দুদিন পরে অর্থাৎ রবিবার, টাইমসে ফেলুদার বিজ্ঞাপন বেরোল। আর আশ্চর্য ব্যাপার— তার পরদিনই বিজ্ঞাপনের ফল পাওয়া গেল। সোমবার সকাল সাড়ে আটটায় ফেলুদার ফোন বেজে উঠল। মিনিটখানেক কথা বলে ফেলুদা ফোনটা রেখে বলল, অত্যন্ত রুক্ষ মেজাজের লোক। নাম আর্চিবল্ড ক্রিপস। বলল ওর কাছে পিটার ডেক্সটরের খবর আছে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই এসে যাচ্ছে লোকটা। রগড় হতে পারে। তুই লালমোহনবাবুকে খবর দে।
লালমোহনবাবু তৈরি ছিলেন, এসে বললেন এত তাড়াতাড়ি রেজাল্ট পাওয়া যাবে সেটা উনি ভাবতেই পারেননি।
সোয়া নটার সময় দরজায় টাকা পড়ল। মৃদু নয়, বেশ জোরে। আমি দরজা খুললাম। রুক্ষ গলার সঙ্গে মানানসই রুক্ষ চেহারাওয়ালা একজন ভদ্রলোক ঢুকে এলেন। তাঁর দৃষ্টি প্রথমে গেল জটায়ুর দিকে।
আর ইউ মিস্টার মিটার?
নো নো। হি, হি।
লালমোহনবাবু ফেলুদার দিকে দেখিয়ে দিলেন। ক্রিপস সাহেব একটা চেয়ার টেনে এনে তাতে বসে ফেলুদার দিকে কঠোর দৃষ্টি দিয়ে বললেন, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো অ্যাবাউট পিটার ডেক্সটর।
প্রথমত, সে এখন কোথায়?
হি ইজ ইন হেভন।
তার মৃত্যু হয়েছে শুনে আমি দুঃখিত। কবে হল?
আজ নয়। অনেক কাল আগে। হোয়েন হি ওয়জ ইন কেমব্রিজ।
উনি কেমব্রিজে পড়তেন?
হ্যাঁ, আর মূর্খের মতো ক্যাম নদীতে নৌকো চালাতে গিয়েছিল।
মূর্খের মতো কেন?
কারণ ও সাঁতার জানত না। নৌকো উলটে গিয়ে জলে পড়ে তার মৃত্যু হয়।
ওঁরা তো শুনেছি অনেক ভাইবোন ছিলেন।
ফাইভ ব্রাদার্স অ্যান্ড টু সিসটারস। তার মধ্যে শুধু দুজনের খবর জানি-বড় ছেলে জর্জ আর ছোট ছেলে রেজি:ন্যান্ড। জর্জ আর্মিতে ছিল, ইণ্ডিপেন্ডেন্সের পর এখানে চলে আসে। বলত শিখ আর গুর্থ ছাড়া ও দেশের সবাই হয় বদমাইস না হয়। অকৰ্মণ্য। ডেক্সটারদের কেউই ইণ্ডিয়ান নিগারদের পছন্দ করে না।
নিগার? নিগার তো ভারতবর্ষে নেই। ইন ফ্যাক্ট, আমেরিকাতেও আজকাল নিগ্রোদের আর কেউ নিগার বলে না।
ফেলুদার মুখ গম্ভীর। বলল, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ভারতীয়দের সম্বন্ধে আপনার ধারণাও ডেক্সটরদের মতোই।
তা তো বটেই। একশোবার।
তা হলে আপনার কাছ থেকে আর কোনও ইনফরমেশন আমি চাই না। যেটুকু দিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।
এই গরম কথাগুলো শুনে ক্রিপস সাহেব যেন একটু নরম হলেন। বললেন, আই অ্যাম সরি ইফ আই হ্যাভ আফেন্ডেড ইউ। রেজিন্যান্ডের কথাটা বলেই আমি উঠছি। রেজি ন্যান্ড ওদের ছোট ভাই। সে ইন্ডিয়াতে একটা চা বাগানে আছে, কিন্তু বেশিদিন থাকবে না।
ফেলুদা চেয়েই রয়েছে ভদ্রলোকের দিকে, মুখে কিছু বলছে না।
বিকজ হি হ্যাঁজ ক্যানসার, বলে চললেন ক্রিপস। ও গিয়েছিল শুধু পয়সা রোজগারের জন্য। ভারতবর্ষের ওপর ওর কোনও মমতা নেই।
ফেলুদা উঠে দাঁড়াল।
থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার ক্রিপস। আমার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই।
ক্রিপসও কেমন যেন বাকা-বোকা ভাব করে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হঠাৎগুড ডে বলে সটান ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কী জঘন্য লোক মশাই, দরজা বন্ধ হবার সঙ্গে সঙ্গে বললেন লালমোহনবাবু। তবে আপনি লন্ডনে বসে একজন সাহেবকে যে ভাবে দাবড়ানি দিলেন, তার কোনও জবাব নেই।
যাই হোক, বলল ফেলুদা, এর কাছ থেকে অন্তত একটা জরুরি তথ্য পাওয়া গেল। পিটার ডেক্সটর কেমব্রিজে ছিলেন এবং নৌকোডুবি হয়ে মারা যান।
এখন কী করা?
