[প্রথম খন্ড]
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ গত আড়াই দশকের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার এলাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নারীবাদীরা যেমন আক্রমণ করেছেন ও বদলে দিতে চেয়েছেন পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক ও রাজনীতিক কাঠামো, তেমনি আক্রমণ করেছেন ও বদলে দিতে চেয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক সমস্ত লিঙ্গবাদী চিন্তাধারা। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা, আবেগ, উপলব্ধি, ও প্রচারেব এক প্রধান এলাকা সাহিত্য।
গত কয়েক হাজার বছরের বিশ্বসাহিত্য পুরুষতান্ত্রিকতার বিশ্ব; পুরুষ সৃষ্টি করেছে। ওই সাহিত্য, তৈরি করেছে তার তত্ত্ব, করেছে মূল্যায়ন। সাহিত্য সৃষ্টি ও ব্যাখ্যার সমগ্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে; সেখান থেকে নারী শুধু বাদই পড়ে নি, তাতে তৈরি করা হয়েছে নারীর মিথ্যে ভাবমূর্তি, নিন্দিত হয়েছে নারী। পুরুষ আশা করে নি যে নারী সৃষ্টি করবে সাহিত্য, তবু নারী সাহিত্য সৃষ্টি করেছে, তবে তা মূল্য পায় নি পুরুষের কাছে, বা পুরুষ তার অপব্যাখ্যা করেছে।
বিশ্বসংস্কৃতির অজস্র পুরাণে পুরুষকেই দেখানো হয়েছে সৃষ্টিশীল বলে; সৃষ্টিশীলতার সব এলাকায়-ধর্ম, শিল্পকলা, বিজ্ঞান প্রভৃতিতে স্বীকৃতি পেয়েছে শুধু পুরুষের সৃষ্টিশীলতা। সব ধর্মেই বিধাতা পুরুষ, যে শূন্যতা থেকে সৃষ্টি করেছে বিশ্ব। শেলি, কোলরিজ, কিটুস, রাসকিন লেখককে দেখেছেন পুরোহিত, ধর্মপ্রবর্তক, যোদ্ধা, বিধানপ্রণেতা, বা সম্রাটরূপে; অর্থাৎ পুরুষের চোখে পুরুষই সৃষ্টিশীল। পুরুষের চোখে নারীও পুরুষেরই সৃষ্টি। ওই নারীর, পিগম্যালিঅনের আইভরি তরুণীর মতো, কোনো নাম বা সত্তা বা কণ্ঠস্বর নেই।
নারী বস্তু, নারী অপর। নারী শুধু বস্তু নয়, পুরুষের চোখে নারী শিল্পকর্ম; নারী মর্মর মূর্তি, বা পুতুল, বা কবিতা, নারী কখনো ভাস্কর বা কবি নয়। শেক্সপিয়রের ওথেলো (৪:২) দেসন্দিমোনার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে : ‘এই শুভ্র কাগজ, এই উৎকৃষ্টতম বইটি কি তৈরি হয়েছিলো এতে ‘বেশ্যা’ লেখার জন্যে?’ নারী লেখে না, লিখিত হয়, নারী কবিতাকল্পনালতা; নারী আঁকে না, অঙ্কিত হয়; নারী ভাস্কর হয় না, ভাস্কর্য হয়।
হেনরি জেমসের এক মহিলার ছবিতে শুদ্ধ এক তরুণীকে বর্ণনা করা হয়েছে ‘কাগজের একটি শূন্য পৃষ্ঠা’ রূপে; সে ‘এতো সুন্দর ও মসৃণ পৃষ্ঠা যে তাকে এক সময় ভ’রে তুলতে হবে মানসিক উন্নতিসাধক পাঠে।’ জেমসের চোখে অভিজ্ঞ নারী এমন কাগজ, ‘যার ওপর নানান হাত লিখেছে নানান পাঠ।’ কনরাডের বিজয়-এ অ্যালমা ‘এক অপরিচিত ভাষার লিপির মতো’, বা ‘নিরক্ষরের কাছে যে-কোনো লিপির মতো’ [দ্র গুবার (১৯৮১, ২৯৪)]।
