[দ্বিতীয় খন্ড]
বাঙলায় নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো আকর্ষণীয় সহচরী, সুগৃহিণী, সুমাতা উৎপাদন করা। এর কোনোটিই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য নয়। আগের নারীরা অশিক্ষিত ছিলো, কিন্তু তারা যে সুগৃহিণী ও সুমাতা ছিলো না, তা নয়; তারা খুবই উৎকৃষ্ট ছিলো মা ও গৃহিণী হিশেবে। এ-বস্তু উৎপাদনের জন্যে মেঘনাদবধকাব্য, জ্যামিতি, বা শেক্সপিয়রের কবিতা লাগে না; কাউকে লেখাপড়া শিখিয়ে এমনভাবে গর্ভবতী করা সম্ভব নয় যে সে প্রসব করবে কোনো রবীন্দ্রনাথ বা নিউটন।
আদর্শ মাতার ধারণাও খুবই ভুল ছিলো, যেমন আছে আজো; তখন অনেকেই কামনা করেছে শিক্ষা এমন মা উৎপাদন করবে, যারা দলে দলে প্রসব করবে নেপোলিয়ন বা জর্জ ওয়াশিংটন বা গারিবান্ডি! যে-মা নেপোলিয়ন বা হিটলার প্রসব করতে পারে, তার সম্পর্কে তো আগে থেকেই সাবধান হওয়া দরকার। আসলে নারীশিক্ষার লক্ষ্য ছিলো আকর্ষণীয় সহচরী ও শয্যাসঙ্গিনী উৎপাদন। নারীর বিকাশ ঘটানো, তাকে স্বায়ত্তশাসিত মানুষরূপে বেড়ে উঠতে দেয়া এর লক্ষ্য ছিলো না; তাকে আর্থনীতিকভাবে স্বাধীন করা এর উদ্দেশ্য তো ছিলোই না, বরং এটাই অনেকের ভয় ছিলো যে নারী একদিন স্বাধীন হয়ে পড়তে পারে। তাই নারী যাতে স্বাধীন স্বনির্ভর না হতে পারে, নারীর জন্যে প্রস্তাবিত হয় ভিন্ন ধরনের শিক্ষা; ভূতা শিক্ষা নয়, নারীশিক্ষা, যাতে বিকশিত হবে নারীর নারীত্ব ও রমণীয়তা। নারীর পাঠক্রম নিয়ে শুরু হয় বড়ো বিতর্ক।
১৮৬০-এর দশকে প্রস্তাব করা হয যে নারীদের বিশেষভাবে দিতে হবে ঘরকন্না, রান্নাবান্না, সেলাই, শিশুপালন ইত্যাদি নারীসুলভ শিক্ষা। ভারতীয় মহাপুরুষেরা কপটতায়ও মহান হয়ে থাকেন। যেমন কেশবচন্দ্ৰ সেন বিলেতে নারীদের সম্পর্কে এতো মহৎ সব কথা বলেন যে অ্যানেট অ্যাক্রয়েড তাতে মুগ্ধ হয়ে নারীশিক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন; এসে দেখেন কেশব সেন নারীদের প্রথাগত নারী ক’রে রাখতেই চান। তাঁর প্রকাশ্য কলহ বাধে কেশব সেনের সাথে, কেননা কেশব সেন চান ‘ভদ্রমহিলা’, অ্যাক্রয়েড চান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী [দ্ৰ বোর্থউইক (১৯৮৪, ৫৮-৫৯)]।
কেশব সেন চেয়েছিলেন নারী শিখবে রমণীয় শিক্ষা:- তারা জ্যামিতি, দর্শন, অঙ্ক প্রভৃতি পুরুষালি বিষয় পড়বে না, শিখবে সেলাই, রান্না, শিশুপালন; শিবনাথ শাস্ত্রী ও তাঁর অনুরাগীরা অবশ্য দাবি করেছেন যে নারীরা পড়বে সব কিছুই। রাজনারায়ণ বসু (১৮৭৪, ৪৭) বলেছেন, ‘হয় স্ত্রীদিগের রীতিমত শিক্ষা দেও, নতুবা শিক্ষা দেওয়ায় কাজ নাই।’ দেড় দশক পরে ইন্ডিয়ান ক্রিস্টান হেরাল্ড (১৮৮২) উগ্রতার সঙ্গেই নারীদের নারী বানিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিতে চায় : ‘ভারত চায় যে তার পুত্ররা হবে পুত্র এবং কন্যারা হবে কন্যা, পুত্র নয়’ [উদ্ধৃত বোর্থউইক (১৯৮৪, ৯৮)]। ভারতকন্যা বানানোর জন্যে তাদের কী পড়াতে হবে? পড়াতে হবে গার্হস্থ্য অর্থনীতি, অঙ্কন, সঙ্গীত, রান্না, সেলাই ও স্বাস্থ্যবিধি, যা আসলে কোনো শিক্ষাই নয়।
