রাত্রে বিশেষ ট্রাফিক নেই, তাও এক ঘণ্টা হাতে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। খাওয়াটা বাড়িতেই সেরে নিলাম। এত তাড়াতাড়ি খাওয়া অভ্যোস নেই। আমাদের; লালমোহনবাবু বললেন, খিদে পেলে ওই মিষ্টির দাকানে ঢুকে পড়া যাবে। কচুরি আর আলুর তরকারি নিঘাত পাওয়া যাবে।
একটা সুবিধে এই যে লালমোহনবাবুর ড্রাইভার হরিপদবাবু ফেলুদার ভীষণ ভক্ত। তার উপর বোম্বাই মার্কা ফাইটিং-এর ছবি দেখার সুযোগ ছাড়েন না। কখনও। এ রকম না হলে রান্তবিরেতে বারাসতে ঠ্যাঙতে অনেক ড্রাইভারই গজগজ করত; ইনি যেন নতুন লাইফ পেলেন।
ভি আই পি রোডে পড়ে লালমোহনবাবু গান ধরেছিলেন–জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে, কিন্তু ফেলুদা তাঁর দিকে চাইতে অমাবস্যায় গানটা বেমানান হচ্ছে বুঝতে পেরে থেমে গেলেন।
আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই। তারার আলো বলে একটা জিনিস আছে, সেটা হয়তো আমাদের কিছুটা হেল্প করতে পারে। ফেলুদার ফরমাশ অনুযায়ী গাঢ় রঙের জামা পরেছি। লালমোহনবাবুর পুলোভারটা ছিল হলদে, তাই তার উপর ফেলুদার রেনকোটটা চাপিয়ে নিয়েছেন। ভদ্রলোক এখন গাড়িতে বক্স; যখন হাঁটবেন তখন একটা পকেট ভীষণ ঝুলে থাকবে, কারণ তাতে ভরা আছে একটা হামানদিস্তার লোহার ভাণ্ডা; ওয়েপন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভদ্রলোক ওটা চেয়ে নিয়েছেন শ্ৰীনাথের কাছে। ফেলুদার পকেটে অবশ্য রয়েছে তার কোল্ট রিভলভার।
আমাদের আন্দাজ ভুল হয়নি; দশটার কিছু আগে আমরা তেমাথায় পৌঁছে গেলাম। মিষ্টির দোকানের পাশেই একটা পানের দোকান—তার সামনে থেকে হৃষীকেশবাবু এগিয়ে এসে আমাদের গাড়িতে উঠে। হরিপদবাবুকে বললেন, ডাইনের রাস্তাটা নিন।
খানিক দূর যেতেই বাড়ি কমে এল। আলোও বেশি নেই; রাস্তায় যা আলো ছিল তাও ফুরিয়ে গেল বাঁয়ে মোড় নিতে। বুঝলাম এটা প্রায় পল্লীগ্রাম অঞ্চল।বারাসতেই ছিল প্রথম নীলকুঠি। বললেন হৃষীকেশবাবু। এ দিকটাতে এককালে অনেক সাহেব থাকত; দিনের আলোয় তাদের সব ভাঙা বাগানবাড়ি দেখতে পেতেন।
মিনিট কুড়ি চলার পর একটা জায়গায় এসে গাড়ি দাঁড় করাতে বললেন হৃষীকেশবাবু।
আসুন।
গাড়ি থেকে নামলাম চার জনে।গাড়িটা এখানেই ওয়েট করুক, বললেন হৃষীকেশবাবু, আমি আপনাদের জায়গাটা দেখিয়ে দিয়ে আসি, তারপরে এই গাড়িই আমাকে বাড়ি পৌঁছে আসব।
লালমোহনবাবু, হরিপদবাবুকে টাকা দিয়ে বললেন, তুমি এঁকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় কোনও দোকান-টোকান থেকে খাওয়াটা সেরে নিও। ফিরতে রাত হবে। আমাদের।
ঘাসের উপর দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটতে একটা জংলা জায়গা এসে পড়ল।
এখানেই ছিল মধুমুরলীর দিঘি, বললেন হৃষীকেশবাবু। আমাদের যেতে হবে ওখানটায়।
খুবই কম আলো, কিন্তু তাও বুঝতে পারছি যে গাছপালা ছাড়াও ও দিকে একটা দালানের ভগ্নস্তৃপ রয়েছে। শীতকাল বলে রক্ষে, না হলে এ জায়গাটা হত সাপ ব্যাঙের ডিপো!
