রাজেনবাবুকে রোজ বিকেলে ম্যাল্-এ আসতে দেখি। মাথার চুল সব পাকা, গায়ের রং ফরসা, মুখের ভাব হাসিখুশি। পুরনো নেপালি আর তিব্বতি জিনিস-টিনিসের যে দোকানটা আছে সেটায় কিছুক্ষণ কাটিয়ে বাইরে এসে বেঞ্চিতে আধঘণ্টার মতো বসে সন্ধে হব-হব হলে জলাপাহাড়ে বাড়ি ফিরে যান। আমি আবার একদিন ওঁর পেছন পেছন গিয়ে ওঁর বাড়িটাও দেখে এসেছি। গেটের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি, হঠাৎ আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে হে তুমি, পেছু নিয়েছ?’
আমি বললাম, ‘আমার নাম তপেশরঞ্জন বোস।’
‘তবে এই নাও লজেঞ্চুস’ বলে পকেট থেকে সত্যিই একটা লেমন-ড্রপ বার করে আমায় দিলেন, আর দিয়ে বললেন, ‘একদিন সকাল সকাল এসো আমার বাড়িতে— অনেক মুখোশ আছে; দেখাবো।’
সেই রাজেনবাবুর যে এমন বিপদ ঘটতে পারে, তা কেউ বিশ্বাস করবে?
ফেলুদাকে কথাটা বলতেই সে খ্যাক করে উঠল।
‘পাকামো করিসনে। কার কিভাবে বিপদ ঘটবে না-ঘটবে সেটা কি মানুষকে দেখলে বোঝা যায়?’
আমি দস্তুরমতো রেগে গেলাম।
‘বা রে, রাজেনবাবু যে ভাল লোক, সেটা বুঝি দেখলে বোঝা যায় না? তুমি তো তাকে দেখোইনি। দার্জিলিং-এ এসে অবধি তো তুমি বাড়ি থেকে বেরোওইনি। রাজেনবাবু নেপালি বস্তিতে গিয়ে গরিবদের কত সেবা করেছেন জান?’
‘আচ্ছা বেশ বেশ, এখন বিপদটা কী তাই শুনি। আর তুই কচি খোকা, সে বিপদের কথা তুই জানলি কী করে?’
কচি খোকা অবিশ্যি আমি মোটেই না, কারন আমার বয়স সাড়ে তের বছর। ফেলুদার বয়স আমার ঠিক ডাবল। সত্যি বলতে কি— ব্যাপারটা আমার জানার কথা নয়। ম্যাল-এ বেঞ্চিতে বসেছিলাম— আজ রবিবার, ব্যান্ড বাজাবে, তাই শুনব বলে। আমার পাশে বসেছিলেন তিনকড়িবাবু, যিনি রাজেনবাবুর ঘর ভাড়া নিয়ে দার্জিলিং-এ গরমের ছুটি কাটাতে এসেছেন। তিনকড়িবাবু ‘আনন্দবাজার’ পড়ছিলেন, আর আমি কোনওরকমে উঁকিঝুঁকি মেরে ফুটবলের খবরটা দেখার চেষ্টা করছিলাম। এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্যাকাসে মুখ করে রাজেনবাবু এসে ধপ করে তিনকড়িবাবুর পাশে বসে গায়ের চাদরটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগলেন।
তিনকড়িবাবু কাগজ বন্ধ করে বললেন, ‘কী হল, চড়াই উঠে এলেন নাকি?’
রাজেনবাবু গলা নামিয়ে বললেন, ‘আরে না মশাই। এক ইনক্রেডিবল ব্যাপার!’
ইনক্রেডিবল কথাটা আমার জানা ছিল। ফেলুদা ওটা প্রায়ই ব্যবহার করে। ওর মানে ‘অবিশ্বাস্য’।
তিনকড়িবাবু বললেন, ‘কী ব্যাপার?’
