ছেলেদের পুরুষাঙ্গের আকার এবং প্রকৃতি কি তবে মেয়েদের যৌনতার নির্বাচনের ফল?
প্রেম ভালোবাসা এবং যৌনতায় পুরুষের পুরুষাঙ্গ যে একটা আলাদা জায়গা দখল করে আছে, তা আর নতুন করে বলে দেবার বোধ হয় দরকার নেই। কিন্তু যেটা অনেকের কাছেই অজানা তা হলো, বহু নারী গবেষকই তাদের অভিজ্ঞতা এবং গবেষণা থেকে ইঙ্গিত করেছেন ভালো যৌনসম্ভোগের জন্য পুরুষাঙ্গের আকার সম্ভবত খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়[১৪২]। কিন্তু তারপরেও বেশ কিছু সমীক্ষায় দেখা গেছে পৃথিবীতে অধিকাংশ পুরুষই তার পুরুষাঙ্গের আকার ‘ছোট’ ভেবে হীনম্মন্যতায় ভুগে থাকে।
যেমন, গবেষক জে. লিভার ২০০৬ সালে ৫২৩১ জন পুরুষের উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেন[১৪৩], প্রায় সকল পুরুষই প্রত্যাশা করে যে, তার পুরুষাঙ্গ আরেকটু বড় হলেই ভালো হতো। প্রতি এক হাজার জনে মাত্র দুজন অভিমত দিয়েছে পুরুষাঙ্গ ছোট হবার পক্ষে। আরেক গবেষক বি.ই. ডিলন এবং তার দলবল ২০০৮ সালে গবেষণায় দেখান যে, কৈশোর থেকে শুরু করে প্রৌঢ়ত্ব পর্যন্ত সবসময়ই পুরুষদের জন্য পুরুষাঙ্গের ক্ষুদ্র আকার একটি বিশাল উদ্বেগের কারণ[১৪৪]। অনেক পুরুষই আছেন যারা সঙ্গীর সাথে প্রথম যৌন সম্পর্কের আগে এই ভেবে উদ্বিগ্ন থাকে যে, নগ্ন অবস্থায় তার ক্ষুদ্র পুরুষাঙ্গ দেখতে পেয়ে তার সঙ্গী নিশ্চয় যারপরনাই মনঃক্ষুণ্ণ হবে। কিন্তু পুরুষেরা তার নিজের যন্ত্রটি নিয়ে যাই ভাবুন না কেন, মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রায় ৮৫ ভাগ নারী মনে করে তার সঙ্গীর পুরুষাঙ্গের আকার তার প্রত্যাশা এবং মাপমতোই আছে[১৪৫]!
সত্যি কথা হলো পুরুষদের পুরুষাঙ্গের ‘ক্ষুদ্র’ আকার নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার আসলে কোনো কারণ নেই। মানবসমাজে পুরুষদের পুরুষাঙ্গের গড়পড়তা আকার অন্যান্য প্রাইমেটদের চেয়ে ঢের বড়— সুপার সাইজ বলা যায়। আর এই ব্যাপারটা তৈরি হয়েছে নারীর যৌন অভিরুচিকে প্রাধান্য দিয়ে। জিওফ্রি মিলার তার ‘সঙ্গমী মনন’ গ্রন্থের Size Mattered অংশে পুরুষাঙ্গের আকার নিয়ে নারী বিজ্ঞানীদের সনাতন কিছু ধারণা খণ্ডন করে অভিমত দিয়েছেন, তারা যেভাবে পুরুষাঙ্গের আকারকে হিসেবের বাইরে রাখতে চেয়েছেন, ব্যাপারটা আসলে এতোটা তুচ্ছ করার মতো নয়।
যৌনতার নির্বাচনের মূল জায়গাটিতে আবারো ফেরত যাই। আমরা আগের একটি অংশে দেখেছিলাম নারীর পিনোন্নত স্তন, সুডৌল নিতম্ব আর ক্ষীণ ক’টিদেশের প্রতি পুরুষদের সার্বজনীন আকর্ষণের কথা, আমরা দেখেছি কীভাবে যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে পুরুষেরা মেয়েদের দেহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে নির্বাচিত করেছিল, কারণ সে বৈশিষ্ট্যগুলোই হয়ে উঠেছিল তাদের চোখে প্রজনন ক্ষমতা এবং সুস্বাস্থ্যের প্রতীক। এই যৌনতার নির্বাচন কিন্তু একতরফাভাবে হয়নি। আমরা আগেই বলেছি, যৌনতার নির্বাচনকে পুঁজি করে পুরুষ যেমন গড়েছে নারীকে, তেমনি নারীও গড়েছে পুরুষের মানসপটকে এবং তার দেহজ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যকে। এক লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যগুলোর আবেদন তৈরি করেছে আরেক লিঙ্গের চাহিদা।