এখন টর্চের আলোটা বোধহয় তেমন বিপজ্জনক কিছু নয়, বলল ফেলুদা।
মনে তো হয় না, বললেন হৃষীকেশীবাবু।
ছোট্ট পকেট টর্চের আলোতে ঝোপঝাড় খানাখন্দ বাঁচিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম নীলকুঠির ভগ্নস্তূপের পাশে।
ওই যে দেখুন। শ্যাওড়া গাছ, বললেন হৃষীকেশবাবু! ফেলুদা সে দিকে একবার টর্চ ফেলে সেটা নিবিয়ে পকেটে পুরল।
আমি তা হলে আসি।
আসুন।
তিন কোয়াটার আপনাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।
আমরা যে দিক দিয়ে এসেছিলাম। সে দিক দিয়েই চলে গেলেন হৃষীকেশবাবু; এক মিনিটের মধ্যেই তাঁর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল।
ওডোমাসটা লাগিয়ে নিন।
ফেলুদা পকেট থেকে টিউব বার করে লালমোহনবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।
যা বলেছেন মশাই। ম্যালেরিয়া শুনছি। আবার খুব বেড়েছে।
আমরা তিন জনেই ওডোমস লাগিয়ে নিয়ে একটা বড় রকম দম নিয়ে অপেক্ষার জন্য তৈরি হলাম। আমাদের কাউকেই দাঁড়াতে হবে না, কারণ ভগ্নস্তূপে নানান হাইটের ইটের পাঁজা রয়েছে, তাতে চেয়ার চৌকি মোড়া সব কিছুবই কাজ হয়? কথা বলতে হলে ফিসফিস্ ছাড়া গতি নেই, তাও প্রথম দিকটায়। পরের দিকে কমপ্লিট মীনী। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে, এখন চারিদিকে চাইলে বট, অশ্বথ, আমগাছ, বাঁশঝাড়—এসব বেশ তফাত করা যায়। ঝিঝির শব্দ ছাড়াও যে অন্য শব্দ আছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। ট্রেনের আওয়াজ, সাইকেল রিকশার চড়া হর্ন, রাস্তার কুকুরের ঘেউ ঘেউ, এমন কী দূরের কোনও বাড়ি থেকে ট্রানজিস্টারের গান পর্যন্ত। ফেলুদার ঘড়িতে রেডিয়াম ডায়াল, তাই অন্ধকারেও টাইম দেখতে পারে।
শীত যেন মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। শহরের চেয়ে নিঘাত পাঁচ-সাত ডিগ্রি কম। লালমোহনবাবু তাঁর টুপি আনেননি, রুমাল সাদা, তাই সেটা বাঁধলেও চলে না; নিরুপায় হয়ে দুহাতের তেলো দিয়ে টাক ঢেকেছেন। একবার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট শব্দ করাতে ফেলুদা বলল, কিছু বললেন? তাতে ভদ্রলোক ফিসফিস করে জবাব দিলেন, শ্যাওড়া গাছেই বোধহয় পেত্ত্বি না। শাঁকচুন্নি কী যেন থাকে।
শ্যাওড়া গাছের নামই শুনেছি, ফিসফিসিয়ে বলল ফেলুদা, চোখে এই প্রথম দেখলাম।
আকাশে তারাগুলো সরছে। একটু আগে একটা তারাকে দেখেছিলাম নারকেল গাছের মাথার উপরে, এখন দেখছি গাছটায় ঢাকা পড়ে গেছে। কোনও চেনা কনস্টেলেশন আছে। কি না দেখার জন্য মাথাটা উপর দিকে তুলেছি, এমন সময় একটা শব্দ কানে এল। পায়ের শব্দ।
এগারোটা বাজেনি এখনও। ফেলুদা দু মিনিট আগে ঘড়ি দেখে ফিসফিস করে বলেছে, পৌনে।
আমরা পাথরের মতো স্থির।
যে দিক দিয়ে এসেছি, সে দিক দিয়েই আসছে শব্দটা। ঘাসের উপর মাঝে মাঝে ইট-পাটকেল রয়েছে, তার জন্যই শব্দ। তাও কান না পাতালে, আর অন্য শব্দ না কমলে শোনা যায় না। এখন বিপ্নবিষ্ণুর ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
