নারী

হুমায়ুন আজাদ

৩৯. বঙ্গীয় ভদ্রমহিলা: উন্নত জাতের নারী উৎপাদন (পর্ব-০১)

[প্রথম খন্ড]

উনিশ শতকের বাঙলা দেখতে পায় এক অভিনব জাতের নারীর উদ্ভব, যার সাথে মিল নেই তার আগের নারীদের। বাঙলার নারী আগের হাজার বছর ধরে ছিলো গাঢ় অন্ধকারে; তার নিজের কোনো সত্তা ছিলো না, স্বাধীনতার কথা সে কখনো শোনে নি, তার কোনো স্বপ্ন ছিলো কিনা তা কেউ জানে না। পুরুষ তাকে পশুর থেকেও নিকৃষ্টরূপে বঁচিয়ে রেখেছে, আগুনে পুড়েছে, ইচ্ছেমতো গ্ৰহণ করেছে ও ছেড়েছে, তাকে অবরোধের কারাগারে আটকে রেখেছে।

উনিশ শতকে পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখি ছিলো নারীর জনপ্ৰিয়তম রূপক, তবে আবহমান বাঙালি নারী পিঞ্জিরা বা ‘সোনার খাঁচা’য় পোষা ময়না ছিলো না; সে ছিলো পশুর থেকেও নিকৃষ্ট, পশুকেও মূল্যবান গণ্য করেছে বাঙালি পুরুষ কিন্তু নারীকে কখনো মূল্যবান মনে করে নি। তার জন্ম ছিলো বাঙালি পুরুষতন্ত্রের জন্যে বিভীষিকা, তার মৃত্যু ছিলো তৃপ্তিকর। তার সাথে পুরুষ কখনো আন্তরিক সম্পর্কে আসে নি, তার শরীরকেও কখনো পরিতৃপ্ত করে নি ব’লেই মনে হয়, যদিও তার ‘মদন আট গুণ’ বলে তাকে ধিক্কার দিয়েছে।

শতাব্দীপরম্পরায় বাঙালির জন্ম হয়েছে পুরুষের ক্ষণিক উত্তেজনায়, অক্রিয় নারীদেহ ক্ষণিক পীড়নের ফলে। উনিশশতকের আগের বাঙালি নারী সম্পূর্ণ মুখাবয়বহীন, পুরুষতন্ত্রের যুপকাঠে রক্তাক্ত উৎসৰ্গিত একটি প্রাণী নারী। এ-অঞ্চলের দুটি সম্প্রদায়, হিন্দু ও মুসলমান, প্রবল পিতৃতান্ত্রিক; উনিশশতক পর্যন্ত তার বাস করেছে গভীর মধ্যযুগীয়তার মধ্যে, এখনো তারা সম্পূর্ণ উঠে আসে নি ওই মধ্যযুগ থেকে বরং সেখানে ফেরার জন্যে তারা আজ খুবই ব্যগ্র। ঐতিহাসিকভাবে এ-অঞ্চলে অধিকাংশ পুরুষেরই কোনো স্বতন্ত্র সত্তা ছিলো না, তারাই ছিলো মুষ্টিমেয় সমাজপতির প্রচণ্ড পীড়নের শিকার; তাই নারীর দুরবস্থা ছিলো এখানে শোচনীয়তম। তারা ক্রীতদাসের ক্রীতদাসী ছিলো না, তারা ছিলো পশুর অধীনে পশুতর নারী।

উনিশশতকে উৎপন্ন হয় এক নতুন জাতের নারী, যার সাথে মিল নেই তার পূর্ব প্রজাতির। যে-প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় তারা, তার নাম শিক্ষা। শিক্ষার ফলে উৎপন্ন অভিনব নারীদের বোঝানোর জন্যে দরকার পড়ে অভিনব শব্দ, তাদের জন্যে ইংরেজির অনুকরণে তৈরি করা হয় এক অভিনব শব্দ; ভদ্রমহিলা। উনিশশতকে তারা ছিলো সমগ্র বাঙালি নারীসমুদ্রে ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো, আঙুলে গোণা যেতো তাদের, সমকালের অধিকাংশের সাথে তাদের লিঙ্গগত মিল ছাড়া আর বেশি মিল ছিলো না।

