[প্রথম পর্ব]
রোকেয়া এখন বাঙালি মুসলমান পিতৃতন্ত্রের কাছে এক মহীয়সী, তিনি আজ অলঙ্কৃত করছেন পুণ্যময়ীদের পংক্তি;–কোনো প্রথাগত নারীর জন্যে এটা পরম প্রাপ্তি, কিন্তু রোকেয়ার জন্যে এটা খুবই শোচনীয় স্বীকৃতি। ভারতীয় ভূভাগের এক বড়ো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে বিদ্রোহীদের মূলেই উপড়ে ফেলা হয় বা চেষ্ট করা হয় উপড়ে ফেলার, তবে তা সম্ভব না হ’লে তাদের নিষ্ক্রিয় ক’রে দেয়া হয় প্রথার ভেতর বিন্যস্ত ক’রে। বিদ্রোহীরা হয়ে ওঠেন প্রথাগত। রোকেয়াকেও তাই করা হয়েছে; রোকেয়া হয়ে উঠেছেন এক মহীয়সী পুণ্যময়ী সতী নারী, বা একজন মুসলমান ভদ্রমহিলা।
এভাবে চূড়ান্তরূপে নিষ্ক্রিয় ক’রে দেয়া হয়েছে রোকেয়াকে। তার নামটিই এর ভালো পরিচয় দেয়। পুরুষেরা ও তাঁর ভক্ত প্রথাগ্রস্ত নারীরা তাকে বিখ্যাত ক’রে তুলেছেন ‘বেগম রোকেয়া’ নামে, যদিও তার নামে কখনো ‘বেগম ছিলো না। তার নাম ছিলো রোকেয়া বা রুকাইয়া খাতুন; তবে তিনি নিজেও মেনে নিয়েছিলেন পশ্চিমি পুরুষতান্ত্রিক নাম ‘আর এস হোসেন’ বা ‘রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন’। তার জন্মের সালতারিখকেও অনেকটা কিংবদন্তি মনে হয়;-অনেকে শুধু ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে তার জন্ম হয়েছিলো বলে জানান, জন্মের তারিখ উল্লেখ করেন না; আবার কেউ কেউ বলেন তার জন্ম হয়েছিলো।
১৮৮০ সালের ডিসেম্বরের ৯ তারিখে, এবং পুণ্যবানদের মতো তার মত্যুও হয়েছিলো ডিসেম্বরের ৯ তারিখেই (১৯৩২)। হয়তো তার জন্মের আসল তারিখটি লুপ্তই হয়ে গেছে। তাঁর জীবনকাহিনীও জানা যায় সামান্য; তবে তার ভেতরেও চোখে পড়ে রোকেয়া নামের অগ্নিশিখাটি।
পিতৃতান্ত্রিক, দুশ্চরিত্র, অপব্যয়ী, জমিদার পিতার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর গর্ভে তাঁর জন্ম হয়েছিলো। বেড়েছেন তিনি অন্ধকার অবরোধের মধ্যে, যেখানে মেয়েদের পড়াশুনো ছিলো নিষিদ্ধ। তবে বড়ো ভাইয়ের কাছে গোপনে শিখেছেন বাঙলা ও ইংরেজি, এবং শিখেছেন অত্যন্ত ভালোভাবে নিজেরই সহজাত প্ৰতিভায়। কেউ কেউ মনে করেন। রোকেয়া বিয়ের পরে স্বামীর কাছে ভালোভাবে শিখেছিলেন ইংরেজি: এটাও এক পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস। তাদের কাছে নারীর ইংরেজি শেখা বিস্ময়কব ব্যাপাব, বাঙলা নিজে নিজেই শেখা সম্ভব; ইংরেজি শিখতে হ’লে দরকার একটি উদার শিক্ষিত স্বামী!
