নারী

হুমায়ুন আজাদ

৪৭. নারীর ভবিষ্যৎ (পর্ব-১)

[প্রথম খন্ড]

নারী কি বিপন্ন? নারী কি এমন কোনো প্ৰজাতি, যা ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে, বা ব্যাপক নিধনের ফলে পৌচেছে অবলুপ্তির প্রান্তে, যাকে বাঁচিয়ে রাখা দরকার পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য? না, নারী এমন কোনো প্ৰজাতি নয়; নারী সংখ্যায় হ্রাস পাচ্ছে না, ব্যাপক সংহারেরও শিকার নয়, বরং গ্রহ জুড়ে বাড়ছে নারীর সংখ্যা। তবে প্রতি প্রজন্মের রক্ষণশীলেরাই আৰ্তনাদ করেছে; এখন আর খাঁটি নারী নেই, যারা ছিলো সুখ শান্তি কল্যাণ সতীত্ব পাতিব্ৰত্য প্রভৃতি বৰ্মণীয়তার আধার, তারা অবলুপ্ত হয়েছে।

প্রতি প্রজন্মের প্রতিক্রিয়াশীলেরা তাদের চারপাশে প্রাচীন পুণ্যময়ী নারীর বদলে বিকশিত হ’তে দেখেছে দানবী, যারা নষ্ট করছে সংসার, পতিকে পদচ্যুত করছে দেবাসন থেকে, এবং সন্দেহজনক যাদের সতীত্ব। উনিশশতকের বাঙলায় প্রাচীনার অবলুপ্তিতে আর্তনাদ করেছে। পুরুষতন্ত্র; দিকে দিকে, সংসারবৃক্ষের ডালে ডালে, ঝুলতে দেখেছে ‘বিষময় ফল’। বিষাক্ত নারী ফুল ফুটিয়েছে ফল ধরিয়েছে বিষবৃক্ষের। পুরুষের চোখে চিরকালই নারী নয়, নারীত্ব বিপন্ন, তাই পুরুষ সব সময়ই চেষ্টা করেছে নারীকে আদিম অবস্থায় রেখে দিয়ে ‘নারীত্ব’ উপভোগ করতে।

নারীর মৃত্যুতে তাদের দুঃখ নেই, তাদের উদ্বেগ নারীত্বের মৃত্যুতে। নারীর সামনে সময় থাকে, নারীর বয়স বাড়ে, সময়ের কামড় বোধ করে নারী; কিন্তু নারীর কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না। পুরুষ এগোয় ভবিষ্যতের দিকে, নারী এগোয় বার্ধক্য ও ভবিষ্যৎহীনতার দিকে; তাই বিশশতকের শেষ দশকে পৌঁছেও মনে হয় নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, যদি নারী তা সৃষ্টি করতে না চায়। পুরুষের হাতে নারীর ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয়ার অর্থ বিপন্নতা, পুরুষের হাতে পর্যুদস্ততা।

প্ৰণতির অগ্ৰগতি ধারাবাহিক ব্যাপার নয়, প্রগতির পর প্রতিক্রিয়াশীলতা মাঝেমাঝেই দেখা দেয়: বিশশতকের শেষাংশে প্রতিক্রিয়াশীলতাই হয়ে উঠছে প্রবল, তাই তা নারীর জন্যে বড়ো আতঙ্কের কারণ। সব ধরনের প্রগতিশীলতা নারীর জন্যে শুভ, প্রতিক্রিয়াশীলতা অশুভ। পিতৃতন্ত্র যতো সংস্থা তৈরি করেছে, —পরিবার, বিয়ে, সমাজ, ধর্ম, বিদ্যালয় সবই মর্মমূলে প্রতিক্রিয়াশীল, এগুলোকে অনেক শতকেও প্রগতিশীল করা যায় নি; কেননা সমাজরাষ্ট্র যারা অধিকার ক’রে আছে, তাদের জন্যে প্রতিক্রিয়াশীলতাই আধিপত্য রক্ষার উপায়। কয়েক সহস্ৰক ধরে নারী ভবিষ্যতহীন, বিশশতকের শেষাংশেও নারী ভবিষ্যতহীন। তার সামনে অনেক শতাব্দী, কিন্তু তার সামনে ভবিষ্যৎ নেই।