অনেক বিজ্ঞানীই আজ মনে করেন মানবসমাজে পুরুষদের পুরুষাঙ্গের আকার এবং প্রকৃতি অনেকটাই নির্ধারিত হয়েছে নারীর যৌন চাহিদাকে মূল্য দিয়ে। ব্যাপারটা নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনায় যাওয়া যাক। মানুষের কাছাকাছি প্রজাতির প্রাইমেট সদস্যদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ম্যান্ড্রিলদের গাঢ় গোলাপি রঙের অণ্ডকোষ আর লাল রঙের পুরুষাঙ্গ আছে। ভার্ভেট বানরদের নীল রঙের অণ্ডকোষের সাথে রক্তিম লাল বর্ণের পুরুষাঙ্গ আছে, ইত্যাদি। মানুষের মধ্যে অবশ্য সেসব কিছুই নেই। সাদা চোখে মনে হতে পারে মানুষদের পুরুষাঙ্গ বোধ হয় সাদামাটা ম্যারম্যারে একটি অঙ্গ। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলেন, আসলে তা নয়।
প্রাইমেটদের অন্য প্রজাতির তুলনায় মানব পুরুষাঙ্গ আকারে বড়, মোটা এবং অধিকতর নমনীয়। একটা তুলনামূলক হিসেব দেই। গরিলাদের বিপুল দেহের কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এতবড় দেহ থাকলে কী হবে, তাদের পুরুষাঙ্গের আকার পূর্ণ উত্থিত অবস্থাতেও মাত্র দুই ইঞ্চির বেশি হয় না। শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে সেটি মাত্র তিন ইঞ্চি। আর মানুষের ক্ষেত্রে উত্থিত পুরুষাঙ্গের আকার গড়পড়তা পাঁচ ইঞ্চি । সবচেয়ে বড় পুরুষাঙ্গের আকার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় পাওয়া গিয়েছে প্রায় তের ইঞ্চি, যা গড়পড়তা দৈর্ঘ্যের দ্বিগুণেরও বেশি। আর তার চেয়েও বড় কথা হলো, মানব পুরুষাঙ্গের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে, যা অন্য প্রাইমেট বর্গদের থেকে একদমই আলাদা।
অন্য প্রাইমেট প্রজাতিতে যেখানে পুরুষাঙ্গে একটি হাড় আছে যেটিকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় ব্যাকালাম (Baculum) বলে অভিহিত করা হয় সেটি মানব লিঙ্গে একেবারেই অনুপস্থিত। সেজন্য বিশেষ এই মানব প্রত্যঙ্গটি হয়েছে অন্য প্রাইমেটদের তুলনায় অনেক বেশি নমনীয়। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী জিওফ্রি মিলার তার গবেষণায় দাবি করেছেন অন্য প্রাইমেটদের পেন্সিল সদৃশ রোগা পুরুষাঙ্গের তুলনায় মানব পুরুষদের দীর্ঘ, চওড়া এবং হাড়বিহীন নমনীয় পুরুষাঙ্গ তৈরি হয়েছে মূলত নারীর সার্বিক চাহিদাকে মূল্য দিয়ে[১৪৬]।
