মুক্তমনায় আমরা প্রতি বছর ডারউইন দিবস পালন করি। সেই বিশেষ দিনটিতে চার্লস ডারউইন এবং তার যুগান্তকারী বিবর্তন তত্ত্বকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার চেষ্টা করা হয়। হয়তো অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এরকম ঘটা করে অজানা অচেনা দিনটিকে স্মরণ করার কারণ কী? কারণ আছে। আসলে পৃথিবীতে খুব কম বৈজ্ঞানিক ধারণাই কিন্তু জনসাধারণের মানসপটে স্থায়ীভাবে বিপ্লব ঘটাতে পেরেছে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোপার্নিকাসের সৌরকেন্দ্রিক তত্ত্ব এমনি বিপ্লবী তত্ত্ব, তেমনি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইন আর রাসেল ওয়ালেস প্রস্তাবিত বিবর্তনতত্ত্ব। দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট তার একটি বইয়ে বলেছিলেন[৬৭],
আমাকে যদি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধারণাটির জন্য কাউকে পুরস্কৃত করতে বলা হয়, আমি নিউটন, আইনস্টাইনদের কথা মনে রেখেও নির্দ্বিধায় ডারউইনকেই বেছে নেব।
কাজেই এমন যুগান্তকারী একটি তত্ত্ব, তার সঠিক উদযাপন না হলে কী চলে! বলা বাহুল্য, মুক্তমনাই প্রথমবারের মতো ডারউইন দিবসকে বাঙালি পাঠকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্বটুকু কাঁধে তুলে নিয়েছিল ২০০৬ সালে। আন্তর্জালের বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা সে বছর ডারউইন দিবস পালন করে প্রথমবারের মতো। এর পর থেকে প্রতি বছরই পালন করা হচ্ছে। সবচেয়ে বড় আকারে পালন করেছিলাম আমরা ২০০৯ সালে। কারণ ঐ বছরটাই ছিল ডারউইনের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী আর সেই সাথে তার জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ ‘প্রজাতির উদ্ভব’ বা ‘অরিজিন অব স্পিশিজ’-এর প্রকাশেরও দেড়শত বছর।
এখন তো বাংলাদেশে বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, যুক্তিবাদী কাউন্সিলসহ বহু সংগঠনই ঘটা করে ডারউইন দিবস পালন করে, দিনব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠান করে। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমাদের জন্য ডারউইন দিবস ডারউইনের দীর্ঘ শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখচ্ছবির কোনো স্তব ছিল না, বরং তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের যথাযথ স্বীকৃতি, তাঁর বৈজ্ঞানিক অবদানের প্রতি নির্মোহ আর বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ডারউইন দিবস পালন করা হয় প্রতি বছর ১২ই ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের প্রায় কেউই এই বিশেষ দিনটির সাথে পরিচিত না হলেও এর দু’দিন পরের ১৪ই ফেব্রুয়ারি তারিখটির সাথে প্রায় সবাই পরিচিত। সেই যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই ভালোবাসা দিবস কী, কিংবা কাহাকে বলে তা নিয়ে বোধ হয় বিশদ না বললেও চলবে। কারণ এ ব্যাপারটি কারোরই এখন অজানা কিছু নয়। কিন্তু যেটি অজানা তা হলো, এই ভালোবাসা দিবসের উদযাপিত ভালোবাসার সাথে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা! এই অধ্যায়টি সেই ঘনিষ্ঠ প্রেমময় সম্পর্কেরই উন্মোচন।
গত বছর ২০১০ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি আমাদের মুক্তমনা সদস্য অপার্থিব একটি চমৎকার প্রবন্ধ লেখেন- ‘ভালোবাসা ও বিবর্তন’ শিরোনামে[৬৮]। দুই দিবসের তাৎপর্যকে বিনি সুতার মালায় তিনি গাঁথলেন এক অনুপম ছন্দে। তিনি তার প্রবন্ধ শুরুই করলেন এই বলে —
রসকষহীন ডারউইন দিবসের পর আসে রসে ভরপুর ভালোবাসা দিবস প্রেমিকদের ডারউইন দিবসের কঠিন শীতল শিক্ষা থেকে রেহাই দিয়ে ভালোবাসার মিষ্টি আমেজের ছোঁয়া নিয়ে। দুটো দিবসের প্রায় একই সময় পালন করাটা হয়তো এক যোগসূত্রহীন কাকতালীয় ব্যাপার। ডারউইনের জন্মদিন আর রোমান পাদ্রী সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যু দিবসের মধ্যে কি যোগসূত্রই বা থাকতে পারে। কিন্তু ডারউইনের তত্ত্ব তথা বিবর্তনের সঙ্গে সত্যই ভালোবাসার এক গভীর যোগসূত্র আছে, যা মোটেই কাকতালীয় নয়।
ডারউইনের “প্রজাতির উৎস (Origin of Species)’’ আর “মানুষের উৎপত্তি (The Descent of man)’’ বই দুটি প্রকাশিত হবার পর থেকে আজ অবধি ডারউইনের সেই মূল তত্ত্বকে ভিত্তি করে ও নতুন সাক্ষ্য প্রমাণ আর পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান এর দ্বারা সেই তত্ত্বকে পরিশীলিত ও সংশোধিত করে মানব প্রকৃতিকে বোঝার চেষ্টায় জীববিজ্ঞানীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। ‘প্রেম কী?’ ‘মানব নৈতিকতার উৎস কি?’