আজো যেমন ভদ্রমহিলার সমগ্র বাঙালি নারীসমাজের একটি ছোটো সুবিধাভোগী অংশ, তারাও ছিলো তেমনই। সমাজে তারা দেখা দিয়েছিলো এক নতুন প্রপঞ্চরূপে, সমাজ তাদের চেয়েছে এবং চায় নি, আজো যেমন সমাজ তাদের চায় ও চায় না। এ-ভদ্রমহিলারা হয়ে আছে বাঙালি নারীসমাজের এক বিচ্ছিন্ন অংশ, পুরুষতন্ত্রের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন। ওই নারীরা ছিলো শিক্ষা নামের অভিনব প্রক্রিয়ার অভিনব উৎপাদন। শিক্ষায় সাথে বাঙালি নারীর কোনো সম্পর্ক ছিলো না।

উনিশ শতকের আগে, যদিও ইতিহাসে মেলে হটী বিদ্যালঙ্কার বা চন্দ্রাবতীর মতো দু-একটি নাম। হিন্দু সংহিতা লিখে তার শিক্ষা নিষিদ্ধ ক’রে দিয়েছিলো, মুসলমানও তাই করেছিলো; মুসলমানের অবস্থা ছিলো আরো নিকৃষ্ট। উনিশ শতকে কিছু নারী হঠাৎ আলো দেখতে পায়। তারা সবাই ব্ৰাহ্ম, দেশি খ্রিস্টান, ও হিন্দুসম্প্রদায়ের, সমাজের উঁচু ও উচ্চবিত্ত শ্রেণীর। ওই আলো, শিক্ষা, তাদের বদলে দিয়েছিলো; এমন নারী দেখা দিয়েছিলো বাঙলায়, যা আগে কখনো দেখা যায় নি। কিন্তু তারা ছিলো পুরুষতন্ত্রেরই পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তুত। তারা নিজেরা স্থির করে নি। তারা কী হবে, নিজেদের জীবন কীভাবে গড়ে তুলবে, তারা নিজেরা চায় নি নিজেদের স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন; তারা উৎপাদিত হয়। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষাকলে পুরুষতন্ত্রের জীবনপরিকল্পনা অনুসারে। তবু তারা অভিনব, কিন্তু অসম্পূর্ণ।

উনিশ শতকে, যেমন আজো, পুরুষ নারীকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে ও দিচ্ছে নিজেরই স্বার্থে নিজেরই সুবিধার জন্যে; নারীর স্বার্থে নয়। তারা চেয়েছে সমাজের সব কিছু থাকবে অক্ষুণ্ণ, অটুট থাকবে শোষণের সমস্ত ব্যবস্থা, পুরুষ থাকবে প্রভু নারী থাকবে তার অধীন, কিন্তু নারী কিছুটা শিক্ষা পাবে। শিখবে লেখাপড়া, পাশও করবে, কিন্তু থাকবে প্রথাগত পদানত নারী। পুরুষ চেয়েছে নারী তার ভূমিকা পালন করে যাবে মনুসংহিতানুসারে; এবং হবে সহচরী, উন্নত জাতের শয্যাসঙ্গিনী, প্রসবকারিণী, ধাত্রী; হবে শিক্ষিত পরিচারিকা। তারা চেয়েছে ভিক্টোরীয় নারীরূপে দেখা দেবে সীতাসাবিত্রী; তারা চেয়েছে শিক্ষিত সতী ও পতিব্ৰতা।

উনিশ শতকি পুরুষতন্ত্র শিক্ষার ক্ষেত্রে লিঙ্গবাদ পুরোপুরি বজায় রেখে সূচনা করেছিলো স্ত্রীশিক্ষার; নারীর স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসন তাদের লক্ষ্য ছিলো না, বরং সাবধান থেকেছে যাতে স্বাধীনতা স্বায়ত্তশাসনের মতো। আপত্তিকর ব্যাপারগুলোতে উৎসাহী না হয়ে ওঠে নারীরা। হাজার বছর ধরে পুরুষতন্ত্রে দীক্ষিত নারীরাও দিয়েছে। পুরুষতন্ত্রের কাম্য অনুকূল সাড়া, তারাও সাধারণত জয়গান গেয়েছে প্রথার; বিদ্রোহ সাধারণত তাদের স্বভাবে ছিলো না।