মিলার তার ‘সঙ্গমী মনন’ (The Mating Mind) বইয়ে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন এ ধরনের পুরুষাঙ্গ নারীরা পছন্দ করেছে কারণ এটি মেয়েদের চরম পুলক (অর্গাজম) আনয়নে সহায়তা করেছে, এটি হয়েছে তাদের জন্য প্রচণ্ড রকমের আনন্দের উৎস, এবং তাদের ক্রমিক চাহিদা তৈরি করেছে উন্নত পুরুষাঙ্গ গঠনের নির্বাচনী চাপ[১৪৭]। অন্য কিছু গবেষকদের সাম্প্রতিক গবেষণাতেও এই দাবির স্বপক্ষে কিছুটা সত্যতা মিলেছে বলে দাবি করা হয়[১৪৮]।
কান টানলে নাকি মাথা আসে। তাই পুরুষাঙ্গের আকারের কথা বলার সাথে সাথে অণ্ডকোষের আকার নিয়েও কিছু কথা এখানে চলে আসবে। পাঠকদের কী মনে হবে জানি না, পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে কিন্তু খুবই আকর্ষণীয়। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা দেখেছেন শুক্রাশয় বা অণ্ডকোষের আকারের সাথে বহুগামিতা কিংবা অবিশ্বস্ততার একটা সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে। সে ব্যাপারটিতে যাওয়ার আগে আমাদের কাছাকাছি প্রজাতিগুলো থেকে কিছু মজার উদাহরণ হাজির করা যাক।
আমরা সবাই চোখে না দেখলেও বই পত্র কিংবা ‘কিং কং’ জাতীয় মুভির মাধ্যমে বিশালকায় গরিলার আকার আয়তনের সাথে পরিচিত। একেকটি ব্রহ্মদৈত্য গরিলা আকারে ওজনে প্রায় সাড়ে তিনশ থেকে চারশ পাউন্ড ছাড়িয়ে যায়। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে, দেহের আয়তনের সাথে তাল মিলিয়ে তার শুক্রাশয়ের আকারও হবে মাশাল্লা ফুটবল না হোক, নিদেনপক্ষে হওয়া উচিত টেনিস বলের সাইজ। আসলে কিন্তু তা হয় না। এমন চারশ পাউন্ড ওজনের বৃহদাকার গরিলাদের শুক্রাশয়ের ওজন হয় মাত্র দেড় আউন্স। আর অন্যদিকে শিম্পাঞ্জিদের দৈহিক আকার কিন্তু অনেক ছোটখাট। কিন্তু সে তুলনায় তাদের শুক্রাশয়ের আকার অনেক বড়। মাত্র ১০০ পাউন্ড ওজনের একটি শিম্পাজির শুক্রাশয়ের ওজন প্রায় চার আউন্স! এ যেন বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বীচি! কিন্তু কেন এমন হলো?
এর কারণ লুকিয়ে আছে শিম্পাঞ্জি আর গরিলাদের সামাজিক সম্পর্কের পার্থক্যের মাঝে। দেখা গেছে শিম্পাঞ্জিদের মধ্যে নারীরা হয় বহুগামী। তারা একই দিনে একাধিক পুরুষ শিম্পাঞ্জির সাথে যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হয়। অধিক সংখ্যক পুরুষের সাথে যথেচ্ছাচার সম্ভোগের মাধ্যমে নারী শিম্পাঞ্জিরা প্রকারান্তরে নিশ্চিত করতে চায় যে, উৎকৃষ্ট জেনেটিক মাল-মশলাসম্পন্ন পুরুষের দ্বারাই যেন তার ডিম্বাণুর নিষেক ঘটে। কিন্তু নারী শিম্পাঞ্জির এই ধরনের অভিরুচির কারণে পুরুষ শিম্পাঞ্জির জন্য ‘বংশ রক্ষা’ হয়ে যায় মাত্রাতিরিক্ত কঠিন। তাদেরকে এক অসম বীর্য প্রতিযোগিতার (Sperm Competition) মধ্যে নামতে হয়।
