক-এর ব্যাপারগুলাে ব্যাখ্যা করার। মিসিং লিঙ্ক’বা ‘হারানাে যােগসূত্র’ কথাটা বহুলভাবে প্রচলিত হলেও এটা কিন্তু ঠিক বৈজ্ঞানিক কোন শব্দ নয়।
এই মিসিং লিঙ্কগুলাে হচ্ছে জীবের বিবর্তনের মধ্যবর্তী স্তরের এমন কিছু ফসিল যারা তাদের আজকের আধুনিক প্রজাতি এবং তার পূর্বপুরুষদের মধ্যে বিশাল কোন গ্যাপ বা ফাঁক পুরণ করে। অর্থাৎ, আগের প্রজাতি এবং তার থেকে বিবর্তিত হওয়া পরের প্রজাতি – এই দুই প্রজাতি বা ট্যাক্সোনমিক (Taxanomic, শ্রেণীবিন্যাসগত) গ্রুপেরই কিছু কিছু বা মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যগুলাে ধারণ করে এমন জীবের ফসিলকে অবস্থান্তরিত বা মধ্যবর্তী ফসিল (Transitional Fossil) বা সাধারণভাবে মিসিং লিঙ্ক বলা হয়।
বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই ধারণা করে আসছেন যে, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া সেই ডায়নােসরগুলাে থেকেই আজকের আধুনিক পাখির উৎপত্তি ঘটেছে। কিন্তু বললেই তাে হল না, এটা তাে আর মুখের কথা নয়, কোথায় ডায়নােসর আর কোথায় পাখি! ডায়নােসর কথাটা শুনলেই আমাদের মনে যে দৈত্যের মত দেখতে প্রাণীগুলাের চেহারা ভেসে ওঠে তাদেরকে দোয়েল বা ময়নার মত গােবেচারী পাখিগুলাের পূর্বপুরুষ বানিয়ে দিলেই হল নাকি? কিংবা ধরুন, বেশীরভাগ প্রাণীর বিবর্তনের ইতিহাস বেশ সহজেই নির্ধারণ করা গেলেও তিমি (মাছ!) বা ডলফিনদের নিয়ে বড্ড বিপাকে পড়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।
কি সৃষ্টি ছাড়া জীবই না এই বিশাল-বপু সামুদ্রিক প্রাণীগুলাে! সমুদ্রেই থাকে ষােল আনা সময়, সাতরে বেড়ায় মাছের মতই, কিন্তু বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বিচার করলে তাে এদেরকে কোনভাবেই মাছ বলে স্বীকার করে নেওয়া যায় না! মাছের কি এদের মত ফুসফুস থাকে নাকি তারা বাচ্চা প্রসব করে? আসলে তারা স্তন্যপায়ী প্রাণী, কিন্তু তাহলে তারা পানিতে নেমে এলাে কখন বা কি করে? বিজ্ঞানীরা যখন বললেন, এরা আসলে ডাঙ্গার জীবন থেকে সমুদ্রে বিবর্তিত হয়েছে তখন কি মহা হৈ চৈ না পড়ে গিয়েছিলাে চারদিকে। বিবর্তনবাদ বিরােধীরা রীতিমত দাবী করতে শুরু করলাে মিসিং লিঙ্কগুলাে দেখাও, আর না হলে এরকম ভাঁওতাবাজী বন্ধ কর।
মাটি থেকে তিমি মাছের পূর্বপুরুষের পানিতে বিবর্তনের মধ্যবর্তী ধাপগুলাে দেখাতে না পারলে এই দাবীর কোন যৌক্তিকতাই নেই! ব্যাপারটা আসলেই তাে গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিতে। এরকম বড় বড় পরিবর্তন যদি ঘটেই থাকে এবং বিবর্তনের নিয়মানুযায়ী অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোটি কোটি বছর ধরেই তা যদি ঘটে থাকে,তাহলে তাে তাদের বিভিন্ন মধ্যবর্তী স্তরের ফসিল বা অন্য কোন প্রমাণও তাে থাকতে হবে! এরকম উদাহরণ কিন্তু বিবর্তনবাদের জগতে অনেকই আছে। তাদের সম্পর্কে এই প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক যে কোথায় গেলাে মাঝামাঝি স্তরের প্রাণীগুলাে বা তাদের মধ্যবর্তী ফসিলগুলাে?