পুরুষতন্ত্র তাদের জন্যে যত্নের সাথে শিক্ষক বেছেছে, তাদের জন্যে এমন পাঠ্যবই লিখতে চেয়েছে যাতে নারী হয়ে ওঠে নারী, যদিও ঠিক মতো লিখতে পারে নি; পুরুষতন্ত্র লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করেছে যাতে শিক্ষা ভূমিকা বদলে দিয়ে নারীকে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী করে না তোলে। তারা চেয়েছে শিক্ষিত নারীসম্বলিত প্রথাগত বা প্ৰাচীন ভারতবর্ষ। তারা উৎপাদন করতে চেয়েছে বাহ্যিকভাবে উন্নত জাতের নারী, যারা পুরুষের সেবা করবে উন্নতভাবে, প্রমোদ যোগাবে উন্নতভাবে, গর্ভবতী হবে ও সন্তান লালন করবে উন্নতভাবে, কিন্তু থেকে যাবে। পুরোনো নারী, রমণী, অবলা, বামা, সতী, ও পুরুষাশ্ৰিত। বাঙলায় নারীশিক্ষা প্রথম থেকেই নারীকে নষ্ট ক’রে দেয়, তার বিকাশের পথ দেয় বন্ধ করে; তাই দেড় শো বছরের নারীশিক্ষা শুধু উন্নত জাতের নারী উৎপাদন ক’রে নিঃশেষ হয়, ব্যর্থ হয় নারীকে মুক্ত বা স্বাধীন করতে।

উন্নত জাতের বাঙালি নারী, যার নাম দেয়া হয়েছে ভদ্রমহিলা, উৎপাদনের স্বপ্ন বাঙালি পুরুষ প্রথম দেখে নি, দেখে বিদেশিরা। রামমোহন উনিশশতকের তৃতীয় দশকে নারীকে বাঁচান। শ্মশানের গ্রাস থেকে, বিদ্যাসাগর দু-দশক পর বিধবাকে দেন আইনসম্মত সংসার, কিন্তু নারীকে শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ তাঁরা নেন নি। বাঙলায় উন্নত জাতের, ভিক্টোরীয়, নারীর স্বপ্ন দেখে প্রথম ইংরেজ ধর্মপ্রচারকেরা, প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করে তারাই।  বাঙালির প্রথম প্রয়াস ছিলো ওই উদ্যোগ ব্যৰ্থ ক’রে দেয়া, স্বপ্ন বার বার ভেঙে দেয়া।

ওই ইংরেজ ধর্ম ও শিক্ষাপ্রচারকেরাও প্ৰগতিশীল গোত্রের ছিলো না, তারা বিশ্বাস করতো না। নারীমুক্তিতে; তারা বিশ্বাস করতো কিঞ্চিৎ শিক্ষায়। নারীশিক্ষার সঙ্গে এদেশে বিদেশি ও দেশি যারা প্রথম জড়িত ছিলো, তারা ছিলো ভিক্টোরীয়; ভিক্টোরীয় যুগের সমস্ত কুসংস্কারে তারা ছিলো আচ্ছন্ন, যদিও ভিক্টোরীয় কুসংস্কারকেই তারা মনে করতো সভ্যতা। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙলায় যখন নারীশিক্ষা একটু ব্যাপকভাবে শুরু হয়, তখন নারীপুরষ সম্পর্কে ভিক্টোরীয় জনপ্রিয় ধারণা ছিলো যে নারী ও পুরুষ পৃথক ও পরিপূরক: নারীর স্থান গৃহ, পুরুষের স্থান বাইর।

টেনিসনের প্রিন্সেস (১৮৪৭), রাসকিনের সিসেম অ্যান্ড লিলিজ-এ (১৮৬৫) প্রস্তাবিত হয় যে- পৃথক এলাকা তত্ত্ব বা পরিপূরকতত্ত্ব, তাই গ্ৰহণ করেছিলো তারা, মিলের দি সাবজেকশন অফ উইমেন-এ (১৮৬৯) নারীর যে-অধিকার দাবি করা হয়, তা ছিলো তাদের কাছে ভীতিকর। টেনিসন, রাসকিন ও ভিক্টোরীয়রা চেয়েছিলেন নারী কিছুটা শিক্ষা পাবে, যা হবে মূলত নিরর্থক, হবে পুরুষের আকর্ষণীয় সহচরী। নারী কিছুটা অগভীর ব্যবহারিক জ্ঞান আয়ত্ত করবে, কিন্তু তার জ্ঞান কাজে খাটাতে পারবে না, সে হবে স্বামীর সুখকর সেবিকা ও বিনোদসঙ্গিনী।

