[দ্বিতীয় খন্ড]
◼ ১৮৪৮ — জুলাইয়ের ১৯ ও ২০ তারিখে নিউ ইয়র্কের সেনেকা ফলস্-এ প্রথম নারী অধিকার সম্মেলন। এতে অংশ নেন তিন শোর মতো নারীপুরুষ। এ-সম্মেলনে মার্কিন স্বাধীনতা ঘোষণার আদলে নারীমুক্তির ঘোষণা ক’রে বারোটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঘোষণার রচয়িতা এলিজাবেথ কোড স্ট্যান্টন। ঘোষণায় বলা হয় :
⇛ আমরা মনে করি এগুলো স্বতঃসিদ্ধ সত্য : যে সব পুরুষ ও নারীকে সমানভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে: স্রষ্টা তাদের ভূষিত করেছে কতিপয় হস্তান্তর অযোগ্য অধিকারে; এগুলোর মধ্যে রয়েছে জীবন, স্বাধীনতা, এবং সুখলাভের প্রয়াস…
⇛ মানবজাতির ইতিহাস হচ্ছে নারীর ওপর পুরুষের পৌনঃপুনিক পীড়ন ও বলপ্রয়োগের ইতিহাস, যাব লক্ষ্য নারীর ওপর পুরুষের চরম স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা। এটা প্রমাণের জন্যে অকপট বিশ্বের কাছে পেশ করতে চাই তথ্য। সে [পুরুষ] তাকে নারী কখনো তার সহজাত অধিকার ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার দেয় নি।
⇛ সে তাকে সে-সব বিধান মানতে বাধ্য করেছে, যা প্রণয়নে তার কথা শোনা হয় নি…
⇛ সে তাকে বিবাহিত অবস্থায়, আইনের চোখে, আইনগতভাবে মৃত বলে নির্দেশ করেছে…
⇛ সে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে সম্পত্তির মালিক হওয়ার সব অধিকার, এমনকি নিজের উপার্জিত পারিশ্রমিকের ওপরের অধিকার…
⇛ সে তাকে পরিণত করেছে নৈতিক দায়িত্বহীন প্রাণীতে, কেননা সে স্বামীর উপস্থিতিতে যে-কোনো অপরাধ করে অব্যাহতি পেতে পারে শাস্তি থেকে।…
⇛ সে নিজের জন্যে একচেটে রেখেছে সমস্ত লাভজনক পেশা, এবং নারীর জন্যে রেখেছে যে-সমস্ত কাজ, তার পারিশ্রমিক অত্যন্ত তুচ্ছ…
⇛ সে পুরুষ ও নারীর জন্যে ভিন্ন নৈতিকতা বিধি দিয়ে জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করেছে মিথ্যা ভাবাবেগ…
⇛ সে জোর করে নিজে অধিকার কারেছে জিহোভার সমস্ত অধিকার, দাবি করেছে যে নারীর জন্য এক পৃথক এলাকা বরাদ্দ করা তার অধিকার…
⇛ সে সবরকমে চেষ্টা করেছে নারীর আত্মবিশ্বাস ধ্বংস ক’রে দিতে, তার আত্মসম্মানবোধ খর্ব করতে, এবং তাকে স্বেচ্ছায় পরাশ্রিত ও শোচনীয় জীবনযাপনে সম্মত হতে।…
এ-সম্মেলনের একটি লক্ষ্য ছিলো নারীর ভোটাধিকার অর্জন, তবে ভোটাধিকারের প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় নি। অনেকে মনে করেছিলেন ভোটাধিকার চাইতে গেলে তারা তা তো পাবেনই না, বরং অন্যান্য লক্ষ্য অর্জনে ও ব্যর্থ হবেন। তবে এলিজাবেথ স্ট্যান্টন ও ফ্রেডরিক ডগলাস মনে করেন শাসক নির্বাচন ও আইন প্রণয়নের অধিকার পেলেই অন্য অধিকারগুলোও পাওয়া যাবে, তাই তারা প্ৰস্তাবটি পাশ করাতে যারপরনাই চেষ্টা করেন। এর পর প্রায় প্রতি বছরই একেক শহরে অনুষ্ঠিত হয় নারী অধিকার সম্মেলন।