‘এই দেখুন না।’
রাজেনবাবু পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা নীল কাগজ বার করে তিনকড়িবাবুর হাতে দিলেন। বুঝতে পারলাম সেটা একটা চিঠি।
আমি অবিশ্যি চিঠিটা পড়িনি, বা পড়ার চেষ্টাও করিনি; বরঞ্চ আমি উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে গুনগুন করে গান গেয়ে এমন ভাব দেখাচ্ছিলাম যেন বুড়োদের ব্যাপারে আমার কোন ইন্টারেস্টই নেই। কিন্তু চিঠিটা না পড়লেও, তিনকড়িবাবুর কথা আমি শুনতে পেয়েছিলাম।
‘সত্যিই ইনক্রেডিবল। আপনার উপর কার এমন আক্রোশ থাকতে পারে যে আপনাকে এভাবে শাঁসিয়ে চিঠি লিখবে?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘তাই তো ভাবছি। সত্যি বলতে কি, কোনদিন কারও অনিষ্ট করেছি বলে তো মনে পড়ে না।’
তিনকড়িবাবু এবার রাজেনবাবুর দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললেন, ‘হাটের মাঝখানে এ সব ডিসকাস না করাই ভাল। বাড়ি চলুন।’
দুই বুড়ো উঠে পড়লেন।
ফেলুদা ঘটনাটা শুনে কিছুক্ষন ভুরু কুঁচকে গুম হয়ে বসে রইল। তারপর বলল, ‘তুই তাহলে বলছিস যে একবার তলিয়ে দেখা চলতে পারে?’
‘বা রে–তুমিই তো রহস্যজনক ঘটনা খুঁজছিলে। বললে, অনেক ডিটেকটিভ বই পড়ে তোমারও ডিটেকটিভ বুদ্ধিটা খুব ধারালো হয়ে উঠেছে।’
‘তা তো বটেই। এই ধর–আমি তো আজ ম্যালে যাইনি, তবু বলে দিতে পারি তুই কোন্ দিকের বেঞ্চে বসেছিলি।’
‘কোন দিক?’
‘রাধা রেস্টুরান্টের ডান পাশের বেঞ্চগুলোর একটাতে।’
‘আরেব্বাস! কী করে বুঝলে?’
‘আজ বিকেলে রোদ ছিল। তোর বাঁ গালটা রোদে ঝলসেছে, ডান ধারেরটা ঝলসায়নি। একমাত্র ওই বেঞ্চিগুলোর একটাতে বসলেই পশ্চিমের রোদটা বাঁ গালে পড়ে।’
‘ইনক্রেডিবল।’
‘যাক গে। এখন কথা হচ্ছে–রাজেন মজুমদারের বাড়িতে একবার যাওয়া দরকার।’
‘আর সাতাত্তর পা।’
‘আর যদি না হয়?’
‘হবেই ফেলুদা। আমি সেবার গুনেছিলাম।’
‘না হলে গাঁট্টা তো?’
‘হ্যাঁ— কিন্তু বেশি জোরে না । জোরে মারলে মাথার ঘিলু এদিক-ওদিক হয়ে যায়।’
কী আশ্চর্য— সাতাত্তরে রাজেনবাবুর বাড়ি পৌঁছলাম না। আরও তেইশ পা গিয়ে তবে ওর বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে পড়লাম।
ফেলুদা ছোট্ট করে একটা গাঁট্টা মেরে বলল, ‘আগের বার ফেরার সময় গুনেছিলি, না আসার সময়?’
‘ফেরার সময়।’
‘ইডিয়ট! ফেরার সময় তো ঢালে নামতে হয়। তুই নিশ্চয়ই ধাঁই ধাঁই করে ইয়া বড় বড় স্টেপস ফেলেছিলি!’
‘তা হবে।’
‘নিশ্চয়ই তাই। আর তাই স্টেপস সেবার কম হয়েছিল, এবার বেশি হয়েছে। জোয়ান বয়সে ঢালে নামতে মানুষ বড় বড় পা ফেলে দৌড়ানোর মতো। আর বুড়ো হলে ঢালুর বেলা ব্রেক ক’ষে ক’ষে ছোট ছোট পা ফেলতে হয়-তা না হলে মুখ থুবড়ে পড়ে।’
কাছাকাছি কোনও বাড়ি থেকে রেডিওতে গান শোনা যাচ্ছে। ফেলুদা এগিয়ে কলিংবেল টিপল।
‘কী বলবে সেটা ঠিক করেছ ফেলুদা?’
