ধরুন, দেড় দুই লক্ষ বছর আগে কোন এক বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণী, আমাদের কল্পনার সেই উড়ন্ত সসারে করে পৃথিবীতে পদার্পণ করলাে। সেই সময়ে আফ্রিকার এক কোণে ঘুড়ে বেড়ানাে আমাদের আধুনিক মানুষের প্রজাতি Homo Sapiens দের দেখে কি ভাবতাে তারা? তারা কি বিবর্তনের পরিক্রমায় এই পৃথিবীতে আমাদের টিকে থাকা নিয়ে কোন বড়সড় বাজী ধরতে রাজী হত? তারা কি ভুলেও কল্পণা করতে পারতাে যে এই প্রজাতিটিই খুব নিকট ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীটাকে দখল করে নেবে? চারদিকের নির্মম প্রকৃতির সাথে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকার জন্য কি আছে তাদের? প্রয়ােজনীয় কিছুই নেই – থাবা নেই, ধারালাে দাঁত নেই, শিং বা লােম কিছুই নেই, অত্যন্ত দুর্বল দেখতে অদ্ভুত এক দ্বিপদী প্রাণী!
জানি, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতই শােনাচ্ছে, কিন্তু ব্যাপারটাকে ঠিক উড়িয়েও দেওয়া যায় না। এখন স্বভাবতই তাহলে প্রশ্ন করতে হয়, সে অবস্থা থেকে আমরা টিকে গেলাম কি করে? শুধু টিকে গেছি বললেও তাে ভুল বলা হবে – মাত্র দেড় দুই লাখ বছরে ফুলে ফেপে সংখ্যায় ছয়শাে কোটি তাে ছাড়িয়ে গেছিই, পৃথিবীব্যাপী প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করছি, ইদানীংকালে আবার পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে মহাবিশ্বের দিকেও দিয়েছি হাত বাড়িয়ে। কিন্তু কি করে সম্ভব হল সেটা? বৈচিত্রময় এই বিশাল প্রকৃতি জগতের এক ক্ষুদ্র অংশ এই মানব প্রজাতির অনন্যতার উৎসটি আসলে কোথায়?
দু’টি বৈশষ্ট্যের কথা তাে চোখ বন্ধ করেই বলা যায়ঃ মানুষই একমাত্র প্রাণী যে দুই পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে শিখেছে, আর ওদিকে আবার খুব অসাধারণ রকমের বড় মস্তিষ্কেরও বিবর্তন ঘটেছে যা অন্য কোন প্রাণীতে ঘটতে দেখা যায় নি। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, অত্যন্ত সুপরিচিত জীববিজ্ঞানী, এডওয়ার্ড উইলসনের গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ২০ লক্ষ বছর আগে থেকে শুরু করে আড়াই লাখ বছর আগে পর্যন্তও আমাদের মস্তিষ্কের । আকার প্রতি এক লাখ বছরে প্রায় এক চামচের সমান করে বেড়েছিলাে [১]। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, ধীর গতিতে হলেও এখনও আমাদের মস্তিষ্কের বিবর্ধন ঘটে চলেছে। আমাদের মস্তিষ্কের যে অংশটি আমাদের বুদ্ধিমত্তার সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত সেই সেরিব্রেল করটেক্স কে যদি টেনে ফ্ল্যাট করে বিছিয়ে দেওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে তা চার পৃষ্ঠা জুড়ে জায়গা করে নিচ্ছে। আমাদের সবচেয়ে কাছের পূর্বসুরী শিম্পাঞ্জীদের সেরিব্রেল করটেক্স নেবে মাত্র এক পাতার সমান জায়গা, বানরেরটা নেবে একটি পােষ্টকার্ডের সমান আর ইদুরের ক্ষেত্রে তা নেবে মাত্র একটা স্ট্যাম্পের সমান জায়গা [২]।
পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতই, তাই হয়তাে সাফল্যের পাল্লাটাও বেশ ভারী। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, উহু, মস্তিষ্কের আকারটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেটাই বােধ হয় একমাত্র কারণ নয়! তাহলে তাে আমাদের মত বড় মস্তিষ্কের অধিকারী নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির মানুষরাও একই রকম সাফল্য অর্জন করতে পারতাে – তাদের মত প্রজাতির তাে তাহলে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার কথা নয়। একদিকে মস্তিষ্কের বিকাশ আবার অন্যদিকে আমাদের শরীরে সময় মত সাহায্যকারী মিউটেশনগুলাের ফলশ্রুতিতেই ঘটেছে