নারী হবে পুরুষের বাইবেলি ‘হেল্পমিট’ বা দাসী। উনিশ শতকের নারীদের জন্যে ও নারীদের সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর নাম বেশ তাৎপর্যপূর্ণ: বামবোধিনী পত্রিকা (১৮৬৩), অবলাবান্ধব (১৮৬৯), বঙ্গমহিলা (১৮৭৫), ভারতী (১৮৭৭), পরিচারিকা (১৮৭৮), পাক-প্ৰণালী (১৮৮৩), গার্হস্থ্য (১৮৮৪), মহিলা-বান্ধব (১৮৮৭), দাসী (১৮৯৭), মহিলা (১৮৯৭), অন্তঃপুর (১৮৯৮)।  পরিচারিকা, আর দাসীধর্মী নামেই জানিয়ে দিয়েছে নারী আসলে কী?

যে-ব্রাহ্মরা এদেশে প্রবল উৎসাহের সাথে এগিয়ে গিয়েছিলো নারীশিক্ষার দিকে, তারা ছিলো বাইবেলি সহচরীতত্ত্বের অনুরাগী, আর দেশি খ্রিস্টানরা তো ধর্মীয় কারণেই ছিলো তার অনুরাগী। বাঙালি পুরুষ সহস্ৰক ধ’রে নিরক্ষর নারীর আত্মোৎসর্গপরায়ণতা, ত্যাগ, সতীত্ব, পাতিব্ৰত্য উপভোগ করেছে, উনিশশতকে তারা উপভোগ করতে চায় শিক্ষিত সতীত্ব, মাতৃত্ব, পাতিব্ৰত্য, আত্মোৎসর্গপরায়ণতা। রাসকিন-টেনিসনি পৃথক এলাকাতত্ত্ব ছিলো নারীর জন্যে কারুকাজ করা নতুন শেকল, নারীর জীবন ব্যর্থ ক’রে দেয়ার ভিক্টোরীয় চক্রান্ত [দ্ৰ নারীর শত্রুমিত্ৰ]।

তাই উনিশ শতকের বাঙলায় নারীশিক্ষার যে-ধারা প্রবর্তিত হয়, তা উৎপাদন করেছে এক ধরনের উন্নত জাতের নারী, যার পবিত্র কাজ পুরুষতন্ত্রের সেবা করা। তখন বাঙলায় নারী বোঝানোর জন্যে পিতৃতান্ত্রিক শব্দ ছিলো ‘স্ত্রীলোক’, ‘মাগীও’ ছিলো বহুলপ্রচলিত; কিন্তু এ-নতুন জাতের নারীর জন্যে ভিক্টোরীয় আদলে তৈরি করা হয় একটি নতুন শব্দ; ভদ্রমহিলা।

‘মহিলা’ শব্দও তাদের জন্যে যথেষ্ট মনে হয় নি, কেননা শব্দটি সম্ভবত তৈরি করেছিলো ভিক্টোরীয় ভাবাদর্শদীক্ষিত পিউরিটান ব্ৰাহ্মরা, যদিও মহিলা’র অর্থই ‘ভদ্র বা সম্ভ্রান্ত নারী’। রাসকিন বিলেতি নারীদের কপটভাবে তোষণের জন্যে প্রস্তাব করেছিলেন ‘লেডি’ শব্দটি, যার অর্থ তিনি করেছিলেন ‘ব্রেড-গিভার’, যার কাজ দীনদক্ষিণা করা বা ভিক্ষা দেয়া। ওই ‘লেডি’র বাঙলাই হয় ‘ভদ্রমহিলা’ : ব্যাকরণিক ও প্রজাতিগতভাবে এক অভিনব নারী, কিন্তু মর্মমূলে প্রথাগত।