‘যা খুশি তাই বলব। তুই কিন্তু স্পিকটি-নট। যতক্ষণ থাকবি এ বাড়িতে একটি কথাও বলবিনে।’
‘কিছু জিজ্ঞেস করলেও না!’
‘শাটাপ!’
একটা নেপালি চাকর এসে দরজা খুলে দিল।
‘অন্দর আইয়ে।’
বৈঠকখানায় ঢুকলাম। বেশ সুন্দর পুরনো প্যাটার্নের কাঠের বাড়ি। শুনেছি রাজেনবাবু দশ বছর হল রিটায়ার করে দার্জিলিং-এ আছেন। কলকাতায় বেশ নামকরা উকিল ছিলেন। চেয়ার টেবিল যা আছে ঘরে, সব বেতের। যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে, চারিদিকে দেওয়ালে টাঙানো সব অদ্ভুত দাত-খিঁচানো চোখ-রাঙানো মুখোশের সারি। আর আছে পুরনো ঢাল, তলোয়ার, ভোজালি, থালা, ফুলদানি এইসব। কাপড়ের উপর রং করা বুদ্ধের ছবিও আছে–কত পুরনো কে জানে? কিন্তু তাতে যে সোনালি রংটা আছে সেটা এখনো ঝলমল করছে। আমরা দু’জনে দুটো বেতের চেয়ারে বসলাম।
ফেলুদা দেওয়ালের এদিক-ওদিক দেখে বলল, ‘পেরেকগুলো সব নতুন, মরচে ধরেনি। ভদ্রলোকের প্রাচীন জিনিসের শখটা বোধহয় বেশি প্রাচীন নয়।’
রাজেনবাবু ঘরে ঢুকলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ফেলুদা উঠে গিয়ে ঢিপ করে এক পেন্নাম ঠুঁকে বলল, ‘চিনতে পারছেন? আমি জয়কৃষ্ণ মিত্তিরের ছেলে ফেলু।’
রাজেনবাবু প্রথমে চোখ কপালে তুললেন, তারপর চোখের দু’পাশ কুঁচকিয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘বা-বা! কত বড় হয়েছ তুমি, অ্যাঁ?
কবে এলে এখানে? বাড়ির সব ভাল? বাবা এসেছেন?’
ফেলুদা জবাব দিচ্ছে, আর আমি মনে মনে বলছি— কী অন্যায়, এত কথা হল, আর ফেলুদা একবারও বলল না সে রাজেনবাবুকে চেনে?
এবার ফেলুদা আমার পরিচয়টাও দিয়ে দিল। রাজেনবাবুর মুখ দেখে মনেই হল না যে, এই সাত দিন আগে আমাকে লজেঞ্চুস দেবার কথাটা ওঁর মনে আছে।
ফেলুদা এবার বলল, ‘আপনার খুব প্রাচীন জিনিসের শখ দেখছি।’
রাজেনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। এখন তো প্রায় নেশায় দাঁড়িয়েছে।’
‘কদ্দিনের ব্যাপার?’
‘এই তো মাস ছয়েক হবে। কিন্তু এর মধ্যেই অনেক কিছু সংগ্রহ করে ফেলেছি।’
ফেলুদা এবার একটা গলা-খাঁকরানি দিয়ে, আমার কাছ থেকে শোনা ঘটনাটাই শুনিয়ে বলল, ‘আপনি আমার বাবার মামলার ব্যাপারে যেভাবে সাহায্য করেছিলেন, তার প্রতিদানে আপনার এই বিপদে যদি কিছু করতে পারি…’
রাজেনবাবুর ভাব দেখে মনে হল তিনি সাহায্য পেলে খুশিই হবেন, কিন্তু তিনি কিছু বলবার আগেই তিনকড়িবাবু ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাঁপানোর বহর দেখে মনে হল বোধহয় বেড়িয়ে ফিরলেন। রাজেনবাবু আমাদের সঙ্গে ভদ্রলোকের আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার বিশেষ বন্ধু অ্যাডভোকেট জ্ঞ্যানেশ সেন হচ্ছে তিনকড়িবাবুর প্রতিবেশী। আমি ঘর ভাড়া দেব শুনে জ্ঞ্যানেশই ওকে সাজেস্ট করে আমার এখানে আসতে। গোড়ায় উনি হোটেলের কথা ভেবেছিলেন।’
তিনকড়িবাবু হেসে বললেন, ‘আমার ভয় ছিল আমার এই চুরুটের বাতিকটা নিয়ে। এমনও হতে পারতো যে রাজেনবাবু হয়তো চুরুটের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। তাই সেটা আমি আমার প্রথম চিঠিতেই লিখে জানিয়ে দিয়েছিলাম।’
ফেলুদা বলল, ‘আপনি কি বায়ু পরিবর্তনের জন্যে এসেছেন?’