পুরুষ চেয়েছে শিক্ষিত স্ত্রী, আর নারী শিক্ষিত হতে চেয়েছে ভালো বর পাওয়ার জন্যে : বাঙলায় নারীশিক্ষার এ-মহান উদ্দেশ্য আজো পুরোপুরি বজায় রয়েছে। পিতৃতন্ত্র নারীর সমস্ত পথ বন্ধ করে খোলা রেখেছে একটি পথ, সেটি বিয়ে; তাকে দিয়েছে একটি পেশা, সেটি বিয়ে। উৎকৃষ্ট পেশায় নিয়োজিত হওয়ার যোগ্যতার থেকেও এ-অঞ্চলে কঠিন একটি ভালো বিয়ে; এবং বিয়েই যেহেতু নারীর নিয়তি, তাই শিক্ষা হয়ে ওঠে নারীর নিয়তি উন্নয়নের হাতিয়ার।
তবে একমাত্র শিক্ষাই ভালো বিয়ের সোনার চাবি নয়। নারীর জন্যে, শিক্ষা নারীর জন্যে শুরু থেকেই হয়ে ওঠে প্ৰসাধন : তাকে ভালো বংশের হতে হবে, তার বাপের সমৃদ্ধ অর্থকোষ থাকতে হবে, তার রূপ থাকতে হবে, তারপর থাকতে হবে শিক্ষা। শিক্ষা হচ্ছে অতিরিক্ত যোগ্যতা, এবং কখনো কখনো অযোগ্যতা। নারীশিক্ষার শুরু থেকেই বাঙলায় শিক্ষা নারীর জন্যে বিয়ের অতিরিক্ত যোগ্যতা হয়ে আছে; এবং এজন্যেই নারীশিক্ষা অনেকটা ব্যর্থ হয়ে গেছে।
ওই সময়, যেমন এখনো, যারা শিক্ষাকে নিয়েছিলো বিয়ের সিঁড়িরূপে, যারা আসলে জ্ঞানের দিকে এগোয়ই নি, তারা প্ৰায্য সবাই সুয়োগ পেলেই বিয়ে বসে শিক্ষার আশুউদ্দেশ্যকে সফল করেছে। কিন্তু যারা শিক্ষাকে নিয়েছিলেন গুরুত্বের সাথে, বিয়ে হয়ে ওঠে তাদের জন্যে সংকট। তারা অনেকে বিয়েই করেন নি, বা করেছেন বেশ দেরিতে, এবং কেউ কেউ বিয়ে ক’রে নষ্ট করেছেন জীবন।
প্রথম এমএ চন্দ্ৰমুখী বসু একচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন বিপত্নীক কেশবানন্দকে, তার বোন বিধুমুখী, প্রথম দুই মহিলা এমবির একজন, অবিবাহিত থাকেন আজীবন। ভার্জিনিয়া মেরি মিত্র, প্রথম দুজন মহিলা এমবির একজন, যিনি অধিকার করেছিলেন প্রথম স্থান, উনচল্লিশ বছর বয়সে বিয়ে করেন এক চিকিৎসককে। ভার্জিনিয়া নিজে ছিলেন সুচিকিৎসক, কিন্তু বিয়ের পর চিকিৎসা ছেড়ে হয়ে ওঠেন স্বামীর রোগীদের সেবিকা। কামিনী সেন (রায়) বিয়ে করেন তিরিশ বছর বয়সে।
এর আগেই কবি হিশেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি, বিয়ের পর কল্যাণী স্ত্রী হওয়ার তার সাধ জাগে, কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে বলেন যে সংসারই তার কবিতা। তবে কবিতাও প্রতিশোধ নিতে দেরি করে নি: অনতিবিলম্বেই বিধবা হয়ে কামিনী রায় ফিরে আসেন কবিতায়। বিয়ে তাকে অপমৃত্যু দিয়েছিলো, কবিতা আজো তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তার বোন যামিনী সেন চিকিৎসক হয়েছিলেন, বিলেত থেকে ডিপ্লোমা নিয়েছিলেন, বুঝেছিলেন সংসার কাকে বলে; তাই বিয়েই করেন নি।