তাদের আন্দোলন যতোই শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে, রক্ষণশীলেরা হতে থাকে ততোই ক্ষিপ্ত। তাদের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলেরা পত্রপত্রিকায়, গির্জায় আক্রমণ চালাতে থাকে অকথ্য ভাষায়। প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদপত্রগুলো তাদের উপকারে আসবে না। ব’লে তারা প্ৰকাশ করেন নিজেদের সাময়িকী : দি লিলি, দি ইউনা, ওম্যানস অ্যাডভোকেট প্রভৃতি। রক্ষণশীলেরা নারীবাদীদের আক্রমণ করতো অশীল ভাষা ও পবিত্র বাইবেল দিয়ে। তারা আদি মার্কিন নারীবাদী ফ্যানি রাইটকে আখ্যা দেয় ‘ধর্মহীনতার লাল বেশ্যা’, এরনেস্টিন রোজকে বলে ‘বেশ্যার থেকে হাজার হাজার গুণ নিচের পতিতা’। পাদ্রিরা নারীবাদী সম্মেলনে হানা দিয়ে বাইবেল উঁচিয়ে ধ’রে চিৎকার করতো, ‘সেইন্ট পল বলেছেন…. সেইন্ট পিটার বলেছেন…। ’
◼ ১৮৪৯ — বাঙলায় প্রাতিষ্ঠানিক নারীশিক্ষার সূচনা। মে মাসে জে ই ডি বেথুন কলকাতায় স্থাপন করেন ভিক্টোরিয়া গার্লস স্কুল, পরে এটি পরিচিত হয় বেথুন স্কুল নামে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লেখেন :
আগে মেয়েগুলো ছিল ভাল,
ব্ৰতধর্ম কর্তো সবে।
একা বেথুন এসে শেষ করেছে,
আর কি তাদের তেমন পাবে৷
যত ছুঁড়িগুলো তুড়ি মেরে,
কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে।
তখন ‘এ বি’ শিখে, বিবি সেজে,
বিলাতী বোল কবেই কবে।।
লেখাপড়া শিখে মেয়েরা ‘বিন্দু বিন্দু ব্ৰান্ডি খাবে’ বলেও আকর্ষণীয় ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ঈশ্বর গুপ্ত। শিক্ষিত মেয়েদের নিয়ে কবিতায় কৌতুক করলেও ঈশ্বর গুপ্ত নারীশিক্ষার বিরোধী ছিলেন না, তার সম্বাদপ্রভাকর-এ তিনি নারীশিক্ষার পক্ষে লিখতেন। সারা পৃথিবীর পুরুষদের মতো বাঙালি পুরুষেরাও যখন মেনে নেয় নারীশিক্ষা, স্ত্রীদের উৎসাহ দেয় শিক্ষায়, তখন তারা নারীশিক্ষাকে পণ্ড ক’রে দেয়ার জন্যে চমৎকার যাদু সৃষ্টি করে, নারীশিক্ষার প্রধান লক্ষ্য ক’রে তোলে ‘উৎকৃষ্ট গৃহিণী ও মাতা’ উৎপাদন। তারা স্টুয়ার্ট মিলকে ছেড়ে গ্রহণ করে রাসকিনের ক্ষতিকর আদর্শ: ‘ভদ্রমহিলা’ উৎপাদন ক’রে করে নষ্ট ক’রে দেয় নারীশিক্ষাকে।
◼ ১৮৫৫ — ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্ৰস্তাব (প্রথম পুস্তক) ও বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (দ্বিতীয় পুস্তক)। রামমোহন নারীদের দিতে চেয়েছিলেন প্ৰাণ, বিদ্যাসাগর দিতে চান জীবন।
◼ ১৮৫৬ — ২৬ জুলাই বিধবাবিবাহ আইন প্রবর্তন।
◼ ১৮৬৬ — মারিয়া দেসরাইসঁমে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম ফরাশি নারী-অধিকার সংঘ।