পৃথিবী জুড়ে আগের থেকে নারীর অবস্থা কিছুটা ভালো, অবশ্য খারাপও হয়েছে অনেক দেশে : ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ও কয়েকটি মুসলমান রাষ্ট্রে দু-তিন দশক আগের থেকে অনেক শোচনীয় এখন নারীর অবস্থা। তবে অধিকাংশ দেশে আগের থেকে কিছুটা ভালো আছে নারী, কিন্তু বেশি ভালো নেই; এখন এমন সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন মহাদেশে যে শিগগিরই নারীর অবস্থা হবে খুবই খারাপ।

নারী এখন কয়েকটি মুসলমান দেশ ছাড়া এক ঘর থেকে বেরোতে, ভোট দিতে, শিক্ষা লাভ করতে, কিছু পেশায় জড়িত হতে পারে, এবং কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে। শোনা যায় পৃথিবীর খুব উন্নতি ঘটেছে, ঘাঁটি চলছে দ্রুত পরিবর্তন; কিন্তু ওই উন্নতি আর পরিবর্তন যতোটা কিংবদন্তি ততোটা বাস্তব নয়। গত আড়াই শো বছরের বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের ফলে পৃথিবীর ঘটেছে নানা বাহ্যিক পরিবর্তন; মানুষ চাঁদে গেছে, ঘরে বসে আজ সারা পৃথিবী দেখা যায়, টেস্টটিউবে উৎপাদিত হচ্ছে শিশু, কিন্তু নারীকে এখনোও রেখে দেয়া হয়েছে আদিম অবস্থায়ই।

সংখ্যাধিক্যবশত পৃথিবী নারীদেরই গ্রহ, কিন্তু তারা এখনো এখানে পরবাসী, পুরুষের শোষণসামগ্ৰী। পুত্বপশ্চিমে মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, পুরুষতন্ত্রের কাছ থেকে কিছুটা সুবিধা আদায় ক’রে নিয়েছে কিছু নারী, কিন্তু অধিকাংশ নারীর অবস্থা শোচনীয়। গত দুশো বছরে গৃহপালিত পশুর অবস্থার যতোটা উন্নতি ঘটেছে নারীর অবস্থার ততোটা উন্নতি ঘটে নি। কিছু নারী এখন বিখ্যাত, কিছু নারী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তিধর, কিন্তু তা নারীর অবস্থার সূচক নয়; বিখ্যাত ও শক্তিধর নারীরাও পুরুষাধীন, পুরুষশোষিত; কেননা পৃথিবী পুরুষতান্ত্রিক।

নারীপুরুষের বিশুদ্ধ সাম্য কোথাও এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নি; নারী তার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার অধিকার পায় নি, যদিও তার অধিকার আন্দোলনের বয়স দুশো বছর। নারীর সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা ও বিধান তৈরি করছে এখনো পুরুষই, পুরুষই স্থির করছে কী মঙ্গলজনক নারীর জন্যে। শোষণমুক্তির জন্যে শোষিতরা এক সময় স্বপ্ন দেখেছে সমাজতন্ত্রের, কিন্তু সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক ব্যর্থতা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনাও নষ্ট ক’রে দিয়েছে; এবং যারা মনে করছে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলে দিতে না পারলে মুক্তি আসবে না।

নারীর, তারা নারীমুক্তিকে সমর্পণ করছে অনিশ্চিত সময়ের হাতে। আসলে তারা চায় প্রথমে পুরুষের মুক্তি, পরে ভেবে দেখবে নারীর মুক্তি, সাম্য, অধিকার প্রভৃতির কথা। কবে সমাজসংগঠন সম্পূর্ণ বদলাবে, তার জন্যে যদি অপেক্ষা করতে হয় নারীকে, তাহলে হয়তো নারী সম্পূর্ণ ভুলে যাবে নিজের মুক্তির কথা। নারীমুক্তিকে সময়ের হাতে ছেড়ে দেয়া যায় না; সম্পূর্ণ সমাজসংগঠন বদলের অপেক্ষায়ও স্থগিত ক’রে রাখা যায় না। নারীর মুক্তি। আর সমাজসংগঠন বদলালেই যে মুক্তি পাবে নারী, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই; কেননা দেখা গেছে সামজতন্ত্রের মধ্যেও নারী পুরুষের সমান অধিকার পায় নি।