জগদীশচন্দ্র বসুর অনুজা হেমপ্ৰভা বসু এমএ, রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লজ্জাবতী বসু বিএ, রাধারাণী লাহিড়ী বিএ, সুরবালা ঘোষ বিএ বিয়ে করেন নি। তারা অস্বীকার করেছিলেন পুরুষতন্ত্রকে, এবং পুরুষতন্ত্র আজো তাদের দেখে সন্দেহের চোখে। বিয়ের পায়ে অনেকেই, নারীশিক্ষার সূচনায়ই, উৎসর্গ ক’রে দেন শিক্ষাকে। সরলা দাস প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রবেশিকার জন্যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পরীক্ষার অনুমতিও মিলেছিলো, কিন্তু এক ডাক্তারের সাথে বিয়ে হবে ব’লে তিনি পরীক্ষা দেন নি।
হেমন্তকুমারীও একই কারণে প্ৰবেশিকা পরীক্ষা দেন নি। সবলা সেনের ইচ্ছে ছিলো বিএ পাশ ক’রে কোনো পেশায় ঢুকবেন, কিন্তু এক ব্যারিস্টারের বউ হওয়ার পর সংসারের পেশায় এতো সুখ পান যে আর কোনো পেশার কথা ভাবতে পারেন নি। শিশিরকুমারী বাগচী ১৮৯৮-এ বিএ পাশ ক’রে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন, কিন্তু বিয়ের পর করেন সুখের সংসার। শিবনাথ শাস্ত্রীর মেয়ে হেমলতা ১৮৯৩-এ বিয়ের পর ছেড়ে দেন একটি ভালো চাকুরি। তাই লেখাপড়া হয়ে থাকে বিয়ের সিঁড়ি, প্রধান পেশা থাকে বিয়ে ও সংসার। বাঙালি নারী আজো বহন করছে এ-সুখকর অভিশাপ।
কেউ বিএ পাশ করে যদি বাসায় বসে থাকে, বা হয় সুগৃহিণী বা সুমাতা, তবে তা হচ্ছে শিক্ষার অপচয়, এবং ক্ষতিকর। শিক্ষিত সুগৃহিণী, যে কোনো পেশায় জড়িত নয়, তার পক্ষে পরগাছা হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। নারীশিক্ষা, পুরুষতন্ত্রের পরিকল্পনা অনুসারে, বাঙলায় সৃষ্টি করেছে পরগাছার জঙ্গল। প্রথম দুজন নারী স্নাতক বেরোতে না বেরোতেই নিউ ডিস্পেন্সেশন (৮ জুলাই ১৮৮৩) লেখে [উদ্ধৃত বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১০)] :
স্নাতক পরীক্ষার জন্যে ছাত্রীদের ভর্তি করার বিশ্ববিদ্যালয়েব নীতির বিরুদ্ধে যাই বলা হোক না কেনো, সত্য আমাদের মেনে নিতেই হবে, এবং তা হচ্ছে যে এর মাঝেই আমরা কয়েকজন নারী-বিএ পেয়েছি। আমরা তাদের নিয়ে কী করবো? যদি তাদের শুধু তাদের ডিগ্রি নিয়ে থাকতে দিই, তবে তাঁরা শিক্ষক হিশেবে পচবেন এবং অহমিকায় নষ্ট হওয়া ছাড়া তাঁদের আর কোনো পথ থাকবে না। নারী স্নাতকদের শুধু ডিগ্রি দিয়ে বিদায় ক’রে দিলে তা সমাজের নৈতিকতা উন্নয়নে কতোটা কাজে আসবে, তা আমরা জানি না। জনস্বার্থে সর্বোৎকৃষ্ট নীতি হবে তাদের সদ্ব্যবহার করা।
কিন্তু শুরু থেকেই এর সদ্ব্যবহার হয় নি। প্রথম পর্যায়ে যারা লেখাপড়া শিখেছিলেন, তারা ধনী পবিবারেরই ছিলেন; তাই তাদের জীবিকা অর্জনের সংগ্রামে নামতে হয় নি। বেশি। আর বিয়ে হয়ে গেলে তো চমৎকার। ছিলো প্ৰচণ্ড রক্ষণশীলতা, দু-এক দশক আগে পর্যন্ত নারীর কোনো পেশায় নিযুক্ত থাকাকে সমাজ ভালো চোখে দেখে নি। নারীরাও নষ্ট করেছে নিজেদের; একটা ভালো বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তারা হারিয়ে ফেলে শিক্ষার সবটুকু, হয়ে ওঠে সচ্ছল স্বামীর অপদাৰ্থ শয্যাসঙ্গিনী। তারা অশিক্ষিত নারীর থেকেও অনেক অধম।