◼ ১৮৬৮ — সুসান বি অ্যান্থনি ও এলিজাবেথ স্ট্যান্টন-এর নারীবাদী সাময়িকী দি রেভোলিউশন। এর মূলমন্ত্র ছিলো : ‘পুরুষ, তার অধিকার এবং এর বেশি নয়; নারী, তার অধিকার এবং এর কম নয়। ’ ভোটাধিকার ছাড়া এতে আলোচিত হতো বিয়ে, আইন, প্রথাগত ধর্ম প্রভৃতি।
◼ ১৮৬৯ — জন স্টুয়ার্ট মিল-এর দি সাবজেকশন অফ উইমেন। ১৮৬১তে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ দেখা দিলে নারীবাদীরা নিজেদের আন্দোলন স্থগিত রাখেন, কিন্তু দেখেন যুদ্ধের পর নিগ্রোদের অধিকার মানা হ’লেও নারীদের অধিকার মানা হয় না। তাদের চোখে নারী নিগ্রোর থেকেও নিকৃষ্ট। যুদ্ধের পর তারা ভোটাধিকারকেই প্রধান লক্ষ্য বলে গণ্য করেন; কিন্তু ১৮৬৯-এ নারীমুক্তি আন্দোলন আদর্শ ও কৌশলগত কারণে বিভক্ত হয় দুটি শিবিরে। মে মাসে সুসান বি অ্যান্থনি ও এলিজাবেথ কেডি স্ট্যান্টন গঠন করেন ‘জাতীয় নারী ভোটাধিকার সংঘ’; নভেম্বরে লুসি স্টোন গঠন করেন ‘মার্কিন নারী ভোটাধিকার সংঘ’। মার্কিন সংঘটি শুধু ভোটাধিকারেই নিজেদের সীমিত রাখে; জাতীয় সংঘটি ভোটাধিকারের সাথে অন্যান্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামেও নিজেদের ব্যাপৃত রাখে।
◼ ১৮৭১ — বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার।
◼ ১৯৭৩ — বিদ্যাসাগবের বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক বিচার–দ্বিতীয় পুস্তক।
◼ ১৯৭৯ — হেনরিক ইবসেন-এর পুতুলের খেলাঘর। নায়িকা নোরা হয়ে ওঠে নারীবাদের কণ্ঠস্বর। জর্মন ভাষায় আউগুষ্ট বেবেল-এর নারী ও সমাজতন্ত্র। প্রথম সংস্করণ গোপনে প্ৰকাশিত। ১৮৮৩তে সংশোধিত সংস্করণ : নারী : অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নামে। জর্মন নারীবাদী ক্লারা জোঁটকিন এ-বই সম্পর্কে বলেছেন : ‘ডিনামাইট যেমন চুরমার করে দেয় কঠিনতম আদিম পাথর, তেমনই এ-বইয়ের বক্তব্য ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে গভীরতম কুসংস্কারকে।‘
◼ ১৮৮৩ — প্রথম বি এ : কাদম্বিনী বসু [ব্ৰাহ্ম]।
◼ ১৮৮৪ — প্রথম এম এ : চন্দ্ৰমুখী বসু [খ্রিস্টান]। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস-এর পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি। তিনি দেখান পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ও ব্যক্তি মালিকানাই নারীর বিপর্যয়ের কারণ।
◼ ১৮৮৯ — পুনায় মহারাষ্ট্র নারীবাদী পণ্ডিত রমাবাইয়ের নারীমুক্তি সম্বন্ধে বক্তৃতা। পুরুষদের হামলায় বক্তৃতা স্থগিত; রবীন্দ্রনাথ, যদিও নারীমুক্তিবিরোধী, লেখেন ‘রমাবাইয়ের বক্তৃতা উপলক্ষে’ (রর : ১২, ৪৫০-৪৫৫)।