ভাষার উৎপত্তি ও ব্যবহার, তার সাথে পাল্লা দিয়ে ঘটেছে সাংস্কৃতিক বিবর্তন এবং বিকাশ ঘটেছে জটিল এক সামাজিক ব্যবস্থার। এখানেই তাে শেষ নয়, গত কয়েক লক্ষ বছরে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঘটতে থাকা পরিবেশগত পরিবর্তনের ব্যাপারটাকেও তাে এই সমীকরণ থেকে বাদ দিয়ে দিলে চলবে না। এই পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে টিকে থাকার জন্য মানুষ যত নতুন ভাবে অভিযােজিত হয়েছে। বিবর্তনের নিয়মে ততই বিকশিত হয়েছে তার নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ –
আজকে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে পূণাংগ কোন ধারণা পেতে হলে শুধু তার বিবর্তনের পিছনের বিজ্ঞানটা পড়লেই হবে না। বরং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে মানুষের চারপাশের পারিপার্শ্বিকতার পরিবর্তনের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশের জটিল | প্রেক্ষাপটটাকেও ঠিক মত বিশ্লেষণ করতে হবে।
আমরা জানি যে, এই মহাবিশ্ব প্রায় ১৪শ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হলেও আমাদের এই বুড়ো পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ শ’ কোটি বছর আগে। এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, প্রাণের জন্ম হতে লেগে গিয়েছিলাে আরও প্রায় একশাে কোটি বছর। আর মানুষের উৎপত্তি? সে তাে সে দিনকার কথা! আদিম এক কোষী প্রাণ, ব্যাকটেরিয়া, বহুকোষী প্রাণী, আলজি, অমেরুদন্ডী প্রাণী, বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীর উৎপত্তি, বিকাশ বা বিলুপ্তির ধাপ বেয়ে, বিবর্তনের চড়াই উত্রাই পেরিয়ে মানুষের আদি পূর্বপুরুষদের উদ্ভব ঘটলাে মাত্র ৫০-৬০ লাখ বছর আগে। সে সময়ে মানুষ এবং অন্যান্য বনমানুষের মাঝামাঝি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কিছু প্রজাতির পায়ের উপর ভর করে দাঁড়াতে শিখলেও তার থেকে আধুনিক মানুষের পুর্বপুরুষদের উদ্ভব ঘটতে লেগে গেছে আরও প্রায় ৩০ লক্ষ বছর।
আর আমাদের নিজেদের প্রজাতি অর্থাৎ Homo sapiens দের গল্পের শুরু তাে সেদিন, মাত্র দেড় লাখ খানেক বছর আগে। ভূতাত্ত্বিক নিয়মে হিসাব করলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্বের ব্যাপারটা একেবারেই আনকোরা। শুধু তাে তাইই নয়, বিবর্তনের ধারায় যেমন অগুনতি জীবের উৎপত্তি ঘটেছে ঠিক তেমনি তাদের একটা বড় অংশ বিলুপ্তও হয়ে গেছে। একইভাবে আমরা ফসিল রেকর্ড থেকে দেখতে পাই যে, মানুষেরও বিভিন্ন প্রজাতির উৎপত্তি ঘটেছে, আবার আমাদের প্রজাতি ছাড়া বাকিরা বিলীন হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতায়। বিবর্তনের
ইতিহাসে অনিয়শ্চতার তাে কোন শেষ নেই, ডাইনােসরের মত অতিকায় প্রাণী বহুকাল ধরে পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করেও শেষ পর্যন্ত হারিয়ে গেছে। সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে ভয়ঙ্কর কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে মহাপরাক্রমশালী ডায়নােসরগুলাে বিলুপ্ত হয়ে না গেলে সেই সময়ের অত্যন্ত নগন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলাে হয়তাে এত বিকশিত হতে পারতাে না। অর্থাৎ, অন্যান্য সব প্রাণীর মতই আমাদের উদ্ভবও তাে কোন পূর্বনির্ধারিত ব্যাপার নয়। আমরা আজকে এখানে আছি কোন ‘নীল নক্সা’র ফলশ্রুতিতে নয়, বরং ঠিক তার উলটো কারণে, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ঘটনাগুলাে যেভাবে ঘটেছে তা না ঘটলেই হয়তাে আজকে আর আমরা এখানে থাকতাম না। প্রখ্যাত বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী এবং ফসিলবিদ স্টিফেন জে. গুলড তাই বলেছিলেন,