‘তা বটে। তবে বায়ুর অভাবটাই যেন লক্ষ্য করছি বেশি। পাহাড়ে ঠাণ্ডাটা আরেকটু বেশি এক্সপেক্ট করে লোকে।’
ফেলুদা হঠাৎ বলল, ‘আপনার বোধহয় গান-বাজনার শখ?’
তিনকড়িবাবু অবাক হাসি হেসে বললেন, ‘সেটা জানলে কী করে হে?’
‘আপনি যখন কথা বলছেন তখন লক্ষ্য করছি যে, লাঠির ওপর রাখা আপনার ডান হাতের তর্জনীটা রেডিওর সঙ্গে তাল রেখে যাচ্ছে।’
রাজেনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘মোক্ষম ধরেছ। উনি ভালো শ্যামা সঙ্গীত গাইতে পারেন।’
ফেলুদা এবার বলল, ‘চিঠিটা হাতের কাছে আছে?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘হাতের কাছে কেন, একেবারে বুকের কাছে।’
রাজেনবাবু কোটের বুক পকেট থেকে চিঠিটা বার করে ফেলুদাকে দিলেন। এইবার সেটা দেখার সুযোগ পেলাম। হাতে-লেখা চিঠি নয়। নানান জায়গা থেকে ছাপা বাংলা কথা কেটে কেটে আঠা দিয়ে জুড়ে চিঠিটা লেখা হয়েছে। যা লেখা হয়েছে, তা হল এই—‘তোমার অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করিতে প্রস্তুত হও।’
ফেলুদা বলল, ‘এ চিঠি কি ডাকে এসেছে?’
রাজেনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। লোক্যাল ডাক–বলা বাহুল্য। দুঃখের বিষয় খামটা ফেলে দিয়েছি। দার্জিলিং-এরই পোস্টমার্ক ছিল। ঠিকানাটাও ছাপা বাংলা কথা কেটে কেটে লেখা।’
‘আপনার নিজের কাউকে সন্দেহ হয়?’
‘কী আর বলব বলো! কোনওদিন কারও প্রতি কোনও অন্যায় বা অবিচার করেছি বলে তো মনে পড়ে না।’
‘আপনার বাড়িতে যাতায়াত করেন এমন কয়েকজনের নাম বলতে পারেন?’
‘খুব সহজ। আমি লোকজনের সঙ্গে মিশি কমই। ডাক্তার ফণী মিত্তির আসেন অসুখ-বিসুখ হলে…’
‘কেমন লোক বলে মনে হয়?’
‘ডাক্তার হিসেবে বোধহয় সাধারন স্তরের। তবে তাতে আমার এসে যায় না, কারণ আমার ব্যারামও সাধারন— সর্দি-জ্বর ছাড়া আর কিছুই হয়নি দার্জিলিং এসে অবধি। তাই ভালো ডাক্তারের প্রয়োজন হয় না!’
‘চিকিৎসা করে পয়সা নেন?’
‘তা নেন বইকি। আর আমারও তো পয়সার অভাব নেই। মিথ্যে অবলিগেশনে যাই কেন?’
‘আর কে আসেন?’
‘সম্প্রতি মিস্টার ঘোষাল বলে এক ভদ্রলোক যাতায়াত… এই দ্যাখো!’
দরজার দিকে ফিরে দেখি একটি ফরসা, মাঝারি হাইটের, স্যুট-পরা ভদ্রলোক হাসিমুখে ঘরে ঢুকছেন।
‘আমার নাম শুনলাম বলে মনে হল যেন!’