তবে সব ধরনের সমাজতন্ত্রই নারীর জন্যে মঙ্গলজনক, যদিও তা-ই যথেষ্ট নয়; নারীমুক্তির জন্যে দরকার সমাজতান্ত্রিক কিছু: এবং গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের মধ্যেও অর্জন করা সম্ভব অনেক অধিকার। নারীর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। শুধু ধর্মতান্ত্রিক মৌলবাদের মধ্যে, মৌলবাদ নারীর চরম শত্রু। আড়াই শতকের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলো পৃথিবীর বাহ্যিক বদল ঘটিয়েছে, অভ্যন্তর বদল বিশেষ ঘটাতে পারে নি; মানব মন ও সমাজের আজো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি, মৌলিক বদল ঘটানো ওই আবিষ্কারগুলোর লক্ষ্যও নয়।

বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোর থেকে আজো মানুষের ওপর বেশি প্রভাবশালী পুরোনো পুরুষাধিপত্যবাদী সংহিতাগুলো, বিজ্ঞানকে ওগুলোকে প্রতিরোধ করার কাজেও ব্যবহার করা হয় নি; বরং বিজ্ঞানকে নতজানু ক’রে রাখা হয়েছে ওই সব পুরোনো কুসংস্কারের কাছে। তাই আধুনিক পৃথিবীও যথেষ্ট আধুনিক নয়; এর ভেতরে আদিমতারই প্রাধান্য। নারী ওই আদিমতারই শিকার। বিজ্ঞান পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব জিনিশ, তাই ব্যবহৃত হচ্ছে পুরুষতন্ত্র ও বিশেষ একগোত্র পুরুষের স্বার্থে।

যে-সব ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা, সেগুলো হচ্ছে পরিবার, বিয়ে, শিক্ষা, পেশা, রাজনীতি, ও ধর্ম। পিতৃতান্ত্রিক সব সংঘ আর ব্যবস্থাই নারীর বিরুদ্ধে। এগুলো প্রথাগত সমাজব্যবস্থা স্থায়ী ক’রে রাখার প্রয়াসে লিপ্ত। পুরুষাধিপত্য টিকিয়ে রাখার ক্ষুদ্রতম প্রতিষ্ঠান পরিবার, বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র রাষ্ট্র কাজ ক’রে চলছে পরিবারের মধ্য দিয়ে, তাই পুরুষতন্ত্র খুবই ব্যাকুল পরিবারসংগঠন অপরিবর্তিত রাখার জন্যে। পরিবারে আজো প্রধান পুরুষ; সমাজ তাকে এ-প্রাধান্য দিয়েছে, এবং এমন ব্যবস্থা করেছে, যাতে রক্ষা পায় তার প্রাধান্য।

পুরুষকে দিয়েছে আর্থনীতিক অধিকার; আজো পুরুষই সাধারণত আয় ও সংসার ভরণপোষণ করে, তাই পুরুষই আধিপত্য করে সংসারে। নারী পরিশ্রম করে পুরুষের থেকে অনেক বেশি, তার শ্রম পুরুষের শ্রমের থেকে অনেক বেশি ক্লান্তিকর, কিন্তু তা নিরর্থক। দরিদ্র নারীদেব শ্রমের শেষ নেই, সংসার সচল রাখার পেছনে তাদের শক্তি তারা পুরোপুরি নিয়োগ করে; কিন্তু তাদের সাংসারিক শ্রমের কোনো মূল্য নেই। পৃথিবী জুড়ে এখন প্রধান শ্রমিক শ্রেণী নারী, তারা উৎপাদন করে দেশের অধিকাংশ সম্পদ, কিন্তু তাদের পারিশ্রমিক ন্যূনতম।