মানুষ আগে থেকে নির্ধারিত বিবর্তনের কোন ধারার শেষ ফসল নয় বরং মানুষ হচ্ছে আকষ্মিকভাবে উদ্ভূত মহাজাগতিক এক অনুচিন্তার ফলাফল। বিশাল শাখা প্রশাখাসহ যে প্রাণবৃক্ষের বিবর্তন ঘটেছে মানুষ হচ্ছে তার একটা ছােট্টো শাখামাত্র। একরকম নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, এই গাছের বীজটাকে যদি আবার নতুন করে বপন করা হয় তাহলে এই শাখাটা আবার একই রকমভাবে একই জায়গায় জন্ম নেবে না [৩]।
আসলে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসটা যে একটু অদ্ভুত এবং অন্য প্রাণীদের থেকে একটু বেশী জটিল সেটা কিন্তু স্বীকার করে নিতেই হবে! একদিক দিয়ে বিচার করলে, তা অন্যান্য সব প্রাণীর মতই প্রাকৃতিক নিয়মে বিবর্তনের ধারায় ঘটে যাওয়া এক আকস্মিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়, আর অন্যদিকে থেকে চিন্তা করলে, তা হচ্ছে অকল্পনীয় বুদ্ধিমত্তা, ভাষা ও সভ্যতার বিকাশের এবং সেই সাথে প্রকৃতির সাথে টেক্কা দেওয়ার এক অনন্য ইতিহাস। মানুষের এই অভূতপূর্ব বুদ্ধিমত্তা একদিকে যেমন তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে সামনের দিকে তেমনি তাকে উৎসাহী করে তুলেছে নিজের উৎপত্তির ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করতে।
অদম্য কৌতূহল ছিলাে তার, কিন্তু জ্ঞানের মাত্রা তখনও এমন অবস্থায় পৌঁছেনি যে সে তার নিজের উৎপত্তির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজে বের করতে পারবে বা উপলব্ধি করতে পারবে যে, কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকা সত্ত্বেও সে আসলে প্রকৃতির অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে তাে মানুষের পক্ষে তার উৎপত্তির রহস্য বৈজ্ঞানিকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিলাে না। যেখানেই তার জ্ঞানের পরিসীমা আটকে গেছে সেখানেই সে জন্ম দিয়েছে হাজারাে কল্পকাহিনী, উপাখ্যান আর নানা রকমের সৃষ্টিতত্ত্বের।
তাই সবার মত প্রকৃতির অধীন হয়ে থেকে তার তাে আর পােষালাে না, সে আরও অনেক বেশী জানতে চায়, বুঝতে চায়, নিজের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা চায়, প্রকৃতিকে জয় করতে চায়। প্রকৃতির বিশালত্ব, নির্মমতা, হিংস্রতার সামনে অসহায় কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষ নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অনবরত লড়াই করেছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে, আবার অন্যদিকে তার সামনেই মাথা নুইয়ে তৈরি করেছে। নানা ধরণের কাল্পনিক স্রষ্টার। সহজাত বুদ্ধি আর অদম্য কৌতুহল আছে তার, কিন্তু অজ্ঞতা এবং কালের সীমাবদ্ধতাও তাে অপরিসীম!
আসলেই তাে অবাক করা ব্যাপার – চারদিকে ফুলে ফলে সম্পদে ভরা পৃথিবী, তেষ্টা মেটাতে, বেঁচে থাকতে, ফসল ফলাতে পানির দরকার, অজানা কারণে বৃষ্টি হয়ে তা ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে, তাকে তাপ দেওয়ার জন্য সূর্য উঠছে একদিকে, দিনের শেষে ডুবে যাচ্ছে আরেক দিকে – এর সবই তার জন্য তৈরি নয় তাে কি? আবার ওদিকে আগুন, মহাপ্লাবন, বজ্রপাত, সাইক্লোনগুলাে কি যেনাে এক অজানা কারণে তাকে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে।
মহাবিশ্বের ছোট্ট এক গ্রহের আরও ছোট্ট এই মানুষ প্রজাতি তার চারদিকের প্রকৃতি এবং মহাবিশ্বের বিশালতায় পুলকিত, অভিভূত এবং ভীত! আর তা থেকেই সে সৃষ্টি করেছে অসংখ্য দেব দেবতা, অলৌকিক সব সৃষ্টিকর্তার এব সৃষ্টিতত্ত্বের, আর তারপর মহা গর্বে, মিথ্যা আস্ফালনে নিজেকে বসিয়েছে তার কেন্দ্রে। মহাবিশ্বের সমস্ত আয়ােজনের উপলক্ষ্য নাকি সে, সেই নাকি ‘সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’!