যদি ধরি যে রোকেয়ার বিয়ে হয়েছিলো আঠারো বা ষোলো বছর বয়সে, তাহলে স্বামীর কাছে ইংরেজি শেখার তত্ত্বটি বাতিল ক’রে দিতে হয়; কেননা ওই বন্যাসের পর একটি বিদেশি ভাষা শেখা এবং তাতে Sultana’s Draum লেখা ভাষা অর্জন সম্পর্কে ভুল ধারণামাত্র। তাঁর বিয়ে হয়। কারো মতে ষোলো, কায়ো মতে আঠারো বছর বয়সে। বেশ বড়ো পরিহাস বলে মনে হয় রোকেয়ার বিয়েটিকে : বাঙালি নারীমুক্তির সন্তের বিয়ে হয় এক দোজবর, অবাঙালি, বিহারির সাথে।
তার স্বামীটি যে-বছর, ১৮৮০তে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন, সে-বছর জন্ম হয় তার; তিনি স্ত্রী হন। পিতার বয়স্ক এক পুরুষের। সাখাওয়াতের বয়স তখন ছিলো ৩৮ বা ৪২, রোকেয়ার ছিলো ১৬ বা ১৮। ওটি ছিলো বিয়ের জন্যে বিয়ে; বিয়ের সময়ই সবাই জানতো যে দীর্ঘ বৈধব্য পালনই হবে রোকেয়ার বিবাহিত জীবন। মুসলমান পিতৃতন্ত্র রোকেয়ার জীবনকে মর্মস্পশী ক’রে তুলতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি করে নি; তাকে ধ্বংস ক’রে দিতে পারলেই সেটি সার্থকতা বোধ করতো, কিন্তু পারে নি।
রোকেয়ার পিতা অমানুষ ছিলেন, কিন্তু বড়ো ভাই ও তাঁর স্বামীটি ভিন্ন ছিলেন ওই সময়ের মুসলমান পুরুষদের থেকে। রোকেয়ার সমগ্র রচনাবলি ভ’রে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ও ঘৃণা; ‘পুরুষ’ ধারণাটিই ছিলো তার কাছে আপত্তিকর। পুরুষদের তিনি যে সামান্য করুণা করেছেন, তা সম্ভবত ভাই ও স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে। রোকেয়ার রচনাবলির প্রধান বৈশিষ্ট্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; পশ্চিমের প্রথম নারীবাদী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের মধ্যেও এতোখানি পুরষবিদ্বেষ ও দ্রোহিতা দেখা যায় না।
মেরি পুরুষকে সমকক্ষ বন্ধু হিশেবে মেনে নিয়েছিলেন রোকেয়া তাও মানতে রাজি হন নি। মেরিব সাথে রোকেয়ার জীবনের মিল ও অমিল দু-ই চোখে পড়ে। মেরি ছিলেন গরিব পরিবারের মেয়ে, লেখাপড়া শিখেছিলেন নিজের চেষ্টায়, বালিকা বিদ্যালয় খুলেছিলেন, বই লিখেছিলেন বালিকাদের শিক্ষা সম্পর্কে। তিনি বিয়ে না ক’রে বাস করেছেন প্রেমিকের সাথে, জন্ম দিয়েছেন অপ্ৰথাগত কন্যা; প্রতারিত হয়েছেন, তারপর আবার প্রেমে পড়ে গর্ভবতী হয়েছেন, এবং কন্যা জন্ম দিতে গিয়ে লোকান্তরিত হয়েছেন মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে।
মেলােমশার সুযোগ পেয়েছেন মেরি ওই সময়ের শ্রেষ্ঠ পুরুষদের সাথে। রোকেয়া জন্মেছেন ধনী পরিবারে, বাল্য কেটেছে অবরোধে, বিয়ে হয়েছে পিতার বয়সী পুরুষের সাথে, জন্ম দিয়েছেন দুটি অকালমৃত কন্যা। তাঁর বিবাহিত জীবন এগারো বা তেরো বছরের। মেরি শারীরিক সম্পর্কে এসেছেন দুটি পুরুষের সাথে, এবং সংস্পর্শে এসেছেন বহু পুরুষের; রোকেয়া শারীরিকভাবে জেনেছেন একটি পুরুষকে, সে-জানাও ছিলো সম্ভবত অতৃপ্তিকর; আর সংস্পর্শে আসেন নি কোনো পুরুষের। রোকেয়ার সমাজের পুরুষ তার কাছে ছিলো পশুর সমান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পুরুষপ্রসঙ্গ তোলেনই নি : পিতাকে তিনি প্রায় পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন, স্বামী ও ভাইদের স্বীকার করেছেন অনেকটা করুণা ক’রে।
নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে নীরবতাই ছিলো তার স্বভাব, কিন্তু ইঙ্গিতেই তিনি জানাতে পারতেন প্রচুর। ৩০, ৪ ৩১-এর এক চিঠিতে লিখেছিলেন :