বাঙলাদেশে এবার বৈদেশিক আয়ের প্রায় সবটাই উপার্জন করেছে নারীরা, বস্ত্ৰবালিকারা; কিন্তু তারা তার ভাগ পায় নি, পরিবারেও তাদের স্থান গৌণ, সমাজে তারা অসম্মানিত ৷ যে-বস্ত্ৰবালিকার আয়ে সংসার চলে, তার স্বামী বা পিতা হয়তো কোনো আয়ই করে না, কিন্তু সেই প্রাধান্য করে পরিবারে ও সমাজে। শিক্ষিত নারীদের বেলা একই ঘটনা ঘটে, তারা তাদের যোগ্যতার থেকে আয় করে অনেক কম। তাদের, দরিদ্র নারীদের থেকেও, অনেক বেশি নির্ভর করতে হয় স্বামীর আয়ের ওপর; এক নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করতে হ’লে অধিকাংশ শিক্ষিত নারীই বস্তিজীবন কাটাতে বাধ্য হতো। শিক্ষা আজো নারীকে আর্থনীতিক স্বনির্ভরতা দেয় নি; কাজে আসে নি নারীমুক্তিতে।

এক শ্রেণীর শিক্ষিত নারীই সহযোগিতা ক’রে চলছে পুরুষাধিপত্য ও নারী-অধীনতা রক্ষায়; ওই নারীরা পরগাছা, তারা আজো সুখ পায় সুখকর ক্রীতদাসীত্বে। নারীর প্রধান শত্ৰু শিক্ষিত গৃহিণীরা, যারা শিক্ষিত কিন্তু শুধুই গৃহিণী। ওই নারীরা শুধুই মাংস, তারা পুরুষ্যের প্রমোদসঙ্গিনী, স্বামীর প্রমোদবালা; তারা বেছে নিয়েছে অধীনতা। তারা অনেক বেশি অসহায় শ্রমিক নারীর থেকেও, শ্রমিক নারী যে-স্বাধীনতা ভোগ করে তারা তাও ভোগ করে না, এবং স্বামী তাদের ছেড়ে দিলে পথনারী হওয়া ছাড়া আর কোনো যোগ্যতা তাদের থাকে না।

তারা এটা জানে, তাই নিজেদের স্বার্থে সেবা ক’রে চলে পুরুষতন্ত্রের; তারা সুবিধার বিনিময়ে বাতিল ক’রে দেয় নিজেদের সত্তা ও স্বাধীনতা। শুধু নিজেদের নয়, তারা শত্ৰুতা ক’রে চলে স্বাধীন নারীর সাথে, নিজের স্বাধীনতা হারানোর পর অন্যের স্বাধীনতা নষ্ট করা হয় তাদের কাজ। শিক্ষিত ধনী গৃহিণীরা যে-সচ্ছলতার মধ্যে থাকে শিক্ষিত কর্মজীবী নারীরা সাধারণত ততোটা সচ্ছলতায় থাকে না; তারা বিচিত্র বিলাসের মধ্যে থেকে উপহাস করে চলে কর্মজীবী শিক্ষিত নারীদের। তাদের কৃতিত্ব তারা ধনী স্বামী ধরতে পেরেছে।

একটি শিক্ষিত নারী যখন দেখে সে কাজ করে, কিন্তু ওই বিলাস নেই তার জীবনে, তখন তার মনে এমন বোধ জন্ম নেয়া স্বাভাবিক যে শিক্ষিত না হয়ে বা পেশা গ্ৰহণ না করে একটি ধনী স্বামী ধরাই ছিলো অনেক ভালো। এ-বোধটা আরো প্রবল হয়ে উঠতে পারে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে। –কোনো বালিকা যখন দেখে তার মায়ের মতো পেশা গ্ৰহণ করে কষ্ট করার চেয়ে পাশের বাড়ির মহিলাটির মতো একটা ধনী স্বামী ধরলে জীবন অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে, তখন সে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছে ছেড়ে দিতে পারে। এমন ঘটছে এখন বাঙলাদেশে। পরগাছারা এখন এতো আকর্ষণীয় যে অনেক বালিকাই নিজের শেকড় গভীরে ছড়ানোর অভিলাষ ছেড়ে দিয়ে সোনালি পরগাছা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। পরগাছারা ওই বিলাস কেনে নিজেদের সত্তার বিনিময়ে, তারা সুস্বাদু মাংসের থেকে বেশি মূল্য পায় না।