এ ধরনের সনাতন প্রশ্নগুলোর উত্তর এখন অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে আসছে সামাজিক-জীববিজ্ঞানী আর বিবর্তন মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার বদৌলতে, বিশেষ করে বিংশ শতকের শেষ দুই দশকে প্রখ্যাত গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে। তাঁদের গবেষণা মানব অনুভূতির সকল দিকেরই কারণ হিসেবে আমাদের বৈবর্তনিক ইতিহাসের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। অন্য সব অনুভূতির মতো প্রেমানুভূতির মূলও বিবর্তনে নিহিত।
অপার্থিব ভুল কিছু বলেননি। বিবর্তনের কল্যাণে প্রেম ভালোবাসার অন্তিম রহস্যগুলোর অনেক কিছুই এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। তবে কিছু কথা আছে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা প্রেম শব্দটিকে কেবল আধো আধো প্লেটোনিক কিংবা স্বর্গীয় পরিমণ্ডলে আবদ্ধ না থেকে এটাকে অনেক ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেন। ফস্টি নস্টি কিংবা টক ঝাল মিষ্টি ভালোবাসার অনুভুতির বাইরে আছে পারস্পরিক মনোদৈহিক আকর্ষণ। পাশাপাশি থাকে রাগ, অভিমান, ঈর্ষা। এর সাথে থাকে সঙ্গী নির্বাচনের কৌশল, আনন্দ, ভয় , ঘৃণা,বিচ্ছেদ এমনকি যৌনমিলনের উদগ্র আকাঙ্ক্ষাও।
শুরু করা যাক সেই চিরপুরাতন অথচ সদা নতুন প্রশ্নটি দিয়ে। প্রেম কী? শেক্সপিয়র তার একটি নাটিকায় তার সৃষ্ট চরিত্রের মুখ দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিলেন, “What ‘is to love?”[৬৯]। আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও তার একটি বিখ্যাত গানে একই ধরনের প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন[৭০] —
সখি, ভাবনা কাহারে বলে ?
সখি, যাতনা কাহারে বলে ?
তোমরা যে বলো দিবস-রজনী – ‘ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা’
সখি, ভালোবাসা কারে কয়!
সেকি কেবলি যাতনাময়।
সেকি কেবলই চোখের জল?
সেকি কেবলই দুখের শ্বাস? …
ভালোবাসা নিয়ে ইংরেজিতেও অনেক ধরনের গান আছে। এর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় গানটি হচ্ছে I’ll Never Fall in Love Again[৭১]. গানের কথাগুলো এরকমের —
What do you get when you fall in love?
A guy with a pin to burst your bubble
That’s what you get for all your trouble
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
What do you get when you kiss a girl
You get enough germs to catch pneumonia
After you do, she’ll never phone you
I’ll never fall in love again
I’ll never fall in love again
কিন্তু কবিগুরু যখন ‘সখি ভালোবাসা কাহারে বলে?’ বলে গানে গানে প্রশ্ন করেছিলেন কিংবা শেক্সপিয়র তার নাটকের সংলাপ লিখেছিলেন, “What ‘is to love?” বলে, তখন কি তারা একবারের জন্যও ভাবতে পেরেছিলেন তাঁদের এই প্রশ্নের উত্তর অপেক্ষা করছে তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে? বিবর্তন মনোবিজ্ঞানসহ বিবর্তনের বিভিন্ন শাখা থেকে পাওয়া প্রান্তিক জ্ঞানের বদৌলতে প্রেমের এক সন্তোষজনক ব্যাখ্যা কিন্তু দেয়া সম্ভব।
কিছুদিন আগেও আমরা ঢালাওভাবে বলে দিতাম ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা নেই, বিজ্ঞান ভালোবাসার কোনো ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম ইত্যাদি। সেই দিন আর নেই। বিজ্ঞান এখন চোরের মতো সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে ভালোবাসার গোপন কুঠুরিতে। চলুন আমরাও সে কুঠুরিতে পা রাখি…
ভালোবাসা কারে কয়
৬৭.↑ Daniel C. Dennett, Darwin’s Dangerous Idea: Evolution and the Meanings of Life, Simon & Schuster, 1996, p 21.
৬৮.↑ ভালবাসা ও বিবর্তন, মুক্তমনা, ফেব্রুয়ারী ১১, ২০১০↑
৬৯.↑ William Shakespeare (1564–1616), Dialogue between Phebe and Silvius, in As You Like It, act 5, sc. 2, l. 83-98.