আমরা জানি যে, মূলত প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বছরের ধীর পরিবর্তনের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে। আমরা আগে এও দেখেছি যে, এক প্রজাতির বিভিন্ন জীবদের মধ্যেই বিভিন্ন রকমের প্রকরণ থাকে, ধীর গতিতে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারায় অধিক সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অংশটি হয়তাে দ্রুত গতিতে সংখ্যায় বাড়তে থাকে। তার ফলে প্রজাতির এই অংশের মধ্যে এই ধরনের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য সঞ্চারিত এবং সঞ্চিত হতে হতে এক সময় তারা উপপ্রজাতিতে পরিণত হয়ে যায় [১]।
এই নতুন উপ-প্রজাতির বেশ কয়েক রকমেরই পরিণতি হতে পারে – তারা এরকম একটা উপপ্রজাতি হয়েই চিরতরে টিকে থাকতে পারে, বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে, অথবা আবার বিবর্তনের মাধ্যমে এক নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। আর যদি প্রজাতির একটি অংশ তার মুল প্রজাতি থেকে ভৌগলিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাহলে বিবর্তনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত গতিতে তরান্বিত হতে পারে। নিজস্ব গতিতে বিবর্তিত হতে হতে তারা তাদের পূর্বপুরুষের থেকে এতই বদলে যায় যে, তাদের মধ্যে আর প্রজনন ঘটা সম্ভব হয় না। সাধারণত, তখনি আমরা তাদেরকে নতুন প্রজাতি বলে ধরে নেই।
তারপর এই নতুন প্রজাতি এবং তাদের পূর্বপুরুষেরা বিবর্তনের ধারায় নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে, ফলে বিলুপ্ত হয়ে না গেলে ক্রমাগতভাবে নতুন প্রজাতির সাথে তার পূর্বপুরুষদের বৈশিষ্ট্যগত বিচ্ছিন্নতা বাড়তেই থাকে। কোটি কোটি বছরের ক্রমাগত পরিবর্তনের ফলে এক সময় তাদের মধ্যে পার্থক্য বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় এসে দাঁড়াতে পারে যে এরা একসময় সম্পর্কযুক্ত ছিলাে তা নির্ধারণ করাই হয়তাে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় আমাদের সেই ফসিল রেকর্ডই ভরসা, মধ্যবর্তী যে স্তরগুলাে তারা পার করে এসেছে লক্ষ কোটি বছরের বিবর্তনের প্রক্রিয়ায়, তার প্রমাণগুলাে লুকিয়ে আছে সেই প্রাণীগুলাের অতীতের ফসিলের মধ্যে।
যেমন ধরুন, আমার জানি যে, জলের প্রাণীর থেকেই বিবর্তিত হয়ে ডাঙ্গার প্রাণীর উৎপত্তি ঘটেছিলাে প্রায় সাড়ে তিনশাে কোটি বছর আগে ডেভােনিয়ান যুগে। এটা তাে আর রাতারাতি ঘটেনি। বিবর্তনের তত্ত্ব যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে ধাপে ধাপে এই পরিবর্তন ঘটেছে, ধীরে। ধীরে পানি থেকে উঠে এসে লক্ষ কোটি বছরের ছােট ছােট পরিবর্তনের মাধ্যমে মাটির জীবনে অভ্যস্ত হতে হয়েছে তাদের। সেভাবে হিসেব করলে তাে নিশ্চয়ই একটা সময় ছিলাে যখন পা বা কোন অঙ্গের উপর ভর করা মাছের বিবর্তন ঘটেছিলাে যারা হয়তাে পানি এবং মাটি দু’জায়গাতেই আংশিকভাবে টিকে থাকতে পারতাে, যাদের থেকেই হয়তাে এক সময় উভচর প্রাণী এবং পরে সরীসৃপের বিবর্তন ঘটেছে। নিশ্চয়ই তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে কালের পরিণতিতে একসময়ে।