উনিশ শতকে, যেমন আজো, নারী যখন পেশা গ্রহণ করতে চেয়েছে, তখন সমাজ তার জন্যে রেখেছে দুটি নারীসুলভ পেশা : শিক্ষকতা, ও চিকিৎসা বা ধাত্রীবিদ্যা। আজো প্ৰধানত এ-দুটি পেশায় আটকে আছে নারী। ১৯০১-এ কলকাতায় বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন ৭২৫জন নারী [দ্ৰ বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১০)] , তার মধ্যে অধ্যক্ষ, অধ্যাপক, শিক্ষকের পেশায় ৫৮৭ জন, প্ৰশাসন ও পরিদর্শন ৬জন, চিকিৎসায় ১২৪জন, চিত্রগ্রহণে ৪জন, লেখক, সম্পাদক, সাংবাদিক ৪জন।
পেশা হিশেবে শিক্ষকতাকে প্রথম নিয়েছিলেন পাবনার বামাসুন্দরী দেবী। ১৮৬৩তে ২০ বা ২১ বছরের এ-তরুণী প্ৰতিষ্ঠা করেন একটি বালিকা বিদ্যালয়। ১৮৬০-এর দশকে ব্ৰাহ্ম মনোরমা মজুমদার বরিশালে নানা বৈরিতার মধ্যে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৮৭৮ সালে তিনি ঢাকা সরকারি বয়স্ক বালিকা বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় সহকারী শিক্ষক হিশেবে যোগ দেন মাসে ৬০ টাকা বেতনে। যাঁরা প্রথম চাকুরি নিয়েছিলেন তারা সাধারণত ছিলেন দেশি খ্রিস্টান ও হিন্দু বিধবা। খিস্টানদের কোনো সামাজিক বাঁধা ছিলো না, আর হিন্দু বিধবার ছিলো জীবিকার সমস্যা; তাই তারা পেশায় জড়িয়েছেন নিজেদের।
১৮৬৬ সালে রাধামণি দেবী মাসে ৩০ টাকা বেতনে শেরপুর বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকরূপে যোগ দেন। তিনি চশমা পরতেন, এটা ছিলো তার সম্পর্কে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য। রাধারানী লাহিড়ী বিএ ১৮৮০তে মাসিক ৬০ টাকা বেতনে বেথুন বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শিক্ষক নিযুক্ত হন; ১৮৮৬তে তিনি হন মাসে ১০০ টাকা বেতনের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক। তারা যে স্বাধীনতা ভোগ করেছিলেন বাঙালি নারী আগের হাজার বছরে তা ভোগ করে নি, কেননা তারা ছিলেন আর্থনীতিকভাবে স্বায়ত্তশাসিত।
চন্দ্ৰমুখী বসু, প্রথম নারী এমএ, ১৮৮৪তে মাসিক ৭৫ টাকা বেতনে বেথুন বিদ্যালয়ের সহকারী তত্ত্বাবধায়ক হন; ১৮৮৬ সালে হন মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের তত্ত্বাবধায়ক। চমৎকার বেতন! কেউ কেউ চাকুরির জন্যে নিজের এলাকা থেকে চ’লে যান সুদূরে : ১৮৯০-এ অবিবাহিত শরৎ চক্রবর্তী বিএ অমৃতসরে আলেকজান্দ্রা খ্রিস্টান বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে চলে যান; কামিনী বসু প্রধান শিক্ষিকা হয়ে চ’লে যান দেরাদুন বালিকা বিদ্যালয়ে।