বাঙলায় সুযোগসুবিধা চিরকালই প্রাপ্য একমুঠো মানুষের, শিক্ষার সুযোগও পেয়েছিলো একমুঠো নারী। মুসলমানেরা তখন শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ দূরে ছিলো; আর এ-দেশের অধিকাংশ যারা, সে-দরিদ্রদের শিক্ষা কেনো জীবনেরই অধিকার নেই, তাই তারা শিক্ষা থেকে সব সময়ই বহু দূরে। মুসলমানদের মধ্যে যারা উচ্চবিত্ত ছিলো, তারা অধিকাংশই বাঙালি ছিলো না; আর বাঙালি মুসলমান মাত্রই ছিলো দরিদ্র, এবং সমগ্র মুসলমান সমাজ ছিলো মধ্যযুগাচ্ছন্ন।

শিক্ষালাভের সুযোগ ছিলো উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের, ব্ৰাহ্মদের, ও দেশি খ্রিস্টানদের। অধিকাংশ সামন্ত হিন্দু ওই সুযোগের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ক’রে থেকেছে৷ অন্ধকারে, ব্রাহ্ম ও দেশি খ্রিস্টানরা সুযোগ নিতে চেয়েছে প্ৰাণপণে। তখনও দেশ জুড়ে জমাট মধ্যযুগ, কুসংস্কারের অপ্রতিহত আধিপত্য; নারী সম্পূর্ণরূপে নিশ্চুপ। বাঙলার পুরুষতন্ত্র নারীকে মুখ খুলতে দেয় নি আবহমান কাল ধ’রে, নারী তার কথা বলে নি কখনো, সে হয়ে উঠেছিলো অবলা ও নির্বাক।

নারী জানতো লেখাপড়া শেখার অর্থ বিধবা হওয়া, নারী জানতো কালিকলমের সংস্পর্শ তার জীবনকে শোচনীয় ক’রে তুলবে; তাই নারীর বুকে শিক্ষার জন্যে আকুলতা জাগার কথা নয়; তবুও আকুলতা জেগেছে, কিন্তু নারী তা প্ৰকাশ করতে পারে নি। উনিশশতকের নারীদের আত্মজীবনীতে মাঝেমাঝে প্রকাশ পেয়েছে লেখাপড়ার জন্যে লোকোত্তর আকুলতা, রাসসুন্দর দিয়েছেন যার অবিস্মরণীয় বর্ণনা, সে-আকুলতা নিশ্চয়ই জন্ম নিয়েছে অজস্র নারীর বুকে; কিন্তু তা কখনো প্ৰকাশ পায় নি।

উনিশশতকে নারীশিক্ষার কথা প্ৰথম বলে বিদেশি পুরুষেরা, পরে দেশি পুরুষেরা: নারীরা নয়। বলার কোনো উপায় ছিলো না, বলার মতো কোনো মানুষ ছিলো না। বাঙলার দরিদ্র নারীরা চিরকাল বাইরে বেরিয়েছে, বাইরের কাজ করেছে, তারা স্বাধীনতার আগুনের মধ্যে জুলেছে; কিন্তু উচ্চবর্ণের সামন্ত পরিবারের নারীরা বন্দী থেকেছে৷ অবরোধে। ভারতবর্ষে অবরোধ নিয়ে এসেছিলো মুসলমানেরা, এবং হিন্দুরা ওই অবরোধে মুসলমানদের মতোই অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো।

অবরোধের শিকার ছিলো উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের নারীরা। ওই অবরুদ্ধ নারীদের বোঝানোর জন্যে বেশ কিছু শব্দ মেলে বাঙলায় : অন্তঃপুরিকা, পুরনারী, পুরলক্ষ্মী, পুরাঙ্গনা, পৌরস্ত্রী, পুরস্ত্রী, পুরমহিলা, পুরবালা, পুরবাসিনী, অন্তঃপুরবাসিনী, পৌরাঙ্গনা, অসূৰ্যসম্পশ্য। পাথরখণ্ডের মতো এ-শব্দগুলোই বুঝিয়ে দেয় কেমন শক্ত দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছিলো বাঙলার উচ্চবিত্ত উচ্চবর্ণের নারীদের।