বিয়ে ও সংসার আজো নারীর জন্যে প্রধান পেশা হয়ে আছে, প্রতিক্রিয়াশীলতা যেভাবে প্রবল হচ্ছে তাতে অচিরেই তা আবার একমাত্র পেশা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সমাজ নারীকে আজো হ’তে বলে সুগৃহিণী ও সুমাতা, তার কাছে দাবি করে সতীত্ব ও পাতিব্ৰত্য! সমাজ পুরুষকে দেয় বাস্তব শর্ত, অর্থাৎ পুরুষের কাজ সংসার চালানো: নারীকে দেয় নৈতিক শর্ত, তাকে হতে হবে সুমাতা, সুগৃহিণী, সতী। নারীর সুমাতা, সুগৃহিণীত্বকে ঐশী ভাবাদর্শে পরিণত করা হয়েছে নারীকে পুরুষাধীন রাখার জন্যে।

মা হওয়ার অর্থ গর্ভধারণ, তবে সুমাতার অর্থ নারী গর্ভধারণ করবে: সমাজসম্মতভাবে, সমাজের জন্যে, নিজের জন্যে নয়; শঙ্ধারণ করবে নারী বিবাহিত হয়ে, বিবাহিত না হয়ে নারী সন্তান চাইতে পারবে না। এর অর্থ তার শরীর, তার জরায়ু তার নয়, তার মালিক পুরুষ ও পিতৃতন্ত্র। পুরুষ এসব বিধি প্রচার করেছে বিধাতার নামে, তবে এসব হচ্ছে বিশেষ এক ধরনের সমাজ সংরক্ষণের বিধিনিষেধ। নারীর গৰ্ভধারণ একান্ত পাশবিক কাজ! নারীকে কি চিরকালই ধারণ ক’রে যেতে হবে গর্ভ, পালন ক’রে যেতে হবে পশুর ভূমিকা?

গৰ্ভবতী নারী দেখতে অনেকটা গর্ভবতী পশুরই মতো, দৃশ্য হিশেবে গর্ভবতী নারী শোভন নয়, আর গর্ভধারণ নারীর জন্যে অত্যন্ত পীড়াদায়ক। এক দিন হয়তো গৰ্ভধারণ গণ্য হবে আদিম ব্যাপার ব’লে, মানুষ বেছে নেবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প উপায়; তখন গর্ভধারণই নারীত্ব বলে মনে হবে না। নারী গর্ভধারণে আনন্দ পায় না। পুরুষতন্ত্রের শিক্ষার ফলে নারী আজো মনে করে গর্ভধারণেই তার জীবনের সার্থকতা, কিন্তু এটা তা নয়। অধিকাংশ নারী এখনই গৰ্ভধারণপ্রক্রিয়া থেকে রক্ষা ফেলে আনন্দে তা গ্ৰহণ করবে; গর্ভবতী হওয়ার মধ্যে জীবনের কোনো সার্থকতা, মহত্ত্ব, পুণ্য নেই।

এক সময় নিয়ত গর্ভিণী থাকাই ছিলো নারীর কাজ, এখন গর্ভের সংখ্যা কমেছে, তাতে ক্ষতি হয় নি, বরং সমাজরাষ্ট্র এই চায়। আমূল নারীবাদীরা মনে করেন মানবপ্রজাতিকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব নারীর নয়, পুরুষকে উদ্ভাবন করতে হবে সন্তানসৃষ্টির বিকল্প পথ; এবং কয়েক শো বছর পর গৰ্ভধারণ যে আদিম পাশবিক কাজ ব’লে গণ্য হবে তাতে সন্দেহ নেই।