এবার লোকটাকে দেখা গেল। সে এগিয়ে এসেছে শ্যাওড়া গাছটাকে লক্ষ্য করে।
এবারে তার হাঁটার গতি কমল। আমরা মাটিতে ঘাপটি মেরে বসা, সামনে একটা ভাঙা পাঁচিল আমাদের শরীরের নীচের অংশটা ঢ়েকে রেখেছে। আমরা তার উপর দিয়ে দেখছি।
হৃষীকেশবাবু—
লোকটা চাপা গলায় ডাক দিয়েছে। হাঁটা থামিয়ে। তাঁর দৃষ্টি যে শ্যাওড়া গাছটার দিকে সেটা মাথাটা দেখে আন্দাজ করতে পারছি, যদিও মানুষ চেনার কোনও প্রশ্ন ওঠে না।
হৃষীকেশবাবু—
ফেলুদা ওঠার জন্য তৈরি। তার শরীর টান সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
লোকটা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে শুরু করল।
লালমোহনবাবুর ডান কনুইটা উচিয়ে উঠেছে। উনি পকেট হাতড়াচ্ছেন হামানদিস্তার ভাণ্ডাটার জন্য।
লোকটা এখন দশ হাতের মধ্যে।
হৃষীকেশ—
ফেলুদা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠতেই একটা রক্ত জল করা ব্যাপার ঘটে গেল।
আমাদের পিছন থেকে দুটো লোক এসে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।
ফেলুদার সঙ্গে থেকেই বোধহয় আমার নার্ভ ও শক্ত হয়ে গেছে। চট করে বিপদে মাথা গুলোয় না। আমি তৎক্ষণাৎ লাফিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সামনের দিকে! ফেলুদার ঘুঁষি খেয়ে একটা লোক আমারই দিকে ছিটকে এসেছিল। আমি তাকে লক্ষ্য করে আরেকটা ঘুঁষি
চালাতে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ঘাসের উপর।
কিন্তু এ কী, আরও লোক এসে পড়েছে। পিছন থেকে! তার মধ্যে একটা আমায় জাপটে ধরেছে, আরও দুটো গিয়ে আক্রমণ করেছে ফেলুদাকে। ধস্তাধস্তির শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু আমি নিজে বন্দি, যদিও তারই মধ্যে জুতো পরা ডান পা-টা দিয়ে ক্ৰমাগত পিছন দিকে লাথি চালাচ্ছি।
লালমোহনবাবু কী করছেন এই চিন্তাটা মাথায় আসতেই থুতনিতে একটা বিরাশি শিক্কা ঘা খেলাম, আর সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকের অন্ধকার যেন আরও দশ গুণ গাঢ় হয়ে গেল।
তারপর আর কিছু জানি না।
কীরে, ঠিক হ্যায়?
ফেলুদার চেহারাটাই প্রথম দেখতে পেলাম জ্ঞান হয়ে।
ঘাবড়াসনি, আমিও নক-আউট হয়ে গোসলাম দশ মিনিটের জন্য।
এবারে দেখলাম ঘরের অন্য লোকেদের। অমিতাভবাবু তাঁর পাশে একজন মহিলা-নিশ্চয়ই তাঁর স্ত্রী—লালমোহনবাবু, হৃষীকেশবাবু, আর দরজার মুখে দাঁড়িয়ে অচিন্ত্যবাবু। এ ঘরটা আগে দেখিনি; বাড়ির বত্ৰিশটা ঘরের কোনও একটা হবে।
আমি বিছানায় উঠে বসলাম। একটা কনকনে ব্যথা থুতনির কাছটায়। তা ছাড়া আর কোনও কষ্ট নেই। ফেলুদা ঘূষিটা খেয়েছিল ডান চোখের নীচে সেটা কালসিটে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ব্ল্যাক-আই ব্যাপারটা অনেক বিদেশি ছবিতে দেখেছি; স্বচক্ষে এই প্রথম দেখলাম।
একমাত্ৰ জটায়ুই অক্ষত, বলল ফেলুদা।
সে কী। আশ্চর্য ব্যাপার তো?–কী করে হল?