‘শৈশবে বাপের আদর পাই নি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ Urine পরীক্ষা করেছি। পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দুবার মা হয়েছিলুম-তাদেরও প্রাণভরে কোলে নিতে পারি নি। একজন ৫ মাস বয়সে, অপরটি ৪ মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বৎসর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি’ [দ্র মোশফেকা (১৯৬৫, ১৫)]।
এ হচ্ছে রোকেয়ার সমগ্র আত্মজীবনী, কয়েক পংক্তিতে লেখা কয়েক খণ্ড। এতে জীবনের প্রথাগত ব্যর্থতার ছবিটি যেমন মর্মস্পশী, তেমনই এর একটি পংক্তি সাংঘাতিক : ‘আর এই ২২ বৎসর যাবত বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি।’ বৈধব্যের কথা এলেই কেনো আসে আগুনের রূপক, দাউ দাউ ক’রে ওঠে কেনো দেহবহ্নুৎসব? বিদ্যাসাগর বালিকা বিধবার ‘অসহ্য বৈধব্যযন্ত্ৰণানলের কথা বার বার বলেছেন, রোকেয়া বলেছেন নিজেরই কথা। শরীরকে তিনি সম্পূর্ণ চেপে গেছেন কাজে ও লেখায়, পালন ক’রে গেছেন মুসলমান ব্ৰহ্মচর্য। মুসলমান পুরুষেরা যে তাকে ধন্যধন্য করে, তার অনেকটা তার ওই মর্ষকামী ব্ৰহ্মচর্যের জন্যে।
তিনি বলেছেন, ‘আশরাফগণ সপ্তম বর্ষীয়া বিধবা কন্যাকে চির-বিধবা রাখিয়া গৌরব বোধ করেন’ (রানী ভিখারিণী’, রোর, ২৯১); পদ্মরাগ-এ (রোর, ৪৬২) বলেছেন, ‘সিদিকা নিজেকে ‘চিরকুমারী’ জ্ঞান করিবেন না, কারণ চিরকুমারী নিঃস্ব;…. তিনি নিজেকে বিধবা মনে করবেন, যেহেতু বিধবার স্বামী-স্মৃতিরূপ বহুমূল্য সম্পদ থাকে। পতিধ্যান তাহার জীবনের নিত্যসহচর। তাহা না হইলে বিধবা বাঁচিবে কি লইয়া?’ এ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রকে মেনে নিয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
তবে রোকেয়া নিজে পতিধ্যান করেন নি। ২৫ ৪ ৩২-এর এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন : ‘আপনি ঘৃণাক্ষরেও ভাববেন না যে, আমার শ্রদ্ধেয় স্বামীর স্মৃতিরক্ষার জন্যই আমি এ স্কুল আঁকড়ে পড়ে আছি।… আমি আমার স্বামীর নামের কাঙ্গাল নই [মোশফেকা (১৯৬৫,২৪-২৫)]। তিনি বিদ্যালয়ের নামবদলের জন্যেও প্রস্তুত ছিলেন; কিন্তু তাঁর পুরুষ অভিভাবকেরা তাতে রাজি ছিলেন না; কেননা তারা ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল’ নামটিতে দেখতেন ‘পুরুষতেন্ত্রর জয়’;–একটি নারী বালিকাদের শিক্ষা দেয়ার ছলে পুজো ক’রে চলছেন একটি মৃত পুরুষকে!
নারীকে মুক্তি চাইতে হবে পুরুষাধিপত্য মেনে নিয়ে; পুরুষের লাশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ জীবিত নারীর থেকে। রোকেয়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি, বিয়ে তার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিলো না: তবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো পুরুষতন্ত্রের কাছে। রোকেয়া যদি আবার বিয়ে করতেন, তাহলে পুরুষতন্ত্র তাকে বাতিল ক’রে দিতো; নারীমুক্তির কথা ভুলে তাকে থাকতে বাধ্য করতো স্বামীর পদতলে। রোকেয়া ছিলেন আমূল নারীবাদী, কিন্তু তিনি জানতেন।
তিনি পৃথিবীর এক বর্বর পিতৃতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত; তাঁকে বিদ্রোহ করতে হবে ওই বর্বরতাকে স্বীকার ক’রেই। ওলস্টোক্র্যাফটের জীবন এ-সমাজে অকল্পনীয়। রোকেয়া নিজের মধ্যে সংহত করেছিলেন প্রবল দ্রোহিতা ও মর্ষকামিতাকে, পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণ ও পরাভূত করার জন্যে তাকে সুখের সাথে সহ্য করতে হয়েছে পুরুষতন্ত্রের পীড়ন। কিন্তু তিনি পুরুষতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্যে নিরন্তর লড়াই ক’রে গেছেন; তাঁর রচনাবলি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক ধারাবাহিক মহাযুদ্ধ।