১৮৯১-এ অঘোরকামিনী রায় প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্যে যান লক্ষ্ণৌ, ফিরে এসে নিজেই স্থাপন করেন বিদ্যালয়। কুমুদিনী খাস্তগীর ১৮৯৩-এ মহিশুরের মহারানী বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা নেন। সরলা দেবী ছিলেন চাঞ্চল্যকরভাবে ব্যতিক্ৰম; তিনি ১৮৯৫-১৮৯৬ সালে চাকুরি নেন হায়দ্রাবাদের মহারানীর সহকারীর মাসে অসাধারণ ৪৫০ টাকা বেতনে। তার চাকুরির প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু তিনি নরনারীর স্বায়ত্ত জীবিকা অর্জনে সমান দাবি প্রতিপন্ন করার জন্যেই চাকুরি নেন, ছেড়ে দেন অল্প পরেই [দ্ৰ গোলাম মুরশিদ (১৯৮৩, ১০৪), বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩১৭-৩২২)]।
দেশি খ্রিস্টানরা লেখাপড়া শিখেছিলেন আগে, এবং লেখাপড়াকে কাজে লাগিয়েছিলেন নানা পেশায় নিযুক্ত হয়ে। ১৮৭৬-এ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা, ইংরেজের বিধবা, মনোমোহিনী হুইলার ২০০ টাকা বেতন ও ৩০ টাকা। যাতায়াত ভাতায় নিযুক্ত হন বিদ্যালয় পরিদর্শক। এঁরাই রেখেছিলেন শিক্ষার মর্যাদা, শিক্ষিত সুগৃহিণীরা নয়।
চিকিৎসা, শিক্ষকতার মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনেকটা নারীর পেশা। আর্থিক কারণে এটি শিক্ষকতার থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। অবরোধপ্রথা ছিলো নারী চিকিৎসকদের জন্যে আশীৰ্বাদ। নারীর চিকিৎসার জন্যে পুরুষ চিকিৎসক গ্রহণযোগ্য ছিলো না, তাই বেশ কজন নারী চিকিৎসক হয়েছিলেন, পেশায় ভালোও করেছিলেন। তাঁদের পেশাগত বাঁধাবিপত্তির অভাব ছিলো না।
কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ১৮৮৬তে এলএমএস পাশ ক’রে হন বাঙলার প্রথম নারী চিকিৎসক। ১৮৮৮-তে তিনি লেডি ডাফরিন নারী হাসপাতালে ৩০০ টাকা বেতনে চিকিৎসক নিযুক্ত হন। প্রাইভেট চিকিৎসা, এবং নেপালে মহারাজার চাকুরি ক’রে তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন; এবং ১৮৯৩-এ উচ্চশিক্ষার জন্যে বিলেত যান। ফিরে আসেন এডিনবরা, ডাবলিন, গ্লাসগো থেকে নানা ডিগ্রি নিয়ে। যামিনী সেন ১৮৯৭-এ এলএমএস পাশ করেন, ১৮৯৯-এ নেপালে চাকুরি নেন। তিনিও বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন।
নারী চিকিৎসকদের পেশা ছিলো বিপদসংস্কুল, বিশেষ ক’রে মফস্বলে তাদের মাঝেমাঝেই বিপদে পড়তে হতো। তাদের বিরুদ্ধে শহরেও কুৎসার শেষ ছিলো না। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি যখন কলকাতায় চিকিৎসা শুরু করেন বঙ্গনিবাসী পত্রিকা সম্পাদকীয়তে তাকে অশ্লীলভাবে আক্রমণে করে। তিনিও মানহানির মামলা করেন, এবং ১৮৯১-এ সম্পাদক মহেন্দ্ৰ পালের এক বছর কারাদণ্ড হয়। অভদ্র মধ্যযুগীয় পুরুষতন্ত্রকে একটি ভালো শিক্ষা দিয়েছিলেন কাদম্বিনী।