মোক্ষম ওয়েপন ওই হামানদিস্তা, বললেন লালমোহনবাবু, হাতে নিয়ে মাথার উপর তুলে হেলিকপটারের মতো বই বাই করে ঘুরিয়ে গেলাম। আমার ধারে কাছেও এগোয়নি। একটি গুণ্ডাও।
ওরা গুণ্ডা ছিল বুঝি? হায়ার্ড গুণ্ডাজ, বললেন লালমোহনবাবু।
বললাম লোকটা ডেঞ্জারাস, বললেন হৃষীকেশবাবু। তবে ও যে এতটা করবে তা ভাবিনি। আমি তো গিয়ে অবাক। একজন শোয়া একজন বসা একজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাটিতে। আর আসল যে লোক সে হাওয়া।
ফেলুদা আর লালমোহনবাবু নাকি আমাকে ধরাধরি করে গাড়িতে এনে তোলেন। অমিতাভবাবু নিজে বেশ রাত অবধি পড়েন, তাই উনি জেগে ছিলেন। যে ঘরটায় আমরা রয়েছি সেটা একতলার একটা গেস্ট রুম। বেশ বড় ঘর, পাশেই বাথরুম। পুবে জানালা দিয়ে নাকি বাগান দেখা যায়। অমিতাভবাবুই জোর করলেন আজ রাতটা এখানে থাকার জন্য। অসুবিধা এই যে বাড়তি কাপড় নেই, যা পরে আছি তাই পরেই শুতে হবে। হৃষীকেশবাবুর ভয়ের জন্যই এই গোলমালটা হল, বললেন অমিতাভবাবু, পুলিশকে বলা থাকলে সাধু সমেত গুণ্ডারা এতক্ষণে হাজতে।
হৃষীকেশবাবুও অবিশ্যি অ্যাপলজাইজ করলেন। কিন্তু ভদ্রলোককেই বা দোষ দেওয়া যায় কী করে? ও রকম শাসনির পর যে কোনও মানুষেরই ভয় হতে পারে।
অমিতাভবাবুর স্ত্রীই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বললেন, বাড়িতে এই দুর্যোগ, আপনাদের সঙ্গে বসে দু দণ্ড কথা বলারও সুযোগ হল না। এনার এত বই আমি পড়েছি।–কী যে আনন্দ পাই তা বলতে পারি না।
শেষের কথাটা অবিশ্যি লালমোহনবাবুকে উদ্দেশ করে বলা।
ফেলুদা বলল, কাল সকালে যাবার আগে আপনার ছেলের সঙ্গে একবার কথা বলে নেব। ঘরে চোর ঢোকার পরেও ও যা সাহস দেখিয়েছে তেমন সচরাচর দেখা যায় না।
সাড়ে বারোটা নাগাদ যখন আমরা শোবার আয়োজন করছি তখন ফেলুদা একটা কথা বলল।
ঘুঁষিটাও যে ব্রেন টনিকের কাজ করে সেটা আজ প্রথম জানলাম।
কী রকম? বললেন লালমোহনবাবু।
সাধুবাবু ভ্যানিশ করার ব্যাপারটা বুঝতে পারছি এতদিনে।
বলেন কী!
তুখোড় লোক। তবে যার সঙ্গে মোকাবিলা করছে, সেও তো কম তুখোড় নয়।
এর বেশি আর কিছু বলল না ফেলুদা।
অনিরুদ্ধ সকালে স্কুলে যায়, তাই চা খাবার আগেই ফেলুদা ওর সঙ্গে দেখা করে নিল।
চোর ঢোকারর কথাটা আজ শুনে মনে হল ছেলেটি বেশি রকম কল্পনাপ্রবণ; পরপর দুবার; একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হল। ফেলুদা বলল, তুমি যে বন্দুকটা দিয়ে চোরকে মারবে ঠিক করেছিলে সেটা তো আমাকে দেখালে না। শুনলাম তোমার ছোটকাকাকে দেখিয়েছ।
অনিরুদ্ধ বন্দুকটা বার করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বলল, এটা থেকে আগুনের ফুলকি বেরোয়।
লাল প্লাস্টিকের তৈরি মেশিনগান, ট্রিগার টিপলে মেশিনগানের মতো শব্দের সঙ্গে নলের মুখ দিয়ে সত্যিই স্পার্ক বেরোয়।
ফেলুদা বন্দুকটা নিয়ে নেড়ে-চেড়ে দেখে সেটার খুব তারিফ করে ফেরত দিয়ে বলল, তোমার যে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে, দেখা যাক সেটা বন্ধ করা যায় কি না।
তুমি চোর ধরে দেবে?
গোয়েন্দার তো ওই কাজ।
আর আমার চন্দনা যে চুরি করেছে সেই চোর?
সেটারও চেষ্টা চলেছে, তবে কাজটা খুব সহজ নয়।
খুব শক্ত?
খুব শক্ত।
দারুণ রহস্য?
দারুণ রহস্য।
আর সে দিন যে বললে, খাঁচার দরজায় রক্ত লেগে আছে?
ওটাই তো ভরসা। ওটাই তো ক্লু।
ক্লু মানে?
কু হল যার সাহায্যে গোয়েন্দা দুষ্ট লোককে জব্দ করে।
লালমোহনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, তোমার পাখিকে কথা বলতে শুনেছ?
হ্যাঁ, বলল অনিরুদ্ধ। আমি ঘরে ছিলাম, আর শুনলাম পাখিটা কথা বলছে।
কী কথা?