রোকেয়া লিখেছেন প্ৰবন্ধ, গল্প, উপন্যাস; এবং প্রতিটি আঙ্গিক তিনি ব্যবহার করেছেন। পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্ররূপে। তাঁর প্রবন্ধ বিশুদ্ধ মননশীল প্ৰবন্ধ নয়, তাতে রয়েছে কথাশিল্পিতার ছাপ; আবার তার উপন্যাসও পুরোপুরি উপন্যাস নয়, তাতে রয়েছে প্রাবন্ধিকতার ছাপ। বিশুদ্ধ শিল্পসৃষ্টি তাঁর লক্ষ্য ছিলো না; তাঁর লক্ষ্য ছিলো পৌনপুনিক আক্রমণে পুরুষতন্ত্রকে দুর্বল ক’রে নারীকে সমাজে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করা। চেতনায় তিনি এগিয়ে ছিলেন তাঁর সময়ের মুসলমান ও হিন্দু সমস্ত পুরুষ, নারী ও মহাপুরুষদের থেকে; তার ছিলো সরাসরি মতপ্রকাশের চমৎকার স্বভাব, এবং ছিলো। প্রখর পরিহাসের শক্তি।
স্বামীর মৃত্যুর আগের রোকেয়ার লেখায় দেখা যায় আক্রমণাত্মক প্রবণতা, একাকী জীবনে তাঁর লেখায় বড়ো হয়ে ওঠে পরিহাস, তীক্ষ্ণ উইট, যা তাঁর অন্তৰ্গত বিষণ্নতার প্রকাশ। তিনটি ভাষা-বাঙলা, উর্দু, ইংরেজি-ছিলো তাঁর আয়ত্তে, তার হাতের লেখা ছিলো পুষ্পপাপড়ির মতো মনোহর; অনুরাগী ছিলেন তিনি প্রথাগত কবিতার, তিনি নিজেই ছিলেন ভালো কবি; এবং মননশীলতায় ছিলেন সে-সময়ের শ্রেষ্ঠদের একজন। উপন্যাস রচনায় ছিলেন তিনি বঙ্কিমানুসারী, তার পদ্মরাগ-এর প্লট বঙ্কিমী রীতিতে তৈরি। তিনি কি ওলস্টোনক্র্যাফটের নাম শুনেছিলেন, তার বইটি দেখেছিলেন? এর কোনো প্রমাণ তিনি রেখে যান নি, তবে মনে হয় মেরির বই তিনি দেখেন নি; দেখলে রোকেয়া ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে প্ৰবন্ধ না লিখে লিখতেন। সুপরিকল্পিত পূর্ণাঙ্গ বই।
তিনি ইংরেজিতে একটি চমৎকার ইউটোপিয়া লিখেছিলেন, এবং বাঙলায় অনুবাদ করেছিলেন; আজো সেটিই বাঙলায় লেখা একমাত্র ইউটোপিয়া। ইউটোপিয়া ও অ্যান্টি-ইউটোপিয়া বা ডিস্টোপিয়া তার চেতনায় বড়ো স্থান ক’রে নিয়েছিলো; কেননা তিনি যে-সমাজে বাস করতেন সেটিই ছিলো এক মূর্ত অ্যান্টি-ইউটোপিয়।, এবং তিনি পেরিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ওই সমাজকে। শুধু ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নয়, তাঁর পদ্মরাগও একধরনের ইউটোপিয়া, আর তার কয়েকটি রূপকথা- ‘জ্ঞানফল’, ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’, ‘নারীসৃষ্টি’, ‘মুক্তিফল’ ইউটোপিয়া ও অ্যান্টি-ইউটোপিয়ার মিশ্রণী।
রোকেয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন সার্বিক আক্রমণ। তিনি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছেন। পুরুষতন্ত্রের তৈরি নারী ও পুরুষের ভাবমূর্তি, বর্জন করেছেন নারীপুরুষের প্রথাগত ভূমিকা; তুলনাহীনভাবে আক্রমণ করেছেন পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা ধর্মকে। রোকেয়া পরে ধর্মের সাথে কিছুটা সন্ধি করেছেন আত্মরক্ষার জন্যে; নইলে তাকে ও তাঁর আদর্শকে অত্যন্ত বিপন্ন ক’রে তুলতো মুসলমান পিতৃতন্ত্র। তিনি এমন এক পিতৃতন্ত্রের সদস্য ছিলেন, যেখানে পুত্র মাকে শেখায় সতীত্ব।
তাঁর ভাগনে আবদুল করিম গজনভি, বাল্যকালেই বিলেতে গিয়েছিলেন, মন্ত্রী আর স্যার হয়েছিলেন, কিন্তু মধ্যযুগ থেকে বেরোতে পারেন নি; তিনি খালা রোকেয়াকে পর্দা শেখাতে দ্বিধা করেন নি। খালাকে শর্ত দিয়েছিলেন যদি খালা পর্দা মানেন (এর অর্থ রোকেয়ার আচরণ পর্দাসম্মত ছিলো না বিলাতফেরত স্যার-ভাগনের মতে), তবে তিনি রোকেয়ার স্কুলটি সরকারি করে দেবেন। পুত্র যেখানে মাকে সতীত্ব শেখায়, সে-উৎকট ভূখণ্ডে রোকেয়া ধর্মের নামে মাঝেমধ্যে দু-একটি খাই উৎসর্গ ক’রে নিস্তেজ ক’রে দিতে চেয়েছেন ধর্মকে।