সুমাতার ভুল ধারণাও আজো প্রবল সমাজে। উনিশশতকে মনে করা হতো যে সুমাতার কাজ মহাপুরুষ জন্ম দেয়া ও লালনপালন করা। পুরুষতন্ত্রের মহাপুরুষেরা’ নারীর কাছে বারবাব সুমাতা দাবি করেছে, সমাজকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে নারী যদি তাদের সুমাতা দেয়, তবে তারা দেশকে উন্নতির চুড়োয় পৌঁছে দেবে। এর অর্থ নারী নষ্ট হয়ে গেছে, তার জরায়ুর অপরাধেই মহাপুরুষেরা সম্পন্ন করতে পারছে না দেশের উন্নতি; অর্থাৎ যে-অপরাধ তাদের, তারা তা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর।

উনিশ শতক নারীর কাছে দাবি করে দলে দলে নেপোলিয়ন, জর্জ ওয়াশিংটন বিয়োনো; কিন্তু কারো পক্ষে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ওয়াশিংটন বা আইনস্টাইন বা রবীন্দ্রনাথ বা একটি একনায়ক জন্ম দেয়া সম্ভব নয়। আর যে-মায়ের এ-ধরনের মহাপুরুষ জন্ম দিয়েছেন, তারা যে সুমাতা ছিলেন, তাও নয়। রবীন্দ্রনাথের মা তো রবীন্দ্রনাথকে লালনপালনই করেন নি, ওই মহাকবি পালিত হয়েছেন ভৃত্যদের দ্বারা। এটা প্রমাণ করে যে মহাপুরুষ লালনের জন্যে কোনো সুমাতা’ দরকার করে না; এবং কোনো মায়ের পক্ষে লালনপালন ক’রে মহাপুরুষ তৈরি করা সম্ভব নয়।

লালনপালনের ওপর মানুষের বিকাশ খুব নির্ভর করে না। সুমাতা বলতে সমাজ বোঝায় এমন মা, যে এমনভাবে চালাবে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া, যার ফলে তার সন্তানরা মেনে নেবে সমাজের সমস্ত বিধিনিষেধ, এবং রোধ করবে সমাজের বিবর্তন। সুমাতার সন্তানরা পৃথিবীকে বদলায় না, তারা পৃথিবীকে অচল ক’রে রাখে। শিশু অবশ্যই মায়ের এবং পিতার কাছে থেকে স্নেহপ্ৰীতি ও অনেক কিছু পাবে, এটা তাদের অধিকার; কিন্তু প্রথাগত সুমাতা দরকার শুধু প্রথাগত সমাজ রক্ষার জন্যে।

প্রথাগত সমাজের আরেক রোগের নাম সুগৃহিণী। সুগৃহিণী হচ্ছে সে-নারী, যার জীবন নানা নিরর্থক কাজে ভারাক্রান্ত: যে একই কাজ বারবার করে, যার কাজ কখনো শেষ হয় না, যার জীবন হচ্ছে একই দিনের আমৃত্যু একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি। এক সময় গৃহিণীর ওপর চাপিয়ে দেয়া হতো সংসারের সমস্ত কাজ, এখন দরিদ্র নারীদের ওপরও ততোটা কাজের ভার নেই। সুগৃহিণীর সারাটি জীবনই অপব্যয়, এবং এক সময় তা হয়ে ওঠে ক্লান্তিকর, নিঃসঙ্গ, নির্জীব।

এক বালিকার যদি বিয়ে হয় আঠারো বছর বয়সে, বাইশ বছর বয়সের মধ্যে সে যদি দুটি সন্তান প্রসব ক’রে মুক্তি নেয়। গৰ্ভধারণ থেকে, তাহলে চৌত্ৰিশ বছর বয়সে সে দেখবে তার সন্তান দুটি নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, স্বামী ব্যস্ত উন্নতি ও অন্য নারী নিয়ে, শুধু তারই হাতে কোনো কাজে নেই। সে যদি আরো ত্ৰিশ বছর বাঁচে, তাহলে ওই ত্ৰিশ বছর তাকে কাটাতে হবে অসীম ক্লান্তির মধ্যে। তখন তার পক্ষে অসম্ভব মানসিক রোগগ্ৰস্ত না হওয়া।