সময় হু হু করে বেরিয়ে যাচ্ছে, বলল ফেলুদা। পরশু আমাদের ফেরার দিন, ভুলবেন না। আজই দুপুরে তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে কেমব্রিজ যাত্রা।
আমরা দেড়টার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম।
পিকাডিলি সার্কাস থেকে প্রথমে লিভারপুল স্ট্রিটে গিয়ে সেখানকার রেল স্টেশন থেকে সাধারণ ট্রেন ধরে যেতে হয় কেমব্রিজে। পৌঁছতে লাগে এক ঘণ্টা। এখানে ট্রেন খুব দ্রুত চলে, আর চড়েও আরাম কারণ কামরাগুলো অত্যন্ত পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন।
সুন্দর শহর কেমব্রিজ, তার মধ্যে ইউনিভার্সিটি দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে। পাশাপাশি অনেকগুলো কলেজ আছে—ফেলুদা বলল আটশোটা—তবে নিশানাথবাবু বলে দিয়েছিলেন রঞ্জন মজুমদার ট্রিনিটি কলেজে পড়তেন, তাই আমরা সেখানেই খোঁজ করলাম। জানা গেল যে ১৯৫১-তে রঞ্জন মজুমদার ইতিহাস পড়তে ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন, এবং তার সঙ্গে একই ক্লাসে ছিল পিটার ডেক্সটার।
এই পিটার ডেক্সটর তো নৌকাডুবি হয়ে মারা যান? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা। যে ভদ্রলোক আমাদের সাহায্য করছিলেন—নাম মিস্টার টেলর—তিনি বললেন যে তিনি মাত্র সাত বছর হল জয়েন করেছেন, কাজেই পুরনো ঘটনা কিছুই জানেন না।
তবে এখানে একজন খুব পুরনো গার্ডনার আছে, চল্লিশ বছর হল এখানে কাজ করছে, নাম হুকিনস। তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।
ফেলুদা বাগানেই হুকিনসকে পাকড়াও করল। গায়ের চামড়া এখনও বেশ টান-টান, তবে চুল সাদা। তাও দিব্যি কাজ করে চলেছে।
তুমি এখানে অনেকদিন আছ, তাই না? ফেলুদা মোলায়েম সুরে প্রশ্ন করল।
ইয়েস, বলল হুকিনস। তবে আর বেশিদিন নয়, কারণ আমার রিটায়ারমেন্টের সময় এসে গেছে। আমার বয়স তেষট্টি হল, কিন্তু এখনও পরিশ্রম করতে পারি। আমার বাড়ি চ্যাটাওয়ার্থ স্ট্রিটে—এখান থেকে দু মাইল। রোজ হেঁটে আসি, হেঁটে ফিরি।
ছাত্রদের সঙ্গে তোমার কীরকম সম্পর্ক?
খুব ভাল। দে অল লাভ মি। আমার সঙ্গে এসে গল্প করে, ঠাট্টা তামাসা করে, আমাকে সিগারেট দেয়, বিয়ার দেয়। আই গেট অ্যালং ভেরি ওয়েল উইথ দেম।
পুরনো ঘটনা মনে থাকে তোমার? স্মরণশক্তি কেমন?