অনেকদিন পর্যন্ত এরকম কোন ফসিল পাওয়া না গেলেও বিজ্ঞানীরা একরকম নিশ্চিতই ছিলেন যে এই পথেই বিবর্তন ঘটেছে মাটিতে বাস করা প্রাণীগুলাের। সৃষ্টিতত্ত্ববাদীরা প্রায়ই ফসিল রেকর্ডের এই গ্যাপ বা ফাঁকটি তুলে ধরে বিবর্তন তত্ত্বের ত্রুটি প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। তাদের মুখে ছাই দিয়ে, গত শতাব্দীতে বিজ্ঞানীরা মাছ থেকে উভচর প্রাণীর বিবর্তনের প্রায় প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ মধ্যবর্তী ধাপের ফসিলই আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।
শুধু তাই নয়, এই তাে কিছুদিন আগে ২০০৬ সালের প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা চার পাওয়ালা এমনই এক মাছের ফসিলের সন্ধান পেয়েছেন যা দিয়ে আসলে এখন এই বিবর্তনের মােটামুটি প্রত্যেকটা ধাপই দিনের আলাের মত পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠেছে আমাদের সামনে। এ রকম ধরণের গুরুত্বপুর্ণ মিসিং লিঙ্কগুলাের আবিষ্কার বিবর্তনের তত্ত্বকে শুধু যে শক্তিশালীই করেছে তাই নয়, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব যে কতখানি সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাও জোরালােভাবে প্রমাণ করে ছেড়েছে। চলুন তাহলে এবার এরকম কিছু উদাহরণ নিয়ে আরও বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা যাক।
পাখি তাহলে ডায়নােসরেরই উত্তরসুরি?
১৮৫৯ সালে ডারউইন যখন বিবর্তনের তত্তট্রি প্রস্তাব করেন। তখন পাখির বিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে কিন্তু তিনি বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলেন। বিবর্তনের অনুক্রমে।
পাখি ঠিক কোথায় পড়বে? আপাতদৃষ্টিতে এখনকার বা জানামতে আগেকার কোন প্রাণীর সাথেই তাে এর তেমন মিল পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকেই তখন এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিবর্তন তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। ডারউইনের আমরণ বন্ধু, হ্যা, আমাদের সেই থমাস হাক্সলি (যাকে কিনা ডারউইনের ‘বুল ডগ’ বলে ডাকা হত) আবারও এগিয়ে এলেন তাকে সেই যাত্রায় রক্ষা করতে। ১৮৬০ সালে বিজ্ঞানীরা প্রায় ১৫ কোটি বছরের পুরনাে জুরাসিক যুগের একেবারে শেষের দিকের সময়ের কোন এক অজানা জীবের পালক আবিষ্কার করেন। তার পরের বছরই তারা জার্মানীতে খুঁজে পেলেন অদ্ভুত একটি প্রাণীর ফসিল –

আর্কিওপটেরিক্স (Archaeopteryx) – একদিকে তার যেমন আছে পাখির মত পাখা এবং পালক, আবার অন্য দিকে দিব্যি পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। ডায়নােসরের মত লম্বা লেজ এবং দাঁতওয়ালা চোয়ালের অস্তিত্ব। তবে তার মধ্যে আধুনিক পাখির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও বেশীর ভাগ বৈশিষ্ট্যই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডায়নােসর থেরাপড়ের (Therapod) সাথেই বেশী মিলে যায় [২]। এই আর্কিওপটেরিক্স এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া মিসিং লিঙ্ক বা মধ্যবর্তী ফসিলের মধ্যে সবচেয়ে বহুলভাবে আলােচিত একটি ফসিল। হাক্সলি সেই সময়েই সদ্য পাওয়া এই ফসিলটি পরীক্ষা করে বললেন, মনে হচ্ছে, আসলে পাখিগুলাে হয়তাে একধরণের ডায়নােসর থেকেই বিবর্তিত হয়েছে।