বলছে : দাদু ভাত খান, দাদু ভাত খান। আমি তক্ষুনি বেরিয়ে এলাম। কিন্তু তারপর আর কিছু বলল না।
লালমোহনবাবুর মুখে হাসি। অনিরুদ্ধ শুনেছে, দাদু ভাত খান আর লালমোহনবাবু শুনেছেন, বাবু সাবধান! মানতেই হয় দুটো খুব কাছাকাছি। পাখি নিশ্চয়ই ওই ধরনেরই কিছু বলছিল।
আপনার এখানে পাখি ধরতে পারে এমন কেউ আছে? ফেলুদা অমিতাভবাবুকে জিজ্ঞেস করল।
আমাদের মালীর ছেলে আছে, শঙ্কর, বললেন অমিতাভবাবু। এর আগে দু-একবার ধরেছে পাখি। খুব চালাক-চতুর ছেলে।
তাকে বলবেন একটু চোখ রাখতে। খুব সম্ভব চন্দনািট আপনাদের বাগানেই রয়েছে।
বারাসতে থাকতেই দেখেছিলাম যে, খবরের কাগজে চন্দনার বিষয় বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে। সেটার কাজ ষে এত তাড়াতাডি হবে তা ভাবতে পারিনি।
বারোটা নাগাদ একটি বছর পাঁচিশের ছেলে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বেশ চোখাচোখা চেহারা, পরনে জিনস আর মাথার চুলের কপাল-ঢাকা কায়দা দেখলেই বোঝা যায় ইনি হাল-ফ্যাশানের তরুন।
ফেলুদা বসতে বলতে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, বাসব না। আজ একটা ইন্টারভিউ আছে। ইয়ে, আমি আসছি। ওই পাখির ব্যাপারে কাগজে যে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছেন সেইটে দেখে।
ওটা আপনাদের পাখি ছিল?
আমাদের মানে আমার দাদুর। দাদু মারা গেছেন। লাস্ট মানুথ। তাই বাবা ওটাকে বেচে দিলেন। ওটার দেখাশুনা দাদুই করতেন। বাবা কোর্ট-কাচারি করেন, মা বাতে ভোগেন, আর আমার ও সবে ইন্টারেস্ট নেই।
কদ্দিন ছিল আপনাদের বাড়ি?
তা বছর দশেক। দাদুর খুব পিয়ারের চন্দনা ছিল।
কথা বলত?
হ্যাঁ। দাদুই শিখিয়েছিলেন। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শিখিয়েছিলেন।
অদ্ভুত মানে?
এই যেমন—দাদুর পাশার নেশা ছিল; পাখিটাকে শিখিয়েছিলেন ‘কচে বারো’ বলতে। তারপর ব্রিজও খেলতেন দাদু। খেলার সময় অপোনেন্টের তাস ভাল বুঝতে পারলে পার্টনারকে একটা কথা খুব বলতেন। সেটা পাখিটা তুলে নিয়েছিল।
কী কথা?
সাধু সাবধান।
ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ।
আর কিছু–?
না, আর কিছু জানার নেই।
ইয়ে, বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতে পারিনি এটা আপনার বাড়ি।
সেটা না বোঝারই কথা।
আপনাকে মিট করে খুব ইয়ে হলাম।
ঝাড়া পাঁচ ঘণ্টা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থেকে বিকেলে চা খেতে বেরিয়ে এসে ফেলুদা হাজরাকে একটা টেলিফোন করল :
কাল সকালে কী করছেন?
কেন বলুন তো?
হালদার বাড়িতে আসতে পারবেন।–নটা নাগাদ? মনে হচ্ছে রহস্যের কিনারা হয়েছে। তৈরি হয়ে আসবেন।
লালমোহনবাবুকে টেলিফোনে বলে দেওয়া হল, আমরা ট্যাক্সি করে চলে যাব তাঁর বাড়ি সাড়ে আটটায়। সেখান থেকে তাঁর গাড়িতে বারাসত।
রহস্য আরও বৃদ্ধি পেল নাকি?
না। সম্পূর্ণ উদঘাটিত।
সব শেষে অমিতাভবাবুকে ফোন করা হল।
আপনাদের বাড়িতে কাল সকালে একটা ছোটখাটো মিটিং করব ভাবছি।
মিটিং?
আপনাদের পুরুষ মেম্বার যে কজন আছেন তাঁরা যেন থাকেন। আর হাজরাকে থাকতে বলেছি।
নটায় হাজিরা। আপনার কাজের হয়তো একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা জরুরি।
অমিতাভবাবু রাজি হয়ে গেলেন। —পুরুষ মেম্বার মানে কি অনুকেও চাইছেন?
