‘স্বতঃজননবাদ’কে (Theory of spontaneous generation) হটিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব অহরহই লুই পাস্তুরকে দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু এটিও সত্য যে, স্বতঃজননের মাধ্যমে প্রাণ যে কখনই উৎপত্তি হতে পারবে না – এমন ধারণায় পাস্তুর নিজে কখনই নিঃসন্দেহ ছিলেন। না। পাস্তুর এ নিয়ে একবার এমন মন্তব্যও করেছেন, তার বিশ বছরের ক্লান্তিহীন গবেষণায়। কখনও মনে হয় নি যে, এভাবে প্রাণের উদ্ভব একেবারেই অসম্ভব।
আসলে পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত পরীক্ষার সাহায্যে যেটা দেখিয়েছিলেন তা হল, জীবাণুমুক্ত নিয়ন্ত্রিত (পাস্তুর প্রদত্ত) পরিবেশে প্রাণ আপনা আপনি জন্ম নেয় না; কিন্তু অন্য পরিবেশে অন্য ভাবে যে কখনই জন্ম নিতে পারবে না – এই কথা কিন্তু পাস্তুরের ফলাফল হলফ করে বলছে না। ব্যাপারটা একটু পরিস্কার করা প্রয়ােজন।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে স্বতঃজনন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্টই মতভেদ ছিল। ব্যাপারটির একটা সুরাহা করবার জন্য ফরাসী বিজ্ঞানী পুশে (F. A. Pouchet) একটি পরীক্ষার বন্দোবস্ত করলেন। তিনি খড়ের নির্যাস নিয়ে মুক্ত এবং বিশুদ্ধ বাতাসে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রমাণ পেলেন যে, অণুজীব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই খড়ের নির্যাসে জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু ১৮৬০ সালে লুই পাস্তুর (Louis Pasteur, ১৮২২-১৮৯৫) পুশের এই ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করলেন। তিনি ইস্ট এবং চিনির মিশ্রণ একটা পাত্রে ভরে মুক্ত-বাতাসে রেখে দেন।
কিছুক্ষণ পরেই দেখলেন পাত্রের মিশ্রণটি ব্যাকটেরিয়া এবং প্রটোজোয়ায় ভরে গেছে। কিন্তু বাতাসের প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে একই পরীক্ষা পুনরায় করে দেখলেন – এবারে কিন্তু কোন অণুজীব জন্মাচ্ছে না। পাস্তুর ঘােষনা করলেন যে, বাতাসে যদি কোন স্পাের না থাকে, অর্থাৎ বাতাস যদি বিশুদ্ধ থাকে তবে কোন স্বতঃ জনন হয় না।
পুশে এবং পাস্তুর দুজনই ছিলেন সে সময়কার নামকরা বিজ্ঞানী। কিন্তু একজন স্বতঃজননের সমর্থক, আরেকজন বিরােধী। তাঁদের মতভেদ থেকে আসল সত্যটা বের করবার জন্য ফরাসী বিজ্ঞান আকাদেমী একটি কমিশন গঠন করে দু’বিজ্ঞানীকেই নিজেদের মতবাদের পক্ষে যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য আমন্ত্রণ জানালেন।
দুই বিজ্ঞানীই একমত হলেন যে, উঁচু পর্বতের চূড়ায় বাতাস থাকে তুলনামূলকভাবে বিশুদ্ধ এবং জীবাণুমুক্ত। কাজেই সেখানে গিয়ে ওই জীবাণুমুক্ত পরিবশে পরীক্ষা করলে স্বতঃজননের ব্যাপারে আসল সত্য জানা যাবে। তাই করলেন পাস্তুর; ২০টি ফ্লাস্কে খড়ের নির্যাস ভরে সেগুলাে সীল করে গাধার পিঠে চাপিয়ে রওয়ানা দিলেন আল্পস পর্বতের মাউন্ট ব্ল্যাঙ্কের চূড়ায়। সেখানে গিয়ে তিনি সীলগালা ভেঙ্গে বাতাস ঢুকতে দিয়ে একটু পরেই আবার সীল করে দিলেন। পরে এগুলােকে নিয়ে নিজের গবেষণাগারে ফিরে আসেন। কিছুদিন পরে দেখা গেল একটি ছাড়া অন্য কোন ফ্লাস্কে জীবাণু নেই। এ থেকে পাস্তর সিদ্ধান্ত নিলেন যে, ফ্লাস্কে প্রাণের কোন স্বতঃজনন হয় নি।