নারী শিম্পাঞ্জির যোনিতে গর্ভধারণ নিয়ে বিভিন্ন পুরুষ শিম্পাঞ্জির শুক্রের মধ্যে নিরন্তর প্রতিযোগিতা চলে, সেই কারণে একটি পুরুষ শিম্পাঞ্জির পক্ষে কখনোই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় না যে, যৌনসম্পর্ক হলেই তার নির্দিষ্ট বীর্য থেকেই নারী শিম্পাঞ্জিটি গর্ভধারণ করবে বা করছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায় যদি তার শুক্রাশয়ের আকার অপেক্ষাকৃত বড় হয়, আর তার শুক্রাশয় যদি সঙ্গমের সময় অঢেল শুক্রের যোগান দিতে সমর্থ হয়। শিম্পাঞ্জির এই বীর্য প্রতিযোগিতার লড়াইকে অনেকটা লটারি টিকেটের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যত বেশি সংখ্যক লটারি টিকেট আপনার দখলে থাকবে তত বেশি সম্ভাবনা তৈরি হবে আপনার বিজয়ী হবার। আপনার যদি সামর্থ্য থাকে প্রায় সব লটারি টিকেট কোনোভাবে করায়ত্ত করার, আপনার বিজয়ী হবার সম্ভাবনা পাল্লা দিয়ে বাড়বে।
আদিতে হয়তো শিম্পাঞ্জি-কুলে বড়, ছোট কিংবা মাঝারিসব ধরনের শুক্রাশয়ওয়ালা পুরুষ শিম্পাঞ্জির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু শিম্পাঞ্জি নারীদের বহুগামিতার সাথে পাল্লা দিতে দিয়ে বড় শুক্রাশয়-ওয়ালা শিম্পাঞ্জিরাই বাড়তি সুবিধা পেয়েছিল, তারাই প্রতিযোগিতায় সফল গর্ভসঞ্চারের মাধ্যমে অধিক হারে সন্তানসন্ততি রেখে গেছে। এই নির্বাচনী চাপই শিম্পাঞ্জিকুলে ত্বরান্বিত করেছে বৃহৎ শুক্রাশয় গঠনের দিকে (গড়পড়তা শিম্পাঞ্জির শুক্রাশয়ের ওজন তার দেহের ওজনের ০.৩ ভাগ, এবং শুক্রাণু প্রক্ষেপণের সংখ্যা প্রতি বীর্যপাতে ৬০×১০৭ )।
ঠিক উলটো ব্যাপারটি ঘটে গরিলাদের ক্ষেত্রে। নারী গরিলারা বহুগামী নয়। কেবল পুরুষ গরিলারা বহুগামী। শক্তিশালী পুরুষ গরিলারা বড় সড় হারেম তৈরির মাধ্যমে নিশ্চিত করে বহু নারীর দখল। এভাবে পুরুষ গরিলারা নিশ্চিত করে তাদের অধিনস্ত নারীর দেহে নিরাপদ গর্ভসঞ্চার। কাজেই পুরুষ গরিলাদের জন্য ব্যাপারটা কখনোই পুরুষে পুরুষে বীর্য প্রতিযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকে না, বরঞ্চ হয়ে উঠে শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতা। শক্তিশালী পুরুষ গরিলারা স্বীয় শক্তির মাধ্যমে অধিকাংশ নারীর দখল নিয়ে নেয়, অধিকাংশ শক্তিহীনদের জন্য পড়ে থাকে দুর্ভাগ্য।
সামাজিক অবস্থানের কারণেই গরিলাদের ক্ষেত্রে নির্বাচনী চাপ তৈরি করেছে বড়সড় দেহ সমৃদ্ধ শক্তিশালী দেহগঠনের, বৃহৎ শুক্রাশয় তৈরির দিকে নয়। গরিলাদের ক্ষেত্রে বৃহৎ শুক্রাশয় গঠনের কোনো উপযোগিতা নেই। নারী পুরুষের মধ্যকার সামাজিক সম্পর্কের কারণেই গরিলাদের ক্ষেত্রে দেহ অনুপাতে শুক্রাশয়ের আকার অনেক ছোট (শুক্রাশয়ের ওজন দেহের ওজনের ০.০২ ভাগ, এবং শুক্রাণু প্রক্ষেপণের সংখ্যা প্রতি বীর্যপাতে ৫×১০৭)।
আপনার মাথায় নিশ্চয় এখন ঘুরতে শুরু করেছে গরিলা আর শিম্পাঞ্জিদের ক্ষেত্রে না হয় বোঝা গেল, কিন্তু মানবসমাজের ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটা কী রকম?