◼ ১৮৯০ — প্রথম এম বি; বিধুমুখী বসু। [খ্রিষ্টান]। দুটি সংঘ মিলে গঠিত হয় ‘জাতীয় মার্কিন নারী ভোটাধিকার সংঘ’। প্রথম সভাপতি স্ট্যান্টন। কৃষ্ণভাবিনী দাসের প্রবন্ধ শিক্ষিতা নারী’। তিনি পেশ করেন একটি সরল ছোটো বক্তব্য : পরোপকার ও অন্যের জন্য জীবন ধারণ করা যেমন নারীর উদ্দেশ্য, রমণী তেমনি নিজের নিমিত্তেও বাঁচিয়া থাকে।
◼ ১৮৯৫ — স্টান্টন ও আরো তেইশজন নারীর ওমানস্ বাইবেল : নারীর বাইবেল। স্ট্যান্টন ভোটাধিকারকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, তবে তাঁর বিশ্বাস ছিলো গির্জা আর ধর্মই নারীর প্রধান শত্ৰু, কেননা নারীবাদবিরোধীদের প্রধান যুক্তিই ছিলো : নারী-অধীনতা ঈশ্বরের বিধান। দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৯৮। এতে আক্রমণ করা হয় বাইবেলে নারীর ভূমিকা ও ভাবমূর্তিকে। তাঁরা বলেন, ‘দীর্ঘকাল ধ’রে আমরা বাইবেলকে অন্ধভক্তির বস্তু ক’রে তুলেছি। এখন সময় এসেছে এটিকে অন্যান্য বইয়ের মতোই পড়ার, নিতে হবে এর ভালোটা বাদ দিতে হবে খারাপটা। ’ স্ট্যান্টন ‘পাঁজরের হাড়ে’র উপাখ্যানকে ‘তুচ্ছ শল্যচিকিৎসা’ ব’লে দেখান যে সম্পূর্ণ বাইবেলই হাওয়া বা নারীর পাপের ওপর ভিত্তি ক’রে তৈরি। তিনি বলেন :
সাপটিকে, ফলগাছটিকে এবং নারীটিকে নিয়ে নাও, তখন আর কোনো পতন, রাগী বিচারক, নরক, চিরকালীন শাস্তি কিছুই থাকে না?–তাই কোনো ত্ৰাতারও দরকার পড়ে না। এভাবে খসে পড়ে সমগ্র খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বের তলদেশ। এ-কারণেই সমস্ত বাইবেল গবেষণা ও উচ্চতর সমালোচনায় পণ্ডিতেবা কখনো নারীর অবস্থানটিকে স্পর্শ করেন না।
এ-বই প্রকাশের পর হৈচৈ পড়ে যায়, রক্ষশীলেরা একটি ভালো শিকার পেয়ে মেতে ওঠে: অ্যান্থনি ও আর কয়েকজন ছাড়া ভোটাধিকার সংঘের সদস্যরাও স্ট্যান্টনকে অস্বীকার করেন। এর মাত্ৰ ন-বছর পর বাঙলায় এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের নারী রোকেয়া বলেন, ‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্ৰ বলিয়া প্ৰকাশ করিয়াছেন। …এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে। ’
◼ ১৮৯৮ — শার্লোট পার্কিন্স গিলমানের নারী ও অর্থনীতি। এমেলিন প্যাংকহাক্টের নেতৃত্ত্বে যুক্তরাজ্যে নারীর সামাজিক ও রাজনীতিক ইউনিয়ন গঠন; নারীমুক্তি আন্দোলনের চরম রূপ। তাদের ঘোষণা : ‘অবিলম্বে ভোটাধিকার’। ১৯০৫-এ আন্দোলনকে তীব্র, ও সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ, করার জন্যে লিবারেল দলের নির্বাচনী জনসভায় প্যাংকহাক্টের মেয়ে ক্রিস্টাবেল ‘তোমরা কি নারীদের ভোটাধিকার দেবো?’ প্লাকার্ড বহন করে, গ্রেফতার হওয়ার জন্যে পুলিশের মুখে থুতু দেয়। দেশে সৃষ্টি হয় প্রবল আন্দোলন।
◼ ১৯০৪ — বেগম রোকেয়ার বিপ্লবী প্ৰবন্ধ ‘আমাদের অবনতি’ [নবনুর, ২:৫]। মতিচুর (১৯০৫) গ্রন্থে ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ নামে সংকলিত। এ-প্রবন্ধেই ভারতে প্রথম ধর্মগ্রন্থের বিরুদ্ধে পেশ করা হয় তীব্র বক্তব্য। রোকেয়া বলেন :
যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, আমনই ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। …আমরা প্রথমতঃ যাহা সহজে মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোদ্ধাৰ্য করিয়াছি; আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্ৰ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন।…এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।…এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্ৰভুত্ব সহা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক।
তার বক্তেব্য রক্ষণশীলেরা উন্মত্ত হয়ে ওঠে,–তবে এখনকার মতো নয়, ব্রিটিশরাজে রক্ষণশীলদের উন্মত্ততারও সীমা ছিলো; গ্রন্থে প্রকাশের সময় তিনি আপত্তিকর অংশ বাদ দিতে বাধ্য হন। ওই আপত্তিকর ও নিষিদ্ধ অংশটুকুই হচ্ছে রোকেয়ার শ্রেষ্ঠ রচনা। পৃথিবীর একটি পরিহাস হচ্ছে এখানে শ্রেষ্ঠরা নিয়ন্ত্রিত হন নিকৃষ্টদের দ্বারা।
◼ ১৯১১ — কলকাতায় ১৬ মার্চে রোকেয়ার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা।
◼ ১৯১৩ — শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীর মূল্য [যমুনা, ১৩২০]৷ বেরিয়েছিলো অনিলা দেবীর ছদ্মনামে। গ্রন্থাকারে বেরোয় ১৯২৪-এ। শরৎচন্দ্ৰ বলেন :
নারীত্বে মূল্য কি? অর্থাৎ, কি পবিমাণে তিনি সেবাপরায়ণ, স্নেহশীলা, সতী এবং দুঃখে কষ্টে মৌনা। অৰ্থাৎ তাঁহাকে লইয়া কি পরিমাণে মানুষের সুখ ও সুবিধা ঘটিবে। এবং কি পরিমাণে তিনি রূপসী। অর্থাৎ পুরুষের লালসা ও প্রবৃত্তিকে কতটা পরিমাণে তিনি নিবদ্ধ ও তৃপ্ত রাখিতে পাবিবেন। দাম কৰ্ষিবার এ ছাড়া যে আর কোন পথ নাই, সে কথা আমি পৃথিবীর ইতিহাস খুলিয়া প্রমাণ করিতে পারি।…
সতীত্বের বাড়া নারীর আর গুণ নাই। সব দেশের পুরুষই এ কথা বোঝে, এটা পুরুষেরা কাছে সবচেয়ে উপাদেয় সামগ্ৰী।…এই সতীত্ব যে নারীর কতবড় ধর্ম হওয়া উচিত, রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদিতে সে কথার পুনঃ পুনঃ আলোচনা হইয়া গিয়াছে।…এখানে স্বয়ং ভগবান পর্যন্ত সতীত্বের দাপটে কতবার অস্থির হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু সমস্ত তর্কই একতরফা–এক নারীরই জন্য।
যুক্তরাষ্ট্রে এলিস পল নামে এক তীব্র তরুণীর আমূল্যবাদী সংঘ কংগ্রেসনাল ইউনিয়ন’ [পরবর্তী নাম ‘ওম্যানস পাটি’]। ভোটাধিকার লাভের জন্যে তিনি প্রয়োগ করেন সব কৌশল : তাঁর দল প্যারেড, গণবিক্ষোভ, অনশন ধর্মঘট করে; তাঁর দলের সদস্যরা কারাগারে যায়। তিনিই মার্কিন নারীদের ভোটাধিকার আন্দোলনকে অবসন্নতা উদ্ধার করেন।