১৯০৪-এ বেরোয রোকেয়ার মূর্তিভাঙা প্ৰবন্ধ ‘আমাদের অবনতি’ (নবনূর : ১৩১১, ভাদ্র)। মতিচুর-এ (প্রথম খণ্ড : ১৯০৫) মুদ্রিত হয় এর খণ্ডিত, মুসলমান পিতৃতন্ত্রের অনুমোদিত রূপ : ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’। এটি রোকেয়ার Vindication of the Rights of Wonian। ওলস্টোনক্র্যাফটের মতো রোকেয়া নারীমুক্তির সার্বিক প্ৰস্তাব পেশা করেন নি। এ-প্রবন্ধে, তবে নারীমুক্তির মূলকথার সবই এতে রয়েছে সংক্ষেপে। এর ‘আপত্তিকর’ অংশের সাথে বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায় এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন ও অন্যান্যের ‘নারীর বাইবেল’-এর (১৮৯৫, ১৮৯৮)।
নারীবাদনেত্রী স্ট্যান্টন দেখেছিলেন, নারীমুক্তির বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্র সব সময়ই উচিয়ে ধরে বাইবেল, তাই তিনি বাতিল ক’রে দেন বাইবেলকেই। তিনি আক্রমণ করেন বাইবেলি নারীর ভূমিকা ও ভাবমূর্তিকে; বলেন : ‘বাইবেলকে আমরা দীর্ঘকাল ধ’রে অন্ধভক্তির বস্তু ক’রে তুলেছি। এখন এটি অন্যান্য বইয়ের মতো পড়ার সময় এসে গেছে, নিতে হবে এর ভালো শিক্ষা বাদ দিতে হবে খারাপটা’ [দ্র হোল ও লেভিন (১৯৭৩, ৪৪৫)]। তিনি ‘পাঁজরের হাড়ের’ গল্পটিকে ‘তুচ্ছ অস্ত্ৰোপচার’ বলে বাতিল ক’রে দেন; দেখান যে সম্পূর্ণ বাইবেল দাঁড়িয়ে আছে হাওয়া বা নারীর পাপের ধারণা ভিত্তি করে।
তিনি বলেন, সাপটি, ফলগাছটি এবং নারীটিকে সরিয়ে নাও; তারপর আর থাকে না কোনো পতন, কোনো ক্রুদ্ধ বিচারক, কোনো নরক, কোনো চিরশাস্তি:- সুতরাং দরকার পড়ে না কোনো ত্ৰাতার। এভাবে খসে পড়ে সমগ্র খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের তলদেশ। এ-কারণেই সমস্ত বাইবেলি গবেষণা ও উচ্চতর সমালোচনায় পণ্ডিতেরা কখনো নারীর অবস্থানটি ছুঁয়ে দেখেন না’ [দ্র হোল ও লেভিন (১৯৭৩, ৪৪৫)]। এর ফলে হৈচৈ পড়ে পশ্চিমে; ভদ্ৰ নারীমুক্তিবাদীরা অস্বীকার করেন স্ট্যান্টনকে।
এর মাত্র ন-বছর পরে পৃথিবীর এক অন্ধকার কোণে উগ্র পিতৃতন্ত্রের মধ্যে রোকেয়া, মাত্র চব্বিশ বছরের তরুণী, ঘোষণা করেন : ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।’ পিতৃতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নারী সরাসরি বাতিল ক’রে দেন কোনো বিশেষ একটি ধর্মগ্রন্থকে নয়, সমস্ত ধর্মগ্রন্থকে; ধর্মগ্রন্থের পেছনের সত্যকে প্রকাশ করেন অকপটে। পিতৃতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থাটি এর আগে, ও পরে, এমন আঘাত আর কখনো বোধ করে নি। [রোর, সম্পাদকের নিবেদন, (১১)-(১৩)] :
‘আমাদেব যথাসম্ভব অধঃপতন হওয়ার পর দাসত্বের বিরুদ্ধে কখনও মাথা তুলিতে পাৱি নাই; যখনই কোন ভাগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, ওমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন রূপ অস্ত্ৰাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মেরি আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি; এখন ত অবস্থা এই যে, ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্রই শুনিতে পাই : ‘প্যাটু তুই জন্মেছিস্ গোলাম, থাকিবি গোলাম।’ সুতরাং আমাদের আত্মা পর্যন্ত গোলাম হইয়া যায় …
আমরা যখনই উন্নত মস্তকে অতীত ও বর্তমানেব প্রতি দৃষ্টিপাত করি, আমনই সমাজ বলে : ‘ঘুমাও, ঘুমাও, ঐ দেখ নরক।’ মনে বিশ্বাস না হইলেও অন্ততঃ আমরা মুখে কিছু না বলিয়া নীরব থাকি।…. আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ কবিয়াছেন।…
এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রূচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন অন্যকিছুই নহে। মুণিদের বিধানে যে-কথা শুনিতে পান, কোন স্ত্রী মুণির পিন্ধানে হয়ত তাহার বিপরীত নিয়ম দেখিতে পাইতেন। যাহা হউক, ধর্ম গ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত কি না, তাহা কেহই নিশ্চয় বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোন দূত বৰ্মণী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণ করিতেন, তবে সে দূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না।…এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।…
‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর কবিয়াছে, ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।…’
রোকেয়া কোনো বিশেষ ধর্মকে বাতিল করেন নি, বাতিল করেছেন সব ধর্মকেই। ১৯০৪-এ এটা সম্ভব ছিলো, কিন্তু রোকেয়া যদি আজ একথা বলতেন, তবে তাকে প্রকাশ্য রাস্তায় ছিঁড়ে ফেলা হতো। মুসলমান পিতৃতন্ত্র তাঁর ধর্মসমালোচনা অনুমোদন করে নি, তাই রোকেয়াকে বাদ দিতে হয়েছিলো তাঁর রচনার শ্রেষ্ঠাংশ; এবং পরে তাকে কিছুটা সন্ধি করতে হয়েছিলো মুসলমান পিতৃতন্ত্রের সাথে। স্ত্রীজাতির অবনতি’তে রোকেয়া শুধু পিতৃতন্ত্রের হিংস্র বলপ্রয়োগসংস্থাটিকে আক্রমণ করেন নি, তিনি আক্রমণ করেছেন পুরুষতন্ত্রের সমগ্র জীবন পরিকল্পনাকেই। তিনি ব্যাখ্যা ও বাতিল করেছেন পুরুষতন্ত্রের তৈরি প্রতিটি ভাবমূর্তি।
নারীর সমস্ত প্রথাগত ভাবমূর্তি বর্জন ক’রে তিনি নারীর অবস্থানের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন নারী দাসী মাত্র। তিনি বলেছেন, ‘এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কি? দাসী৷’ (রোর, ১৭)!! একবার নয়, বলেছেন বার বার। তিনি বলেছেন, ‘দাসী’ শব্দে অনেক শ্ৰীমতি আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, ‘স্বামী’ শব্দের অর্থ কি? দানকর্তাকে ‘দাতা’ বলিলে যেমন গ্রহণকর্তালে “গ্রহীতা” বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে “স্বামী, প্রভু, ঈশ্বর” বলিলে অপরকে “দাসী” না বলিয়া আর কি বলিতে পারেন’ (রোর, পাদটীকা, ১৮-১৯)? তার কাছে নারীপুরুষের প্রথাগত সম্পর্ক কোনো পবিত্র মহৎ ব্যাপার নয়; তা শক্তিব সম্পর্ক, যাতে একজন জয়ী ও আরেকজন পরাজিত। রোকেয়া জানতেন। নারীপুরুষের লৈঙ্গিক রাজনীতিতে বলপ্রয়োগের ফলে নারী পরাজিত; তাদের সম্পর্ক লৈঙ্গিক রাজনীতিক।
নারী কেনো দাসী হয়েছে, তাও ব্যাখ্যা করেছেন রোকেয়া; তাঁর ব্যাখ্যা অনেকটা এঙ্গেলসের (১৮৮৪) ব্যাখ্যার কাছাকাছি। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন ব্যক্তিমালিকানা ও পরিবারের উৎপত্তিই নারীর পুরুষাধীনতার মূলে; এবং রোকেয়া (রোর, ১৭) বলেছেন :
পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না, সমাজবন্ধন ছিল না, তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ মানবজাতিব এক অংশ (নর) যেমন নানা বিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিণী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল।
তিনি বিশ্বাস করেন যখন সমাজবন্ধন ছিলো না, তখন মুক্ত স্বায়ত্তশাসিত ছিলো নারী। সমাজবন্ধনের মূলেই রয়েছে পরিবার, তাই পরিবারই যে নারীর দাসীত্বের মূল কারণ, তা অস্পষ্ট থাকে নি তার কাছে। পরিবারে পুরুষ হয়েছে প্ৰভু, নারী দাসী। তিনি অবশ্য প্রশ্ন করেছেন, ‘আমাদের এ বিশ্বব্যাপী অধঃপতনের কারণ কেহ বলিতে পারেন কি? সম্ভবত সুযোগের অভাব ইহার প্রধান কারণ। স্ত্রীজাতি সুবিধা না পাইয়া সংসারের সকল প্রকার কার্য হইতে অবসর লইয়াছে’ (রোর, ১৭)। সুযোগটা যে নারীকে দেয় নি। পুরুষ, তাও তিনি জানিয়েছেন।
