[তৃতীয় খন্ড]
এলেন সিজো বলেছেন, ‘আরো দেহ, তাই আরো লেখা। ’ নারীবাদীদের কেউ কেউ জৈব বা দেহবাদী সমালোচনারও প্রস্তাব করেছেন। এতে দেহই হয়ে ওঠে রচনা বা বই ৷ দেহকে সমালোচনার মানদণ্ড করা বিপজ্জনক, কেননা সব জাতিই বিশ্বাস করে যে নারী দৈহিকভাবে দুর্বল, তার মস্তিষ্কও দুর্বল। জৈব নারীবাদী সমালোচকেরা অবশ্য দৈহিক হীনতা স্বীকার করেন না, কিন্তু মনে করেন নারীর শরীর তার লেখাকেও স্বতন্ত্ৰ ক’রে তোলে।
পিতৃতন্ত্রের বিশ্বাস হচ্ছে লেখক জনক, যার কলম অনেকটা শিশ্নের মতোই জন্মদানের হাতিয়ার। গিলবার্ট ও গুবার প্রশ্ন করেছেন, ‘যদি কলম হয়ে ওঠে একটি রূপক-শিশ্ন, তাহলে কোন অঙ্গ থেকে নারী উৎপাদন করবে পাঠ বা রচনা?’ উত্তরে শোঅল্টার (১৯৮১, ২৫০) বলেছেন, নারী পাঠ বা রচনা জন্ম দেয় মস্তিষ্ক থেকে, বা ওয়ার্ড-প্রসেসর থেকে, যা একটি রূপক-জরায়ু। সাহিত্যিক পিতৃত্বের রূপক নারীদের পীড়ন করছে আবহমান কাল ধ’রে; তবে আঠারোউনিশশতকে সাহিত্যিক মাতৃত্বের রূপকও বেশ বড়ো হয়ে উঠেছিলো, যাতে সাহিত্যসৃষ্টি হয়ে ওঠে৷
গৰ্ভধারণ ও প্রসবের মতো ব্যাপার। বিশেষ ক’রে ফ্রান্সে ও আমেরিকায় কোনো কোনো আমূল নারীবাদী মনে করেন এসব রূপককে নিতে হবে শুরুত্বের সাথে, ন্যায়ী পুরুষের জৈব পার্থক্যকে দেখতে হবে নতুনভাবে, এবং খুঁজতে হবে দেহের সাথে লেখার সম্পর্ক। তারা মনে করেন নারীর লেখা বেরোয় দেহ থেকে, তাদের দৈহিক পার্থক্য তাদের লেখাব উৎসও। অ্যাড্রিয়েন রিচ বলেন শোঅল্টার (১৯৮১, ২৫১)] :
আমরা এখনো যতোটা বুঝতে পেরেছি, নারীদেহের রয়েছে তার চেযে অনেক বেশি আমূল তাৎপৰ্য। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা তার সংকীর্ণ নির্দেশ অনুসারে নারীদেহকে সীমাবদ্ধ ক’রে ফেলেছে। এ-কারণে নারীবাদী দৃষ্টি সবে এসেছে নারীর জৈবসংগঠন থেকে; আমি বিশ্বাস করি তা একদিন আমাদের দেহকে নিয়তি মনে না করে সম্পদ ব’লেই গণ্য করবে। পরিপূর্ণ মানবিক জীবন যাপনের জন্যে আমাদের দেহকে নিয়ন্ত্রণ করাই শুধু আমাদের জন্যে জরুরি নয়, আমাদেের স্পর্শ করতে হবে। আমাদের দেহের ঐক্য ও অনুনাদকে, যা আমাদের মননের দৈহিক ভিত্তি।
নারীবাদী জৈল সমালোচনায় খোজা হয় কীভাবে দেহ ব্যবহৃত হয় চিত্রকল্পের উৎসরূপে; আর নারীবাদী জৈব সমালোচনা, যা উৎসারিত করা হয় সমালোচকের দেহ থেকে, হয়ে থাকে অন্তরঙ্গ, স্বীকারোক্তিমূলক, ও আঙ্গিকগতভাবে অভিনব। তবে নারীসত্তার খোঁজে বেরিয়ে দেহকেই তার কেন্দ্ৰ ব’লে গণ্য করা ভয়ঙ্কর কাজ, কেননা দেহকেই পুরুষতন্ত্র ব্যবহার করেছে নারীশোষণের প্রধান যুক্তিরূপে। নারীর দেহেই খুঁজতে হবে নারীর সৃষ্টিশীলতা? এর চমৎকার উত্তর দিয়েছেন ন্যান্সি মিলার; তিনি বলেছেন নারীর সাহিত্যিক স্বাতন্ত্র্য খুঁজতে হবে তার দেহের লেখায় নয়, বরং তার লেখার দেহে’ [দি শোঅল্টার (১৯৮১, ২৫২)]।