যুক্তরাজ্যে নারী ভোটাধিকার আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। তারা রাতে দেয়ালে দেয়ালে দাবি লেখে, ডাকবাক্সে জ্যাম ঢেলে ডাকবিভাগকে বিব্রত করে, দমকলঘন্টা বাজায়, প্রধান মন্ত্রী লয়েড জর্জের বাড়ির ক্ষতিসাধন করে, রেলস্টেশন স্টেডিয়াম গির্জায় আগুন লাগায়। জুনের ৮ তারিখে এপসম ডাউন্সে রাজার রেসের ঘোড়া যখন দৌড়োচ্ছিলো, তখন এমিলি ওয়াইন্ডিং ডেভিসন দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরেন। আহত এমিলি চার দিন পর মারা যান। এমিলি নারীবাদের প্রথম শহীদ।
◼ ১৯১৭ — ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার দাবি; জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি।
◼ ১৯১৮ — যুক্তরাজ্যে ত্রিশোর্ধ্ব নারীরা ভোটাধিকার পান; ১৯২৮-এ তাঁদের ভোটাধিকার বয়স কমিয়ে পুরুষের সমান, ২১ বছর, করা হয়।
◼ ১৯১৯ — জর্মন নারীবাদের জনপ্ৰিয়তম নেত্রী, তাত্ত্বিক, বক্তা ডক্টর রোসা লুক্সেমবুর্গ ডানপন্থী সৈন্যদের হাতে নিহত [১৫ জানুয়ারি]।
◼ ১৯২০ — আগস্টের ২৬ তারিখে মার্কিন কংগ্রেস নারী ভোটাধিকার (১৯তম) সংশোধনী বিল পাশ করে। ১৮৭৮ থেকে ‘অ্যান্থনি সংশোধনী’ নামে এটি কংগ্রেসের প্রতি অধিবেশনে উত্থাপি৩ হয়, কিন্তু গৃহীত হ’তে লাগে বেয়াল্লিশ বছর! এর সাথে আমেরিকায় ঘটে নারীবাদের মৃত্যু; পুনরুজীবিত হ’তে লাগে চল্লিশ বছর।
◼ ১৯২১ — ভারতীয় নারীদের ভোটাধিকার লাভ। প্রথমে মাদ্রজ প্রদেশে, ১৯২১-এ; ১৯২৯-এর মধ্যে সব প্রদেশে। বাঙলায় ১৯২৫-এ। তারা ভোটাধিকার পান, তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার পান আরো পরে।
◼ ১৯২৭ — প্রথম বাঙালি মুসলমান এম এ : ফজিলতুন্নেসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে প্রথম শ্রেণীতে প্ৰথম।
◼ ১৯২৯ — ভার্জিনিয়া উল্ফ্-এর এ রুম অফ ওয়ান্স্ অঔন। তাঁর এ-বইয়ের বিষয় নারী ও কথাসাহিত্য, তিনি এ-বক্তৃতাগ্রন্থে একটিই প্রশ্ন করেন–নারী কেনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে নি? তাঁর উত্তর হচ্ছে–দারিদ্র্য। নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার সূত্রপাত।
◼ ১৯৪৯ — আধুনিক আমূল্যবাদী নারীবাদের মহাগ্রন্থ সিমোন দ্য বোভোয়ার-এর দ্বিতীয় লিঙ্গ। বোভোয়ার উগ্র বাঁজালো নন, তিনি গভীর মননশীল এবং আধুনিক নারীবাদের শ্রেষ্ঠ নারী; তাঁর প্রজ্ঞা অতুলনীয়, লক্ষ্য অবিচল। তাঁর বইয়ের দর্শন সার্ত্রীয় অস্তিত্ববাদ। এ-বইয়ে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে যে ইতিহাস ভ’রে নারী পরিণত হয়েছে। পুরুষের সামগ্ৰীতে; নারীকে তৈরি করা হয়ছে পুরুষের ‘অপর’রূপে, অস্বীকার করা হয়ছে তার নিজস্বতা, এবং নিজ দায়িত্বভারের অধিকার। বার বার তিনি, অস্তিত্ববাদী পরিভাষায়, বলেছেন, পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শ নারীকে দেখে সীমাবদ্ধ’ আর পুরুষকে ‘অসীম’ বা ‘সীমাতিক্রান্ত রূপে।