যুগ যুগ ধরে দাসত্বের কুপ্রভাব পড়ে দাসদের স্বভাবের ওপর, নারীর ওপরেও পড়েছে; রোকেয়া তাও দেখিয়েছেন চমৎকার ও বিস্তৃতভাবে। ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিন্ডিকেশন-এর চতুর্থ পরিচ্ছেদের নাম ‘Observations on the State of Degradation to which Woman is Reduced by Various Causes’: নানা কারণে নারীর যে-অবনতি ঘটেছে, সে-সম্পর্কে ‘পর্যবেক্ষণ’। রোকেয়ার প্রবন্ধটির নাম ‘আমাদের/স্ত্রীজাতির অবনতি’ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ওলস্টোনক্র্যাফটু দেখিয়েছেন নারীকে বন্দী করার পর তার মানসিক শক্তি সম্পূর্ণ নষ্ট ক’রে ফেলা হয়েছে, নারীকে শেখানো হয়েছে তুচ্ছ রূপ, বিনোদন, ভাবাবেগ প্রভৃতিতে মেতে থাকতে, আর তারাও বোধ করেছে ‘নিকৃষ্টতায় মহিমান্বিত’!
রোকেয়াও বলেছেন একই কথা : ‘আমাদের মন পর্যন্ত দাস (Enslaved) হইয়া গিয়াছে’ (রোর, ১৭)। ওলস্টোনক্র্যাফটু রূপচর্চা, অলঙ্কার, বিনোদন, উপন্যাস পড়া, শারীরিক ও মানসিক বলহীনতাকে আক্রমণ করেছেন প্রবলভাবে, রোকেয়াও তাই করেছেন। রোকেয়া বলেছেন, ‘সৌন্দর্যবর্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্বলতা নহে (রোর, ২১)? তিনি প্রশ্ন করেছেন, ‘আমরা শারীরিক বল, মানসিক সাহস, সব কাহার চরণে উৎসর্গ করিয়াছি (রোর, ২৪)?
ওলস্টোনক্র্যাফটের মতোই বলেছেন, ‘শরীর যেমন জড়পিণ্ড, মন ততোধিক জড়’ (রোর, ২৫); বলেছেন, ‘আমাদের শয়ন-কক্ষে যেমন সূর্যালোক প্রবেশ করে না, তদ্রুপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না’ (রোর, ২৬); বহুকাল হইতে নারী-হৃদয়ের উচ্চ বৃত্তিগুলো অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায়, নারীর অন্তর, বাহির, মস্তিষ্ক, হৃদয় সবই “দাসী” হইয়া পড়িয়াছে’ (রোর, ১৮)।
রোকেয়া ভিন্ডিকেশন পড়েন নি ব’লেই মনে হয়, পড়লে নারীর অধিকার সম্পর্কে হয়তো সম্পূর্ণ বইই লিখতেন; কিন্তু কেনো মিল ওলস্টোনক্র্যাফটের সাথে তাঁর? এর এক চমৎকার উত্তর অন্য প্রসঙ্গে তিনি নিজেই দিয়েছেন : ‘বঙ্গদেশ, পাঞ্জাব, ডেকান (হায়দরাবাদ), বোম্বাই, ইংল্যান্ড- সৰ্ব্বত্র হইতে একই ভাবের উচ্ছাস উখিত হয় কেন? …ইহার কারণ সম্ভবতঃ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা’ (মতিচুর, নিবেদন)! এ যে প্রচণ্ড পরিহাস- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা’- এটাও পুরুষতন্ত্রকেই পরিহাস। তিনি জানেন এটা আধ্যাত্মিক নয় সম্পূর্ণ বাস্তবের একতা, নারীর দাসীত্ব বিশ্বজনীন ব্যাপার। অলঙ্কারের যে-ব্যাখ্যা রোকেয়া (রোর, ১৯-২০) দিয়েছেন, তা নারীকে দাসী থেকে পশুর স্তরে নামিয়ে দিয়েছে :
‘আমাদের অতিপ্রিয় অলঙ্কারগুলি-এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ! এখন ইহা সৌন্দর্যবর্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে; কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলঙ্কার দাসত্ত্বের নিদর্শন (Originally Hadges of Slavery) ছিল। তাই দেখা যায় কারাগারে বন্দীগণ পায় লৌহনির্মিত বেড়ী পরে, আমরা (আদরের জিনিস বলিয়া) স্বর্ণরৌপ্যের বেড়ী অর্থাৎ ‘মল’ পরি। উহাদের হাতকড়ি লৌহ-নির্মিত, আমাদেব হাতকড়ি স্বর্ণ বা রৌপ্য-নির্মিত চুড়ি কুকুরের গলে যে গলাবন্ধ (চমথ-ড়মফফটব্য) দেখি, উহারই অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয় চিক নির্মিত হইয়াছো…গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া ‘নাকাদড়ী’ পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের ‘নোলক’ পরাইয়াছেন!! ঐ নোলক হইতেছে ‘স্বামী’ব অস্তিত্বের (সধবার) নিদর্শন!’