এক্ষেত্রে মানুষের অবস্থান হলো গরিলা আর শিম্পাঞ্জির মাঝামাঝি (শুক্রাশয়ের ওজন দেহের ওজনের ০.০৪-০.০৮ ভাগ এবং শুক্রাণু প্রক্ষেপণের সংখ্যা প্রতি বীর্যপাতে ২৫×১০৭), যদিও গবেষকদের অনেকেই রায় দিয়েছেন শুক্রাশয়ের গতি প্রকৃতি কিছুটা শিম্পাঞ্জির দিকে একটু বেশি করে ঝুঁকে রয়েছে। মানবসমাজে পুরুষ মানুষদের শুক্রাশয়ের আকার গরিলাদের মতো এত ছোট নয়, ফলে ধরে নেওয়া যায় যে, মানবসমাজে নারীরা শতভাগ একগামী মনোভাবাপন্ন নয়। আবার শুক্রাশয়ের আকার পুরুষ শিম্পাঞ্জিদের শুক্রাশয়ের মতো এত বড়সড়ও নয় ফলে আমরা এটাও বুঝতে পারি যে, মানবসমাজে নারীরা আবার শতভাগ নির্বিচারী বহুগামীও হবে না।
মানুষের মধ্যে একগামিতা যেমন আছে তেমনি বহুগামিতার চর্চাও। মানুষ নামের এই প্রাইমেটের এই স্পিশিজটির অধিকাংশ সদস্যই ‘বিবাহ নামক ইন্সটিটিউশনের’ মাধ্যমে মনোগামিতার চর্চাকে বৈশিষ্ট্য হিসেবে জ্ঞাপন করলেও এর মধ্যে আবার অনেকেই সময় এবং সুযোগমতো বহুগামী হয়, কাকোল্ড্রির চর্চা করে। অনেক ক্ষমতাবান পুরুষেরা (যেমন মহামতি আকবর, চেঙ্গিসখান প্রমুখ) আবার অধিক নারীর দখল নিতে অনেকটা গরিলাদের মতোই ‘হারেম তৈরি’ করে, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই ‘সিরিয়াল মনোগামি’ অর্থাৎ, একই সময়ে কেবল একজন সঙ্গীর সাথেই জীবন অতিবাহিত করে।
নারীদের ক্ষেত্রেও বহুগামিতা ঠিক একই কারণে দৃশ্যমান এবং সেটা সকল সমাজেই। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অধিকাংশ নারীরাই নাকি বিয়ের আগে দু চারটি প্রেম-টেম করে শেষমেষ একটি স্বামী খুঁজে নিয়ে ঘর-সংসার করে, কদাচিৎ স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে পরকীয়া করে লুকিয়ে-ছাপিয়ে, কখনো বা একেবারেই নয়। পশ্চিমেও মেয়েরা বয়ঃসন্ধির পর থেকেই স্বাধীনভাবেই একাধিক ‘ডেট’ করে, তাদের মধ্য থেকেই যোগ্য সঙ্গীকে বেছে নেয়। কখনো বা সঙ্গী বাছার প্রক্রিয়া চলতেই থাকে আজীবন, অনেকটা অধুনা পরলোকগত অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলরের মতো। সেজন্যই জোয়ান এলিসন রজার্স তার “যৌনতা : প্রাকৃতিক ইতিহাস” (Sex: A Natural History) বইয়ে উল্লেখ করেছেন[১৪৯] —
পুরুষের অপেক্ষাকৃত বড় শুক্রাশয় এটাই ইঙ্গিত করে যে, নারীরা বিবর্তনের ইতিহাস পরিক্রমায় একগামী নয়, বরং বহুগামীই ছিল।