একটি সামন্ত জমিদার বা ধনী গৃহস্থের বাড়ির বর্ণনা দেয়া যাক। ওই বাড়িটি বিশাল; ওই গৃহের সম্মুখভাগের বড়ো অংশ জুড়ে সদরমহল, এবং পেছনের দিকে অল্পজায়গা জুড়ে অন্তঃপুর বা অন্দরমহল বা জেনানা, যেখানে বন্দী থাকতো নারীরা। অন্দরমহলটি হতো অন্ধকার, অস্বাস্থ্যকর, যাতে ধুকে ধুকে বাঁচতো উচ্চবর্ণের নারীরা। তাদের জীবনে কোনো আলো ছিলো না, জীবন ছিলো না। বাড়ির কর্তাও দিনের বেলা অন্দরমহলে ঢুকতে পারতো না; রাতে হয়তো কখনো এসে আকস্মিকভাবে মিলিত হতো স্ত্রীর দেহের সাথে। সামন্ত প্ৰভুদের অবশ্য স্ত্রীসহবাসের বিশেষ শারীরিক প্রয়োজন পড়তো না, বাগানবাড়িতে ও পতিতাপল্লীতে তাদের প্রয়োজন মিটাতো, তবু তারা উত্তরাধিকার সৃষ্টির গভীর আগ্রহেই মিলিত হতো স্ত্রীদের শরীরের সাথে।

উনিশ শতকের আগে বাঙলায় স্বামীস্ত্রীর মধ্যে কোনো মানবিক সম্পর্ক ছিলো না, উচ্চবিত্তের পুরুষ পতিতার সাথে যতোটা সময় কাটাতো স্ত্রীর সাথে তার একাংশও কাটাতো না; মানসিক সম্পর্কের কথা ছিলো অজানা, শারীরিক সম্পর্ক ছিলো খণ্ড উত্তেজনার। তাই নারীর কথা কেউ শুনতে পায় নি, নারী কারো কাছে নিজের কথা বলে নি। দরিদ্র নারীরা ভাত নিয়ে চিরকাল চিৎকার করেছে, জীবনের কথা বলার অধিকার তাদের ছিলো না। পুরুষই চিরকাল বলেছে নারীর কথা, উনিশশতকে নারীর কথা বলে, আর নারীর জন্যে জীবনপরিকল্পনা করে পুরুষই।

১৮১৭তে যেদিন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেদিনই অনিবার্য হয়ে ওঠে নারীশিক্ষা। ওই কলেজ যে-অভিনব পুরুষ সৃষ্টির ভার নেয়, তার জন্যে যে অপরিহার্য হয়ে উঠবে। অভিনব ধরনের নারী, তা হয়তো সেদিন কেউ ভাবে নি, কিন্তু সেদিনই হয় নারীশিক্ষার বীজ বোনা। নারীশিক্ষা এদেশে নারীর জন্যে হয় নি, হয়েছে পুরুষের জন্যে; নারীশিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো নারী শিক্ষিত হবে, তার ফল ভোগ করবে পুরুষ।

১৮১৮তে চুঁচুড়ায় এক ইংরেজ ধর্মপ্রচারক প্ৰতিষ্ঠা করেন। এদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় সম্ভবত ক্রাইষ্টের করুণা নারীজাতির কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে, কিন্তু তার করুণা পাওয়ার জন্যে বিশেষ কারো আগ্রহ জাগে নি। মেরি অ্যান কুক ১৮২৩ থেকে কয়েক বছরের মধ্যে স্থাপন করেন বেশ কিছু বালিকা বিদ্যালয়, কিন্তু সেগুলো সফল হয় নি; কেননা হিন্দু কলেজের ছাত্ররা তখনো নিজেদের চাহিদা জানায় নি। তখনো সৃষ্টি হয় নি লেখাপড়া জানা মেয়ের জন্যে যুবকদের বুকে আবেগ, বা শিক্ষিত বউবাজার।

কিন্তু ১৮৩০-এর দশকেই দেখা দেয় এক অভিনব ব্যাপার, স্বামীরা বাড়িতে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করে স্ত্রীদের। স্পষ্ট হয়ে ওঠে একটি সত্য যে হিন্দু কলেজে অভিনব পুরুষ তৈরি হয়েছে, তার জন্যে দরকার অভিনব নারী।  ১৮৩৮–এই সমাচার দর্পণ-এ চিঠি বেরোয়; ‘দিবসীয় মানসিক ও শারীরিক পরিশ্রমের পর পুরুষের যে সান্তনা ও সাহায্যের আবশ্যকতা তাহা কি তিনি ঐ অজ্ঞান স্ত্রীর নিকটে পাইতে পারিবেন?

