প্রাণের উৎপত্তি নিয়ে কোন সঠিক ধারণা তখনও মানুষের মনে ছিল না। নিম্নশ্রেনীর প্রাণী যেমন কীট পতঙ্গ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাটি, কাদা ময়লা আবর্জনা থেকে জন্ম নেয় – এই বিশ্বাস প্রাচীন চীন, ভারত আর মিশরে আমরা দেখতে পাই। এর কারণও ছিল। আবর্জনা কাদার মধ্যে কীটের ডিম পারার ফলে তা থেকেই যে কীটের জন্ম হয়, তা জানতে হলে যে শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়ােজন হয়, তা তখনকার দিনে ছিল না। ফলে জীবনের উৎপত্তির এই স্বতস্ফুর্ত তত্ত্ব দীর্ঘকাল মানব সমাজে রাজত্ব করেছে।
এমনকি শ’চারেক বছর আগেও যখন আধুনিক বিজ্ঞান যাত্রা শুরু করে তখনও এই স্বতঃস্ফুর্ততত্ত্ব (Theory of spontaneous generation) বহাল তবিয়তেই রাজত্ব করছে। শুধু রােগ জীবাণু বা আণুবীক্ষণিক জীবের ক্ষেত্রেই নয়, এমনকি বড় বড় প্রাণীর ক্ষেত্রেও ✪ । ব্রিটিশ গবেষক আলেকজান্দার নীডহ্যাম (১১৫৭ – ১২১৭) বিশ্বাস করতেন ফার গাছ সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ফেলে রাখলে তা থেকে রাজহাঁস জন্ম নেয়।
জ্যান ব্যাপটিস্ট হেলমন্ট (১৫৮০-১৬৪৪) ভাবতেন ঘর্মাক্ত নােংরা অন্তর্বাস ঘরের কোনায় ফেলে রাখলে তা থেকে ইদুর আপনা আপনিই জন্ম নেয়! উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় মূলতঃ লুই পাস্তুরের গবেষণার মধ্য দিয়ে আমরা এই পুরােন ধারণা ছেড়ে দেই (পরবর্তী অধ্যায়ে স্বতঃস্ফুর্ততত্ত্ব এবং এর মৃত্যু নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে)।
ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে যখন স্বতঃজননবাদ গ্রহনযােগ্য বিবেচিত হচ্ছিল না, তখন অন্য একটি অনুকল্প প্রস্তাবিত হয়। তার মূল কথা হল জীবনের প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল। মহাবিশ্বে। সেখান থেকে পৃথিবীতে জীবন এসেছে। এ অনুকল্পের নাম বহির্বিশ্বে জীবনের উৎপত্তি (Extra terrestrial origin of life)। প্রথম দিকে রিখটার, আরহেনিয়াস (তাঁর অনুকল্পের নাম ছিলাে ‘প্যানস্পার্মিয়া’, এ বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে এ নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে) এবং পরবর্তীতে ব্রুকস, শ’, ক্রিক, হয়েল, বিক্রমসিংহ প্রমুখ এই তত্ত্বের প্রচারক ছিলেন। তাদের মতে পৃথিবীর বাইরে কোন গ্রহে বা অন্য কোথাও জীবনের উৎপত্তি হয়েছিল।
সেখান হতে প্রাণ স্পাের বা অনুবীজ হিসেবে পৃথিবীতে এসেছিল। কিন্তু মহাশূন্যের পরিবেশ এই আন্তঃগ্রহ পরিভ্রমনের জন্য এতই প্রতিকুল (নিম্নমাত্রার তাপ, বায়ুর অনুপস্থিতি, উচ্চশক্তির বিকিরণ, অকল্পনীয় দূরত্ব ইত্যাদি) যে এভাবে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ এবং টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।
কার্ল স্যাগান আর শকোভস্কি ১৯৬৬ সালে অনুজীবের আন্তঃনাক্ষত্রিক পরিভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তারা হিসেব করে দেখিয়েছেন, অণুজীবগুলাে যদি এক মাইক্রনের কম হয় তবে সেগুলাের পক্ষে পৃথিবীতে জীবন ধারণের উপযােগী অঙ্গাণুধারণ করা সম্ভব নয়। আবার অণুজীবগুলো যদি এক মাইক্রনের বেশী হয় তবে পৃথিবীর মত অন্য কোন গ্রহ থেকে এই ধরােনের প্রাণকণা নির্গত হয়ে পৃথিবীতে চলে আসা খুবই কঠিন। আর বিকিরণজনিত বিভিন্ন কারণে সেগুলাের পুড়ে যাবার সম্ভাবনা তাে আছেই।