কিছুদিন আগে মিশরের এক ফেরাউনের কয়েক হাজার বছরের পুরনো সমাধি খুঁড়ে বিচিত্র সব জিনিস পাওয়া গেছে, নরবলি দেওয়া কঙ্কাল থেকে শুরু করে ৭০ ফুট লম্বা ১৪টি নৌকার পর্যন্ত কি না পাওয়া গেছে সেই সমাধির ভিতরে। পরজন্মে রাজাদের দাস দাসী তাে লাগবেই, সে জন্যই এ নরবলি; তার সাথে নৌকাগুলােও দিয়ে দেওয়া হয়েছিলাে যাতে চরে ফেরাউনের আত্মা পরপারে পাড়ি জমাতে পারবে! এখন হয়তাে এ ধরণের কাহিনীগুলাে শুনলে আমরা চমকে উঠি কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখুন – আমাদের চারপাশে পৃথিবীর আনাচে কানাচে, সব জাতি, গােষ্ঠি, সমাজ এবং সভ্যতার মধ্যেই বহু রকমের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং ধর্মীয় রীতিনীতির অস্তিত্ব দেখা যায়। বহুকালের সঞ্চিত সামাজিক অভিজ্ঞতার সাথে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে আমরা তৈরি করেছি এই সৃষ্টিতত্ত্বগুলাে, আর তদানীন্তন সামাজিক রীতিগুলােকে তার সাথে বেঁধে দিয়ে বলেছি এটাই নিয়ম, এটাই ধর্ম এবং একমাত্র জীবন বিধান।
শুধুই যে অজ্ঞতা থেকে, ভীতি থেকেই কল্পকাহিনীগুলাের জন্ম দিয়েছে তাও কিন্তু নয়, সমাজের অধিপতিরা তাদের শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্যও ভর করেছে ধর্মের উপর, একে পুঁজি করে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শােষণকে বৈধতা দিয়েছে। আর সত্যিকারের জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা যেনাে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত না পৌঁছায় তার জন্য তৈরি করে রেখেছে বিভিন্ন নিয়মাবলীর। আড়াই হাজার বছর আগে সেই প্রাচীণ গ্রীস দেশে বিজ্ঞান তার সঠিক গতিতেই এগুতে শুরু করেছিলাে।
কিন্তু প্লেটো এবং বিশেষ করে এরিস্টোটল সেই সময়ের দাসপ্রথাভিত্তিক নিবর্তনমুলক সমাজব্যবস্থাকে গ্রহনযােগ্যতা দেওয়ার জন্য শক্তিশালী এক ভাববাদী দর্শনের জন্ম দিলেন যার মূলে ছিলাে অপরিবর্তনশীলতা এবং জীবের শ্বাসত স্থায়ীত্বের তত্ত্ব [৪]। আর এই স্থবির ধারণার উপর ভর করেই রােমান সাম্রাজ্যের পৃষ্ঠপােষকতায় গড়ে উঠলাে খ্রীস্টিয় ধর্ম। গত হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে শাসকচক্রের সাথে মিলে ধর্মীয় অনুশাসনগুলো কিভাবে বৈজ্ঞানিক অগ্রসরতার টুটি চেপে ধরেছে সেই কাহিনীতে এখন আর ঢুকছিনা, যারা মানব সভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে কিছু হলেও ধারণা রাখেন তারা সবাই এ সম্পর্কে কম বা বেশী জানেন।
এটুকুই শুধু বলা যায় যে, এখনও আমাদের চারপাশে এ রকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার কোন শেষ নেই। কিন্তু মানুষের ইতিহাসের আরেকটি দিক না বললে গল্পটার একটা দিক না বলাই থেকে যাবে। আমরা উপরে মানুষের কল্পনার কথা বলেছি, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রতিরােধের কথা বলেছি কিন্তু তার বিরুদ্ধে মানব সভ্যতার অনন্ত সংগ্রামের কথাটা এখনও বলা হয়নি। যুগে যুগে মানুষের সৃজনীশক্তি, অজানাকে জানার অদম্য কৌতূহল এবং বুদ্ধিমত্তা তাকে একদিকে যেমন কল্পনা করতে শিখিয়েছে তেমনি আবার নতুন নতুন চিন্তা এবং আবিষ্কারেরও খােরাক জুগিয়েছে।
কালের পরিক্রমায় নতুন নতুন জ্ঞানের আলােয় আলােকিত হয়ে সে যখন অজানা বিষয়গুলােকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে পেরেছে, তখনই সব বাঁধা অতিক্রম করে, পুরনাে ভুলের এবং প্রতিরােধের দেওয়ালগুলােকে ভেঙ্গে চুড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মানুষ শত অত্যাচার সহ্য করেছে, এমনকি মৃত্যুকেও বরণ করে নিয়েছে। তাই আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে এ ধরণের প্রতিরোধ এবং সংগ্রামের কাহিনীর কোন শেষ নেই। তার এই কল্পনাশক্তি এবং সেই সাথে যুক্তি দিয়ে, বস্তুবাদী চিন্তা দিয়ে তার চারদিকের সব কিছুকে বিশ্লেষণ করে দেখার অসীম ইচ্ছা এবং সর্বোপরি সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার নিরন্তর সংগ্রামের কারণেই জ্ঞান-বিজ্ঞান আজকে এখানে এসে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে।
সে যাই হােক, চলুন আমরা ফিরে যাই মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের গল্পে। আমরা জানি যে, ষােড়শ শতাব্দীতে এসে কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক সৌরজগতের ধারণাটা হাজার বছর ধরে টিকে থাকা মধ্যযুগীয় ধর্মীয় এবং সামাজিক স্থবিরতার ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপরও তাে প্রায় কয়েকশ বছর লেগে গিয়েছিল সেই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে। আমরা দ্বিতীয় অধ্যায়ে দেখেছি কিভাবে বহু বাঁধা বিঘ্ন পেরিয়ে জীববিজ্ঞান শেষ পর্যন্ত উনবিংশ শতাব্দীতে বেরিয়ে এসেছিলাে সেই প্রজাতির পৃথক পৃথক সৃষ্টি এবং স্থির প্রজাতির মতবাদের ভ্রান্তি থেকে!