সমালোচকেরাও সাহিত্যপাঠকে বর্ণনা করেন লৈঙ্গিক ভাষায়। দেরিদা কলমকে শিশ্নের সাথে, আর যোনিচ্ছদকে কাগজের সাথে অভিন্ন ক’রে দেখেছেন। কলম-শিশ্ন লিখে চলে কুমারী পৃষ্ঠার ওপর, এ-বোধের ঐতিহ্য বেশ দীর্ঘ। এ–বোধ অনুসারে লেখক পুরুষ, ও প্রধান; নারী তার অক্রিয় সৃষ্টি, গৌণ বস্তু, যার নেই কোনো স্বায়ত্তশাসিত সত্তা, যার কখনোবা স্ববিরোধী অর্থ রয়েছে কিন্তু কোনো অভিপ্ৰায় নেই। এ-ধারা সংস্কৃতিসৃষ্টির প্রক্রিয়া থেকে বাদ দেয় নারীকে, এবং গণ্য করে শিল্পকর্মরূপে।
উনিশ শতকে অনেক নারী লেখক হ’তে গিয়ে সমস্যায় পড়েন, কেননা কলম তাদের জন্যে নয়; কলম ধরা তাদের কাছে মনে হয় দানবিক কাজ, তাই তারা নেন নানা কৌশল। এ-কৌশলগুলো সান্ড্রা এম গিলবার্ট ও সুজান গুবার বর্ণনা করেছেন দি ম্যান্ড ওম্যান ইন দি অ্যাটিক : দি ওম্যান রাইটার অ্যাদি দি নাইনটিনৰ্থ-সেঞ্চুরি র্কিন টেবেরি ইমাজিনেশন (১৯৭৯) বা চিলেকোঠার পাগলীতে।
সুজান গুবার আইসক ডিনেসেনের ‘শূন্যপৃষ্ঠা’ নামের একটি গল্প ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন। পুরুষতান্ত্রিক ঐতিহ্য বিশ্বাস করে যে নারীর পক্ষে শিল্পী হওয়া অসম্ভব, তবে সে নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে শিল্পকর্মে। তিনি আরো দেখিয়েছেন অনেক নারী বোধ করে যে শরীরই তাদের শিল্পীসৃষ্টির একমাত্র মাধ্যম। এর ফলে নারী শিল্পী ও তার শিল্পকর্মের মধ্যে কোনো দূরত্ব থাকে না। নারীদেহ যে-সব রূপক সরবরাহ করে, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে রক্তের রূপক, তাই নারীর শিল্পীসৃষ্টি হয়ে ওঠে একধরনের যন্ত্রণাকর ক্ষত। প্রসবে ও লেখায় নারীর নিয়তি যন্ত্রণা।
নারীবাদীরা পুরুষের সৃষ্টিশীলতাতত্ত্ব মানেন নি, এবং পুরুষের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতিকে সংশোধন করার জন্যে গড়ে তোলেন নিজেদের সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনারীতি। এ-ক্ষেত্রে গত আড়াই দশকে সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক কাজ করেছেন। তারাই, যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমালোচকেরা আজো দ্বিধা করেন তা স্বীকার করতে। অনেকে শুধু দ্বিধা নয় ক্ষুব্ধ বোধ করেন। তাদের মতে নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার কাজ ‘মহৎ পুরুষ লেখকদের ধ্বংস করা’; এটা ‘সমালোচনার মুখোশ পারে নারীবাদী অপপ্রচার’।
নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার লক্ষ্য সব সময়ই রাজনীতিক; এর প্রচেষ্টা পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি বের করা। নারীবাদী সমালোচনার একটি ধারা দেখা দিয়েছিলো মেরি ওলস্টোনক্র্যাফটের ভিন্ডিকেশন অফ দি রাইটস অফ ওমান-এই (১৭৯২), যেখানে তিনি পুনর্বিচার ও তিরষ্কার করেন রুশো ও পুরুষতন্ত্রের নানা মহাপুরুষকে; তবে এর ধারাবাহিক বিকাশ ঘটে নি। তাই উনিশ শতকে নারীবাদী সমালোচনা, স্ট্যান্টনের নারীর বাইবেল (১৮৯৫) ছাড়া, বিশেষ চোখে পড়ে না।
এ-শতকেও ১৯৬৯-এর মধ্যে নারীবাদী সমালোচনার বই বেরোয় গুটিকয়; ভার্জিনিয়া উলফের এ রুম অফ ও অ্যাস স্রৌন : কারো নিজের ঘর (১৯২৭), সিমোন দ্য বোভোয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ (১৯৪৯), ক্যাথবিন এম রজার্সের দি টাইেবলসাম হেল্পমেট : বিরক্তিকর সহধর্মিণী (১৯৬৬), মেরি এলমানের থিংকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা (১৯৬৮), এবং কেইট মিলেটের সেক্সয়াল পলিটিক্স : লৈঙ্গিক রাজনীতি (১৯৬৯)। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ ঘটে নারীবাদী সংগ্রামের এক শক্তিশালী অঙ্গরূপে। নারীবাদী সংগ্রাম চায় পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস বা রূপান্তরিত করতে; সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা করতে চায় একই কাজ, ভিন্নভাবে ভিন্ন এলাকায়।
তাই তত্ত্ব ও সমালোচনায় নারীবাদীদের মিলন ঘটাতে হয়েছে রাজনীতি ও সমালোচনার। প্রথাগত পুরুষি সমালোচনার মানদণ্ডে চলতে পারে না। নারীবাদী সমালোচকের তাদের খুঁজতে হয়েছে ভিন্ন মানদণ্ড। নারীবাদী সমালোচনা ভালো লাগার কথা নয় প্রথাগত পুরুষ সমালোচক ও পুরুষি প্রতিষ্ঠানগুলোর। নারীবাদী সমালোচকদের সামনে খোলা ছিলো দুটি পথ : প্রচলিত মানদণ্ডের সাথে সন্ধি ক’রে পুরুষের স্বীকৃতি আদায় করা, অথবা প্রতিষ্ঠিত মানদণ্ডগুলোকে ঘৃণাভরে বর্জন ক’রে নিজেদের নতুন মানদণ্ড তৈরি করা। নারীবাদীরা বেছে নেন দ্বিতীয় পথ। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার দুটি ধারা রয়েছে : একটি ইঙ্গমার্কিন, অন্যটি ফরাশি। এর মাঝে ইঙ্গমার্কিন ধারাটিই অর্জন করেছে প্রাধান্য।
বিশশতকের ষাটের দশকের শেষ থেকে, আন্তর্জাতিক নারীবাদের এক প্রবল শাখারূপে, বিপ্লবাত্মক বিকাশ শুরু হয় নারীবাদী সমালোচনা ও সাহিত্যতত্ত্বের, এবং অনেকখানি বদলে দেয় সাহিত্য মূল্যায়নের প্রথাগত রীতি। বিশ্ব জুড়ে এতোকাল ধরে নেয়া হয়েছে যে পুরুষই লেখক, পাঠক, সমালোচক; নারীবাদীরা দেখান নারী সমালোচক ও পাঠক সাহিত্য উপলব্ধি করেন ভিন্নভাবে, ও সাহিত্যের কাছে তাদের প্রত্যাশা ভিন্ন।