রাজেনবাবু বললেন, ‘এইমাত্র আপনার নাম করা হয়েছে। আপনারও যে আমার মতো পুরনো জিনিসের শখ–সেটাই এই ছেলেটিকে বলতে যাচ্ছিলুম। আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই—’
নমস্কার-টমস্কারের পর মিস্টার ঘোষাল–পুরো নাম অবনীমোহন ঘোষাল–রাজেনবাবুকে বললেন, ‘আপনাকে আজ দোকানে দেখলুম না, তাই একবার ভাবলুম খোজ নিয়ে যাই।’
রাজেনবাবু বললেন, ‘নাঃ,–আজ শরীরটা ভালো ছিল না।’
বুঝলাম রাজেনবাবু চিঠিটার কথা মিস্টার ঘোষালকে বলতে চান না। ফেলুদা মিস্টার ঘোষাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই চিঠিটা হাতের তেলোর মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছে।
ঘোষাল বললেন, ‘আপনি ব্যস্ত থাকলে আজ বরং…আসলে আপনার ওই তিব্বতি ঘন্টাটা একবার দেখার ইচ্ছে ছিল।’
রাজেনবাবু বললেন, ‘সে তো খুব সহজ ব্যাপার। হাতের কাছেই আছে।’
রাজেনবাবু ঘন্টা আনতে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
ফেলুদা ঘোষালকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি এখানেই থাকেন?’
ভদ্রলোক দেওয়াল থেকে একটা ভোজালি নামিয়ে সেটা দেখতে দেখতে বললেন, ‘আমি কোনও এক জায়গায় বেশিদিন থাকি না। আমার ব্যবসার জন্যে প্রচুর ঘুরতে হয়। আমি কিউরিও সংগ্রহ করি।’
বাড়ি ফেরার পথে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, ‘কিউরিও’ মানে দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন জিনিস। রাজেনবাবু ঘন্টাটা নিয়ে আসলেন। দারুণ দেখতে জিনিসটা। নিচের অংশটা রুপোর তৈরি, হাতলটা তামা আর পেতল মেশানো, আর তার ওপরে লাল নীল পাথর বসানো। অবনীবাবু চোখ-টোখ কুঁচকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঘন্টাটা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন।
রাজেনবাবু বললেন, ‘কী মনে হয়?’
‘সত্যিই দাঁও মেরেছেন। একেবারে খাঁটি পুরনো জিনিস।’
‘আপনি বললে আমার আর কোনও সন্দেহই থাকে না। দোকানদার বলে, এটা নাকি একেবারে খোদ লামার প্রাসাদের জিনিস।’
‘কিছুই আশ্চর্য না। …আপনি বোধহয় এটা হাতছাড়া করতে রাজি নন? মানে, ভালো দাম পেলেও?’
রাজেনবাবু মিষ্টি করে হেসে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী জানেন? শখের জিনিস— ভালবেসে কিনেছি। সেটাকে বেচে লাভ করব, এমন কি কেনা দরেও বেচব— এই ইচ্ছে আমার নেই।’
অবনীবাবু ঘন্টাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আজ আসি। কাল আশা করি বেরোতে পারবেন একবার।’
রাজেনবাবু বললেন, ‘ইচ্ছে তো আছে।’
অবনীবাবু বেরিয়ে যাবার পর ফেলুদা রাজেনবাবুকে বলল, ‘ক’টা দিন একটু না বেরিয়ে-টেরিয়ে সাবধানে থাকা উচিত নয় কি?’
‘সেটাই বোধহয় ঠিক। কিন্তু মুশকিল কী জানো? সেই চিঠির ব্যাপারটা এতই অবিশ্বাস্য যে, এটাকে ঠিক যেন সিরিয়াসলি নিতেই পারছি না। মনে হচ্ছে এটা যেন একটা ঠাট্টা— যাকে বলে প্র্যাকটিক্যাল জোক।’
‘যদ্দিন না সেটা সম্পর্কে ডেফিনিট হওয়া যাচ্ছে, তদ্দিন বাড়িতেই থাকুন না! আপনার নেপালি চাকরটা কদ্দিনের?’
‘একেবারে গোড়া থেকেই আছে। কমপ্লিটলি রিলায়েবল।’
ফেলুদা এবার তিনকড়িবাবুর দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি কি বেশিরভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন?’