তারপরও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া হয় যে, ঠিক ঠিক এক মাইক্রনের অণুজীবেরা কোন না কোন ভাবে পৃথিবীতে আসতে সক্ষম হয়েছিলাে, স্যাগান আর শকোভস্কি হিসেব দিয়েছেন যে, পৃথিবীকে একশ’ কোটি বছরে একটি মাত্র এ ধরণের স্পাের পেতে হলে আমাদের গ্যালাক্সির ১০০টি প্রাণধারণক্ষম গ্রহকে একসাথে ১০০০ টন অনুবীজ ছড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের গ্যালাক্সিতে এ ধরনের ১০০টি গ্রহ তাে দূরের কথা, পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন জীবনবাহী গ্রহের সন্ধানই এখনাে মেলেনি।
আর তাছাড়া যদি ধরেই নেওয়া হয়, বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে প্রাণের বীজ এ পৃথিবীতে এসেছিল, তা হলেও প্রশ্ন থেকে যায় বহির্বিশ্বেই বা কি ভাবে প্রাণের উৎপত্তি হয়েছিল? তারমানে পৃথিবীর ক্ষেত্রে যে সমস্যাটির সমাধান করা যাচ্ছিল না, বহির্বিশ্বের দিকে ঠেলে দিয়ে সেই সমস্যাটিকে পেছানাের প্রয়াস নেয়া হল মাত্র।
পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত উল্কাপিন্ড আছরে পড়ছে পত্র-পত্রিকায় প্রায়ই আমরা এধরনের খবর দেখতে পাই। এগুলােকেই প্রাথমিকভাবে প্রাণ কণার বাহন বলে মনে করেন বহির্বিশ্বে জীবনের উৎপত্তি তত্ত্বের প্রবক্তারা। কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে সমস্ত অ্যামাইনাে এসিড উল্কাপিন্ডের উপর ভর করে এই পৃথিবীতে এসেছে সেগুলাের সাথে পৃথিবীতে তৈরী অ্যামাইনাে এসিডের পার্থক্য রয়েছে বিস্তর।
মহাকাশের উল্কাপিন্ডের সাথে আসা অ্যামাইনাে এসিডগুলাের মধ্যে কিছু বামাবর্তী এবং কিছু ডানাবর্তী (Left and Righthanded); ফলে এগুলাের কোন আলােক ক্রিয়া নেই। কিন্তু পৃথিবীতে প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরী অ্যামাইনাে এসিডগুলাে সবই বামাবর্তী (Left-handed)। এ ছাড়া এমন কিছু অ্যামাইনাে এসিড উল্কাপিন্ডে পাওয়া গেছে যেগুলাে পৃথিবীর কোন জীবে দেখা যায় না। তাই অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন এ সব অ্যামাইনাে এসিড থেকে পৃথিবীর অ্যামাইনাে এসিড তৈরী হতে পারে না।
আসলে এ পৃথিবীতেই আদিম অবস্থায় অজৈব পদার্থ হতে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে এবং তা কোন রহস্যজনক কারণে নয়, বরং জানা কিছু রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে – জীবনের এই রাসায়নিক উৎপত্তি তকেই (Chemical theory of origin of life) আজ পৃথিবীর অধিকাংশ। বিজ্ঞানীরা সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন। গত শতকের শেষভাগে থমাস হাক্সলি আর জন টিন্ডেলের গবেষণায় জীবনের এই বস্তুগত ভিত্তির কথা সাধারণভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। তারপরও অনেকটাই ধোয়াটে ছিল সবকিছু। ধীরে ধীরে কুয়াশা কেটেছে, কাটছে।
হাক্সলির উত্তরসূরীরা যেমন হার্ডি, উইলসন, বার্নাল, হলডেন, কেলভিন, ওপারিন, মিলার, ইউরে, ডবঝানােস্কি প্রমুখ বিজ্ঞানীরা মানব মনের কুয়াশা কাটিয়ে জীবনের এই বস্তুবাদীরূপটিকে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রয়াস পেয়েছেন।
আমরা আগামী অধ্যায়ে এ তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করব।