তাঁরা আরো দেখান যে বিশ্ব জুড়েই নারীরা সৃষ্টি করেছেন গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য। পুরুষের সভ্যতা জুড়ে কয়েক হাজার বছর ধরে সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা থেকেছে পুরুষের অধিকারে, নারীবাদীর, ঢোকেন সেখানে, পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেন পূর্ববতী সমগ্ৰ সাহিত্য। নারীবাদী সমালোচনার প্রধান মানদণ্ড লিঙ্গ। নারীবাদীরা বিকাশ ঘটান সাহিত্য সৃষ্টি, পাঠ, ও সমালোচনার লৈঙ্গিক স্বাতন্ত্র্যের তত্ত্ব। তাদের তত্ত্ব ও সমালোচনারীতি কোনো একক উৎস থেকে জনে নি, তাদের নেই কোনো পুণ্য বা ঐশী গ্রন্থ বা মহামাতা।
যেমন রয়েছেন মার্ক্সীয়দের মার্ক্স, সাংগঠনিকদের সোস্যুর, মনোবিজ্ঞানবাদীদের ফ্রয়েড বা লাকঁ, বিসংগঠনবাদীদের দেরিদা, নারীদের নেই তেমন কেউ। নারীরা নিরীশ্বর। একাধিক উৎসকে কাজে লাগিয়েছেন তারা। তারা নারীসাহিত্য পড়েছেন, জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-ইতিহাস, মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্বে গবেষণারত নারীবাদীদের সাথে ভাববিনিময় করেছেন, প্রচলিত সাহিত্যতত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন করেছেন, কৌশল ধার করেছেন মার্ক্সবাদ, ভাষাবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, বিসংগঠনবাদ থেকে, এবং গড়ে তুলেছেন নিজেদের তত্ত্ব ও রীতি।
যদিও আজো কোনো সমন্বিত সাহিত্যতত্ত্ব তারা গড়ে তুলতে পারেন নি- অনেকে তা চানও না, তবু সমন্বিত সাহিত্যতত্ত্বের দিকে তারা এগিয়েছেন। অনেকখানি। নারীবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক বা সমালোচককে যে নারীই হতে হবে, তা নয়; তবে নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনার বিকাশ ঘটান নারীরাই; তারাই লড়াই করেন এর জন্যে, কখনো কখনো বিপদগ্ৰস্তও হন। তারা চেষ্টা করেন তত্ত্ব ও ব্যক্তিতার সমন্বয় ঘটাতে। তারা খোঁজেন নিজেদের একান্ত ভাষা, আঙ্গিক, কণ্ঠস্বর, সংগঠন, যা নিয়ে তারা ঢুকতে পারেন। পুরুষাধীন একটি এলাকায়।
নারীবাদী সাহিত্যতাত্ত্বিক ও সমালোচকেরা কখনো ক্রুদ্ধ আর তিরষ্কারমুখর, কখনো আবেগাত্র ও গীতিময়; আর তাদের তত্ত্ব ও সমালোচনায় মূর্ত তাদের নারীমুক্তির রাজনীতি। নারীবাদ নারীদের মহাজাগরণ, সাহিত্য সমালোচনায় ঘটে ওই মহাজাগরণেরই প্ৰকাশ। নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা এক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, যাতে রয়েছে প্রতিষ্ঠিত কাঠামো ভাঙার উত্তেজনা ও নতুন দৃষ্টি আবিষ্কারের সাধনা।
তাঁরা প্রকাশ করেছেন নানা নারীবাদী পত্রিকা, যাতে নিয়মিতভাবে বেরোয় নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব ও সমালোচনা বিষয়ক তীব্র মননশীল প্ৰবন্ধ। এগুলোর মধ্যে বয়েছে ক্যামেরা অ্যাবস্কিউয্যারা : লস অ্যাঞ্জেলেস, কোন্ডিশন্স : ব্রকলিন, কানেকশন্স : অকল্যান্ড, ক্রিটিক্যাল ইনকোয়ারি : শিকাগো, ডায়াক্রিটিক্স; ইথাকা, ফেমিনিষ্ট রিভিউ : লন্ডন, হেকেট : কুইন্সল্যান্ড, হের্যাসিজ : নিউ ইআর্ক, এম/এফ : লন্ডন, সেইজ : আটলান্টা, সিনিস্টার উইজডম : রকল্যান্ড প্রভৃতি।
নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনার উন্মেষের বছরগুলোতে জোর দেয়া হয়। পুরুষের লেখা সাহিত্যে লিঙ্গবাদ ও নারাবিদ্বেষের স্বরূপ উদঘাটনের ওপর। তারা দেখান পুরুষ তৈরি করেছে ছকবাঁধা নারীমূর্তি, সৃষ্টি করেছে দেবী ও দানবী; দেখান ধর্মগ্রন্থে, ধ্রুপদী ও জনপ্রিয় সাহিত্যে নারীকে পীড়ন ও অপব্যবহার করা হয়েছে নানাভাবে. আর নারীকে বাদ দেয়া হয়েছে সাহিত্যের ইতিহাস থেকে।
সমাজে যেমন চলে নারীপীড়ন, নারী যেমন হয় ধর্ষণের শিকার, তেমনি যুগেযুগে সাহিত্যে পীড়িতধর্ষিত হয়েছে নারী। তাঁরা পুরুষের ‘মহৎ’ সাহিত্য ঘেটে দেখান যে তাতে নারীবিদ্বেষ পুরুষের নিশ্বাসের মতো। প্রচুর মহৎ সাহিত্যের মহিমা তারা হরণ করেন। এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ কেইট মিলেট। মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি (১৯৬৯) আধুনিক নারীবাদের সবচেয়ে সাড়াজাগানো বই, পিএইচডি অভিসন্দৰ্ভ, যাতে মিলন ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও অপ্রাতিষ্ঠানিক সমালোচনার; আর কাজ করে ধ্বংসাত্মক বোমার মতো।
এটি শুধু সাহিত্য সমালোচনা নয; এর রয়েছে তিনটি ভাগ : ‘লৈঙ্গিক রাজনীতি’, ‘ঐতিহাসিক পটভূমি’, এবং ‘সাহিত্যিক প্রতিফলন’। প্রথম ভাগে মিলেট দেখান নারীপুরুষের লৈঙ্গিক রাজনীতির স্বরূপ, দ্বিতীয় ভাগে লেখেন উনিশবিশশতকের নারীমুক্তি আন্দােলনের নিয়তির ইতিহাস, তৃতীয় ভাগে উদঘাটন করেন ডি এইচ লরেন্স, হেনরি মিলার, নরমান মেইলার, ও জয় জোনের লেখায় লৈঙ্গিক রাজনীতির রূপ। টোরিল মোই (১৯৮৫, ২৪-৩১), যিনি অন্যায়ভাবেই কঠোর সমালোচনা করেছেন মিলেটের, তিনিও স্বীকার করেছেন, ‘এটি সৃষ্টি করে যে-অভিঘাত, তাতে এটি হয়ে ওঠে পরবতী ইঙ্গমার্কিন নারীবাদী সমালোচনামূলক সমস্ত গ্রন্থের জননী ও অগ্রদূত, এবং ১৯৭০ ও ১৯৮০র নারীবাদীরা কখনোই মিলেটের পথিকৃৎ প্রবন্ধটির কাছে ঋণ স্বীকার বা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে অস্বীকার করেন নি।’
মিলেট বেরিয়ে আসেন সে-সময়ের মার্কিন নবসমালোচনার রীতি থেকে; নবসমালোচনা রীতির বিরোধিতা ক’রে তিনি যুক্তি দেন যে ঠিক মতো সাহিত্য বুঝতে হ’লে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিবেশকে। মিলেটের সমালোচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য অসম্ভব অভাবিত প্ৰতিভাদীপ্ত সাহস। ১৯৬৯-এ যখন ‘মহৎ’ লেখকদের কাছে বিনীত থাকাই ছিলো সাহিত্য সমালোচনার আদব, তখন লরেন্স, মিলার, মেইলার, জাঁ জোনের সাথে প্ৰচণ্ড বেয়াদবি করেন মিলেট। তার আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এ-আধুনিকেরা।