তিরিশের দশক থেকে ফল ফলতে শুরু করে হিন্দু কলেজের; তখন যারা ওই কলেজে পড়তে, বা পড়া শেষ করেছে তাদের পক্ষে পিতামহীকে নিয়ে জীবন কাটানো সম্ভব ছিলো না। তাই তরুণ স্বামীরা নিজেদের চাহিদা অনুসারে ঢালাই করতে শুরু করে স্ত্রীদের, নিজেরাই প্ৰস্তুত করতে শুরু করে স্বপ্নের স্ত্রী। শুরু হয় বঙ্গীয় হাওয়া উপাখ্যান; ব্রাহ্ম-হিন্দু আদমেরা পাঁজরের অস্থির বদলে পুস্তক দিয়ে সষ্টি করতে থাকে ব্রাহ্ম-হিন্দু হাওয়া। নিজের স্বার্থে নিজের উপভোগের জন্যে।

তরুণ স্বামীরা দেখা দেয় শিক্ষকরূপে, এবং তিরিশের দশক থেকে কয়েক দশক ধ’রে বাড়িতে স্বামীর কাছে লেখাপড়া শেখে অনেকেই: শেখে বেশ ভালো লেখাপড়া। কৈলাসবাসিনী দেবী, দ্রবময়ী, বামাসুন্দরী, কুমুদিনী, নিস্তারিণী দেবী, জ্ঞানদানন্দিনী ও আরো কজন গৃহশিক্ষিত নারী এখন বিখ্যাত। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রথম ভারতবর্ষীয় আইসিএস, যেভাবে স্ত্রীকে শিক্ষিত ক’রে তোলেন, তা নিজের জন্যে উপযুক্ত স্ত্রী সৃষ্টির অনন্য উদাহরণ হয়ে আছে!

সত্যেন্দ্রনাথের উদ্যম, উদ্দীপনা ও প্রগতিশীলতাকে স্বীকার না ক’রে পারা যায় না, কিন্তু ওই রীতিতে শিক্ষিত নারী সৃষ্টিই বাঙলায় নারীশিক্ষার এক মৌল দুর্বলতা। স্বামী শিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি করে না, সৃষ্টি করে শিক্ষিত স্ত্রী; গড়ে নেয় নিজের মতো ক’রে, স্ত্রী হয় স্বামীর ব্যবহারের সুখকর সামগ্ৰী।  জ্ঞান্দানন্দিনী যদি অন্য কারো হাতে পড়তেন, তাহলে হয়তো অশিক্ষিতই থাকতেন; বা কোনো উকিলের স্ত্রী হ’লে তিনি হতেন উকিলের স্ত্রী। এতে নারীর মুক্তি ঘটে না, ব্যক্তিগতভাবেও নয়, শ্রেণীগতভাবে তো নয়ই। মুক্তি না ঘটলেও কিছুটা মুক্তি ঘটেছে অবশ্যই, তাতে ব্যক্তিগতভাবে উপকার হয়েছে অনেকের; কিন্তু বাঙালি নারীর তাতে বিশেষ উপকার হয় নি।

১৮৪৯ সালে জে ই ডি বেথুন বা বিটন কলকাতায় স্থাপন করেন ভিক্টোরিয়া গার্লস স্কুল, পরে শার নাম হয় বেথুন বালিকা বিদ্যালয়। এ-বিদ্যালয় থেকেই শুরু হয় বাঙালি নারীদের ধারাবাহিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ইংরেজের উদ্যোগে, ও বিদ্যাসাগরের মতো দেশি উৎসাহীদের সহযোগিতায়। দেশি বুড়োদের নারীশিক্ষায় উৎসাহ থাকার কথা ছিলো না, কেননা ওই শিক্ষার ফল তারা ভোগ করতো না; তাই তারা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় নি।