১৯০২ সালে মালদায় ঘটে নারীচিকিৎসক হরণ ও শ্লীলতাহরণ। প্রমীলাবালা ছিলেন মালদায় নারীচিকিৎসক; সেখানকার লম্পট জমিদার মদনগোপাল তার স্ত্রীর চিকিৎসার নামে রাতের বেলা তাকে ডেকে পাঠায়। জমিদারের নৌকোয় নিয়ে তার শ্লীলতাহানি করা হয়। ওই সমাজ নারী ডাক্তার বেশি দিন সহ্য করে নি, কেননা তা পুরুষের অহমিকাকে ঘা দেয়; তাই দেখা যায় পুরুষেরা অল্পকালের মধ্যেই নারী ডাক্তারের বদলে চায় ধাত্রী। ডাক্তারকে ধাত্রী বানাতে না পারলে পুরুষতন্ত্রের মনে শান্তি থাকে না। কেশব সেন দাবি করেন যে তাদের নারী ডাক্তার দরকার নেই, দরকার ধাত্রী। ধাত্রী খুবই দরকার ছিলো সন্দেহ নেই; চিকিৎসার অভাবে নারী মরলে ক্ষতি ছিলো না, কিন্তু পুরুষের উত্তরাধিকারীকে প্রসব করানো ছিলো খুবই জরুরি।
বাঙালি নারীর জন্যে নারীকে লেখাপড়া শেখায় নি, শেখাতে বাধ্য হয়। পুরুষেরই জন্যে; কিন্তু নারীশিক্ষাবিরোধী প্রবণতা তার কখনোই কমে নি। তার মনের মধ্যে সব সময়ই কাজ ক’রে চলেছে। এ-বোধ যে এটা খর্ব করে পুরুষের প্রভূতু, শিক্ষায় নারী হয়ে ওঠে অসতী, শিক্ষিত নারী নষ্ট করে পরিবার। সতীত্বের চিন্তায় বড়ো উদ্বিগ্ন পুরুষযতন্ত্র, যদিও নারীর সতীত্ব নষ্ট করে পুরুষই।
নারীশিক্ষার শুরুতেই ধৰ্মসভার মুখপত্ৰ সমাচারচন্দ্ৰিকা ভয় দেখায় যে ‘বালিকাগণকে বিদ্যালয়ে পাঠাইলে ব্যভিচার সংগঠনের শঙ্কা আছে, কেননা বালিকাগণ কামাতুর পুরুষের দৃষ্টিপথে পড়িলে অসৎপুরুষেরা তাহাদিগকে বলাৎকার করিবে, অল্পবয়স্ক বলিয়া ছাড়িবে না, কারণ খাদ্য খাদক সম্পর্ক।…ধন্যবানদিগের কন্যারা পথিমধ্যে ভূত্য দ্বারা রক্ষিত হইয়া গমন করিলে তথাপি কীেমার হরণের ভয় আছে, কেননা রক্ষকেরাই স্বয়ং ভক্ষক হইবে।’ [দ্ৰ শ্ৰীপান্থ (১৯৮৮, ২৩)]।
এ-বৰ্ণনা যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে বাঙালি পুরুষ আপাদমস্তক লম্পট। নারীশিক্ষা আজো বাঙালির বড়ো উদ্বেগ, যদি তা হয় প্রকৃত নারীশিক্ষা; ছদ্মনারীশিক্ষায় তার আপত্তি নেই। শিক্ষা যদি নারীকে স্বাধীন, স্বায়ত্তশাসিত, মুক্ত করে, তবে তা আপত্তিকর হিন্দু-মুসলমান-ব্ৰাহ্মর কাছে, কিন্তু তা যদি নারীকে উন্নত দাসী করে, তবে তা গ্রহণযোগ্য। নারীর প্রকৃত শিক্ষা এখানকার পুরুষ চায় নি, নারীও সাধারণত তা বুঝে উঠতে পারে নি। নারীশিক্ষা একই সাথে পুরুষের কাছে ছিলো বিষ ও অমৃত- আনন্দ ও উদ্বেগের ব্যাপার, যদি তা নারীকে পরিণত করে আবেদনময়ী পরিচারিকায়, তবে তা আনন্দদায়ক, যদি তা নারীকে মুক্ত করে, তবে তা উদ্বেগের কারণ।
উনিশ শতকে নারী যখন লেখাপড়া শিখতে শুরু করেছে, সমাজ তাকে দেখেছে গভীর সন্দেহের চোখে। তরুণেরা শিক্ষার পক্ষে থাকলেও মহাপুরুষদের অনেকেই ‘নবীনা’র সমালোচনায় থেকেছেন মুখর, যেমন বঙ্কিম। তখন ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ বা আলেকজান্ডার পোপের ‘লিটল লার্নিং ইজ এ ডেঞ্জারাস থিং’ নারীশিক্ষার অপকারিতা প্রমাণের জন্যে ফিরেছে মুখেমুখে।