বোনি জিমারম্যান (১৯৮১) ‘যা কখনো ছিলো না’ নামক একটি তীব্র প্রবন্ধে তুলে ধরেন এমন এক বিষয়, যা পিতৃতন্ত্রের বিধানে নিষিদ্ধ, আর নারীবাদীরাও চান চেপে রাখতে। তিনি আলোচনা করেন নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতি। নারীসমকামবাদকে উপেক্ষার বিরুদ্ধে তিনি জানান প্রবল প্ৰতিবাদ। নারীসমকাম নিষিদ্ধ ব্যাপার, তা যে ছিলো আর আছে, তা-ই কেউ স্বীকার করতে চায় নি ও চায় না; কিন্তু সত্য হচ্ছে তা ছিলো, এবং আছে। নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব প্রস্তাবের সূচনায়ই প্রশ্ন ওঠে যে নারীর যৌন ও প্রীতির সম্পর্ক কতোখানি প্রভাব ফেলে তার লেখা, পড়া, ও চিন্তার ওপর?
নারীসমকামবাদী নন্দনতত্ত্ব কি পৃথক হবে নারীবাদী নন্দনতত্ত্ব থেকে? কী হবে নারীসমকামবাদী সমালোচকের কাজ? সম্ভব কি কোনো নারীসমকামবাদী মানদণ্ড বা বিধান প্রতিষ্ঠা করা? নারীসমকামবাদীরা কি বিকাশ ঘটাতে পারেন এমন কোনো অন্তর্দৃষ্টির, যা ঋদ্ধ করবে সমগ্র সমালোচনাশাস্ত্রকে? নারীসমকামবাদী সমালোচনার কিছু বিষয় সম্পর্কে প্রায় সব নারীসমকামবাদীই একমত। তারা মনে করেন এমন নয় যে নারীসত্তা স্থির করতে হবে শুধু পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কিত ক’রেই, নারীসাহিত্যকেও যে পুরুষসাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত ক’রে দেখতে হবে, তাও নয়; তাদের মতে নারীর সাথে নারীর তীব্র সম্পর্কও নারীর জীবনের বড়ো ব্যাপার, এবং নারীর যৌন ও আবেগগত প্রবণতা গভীরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার চেতনা ও সৃষ্টিশীলতাকে।
পিতৃতন্ত্র স্বীকার করে শুধু বিষমকামকে; নারীসমকামবাদীদের মতে বিষমকামই একমাত্ৰ স্বাভাবিক যৌন ও আবেগগত সম্পর্ক নয়। বিষমকামকেই শুধু স্বাভাবিক ভাবা পিতৃতন্ত্রের শিক্ষামাত্র। জিমারম্যান দেখান যে নারীবাদীরাও দীক্ষিত পিতৃতন্ত্রের বিষমকামবাদে; তাই নারীবাদী সংগ্রহ থেকে বাদ পড়েন নারীসমকামী রেনি ভিভিয়েন ও র্যাডক্লিফ হল, বা সংকলিত হয় ক্যাথেরিন ফিলিপস, ও অ্যাড্রিয়েন রিচের বিষমকামী বা নিষ্কাম রচনা, যদিও তারা বিখ্যাত নারীসমকামী লেখার জন্যে। জিমারম্যান (১৯৮১, ২০১-২০২) বলেন :
যখন পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত কোনো সংগ্রহে থাকে স্ত্রী, মাতা, যৌনসামগ্ৰী, তরুণী, বৃদ্ধা, এবং মুক্ত নারী প্রভৃতি বিভাগ, কিন্তু থাকে না নারীসমকামী- তখন তা বিষমকামবাদ। নারীবাদী সংগ্রহে বিষমকামবাদ-পুংকেন্দ্ৰিক সংগ্রহে লিঙ্গবাদের মতো- মুছে ফেলে নারীসমকামবাদী অস্তিত্ব এবং লালন করে এ-মিথ্যেটি যে নারী শুধু পুরুষের মধ্যেই খোঁজে কাম ও আবেগের তৃপ্তি, বা একেবারেই খোঁজে না।
নারীসমকামবাদীরা অভিযোগ করেন নারীবাদী পত্রিকা- ফেমিনিস্ট স্টাডিজ, উইমেন্স স্টাডিজ, উইমেন অ্যান্ড লিটেরেচার প্রভৃতিতে যে নারীসমকামবাদী রচনা বেরোয় না, তার মূলে রয়েছে বিষমকামবাদ, বা পরিকল্পিত উদ্দেশ্য। অধিকাংশ নারীসমকামবাদী লেখা প্রথম বেরোয় বিকল্প, অপ্রাতিষ্ঠানিক নারীসমকামবাদী পত্রিকা সিনিস্টার উইজডম, কোভিশন্স প্রভৃতিতে। বিষমকামবাদের প্রতাপ দেখা যায় নারীবাদী সমালোচনার গুরুত্বপূর্ণ সব সংগ্রহে; যেমন দি অথোরিটি অফ এক্সপেরিএন্স বা শেক্সপিয়ারস সিস্টারসূ-এ নেই কোনো নারীসমকামবাদী প্ৰবন্ধ।
নারীবাদী সমালোচকেবা চেপে গেছেন নারীসমকামবাদকে; তাই নারীসমকামবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার ভিত্তি স্থাপন করতে এগিয়ে আসেন নারীসমকামবাদীরাই। ১৯৫৬তে বেরোয় জেনেট ফস্টারের সেক্স ভারিয়েন্ট উইমেন ইন লিটেরেচার, ১৯৬৭তে জেন ড্যামন (ছদ্মনাম), জ্যান ওয়াটসন, ও রবিন জর্ডানের দি লেসবিয়ান ইন লিটেরেচার : এ বিবলিওগ্রাফি।
নারীসমকামবাদী সমালোচনার মূলে, নারীবাদী সমালোচনার মতোই, রয়েছে রাজনীতিক ভাবাদর্শ। তাদের মতে নারীসমকাম এক সুস্থ জীবনপদ্ধতি, নারীরা যা যাপন করেছে ও করছে সব দেশে ও কালে। তাই তাঁরা দূর করতে চান এর ওপর চাপানো নিষেধ। এতে সফল হওয়ার এক উপায় নারীদের পুরুষের মূল্যবোধ থেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে একান্তভাবে নারীসমাজভুক্ত করা। এক ধরনের নারীস্থান গড়ে তোলা।
র্যাডিক্যালেসবিয়ান বা আমূলনারীসমকামবাদীরা মনে করেন যে নারীর কাছে নারীই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, নারীরা মিলে গ’ড়ে তুলবে এক নতুন চৈতন্য, তারা নিজেদের কেন্দ্ৰ খুঁজবে নিজেদের ভেতরে। তাদের মতে বিষমকামবাদ এক রাজনীতিক সংস্থা, তা ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার নয়। নারীসমকামবাদীরা বিকাশ ঘটাতে চান একান্ত নারীসমকামী নারীবাদী প্রেক্ষিত; তাই তাদের প্রশ্ন; কখন কোনো রচনা হয়ে ওঠে, বা তার লেখক হন নারীসমকামবাদী?
এটা নির্ভর করে নারীসমকামী বলতে কী বোঝায়, তার ওপর। নারীসমকামী বলতে কি বোঝাবে শুধু সে-নারীদেরই, অন্য নারীর সাথে যাদের যৌন অভিজ্ঞতার প্রমাণ রয়েছে? এটা অসম্ভব কাজ। অনেকেই তো তার কোনো প্রমাণ রেখে যান নি। তাছাড়া এতে নারীসমকাম হয়ে ওঠে শুধুই যৌন ব্যাপার। অ্যাড্রিয়েন রিচের মতে নারীসমকামবাদ শুধু অন্য নারীর সাথে যৌনসংসর্গ নয়, তা নারীর সংসর্গে নারীর অভিজ্ঞতা, নারীর সাথে নারীর আন্তর জীবনের ঐক্য, রাজনীতিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নারীদের ঐক্য [দ্ৰ জিমারম্যান (১৯৮১, ২০৫)]।
তবে নারীদের সব ধরনের সম্পর্ককেই যদি নারীসমকামী সম্পর্ক বলা হয়, তাতে অসুবিধা দেখা দেয়; নারীদের মধ্যে নারীসমকামী ও অসমকামী সম্পর্কের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। অনেকে নারীসমকামবাদের রাজনীতিক সংজ্ঞাও দিয়েছেন; বলেছেন নারীসমকাম হচ্ছে শক্তি, স্বাধীনতা, ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। লিলিআন ফ্যাডারম্যান সািরপাসিং দি লাভ অফ ম্যান : রোম্যান্টিক ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড লাভ বিটুইন উইমেন ফ্লম দি রেনেসাঁস টু দি প্রসেন্ট (১৯৮১) বইতে দিয়েছেন নারীসমকামবাদের মাঝপথি সংজ্ঞা [দ্র জিমারম্যান (১৯৮১, ২০৬)] :
নারীসমকামী’ বলতে বোঝায় সে-সম্পর্ক, যাতে দুটি নারীর তীব্ৰতম আবেগ ও পীতি ধাবিত হয়। পরস্পরের দিকে। এ-সম্পর্কে থাকতে পারে কম বা বেশি যৌন সংসৰ্গ, এমনকি একেবারে নাও থাকতে পারে। এতে দুটি নারী পছন্দ করে তাদের অধিকাংশ সময় একসাথে কাটাতে এবং জীবনের অধিকাংশ ব্যাপার তারা যাপন করে পরস্পবেক সাথে।
নারীসমকামবাদী সমালোচকের একটি দায়িত্ব নারীসমকামবাদের ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করা, যাতে তা হয়ে উঠতে পারে শ্ৰদ্ধেয়। জেন রুল লেসবিয়ান ইমেজেজ : নারীসমকামবাদী ভাবমূর্তিতে (১৯৭৩) প্রথম নারীসমকামবাদের ঐতিহ্য আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। এটি নারীসমকামবাদী সমালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ বই। এর পর ডোলোরেস ক্লাইস ওম্যান প্লাস ওম্যান : নারী যোগ নারী (১৯৭৪), লুইসে বারনিকেও দি ওয়ার্ল্ড স্পিলিটু ওপেন : ফালি করে খোলা পৃথিবী (১৯৭৪) বইতে প্রতিষ্ঠা করেন নারীসমকামবাদের এক মহৎ ঐতিহ্য। তারা স্যাফো থেকে শুরু ক’রে তাদের ধারায় পান মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটু, এমিলি ডিকিনসন, ভার্জিনিয়া উলফ, ভিটা স্যাকভিল-ওয়েস্ট, এথেল স্মাইথি, জারটুড স্টেইন, র্যাডক্লিফ হল, নাটালি বার্নি, কোলেৎ, রেনি ভিভিয়েন, রোমেইন ব্রুকস, ও আরো অনেককে।
নারীসমকামবাদী সমালোচনার এক বৈশিষ্ট্য ঐতিহ্য আবিষ্কার হ’লেও এই এর একমাত্ৰ লক্ষ্য নয়; নারীসমকামবাদীরা খুঁজেছেন উপন্যাসে নারীসমকামীর ভাবমূর্তি, ছক প্রভৃতি। বার্থ হ্যারিস দেখিয়েছেন উপন্যাসে নারীসমকামী চিত্রিত হয় দানবীরূপে, যে ভেঙেচুরে ফেলে নারীর অনুগত, অক্রিয়তা, সতীত্বের প্রথাগত ধারণা। তারা রচনাশৈলী ও সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়েও কিছু কাজ করেছেন। নারীসমকামবাদীদের কাছে ভাষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা শতাব্দী পরম্পরায় তাদের মুখ খুলতে দেয়া হয় নি, তাদের ভাষা কেড়ে নেয়া হয়েছিলো। এক সময় তারা সাংকেতিক ভাষায় কথা বলেছেন, এখন চালাচ্ছেন নানা নিরীক্ষা। তাদের ব্যাকরণ অপ্রথাগত, কথা বলেন তারা ঘটমান বর্তমান কালে, নিয়মিতভাবে তৈরি করেন নতুন শব্দ।
নারীবাদ, এবং নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ ধারার বিকাশ ঘটে ফরাশিদেশে। একে বলা হয় ফরাশি নারীবাদ। ফরাশি ও বিশ্বনারীবাদের মহত্তম তাত্ত্বিক সিমোন দা বোভোয়ার। তার কাছে, অন্যদের মতো, ফরাশি নবনারীবাদীরা ঋণী, ও ঋণস্বীকারে অকুণ্ঠ। তিনি নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনারও সূত্রপাত করেছিলেন দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ, লিঙ্গবাদের রূপ দেখিয়েছিলেন পাঁচজন- মঁথেরলঁ, ডি এইচ লরেন্স, ক্লাদেল, ব্ৰেতো, স্তাঁদাল- লেখকের উপন্যাস ও কবিতায়।
তবে ১৯৬৮র ছাত্রবিদ্রোহ থেকে উদ্ভূত ফরাশি নবনারীবাদীরা সাহিত্য সমালোচনায় তাঁকে অনুসরণ করেন নি। ১৯৭০ থেকে ফরাশি নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্বের উৎস হয় দেরিদীয় বিসংগঠন ও লাকীর ফ্ৰয়েডীয় মনোবিজ্ঞানের সাংগঠনিক ভাষ্য। তারা পুরুষ প্ৰভুদের ধারণা নিয়েই করেন নারীবাদী কাজ। ১৯৭৪-এর মধ্যে ফরাশি নারীবাদীরা তাদের ভয়াবহ মননশীল নারীবাদীতত্ত্বের অনেকটা রচনা ক’রে ফেলেন; কিন্তু অতিমননশীলতাভারাক্রান্ত ওই তত্ত্ব বাইরে গৃহীত হ’তে সময় নেয়। মার্ক্স, নিটশে, হাইডেগার, দেরিদা, লাকঁর চিন্তায় তাদের তত্ত্ব পরিপূর্ণ, যা অফরাশি পাঠকের কাছে বিপন্নকরভাবে দুরূহ। এলেন সিজোর দুরূহজটিল ভাষারীতি, লুসি ইরিগারের গ্রিক বর্ণমালামোহ, জুলিয়া ক্রিস্তেভার এক বাক্যে পাঁচসাতজন তাত্ত্বিককে উল্লেখ করার প্রবণতা পাঠকের মনে ভয় জাগায়।
ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীরা যেমন সৃষ্টি করেন বিপুল পরিমাণ নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা, ঠিক সে-ধরনের সমালোচনা ফরাশি নারীবাদীরা লিখেছেন কম; তারা লিখেছেন পাঠগত, ভাষাতাত্ত্বিক, সাংকেতিক বা মনোবিশ্লেষণাত্মক তত্ত্বের সমস্যা সম্পর্কে, এবং লিখেছেন এমন রচনা, যাতে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবিতা ও তত্ত্ব। তারা ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীদের মতো প্রশ্ন তোলেন নি।
‘মহৎ’ সাহিত্যের মহত্ত্ব সম্বন্ধে, তারা তা মেনে নিয়েছেন; তাই তারা ইঙ্গমার্কিন নারীবাদীদের মতো সফলভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেন নি পুরুষতান্ত্রিক সাহিত্যের পীড়নমূলক সামাজিক ও রাজনৈতিক চক্রান্তের মুখোমুখি। পুরুষেরা যে-সমস্ত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে ফরাশিদেশে, তারাও ব্যস্ত থেকেছেন তা নিয়েই; তবে তা বিশ্লেষণ করেছেন নারীবাদী দৃষ্টিতে। ফরাশি নারীবাদীদের কাছে ভাষা প্ৰধান গুরুত্বের বস্তু। ফরাশি নবনারীবাদের তিন প্রধান এলেন সিজো, লুসি ইরিগারে, ও জুলিয়া ক্রিস্তেভা।
এলেন সিজে ১৯৭৫-১৯৭৭ সময়ের মধ্যে লেখেন একরাশ তাত্ত্বিক রচনা, যাতে খোজা হয় নারী, নারীত্ব, নারীবাদ, ও লেখার সম্পর্ক। তাঁর লেখার মধ্যে রয়েছে ল্য জিন নে (ক্যাথেরিন ক্লেমওর সাথে, ১৯৭৫), ‘মেদুসার হাস্য’ (১৯৭৫), ‘নপুংসকীকরণ না শিরচ্ছেদীকরণঃ’ (১৯৭৬), ল্য ভ্যানু লেক্রিতুর : লেখায় আসা (১৯৭৭)। তাঁর লেখায় কিছু কেন্দ্রীয় ধারণা ও চিত্ৰকল্প ফিরে ফিরে আসে, আর তাঁর লেখা হয়ে ওঠে এমন যেনো তা সরলরৈখিকভাবে পড়ার জন্যে নয়। তাঁর লেখা কাব্যিক, রূপকভরা, চিত্রকল্পের বিশ্লেষণ অসম্ভব জালের মতো।
দেরিদার মতে পশ্চিমি পরাবিদ্যা আলোচনার ভিত্তি পুরুষ, পুরুষের একটি অতিশায়িত আদর্শায়িত রূপ গঠন ক’রে সমস্ত চিন্তার কেন্দ্রে বসানো হয়েছে পুরুষকে। দর্শনের সূচনাকাল থেকে পুরুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এমন এক জ্ঞানতত্ত্বের কেন্দ্রে, যা গ’ড়ে উঠেছে ক্ৰমস্তরিকভাবে বিন্যস্ত একরাশ দ্বিমুখি ধারণায়। তাতে পুরুষ সব সময় অধিকার ক’রে আছে সুবিধাজনক স্থান : সত্তা/অপর, কর্তা/কর্ম উপস্থিতি/অনুপস্থিতি, বিধি বা শৃঙ্খলা/বিশৃঙ্খলা, পুরুষ/নায়ী প্রভৃতি দ্বিমুখি ধারণায় পুরুষই মূল ধারণা [দ্ৰ জোন্স (১৯৮৫, ৮১)]।
ফরাশি নারীবাদীরা দেখান পুরুষ নারীকে এই ক্রমস্তরিক বিন্যাসের ঋণাত্মক প্রান্তেব্য দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং নারীকে জড়িয়ে দিয়েছে সে-সব ধারণার সাথে যেগুলো বোঝায়। মানুষ-নয়’। পুরুষ এভাবে অধিকার করেছে কেন্দ্রিকতা ও ক্ষমতা। তারা পুরুষাধিপত্যবাদী পরাবিদ্যাকে বুঝিয়ে থাকেন একটি শব্দে, শব্দটি ‘ফ্যালোসেন্ট্রিজম’ বা ‘শিশ্নকেন্দ্রিকতা’, যাতে শিশ্নই কেন্দ্র, পুরুষই সব।
পিতৃতন্ত্রে নারীপুরুষের মূল্য কী, তা দেখানোর জন্যে সিজো পেশ করেছেন তাঁর পিতৃতান্ত্রিক দ্বিমুখি বৈপরীত্যু’-এর তালিকা; সক্রিয়/অক্রিয়, সূৰ্য/চন্দ্ৰ, সংস্কৃতি/প্রকৃতি, দিন/রাত, পিতা/মাতা, মস্তিষ্ক/আবেগ, বোধগম্য/ভাবাবেগপরায়ণ প্রভৃতি; এবং দেখিয়েছেন এ-তালিকাব ধনাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো সবই পুরুষের, ঋণাত্মক বৈশিষ্ট্যগুলো নারীর। এ-ধরনের চিন্তায় সিজে সক্রিয় দেখেছেন মৃত্যুকে। তাঁর মতে দ্বিমুখি বৈপরীত্যের একটি ধারণাকে অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্যে দরকার অপরটির বিনাশ; তাই আধিপত্যের জন্যে লড়াই ক’রে চলছে ধারণাগুলো। এতে বিজয় = সক্রিয়তা, আর পরাজয় = অক্রিয়তা।
পিতৃতন্ত্রে পুরুষই সব সময় বিজয়ী। তাই নারী অভিন্ন মৃত্যুর সাথে। সিজো সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এক্রিত্যুর ফেমিনিন বা নারীর লেখা বলে একটি ধারণা। তার মতে নারীর লেখার অভিমুখ ভিন্নতার দিকে, যার লক্ষ্য শিশ্নবাক্যকেন্দ্ৰিক- ফ্যালোগোসোস্ট্রিক- যুক্তি উপেক্ষা করা। তিনি নির্দেশ করেছেন লেখারও লিঙ্গ; তবে ওই লিঙ্গ লেখকের লিঙ্গের ওপর নির্ভরশীল নয়। তাঁর মতে অনেক নারীই এমন লেখা লিখেছেন, যা আসলে পুংলিঙ্গ। তবে তিনি লিঙ্গ ধারণাই ত্যাগ করতে চান।
লুসি ইরিগারের প্রথম বই চিত্তভ্রংশতার ভাষা (১৯৭৩) বেশ সুদূর নারীবাদী লক্ষ্য থেকে, কিন্তু দ্বিতীয় বই অপর নবীর অবতল দৰ্পণ-এ (১৯৭৪) তিনি নারীবাদের জন্যে পেশ করেন গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব, এবং এ-বইয়ের জন্যে তিনি বহিষ্কৃত হন লার্কর ফ্রয়োড়ীয় ইস্কুল থেকে। বইটি অতিবিতর্কিত। ১৯৭৭-এ বেরোয় এই লিঙ্গ যা একটি নয়, এর পর বেরোয় এবং একজন অপরজনকে ছাড়া আলোড়িত হয় না (১৯৭৯), ফ্রিডরিখ নিটশের জলীয় প্রেমিক (১৯৮০), মায়ের সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ (১৯৮১), প্রাথমিক সংরাগ (১৯৮২)।
তাঁর অবতল দিপর্ণ-এর প্রথম ভাগে রয়েছে ফ্রয়েডের নারীমনোবিজ্ঞানের কঠোর সমালোচনা, তবে তিনি মিলেটের মতো মনোবিজ্ঞানকে সহজাতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল বলে বাদ দেন নি। বইটি তিনি ফ্ৰয়েডকে দিয়ে শুরু এবং প্লাতোকে দিয়ে শেষ ক’রে নষ্ট ক’রে দেন স্বাভাবিক কালানুক্রম। এ-বইয়ের গঠনের সাথে মিল রয়েছে স্ত্রীরোগবিদদের ব্যবহৃত অবতল দর্পণের, যা দিয়ে তারা নারীদেহের নানা রন্ধ পর্যবেক্ষণ করে। তাঁর রচনাপদ্ধতি বিসাংগঠনিক। জুলিয়া ক্রিস্তেভা বুলগেরীয়, ১৯৬৬তে আসেন প্যারিসে। রোঁল বার্ত তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘জুলিয়া ক্রিস্তেভা বস্তুর স্থান বদলে দেন; তিনি ধ্বংস করেন অতিসাম্প্রতিক পূর্বধারণা, তিনি ধ্বংস করেন কর্তৃত্ব, একযৌক্তিক বিজ্ঞানের কর্তৃত্ব’ [দ্র মোই (১৯১, ৫, ১৫০)]।
তাঁর বইয়ের মধ্যে রয়েছে কাব্যভাষার বিপ্লব (১৯৭৪), ভাষায় কামনাবাসিনা (১৯৮০), বিভীষিকার ক্ষমতা (১৯৮০) প্রভৃতি। ক্রিস্তেভার প্রধান প্রবণতা ভাষার সমস্যা বিশ্লেষণ। তাঁর মতে আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের ভাবাদর্শগত ও দার্শনিক ভিত্তিটি কর্তৃত্বপরায়ণ ও পীড়নবাদী। ক্রিস্তেভা, রুশ ভাষাবিজ্ঞানী ভোলোসিনোভের মতো, ভেঙে দিতে চান ভাষাবিজ্ঞান, অলঙ্কারশাস্ত্র ও কাব্যতত্ত্বের মধ্যবর্তী দেয়াল, এবং তৈরি করতে চান একটি নতুন ক্ষেত্র, যার নাম পাঠগত তত্ত্ব।