হালের ঘটনা ভুলে যাই, কিন্তু পুরনা কিছু কিছু মনে আছে। অবিশ্যি কত পুরনা তার ওপর নির্ভর করে।
মনটাকে চল্লিশ বছর পিছিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?
হোয়াই?
তোমাদের এখানে ক্যাম নদীতে নৌকো চালায় না ছেলেরা?
শুধু ছেলেরা কেন, মেয়েরাও চালায়।
কোনও নৌকোডুবির ঘটনা মনে পড়ছে?
হুকিনস মাথা নেড়ে-গলাটাকে ভারী করে বলল, ইটস এ স্যাড স্টেরি, স্যাড স্টোরি। একটি ইংরেজ ছেলে, নাম মনে নেই। নৌকো উলটিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। সাঁতার জানত না।
সে কি একাই ছিল?
একা? না বোধহয়। সঙ্গে বোধহয় আরেকজন ছিল।
ঠিক করে ভেবে বলে তো।
অত দিন আগের কথা তো— তাই ভাল মনে পড়ছে না।
ওই ইংরেজ ছেলেটির একজন ভারতীয় বন্ধু ছিল না?
আই থিঙ্ক হি হ্যাড।
একটু চেষ্টা করে মনে করে দেখো তো-সেই ভারতীয় ছেলেটিও নৌকোয় ছিল কি না।
মে বি হি ওয়াজ-মে বি হি ওয়াজ…
ওই ঘটনার সময় তুমি কোথায় ছিলে?
আমি একটা ঝোপের ধারে বসে বিশ্রাম করছিলাম। হয়তো সিগারেট খাচ্ছিলাম।
ঘটনাটা তুমি দেখেছিলে?
হেলপ-হেলপ চিৎকার শুনে আমি নদীর ধারে যাই। গিয়ে দেখি এই কাণ্ড!
তা হলে তো তোমার মনে থাকা উচিত নৌকোতে আর কেউ ছিল কি না।
হুকিনস মাথা হেঁট করে যেন ভাববার চেষ্টা করল। তারপর বলল, নাঃ—এর বেশি আর মনে করতে পারছি না! আই অ্যাম সরি। এইটুকু যে মনে আছে তার একটা কারণ ওই একই দিনে আমি বিয়ে করি। ম্যাগি। দ্য বেস্ট ওয়াইফ ওয়ান কুড হ্যাভ।
টাইমসের বিজ্ঞাপনের ফল যে মিস্টার ক্রিপস-এর আসাতেই শেষ হয়ে গেল তা নয়। কেমব্রিজ যাবার পরদিনই ফেলুদা টেলিফোন পেল এক ভারতীয় ভদ্রলোকের কাছ থেকে-নাম সত্যনাথন। মাদ্রাজি, তাতে সন্দেহ নেই। ভদ্রলোক বললেন পিটার ডেক্সটর সম্বন্ধে কিছু তথ্য তিনি দিতে পারেন। আমি এগারোটা নাগাদ তোমাদের হোটেলে পৌঁছতে পারি।
খুব ভাল কথা, বলল ফেলুদা, চলে আসুন।
সত্যনাথন কথা মতো এলেন। বেশ গাঢ় কালে রং, মাথার চুল একেবারে সাদা। একটা চেয়ারে বসে বললেন, বিজ্ঞাপনটিা পড়েই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব ভেবেছিলাম, কিন্তু কয়েকটা কাজে একটু আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।
আপনি লন্ডনেই থাকেন?
না। কিলবার্নে। এখান থেকে বেশি দূর নয়! ওখানে একটা ইস্কুলে মাস্টারি করি। পিটার ডেক্সটরের সঙ্গে একসঙ্গে আমি কেমব্রিজে ছিলাম।
তার মানে রঞ্জন মজুমদারও আপনার সহপাঠী ছিল?
তা তো বটেই।
তাকে মনে আছে?
স্পষ্ট। পিটারের খুব বন্ধু ছিল। অবিশ্যি দুজনের মধ্যে ঝগড়াও হত প্রায়ই।
কী নিয়ে?
পিটার ভারতীয়দের একেবারে পছন্দ করত না। রঞ্জনকে দেখে একেবারে সাহেব বলে মনে হত, তাই পিটার তাকে বন্ধু হিসেবে মেনে নেয়। বলত—ইউ আর নট ইন্ডিয়ান, ইউ আর হাফ ইংলিশ।
আপনার সঙ্গে পিটারের কীরকম সম্পর্ক ছিল?