সেদিন ফসিলবিদ্যার জগতে মহা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল ব্যাপারটি নিয়ে। তারপর আরও বেশ কয়েকটি এ ধরণের ফসিলই পাওয়া গেছে গত প্রায় দেড়শাে বছরে। কিন্তু তাদের সবারই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পাখির কিছু বৈশিষ্ট্য থাকলেও বেশীরভাগ বৈশিষ্ট্যই ছিলাে একধরনের ছােট আকারের থেরাপড ডায়নােসর বৈশিষ্ট্যের কাছাকাছি [৩]। তাই খুব পরিষ্কার একটা ধারণা থাকা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা তাদের ডায়নােসর থেকে পাখির বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটিকে এতদিন তত্ত্বে রূপ দিতে পারছিলেন না। আরও কিছু মধ্যবর্তী ফসিলের অস্তিত্ব না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত এই গােলমেলে ব্যাপারটা নিয়ে শেষ সিদ্ধান্তে পৌছুনাে একটু কঠিনই হয়ে যাচ্ছিলাে।
দেড় শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে বিজ্ঞানীদের নাকে দড়ি দিয়ে ঘুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে ব্যাপারটার একটা দফা রফা হতে চলেছে। গত কয়েক বছরে চীনে যে অসংখ্য ফসিল পাওয়া গেছে তারা থেরাপড ডায়নােসর থেকে ক্রমান্বয়ে পাখিতে রূপান্তরের বিভিন্ন স্তরকে অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে আমাদের চোখের সামনে। সম্প্রতি চীনে পাওয়া সায়নােসরপটেরিক্সের ফসিলের গায়ে ছােট ছােট পালকের নমুনা পাওয়া গেছে, কডিপটেরিক্সের হাতে এবং লেজে পাওয়া গেছে বেশ চওড়া ধরণের পালক, আবার বিজ্ঞানীরা মায়ক্রোর্যাপট্র গুই নামে এক অদ্ভুত চার পাখাওয়ালা ডায়নােসরের ফসিল আবিষ্কার করেছেন যার সবগুলাে পাখায়ই উড়ার সহযােগী পালক দেখতে পাওয়া যাচ্ছে (চিত্র ৮.২ -৮.৪)।


বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রকমের পালকের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া গেছে এই ফসিলগুলাের মধ্যে। আসলে পাখিতে বিবর্তিত হওয়ার অনেক আগেই বিভিন্ন ধরণের থেরাপড ডায়নােসরের মধ্যে পালকের উদ্ভব ঘটে। পালক বা পাখা থাকলেই যে উড়া যাবে তাও তাে নয়, উড়ার জন্য এক ধরনের বিশেষ ধরণের পালকের প্রয়ােজন হয়। তাই পালকের উন্মেষ ঘটার অনেক পরে বিশেষ ধরণের অপ্রতিসম আকারের পালকের বিবর্তন না ঘটা পর্যন্ত আসলে এই ডায়নােসরগুলাের পক্ষে উড়াল দেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ ধরণের যত নতুন নতুন ফসিলের আবিষ্কার হচ্ছে ততই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন যে, আর্কিওপটেরিক্সের অনেক আগেই ডায়নােসরদের মধ্যে তথাকথিত পাখিসুলভ কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে শুরু করেছিলাে, যেমন ধরুন সরু সরু হাত পার গঠন, বা পালকের বিবর্তন। আবার আধুনিক পাখিগুলাের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য যেমন, লেজের হাডডিগুলাের জোড়া লেগে ছােট হয়ে যাওয়া, দাঁত বা হাতের নখরের বিলুপ্তি ঘটার মত ঘটনাগুলাে ঘটেছে আর্কিওপটেরিক্সেরও বেশ পরে।