এটি পরবর্তী নারীবাদী সমস্ত চিন্তা ও গ্রন্থের জননী। বইটি লেখাব সময় তার বিশ্বাস ছিলো সমাজতন্ত্রের বিকাশই সমাধান করবে: নারীর সব সমস্যার, তাই তিনি নারীবাদী নন, তিনি সমাজতান্ত্রিক। ক্রমশ তার বিশ্বাস ভেঙে যায়, ১৯৭২-এ তিনি যোগ দেন নারীবাদী আন্দোলনে, এবং প্ৰথমবারের মতো নিজেকে ঘোষণা করেন নারীবাদী বলে। তিনি বলেন। [দ্র মোই (১৯৮৫, ৯১-৯২)] :
১৯৭০-এ এমএলএফ নারীমুক্তি আন্দোলন স্থাপিত হওয়ার আগে ফ্রান্সে যে-সব নারীসংঘ ছিলো, সেগুলো ছিলো সাধারণত সংস্কার ও আইনবাদী। তাদের সাথে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার হয় নি! তুলনায় নবনারীবাদ আমূল্যবাদী।…দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষভাগে বলেছিলাম। আমি নারীবাদী নই, কেননা আমি বিশ্বাস করিতাম যে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের সাথে আপনাআপনি সমাধান হয়ে যাবে নারীয় সমস্যা।
নারীবাদী বলতে আমি বোঝাতাম শ্রেণীসংগ্রাম নিরপেক্ষভাবে বিশেষ নারী সমস্যা নিয়ে লড়াইকে। আমি আজো একই ধারণা পোষণ কবি! আমার সংজ্ঞায় নারীবাদীরা এমন নারী-বা এমন পুরুষও-যারা, সংগ্রাম কবছেন নারীর অবস্থা বদলের জন্যে, সাথে থাকছে শ্রেণীসংগ্রাম; এবং তারা শ্রেণীসংগ্রাম নিরপেক্ষভাবেও, সমস্ত সমাজবদলের ওপর নির্ভর না করে, নারীর অবস্থা বদলের জন্যে সংগ্রাম করতে পারেন। আমি বলবো, এ-অর্থেই আমি আজ নারীবাদী, কেননা আমি বুঝতে পেরেছি যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগে নারীর পরিস্থিতির জন্যে আমাদেরই লড়াই করতে হবে, এখানে এবং এখনই।
◼ ১৯৫৯ — দ্বিশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে, প্রায় দেড় শো বছর স্বেচ্ছায় ভুলে থাকার পর, সেইন্ট প্যাংক্রাস পুরোনো গির্জায় মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের সমাধিতে পুষ্পার্ঘ্য। অৰ্পণ করে ফসেট সমিতি।
◼ ১৯৬০ — নারী সরকার প্রধানদের আবির্ভাব : শ্ৰীমাভো বন্দরনায়েক (শ্ৰীলঙ্কা, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৬০), ইন্দিরা গান্ধি (ভারত, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৬৬, ১৯৬৭, ১৯৭১, ১৯৮১), গোল্ড মেয়ার (ইসরায়েল, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৬৯), ইসাবেলা পেরন (আর্জেন্টিনা, রাষ্ট্রপতি, ১৯৭৪), মাৰ্গারেট থ্যাচার (যুক্তরাজ্য, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৭৯, ১৯৮৩, ১৯৮৭), কোরাজান অ্যাকিনো (রাষ্ট্রপতি, ফিলিপাইনস, ১৯৮৬), বেনজিব ভুট্টো (পাকিস্তান, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৮৮), খালেদা জিয়া (বাঙলাদেশ, প্ৰধান মন্ত্রী, ১৯৯১), শেখ হাসিনা (বাঙলাদেশ, প্রধান মন্ত্রী, ১৯৯৬)। তবে এঁরা নারীবাদী নন, পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধি; অধিকাংশই নারীর জন্যে ক্ষতিকর।