রক্ষণশীল রাধাকান্ত দেবের উৎসাহে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার লিখেছিলেন স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক (১৮২২); রাধাকান্ত নারী শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন, কিন্তু নিজের কন্যাদের শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন না; যেমন অনেক পরে রবীন্দ্রনাথও নিজের কন্যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেন নি। বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উৎসাহ ছিলো বিদেশিদের, তারা জীবনে মহৎ কিছু করতে চেয়েছিলো, আর ছিলো তরুণ শিক্ষিতদের, কেননা তারা স্ত্রী হিশেবে পেতে চেয়েছে শিক্ষিত নারী। তরুণদের বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গতি ছিলো না, তাই বিদেশিরাই ছিলো বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা।  বিদেশিরা চেয়েছিলো ভিক্টোরীয় নারী তৈরি করতে, তরুণরা চেয়েছিলো শিক্ষিত বা আধুনিকা স্ত্রী।

১৮৭০-এর দশকে লেখাপড়া জানা বউর প্রবল চাহিদা সৃষ্টি হয়ে যায়, তাই দিকে দিকে ব্যাঙের ছাতায় মতো বালিকা বিদ্যালয় দেখা দিতে থাকে, যেগুলোর লক্ষ্য মেয়েদের বিয়ের বাজারে আকর্ষণীয় ক’রে তোলা। ওই সব বিদ্যালয় টেকে নি। জ্ঞানাঙ্কুর ১৮৭৫ সালেই জানায় যে ‘এক্ষণকার যুবকেরা শিক্ষিত স্ত্রী চাহেন, কেনই বা না চাহিবেন? যুবকদের লেখাপড়া শিখাইলে স্ত্রীদিগকে অবশ্যই লেখাপড়া শিখাইতে হইবে…আরো কিছু দিন পরে, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সমাজে অশিক্ষিত স্ত্রীলোকদিগের বিবাহ হওয়া ভার হইয়া উঠিবে। [উদ্ধৃত গোলাম মুরশিদ (১৯৮৫, ৩২)]।

তখন পর্যন্ত একটি বাঙালি মেয়েও প্রবেশিকা পাশ করে নি, কিন্তু শিক্ষিত স্ত্রীর বাজার তৈরি হয়ে গেছে, বউ হওয়ার জন্যেই দরকার পড়ে ক খ গ ঘ এ বি সি ডি লেখাপড়া। শিক্ষিত বাউর বিবোধীরও অভাব ছিলো না। চন্দ্ৰশেখর মুখোপাধ্যায় জ্ঞানাঙ্কুর-এ ১৮৭৩-এ লিখেছিলেন, ‘বিদ্যাবতী স্ত্রীলোকের সংসৰ্গ অপেক্ষা নরকবাস বরং ভাল।’ প্রথম যে-বাঙালি মেয়েটি প্রবেশিকা বা এন্ট্রান্স আর্টস পাশ করেন, তিনি দেশি খ্রিস্টান চন্দ্ৰমুখী বসু। দেরাদুন বিদ্যালয় থেকে ১৮৭৬-এ তিনি পাশ করেন।

তাঁর দু-বছর পর ১৮৭৮-এ প্রবেশিকা পরীক্ষা দেন কাদম্বিনী বসু ব্ৰাহ্মা, যিনি এক নম্বরের জন্যে প্রথম বিভাগ পান নি। ১৮৮০তে চন্দ্ৰমুখী ও কাদম্বিনী ফাষ্ট্র আর্টস পরীক্ষা দেন, দুজনেই বিএ পাশ করেন। ১৮৮৩তে। চন্দ্ৰমুখী ১৮৮৪ তে এমএ পাশ করেন, কাদম্বিনী চিকিৎসাবিদ্যায় ভর্তি হন। বিদ্যাসাগর চন্দ্ৰমুখীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শেক্সপিয়রের রচনাবলি উপহার দেন। ১৯০০ সালের মধ্যে ২৭জন নারী বিএ পাশ করেন। শিক্ষা খুব এগোয় নি, কিন্তু তখন আলোড়ন তৈরি হয়েছে বিপুল।

 


 নারী

শেয়ার করুন —
5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top