মিলেট লেখককে বিধাতা হিশেবে মানেন নি; তিনি পাঠককে ক’রে তোলেন লেখকের প্রতিদ্বন্দ্বী, এবং প্রশ্ন করেন পংক্তিতে পংক্তিতে। মিলেট সমালোচক-পাঠক হিশেবে বিনীত বা ভদ্রমহিলাসুলভ নন; তিনি লেখকের মুখোমুখি দাঁড়ান উদ্ধত তরুণের মতো, প্রতি মুহূর্তে বিরোধিতা করেন লেখকের আধিপত্যের। তিনি মূর্তিভগ্নকারী: তাঁর সমালোচনা পড়ার পর ওই আধুনিক প্রধানদের ভাবমূর্তি আর আগের মতো থাকে না; তাঁরা তাদের কীর্তিসহ ধ’সে পড়েন। মিলেটের রীতির একটু নমুনা দিচ্ছি। মিলেট (১৯৬৯, ২৩৭-২৩৮) ডি এইচ লরেন্স সম্পর্কে আলোচনার শুরুতে লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক (১৯২৮) থেকে উদ্ধৃত করেন প্রচণ্ড লিঙ্গবাদী এ-অংশটুকু :
❝তোমাকে আমি দেখতে চাই।❞
সে [মেলার্স] তার শার্ট খুলে ফেললো এবং লেডি জেইনের [যোনির অপভাষা] দিকে তাকিয়ে স্থিরভাবে দাঁড়ালো। নিচু জানোলা দিয়ে সূর্যরশ্মি ঢুকে তার উরু, আর কুশ উদরকে, এবং জ্বলজ্বলে স্বর্ণ-লাল কেশেব ছোটো মেঘের ভেতর থেকে জেগে ওঠা কৃষ্ণাভ ও তপ্ত চেহারার দাঁড়ানো শিশ্নকে আলোকিত ক’রে তুললো।
❝কী অদ্ভুত।❞ সে ধীরে ধীরে বললো। ❝কী অদ্ভুতভাবে সে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে! কী বিশাল এবং কী কৃষ্ণাভ এবং সুনিশ্চিত! সে কি তার মতো?❞
পুরুষটি তার পাতলা শাদা শবীরের সম্মুখভাগের নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ছোট্ট বুকের মাঝখানে কেশের রঙ কৃষ্ণাভ, প্রায় কৃষ্ণ; কিন্তু উদরের মূলদেশে, যেখান থেকে শিশ্নটি মোটা ও ধনুকাকৃতি খিলানের মতো উঠে এসেছে, সেখানকার কেশ সোনা-লাল, ছোটো মেঘের মতো জ্বলজ্বলে।
❝কী গৰ্বিত❞। সে গুনগুন করলো, অস্বস্তি। ❝এবং কী প্ৰভুসুলভ। এখন বুঝতে পারছি কেনো পুরুষেরা এতো কর্তৃত্বপরায়ণ। কিন্তু সে (শিশ্ন) সত্যিই সুন্দর। আরেকটি মানুষের মতো! একটু ভীতিকর! তবে সত্যিই সুন্দর। এবং সে আমার দিকে আসছে। –❞ সে ভয়ে ও উত্তেজনায় অধর কামড়ে ধরলো। পুরুষটি নীরবে নিচে তার শক্ত শিশ্নের দিকে তাকালো। ওটার কোনো বদল ঘটে নি।
❝ভোদা, তুই যা চাস তা অইল ভোদা। ক তুই লেডি জেনরে চাস। জন টমাস [শিশ্নের অপভাষা] লেডি জেনরে চায়। –❞
❝আহা, তাকে ক্ষেপিয়ো না…❞ বিছানায় হাঁটু ভর ক’রে তার দিকে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে এগোতে কোনি বললে। সে দু-হাতে তার কৃশ কটি ধ’রে তাকে নিজের দিকে টানলো যাতে তার ঝুলন্ত আন্দোলিত স্তনদুটি স্পর্শ করলো উত্তেজিত, উত্থিত শিশ্নের শীর্ষ, এবং তাতে লাগলো তরল পদার্থের ফোঁটা। সে পুরুষটিকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরলো।
❝শোও!❞ সে বললো। ❝শোও। আমাকে হ’তে দাও।❞
সে এখন খুবই তাড়ার মধ্যে।