প্রথমবারের মত আমরা জানতে পেরেছিলাম আমাদের উৎপত্তি এবং বিকাশের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা। তারপর প্রায় দেড়শাে বছর কেটে গেছে, বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক শাখাগুলাে প্রতিদিনিই আরও জোরালােভাবে এই বিবর্তন তত্ত্বের সঠিকতা প্রমাণ করে চলেছে, কিন্তু প্রাচীন চিন্তার আচলায়তন ভেঙ্গে আমাদের সমাজে তা কিন্তু এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি। পৃথিবীতে যে গুটিকয়েক তত্ত্ব সমস্ত পুরনাে ঘুণে ধরা রক্ষণশীল ভ্রান্ত চিন্তা ভাবনা ও প্রথাকে সমুলে আঘাত করেছে তার মধ্যে বিবর্তনবাদ অন্যতম। তাই তার বিরুদ্ধে প্রতিরােধেরও মাত্রাটা যে একটু বাড়াবাড়ি রকমের বেশি হবে তা তাে জানা কথাই।
মানব সভ্যতার সমগ্র ইতিহাস জুড়েই আমরা এর পুনরাবৃত্তি দেখে এসেছি। অন্যান্য জীবের বিবর্তন নিয়ে কথা বললে যাও বা ঠিক আছে, কিন্তু মানুষের বিবর্তনের প্রসংগ আসলেই আমাদের মাথায় যেনাে আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সেই ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড ওয়ালেস যখন প্রথম বিবর্তনের তত্ত্বটি প্রস্তাব করলেন তখন চার্চের বিশপের স্ত্রীর মুখ থেকে যে আতঙ্কবানী বের হয়ে এসেছিলাে তা যেনাে আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। তিনি আর্তনাদ করে বলেছিলেন [৫],
‘বনমানুষ থেকে আমাদের বিবর্তন ঘটেছে। আশা করি যেনাে এটা সত্যি না হয়, আর যদি তা একাই সত্য হয়ে থাকে তবে চলাে আমরা সবাই মিলে প্রার্থনা করি সাধারণ মানুষ যেনাে এটা কখনই জানতে না পারে!
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সত্যকে সরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা তাে আর নতুন কিছুই নয়। এখনও বিশ্বব্যাপী সেই চেষ্টার যেন কোন কমতি নেই!
ডারউইন প্রথমে তার প্রজাতি উৎপত্তি বইটিতে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে তেমন কিছুই বলেন নি (শুধু বলেছিলেন, ‘light will be thrown on the origin of man and his history’), এবং সেই সময়ের সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার এই নিশ্চুপতার কারণটা বােঝা তেমন কঠিনও নয়। ১৮৫৭ সালে জার্মানির ডুসেল নদীর উপত্যকায় নিয়েন্ডারথাল নামক জায়গায় বেশ কিছু আদিম মানুষের করােটি আবিষ্কৃত হয়। তখন জার্মানীর প্রখ্যাত অধ্যাপক স্কাফ হাউসেন ফসিলগুলাে পর্যবেক্ষণ করে প্রস্তাব করেন যে, এগুলাে আসলে মানুষের কোন বিলুপ্ত আদিম প্রজাতির হাড়গােড়। এদের নাম দেওয়া হয় নিয়েন্ডারথাল মানুষ [৬]।
তখনকার শিক্ষিত সমাজ কিন্তু তার কথা বিশ্বাস করেননি। ওদিকে ডারউইনের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং বিজ্ঞানী টি এইচ হাক্সলি সে সময়ই মানুষের বিবর্তনের বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং এপ বা বন মানুষের সাথে মানুষের সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্যগুলাে তুলে ধরে ১৮৬৩ সালে ‘Evidence as to Man’s Place in Nature’ নামক বইটি প্রকাশ করেন। এর পর ডারউইন যখন “The Descent of Man and selection with respect to Sex’ বইটি বের করেন ততদিনে মানুষের বিবর্তনের বিষয়টি বুদ্ধিজীবী মহলে মােটামুটিভাবে সুপরিচিত হয়ে গেছে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে জার্মান বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট হেকেল তার বিখ্যাত সৃষ্টির ইতিহাস বইয়ে লিখেছিলেন যে, বনমানুষ থেকে মানুষের বিবর্তন যদি সত্যিই ঘটে থাকে তবে মানুষও নয় আবার ঠিক বনমানুষও নয় এমন ধরণের মধ্যস্থিত ফসিল পাওয়া যাবে। তিনিই প্রথম বিবর্তনের মধ্যবর্তী অবস্থার এরকম ফসিলগুলােকে হারানাে যােগসূত্র বা ‘Missing