নারী শুধু দাসীই নয়, তারও নিম্নস্তরের; তিনি বলেছেন, ‘আমি আজ ২২ বৎসর হইতে ভারতের সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট জীবের জন্য রোদন করিতেছি’ (রোর, ২৭৭)। তিনি দেখিয়েছেন নারী আসলে নিরাশ্রয়, কেননা তার নিজের বলে কিছু নেই; এমনকি নিজের ওপরও নেই নারীর নিজের অধিকার। নারীর সবখানেই থাকে পরাশ্ৰিত; যখন আমরা রাজকন্যা, রাজবধুরূপে প্রাসাদে থাকি, তখনও প্রভু-গৃহে থাকি।
যখন… গোশালায় গিয়া আশ্রয় লই,-তখনও অভিভাবকের বাটিতে থাকি।.গৃহ বলিতে আমাদের একটিও পর্ণকুটীর নাই। প্ৰাণী-জগতের কোন জন্তুই আমাদের মত নিরাশ্রয় নহে। সকলেরই গৃহ আছে- নাই কেবল আমাদের (‘গৃহ’, রোর, ৭৪)। মনে পড়ে উলফের এ রুম অফ ও অ্যান্স জেট্রন-এর কথা। পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণের জন্যে তিনি নারীর অবস্থানটিকে শনাক্ত ক’রে নিয়েছেন, এবং নারীর বিকৃত স্বভাবের পরিচয় দিয়েছেন।
‘পুরুষ’ ধারণাটি রোকেয়ার ধারাবাহিক আক্রমণস্থল : তিনি উপহাস করেছেন পুরুষকে, তাকে গণ্য করেছেন পশুর থেকেও নিকৃষ্ট, আদমেব কাল থেকেই পুরুষকে দেখিয়েছেন নির্বোধরূপে। পুরুষ তার চোখে প্ৰতারক আর পীড়নকারী। প্রাচীন কাল থেকে বিশ্বজুড়ে চলে এসেছে নারীবিদ্বেষের যে-ধারাটি, রোকেয়া একা যেনো তাকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছেন প্রচণ্ড পুরুষবিদ্বেষের সাহায্যে। পুরুষ তাঁর নিরন্তর আক্রমণলক্ষ্য, কেননা পুরুষ নারীকে পরিণত করেছে দাসীতে, পুরুষ কেড়ে নিয়েছে নারীর স্বাধিকার ও স্বাধীনতা; কিন্তু তিনি নারীর সাম্য চেয়েছেন তাঁর ধিক্কৃত পুরুষের সাথেই।
তাঁর পুরুষবিদ্বেষ ও পুরুষের সাথে সাম্য লাভের দাবি এমনভাবে প্রকাশ পেয়েছে যে ফ্রয়েড বা ফ্রয়েডীয়রা তাকে পেলে খুব সুখবোধ করতেন; তাঁরা তাকে শনাক্ত করতেন এক পুংগূঢ়ৈষ্যা-শিশ্নাসূয়াগ্রস্ত নারীরূপে; কিন্তু তিনি তাদের যে-উত্তর দিতেন, তাতে অনেক আগেই ভেঙে পড়তো ফ্রয়োডীয় মনোবিজ্ঞানের কুসংস্কারসৌধ। তিনি পুরুষকে বলেছেন, ‘নিরাকারে পিশাচ’ (‘গৃহ’, রোর, ৭৩); বলেছেন, ‘ডাকাতী, জুয়াচুরি, পরস্বাপহরণ, পঞ্চ ‘মকার’ আদি কোন পাপের লাইসেন্স তাঁহাদের নাই’ (পদ্মরাগ : রোর, ৩৩৪)? বাঙালি পুরুষকে পরিহাস ক’রে বলেছেন, ‘ভারতের পুরুষসমাজে বাঙ্গালী পুরুষিকা’ (‘নিরীহ বাঙ্গালী’, রোর, ৩২)!