মিলেট বলেন লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক একটি আপাত-ধর্মীয় রচনা, যাতে এক আধুনিক নারীর আত্মার মুক্তি ঘটানো হয়েছে লেখকের নিজস্ব ধর্মমত শিশ্নের রহস্যে’র সাহায্যে। এখানে আবির্ভাব ঘটেছে শিশ্নদেবতার। অলিভার মেলার্স হচ্ছে চূড়ান্ত লবেন্সীয় পুরুষ, মনুষ্যদেব, সে মারাত্মক যৌনপীড়নে সক্ষম, তবে এ-উপন্যাসে কোনো যৌনপীড়ন নেই। এতে কনস্ট্যান্স চাটার্লিকে দেয়া হয়েছে ঈশ্বরদর্শনের অনুমতি। এ-বইটি অলিভার মেলার্সের শিশ্নের পূজানুষ্ঠান; এতে পুরুষের মহিমাকে উন্নীত করা হয়েছে এক অতীন্দ্ৰিয় ধর্মে। এটা লৈঙ্গিক রাজনীতির সবচেয়ে কর্তৃত্বপরায়ণ রূপ।
লৈঙ্গিক রাজনীতিকদের মধ্যে লরেন্স সবচেয়ে প্রতিভাবান ও একাগ্র; তিনি সবচেয়ে নিপুণও, কেননা তিনি লৈঙ্গিক বার্তা জ্ঞাপন করেন নারীর চেতনার মাধ্যমে। নারীটিই আমাদের জানায় যে সোনালি যৌনকেশের জ্যোতিশ্চিক্রের ভেতর থেকে জেগে ওঠা দাঁড়ানো শিশ্নটি সত্যিই ‘গর্বিত’, আর ‘প্রভুসুলভ’, এবং সর্বোপরি, সুন্দর। সেটি ‘কৃষ্ণাভ এবং সুনিশ্চিত, আর ভীতিকর’ ও ‘অদ্ভূত’, যা নারীকে যেমন ‘ভীত’ করে তেমনি করে ‘উত্তেজিত’।
শিশ্নের দাঁড়ানো নারীকে দীক্ষিত করে এ-ধর্মে যে পুরুষাধিপত্য শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোনি চমৎকার শিষ্যের মতো সাড়া দেয়, ‘এখন বুঝতে পারছি কেনো পুরুষেরা এতো কর্তৃত্বপরায়ণ।’ এ-বইয়ের সঙ্গমদৃশ্যগুলো লেখা হয়েছে ফ্রয়েডীয় বিধিমতে যে নারী ‘অক্রিয়, পুরুষ সক্রিয়।’ এতে শিশ্নই সব, কোনি হচ্ছে ‘ভোদা’, যে-বস্তুর ওপর ক্রিয়া করা হয়। এভাবে বিশ্লেষণ ক’রে মিলেট লরেন্সকে মহিমাহীন ক’রে তুলেছেন।
মিলেটের মতো তীব্ৰভাবে না হ’লে একই কাজ করেন মেরি এলমান থিনকিং অ্যাবাউট উইমেন : নারীদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তায় (১৯৬৮)। তার বইটি বেরোয় মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতির এক বছর আগে, কিন্তু এটা, একান্তভাবেই সাহিত্যকেন্দ্ৰিক বই ব’লে, ততোটা সাড়া জাগায় নি। এলমান পিতৃতন্ত্রকে সামাজিক ও রাজনীতিকভাবে আক্রমণ করেন নি, তিনি আক্রমণ করেন সাহিত্যে রূপায়িত পুরুষতান্ত্রিক লিঙ্গবাদকে।
মিলেটের লৈঙ্গিক রাজনীতি ও তার নারীদের সম্পর্কে ভাবনা চিন্তায় জন্মে নারীবাদী সমালোচনার একটি ধারা, যা নারীভাবমূর্তি সমালোচনা নামে পরিচিত। পুরুষদের লেখায় নারীর ছক খোঁজেন এলমান, দেখান যে পুরুষ সমালোচকেরা নারীর লেখা বই আলোচনার সময়ও ব্যবহার করেন লৈঙ্গিক ধারণা। তাঁর মতে পশ্চিমি সংস্কৃতির বড়ো বৈশিষ্ট্য ‘লৈঙ্গিক সাদৃশ্যমূলক চিন্তা’, অর্থাৎ যে-কোনো চিন্তায়ই নারী বা পুরুষ ধারণাটি জেগে ওঠে, আর প্রধান হয়ে ওঠে পুরুষ ধারণাটি।