‘সকাল-বিকেল ঘন্টাখানেক একটু এদিক-ওদিক ঘুরে আসি আর কি। কিন্তু বিপদ যদি ঘটেই, আমি বুড়ো মানুষ খুব বেশি কিছু করতে পারি কি? আমার বয়স হল চৌষট্টি। রাজেনবাবুর চেয়ে এক বছর কম।’
রাজেনবাবু বললেন, ‘উনি চেঞ্জে এসেছেন, ওকে আর বাড়িতে বন্দি করে রাখার ফন্দি করছো কেন তোমরা? আমি থাকব, আমার চাকর থাকবে, এই যথেষ্ট। তোমরা চাও তো দু’বেলা খোঁজ-খবর নিয়ে যেও এখন।’
‘বেশ তাই হবে।’
ফেলুদার দেখাদেখি আমিও উঠে পড়লাম। আমরা যেখানে বসেছিলাম তার উলটো দিকেই একটা ফায়ারপ্লেস। ফায়ারপ্লেসের উপরেই একটা তাক, আর সেই তাকের উপর তিনটি ফ্রেমে-বাঁধানো ছবি। ফেলুদা ছবিগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।
প্রথম ছবিটা দেখিয়ে রাজেনবাবু বললেন, ‘ইনি আমার স্ত্রী। বিয়ের চার বছর পরেই মারা গিয়েছিলেন।’
দ্বিতীয় ছবি, একজন আমার বয়সী ছেলের, গায়ে ভেলভেটের কোট। ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘এটি কে?’
রাজেনবাবু হো হো করে হেসে বললেন, ‘সময়ের প্রভাবে মানুষের চেহারার কী বিচিত্র পরিবর্তন ঘটতে পারে, সেইটে বোঝানোর জন্যে এই ছবি। উনি হচ্ছেন আমারই বাল্য সংস্করণ। বাঁকুড়া মিশনারি স্কুলে পড়তাম তখন। আমার বাবা ছিলেন বাঁকুড়ার ম্যাজিস্ট্রেট।’
সত্যি, ভারি ফুটফুটে চেহারা ছিল রাজেনবাবুর ছেলেবয়সে।
‘অবিশ্যি ছবি দেখে ভুলো না। দুরন্ত বলে ভারি বদনাম ছিল আমার। শুধু যে মাস্টারদের জ্বালিয়েছি তা নয়, ছাত্রদেরও। একবার স্পোর্টসের দিন হান্ড্রেড ইয়ার্ডস-এ আমাদের বেস্ট রানারকে কাত করে দিয়েছিলাম, ল্যাং মেরে।’
তৃতীয় ছবিটা ফেলুদার বয়সী একজন ছেলের। রাজেনবাবু বললেন, সেটা তাঁর একমাত্র ছেলে প্রবীরের।
‘উনি এখন কোথায়?’
রাজেনবাবু গলা খাঁকরিয়ে বললেন, ‘জানি না ঠিক। বহুকাল দেশ ছাড়া, প্রায় সিক্সটিন ইয়ার্স।’
‘আপনার সঙ্গে চিঠি লেখালেখি নেই ?’
‘নাঃ।’
ফেলুদা দরজার দিকে এগুতে এগুতে বলল, ‘ভারি ইন্টারেস্টিং কেস।’
আমি মনে মনে বললাম, ফেলুদা একেবারে বইয়ের ডিটেকটিভের মতো কথা বলছে। বাইরেটা ছম্ছমে অন্ধকার হয়ে এসেছে। জলাপাহাড়ের গায়ের বাড়িগুলোতে বাতি জ্বলে উঠেছে। পাহাড়ের নিচের দিকে চেয়ে দেখলাম, রঙ্গিত উপত্যকা থেকে কুয়াশা উপর দিকে উঠছে। রাজেনবাবু আর তিনকড়িবাবু আমাদের সঙ্গে গেট অবধি এলেন। রাজেনবাবু গলা নামিয়ে ফেলুদাকে বললেন, ‘তুমি ছেলেমানুষ, তাও তোমাকে বলছি–একটু যে নার্ভাস বোধ করছি না তা নয়। এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এ চিঠি যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।’
ফেলুদা বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, ‘আপনি কিছু ভাববেন না। আমি এর সমাধান করবই। আপনি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন গিয়ে।’
রাজেনবাবু ‘গুডনাইট এন্ড থ্যাংক ইউ’ বলে চলে গেলেন।
এবার তিনকড়িবাবু ফেলুদাকে বললেন, ‘তোমার–তোমাকে “তুমি” করেই বলছি–তোমার অবজারভেশনের ক্ষমতা দেখে আমি সত্যিই ইম্প্রেসড হইচি। ডিটেক্টিভ গল্প আমিও অনেক পড়েচি। এই চিঠিটার ব্যাপারে আমি হয়তো তোমাকে কিছুটা সাহায্যও করতে পারি।’
‘তাই নাকি?’