আমার গায়ের রং তো দেখতেই পাচ্ছেন। আমাকে সে বহুবার ডার্টি নিগার বলে সম্বোধন করেছে। আমি ব্যাপারটা হজম করে নিতাম।
পিটারের মৃত্যুর কথা মনে আছে?
তা থাকবে না? এমন কী দিনটাও মনে আছে-হুইট-সানডের আগের দিন। পিটার, যখন সাঁতার জানত না তখন ওর নৌকোয় চড়া অত্যন্ত ভুল হয়েছিল।
ওর সঙ্গে আর কে ছিল?
রঞ্জন।
সে বিষয় আপনি নিশ্চিত?
অ্যাবসোলিউটলি। রঞ্জনের সর্বাঙ্গ জলে ভেজা চেহারাটা এখনও আমার চোখের সামনে ভাসে। আমি তখন আমার ঘরে ছিলাম। আমাদের মালী হুকিনসের চেচামেচিতে বাইরে বেরিয়ে এসে সব ব্যাপারটা জানতে পারি। রঞ্জন তার বন্ধুকে বাঁচাবার জন্যে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাই ইট ওয়জ ঢুঁ লেট। রেজিনাল্ডও চেষ্টা করেছিল দাদাকে বাঁচাতে, কিন্তু পারেনি।
পিটারের পরের ভাই?
হ্যাঁ। সে আমাদের পরের বছরই কেমব্রিজে ভর্তি হয়। সেই একই ছাঁচে ঢালা। ভারতীয়দের সঙ্গে প্রায়ই হাতাহাতি লেগে যেত। অনেকবার ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও ফল হয়নি। রেজি:ন্যান্ডের ধারণা ছিল রঞ্জন ইচ্ছা করলে পিটারকে বাঁচাতে পারত। এই কথা সে সারা কলেজে বলে বেড়াত-হি ডেলিবারেটলি লেট হিম ড্রাউন।
রঞ্জন মজুমদার তো এক বছরের বেশি কেমব্রিজে পড়েনি?
না। একটা বাইসিক্ল অ্যাক্সিডেন্টের পর সে দেশে ফিরে যায়।
কথা শেষ, তাই সত্যুনাথন উঠে পড়লেন। ওঁর কাছ থেকে একটা মূল্যবান তথ্য জানা গেল—নীকোঁতে পিটারের সঙ্গে রঞ্জন ছিলেন, আর তিনি বন্ধুকে বাঁচাতে চেষ্টা করে পারেননি। সত্যনাথন চলে যাবার পর থেকেই লক্ষ করলাম ফেলুদার ভুরুটা কুঁচকে গেল। লাঞ্চ খেতে খেতে লালমোহনবাবু বললেন, আপনাকে যেন ডিসস্যাটিসফায়েড বলে মনে হচ্ছে। কারণটা জানতে পারি কি?
একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে।
কী?
মনে হচ্ছে হুকিনস যা বলেছে তার চেয়ে বেশি ও জানে এবং ওর মনে আছে। কোনও একটা কারণে তথ্য লুকিয়ে যাচ্ছে।
তা হলে কী করবেন?
আরেকবার কেমব্রিজ যাওয়া দরকার। এবারে হুকিনসের বাড়ি। রাস্তার নামটা ও বলেছিল। মনে আছে, তোপ্সে?