পশ্চিম বা দু-গোলার্ধেরই সমস্ত চিন্তার মূলে আছে লিঙ্গভিন্নতার বোধ। সাহিত্য সমালোচনায়ও, তিনি দেখান, অত্যন্ত প্ৰবল লৈঙ্গিক চিন্তা; তিনি এর নাম দেন ‘ফ্যালিক ক্রিটিসিজম’ বা ‘শৈশ্লিক সমালোচনা’। তার মতে পুরুষ সমালোচকদের কাছে নারীর লেখা বইও নারী, সম্ভোগের সামগ্ৰী; ওই বই সমালোচনার নামে তারা মাপামাপি করেন বইয়ের বক্ষ ও নিতম্ব,। পুরুষ লেখক-সমালোচকদের লেখায় তিনি খুঁজে পান নারী ও নারীত্বের এগারোটি ছক; সেগুলো হচ্ছে নিরবয়বতা, অক্রিয়তা, অস্থিরতা, বন্দীত্ব, ধার্মিকতা, বস্তৃজ্ঞান, আধ্যাত্মিকতা, অযৌক্তিকতা, পরের ইচ্ছাপূরণে সম্মতি, দানবী ও মুখরা স্ত্রী।
নারীবাদী সমালোচনার এক উর্বর ধারা নারী ভাবমূর্তিমূলক সমালোচনা। এ-ধারার অজস্র নিবন্ধ ও বই বেরিয়েছে। ১৯৭২-এ সুজান কোপোলম্যান কোরানিলনের সম্পাদনায় বেরোয় নারীভাবমূর্তিমূলক সমালোচনা সংগ্ৰহ ইমেজেজ অফ উইমেন ইন ফিকশন : ফেমিনিস্ট পারস্পেক্টিভস : কথাসাহিত্যে নারীভাবমূর্তি: নারীবাদী প্রেক্ষিত। এ-বইতে উনিশবিশশতকের বেশ কয়েকজন নারী ও পুরুষ ঔপন্যাসিকের আঁকা নারীর ভাবমূর্তি তুলে ধরে প্রচণ্ড সমালোচনা করা হয় ওই সব অবাস্তব নারীচরিত্রের।
অবাস্তব নারী সৃষ্টির জন্যে শুধু পুরুষেরাই অভিযুক্ত হয় নি। এ-প্রবন্ধগুচ্ছে, বরং দেখানো হয় যে এ-কাজে পুরুষদের থেকে অনেক নিকৃষ্ট নারী লেখকেরা। অবাস্তব নারী সৃষ্টি করে নারী লেখকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নিজেদের লিঙ্গের সাথে। এ-ধরনের সমালোচনায় মিলিয়ে দেখা হয় লেখকের ও পাঠকের অভিজ্ঞতাকে; আর পাঠকের অভিজ্ঞতার সাথে যদি না মেলে লেখকের অভিজ্ঞতা, তাহলে অভিযোগ তোলা হয় লেখকের বিরুদ্ধে। নারীভাবমূর্তি সমালোচকেরা আত্মজীবনীকে ব্যবহার করেন সমালোচনার মানদণ্ডরূপে; তারা মনে করেন কোনো সমালোচনাই মুক্ত নয় নিজের মূল্যবোধ থেকে। প্রতিটি মানুষ, এবং লেখকও, কথা বলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনীতিক, ও ব্যক্তিগত ব্যাপারে গ’ড়ে ওঠা বিশেষ অবস্থান থেকে।
এ-পরিপ্রেক্ষিত সীমাবদ্ধ, একে সর্বজনীন ব’লে চালানো খুবই আধিপত্যমূলক কাজ। নারীভাবমূর্তি সমালোচনার কাজে সাহিত্যে রূপায়িত মিথ্যে নারীভাবমূর্তির স্বরূপ বের করা। ওই মিথ্যে ভাবমূর্তি যেমন পুরুষ লেখকেরা তৈরি করেছেন, তেমনি করেছেন নারী লেখকেরাও। এতে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার ওপর; মনে করা হয় বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা উপস্থাপনই সাহিত্যের লক্ষ্য। তাই এ-সমালোচনা আধুনিকতাবিরোধী, সব ধরনের আধুনিক রীতিকেই আক্রমণ করা এর স্বভাব। তাদের মানদণ্ডে সে-সাহিত্যের মূল্য কম, যা তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়; তাকেই তারা বাতিল করেন যা তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে না।