Link’ বলে আখ্যায়িত করেন [৬]। তার কথাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে – গত একশাে বছরে এমন অসংখ্য ফসিলের সন্ধান পাওয়া গেছে যা থেকে মানুষ এবং বনমানুষের মধ্যবর্তী অবস্থার বিবর্তনের ধাপগুলাে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শুধু ত তাইই নয়, এথেকে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন সময়ে আমাদের প্রজাতির (Homo sapiens) মানুষ ছাড়াও আরও অন্যান্য প্রজাতির মানুষও বিচরণ করেছে, এমনকি অনেক সময় একাধিক প্রজাতির মানুষ একই সময়ে তাদের সম্মিলিত পদচারণায় মুখরিত করে তুলেছে আমাদের এই ধরণী। অর্থাৎ, আমরা নিজেদেরকে যতই বিশেষ এক সৃষ্টি বলে দাবী করি না কেনাে আমরাও আসলে অন্য কোন পূর্ববর্তী প্রজাতি থেকেই বিবর্তিত হয়েছি, অন্যান্য জীবের মতই আমাদের পুর্বপুরুষদেরও বিবর্তন ঘটেছে বিভিন্ন ধারায়, প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় তাদের মধ্যেও উদ্ভব ঘটেছে বিভিন্ন ধরণের প্রজাতির। এই মুহুর্তে আমরা ছাড়া আর কোন মানব প্রজাতির অস্তিত্ব না থাকলেও অতীতে যে তা ছিলাে তা নিয়ে কিন্তু দ্বিমত প্রকাশের কোন অবকাশই আর নেই।
গত একশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা মানুষ এবং এপের মধ্যবর্তী স্তরের যে সমস্ত ফসিল খুঁজে পেয়েছেন তা থেকে মানব বিবর্তনের একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া কিন্তু আর কোন কঠিন ব্যাপার নয়। এখন সমস্যাটা আর যথেষ্ট পরিমাণে ফসিল পাওয়া যাচ্ছে না তা নয় বরং ঠিক তার উলটো। এত রকমের মানুষের পুর্বপুরুষের প্রজাতির এবং তাদের মধ্যবর্তী স্তরের ফসিল পাওয়া যাচ্ছে যে তাদেরকে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঠিকঠাক মত শ্রেণীবিন্যাস করাটাই বিজ্ঞানীদের জন্য এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞানী আর্নেষ্ট হেকেলের মনােবাঞ্ছা যে এভাবে পূরণ হবে তা হয়তাে তিনি নিজেও আশা করেননি। তার উপরে আবার গত কয়েক দশকে ডেটিং পদ্ধতির যে অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছে তার ফলে সঠিকভাবে ফসিলের বয়স এবং প্রকৃতি নির্ধারণ করার ক্ষমতাও বেড়ে গেছে বহুগুণ।
আরও উন্নত পদ্ধতির রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে ঠিকমত আগ্নেয়শীলা পাওয়া যাচ্ছে না বা যেগুলাে রেডিওকার্বন ডেটিং এর সময়সীমার আওতায় পড়ছে না সেখানে এখন ইলেকট্রন স্পিন রেসােনেন্স এবং ইউরেনিয়াম সিরিজ ডেটিং এর মত অত্যাধুনিক পদ্ধতিগুলাে ব্যবহার করা হচ্ছে। সিটি স্ক্যান নামের ত্রিমাত্রিক এক্স-রে পদ্ধতিটি মূলত চিকিৎসাবিদ্যার জন্য আবিষ্কৃত হলেও এখন তার মাধ্যমে ফসিলের বাইরের এবং ভিতরের আভ্যন্তরীণ গঠণের ছবি তােলা সম্ভব হচ্ছে, মাইক্রোস্কপিক পদ্ধতির মাধ্যমে হাড়ের বা দাঁতের গঠন বের করে ফেলা যাচ্ছে, আবার আইসােটোপিক পর্যালােচনার মাধ্যমে বিলুপ্ত প্রজাতিগুলাের খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কেও বেশ ভালাে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে [৮], [৯]।
এছাড়া মানুষ এবং এপের দৈহিক গঠনের তুলনামুলক বিচার থেকেও বহু তথ্য বেড়িয়ে এসেছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের সাথে এপের পার্থক্যগুলাে যত বেশী না পরিমাণগত তার চেয়ে অনেক বেশী গুণগত। মানুষের মধ্যে উল্লেখযােগ্য রকমের ভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলাে হচ্ছেঃ কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের আকার বিশেষতঃ মস্তিষ্কের আকার মানুষের অনেক বড়, বনমানুষের সাথে তাদের হাত এবং পায়ের আকারের অনুপাতেও পার্থক্য রয়েছে, গায়ের লােম পড়ে গেছে অনেকাংশেই, চামড়ার রঞ্জকবস্তু এবং বুড়াে আঙ্গুল নাড়াবার ক্ষমতাও মানুষের অনেক বেশী।