মনে ছিল। বললাম, চ্যাটওয়ার্থ স্ট্রিট।
ভেরি গুড। কেমব্রিজ গিয়ে রাস্তার একটা পুলিশকে জিজ্ঞেস করলেই বাতলিয়ে দেবে। এটাও জেনে রাখুন, লালমোহনবাবু-এখানকার পুলিশ, যাকে এরা বলে ববি-এদের মতো হেলপাফুল পুলিশ পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।
লাঞ্চের পর ফেলুদা বলল ওর একটা কাজ আছে, ও একটু বেরোবে। ও ফিরলে তারপর আমরা কেমব্রিজ যাব। ঘণ্টায় ঘণ্টায় কেমব্রিজের ট্রেন ছাড়ে–কোনও অসুবিধা নেই।
সাড়ে চারটায় রওনা হয়ে আমরা যখন কেমব্রিজে পৌঁছলাম, তখন রাস্তার বাতি জ্বলে গেছে। আমরা একটা বড় রাস্ত ধরে এগিয়ে একটা পুলিশের কাছে গিয়ে হাজির হলাম।
চ্যাটওয়ৰ্থ স্ট্রিট কোথায় বলতে পার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। পুলিশ প্রায় কাগজে নকশা আঁকার মতো করে বুঝিয়ে দিল।
আধঘণ্টা লাগল চ্যাটওয়্যৰ্থ স্ট্রিট পৌঁছতে। এটাকে গলি বললেই চলে, দেখে বোঝা যায় যে খুব অবস্থাসম্পন্ন লোকেদের পাড়া নয়। একটা বাড়ির সামনে একজন লোক রাস্তা থেকে একটা বেড়ালকে তুলে কোলে নিল। তাকেই ফেলুদা জিজ্ঞেস করল হুকিনস কোন বাড়িতে থাকে।
ফ্রেড হুকিনস? ভদ্রলোক বললেন। নাম্বার সিক্সটন।
এখানে সব বাড়ির বাইরেই নম্বর লেখা থাকে, তাই ষোলো খুঁজে পেতে সময় লাগল না।
এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করতে হুকিনস নিজেই দরজা খুলল।
গুড ইভনিং, বলল ফেলুদা।
আমাদের দেখে হুকিনসের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। সে কী-তোমরা আবার…?
একটু ভিতরে আসতে পারি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
হুকিনস এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের ঢোকবার জায়গা করে দিল। আমরা তিনজনে ঢুকলাম। এটাই বসবার ঘর, যদিও আয়তনে খুবই ছোট। আমরা দুটাে চেয়ারে আর একটা সোফায় ভাগাভাগি করে বসলাম।
ওয়েল?
ফেলুদার দিকে জিজ্ঞাসুর দৃষ্টি দিলে হুকিন্স।
তোমাকে দু একটা প্রশ্ন করার ছিল।
অ্যাবাউট দ্য ড্রাউনিং?
হ্যাঁ।
আমি যা বলেছি তার বেশি তো আর কিছু জানি না।
আমি নতুন প্রশ্ন করব।
কী?
মিস্টার হুকিনস, যে নৌকো ধীরে চলছে, তাতে কেউ বসা অবস্থায় জলে পড়ে যেতে পারে এটা কি তোমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
যদি ঝড় থাকে তা হলে নৌকে নিশ্চয়ই উলটে যেতে পারে। দেয়ার ওয়জ এ হাই উইন্ড দ্যাট ডে।
আমি আজই দুর্ঘটনার পরের দিনের খবরের কাগজ দেখেছি। তাতে পিটার ডেক্সটরের মৃত্যু সংবাদ আছে, কিন্তু ঝড়ের কোনও খবর নেই। ওয়েদার রিপোর্টে বলছে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৩৫ মাইল। সেটাকে কি তুমি হাই উইন্ড বলবে?
হুকিনস চুপ। আর একটা টেবিল ক্লকের টিক টিক শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
ফেলুদা বলল, আমার ধারণা তুমি একটা কিছু লুকোচ্ছ। সেটা কী দয়া করে বলবো?
এতদিন আগের ঘটনা…
কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যে দুজনকে নিয়ে ঘটনা, তার মধ্যে একজন তো তোমার বেশ কাছের লোক ছিল বলে মনে হচ্ছে।
হুকিনস ফেলুদার দিকে চাইল। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে তার দৃষ্টিতে সংশয় ঘনিয়ে আসছে।
হোয়াট ডু ইউ মিন?
তোমার শেলফে আমি অনেকরকম জিনিসের মধ্যে একটা পিতলের গণেশ আর একটা আইভরির বুদ্ধ দেখতে পাচ্ছি। ওগুলো কী করে পেলে জানতে পারি কি?
রন দিয়েছিল আমাকে ৷
রন মানে বোধ করি রঞ্জন।
ইয়েস। ওকে আমি রনও বলতাম, রনও বলতাম।
আই সি। এবার একটা কথা বলো—পিটারের হেলপ হেলপ চিৎকারের আগে তুমি ওদের কোনও কথা শোনোনি? ইন্ডিয়ান গডদের সামনে মিথ্যা কথা বলা কিন্তু মহাপাপ।
কী কথা বলছিল বুঝিনি—আই ওনলি হার্ড দেয়ার ভয়েসেস।
তার মানে ওরা বেশ জোরে কথা বলছিল?