অল্পবিদ্যা আসলেই ভয়ঙ্কর, কেননা তা আরো শেখার আগ্রহ জাগায়। বঙ্কিম ‘প্রাচীনা ও নবীনা’ প্ৰবন্ধে প্রাচীনার গুণগানে মুখর থেকে দোষ ধরেছেন নবীনার; নবীনার বহু দোষের একটি হচ্ছে তারা একটু লেখাপড়া শিখেই ধর্মকে অবহেলা করতে শিখেছে। নিরপেক্ষ বিচারে বোঝা যায় তারা অল্প লেখাপড়া শিখে যতোটা বুঝেছিলো, বঙ্কিম অনেক লেখাপড়া শিখে মহাপুরুষ হওয়া সত্ত্বেও ততোটা বোঝেন নি: বোঝেন নি যে ধর্ম আসলেই গুরুত্বহীন।
নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়ার বিস্ফোরণ ঘটতে দেরি হয় নি। ১৮৭০-এর দশকে প্রথম প্রবেশিকা পাশ মেয়েটি বেরোনোর আগেই প্রতিক্রিয়ার কলরোল শোনা যায়; এবং অচিরেই প্রহসনে প্রহসনে নারীশিক্ষার বদনাম রটাতে থাকে মঞ্চে মঞ্চে। লৈঙ্গিক রাজনীতিতে পুরুষতন্ত্রের শেষ অশ্লীল অস্ত্র হচ্ছে ব্যঙ্গবিদ্রূপ। পাশকরা ম্যাগ, কেয়াবাৎ মেয়ে, পরিণয়ে প্রগতি, মডেল ভগিনী, স্বাধীন জেনানা ধরনের অশ্লীল প্রহসনে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ দূষিত হয়ে ওঠে।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৮৭৮-এই লেখে, ‘স্ত্রীশিক্ষার যে বিষময় ফল দাড়াইতেছে তাহা কেবল এই প্রণালীর দোষ।… যে সমস্ত পুস্তক পাঠ করিলে স্ত্রীজাতি উৎকৃষ্ট গৃহিণী ও মাতা হইতে পারে তাঁহাই তাহাদের বিশেষ পাঠ্য’ [উদ্ধৃত গোলাম মুরশিদ (১৯৮৫, ৩৮)]। একটি মেয়েও তখনো প্রবেশিকা পাশ করে নি, কিন্তু শুরু হয়ে গেছে ‘বিষময় ফল’ ফলা! পুরুষতন্ত্রের অভিযোগ তারা উৎকৃষ্ট মাতা ও গৃহিণী নয়; তারা আশা করেছিলো নারী শিক্ষিত হয়ে ঘরে ঘরে নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটন প্রসব করবে; পুত্রদের ক’রে তুলবে মহাপুরুষ, স্বামীদের করবে শিক্ষিত সেবা। কিন্তু দেখতে পায় স্বৰ্গে গোলমাল শুরু হয়ে গেছে, হাওয়া গন্ধম খেতে শুরু করেছে আদমের অনুমতি ছাড়াই।
১৮৮৫তে প্রতিষ্ঠিত হয় কংগ্রেস; ১৮৮৯ সালের দিকে কতিপয় নারী যোগ দেন কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে। দ্বারকানাথ গাঙ্গুলির উদ্যোগে ১৮৮৯ সালে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন ছ-জন নারী, তাদের দুজন বাঙালি : একজন দ্বারকানাথের স্ত্রী কাদম্বিনী, আরেকজন জানকীনাথ ঘোষালের স্ত্রী স্বর্ণকুমারী দেবী। তারা যোগ দিয়েছিলেন স্ত্রী হিশেবে, ব্যক্তি হিশেবে নয়।
নারীদের যোগ দেয়ার উদ্যোগ নেয়ায় কংগ্রেসিরা দ্বারকানাথকে উপহাসও করে। কংগ্রেসের ষষ্ঠ সম্মেলনে, কলকাতায়, যোগ দিয়েছিলেন মাত্র একটি নারী- স্বর্ণকুমারী দেবী। কিন্তু তিনি উপস্থিত থেকেও ছিলেন অস্তিত্বহীন। সম্মেলনে ধন্যবাদ প্রস্তাব ইংরেজিতে পড়েন। কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সবার। অ্যানি বেসান্ট এ-ঘটনায় খুঁজে পান প্রতীকী তাৎপৰ্য; তিনি বলেন যে, কাদম্বিনীর অংশগ্রহণ ‘এমন প্রতীক, যা বুঝিয়ে দেয় যে ভারতের স্বাধীনতা উন্নীত করবে ভারতের নারীজাতিকে’ [দ্রা বোর্থউইক (১৯৮৪, ৩৪২)]।