আগে মানুষের সাথে বনমানুষের পার্থক্যকে যত বড় বলে মনে করা হত আধুনিক গবেষণার ফলে তা ক্রমশঃ যেন কমে আসছে। অনেকেই এখনও বৃটিশ বিজ্ঞানী রিচার্ড ওয়েন (Richard Owen, 1804-1892) এর বলা কিছু ভুল তথ্যকে সত্য বলে মনে করে বসে আছেন – ওয়েন মনে করেছিলেন যে, তিনি মানুষ এবং বনমানুষের মধ্যে বিশাল এক পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন যা দিয়ে প্রমাণ করা যায় যে মানুষ এবং বনমানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়ে আসেনি। তিনি বলেন মানুষের মস্তিষ্কে হিপােক্যাম্পাস নামের একটি বাড়তি উপাংগ রয়েছে যা কিনা বনমানুষের মধ্যে নেই। কিন্তু ডারউনের বন্ধু টি এইচ হাক্সলি তখনই তা ভুল প্রমাণ করেন, প্রকৃতপক্ষে মানুষ এবং এপ দুই গ্রুপেরই মধ্যে এই উপাংগটির অস্তিত্ব রয়েছে।
এ তাে গেলাে একটা দিক, অন্যদিকে জেনেটিক্স এবং জিনােমিক্সের আধুনিক গবেষণা এবং পর্যালােচনাকে বাদ দিলে তাে বিবর্তনের গল্প বলাই এখন আর সম্ভব নয়। গত দুই তিন দশকে বিজ্ঞানের এই শাখাটি বিবর্তনবাদ এবং মানুষের বিবর্তনের পক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী সব তথ্য এবং সাক্ষ্য হাজির করেছে যার সাথে অংগস্থানবিদ্যা এবং ফসিলবিদ্যা থেকে আলাদা আলাদাভাবে পাওয়া তথ্যগুলাে প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। আর দু’এক জায়গায় যেখানে অমিল বা সংশয় ধরা পড়ছে সেখানে বিজ্ঞানীরা সুযােগ পাচ্ছেন আরও নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে ভুলগুলাে শুধরে নেওয়ার।
বিজ্ঞানের তিনটি শাখা থেকে স্বতন্ত্রভাবে পাওয়া এই সম্মিলিত তথ্যগুলাে বিবর্তন বিদ্যাকে অত্যন্ত সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। মানুষ এবং তার কাছাকাছি প্রজাতিগুলাের জিনােমের অনুক্রম বা সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে আমরা মানুষের বিবর্তন নিয়ে যে বিস্তারিত সব তথ্য পেতে শুরু করেছি।

এখন আবার প্যালেও-অ্যানথ্রোপলজি নামে বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা তৈরি করা হয়েছে, এরা মানুষের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা করে। নৃতত্ত্ববিদ্যার অংশ হলেও এখানে জীববিদ্যা, ভূতত্ত্ববিদ্যা এমনকি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের সমস্ত গবেষণাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আসলে যতই দিন যাচ্ছে ততই আরও বেশী করে পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে মানুষের বিবর্তনকে শুধুমাত্র জীববিজ্ঞানের সীমার মধ্যে রেখে বিচার করলেই হবে না। বুদ্ধিমত্তা এবং ভাষার অচিন্ত্যনীয় বিকাশের ফলে মানুষ এমন এক জটিল সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যে, বিবর্তনের প্রক্রিয়াও তার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। আবার অন্যদিকে, মানুষ ছাড়া আমাদের খুব নিকটাত্মীয়রাও, যেমন ওরাং ওটাং, গরিলা, বা শিম্পাঞ্জিও, যেহেতু বেশ জটিল সামাজিক বন্ধন তৈরি করে, তাই মানুষের বিবর্তন বুঝতে হলে এই প্রজাতিগুলােরও জেনেটিক গঠন এবং বৈশিষ্ট্য তাে বুঝতে হবেই এবং তার পাশাপাশি এদের ব্যবহার এবং প্রবণতাগুলােকেও বােঝাও অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘মানুষের বিভিন্ন প্রজাতি’ বলতে কি বুঝায় তা আরেকবার একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। জীববিদ্যার সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রজাতি বলতে আমরা বুঝি এমন এক জনপুঞ্জ যারা নিজেদের মধ্যে প্রজননে সক্ষম, কিন্তু অন্য জনপুঞ্জ থেকে প্রজননের দিক থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। যেমন ধরুন, বিভিন্ন ধরণের বিড়াল প্রজাতি বললে আমরা বুঝি তার মধ্যে রয়েছে, ঘরের সাধারণ বিড়াল থেকে শুরু করে, বাঘ, চিতা বাঘ, সিংহ, জাগুয়ার, বন্য বিড়াল পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতি।