পারহ্যাপস…পারহ্যাপস…
আমার কী বিশ্বাস জান?
হুকিনস আবার ফেলুদার দিকে দেখল।
হোয়াট?
আমার বিশ্বাস ওদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল। পিটার দাঁড়িয়ে উঠেছিল, আর——
ইয়েস, ইয়েস। হুকিনস হঠাৎ বলে উঠল। আর ও রনকে আক্রমণ করতে যায়, আর টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ে যায়।
তার মানে পিটার তার মৃত্যুর জন্য নিজেই দায়ী?
অফ কোর্স!
তোমাদের এই যে ক্যাম নদী, আমাদের দেশে এটাকে বলে কেন্যাল। এতে একটা লোক সাঁতার না জানলেও এত সহজে ডুবে যেতে পারে। –বিশেষ করে যখন তাকে একজন বাঁচাবার চেষ্টা করছে?
ডুবল যে সে তো চোখের সামনে দেখলাম।
তুমি এখনও সত্যি কথা বলছি না, মিস্টার হুকিনস। আই ওয়ান্ট দ্য ট্রুথ। আমি এত দূর থেকে এসেছি শুধু এই ট্রুথের সন্ধানে; পিটার কেন এত সহজে ডুবে গেল?
ছকিনসকে দেখেই বুঝতে পারছিলাম যে সে ক্রমেই কোণঠাসা হচ্ছে! এবার সে হঠাৎ ভেঙে পড়ে বলল, ঠিক আছে, আমি বলছি কেন পিটার ডুবে যায়। তার কারণ ও যখন জলে পড়ে তখন ওর জ্ঞান ছিল না।
জ্ঞান ছিল না?
ফেলুদা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে হুকিনসের দিকে। তারপর চাপ স্বরে বলল, বুঝেছি। নৌকে বাইছিল রঞ্জন, তাই না?
ইয়েস।
তার মানে তার হাতে দাঁড় ছিল।
ইয়েস।
অর্থাৎ একটা অস্ত্র ছিল, যেটা দিয়ে সে পিটারকে আঘাত করে। তার ফলে পিটার সংজ্ঞা হারিয়ে জলে পড়ে যায়। অর্থাৎ সে কোনও স্ট্রাগলই করেনি। আর রঞ্জন যে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল সেটা একটা অভিনয়। অর্থাৎ রঞ্জনই পিটারের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
হুকিনস মাথা চাপড়ে বলল, আমি তোমাদের আঘাত দিতে চাইনি। তাই সত্য গোপন করছিলাম। রঞ্জনের জায়গায় আমি থাকলে আমিও ওরই মতো করতাম। পিটার ওকে অশ্রাব্য ভাষায় গাল দিচ্ছিল। বলছিল তোমার চামড়া সাদা হলে কী হবে, আঁচড় কাটলেই দেখা যাবে। নীচে কালো। ইউ আর নাথিং বাট এ ডার্টি ব্ল্যাক নেটিভ। এতে কার মাথা ঠিক থাকে বলো!
তুমি ছাড়া এই ঘটনার সাক্ষী আর কেউ ছিল?
ইয়েস। ওনলি ওয়ান।
কে?
রেজিন্যাল্ড ।
রেজিন্যাল্ড ডেক্সটর?
আমরা দুজন একসঙ্গেই বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম। সমস্ত ঘটনাই আমরা দুজন একসঙ্গে দেখি। পরে আমি রনকে বাঁচাবার জন্য বলেছিলাম পিটার রনকে আক্রমণ করতে গিয়ে জলে পড়ে যায়। এদিকে রেজিন্যাল্ড অনবরত সত্যি ঘটনাটা বলে বেড়াচ্ছিল। সৌভাগ্যক্রমে সকলেই জানত যে রেজিন্যাল্ড ইন্ডিয়ানদের ঘৃণা করে, তাই তার কথা কেউ বিশ্বাস করেনি। থ্যাঙ্ক গড ফর দ্যাট–রন ওয়জ সাচ এ নাইস বয়, সে জেনা্রাস, সে কাইন্ড।
এ ব্যাপারে তদন্ত হয়নি? ইনকুয়েস্ট হয়নি?’