না। সে না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। এটা শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।
আমরা যখন পৌঁছলাম, তার আগেই হাজরার দল হাজির। ফেলুদা এ রকম ধরনের মিটিং এর আগেও করেছে। প্রত্যেক বারই আমার মনের মধ্যে একটা চনমনে ভাব, কারণ জানি না। কী হতে চলেছে, কার ভাগ্যে হাতকড়া আছে, কীভাবে ফেলুদা রহস্যের সমাধান করেছে। লালমোহনবাবু আমাকে বললেন, আমি চিন্তাটাকে স্রেফ অন্য পথে ঘুরিয়ে নিয়েছি। এ ব্যাপারে ব্রেন খাটিয়ে কোনও লাভ নেই, কারণ আমার ঘিলুতে অনেক ভেজাল, তোমার দাদারটা পিওর। নিজের তৈরি রহস্যের সমাধান এক জিনিস, আর অ্যাকচুয়েল লাইফে সমাধান আরেক জিনিস।
নীচের বৈঠকখানা ঘরে জমায়েত হয়েছি। হৃষীকেশবাবুর দিল্লি যাবার সময় হয়ে এসেছে। বললেন, এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি মশাই! কাগজ থাকলে তরু একটা কথা। এখন প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।
অচিন্তবাবুর সঙ্গে ভাল করে আলাপ হয়নি। তিনি আপত্তি করেছিলেন এই মিটিং-এ উপস্থিত থাকার ব্যাপারে। তাঁর নাকি একটা বড় পার্ট নিয়ে খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কালই নাকি নাটকটার প্রথম শো। ভদ্রলোক ফেলুদাকে বললেন, আপনার এ ব্যাপারটা কতক্ষণ চলবে?
ফেলুদা বলল, খুব বেশি তো আধা ঘণ্টা।
ভদ্রলোক তাও গজগজ করতে লাগলেন।
কফি খাবার পর ফেলুদা উঠে দাঁড়াল। কালশিটে ঢাকার জন্য ও আজ কালো চশমা। পরেছে। এটা ওর একেবারে নতুন চেহারা। হাত দুটোকে প্যান্টের পকেটে পুরে সে আরম্ভ করলে তার কথা।
পাৰ্ব্বতীচরণের খুনের ব্যাপারে। আমাদের যেটা সবচেয়ে অবাক করেছিল সেটা হল সাধন দস্তিদারের অন্তধন। দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে খুনটা হয়। সাধন দস্তিদার পার্বতীবাবুর ঘরে ছিলেন সোয়া দশটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত। সাড়ে দশটায় তাঁকে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে দেখেছি; দশটা পঁয়ত্ৰিশে অনিরুদ্ধর সঙ্গে কথা বলে পাৰ্বতীবাবুর ঘরে গিয়ে আমরা তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখি। তৎক্ষণাৎ সাধন দস্তিদারকে খোঁজা হয়, কিন্তু পাওয়া যায় না; দারোয়ান বলে, তাঁকে গেট থেকে বেরোতে দেখেনি। বাগানে খোঁজা হয়, সেখানেও পাওয়া যায়নি। কম্পাউন্ডের যে পাঁচিল, সেটা আট ফুট উঁচু। সেটা টপকানো সহজ নয়, বিশেষ করে হাতে একটা ব্রিফকেস থাকলে। আমরা–
এখানে অচিন্ত্যবাবু ফেলুদাকে বাধা দিলেন।
সাধনবাবুর আগে যিনি এসেছিলেন, তাকে কি আপনি বাদ দিচ্ছেন? আপনার বাবাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছিল, সেটা শক্ত সমর্থ লোকের পক্ষেই সম্ভব। পেস্টনজীর আকঞ্জাইটিস আছে, তিনি ডান হাত কাঁধের উপর তুলতে পারেন না। অবিশ্যি পেস্টনজী ছাড়াও একজন তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন যিনি পেস্টনজী ও সাধনবাবুর ফাঁকে পাৰ্ব্বতীবাবুর ঘরে গিয়ে থাকতে পারেন।
তিনি কে?
আপনি।
অচিন্ত্যবাবু সোফা ছেড়ে উঠে পড়েছেন।
আ-আপনার কি ধারণা আমি।–?