হ্যা, মানুষ এবং তার পূর্বপুরুষদের বিভিন্ন প্রজাতি বলতে আমরা সেরকম ওই বিভিন্ন ধরনের মানুষের কথাই বুঝি। এখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানুষের একটাই প্রজাতি টিকে রয়েছে বলে ব্যাপারটা ঠিকমত বুঝে ওঠা আমাদের জন্য যেনাে একটু কষ্টকরে হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের প্রজাতির মানুষের সাথে কিছুটা মিল রয়েছে, আবার অমিলগুলােও চোখে পড়ার মতই, কিন্তু আবার বংশগতীয় দিক থেকে এতটাই ভিন্ন যে, তারা আমাদের সাথে প্রজননে অক্ষম এমন বিভিন্ন ধরণের মানুষ নামক জীব পৃথিবীতে ছুড়ে বেড়িয়েছে? হ্যা, বেশ অবিশ্বাস্য হলেও ব্যাপারটা আসলে সেরকমই।
এই বইটা তাে শুরুই করেছি সেরকম এক ধরণের মানব প্রজাতির (Homo floresiensis বা যাদেরকে সাধারণ ভাষায় হবিট বা বেটে মানুষও বলা হয়) বর্ণনা দিয়ে। একটু পরেই আমরা আরও দেখবাে যে, শুধু Homo floresiensis বা নিয়ান্ডারথাল প্রজাতিই নয়, বিবর্তনের ধারায় মানুষ এবং এপের মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বিভিন্ন রকমের প্রজাতি এবং ক্রমশঃ সময়ের সাথে সাথে আজকের আধুনিক মানুষের। কাছাকাছি বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন বিভিন্ন ধরণের মানব প্রজাতি এই পৃথিবীতে বিকশিত হয়েছিল।
গত কয়েক দশকে আণবিক জীববিদ্যা, জেনেটিক্স, জিনােমিক্সের বিভিন্ন আবিষ্কারগুলাে প্রাণের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে এক নতুন পর্যায়ে উত্তোরিত করেছে। এই বিষয়টি নিয়ে আলােচনা না করলে একুশ শতকে বসে লেখা কোন বিবর্তনের গল্প সম্পুর্ন হতে পারেনা। তাই ভাবছি এই নতুন জ্ঞানের আলােয় আমাদের পূর্বপুরুষদের গল্পটা কি রূপ নিয়েছে তা নিয়েই না হয় আগে আলােচনা করা যাক, তারপর আমরা দেখবাে ফসিল রেকর্ডগুলাে তার সাথে একমত হচ্ছে কিনা। এখানে ডিএনএ-র গঠন বা কিভাবে জেনেটিক তথ্য ডিএনএ-র ভিতর সঞ্চিত থাকে বা আণবিক জীববিদ্যার সাম্প্রতিক সবগুলাে আবিষ্কার উল্লেখ করার সুযােগ বা সময় কোনটাই নেই বলে শুধু মানুষের বিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কারের কথাই উল্লেখ করবাে।
আসলে সত্যি কথা বলতে কি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে গত কয়েক শতাব্দী ধরে এত কাজ হয়েছে এবং হচ্ছে যে শুধু তা নিয়েই একটি বড়সড় বই লেখা যায়। এখানে একটি অধ্যায়ের ছােট্টো পরিসরে তার সবকিছু ব্যাখ্যা করার প্রয়াসকে এক ধরণের ধৃষ্টতা ছাড়া আর কি যে বলা যায় তা ভেবে পাচ্ছি না। কিন্তু কি আর করা, সময় এবং সুযোগের সীমাবদ্ধতাটাকে মেনে নিয়ে আপাতত এখানেই এর কয়েকটি অংশ তুলে ধরা যাক।
বিবর্তনের পথ ধরে
১.↑ DiChristine M, 2006, Becoming Human, Scientific American Science Magazne:Special Edition, p.1.
২.↑ Calvin W. 2006, The Emergence of Intelligence, Scientific American:Special Edition, pp 85.
৩.↑ Gould, S, J: Understanding Evolution, PBS Website.
৪.↑ ইসলাম, শ, ২০০৫, বিজ্ঞানের দর্শন, প্রথম খন্ড,শিক্ষাবার্তা প্রকাশনা, ঢাকা, পৃষ্ঠাঃ ৭৯।
৫.↑ Skybreak, A. 2006, The Science of Evolution and The Myth Of Creationism, Insight Press, Illinois, USA
৬.↑ আখতারুজ্জামান, ম, ২০০৪, বিবর্তনবিদ্যা, হাসা বুক হাউজ, ঢাকা, পৃষ্ঠাঃ ২৭৭-৩৭৫ ।
৮.↑ Stringer, C and Andrews, P, 2005, The complete Wrold of Human Evolution, Thames and Hudson Ltd, London
৯.↑ Blow to Neanderthal breeding theory,2003, BBC Science News