মানবেতিহাসের পথপরিক্রমায় নারীরা যে আসলে একগামী ছিল না, তা পুরুষদের পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের আকৃতি এবং সেই সাথে সঙ্গমের প্রকৃতি থেকেও তা কিছুটা আঁচ করা যায়। এ নিয়ে জৈব শরীরতত্ত্ববিদ গর্ডন জি গ্যালপ এবং তার দলবলের একটি চমৎকার গবেষণা আছে[১৫০]। ‘মানব লিঙ্গ একটি বীর্য প্রতিস্থাপন যন্ত্র’ (The human penis as a semen displacement device) শিরোনামের এই গবেষণাপত্রে গবেষকদল দেখিয়েছেন, অন্য প্রাইমেটদের থেকে মানুষের পুরুষাঙ্গের গঠন কিছুটা আলাদা। ব্যাকালাম নামের হাড়টি যে আমাদের পুরুষাঙ্গে অনুপস্থিত, তা আমরা আগেই জেনেছি। এর বাইরে, পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ (Glans) সুচালো কীলকাকৃতির (Wedge Shaped)।
লিঙ্গের অগ্রভাগের ব্যাস পুরুষাঙ্গের স্তম্ভের ব্যাসের চেয়ে খানিকটা বড় হয়। পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ এবং স্তম্ভের সাধারণ তলে উদ্ভূত হওয়া ‘করোনাল রিজ’-এর অবস্থান থাকে স্তুম্ভের সাথে উলম্বভাবে। এ ছাড়া, সঙ্গম শুরুর পর থেকে বীর্যস্খলনের আগ পর্যন্ত যোনির অভ্যন্তরে পুরুষকে উপর্যুপরি লিঙ্গ সঞ্চালনের (Repeated Thrusting) প্রয়োজন হয়। কাজেই সুচালো কীলক সদৃশ লিঙ্গের অগ্রভাগের আকৃতি এবং সেই সাথে উপর্যুপরি লিঙ্গাঘাতের প্রক্রিয়া এটাই ইঙ্গিত করে যে, নারীর যোনির ভিতরে স্বল্প সময়ের মধ্যে অন্য কোনো পুরুষের শুক্রাণুর আগমন ঘটে থাকলে সেটাকে বিতাড়িত করার জন্য যথেষ্ট।
গ্যালোপের গবেষণাপত্রের ২৭৮ পৃষ্ঠায় সেটারই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে[১৫১] —
If a female copulated with more than one male within a short period of time, this would allow subsequent males to ‘‘scoop out’’ semen left by others before ejaculating.
আরও একটি ব্যাপারেও নারীদের পরকীয়ার ভালোই আলামত পাওয়া গেছে। দম্পতিদের দীর্ঘদিন আলাদা করে রেখে এবং বহুদিন পরে সঙ্গমের সুযোগ করে দিয়ে দেখা গেছে এতে পুরুষের বীর্যপাতের হার নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। যত বেশি দিন যুগলকে পরস্পর থেকে আলাদা করে রাখা হয়, পুনর্বার মিলনের সময় তত বেশি পাওয়া যায় শুক্রাণু প্রক্ষেপণের হার। দেখা গেছে যদি কোনো দম্পতির মধ্যে স্বামী স্ত্রী শতভাগ সময় জুড়ে একসাথে থাকে, তবে প্রতিবার সঙ্গমে গড়পড়তা ৩৮৯ মিলিয়ন শুক্রাণু প্রক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু যদি শতকরা ৫ ভাগ সময় জুড়ে দম্পতিরা একসাথে থাকে, তবে প্রতি প্রক্ষেপণে শুক্রাণুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১২ মিলিয়নে – অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ!