‘এই যে টুকরো টুকরো ছাপা কথা কেটে চিঠিটা লেখা হয়েছে, এর থেকে কী বুঝলে বলো তো?’
ফেলুদা কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল, ‘এক নম্বর— কথাগুলো কাটা হয়েছে খুব সম্ভব ব্লেড দিয়ে— কাঁচি দিয়ে নয়।’
‘ভেরি গুড।’
‘দুই নম্বর— কথাগুলো নানারকম বই থেকে নেয়া হয়েছে— কারণ হরফ ও কাগজে তফাত রয়েছে।’
‘ভেরি গুড। সেইসব বই সম্বন্ধে কোনও আইডিয়া করেছ?’
‘চিঠির দু’টো শব্দ “শাস্তি” আর “প্রস্তুত”— মনে হচ্ছে খবরের কাগজ থেকে কাটা।’
‘আনন্দবাজার।’
‘তাই বুঝি?’
‘ইয়েস। ওই টাইপটা আনন্দবাজারেই ব্যবহার হয়— অন্য বাংলা কাগজে নয়। আর অন্য কথাগুলোও কোনওটাই পুরনো বই থেকে নেয়া হয়নি, কারণ যে হরফে ওগুলো ছাপা, সেটা হয়েছে, মাত্র পনের-বিশ বছর। …আর যে আঠা দিয়ে আটকানো হয়েছে সেটা সম্বন্ধে কোন ধারনা করেছ?’
‘গন্ধটা গ্রিপেক্স আঠার মতো।’
‘চমৎকার ধরেছ।’
‘কিন্তু আপনিও তো ধরার ব্যাপারে কম যান না দেখছি।’
তিনকড়িবাবু হেসে বললেন, ‘কিন্তু তোমার বয়সে আমি ডিটেকটিভ কথাটার মানে জানতুম কিনা সন্দেহ!’
বাড়ি ফেরার পথে ফেলুদা বলল, ‘রাজেনবাবুর মিস্ট্রি সল্ভ করতে পারব কিনা জানি না— কিন্তু সেই সূত্রে তিনকড়িবাবুর সঙ্গে আলাপটা বেশ ফাউ পাওয়া গেল।’
আমি বললাম, তা হলে উনিই ব্যাপারটা তদন্ত করুন না। তুমি আর মিথ্যে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?’
‘আহা— বাঙলা হরফের ব্যাপারটা জানা আছে বলে কি সবই জানবেন নাকি?’
ফেলুদার কথাটা শুনে ভালোই লাগল। ওর মতো বুদ্ধি আশা করি তিনকড়িবাবুর নেই। মাঝে মাঝে ফোড়ন দিলে আপত্তি নেই, কিন্তু আসল কাজটা যেন ফেলুদাই করে।
‘কাকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে ফেলুদা?’
‘অপরা—’
কথাটার মাঝখানেই ফেলুদা থেমে গেল। তার দৃষ্টি দেখলাম একজন লোককে ফলো করে পিছন দিকে ঘুরছে।
‘লোকটাকে দেখলি?’
‘কই, না তো। মুখ দেখিনি তো।’
‘ল্যাম্পের আলোটা পড়ল, আর ঠিক মনে হল’— ফেলুদা আবার থেমে গেল।
‘কী মনে হল ফেলুদা?’
‘নাঃ, বোধহয় চোখের ভুল। চল’ পা চালিয়ে চল’, খিদে পেয়েছে।’