আমি শুধু বলেছি আপনার সুযোগ ছিল। আপনি খুন করেছেন সে কথা তো বলিনি।
তাও ভাল।
যাই হাক–সাধনবাবুর অন্তর্ধান বিশ্বাসযোগ্য হয় এক যদি দারোয়ান ভুল বা মিথ্যে বলে থাকে। আর দুই, যদি সাধনবাবু এ বাড়ি থেকে না বেরিয়ে থাকেন।
কোনও চারা কুঠুরিতে আত্মগোপন করার কথা বলছেন? হৃষীকেশবাবু প্রশ্ন করলেন।
অমিতাভবাবু বললেন, সে রকম লুকোনোর কোনও জায়গা এ বাড়িতে নেই। একতলার অধিকাংশ ঘরই তালাচাবি বন্ধ। এক বৈঠকখানা খোলা, রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর খোলা আর হৃষীকেশবাবুর ঘর খোলা।
এবং সে ঘরে তাকে আমি আশ্রয় দিইনি। সেটা আমি বলতে পারি, বললেন। হৃষীকেশবাবু। শুধু তাই নয়, সাধনবাবু যখন আসেন, তখন আমি ছিলাম না।
আমরা পোস্টাপিসে খোঁজ নিয়েছি, বলল ফেলুদা।আপনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন পোস্টাপিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে। তখন দশটা। পাঁচ মিনিট লেগেছে। আপনার টেলিগ্রাম করতে। তারপরেই আপনি–
তারপর আমি যাই ঘড়ির ব্যান্ড কিনতে।
দুঃখের বিষয় দোকানের লোক আপনাকে মনে করতে পারছে না।
মিঃ মিত্তির, দোকানের লোকের স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করেই কি আপনি গোয়েন্দাগিরি করেন?
না, তা করি না। এবং তাদের কথায় আমরা খুব আমল দিইনি। আর আপনিও যে সত্যি কথা বলছেন সেটা আমরা মানতে বাধ্য। নই।
কেন, আমি মিথ্যে বলব কেন?
কারণ সোয়া দশটার সময় আপনারও তো পাৰ্বতীচরণের ঘরে যাবার প্রয়োজন হয়ে থাকতে পারে!
এ সব কী বলছেন। আপনি? আপনি নিজেই বলছেন। সাধনবাবুকে বেরোতে দেখেছেন, আবার বলছেন আমি গিয়েছি?
ধরুন সাধন দস্তিদার যদি নাই এসে থাকেন। তার জায়গায় আপনি গেলেন।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘরে সবাই চুপ, তারই মধ্যে হৃষীকেশবাবু হা হা করে হেসে উঠলেন।
মিঃ হালদার কি উন্মাদ না জরাগ্রস্ত, যে আমি দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকব আর তিনি আমাকে চিনবেন না?
কী করে চিনবেন, হৃষীকেশবাবু? আপনি যদি গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে চোখের চশমাটা খুলে পোশাক বদলে তাঁর ঘরে ঢোকেন, তা হলে আপনাকে সাত বছর আগের সাধন দস্তিদার বলে। কেন মনে করবেন না পাৰ্বতীবাবু? আপনি আর সাধন দস্তিদার যে আসলে একই লোক! প্রতিশোধ নেবার জন্য চেহারা পালটে নাম পালটে সেই একই লোক যে আবার সেক্রেটারি হয়ে ফিরে এসেছে, সেটা তো আর বোঝেননি পার্বতীচরণ!
হৃষীকেশবাবুর মুখের ভাব একদম পালটে গেছে। তাঁর ঠোঁট নড়ছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। দুজন কনস্টেবল এগিয়ে গেল তাঁর দিকে!
ফেলুদার কথা এখনও শেষ হয়নি।
খুনের পর কি আপনার ভাড়া করা কোটের পকেটে পেপার ওয়েট পুরে তার ওজন বাড়িয়ে আপনি পুকুরের জলে ফেলে দেননি? তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আবার হৃষীকেশ দত্ত সেজে বেরিয়ে আসেননি?
এই শীতকালেও হৃষীকেশবাবুর শার্টের কলার ভিজে গেছে।
আরও একটা কথা, বলে চলল ফেলুদা। সাধু সাবধান কথাটা কি চেনা চেনা লাগছে? অনিরুদ্ধের জন্য কেনা চন্দনার মুখে কি কথাটা শোনেননি। আপনি সম্প্রতি? আর শুনে আপনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে কি বিশ্বাস ঢোকেনি যে কথাটা আপনাকে উদ্দেশ করেই বলছে? আপনি সাধু সেজে মনিবের সর্বনাশ করতে যাচ্ছেন জেনেই পাখি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছে? আপনিই কি এই পাখিকে খাঁচা থেকে বার করে বাগানে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেননি? এবং এই কাজটা করার সময় আপনাকেই কি পাখি জখম করেনি?
হৃষীকেশবাবু এবার লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার থেকে।
অ্যাবসার্ড! অ্যাবসার্তা! কোথায় জখম করেছে? কোথায়?
ইনস্পেক্টর হাজরা, আপনার লোককে বলুন তো ওঁর ডান হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নিতে।
প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও ঘড়ি খুলে এল।
কবজিতে প্ৰায় এক ইঞ্চি লম্বা একটা আঁচড়ের দাগ, সেটা দিব্যি ঘড়ির ব্যান্ডের তলায় লুকিয়ে ছিল।
আমি খুন করতে যাইনি–দোহাই আপনার–বিশ্বাস করুন!