◼ ১৯৬৩ — বেটি ফ্রাইডান-এর দি ফেমিনিন মিষ্টিক। মার্কিন নরনারীবাদের প্রথম বই এটি, তিনি দেখান কীভাবে বিলাসে নষ্ট হচ্ছে মার্কিন গৃহিণীরা।
◼ ১৯৬৬ — ফ্রাইডানের ‘ন্যাশনাল অরগানাইজেশন অফ উইমেন’ (নাউ)।
◼ ১৯৬৮ — মেরি এলমানের নারীসম্পর্কে ভাবনা : নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা।
◼ ১৯৬৯ — কেইট মিলেট-এর লৈঙ্গিক রাজনীতি, অ্যান কোড্ট্-এর ‘যোনীয় পুলকের উপকথা’। কেইট মিলেটই প্রথম নারীপুরুষের সম্পর্ককে নির্দেশ করেন রাজনীতিক সম্পর্ক ব’লে, যার নাম দেন। তিনি লৈঙ্গিক রাজনীতি’। এটি তাঁর পিএইচডি অভিসন্দৰ্ভ, একই সাথে মননশীল ও প্রচণ্ড। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর পর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও প্রেরণাদায়ক গ্ৰন্থ। নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার জন্যেও উল্লেখযোগ্য : লরেন্স, মিলার, মেইলার, জাঁ জোনের সাহিত্য আলোচনা করে দেখান তাদের রুগ্ন পুরুষতান্ত্রিকতা।
◼ ১৯৭০ — জারমেইন গ্রিয়ার-এর দি ফিমেল ইউনাক শুলামিথ ফায়ারস্টোন-এর লিঙ্গ দ্বাদ্রিকতা : নারীবাদী বিপ্লবের পক্ষে।
◼ ১৯৭২ — সুজান কোপেলম্যান কোরানিলন সম্পাদিত নারীবাদী সমালোচনাসংগ্ৰহ কথাসাহিত্যে নারীভাবমূর্তি। তারা দেখান, কথাসাহিত্যে চিত্রিত হয়েছে ‘অসত্য’ নারীচরিত্র; এ-কাজে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছেন নারী লেখকেরা, তাঁরা পুরুষদের থেকেও নিকৃষ্ট; বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তাঁরা নিজ লিঙ্গের সাথে।
◼ ১৯৭৩ — আন্তর্জাতিক নারীবাদী সম্মেলন।
◼ ১৯৭৫ — জাতিসংঘের নারী-অধিকার দশক। ফাতিমা মেরনিস্সির বোরখা পেরিয়ে। মরোক্কোর এ-তীব্ৰ নারীবাদী দেখান মুসলমান নারীদের শোচনীয়তা, ধর্মকে আক্রমণ করেন বিস্ময়কর সাহসের সাথে। ১৯৮৪তে বেরোয় তাঁর প্রচণ্ডতর বই মুসলমানের অবচেতনায় নারী, লেখেন ফাতনা এ সাবাহ্ ছদ্মনামে।
◼ ১৯৭৮ — শেরিল এল ব্ৰাউন ও করেন ওলসন সম্পাদিত নারীবাদী সমালোচনাসংগ্ৰহ নারীবাদী সমালোচনা : তত্ত্ব, কবিতা ও গদ্য বিষয়ক প্ৰবন্ধ।
◼ ১৯৮০ — মিশরি নারীবাদী নওঅল এল সাদাওয়ির হাওয়ার লুকোনো সুখ : আরব বিশ্বে নারী। আমূল নারীবাদী নওঅল চিকিৎসক, ছিলেন মিশরের গণস্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান; কিন্তু নারীবাদের অপরাধে সাদাতের কালে চাকুরি হারান, কারারুদ্ধ হন।
◼ ১৯৯৫ — ১৯ নভেম্বর। নারী নিষিদ্ধ।
◼ ২০০০ — ৭ মার্চ। উচ্চ বিচারালয় কর্তৃক নারীর নিষিদ্ধকরণ আদেশকে অবৈধ ঘোষণা।