১৮৬৪ সালের ২২ শে জুন পুশে এবং পাস্তুর উভয়কেই কমিশনের সামনে হাজির হওয়ার আমন্ত্রণ জানানাে হল। পাস্তুর আসলেও পুশে কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসলেন না। পাস্তুর তার পরীক্ষায় পাওয়া ১৯টি ফ্লাস্ক কমিশনের সদস্যদের দেখালেন। কোন জীবাণু দেখা গেল না। তখন কমিশনের থেকে সন্দেহ করা হল যে, ফ্লাস্কের ভিতেরে হয়ত অণুজীব জন্মানাের মত পর্যাপ্ত বাতাস নেই, সে জন্যই জীবাণু জন্মাচ্ছে না। পাস্তুর তখন বাধ্য হয়ে একটি ফ্লাস্কের নল ভেঙ্গে বাতাস বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে তাতে বাতাস বা অক্সিজেনের পরিমান স্বাভাবিক মাত্রায়ই আছে।
তখন আবার প্রশ্ন তােলা হল, পাস্তুর যে ঈস্টের মিশ্রণ ব্যবহার করছেন তাতে হয়ত অণুজীব বাঁচতে পারে না। এই সন্দেহের জবাব দিতে গিয়ে পাস্তুর আরেকটি ফ্লাস্কের নল ভেঙ্গে তাতে বাতাস ঢুকালেন, তারপর তিনদিন খােলা জায়গায় রেখে দিয়ে দেখালেন যে মিশ্রণটি অণুজীবে ভর্তি হয়ে গেছে। অন্য ফ্লাস্ক গুলােকে অক্ষত রেখে দেওয়া হল। বেশ কয়েক বছর পরও তাতে কোন অণুজীব পাওয়া গেল না। পাস্তুরের সীল করা ফ্লাস্ক ১৪০ বছর পরেও তেমনি অবস্থায় আছে, কোন জীবাণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি তার অনেক আগেই অবশ্য প্রমাণিত হয়ে গেছে অণুজীবের স্বতঃজনন হয় না।
ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব :
স্বতঃ জনন ভুল প্রমাণিত হওয়ায় একটা জিনিস বােঝা গেল যে, আপনা-আপনি প্রাণের উৎপত্তি হয় না। কিন্তু এটিকে ‘বেদ-বাক্য’ হিসেবে বিশ্বাস করলে হবে না, কারণ এটি কোন স্বতঃসিদ্ধ নয়। আসলে সঠিক বাক্যটি হবে, ‘পৃথিবীর আজকের দিনের যে পরিবেশ সেই পরিবেশে জড় পদার্থ থেকে প্রাণ আপনা-আপনি তৈরী হতে পারে না’। এবারে ঠিক আছে। কারণ, আজকের দিনের পৃথিবীর ছবি প্রাচীন পৃথিবীর ছবিটা থেকে একেবারেই আলাদা।
বিজ্ঞানীরা আজ মনে করেন, ওই আদিম পৃথিবীর বিজারকীয় পরিবেশেই জড় উপাদান থেকে ধীরে ধীরে সময় সাপেক্ষ বিভিন্ন ধাপ পেরিয়ে জীবনের উৎপত্তি ঘটেছে কোন অজ্ঞেয় কারণে নয়, বরং জানা কিছু রায়ায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই তত্ত্বটিকে বলা হয় জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি তন্তু (Chemical theory of Origin of Life)। এই তত্ত্বটির কথা আগের অধ্যায়ে খানিকটা বলেছি। তবে পুরাে তত্ত্বটি নিয়ে একটু পরেই বিস্তারিত ভাবে আলােচনা করা হবে।
চার্লস ডারউইন এ মতবাদটি মানতেন ✪ , কিন্তু হয়ত গোঁড়া ধর্মবাদীদের ভয়ে মুখ খুলতেন না তেমন। কিন্তু ‘ডারউইনের বুলডগ’ বলে পরিচিত বিখ্যাত বিজ্ঞানী টিএইচ হাক্সলি আর বিখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থ বিজ্ঞানী জন টিন্ডল প্রকাশ্যে সাধারণ জনগণের কাছে জীবনের রাসায়নিক তত্ত্ব প্রচার করে ধীরে ধীরে এটিকে জনপ্রিয় করে তুলেন। তবে জীবনের উৎপত্তির আধুনিক রাসায়নিক তত্ত্বের জন্মদাতা কিন্তু এরা কেউ নন। জন্মদাতা হিসেবে কাউকে গ্রহন করতে হলে করতে হবে রুশ প্রাণরসায়নবিদ ওপারিন (Alexandar I. Oparin)’কে।
তিনি ১৯২২ সালে ‘জীবনের উৎপত্তি’ নামে রুশ ভাষায় একটি বই লেখেন। এই বইটিতেই তিনি প্রথম বারের মত এ পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি কিভাবে হয়েছিল তার একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন। বিবর্তনের দুটি পর্বের কথা তিনি বললেন বইয়ে – রাসায়নিক বিবর্তন (Chemical evolution), আর জৈব বিবর্তন (Organic Evolution)। প্রথম পর্বে রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে জড় বস্তু থেকে জীবনের উৎপত্তি হয়, পরবর্তী পর্বে ডারউইনের দেখানাে পথে জীব থেকে জীবের বিবর্তন ঘটে। ওপারিনের মতে এ দুটি পর্ব আসলে অবিচ্ছিন্ন ঘটনা। দুটি পর্ব মিলেই হয় সম্পূর্ণ বিবর্তন (Complete Evolution)।