হৃষীকেশবাবুর অবস্থা শোচনীয়।
সেটা অবিশ্বাস্য নয়, বলল ফেলুদা, কারণ আপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল নেপোলিয়নের চিঠিটা নেওয়া। পেস্টনজী বড় রকম দর দিয়েছেন সেটা আপনি জানতেন। মিঃ হালদার বেচাবেন না সেটাও আপনি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতেন। কিন্তু জিনিসটা চুরি করে তো পেস্টনজীর কাছে বিক্রি করা যায়! তাই—
আমি না, আমি না? মরিয়া হয়ে প্রতিবাদ জানালেন হৃষীকেশবাবু।
আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। ফেলুমিত্তির আধাখেচড়াভাবে সমস্যার সমাধান করে না। এ ব্যাপারে আপনি এক নন, সেটা আমি জানি। চিঠিটা বার করে এনে নিজের ঘরে গিয়ে মেক-আপ বদলে আপনি যান আরেকজনের কাছে চিঠিটা দিতে। কিন্তু বাড়িতে খুন হয়েছে, খানাতল্লাশি হবে, সেটা জেনে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও সাময়িকভাবে চিঠিটাকে অন্য জায়গায় চালান দেন। তাই নয়, অচিন্ত্যবাবু?
প্রশ্নটা একেবারে বুলেটের মতো। কিন্তু লোকটার আশ্চর্য নাৰ্ভ। অচিন্তবাবু ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে দিব্যি বসে আছেন সোফায়।
বলুন, বলুন, কী বলবেন, বললেন ভদ্রলোক, আপনি তো দেখছি সবই জেনে বসে আছেন।
আপনি সাড়ে দশটার একটু পরে একবার আপনার ভাইপোর ঘরে যাননি?
গিয়েছিলাম বইকী। আমার ভাইপোর ঘরে যাওয়ায় তো কোনও বাধা নেই। সে ক’দিন থেকেই বলছে তার নতুন খেলনা দেখাবে, তাই গিয়েছিলাম।
আপনার ভাইপোর ঘরে গতকাল এবং তার আগের রাত্রে একজন চোর ঢুকেছিল। সে যা খুঁজছিল তা পায়নি। আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে, সে চার আপনিই এবং আপনি খুঁজতে গিয়েছিলেন নেপোলিয়নের চিঠি-যেটা আপনিই তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন? চিঠিটা পাবেন। এই বিশ্বাসে আপনিই পেস্টনজীকে ফোন করে আফার দিয়েছিলেন, তারপর সেটা না পেয়ে আর পেস্টনজীর ওখানে যেতে পারেননি?
আমিই যখন লুকিয়েছিলাম, তখন সেটা আমি কেন পাব না সেটা বলতে পারেন?
কারণ যাতে লুকিয়েছিলেন, সেটা ছিল খোকার বালিশের তলায়। এই যে।
ফেলুদা মিঃ হাজরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হবি সেন্টার থেকে কেনা লাল প্লাস্টিকের মেশিনগান চলে এল ফেলুদার হাতে। তার নলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে টান দিতে বেরিয়ে এল গোল করে পাকানো নেপোলিয়নের চিঠি।
হৃষীকেশবাবুর মেক-আপের ব্যাপারে আপনিই মালমশলা সাপ্লাই করেছিলেন বোধহয়? প্রশ্ন করল ফেলুদা,ভাগ বাঁটায়ারা কী রকম হত? ফিফ্টি ফিফ্টি?
*
মালীর ছেলে শঙ্কর চন্দনাটা ধরতে পেরেছিল ঠিকই, যদিও পাখি ফেরত পাওয়ার পুরো ক্রেডিটটা তার খুদে মক্কেলের কাছে ফেলুদাই পেল।
অমিতাভবাবু ফেলুদাকে অফার করেছিলেন পাৰ্বতীচরণের কালেকশন থেকে একটা কোনও জিনিস বেছে নিতে। ফেলুদ রাজি হল না। বলল, এই কেসটায় আমার জড়িয়ে পড়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা। আসলে আমি এসেছিলাম। আপনার ছেলের ডাকে। তার কাছ থেকে তো আর ফি নেওয়া যায় না?
ঘটনার দু দিন পরে শনিবার সকালে লালমোহনবাবু এসে বললেন, জলের তল পাওয়া যায়, মনের তল পাওয়া দায়। আপনার অতলস্পর্শী চিন্তাশক্তির জন্য আপনাকে একটি অনারারি টাইটেলে ভূষিত করা গেল। —এ বি সি ডি।
এ বি সি ডি?
এশিয়া’জ বেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর।