[দ্বিতীয় খন্ড]
লিঙ্গবাদ ও নারীভাবমূর্তি বের করার পর, ১৯৭৫ থেকে, নারীবাদী সমালোচনার বিষয় হন নারী লেখকেরা; নারীবাদী সমালোচনা হয়ে ওঠে নারীকেন্দ্ৰিক। নারীবাদীরা আবিষ্কার করেন যে নারী লেখকদের ছিলো নিজেদের এ ধরনের সাহিত্য, যে-সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও বিষয়গত সামঞ্জস্য, আর শৈল্পিক গুরুত্ব স্বীকৃতি পায় নি। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাছে। তাঁরা বলেন নারীকল্পনাপ্রতিভার কথা।
১৯৭১-এ শোঅল্টার দাবি করেন নারী লেখকদের রয়েছে এক বিশেষ ইতিহাস, যা গুরুত্বের সাথে বিবেচনাযোগ্য। নারীরা আলোচনা করেন নারীরচিত সাহিত্য, এটা হয়ে ওঠে ইঙ্গমার্কিন নারীবাদী সমালোচনার প্রধান প্রবণতা। সত্তর দশকের শেষের দিকে বেরোয় এ-ধারার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই; যেমন এলেন মোয়ের্সের লিটেরেরি উইমেন : সাহিত্যিক নারী (১৯৭৬), ইলেইন শোঅল্টারের এ লিটেরেচার অফ দেয়ার অওন : তাঁদের নিজেদের সাহিত্য (১৯৭৭), শিরিল এল ব্ৰাউন ও কারেন ওলসন সম্পাদিত ফেমিনিষ্ট ক্রিটিসিজম : এসেইজ অন থিয়োরি, পোয়েট অ্যান্ড প্রোউজ : নারীবাদী সমালোচনা : তত্ত্ব, কবিতা ও গদ্য বিষয়ক প্রবন্ধ (১৯৭৮), এবং সান্দ্রা গিলবার্ট ও সুজান গুবারের দি ম্যান্ড ওম্যান ইন দি অ্যাটিক : সিলেকোঠার পাগলী (১৯৭৯)।
এ-বইগুলোতে শনাক্ত করা হয় সাহিত্যে নারী-ঐতিহ্যের পৃথক ধারা; দেখানো হয় নারীর লিঙ্গ নয়, সমাজই স্থির করে দেয় নারীর বিশ্বদৃষ্টি ও সাহিত্যে তার উপস্থাপন। এলেন মোয়ের্স সাহিত্যিক নারীতে সবার আগে উদ্যোগ নেন নারীসাহিত্যের ইতিহাস লেখার। তার মতে পুরুষ-ঐতিহ্যের তলে বা পাশাপাশি নারীসাহিত্য এক গতিশীল ও শক্তিমান অন্তঃস্রোত। বইটিতে কোনো তত্ত্ব প্রস্তাব না ক’রেই তিনি দেখান যে পুরুষের পাশাপাশি দেখা দিয়েছিলেন মহৎ নারী লেখকেরাও, কিন্তু তারা মূল্য পান নি।
ইলেইন শোঅল্টার তাঁদের নিজেদের সাহিত্য-এ বর্ণনা করেন ব্রোন্টিদের থেকে বর্তমান পর্যন্ত লেখা ইংরেজি উপন্যাসের ইতিহাস; দেখান এ-ধারার বিকাশের রীতি সাহিত্যিক উপসংস্কৃতি বিকাশের রীতির মতো। তিনি নির্দেশ করেন এ-ধারা বিকাশের তিনটি পর্ব। প্রথম পর্বটি হয় বেশ দীর্ঘ; এ-পর্বে অনুকরণ করা হয় আধিপত্যশীল ঐতিহ্যকে, এবং অন্তরীকরণ করা হয় শিল্পকলার মান ও সামাজিক ভূমিকা; দ্বিতীয় পর্বে দেখা দেয় এসব ধারণা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, দাবি করা হয় স্বায়ত্তশাসন; সব শেষে দেখা দেয় আত্ম-আবিষ্কার-এর পর্ব। এ-পর্ব তিনটির নাম তিনি দেন ফেমিনিন, ফেমিনিস্ট এবং ফিমেলা।
তার মতে ইংরেজি সাহিত্যে ফেমিনিন পর্ব শুরু হয় ১৮৪০-এর দশকে, যখন নারী লেখকেরা দেখা দেন পুরুষছদ্মনামে। এ-পর্ব সমাপ্ত হয় ১৮৮০ সালে জর্জ এলিঅটের মৃত্যুতে। ফেমিনিস্ট পর্বের কাল ১৮৮০ থেকে ১৯২০; এবং ফিমেল পর্ব ১৯২০-এ শুরু হয়ে এখনো চলছে। সাহিত্যের ইতিহাস ও নারীবাদী সমালোচনায় শোঅল্টারের বড়ো কৃতিত্ব বিস্মৃত ও উপেক্ষিত নারী লেখকদের পুনরাবিষ্কার।
সান্ড্রা এম গিলবার্ট ও সুজান গুবারের চিলেকোঠার পাগলী বিশাল বই। এতে আলোচিত হন। জেইন অস্টিন, মেরি শেলি, ব্রোন্টি বোনেরা, জর্জ এলিঅট, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং, ক্রিস্টিনা রসেটি, এবং এমিলি ডিকিনসন। তারা তুলে ধরেন উনিশশতকের ‘সুস্পষ্টভাবে পৃথক নারীসাহিত্যধারা’র প্রকৃতি, এবং প্রস্তাব করেন নারীর সাহিত্য-সৃষ্টিশীলতা সম্পর্কে এক অভিনব তত্ত্ব। তারা দেখান উনিশশতকে পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শ এমন বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতা একান্ত পুরুষের গুণ। লেখক রচনার ‘জনক’, বিধাতার আদলে তিনি স্রষ্টা বা প্রণেতা বা গ্রন্থকার। সৃষ্টিশীলতার এ-শিশ্নতান্ত্রিক উপকথার মধ্যে নারী লেখকদের দাঁড়াতে হয় কঠিন অবস্থায় মুখোমুখি।
সৃষ্টিশীলতাকে পিতৃতন্ত্র যেহেতু গণ্য করে পুরুষালি কাজ ব’লে, তাই নারীভাবমূর্তিও তৈরি হয়েছে। পুরুষের কল্পনায়; নারী অধিকার পায় নি নারী বা নারীত্ব সম্পর্কে ভাবমূর্তি সৃষ্টির, তাদের বাধ্য করা হয়েছে পুরুষের কল্পিত ভাবাদর্শের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে। গিলবার্ট ও গুবার বিশ্লেষণ করেন পিতৃতন্ত্রে নারীশিল্পীর অবস্থান। তাঁরা দেখা পিতৃতন্ত্রের তৈরি নারীধারণা নারী ও নারীশিল্পীর মধ্যে বাঁধা সৃষ্টি করে, নারী ও নারী শিল্পীর মধ্যে তৈরি করে জটিলতা; এর ফলে ন্যায়ী লেখক হ’তে গিয়ে ভোগে তীব্র উদ্বেগে, কেননা তার অধিকার নেই লেখক হওয়ার।
পিতৃতন্ত্রে লেখক অবধারিতভাবে পুরুষ, আর নারী পুরুষের দাসী; তাই নারী কীভাবে ধরবে কলম, হবে লেখক? নারী লেখকেরা এ-সংকট থেকে মুক্তির জন্যে নেন এক কৌশল : তামা তাদের সাহি৩্যের বাহ্যসংগঠন ও আন্তর তাৎপর্যের মধ্যে রাখেন দূরত্ব। বাইরে তারা মেনে নেন পিতৃতন্ত্রের বিধান, কিন্তু ভেতরে গোপন ক’রে রাখেন ধ্বংসাত্মক তাৎপৰ্য, কাজ করেন পিতৃতান্ত্রিক বিধানের বিরুদ্ধে।
এমিলি ডিকিনসন বলেছিলেন, ‘সত্য বলো, তবে তির্যকভাবে বলো’; তারা নেন ওই তির্যক ভঙ্গি। তাদের মতে নারীর কণ্ঠস্কর ছলনাময়, তবে সত্য। তারা যে-চিলেকোঠার পাগলীর কথা বলেছেন, সে কে? ওই পাগলীটি আর কেউ নয়, সে নারী লেখকের ‘ডবল’, নারী লেখকের উদ্বেগ ও ক্রোধের উন্মাদিনী রূপ। পিতৃতন্ত্রের চাপে উনিশশতকের নারী লেখকদের প্রায় প্রত্যেকে সৃষ্টি করেন একেকটি পাগলী, যে তাঁরই আরেক সত্তা। এ-পাগলী সৃষ্টি ছিলো তাদের এক সাহিত্যিক কৌশল, যা উনিশশতকের নারীদের লেখা উপন্যাসকে দিয়েছে বিপ্লবাত্মক প্রকৃতি।
নারীবাদীরা নারীসাহিত্যের ওপর যে-গুরুত্ব আরোপ করেন, তাতে দেশে দেশে পুনরাবিষ্কৃত হয় বিপুল পরিমাণে নারীসাহিত্য। সেগুলোকে নতুনভাবে পড়েন তাঁরা। তাঁরা পুনরাবিষ্কার করেন বহু বিস্মৃত নারী লেখককে, প্রকাশ করেন তাদের চিঠিপত্র ও দিনপঞ্জি, এবং দেখান যে নারীসাহিত্যের রয়েছে এক বিশেষ স্বভাব। নারীবাদী সমালোচনার প্রথম সুফল পান আঠারোউনিশ শতকের নারী লেখকেরা, যাদের বই শিকার হয়েছিলো উপেক্ষা আর বিস্মৃতির।
নারীবাদী প্রকাশনা থেকে ১৯৭২-এ পুনঃপ্রকাশিত হয় রেবেকা হার্ডিং ড্যাভিসের উপন্যাস লাইফ ইন দি আয়রন মিলস (১৮৬১), ১৯৭৩-এ পুনঃপ্রকাশিত হয় শার্লেট পার্কিন্স গিলমানের ছোটগল্প ‘দি ইয়েলো ওয়ালপেপার’ (১৮৯২), বেরোয় বিস্মৃত নারী লেখকদের নানা রচনাসংগ্ৰহ। এসব লেখায় পাওয়া যায় নীরব বিদ্রোহ, এমনকি আমূল্যবাদী মনোভাব; এবং নারীবাদীরা খুঁজতে শুরু করেন কেনো এসব লেখা বাদ পড়েছিল ‘প্রধান রচনা’র পংক্তি থেকে?
১৯৭৮-এ বিরোয় নিনা বায়ামের ওমানস ফিকশান : এ গাইড টু নোভেলস বাই অ্যান্ড অ্যাবাউট উইমেন ইন আমেরিকা, ১৮২০-১৮৭০। এতে দেখানো হয় যে উনিশ শতকের অধিকাংশ জনপ্ৰিয় ঔপন্যাসিকই ছিলেন নারী, তারা ‘বেস্ট-সেলার’ লিখেছিলেন, কিন্তু বাদ পড়ে গেছেন সাহিত্যের প্রধান পংক্তি থেকে। বেস্ট-সেলার উৎকৃষ্ট সাহিত্য হয় না ঠিকই, কিন্তু নারীবাদীরা মনে করে- ওই নারী লেখকদের কেউ কেউ স্বীকৃতি পেতে পারতেন।
১৯৭০ থেকে নারীবাদীরা বিকাশ ঘটাতে থাকেন নারীর নন্দনতত্ত্ব বলে একটি ধারণার, তারা বলতে থাকেন নারীর বিশেষ সাহিত্যচৈতন্য-এর কথা। অ্যাড্রিয়েন রিচ, মার্জেপিয়ের্সি, জুডি শিকাগো, সুজ্যান গ্রিফিন, অ্যালিস ওয়াকার প্রমুখের রচনায় দেখা দেয় নারীর নন্দনতত্ত্বের ধারণা; তাঁরা দাবি করেন নারীসংস্কৃতি ব’লে এক বিশেষ সংস্কৃতি। তবে নারীর নন্দনতত্ত্বের ধারণা নিয়ে বিতর্ক বেধেছে; অনেকে একে নারীসমকামবাদী চৈতন্য, ও নারীসমকামবাদী স্বাতন্ত্র্যবাদের সাথে এক ক’রে দেখেন। অ্যাড্রিয়েন রিচ লিখেছেন [দ্র শোঅল্টার (সম্পাদক ১৯৮৫, ৭)] :
প্রত্যেক নারীর মধ্যে রয়েছে একটি নারীসমকামী, সে অভিভূত হয় নারীশক্তি দিয়ে, সে আকর্ষণ বোধ করে শক্তিশালী নারীর প্রতি, সে খোঁজে এমন সাহিত্য যাতে প্ৰকাশ পায় ওই শক্তি ও জোর। আমাদের আন্তর নারীসমকামীটিই আমাদের চালায় কল্পনাদীপ্ত অনুভবের দিকে, আর ভাষায় প্রকাশ করে নারীর সাথে নারীর পূর্ণ সম্পর্ক। আমাদের আন্তর নারীসমকামীটিই শুধু সৃষ্টিশীল, কেননা পিতাদের দায়িত্বশীল কন্যারা ভাড়াটে লেখকমাত্র।
অনেকে অবশ্য মেনে নিতে রাজি হন নি যে নারীসত্তা শুধু একটি বিশেষ সাহিত্যশৈলীর মধ্যেই প্রকাশ পায়, বা নারীর সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পায় নারীসমকামে। ১৯৮০ থেকে নারীসমকামবাদী নন্দনতত্ত্ব ভিন্ন হয়ে যায় নারীনন্দনতত্ত্ব থেকে।
নারীবাদী সমালোচকেরা নিজেরা পুনর্বিচার ক’রে দেখতে চান সাহিত্যের সব কিছু, তাঁরা রাজি নন পুরুষের মূল্যায়ণ বিনীতভাবে মেনে নিতে। তাঁদের বিরুদ্ধে পুরুষের অভিযোগ হচ্ছে তাঁরা ছুড়ে ফেলে দিতে চান হাজার বছরের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। নারীবাদী সমালোচকদের একটি চাবিশব্দ ‘পুনঃ’ বা ‘আবার’। ‘ইতিহাস পুনর্লিখনের’ কথা বলেছেন ভার্জিনিয়া উলফ, অ্যাড্রিয়েন রিচ বলেছেন নারীর লেখা শুরু হতে হবে।
অতীতকে পুনরাবলোকন বা সংশোধন করে, নারীত্ব পুনরাবিষ্কারের কথা বলেছেন ক্যারোলিন হিলবার্ন, জোন কেলি বলেছেন, ‘নারীদের পুনরুদ্ধার করতে হবে ইতিহাসে, এবং ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করতে হবে নারীর কাছে’ [দ্ৰ গিলবার্ট (১৯৮০, ৩২)]। পুরুষ এতোদিন যেভাবে সাহিত্য পড়েছে, সেভাবে নয়, পড়তে হবে নারীর, নারীবাদীর চোখে; তখন ওই সাহিত্য ভ’রে ছড়ানো দেখা যাবে লিঙ্গের পীড়ন। ওই পীড়নে বিকৃতরূপে গ’ড়ে উঠেছে নারী। সাইেড্রা গিলবার্ট ‘নারীবাদী সমালোচকেরা কী চান? অগ্নিগিরি থেকে পোস্টকার্ড’ (১৯৮০) প্রবন্ধে বলেন, পাশ্চাত্য সংস্কৃতি পুরুষ লেখকদের ভাণ্ডার, পূৰ্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পুরুষ লেখকদের সম্পত্তি। ওই সম্পত্তিতে নারীর অধিকার প্রায় নেই।
তাঁর মতে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির স্রষ্টা গম্ভীর পণ্ডিত, সংরক্ত কবি, আর চিন্তাক্লিষ্ট দার্শনিকেরা সবাই পুরুষ, মহাজগত তাদেরই উত্তরাধিকারপ্রাপ্ত সম্পত্তি। তার মতে পুরুষের সব শক্তি ছিলো, ছিলো বাকশক্তিও, কিন্তু নারীদের পালন করতে হয়েছে নীরবতা; পুরুষ তাদের দিয়েছে যে-ভাষা, তা হচ্ছে নীরবতা। যে-নারীরা নীরবতাব্রত পালনে রাজি হন নি, তাদের কী হয়েছে? তারা হারিয়ে গেছেন অন্ধকারে, বা তাদের ভুল বোঝা আর অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। নারীদের রচনা হয়তো মহৎ সাহিত্য হয় নি, তা হয়তো খুবই বশমানা; তবে ওই লেখার ভেতরে রয়ে গেছে বিপজ্জনক বস্তু, যা অনেক সময় অগ্নিগিরির মতো, এবং গভীরভাবে রিভিশনারি-সংশোধনপন্থী।
অ্যানেট কোলোডনিও (১৯৮০) বলেন একই কথা: বলেন যে নারী সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে দেখে তার কোনো ঐতিহ্য নেই। সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্য বলে যা গৃহীত, নারী লেখকেরা একাত্ম বোধ করতে পারেন নি। তার সাথে, ওই ঐতিহ্যকে মনে করতে পারেন নি নিজেদের ব’লে। পুরুষ যেমন লিখতে বসেই মনে করে একটা মহৎ বস্তু সে উপহার দিচ্ছে মানবজাতিকে, নারী লেখকেরা তা মনে করতে পারেন নি; মহৎ কিছু বা শিল্পকলা সৃষ্টি করছেন, এমন ভাবাও সম্ভব হয় নি তাদের পক্ষে; তারা, অধিকাংশ সময়, নিজেদের বিচ্ছিন্ন ক’রে রেখেছেন ‘লেখকদের’ থেকে।
তারা বারবার জানিয়েছেন পণ্ডিতদের জন্যে তারা গল্প লিখছেন না, লিখছেন সাধারণদের জন্যে, যারা সাহিত্য’ থেকে দূরবর্তী। নিনা বায়াম বলেছেন, সবাই আশা করতো যে নারী লেখকেরা লিখবেন নারীদের জন্যে, তারা সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। তাঁরাও কখনো নিজেদের মিল্টন বা স্পেন্সারের উত্তরসূরী বলে মনে করেন নি [দ্র কোলোড়নি (১৯৮০, ৪৯)]। ১৮৯৯–এ কেইট শপিনের দি অ্যাওকেনিং উপন্যাসটি প্রকাশের পর পাঠকেরা বেশ বিব্রত বোধ করে; উপন্যাসটিতে তিনি বিবাহবহির্ভূত যৌনতার যে-বিবরণ দেন, তা কোনো নারী ঔপন্যাসিকের কাছে পাঠক প্রত্যাশা করে নি। নারীর কাছে চাওয়া হয় ‘ভদ্র উপন্যাস’।
বায়াম (১৯৮১) দেখান মার্কিন সাহিত্য পাঠ ও সমালোচনায় সক্রিয় যে-তত্ত্ব, তা নারী লেখকদের মহৎ সাহিত্যের পংক্তি, ক্যান্যান, থেকে বাদ দেয়। তিনি দেখান ১৭৭৪-১৭৯৯ কালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আটতিরিশটি উপন্যাস বেরোয়। এগুলোর নটির লেখকের নাম আজো অজানা, হয়তো সেগুলো লিখেছিলেন নারীরাই; বাকি উন্নতিরিশটি লেখেন আঠারোজন লেখক, যাদের চারজন নারী। তাদের একজন, সুজানা রোওসন, একাই লেখেন ছটি উপন্যাস। তাঁর উপন্যাস শার্লোিট প্রথম প্রকাশের দশকে তিনবার, ১৮০০-১৮১০ সালের মধ্যে উনিশবার, উনিশশতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে আশিবার ছাপা হয়।
হ্যানা মুরের দি ককেট উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে তিরিশিবার ছাপা হয়। নারী ঔপন্যাসিক হ্যারিয়েট বিশার স্টোর অ্যাংকেল টমস্ কেবিন মার্কিন সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত উপন্যাস। উনিশ শতকে আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পঠিত ঔপন্যাসিক ছিলেন ই ডি ই এন সাউথওয়ার্থ, একজন নারী। এসব সত্ত্বেও তারা মার্কিন সাহিত্যের ঐতিহাসিক ও সমালোচকদের কাছে মূল্য পান নি; তারা বাইরে থাকেন। সাহিত্যের মহৎ ধারার।
কেনো এমন হয়েছে? এর এক কারণ, বায়ামের মতে, পক্ষপাত; সমালোচকেরা পছন্দ করেন না। নারীদের লেখক হিশেবে দেখতে, তারা বিশ্বাস করেন না যে নারীরা লেখক হতে পারে; তাই চোখের সামনের নারী লেখকদেরও দেখতে পান না তারা। আরেকটি কারণ হয়তো নারী লেখকেরা মহৎ কিছু লিখে উঠতে পারেন নি। পারেন নি এটা অনেকখানি সত্য, তবে • পারার রয়েছে সামাজিক কারণ। এটা ভুলে গিয়ে পুরুষ সমালোচকেরা নারী লেখকদের উপেক্ষা করেন প্রধানত লৈঙ্গিক কারণে; তারা সাহিত্যকে মনে করেন মূলত পুরুষের কাজ ব’লে।
লিলিআন রবিনসনও (১৯৮৩) আক্রমণ করেছেন সাহিত্য মূল্যায়নের প্রতিষ্ঠিত ক্যান্যান বা মানদণ্ড ও রুচিকে। তার মতে প্রধান/অপ্রধান ব্যাপারগুলো ভদ্ৰলোকের চুক্তি। ওই ভদ্রলোকেরা সুবিধাভোগী শ্রেণী ও পুংলিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত। সাহিত্যের যে-ক্যান্যান স্বীকৃত, তা সম্পূর্ণরূপে ভদ্রলোকদের সৃষ্টি; তাই তাদের রুচির বাইরের কোনো কিছুই মহৎ বলে গণ্য হয় না। পশ্চিমের মহৎ বইগুলো সবই পুরুষের লেখা, সেখানে কোনো নারীর বই নেই; কখনো তাতে অস্টিন, ব্রোন্টি বোনেরা, জর্জ এলিঅট, বা এমিলি ডিকিনসনের স্থান হয়, কিন্তু তারাও থাকেন বেশ নিচে।
এ-অবস্থা কাটানোর জন্যে লিলিআন রবিনসন নারীবাদী সমালোচনার দুটি দায়িত্ব নির্দেশ করেন; নতুনভাবে পড়তে হবে সমগ্র ঐতিহ্যকে, পুনর্ব্যাখ্যা করতে হবে নারীচরিত্রগুলো, শনাক্ত করতে হবে লিঙ্গবাদী ভাবাদর্শ, এবং দাঁড়াতে হবে তার মুখোমুখি। আর প্রয়াস চালাতে হবে নারী লেখকদের ক্যান্যনভুক্ত করার। মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্, কেইট মিলেট, ইভা ফিজেস, এলিজাবেথ জেনওয়ে, জারমেইন গ্রিয়ার, ক্যারোলিন হিলবুন করেছেন তাই তারা প্রশ্ন তুলেছেন মহৎ বইগুলোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে।
মহৎ সাহিত্য পুনর্মূল্যায়ন করলে কি দেখা যাবে নারীর লেখা অনেক মহৎ সাহিত্য বাদ পড়ে গেছে সাহিত্যের মহৎ ঐতিহ্য থেকে? তাঁরা কি কোনো হ্যামলেট, যুদ্ধ ও শক্তি, বা গীতাঞ্জলি লিখেছেন, যা স্বীকৃতি পায় নি পুরুষের? নিনা বায়াম স্বীকার করেছেন অমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। ১৮২০-১৮৭০ সালের মধ্যে লেখা মার্কিন নারী ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস সম্পর্কে তিনি বলেছেন। ওগুলোতে নান্দনিক, মননগত, নৈতিক জটিলতা ও শিল্পিতার অভাব রয়েছে, যা আমরা প্রত্যাশা করি মহৎ সাহিত্যের কাছে। ওই সময়ের নারী ঔপন্যাসিকদের রচনা নানাভাবে আকর্ষণীয়, কিন্তু কোনো বিস্মৃত জেন অস্টিন বা জর্জ এলিঅট আবিষ্কার করা যায় না।
তাদের মধ্যে, বা এমন কোনো উপন্যাস খুঁজে পাওয়া যায় না, যা দি স্কারলেট লেটার-এর মানের। তবু তিনি মনে করেন সাহিত্য মূল্যায়নের যে-মানদণ্ড আমেরিকায় ব্যবহৃত হয়, তা পুরুষের কাজের প্রতি পক্ষপাতপূর্ণ। ওই মানদণ্ডে শেলাইয়ের থেকে তিমি শিকার অনেক বেশি মহৎ কাজ বলে গণ্য হয়, তাই নারী বাদ পড়ে। এক নতুন ধরনের উপন্যাস দেখা দিয়েছে সম্প্রতি, যেগুলোকে বলা হয় নারীবাদী উপন্যাস। ব্যবসায়িকভাবে এগুলো অত্যন্ত সফল। এ-ধরনের উপন্যাস নারীবাদী প্রকাশনাসংস্থা, এমনকি ব্যবসায়িক প্রকাশনাসংস্থা থেকেও বেরোচ্ছে।
তবে এগুলোর সবই কি নারীবাদী উপন্যাস? এগুলো কি উপকারে আসছে নারীবাদী আন্দােলনের, নাকি শুধুই প্রথাগত বিনোদন সামগ্ৰীর কাজ করছে এগুলো? ঔপন্যাসিক নারী হ’লেই নারীবাদী হন, তিনি যা লেখেন তাই কি হয় নারীবাদী উপন্যাস? কিছু উপন্যাস নারীকেন্দ্ৰিক, তবে নারীকেন্দ্ৰিক উপন্যাসমাত্রেই নারীবাদী উপন্যাস নয়। নারীকেন্দ্রিক উপন্যাস নতুন ব্যাপার নয়; অনেক আগে থেকেই নারীরা নারীদের জন্যে নারীকেন্দ্ৰিক উপন্যাস লিখে আসছেন, যেমন ঘটেছে রোম্যান্টিক উপন্যাসে। ওই সব উপন্যাসের চেতনা, সেগুলোতে চিত্রিত লিঙ্গ, জাতি, ও শ্রেণী-আনুগত্যের ব্যাপারগুলো নারীবাদবিরোধী। তাই নারীকেন্দ্ৰিক উপন্যাসমাত্ৰই নারীবাদী উপন্যাস নয়, তা চরিত্রগতভাবে ভিন্ন [দ্র কাওয়ার্ড (১৯৯০)]।
ইলেইন শোঅল্টার (১৯৭৯) দুটি রীতিতে ভাগ করেছেন নারীবাদী সমালোচনাকে। প্রথম রীতিতে নারীবাদী সমালোচক হচ্ছেন পাঠক হিশেবে নারী; তিনি পুরুষ লেখকদের সাহিত্য পড়ে তার লৈঙ্গিক ইঙ্গিতগুলো খুঁজে বের করেন। শোআল্টার এ-রীতির সমালোচনাকে বলেন নারীবাদী সমালোচনা। এ-রীতিতে বিচার করা হয় ভাবাদর্শগুলো, বের করা হয় নারীভাবমূর্তি ও নারীছক, খোজা হয় কোথায় প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে নারী লেখককে, আর রটনা করা হয়েছে নারী সম্পর্কে কুৎসা। দ্বিতীয় রীতির সমালোচনার বিষয় লেখক হিশেবে নারী; এতে বিচার করা হয় নারীসাহিত্য, নবীসাহিত্যের ইতিহাস, বিষয়, শ্রেণী, ও সংগঠন। এতে আলোচিত হয় নারীর সৃষ্টিশীলতার প্রকৃতি, ভাষাবিজ্ঞান, নারীর ভাষার সমস্যা, ও বিশেষ বিশেষ নারী লেখক।
শোঅল্টার এ-রীতির সমালোচনাকে বলেছেন গাইনেক্রিটিক বা গাইনোক্রিটিসিজম। তাঁর মতে নারীবাদী সমালোচনা রাজনীতিক ও বিতর্কমূলক, যা বহু কিছু নিয়েছে মার্ক্সীয় সমাজবিজ্ঞান ও নন্দনতত্ত্ব থেকে; আর তাঁর প্রস্তাবিত গাইনোক্রিটিক স্বয়ংসম্পূর্ণ ও নিরীক্ষাধর্মী। শোঅল্টারকথিত নারীবাদী সমালোচনা অনেকটা আদি টেস্টামেন্টের মতো, যার কাজ ‘অতীতের পাপ ও ভুলভ্রান্তি খোঁজা’, আর গাইনোক্রিটিক অনেকটা নতুন টেস্টামেন্টের মতো, যার কাজ ‘কল্পনাপ্রতিভার শোভা’ খোঁজা। প্রথম রীতিটি ন্যায়পরায়ণ, রাগী, ও ভৎসনাপূর্ণ; দ্বিতীয় রীতিটি নিরাসক্ত। দুটি রীতিই দরকারী; কেননা আদর্শের জেবিমাইঅ্যারাই শুধু ‘দাসত্বের মিশর থেকে’ নারীদের মুক্তি দিয়ে পৌঁছে দিতে পারেন মানবতাবাদের প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডে [দ্র শোঅল্টার (১৯৮১, ২৪৩)]
নারীবাদীরা কতোখানি আগ্রহী সাহিত্য ও সমালোচনাতত্ত্বে? তত্ত্ব জিনিশটি পুরুষের সম্পত্তি; সব তত্ত্বের তারাই স্রষ্টা, নারীর তাতে কোনো অংশ নেই, যদিও নারী ধারাবাহিকভাবে হয়েছে তত্ত্বের শিকার। এখন নারীবাদীরা মনে করেন সেখানে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়েও নারীবাদী সমালোচনার কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি ছিলো না; ১৯৭৫-এ শোঅল্টার বলেছিলেন কোনো তত্ত্বই নারীবাদী ভাবাদর্শ ও পদ্ধতি ধারণের জন্যে যথেষ্ট নয়।