ওপারিনের বইটির বেশ ক’টি রুশ সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তারমধ্যে ১৯২৭ সালের বর্ধিত সংস্করণটি ‘The Origin of Life‘ নামে ইংরেজী ভাষায় অনূদিত হয় – ১৯৩৮ সালে। কিন্তু এর মধ্যেই হালডেন (J.B.S Haldane) নামে আরেক বিজ্ঞানী ওপারিনের কাজের কথা কিছু না জেনেই প্রায় একই রকম বক্তব্য সহ আরেকটি বই লিখেছিলেন। দুই বিজ্ঞানীকেই সমান স্বীকৃতি দিতে জীবনের উৎপত্তির রাসায়নিক তত্ত্বটিকে এখন ‘ওপারিন-হালডেন তত্ত্ব’ নামেই অভিহিত করা হয়।

ওপারিন আর হালডেন দু’জনেই তাদের লেখায় বললেন, সাড়ে চারশ কোটি বছর আগেকার পৃথিবী কিন্তু কোন দিক দিয়েই আজকের পৃথিবীর মত ছিল না। এ সময় পৃথিবী ছিল প্রচন্ড গরম, অনেকের মতে তাপমাত্রা ছিল প্রায় ৫০০০-৬০০০ ডিগ্রীর মত। পানি পড়া মাত্রই তা বাষ্প হয়ে উড়ে চলে যেত।
তখন সেখানে ছিল না কোন প্রাণ, ছিল না কোন মুক্ত অক্সিজেন। আকাশ আর পৃথিবী পরিপূর্ণ ছিল হাইড্রোজেন(H), হিলিয়াম (He), নাইট্রোজেন (N), মিথেন (CH4), অ্যামােনিয়ার (NH) মত বিষাক্ত গ্যাসে। সাথে ছিল জলীয় বাষ্প আর কিছু খনিজ পদার্থ। পরে পৃথিবীর অভ্যন্তরস্থ তাপ বৃদ্ধির সাথে সাথে আর সূর্যের মহাকর্ষের টানে অধিকাংশ প্রাথমিক গ্যাসগুলাে উড়ে চলে যায়। অক্সিজেনের পুরােটুকু বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন ধরনের পরমাণুর সাথে মিলে নানা ধরনের অক্সাইড তৈরী করে।
কার্বনও বিভিন্ন ধাতুর সাথে যুক্ত হয়ে তৈরী করে নানা ধরনের মেটাল কার্বাইড। তৈরী হয় ধীরে ধীরে কার্বন-ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন, সিলিকন-ডাই-অক্সাইড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড আর সামান্য পরিমাণে হাইড্রোজেন, মিথেন, কার্বন মনােক্সাইড, অ্যামােনিয়া, হাইড্রোক্লোরিক এসিড ইত্যাদি।
বায়ুমন্ডলে তাে কোন মুক্ত-অক্সিজেন ছিল না, আর সেই সাথে বায়ুমন্ডলের বাইরে আজকের দিনের মত ওজোনের স্তরও ছিল না। তাই সূর্যের আলাের অতি বেগুনী রশ্মি খুব সহজেই পৃথিবীতে এসে পৌঁছুত। আর এক্স রশ্মি, গামা রশ্মি, কসমিক রশ্মি গুলাের বিকিরণ, আর সেই সাথে বৈদ্যুতিক বিকিরণও ছিল আজকের দিনের চেয়ে বহুগুন বেশী।
ওপারিন আর হালডেনের মতে এমন একটি প্রাণহীন পরিবেশে একটা সময় এসব গ্যাসের উপর উচ্চশক্তির বিকিরণের প্রভাবে নানা ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থের উদ্ভব হয়। এগুলাে পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে আরাে জটিল জৈব পদার্থ উৎপন্ন করে। এগুলাে থেকেই পরবর্তীতে ঝিল্লি তৈরী হয়। ঝিল্লিবদ্ধ এসব জৈব পদার্থ বা প্রােটিনয়েড ক্রমে ক্রমে এনজাইম ধারণ করতে থাকে আর বিপাক ক্রিয়ার ক্ষমতা অর্জন করে।
এটি একসময় এর মধ্যকার বংশগতির সংকেত দিয়ে নিজের প্রতিকৃতি তৈরী করতে ও পরিব্যক্তি (Mutation) ঘটাতে সক্ষম হয়। এভাবেই একটা সময় তৈরী হয় প্রথম আদি ও সরল জীবনের। তবে এ স্তরে জীবন ছিল অকোষীয়; পরে তা থেকে কোষীয় জীবের উদ্ভব হয়। এ তত্ত্বটির মূল নির্যাসটি হল এটি অজৈবজনি (Abiogenesis) – অর্থাৎ, অজৈব জড় থেকে জীবের উৎপত্তির নিদর্শক।
একই ধরনের অজৈবজনি সংক্রান্ত ধারণা সমন্বিত করে পরবর্তীতে বই লেখেন জে ডি বার্নাল ‘The physical basis of life’ (১৯৫১) এবং দু’বার নােবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী হ্যারল্ড ইউরে ‘Planets, their origin and Development’ (১৯৫২) শিরােনামে। তাঁদের এবং পরবর্তীতে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের ক্রমিক অবদানের পরিপ্রেক্ষিতেই জীবনের অজৈবজনি বা রাসায়নিক উৎপত্তির তত্ত্বটি ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়।