তার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই, তার কোনো সত্তা নেই। এমনকি তার যৌন জীবনও তখন বিপন্ন। নারীকে ছেড়ে দিতে হবে গৃহিণীর ভাবমূর্তি যদি সে জীবনকে ক’বে তুলতে চায় তাৎপর্যপূর্ণ। এর মানে এ নয় যে সে স্বামীকে তালাক ও সন্তানদের ছেড়ে দিয়ে একলা জীবন শুরু করবে। এ-মুহূর্তেই জরুরি হচ্ছে নারীকে একটি পেশা নিতেই হবে, আর সে-পেশাটি কিছুতেই সংসার হবে না।

দরিদ্র দেশগুলো যেমন দরিদ্র, তেমনই প্রথাগত। অধিকাংশ দেশে নারীর পেশা গ্রহণের সুযোগ নেই। বাঙলাদেশ এমন এক দেশ। শিক্ষিত নারীদেরই এখানে পেশা গ্রহণের সুযোগ কম, দরিদ্র নারীদের সুযোগ আরো অনেক কম; তবু এখানে দরিদ্র নারীরাই জীবিকার জন্যে পেশা গ্রহণ করে বেশি। তা গৃহপরিচারিকার পেশা হ’তে পারে, হতে পারে ছাইআলির পেশা, বা ইটভাঙানির, বা বস্ত্ৰবালিকার পেশা। কোনো পেশাই নারীর জন্যে অস্বাভাবিক নয;–পুরুষ যে-সব পেশা দখল ক’রে আছে, তার প্রতিটির জন্যেই নারী উপযুক্ত; এমনকি শারীরিক শ্রমের পেশায়ও।

নারীর শারীরিক অশক্তি অনেকটা পুরুষতন্ত্রেরই সৃষ্টি: পুরুষ তার কাছে চেয়েছে অশক্তি, তাই নারী অশক্ত দুর্বল হওয়াকেই নিজের গুণ ব’লে মনে করেছে। নারীর পক্ষে হাল চাষ, মাছ ধরা, নৌকো বাওয়া কঠিন কাজ নয়; তবে নারী সাধারণত এসব করে না, কেননা সমাজ নারীকে তা করতে দেয় না! এক সময় নারীর জন্যে সমস্ত পেশাই নিষিদ্ধ ছিলো, আজ নিষিদ্ধ অধিকাংশ পেশা, যার ফলে রক্ষা পাচ্ছে পুরুষের প্রাধান্য। বাঙলায় নারীশিক্ষা এগিয়েছে অজস্র প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, কিন্তু পুরুষতন্ত্র তা ব্যৰ্থ ক’রে দিতে কোনো আয়োজন বাকি রাখে নি।

নারীশিক্ষার বিরুদ্ধে বড়ো চক্রান্ত নারীর শিক্ষা নিষিদ্ধ করা নয়, সবচেয়ে বড়ো চক্রান্ত হচ্ছে শিক্ষিত নারীকে নিষ্ক্রিয় ক’রে দিযে তাকে নিজের, পরিবার, ও সমাজের কাছে বোঝা ক’রে তোলা।  এটা করা হয়েছে শিক্ষা ও পেশার থেকে বিয়েকে নারীর জন্যে প্রধান ক’রে রেখে। শিক্ষা যদি নারীকে আর্থনীতিকভাবে স্বাবলম্বী করে, তখন বিয়ে হয়ে ওঠে ঐচ্ছিক ব্যাপার; নারী তার শারীরিক বা মানসিক প্রয়োজনে বিয়ে করতে পারে, না : করতে পারে। করা না-করা তার নিজের পছন্দ; কিন্তু শিক্ষিত নারীকেও পুরুষের ওপর আর্থনীতিকভাবে নির্ভরশীল ক’রে ব্যৰ্থ ক’রে দেয়া হয়েছে শিক্ষাকে; সফল ক’রে রাখা হয়েছে বিয়ে ও সংসারকে।

 


 নারী

5 1 vote
Post Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments
0
মন্তব্য করুনx
()
x
Scroll to Top
Scroll to Top