আসলে দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর মিলনের সময় স্পার্মের যোগান বেড়ে যায় কারণ, পুরুষেরা ভেবে নেয় যে বিচ্ছেদকালীন সময়টুকুতে স্ত্রীর পরকীয়া ঘটার কিছুটা হলেও সম্ভাবনা থাকে। অন্য কোনো পুরুষের শুক্রাণু স্ত্রী ধারণ করতে পারে এই সম্ভাবনা থেকেই বীর্য প্রতিযোগিতা বা স্পার্ম ওয়ার এ লিপ্ত হয় পুরুষটি তার অজান্তেই। প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে সে নিক্ষিপ্ত করে তার অঢেল শুক্রাণুর যোগান, এবং দাবি করে তার শুক্রের মাধ্যমে নারীর গর্ভধারণের কাঙ্ক্ষিত নিশ্চয়তা। ইতিহাসের পথপরিক্রমায় নারীদের পরকীয়া এবং বহুগামিতার আলামত প্রচ্ছন্নভাবে আছে বলেই দীর্ঘদিন বিচ্ছেদের পর মিলনের সময় খুব প্রত্যাশিতভাবেই শুক্রাণুর সংখ্যা বেড়ে যায়।
যদি মানবসমাজে নারীরা অনাদিকাল থেকে বহুগামিতায় অভ্যস্থ না হতো, যদি একগামী সম্পর্কের বাইরেও অতিরিক্ত যুগল মৈথুনে (Extra-pair Copulations) কখনোই নিজেদের নিয়োজিত না করত, তাহলে পুরুষের পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ কীলকাকৃতি হওয়ারও দরকার পড়তো না, প্রয়োজন হতো না সঙ্গমকালীন সময়ে উপর্যুপরি লিঙ্গাঘাতেরও[১৫২]। দরকার ছিল না দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্ন থাকার পর মিলনের সময় শুক্রাণুর সংখ্যা বৃদ্ধিরও। আসলে মানবসমাজে নারীর একগামিতার পাশাপাশি বহুগামিতার প্যাটার্নের একটি উল্লেখযোগ্য সাক্ষ্য এগুলো। শুধু পুরুষের বিশেষ অঙ্গেই নয়, বহুগামিতার নিদর্শন রয়েছে নারীদের নিজেদের শরীরেও। সেটা জানতে হলে আমাদের নারীর চরম পুলক বা অর্গাজম সম্বন্ধে জানতে হবে।
ভালোবাসা কারে কয়
১৪২.↑ উদাহরণ হিসেবে স্নায়ুবিজ্ঞানী Louann Brizendine এবং জীববিজ্ঞানী Lynn Margulis বলেছেন
১৪৩.↑ J. Lever, D.A. Frederick & L.A. Peplau, Does size matter? Men’s and women’s views on penis size across the lifespan. Psychology of Men & Masculinity, 7, 129-143, 2006
১৪৪.↑ BE Dillon, NB Chama, SC Honig. Penile size and penile enlargement surgery: A review. Int J Impot Res,20:519–29, 2008
১৪৫.↑ Louann Brizendine M.D., The Male Brain, Broadway; March 23, 2010
১৪৬.↑ G. F. Miller, (1998). How mate choice shaped human nature: A review of sexual selection and human evolution. In C. B. Crawford, & D. Krebs (Eds.), Handbook of evolutionary psychology: Ideas, issues, and applications (pp. 87−130). Mahwah, NJ: Lawrence Erlbaum Associates
১৪৭.↑ Geoffrey Miller, The Mating Mind: How Sexual Choice Shaped the Evolution of Human Nature, Anchor, 2001.
১৪৮.↑ Paul Bloom, How Pleasure Works: The New Science of Why We Like What We Like, W. W. Norton & Company; 1st edition , 2010
১৪৯.↑ Joann Ellison Rodgers, Sex: A Natural History, W. H. Freeman, January 15, 2002
১৫০.↑ G.G. Gallup Jr. et al., The human penis as a semen displacement device, Evolution and Human Behavior 24, 2003, pp 277–289
১৫১.↑ পূর্বোক্ত।
১৫২.↑ Baker, R. R., & Bellis, M. A. (1995). Human sperm competition: copulation, masturbation, and
infidelity. London: Chapman & Hall.