কিন্তু ১৮৯০-এর দশকে শুরু হয়ে যায় জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়াশীলতা, সমাজপতিরা বলতে থাকে যে গৃহই নারীর স্থান। এরপর কংগ্রেস নারীদের নানাভাবে ব্যবহার করেছে, তাদের দিয়ে চাঁদা সংগ্ৰহ করিয়েছে, মিছিল করিয়েছে, কারাগারে পাঠিয়েছে, দু-একটি নারীকে প্রচ্ছদ ক’রে তুলেছে, কিন্তু কংগ্রেসি রাজনীতিতে নারী হচ্ছে পুরুষের পরিচারিকা। পরে কিছু নারী ভয়াবহ উদ্যোগ নিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন সন্ত্রাসবাদী শিহরণজাগানো ঘটনায়, জয় করেছেন জনচিত্ত, কিন্তু তারাও মুক্ত নারী ছিলেন না; তারাও ছিলেন পুরুষেরই পুতুল।
উনিশশতকে বাঙালি মুসলমান ভদ্রমহিলার উন্মেষ ঘটে নি, উন্নত জাতের নারী উৎপাদন করতে মুসলমান সম্প্রদায়কে অপেক্ষা করতে হয় বিশশতকের কয়েক দশক। রোকেয়ার বালিকা বিদ্যালয়ও বাঙালি মুসলমানের বিশেষ উপকারে আসে নি, কেননা ওটি আসলে ছিলো উর্দু বিদ্যালয়। ফজিলতুন্নেসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে এমএ পাশ করেন ১৯২৭-এ, তার পরীক্ষার ফল প্রায় জাতীয় উল্লাসে পরিণত হয়েছিলো; তবু পঞ্চাশ, এমনকি ষাটের দশকের আগে, উন্নত জাতের মুসলমান নারী উৎপাদনের কলটি ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় থাকে নি।
মুসলমান সমাজ ছিলো, এখনো আছে, হিন্দু ও ব্রাহ্ম সমাজের থেকে অনেক অনগ্রসর, নারীমুক্তির কথা এখনো তারা ভাবতে পারে না। বিয়েই ছিলো, আজো আছে, মুসলমান নারীশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য: এবং এর ফলে মুসলমান নারীশিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুরু হয়েছে কূট প্রতিক্রিয়াশীলতা: আবার অদ্ভুত বোরখায় ঢেকে দেয়া হচ্ছে মুসলমান নারীর মুখমণ্ডল, এবং এভাবে চলতে থাকলে দু-এক দশকের মধ্যেই হয়তো মুসলমান নারী আবার বন্দী হয়ে পড়বে অবরোপে: বাস করবে হারেমে।
মুসলমান পিতৃতন্ত্র এখন দেখা দিচ্ছে উগ্র পিতৃতন্ত্ররূপে, নারী হয়ে উঠছে তার শিকার; অনতিবিলম্বেই মুসলমান নারীকে পুরোপুরি মধ্যযুগে পাঠিয়ে দেয়া হবে, এমন আভাস এখন চারপাশে। শিক্ষা এখন সংকট হয়ে উঠছে নারীর জন্যে; সমাজ শিক্ষিত নারীকে আর্থনীতিক নিশ্চয়তা দিচ্ছে না, কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতাবশত নষ্ট হচ্ছে শিক্ষিত নারীর প্রথাগত পেশা বা বিয়ের সুযোগ।
নবমধ্যযুগীয় তরুণ তার পিতামহের মতো শিক্ষিত নারী এড়িয়ে স্ত্রী হিশেবে খুঁজছে কচি মেয়ে, যার শরীর তার চোখে বেশি আবেদনময়, এবং যার ওপর সে প্রভুত্ব করতে পারবে মধ্যযুগীয় পুরুষের মতো। উনিশ শতকে যে-ভদ্রমহিলা প্ৰজাতিটির উদ্ভব ঘটেছিলো বাঙলায়, মুসলমান পিতৃতন্ত্ৰ যেটিকে প্রতিহত করার চেষ্টা ক’রেও প্রতিরোধ করতে পারে নি, সেটি আজ বিপন্ন, শিগগিরই হয়ে উঠবে বিপন্নতর, কেননা প্ৰতিক্রিয়াশীলতার প্রথম শিকারই হয় নারী!