হয়েছিল বইকী।
তুমি সাখকী দিয়েছিলে?
ইয়েস।
মিথ্যে সাক্ষী তো?
তা বটে। আই ওয়জ ডিটারমিনড টু সেভ রঞ্জন। সেও অবশ্য সাক্ষী দিয়েছিল। আমি যা বলেছিলাম, সেও তাই বলেছিল।
আর রেজিন্যাল্ড ? সে সাক্ষী দেয়নি?’
হ্যাঁ-এবং সে সত্যি ঘটনাই বলেছিল। তবে তার কথায় ভারতীয় বিদ্বেষ এত প্ৰকাশ পাচ্ছিল যে জুরি তার কথা বিশ্বাস করেনি। তারা রায় দিয়েছিল ডেথ বাই অ্যাক্সিডেন্ট।
ফেলুদা উঠে পড়ল।
থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার হুকিনস। আমার আর কোনও প্রশ্ন নেই।
হোটেলে ফিরলাম ডিনারের ঠিক আগে। রিসেপশন থেকে ঘরের চাবি নিচ্ছি, এমন সময় একজন কর্মচাবী ফেলুদার দিকে চেয়ে বলল, মিস্টার মিটার ?
ইয়েস।
তোমার একটি টেলিগ্রাম আছে।
ফেলুদা টেলিগ্রামটা নিয়ে খুলে পড়ল। পাঠিয়েছেন রঞ্জন মজুমদার। তিনি বলছেন- ক্যান রিকল এভরিথিং। রিটার্ন ইমিডিয়েটলি।
পারফেক্ট টাইমিং, বলল ফেলুদা। এখানের মামলা শেষ, কাল আমাদের রিটার্ন বুকিং, আর মিস্টার মজুমদারের স্মৃতি ফিরে এসেছে।
প্লেনেই ফেলুদা বলেছিল যে দমদম থেকে সোজা মিস্টার মজুমদারের বাড়ি যাব। আমরা কলকাতায় পৌঁছাচ্ছি। দুপুর একটা পাঁচে।
মনে গভীর উৎকণ্ঠা। রঞ্জনবাবু জানেন তিনি খুন করেছিলেন; এখন তিনি কী করবেন ?
আমাদের ফেরার তারিখ আর সময় আগে থেকেই জানা ছিল, তাই লালমোহনবাবুর গাড়ি এয়ারপোর্টে হাজির ছিল।
রোল্যান্ড রোডে পৌঁছে বুকটা ধক করে উঠল। রঞ্জনবাবুর বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি কেন?
গাড়ি থেকে নেমে গেটের ভিতর ঢুকতেই আমাদের চেনা ইনস্পেকট্টর মণ্ডল গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলেন।
আজ সকাল আটটায় ব্যাপারটা ঘটেছে।
কী ব্যাপার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
মিস্টার মজুমদার খুন হয়েছেন। সকালে নাকি একজন সাহেব এসেছিল ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। সে কে তা জানা যায়নি। আপনি কোনও এনকোয়ারি করবেন?
না।
পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় লালমোহনবাবু এসে হাজির। ভদ্রলোক অত্যন্ত উত্তেজিত। পাঁচ নম্বরের পাতার খবরটা দেখেছেন?
কোন কাগজ? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
স্টেটসম্যান–আবার কোন কাগজ।
না, এখনও দেখিনি।
প্রথম পাতায় তো মজুমদারের খবরটা রয়েছে-এবার পাঁচের পাতা দেখুন।
ফেলুদা কাগজটা নিয়ে পাঁচের পাতা খুলল। ‘নীচে বা দিকে’, বললেন জটায়ু। খবরটা বার করে ফেলুদা পড়ে শোনাল। তার বাংলা করলে এই দাঁড়ায়—
হোটেলে আত্মহত্যা
সদর স্ট্রিটের একটি হোটেলে গতকাল রাত্রে গুলির আওয়াজ পেয়ে অনুসন্ধান করে দেখা যায় সাত নম্বর ঘরে একটি সাহেব মৃত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছেন। তাঁর হাতে রিভলভার। হোটেলের খাতা থেকে জানা যায় সাহেবের নাম রেজিনাল্ড ডেক্সটার। ইনি এসেছিলেন দাৰ্জিলিং-এর নিকটবর্তী খয়রাবাড়ি চা বাগান থেকে।