কোলোড়নি বলেন, নারীবাদী সমালোচনা দেখা দিয়েছে ‘কোনো সামঞ্জস ধারা বা সমন্বিত লক্ষ্যের বদলে একরাশ পরস্পর বদলসম্ভব কৌশল হিশেবে।’ এর পরও সমন্বিত তত্ত্ব গড়ে ওঠে নি। কৃষ্ণনারীবাদীরা অভিযোগ করেন যে নারীবাদী সমালোচনা কৃষ্ণ ও তৃতীয় বিশ্বের নারী লেখকদের সম্পর্কে পালন করে প্রকাণ্ড নীরবতা’; তাঁরা চান কৃষ্ণনারীবাদী সমালোচনা, যা বিবেচনার মধ্যে নেবে জাতিক ও লৈঙ্গিক উভয় ব্যাপার; মার্ক্সীয় নারীবাদীরা গুরুত্ব দেন শ্রেণী ও লিঙ্গ দুয়েরই ওপর; নারীবাদী সাহিত্য-ঐতিহাসিকেরা পুনরুদ্ধার করতে চান এক লুপ্ত ঐতিহ্য; বিসংগঠনবাদীরা চান এমন সমালোচনা, যা একই সঙ্গে পাঠগত ও নারীবাদী।
প্রথম দিকে অনেক নারীবাদীই কোনো তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করতে চান নি নারীবাদী সমালোচনার; তাঁরা মনে করেছিলেন তত্ত্ব নারীবাদের মতো গতিশীল ব্যাপারকে সীমাবদ্ধ করে ফেলবে। তারা চেয়েছিলেন নারীবাদী সমালোচনাকে খোলা রাখতে। সত্তরের দশকে সাংগঠনিক, উত্তরসাংগঠনিক, বিসাংগঠনিক ইত্যাদি যে-সমস্ত বিতর্ক দেখা দেয়, নারীবাদীদের কাছে সেগুলোকে মনে হয়। উষর ও ছদ্মবিস্তুনিষ্ঠ। ওই সমস্ত ক্ষতিকর পুরুষতান্ত্রিক রচনার কবল থেকে তাঁরা মুক্ত থাকতে চান।
ভার্জিনিয়া উলফ থেকে শুরু করে মেরি ড্যালি, অ্যাড্রিয়েন রিচ, মাৰ্গারেট ডুরাস, ও আরো অনেকে উপহাস করেন ‘পুংপাণ্ডিত্যের নপুংসক আত্মপ্রেম কে, এবং মুক্ত থাকতে চান পিতৃতান্ত্রিক পদ্ধতিপুজো থেকে। তবে নারীবাদীরা আজ আর তত্ত্ববিমুখ নন। স্যান্দ্রো গিলবার্ট (১৯৮০, ৩৬) বলেন, ‘যে-সব ছদ্মপ্রশ্ন ও উত্তর, পাঠ ও যৌনতা, আঙ্গিক ও লিঙ্গ, মনোলৈঙ্গিক সত্তা ও সাংস্কৃতিক সত্তার সম্পর্ককে ছায়াবৃত ক’রে রেখেছে’ নারীবাদী সমালোচনা ‘সে-সবের পাঠোদ্ধার ও রহস্য উন্মোচন’ করতে চায়। সংশোধনপন্থী নারীবাদী সমালোচনা অনেকটা গ’ড়ে উঠেছে চলতি সমালোচনা কাঠামো ভিত্তি ক’রেই।
তবু নারীবাদীরা লেগে আছেন পুরুষের সমালোচনা রীতি সংশোধন ও তাকে মানবিক ক’রে তুলতে, এবং তাকে নিরন্তর আক্রমণ ক’রে চলছেন; পুরুষের সমালোচনাতত্ত্ব হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা, সাহিত্যের ইতিহাস বা সাহিত্য ব্যাখ্যার সে-তত্ত্ব, যার ভিত্তি পুরুষের অভিজ্ঞতা, তবে তা পেশ করা হয় সর্বজনীন বলে। শোঅল্টারের (১৯৮১) মতে নারীবাদীরা যতোদিন পুরুষকেন্দ্রিক সমালোচনাকাঠামো ভিত্তি হিশেবে ব্যবহার করবে, এমনকি তা সংশোধন ক’রে যোগ করবে কিছুটা নতুনত্ব, ততোদিন নারীরা নতুন কিছুই শিখবে না।
তাঁর মতে পুরুষের ধারণা দিয়ে চলবে না। নারীদের; লাকঁ, দেরিদায় নারীর চলবে না; কেননা এতে নারী মেনে চলে পুরুষ প্ৰভুদেরই। তিনি চান একটি একাত্ত নারীবাদী সমালোচনারীতি, যা হবে নারীকেন্দ্ৰিক, স্বাধীন, ও মননগতভাবে সুসামঞ্জস। তার মতে নারীবাদী সমালোচনাকে ‘বের করতে হবে নিজ বিষয়, নিজ পদ্ধতি, নিজ তত্ত্ব, এবং নিজ কণ্ঠস্বর। ’