থেরাপড ডায়নােসরের সাথে আর্কিওপটেরিক্স এবং আধুনিক পাখির শারীরিক গঠনের তুলনামুলক চিত্রটি (চিত্র ৮.৪) দেখলে বিবর্তনের এই পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলাে বেশ পরিষ্কারভাবে ধরা পরে। এই তুলনামুলক পরীক্ষা থেকে বিজ্ঞানীরা যে শুধু ডায়নােসরের সাথে আধুনিক পাখির বিবর্তনের সম্পর্কটি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তাইই নয়, এই পরিবর্তনগুলাে কিভাবে ঘটেছিলাে তা সম্পর্কেও একটা পরিষ্কার ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কিছুদিন আগে ঘুমন্ত অবস্থায় ফসিল হয়ে যাওয়া হাঁসের মত আকারের এক ধরণের ডায়নােসরের ফসিল পাওয়া গেছে যাকে দেখলে মনে হবে আজকের দিনের কোন পাখি যেনাে ঘুমিয়ে আছে তার শরীরের মধ্যে মাথাটা গুঁজে দিয়ে এইসব থেকে স্পষ্টই বােঝা যায় যে পাখি হিসেবে বিবর্তিত হওয়ার অনেক আগেই সেই প্রাচীন ডায়নােসরদের মধ্যেই তথাকথিত পাখিসুলভ বৈশষ্ট্যিগুলো দেখা দিতে শুরু করে।

তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াচ্ছে – মােটেও উড়ার জন্য ডায়নােসরের মধ্যে পালকের বিবর্তন ঘটেনি, এর উদ্ভব ঘটেছিলাে নিতান্তই তাদের চামড়ায় ঘটা এক বিশেষ পরিবর্তনের ফলে। এর পর তাপ সংরক্ষণে সুবিধা করে দেওয়ার মাধ্যমে বা অন্য যে কারণেই হােক তা তাদেরকে টিকে থাকতে বাড়তি কোন সুবিধা জুগিয়েছিলাে বলেই এই বৈশিষ্ট্যটি টিকে গিয়েছিলাে থেরাপড ডায়নােসরগুলাের মধ্যে। অর্থাৎ উড়ার জন্য পালকের উদ্ভব ঘটেনি, বরং ব্যাপারটা ঠিক তার উলটো – কোন এক মিউটেশন বা পরিবর্তনের মাধ্যমে হঠাৎ করেই পালকের উৎপত্তি ঘটে আর তারই ফলশ্রুতিতে এক সময় কোন এক
পরিস্থিতে ডায়নােসরগুলাে উড়তে সক্ষম হয়। সৃষ্টতত্ত্ববাদীরা যদিও বলে থাকেন, পৃথিবীর সব কিছুই নাকি নীল নক্সা অনুযায়ী প্ল্যান করে তৈরি করা হয়েছে, অর্থাৎ পাখি উড়বে বলেই নাকি পরিকল্পনা করে তার শরীরে পালকের সৃষ্টি করা হয়েছে! কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, প্রাকৃতিতে কিছুই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি নয়, কেমন যেনাে এলােমেলােভাবে উদ্দেশ্য ছাড়াই তাদের উৎপত্তি ঘটে প্রাকৃতিক নিয়মেই। আর কোটি কোটি বছর ধরে এই বৈশিষ্ট্যগুলাের উপর ক্রমাগতভাবে ঘটতে থাকা প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে উৎপত্তি হয়েছে এতাে রকমের প্রাণীর, এত রকমের উন্নত এবং জটিল সব জীবের। বিখ্যাত বিবর্তনবাদী রিচার্ড ডকিন্স ঠিকই বলেন –
“আমাদের চারপাশে বিশ্বজগতে বিদ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলাে দেখলেই বােঝা যায় এর মধ্যে কোন পরিকল্পনা নেই, উদ্দেশ্য নেই, নেই কোন অশুভ কিংবা শুভের অস্তিত। আসলে অন্ধ, কেবল করুণাহীন উদাসীনতা ছাড়া এখানে আর কিছুই চোখে পড়ে না [১০]। ডায়নােসরের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে পালকের উদ্ভব, সেখান থেকে ধীরে ধীরে কোটি কোটি বছরের ব্যবধানে উড়তে পারা পাখির বিবর্তন আবারও আমাদেরকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন তত্ত্বের সঠিকতাকে মনে করিয়ে দেয়। এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যে বিভিন্ন ধরণের জটিল এবং উন্নত প্রাণের উদ্ভব ঘটা সম্ভব তারই এক চাক্ষুষ প্রমাণ দিয়ে চলেছে ডায়নােসর থেকে পাখির এই বিবর্তনের কাহিনী।
বিবর্তনের পথ ধরে
১.↑ মজুমদার, সুশান্ত (২০০৩), চার্লস ডারউইন এবং বিবর্তনবাদ, পৃঃ ৯২, শৈব্যা প্রকাশন বিভাগ, কোলকাতা, ইন্ডিয়া
২.↑ Which Came Frist the Feather Or Birds?, 2003, Scientific American, March edition.
৩.↑ Futuyma, Douglus (2005), Evolution, pg.74-78 Sinauer Associates, INC, MA, USA
১০.↑ http://www.mukto-mona.com/Articles/bonna/menace_darwinism.pdf